#সুখের_পাখি
৪৯
দুই তিন দিনেও ইহানের রাগ কমেনি। সে এখনও বাড়ি আসার নাম নিচ্ছে না। তনু যতই মিনতি করুক ইহানের এক কথা, ‘ওই বাড়িতে আমি আর যাচ্ছি না। চাইলে তুমি আমার কাছে চলে আসতে পারো।’
তনু কত বুঝিয়েছে, এটা সম্ভব না। তবুও ইহান মানছে না। শেষমেশ ফুপু আম্মার দোহাই দিয়েও কাজ হলো না।
–‘আপনার জন্য ফুপু আম্মা কষ্ট পাচ্ছে ইহান ভাই।’
–‘কষ্ট পেলেও মা কখনও ওই লোকের বিরদ্ধে যাবে না।’
তনু হতাশ হয়ে বলল,
–‘বাবাকে ওই লোক বলতে আপনার খারাপ লাগে না?’
–‘তোমার কি লোকটাকে খুব পছন্দ হয়েছে তনু? উনি কিন্তু মানুষ হিসেবে মোটেও সুবিধার নয়। তোমার তো বাবা নেই। তাই বাবার বয়সী কাউকে দেখলেই মায়ায় জড়িয়ে যাও।’
–‘বাবা নেই বলে হয়তো আমি বাবার গুরুত্ব বুঝি। আপনার আছে বলেই বুঝতে পারছেন না।’
–‘মা’কে একটু দেখো। বেশি কান্নাকাটি করতে না কোরো। আমি কাল কলেজের তোমার সাথে দেখা করব। ছুটির পর ঘুরতে যাব।’
–‘আপনি বাড়ি ফিরে আসুন না, প্লিজ।’
–‘রাখি তনু। আর একটা কথা, বাড়ি থেকে আসার পর বুঝতে পেরেছি তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারি না। কিছুই যেন ভালো লাগে না। তুমি আমার কাছে আসবে তনু? চলে আসো না প্লিজ।’
–‘আপনি আপনার কোন বন্ধুর বাড়িতে আছেন?’
ইহান উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করল,
–‘তুমি আসবে?’
–‘ওরা আমাকেও থাকতে দিবে?’
–‘কেন দিবে না! অবশ্যই দেবে। সৌরভের বাড়ি তো ফাঁকাই পড়ে আছে। ওর বাবা মা এখানে থাকে না। তুমি আসতে চাইলে কিছু জামাকাপড় নিয়ে এসো।’
–‘ফুপু আম্মাকে বলে আসব?’
ইহান হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। একটু পর ওর চিন্তিত গলা শোনা গেল।
–‘মা তো এখনও আমাদের কথা জানে না। ভেবেছিলাম আমিই মা’কে বলব। তুমি চলে এলে মা কষ্ট পাবে।’
–‘এখনও তো পাচ্ছে। আরেকটু নাহয় পাবে।’
–‘না। তোমার আসতে হবে না।’
–‘না। আমি আপনাকে না দেখে আর থাকতে পারছি না। হয় আপনি বাড়ি ফিরে আসুন। নয় আমাকে আপনার কাছে নিয়ে যান।’
–‘কেন জেদ করছ তনু! তুমি তো বোঝো। চাইলেই তো আমি তোমাকে আমার কাছে রাখতে পারব না। তাহলে যে মানুষ আমাদের সম্পর্কের অন্য নাম দিয়ে দিবে।’
তনু মনে মনে হাসল। ইহান ভাই সবদিকই ভাবে। শুধু রাগটাই কমাতে পারে না। ফুপার উপর রাগ করে যে এভাবেও সে ফুপুকেই কষ্ট দিচ্ছে।
তনু ইহানের খোঁজ নিয়ে নিয়েছে। আর দেরি করল না সে। ফুপুকে নিয়ে সোজা ইহান ভাইয়ের বন্ধুর বাড়িতে চলে গেল। ইহান ওদের দেখে তব্দা। তনুর উপর যে ও রেগে গেছে সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তনু ভুলেও ইহানের দিকে তাকাল না। সাবিনা ভেতরে এসেই ইহানকে মারতে লাগল। ওর চড় থাপ্পড়ে ইহান হাসছে।
–‘অনেক বড় হয়ে গেছিস তুই! হাত পা এত বড় হয়েছে তোর! তুই এখন বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে পারিস। মা’র কথা মনেও পড়ে না তোর।’
ইহান পিছিয়ে যাচ্ছে। সাবিনা থামছে না। ছেলে যতই বড় হোক রাগ উঠলে গায়ে হাত তুলতেও বাকি রাখেন না তিনি।
–‘মা কী করছ তুমি? আমার বন্ধু দেখছে।’
–‘দেখুক। ওকেও ছাড়ব না আমি। তুই যে ওর বাড়িতে উঠেছিস এই খবর ও আমাকে দিয়েছে?’
সৌরভ মাঝ থেকে বলে উঠল,
–‘খালাম্মা বিশ্বাস করেন, ওকে আমি জায়গা দিতে চাইনি। জোর করে উঠেছে। এখন যাওয়ার নামই নিচ্ছে না।’
ইহান চোখ পাকিয়ে সৌরভকে শাসাল। সব দোষ ওর উপর দিয়ে দিল ব্যাটা! অথচ প্রথম দিনই ও বলে দিয়েছে, ‘এটাকে নিজের বাড়ি মনে করলেই থাকতে পারবি। নইলে চলে যা। মেহমান পুষতে পারব না আমি। রান্নাবান্না, কাজটাজ সব নিজে করবি।’
এখন বলছে থাকতে দিতে চায়নি ও। আর তনু! কী চালাক মেয়েরে বাবা! কীভাবে ওকে ভুলিয়ে ঠিকানা জেনে নিয়ে মা’কে নিয়ে চলে এলো।
–‘এক্ষুনি আমার সাথে বাড়ি ফিরবি তুই। আমার ফোন তুলিসনি কেন তার বিচার বাড়ি নিয়ে গিয়ে করব।’
ইহান কিছু বলতে যাচ্ছিল। সাবিনা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল,
–‘একটা কথা বললে হাড়গোড় ভেঙ্গে ফেলব তোর। তোকে পেটে নিয়ে আমি কম কষ্ট করিনি। আহানের থেকে দশগুণ বেশি জ্বালিয়েছিস তুই আমাকে। তাই আমার সব কথা তোকে শুনতে হবে।’
–‘তোমার স্বামী আমাকে বাড়ি থেকে…
–‘আমার স্বামী কী হ্যাঁ! ও তোর বাবা না? অন্য কারো সন্তান তুই? আমার সহ্যের সীমা ভাঙিস না ইহান। বাবাকে বাবা ডাকতে লজ্জা করে?’
তনু দেখছিল ইহান ভাই কেমন ফুপুর কথার উপর আর কোন কথা বলতে পারে না। সাবিনা সৌরভকে উদেশ্য করে বলল,
–‘আর বাবা তুমিও শোনো, ওকে আর কোনোদিন তোমাদের বাড়িতে জায়গা দিবে না। তোমাদের বাকি বন্ধুদেরও এই কথা বলে দিবে।’
–‘জি খালাম্মা, আর জীবনেও ওকে জায়গা দিব না। দরকার পড়লে রাস্তায় থাকবে। অত রাগ থাকবে কেন হ্যাঁ? রাগ করে বাড়ি থেকে চলে আসে! কত বড় সাহস!’
সাবিনা ইহানকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার পর ওর বাবা আর কোনো কথাই বলেনি। ইহানও যেচে পড়ে বাবার সাথে লাগতে যায়নি। কিন্তু তনুর উপর ও এখনও চটে আছে।
–‘তোমার জন্য আমাকে আবার এই জেলখানায় ফিরে আসতে হয়েছে। তুমি কিন্তু কাজটা ঠিক করোনি তনু।’
তনু হেসে বলল,
–‘ফুপুর হাতের মার গুলো কেমন লেগেছে?’
–‘এই মেয়ে তুমি আমার সাথে ইয়ার্কি করছ! প্রেমে পড়ে ভয়ডর সব বেচে দিয়েছ?’
–‘হুম। বেচে ওই টাকায় কটকটি খেয়েছি।’
তনু একবার ভাবল ইহান ভাইকে জিজ্ঞেস করবে কেন ফুপার সাথে ওর এত রাগ। দেখবে ইহান ভাই কী বলে।
–‘ফুপার উপর আপনার এত রাগ কেন?’
ইহান চুপ হয়ে গেল। তনুকে এখনও বলা হয়নি।
–‘তোমাকে আমার কিছু বলার আছে তনু। শুনে তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পারবে না। এটা কথা দিলে তবেই বলব।’
ইহান ভাই কি ভয় পাচ্ছে? তনু ওকে ভুল বুঝবে এই ভয়! তনু তো সবই জানে। সে এই মুহূর্তে ওই সত্যের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না। তারও যে বড্ড ভয় করে। ইহান ভাইকে হারানোর ভয়।
তনুর এইচএসসি পরীক্ষার পর একদিন ইহান হুট করে ওর ঘরে চলে এলো। তনু তখন সবে গোসল করে বেরিয়েছে। ভেজা চুল মেলে দিয়ে আয়নার সামনে বসে ছিল সে। ইহান ঘরে ঢুকে কতক্ষণ তনুর চুলের দিকে এক ধ্যানে চেয়ে রইল। তনুর চুল এত লম্বা আগে কখনও লক্ষ করেনি সে। তনু টুলে বসে আছে। ওর চুল প্রায় মেঝে ছুয়ে দিচ্ছে।
তনুর চোখ ইহানের উপর পড়লে ও বলল,
–‘আপনি!’
ধ্যান ভাঙল ইহানের। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
–‘আজ বিকেলে তোমার কোন কাজ আছে?’
–‘না। কেন?’
–‘আমার সাথে বেরুবে তুমি।’
তনু মনে মনে খুশি হয়ে গেল। আজকের দিনের কথা তাহলে ইহান ভাইয়ের মনে আছে। তনু ভেবেছিল ইহান ভাই ভুলে গেছে। ওদের একসাথে হওয়ার এক বছর হলো আজ। এই দিনেই ইহান ওকে ভালোবাসি বলেছিল। দেখতে দেখতে কীভাবে একটা বছর কেটে গেল!
তনু শাড়ি পরেছে। কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে। পরীক্ষা শেষ। এখন বাড়ি থেকে বের হলে ফুপুকে মিথ্যা বলে বের হতে হবে। সে রেডি হয়ে ফুপু কাছে এসে কিছু বলার আগেই সাবিনা বলল,
–‘সন্ধ্যার আগে কিন্তু ফিরে আসতে হবে।’
তনু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ফুপু জানে সে ইহান ভাইয়ের সাথে বের হচ্ছে?
–‘আমার ছেলের তো আক্কেল জ্ঞান নেই। তোর মত মেয়ে মানুষ নিয়ে রাতে বাইরে ঘোরা ঠিক হবে না। ওকে তাড়া দিয়ে নিয়ে আসিস তুই।’
তনু ভয়ে ভয়ে বলল,
–‘তুমি জানো আমি কোথায় যাচ্ছি?’
–‘জানব না কেন? ইহান বলল পরীক্ষার পর তোর নাকি মন খারাপ। তোর সব বন্ধুরা ঘুরতে গেল, তুই-ই শুধু গেলি না। তা আমাকে বলিসনি কেন? আমি কি তোকে যেতে দিতাম না! তাও ভালো ইহান তোকে নিয়ে বের হতে রাজি হয়েছে।’
তনু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তার কিছুই বলতে হলো না। ইহান ভাই এত ভালো কেন?
ইহানের বন্ধুরা ওদের জন্য বিশাল সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছিল। তনু পুরোটা সময় এত খুশি ছিল! মনে হচ্ছিল আজকের মত খুশির দিন তার জীবনে আর একটাও আসেনি। অথচ তার এই খুশি বেশিক্ষণ টিকল না। ইহান তাকে কোন গিফট দিল না। বরং সে তনুর কাছ যা চাইল তা হলো, তনুকে স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। কথাটা শুনেই তনুর মন কেমন করতে লাগল। ইহান ভাইকে ছেড়ে কীভাবে কোথাও যাবে তনু? ইহান ভাই এমন কেন? ফেরার পথে তনু একদম চুপচাপ হাঁটছে। কোনো কথা বলছে না সে। পাশেই ইহান। সে-ও চুপ। এই নিস্তব্ধতা ক্রমশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। আকাশে মেঘ করেছে। জোর বাতাস বইছে। রাতে হয়তো বৃষ্টি আসবে।
তনুর পরনে মেরুন রঙের শাড়ি। বাতাসে শীত শীত লাগলেও হাঁটার গতি থামাচ্ছে না সে। শেষ পর্যন্ত ইহানই কথা বলল,
–‘তনু আমি চাই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও। নিজের পরিচয়ে বড় হয়ে উঠো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। যতদিন তুমি ফিরে না আসবে আমি কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাব না। তুমি ফিরে এলেই আমরা বিয়ে করে ফেলব।”
–‘আমি এতগুলো বছর আপনাকে না দেখে থাকব!”
–“এটা কি এখনও সেই চিঠির যোগ রয়ে গেছে পাগল! স্মার্ট ফোন কেন বের হয়েছে? তোমার যখন মন চাইবে ভিডিও কলে আমাকে দেখবে।”
–“আপনি কথাগুলো এত সহজে কীভাবে বলতে পারছেন? আমার জন্য মন খারাপ লাগবে না আপনার?”
বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দিল। তনু নড়ল না। ভিজে যেতে লাগল সে। অথচ ওদিকে তার কোন খেয়াল নেই। ইহানের চোখে চোখ রেখে কিছু খুঁজছে সে। ইহান তনুর হাত ধরে টেনে একটা ছাউনির নিচে নিয়ে এলো। তবুও অনেকটা ভিজে গেছে ওরা। তনু হঠাৎ কাঁদতে লাগল। ইহান অসহায়ের মতো তনুকে ফোঁপাতে দেখছে। বৃষ্টি বাড়ছেই। বৃষ্টির ছাঁট এসে ওদের ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ইহান নরম গলায় ডাকল,
–‘তনু!’
কোন সাড়া দিল না তনু। ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে সে।
–‘তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?’
–‘আপনি অনেক পাষাণ ইহান ভাই। সবসময় আমাকে কষ্ট দেন। আমি তো ওসব কিছু চাই না। আমি শুধু আপনাকে চাই। আমায় নিয়ে আপনার এত স্বপ্ন কেন? আমি কোথাও যাব না। আপনাকে বিয়ে করে সংসার করব। আপনি আমাকে জোর করবেন না। আমি মরে যাব।’
ওদের সামনে একটা গাড়ি এসে ঠাস করে চাকায় শব্দ তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল। টায়ার পাংচার হয়েছে নিশ্চয়। ড্রাইভিং সিট থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো। চাকা পরীক্ষা করে কিছু বলল। অনেক আগেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আবহাওয়ার জন্য এখন গভীর রাত মনে হচ্ছে। ইহানরা ভিজেই গিয়েছিল। তনুর হাত শক্ত করে ধরে গাড়িটার দিলে এগিয়ে আসছে ইহান। লোকটার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
–‘কী হয়েছে?’
লোকটা শিশুর মত মুখ করে ইহানের কাছে নালিশ করার মত করে বলল,
–‘চাকাটা গেছে। আসার পথে এদিকে কোন গ্যারেজ চোখে পড়েনি। এই ঝড়বৃষ্টির রাতে নষ্ট গাড়ি নিয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে কীভাবে বাড়ি পৌছাব বলুন তো? আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল! বাংলাদেশের ওয়েদার আমার একদম পছন্দ না। যখন তখন যা খুশি তা হয়ে যায়। ‘
তখনই গাড়ির দরজা খুলে পেছনের সিট থেকে ছাতা হাতে একজন বেরিয়ে এলো। একটা মিষ্টি নারী কন্ঠ বলে উঠল,
–‘চাকা নষ্ট হয়ে গেছে?’
ইহান চমকে সেদিকে তাকাল। গলাটা তার চেনা। এত বছরেও গলাটা সে ভুলেনি।#সুখের_পাখি
৫০
গাড়ির দরজা খুলে পেছনের সিট থেকে ছাতা হাতে একজন বেরিয়ে এলো। একটা মিষ্টি নারী কন্ঠ বলে উঠল,
–‘চাকা নষ্ট হয়ে গেছে?’
ইহান চমকে সেদিকে তাকাল। গলাটা তার চেনা। এত বছরেও গলাটা সে ভুলেনি। বুকের ভেতর কেমন মুচড় দিয়ে উঠল তার। মেয়েটা ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আবার লোকটাকে জিজ্ঞেস করল,
–‘সারানো যাবে না? বাবু কাঁদছে। বৃষ্টিও তো থামবে না মনে হচ্ছে।’
ইহান চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখার সাহস পাচ্ছে না। এটা সেই কন্ঠ যে কন্ঠে সে বারংবার ভালোবাসি কথাটা শুনেছি। ইহান এখনও তনুর হাত ধরে আছে। ওর পাশে তনুর অস্তিত্ব টের পেয়ে ইহান শক্ত হলো। শান্তি তার অতীত। শান্তিকে সে এখন আর ভালোবাসে না। শান্তিরও বিয়ে হয়ে গেছে। সম্ভবত এই লোকটাই শান্তির স্বামী। তনু শান্তির ব্যাপারে কিছুই জানে না। তাই ইহান এরকম কোন আচরণ করল না যাতে তনুর মনে সন্দেহ তৈরি হয়।
–‘আসার পথে তো কোন গ্যারেজ দেখলাম না।’
–‘তুমি পারবে না?’
–‘বৃষ্টির মধ্যে কীভাবে? ভিজে যাব তো। তুমি আবার বাইরে বেরুলে কেন? বাবু কাঁদবে।’
–‘কাঁদবে না। বাবু ঘুমোচ্ছে।’
তনু ইহানের হাতে নাড়া দিল। কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
–‘আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন? ভিজে যাচ্ছি তো।’
ইহান কিছু বলল না। তনু ওদের দেখল। একটু মায়া হলো তার। তারপর আবার বলল,
–‘আপনি চাকা পাল্টাতে পারেন? বেচারারা বিপদে পড়েছে। সাথে বাচ্চাও আছে।’
বাচ্চা আছে! শান্তি তাহলে মা-ও হয়ে গেছে! লোকটা এবার ইহানের দিকে ফিরল। ইহান বলল,
–‘গাড়িতে বাড়তি চাকা আছে?’
–‘হ্যাঁ।’
–‘বের করুন।’
–‘আপনি চাকা চেঞ্জ করবেন?’
লোকটা যেন অবাক হলো। কেউ যেচে পড়ে সাহায্য করতে এলে লোকে সহজ ভাবে নিতে পারে না। ইহান তনুর হাত ছেড়ে দিয়ে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,
–‘আপনিই তো বললেন আশেপাশে কোন গ্যারেজ নেই। আজ রাতে বৃষ্টি না-ও থামতে পারে। পুরো রাত রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাটানোর ইচ্ছে থাকলে আমরা চলে যাই।’
–‘না,না। প্লিজ আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। থ্যাঙ্ক মেনি মেনি থ্যাঙ্ক।’
শান্তি ইহানকে দেখেই গাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল। ইহানের সাথে একটা মেয়ে। ইহান মেয়েটার হাত ধরে আছে দেখে প্রথমটায় ওর একটু কষ্ট হচ্ছিল। ইহান ওকে দেখে না চেনার ভান করছে। কিন্তু ওর চেহারার ভাব পরিবর্তন হয়ে যেতে স্পষ্ট দেখেছে শান্তি। এতগুলো বছর পর ইহানকে দেখছে সে। ইহান একটুও পাল্লায়নি। শুধু এখন ওকে দেখলে কলেজে পড়ুয়া ছেলে মনে হয় না। মনে মনে হেসে ফেলল শান্তি। হবার কথাও না। কলেজের দিনগুলো চলে গেছে অনেক বছর হয়ে গেছে। শান্তি ইহানের সাথের মেয়েটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। মেয়েটা ভীষণ মিষ্টি। মুখটা দেখে মায়া লাগে। ইহানের সাথে ওকে সত্যিই মানিয়েছে। সব যখন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে তাহলে আর নতুন করে আলাপ করে কী লাভ? তবুর ইহানের সাথে কথা বলতে শান্তির ভীষণ ইচ্ছে করছিল। এতগুলো বছর পর দেখা। অথচ কেউ কাউকে চিনেছে এটাও বোঝাতে পারবে না। একবার জিজ্ঞেস করবে না ‘কেমন আছ?’
শান্তি সবার আড়ালে চোখের পানি মুছল। মনে মনে বলল,
–‘মেয়েটা তোমার কে হয় ইহান? বউ নাকি গার্লফ্রেন্ড? মেয়েটা কিন্তু অনেক সুন্দর। তোমার সাথে বেশ মানিয়েছে। তুমি কি ওকে ভালোবাসো?’
গাড়ি ঠিক হয়ে গেলে ইহান উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার দিকে তাকাল।
–‘এবাব চলবে।’
খুশিতে হোক বা ইহানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় হোক লোকটা হঠাৎ ইহানকে জড়িয়ে ধরল। ইহান বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।
–‘এই শহরের মানুষদের নিয়ে আমার মনে একটা ভুল ধারণা পোষণ করে রেখেছিলাম। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার সেই ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। আমরা আপনার কাছে সাহায্য না চাইতেও আপনি আমাদের বিপদে দেখে যেভাবে নিজে থেকে এগিয়ে এসে সাহায্য করলেন! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মিস্টার… ওহহো নামটাই তো জানা হলো না।’
ইহান ভদ্রলোকের অস্থিরতা দেখে দ্রুত বলল,
–‘ইহান।’
–‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ মিস্টার ইহান। আপনি না থাকলে বউ বাচ্চা নিয়ে আমি যে কী ঝামেলায় পড়তাম।’
তনু ইহানের এক হাত জড়িয়ে ধরে আছে। ইহানের প্রশংসা শুনে তার গর্ব হচ্ছে। যেন সে নিজেই ওদের সাহায্য করেছে। এই প্রশংসাটুকু ওর প্রাপ্য।
এতক্ষণে হয়তো লোকটার নিজের স্ত্রীর কথা মন পড়লো। তিনি স্ত্রীকে ডাকলেন।
–‘শান্তি। এদিকে এসো।’
শান্তি! এই নামটা তনু ফুলি আপার মুখে শুনেছিল। হ্যাঁ, ইহান ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড এর নাম শান্তি ছিল। তনু ঝট করে মেয়েটার দিকে তাকাল। এটা কি ইহান ভাইয়ের ওই শান্তি! চিন্তাটা জোর করেই তনু মাথা থেকে বের করে দিল। দুনিয়ায় এক নামের হাজার মানুষ আছে। এমনটা হওয়া জরুরি নয় এটাই ওই শান্তি।
শান্তি এতটা স্বাভাবিক ভাবে ইহানকে ধন্যবাদ দিল যে ইহান ভেতরে ভেতরে না চমকে পারল না। শান্তি কি তাকে চিনতে পারছে না! অসম্ভব, না চেনার প্রশ্নই আসে না। তাহলে শান্তি এমন ভাব করছে কেন যে ওকে আজই প্রথম দেখলো৷ এর আগে কোনোদিনও ওদের মাঝে কোন সম্পর্ক ছিল না। ওর সাথে তনুকে দেখেছে বলে? শান্তি খুব সহজ ভাবে ইহানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে এক পলকের জন্য ওর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
–‘ধন্যবাদ।’
–‘হু।’
ইহান মাথা নাড়ল। বুকটা চিনচিন করছে তার। এই শান্তি একসময় তার জন্য কীরকম পাগল ছিল! ওর পাগলামির কত ধরন দেখেছে ইহান। হাত কেটে বাবা মা’কে ভয় দেখিয়েছে ইহানকে না পেলে এইভাবে ওদের চোখের সামনে মরবে ও। ইহান যদি মজা করেও তাকে জ্বালানোর জন্য অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেছে তাহলেও শান্তি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। আজ এগুলো বছর পর চোখের সামনে দাঁড়ানো এই মেয়েটাকে দেখে ইহানের একটুও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না, এটাই সেই শান্তি। কোথায় সেই পাগলামি? সেই মেয়েটা কীভাবে এতটা পাল্টে যেতে পারল! ইহান তো অত গুলো বছরেও শান্তিকে ভুলতে পারেনি। তনু না এলে তার মনে এখনও শান্তিই থাকত। অথচ শান্তি কত সুন্দর সংসার করছে। বাচ্চাও আছে ওর! আচ্ছা তার কথা কি শান্তির মনে পড়ে না? অন্য একজনের বউ হতে শান্তির কষ্ট হয়নি? ইহান আর দাঁড়াতে পারল না। সেই অনেক দিনের খারাপ লাগা এবারও তাকে জাপটে ধরতে চাচ্ছে। ইহান অনুভব করল যতই সে এখন তনুকে ভালোবাসুক, শান্তির জন্য তার মনে কোমল একটা অনুভূতি এখনও কাজ করে। হয়তো শান্তির করে না।
বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়েও ইহান গুম হয়ে থাকল। এত বছর পর শান্তির মুখোমুখি হয়েছে। কেউ কারো মনের অবস্থা জানতে চাইল না। ইহানের খুব ইচ্ছে করছিল শান্তির সাথে কথা বলতে। ওকে জিজ্ঞেস করতে, কেমন আছে সে? দেখে তো মনে হয়েছে ভালোই আছে। কেমন একটা খারাপ লাগা ক্রমশ ইহানকে অস্থির করে তুলছিল। শেষবার দেখে আসা শান্তির মুখটা কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না। ওর চোখে কষ্ট ছিল? ইহান সিগারেট ধরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ইদানিং নিজের বেডরুমে থাকছে ও। ছাদের চিলেকোঠায় যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে তনুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দু’বার দরজায় শব্দ করতেই ভেতর থেকে তনু দরজা খুলে দিল। মাঝরাতে ইহানকে দেখে অবাকই হলো তনু। তনুকে দেখে ইহানের কী হলো কে জানে? এতক্ষণ যে অস্থিরতা কাজ করছিল তনুকে দেখে এখন সেটা ভয়ে রূপ নিয়েছে। তনুকে সে কখনও হারাতে পারবে না। কক্ষনো না। তনু কিছু বলার আগেই ইহান ওকে জড়িয়ে ধরল। তনু পাথরের মত জমে গেল। এই একটা বছরে ইহান তার হাতটাও ধরেনি। আজ কী এমন হলো যে ইহান তাকে… বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে তনু কোনরকমে উচ্চারণ করল,
–‘কী হয়েছে ইহান ভাই? আপনি কাঁপছেন কেন?’
ইহান ওকে পিষে ফেলতে চাইছে যেন। তনু কিছুই বুঝতে পারছে না।
–‘তুমি আমাকে কোনোদিনও ছেড়ে যেও না তনু।’
ইহানকে এরকম গলায় কথা বলতে এর আগে কখনও শুনেনি তনু। তার গলাটাও কেঁপে উঠল,
–‘আমি আপনাকে ছেড়ে কোথায় যাব!’
চলবে🌼
#জেরিন_আক্তার_নিপা