সুখের পাখি পর্ব -৫৩+৫৪

#সুখের_পাখি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
#পর্ব-৫৩

বাড়ি গিয়ে পুরোটা রাতই তনু কেঁদেছে। কাল ও চলে যাবে। তনুর এখনও এটা মানতে কষ্ট হচ্ছিল ইহান ভাই শান্তিকে ভুলতে পারেনি। এখনও ও শান্তিকেই ভালোবাসে। তনু তার জীবনে দ্বিতীয় ব্যক্তি। তনু কখনও কারো জীবনে অবহেলার পাত্র হয়ে থাকতে চায় না। শান্তিকে ইহান ভাই ভুলতে না পারলে তাকে কোনোদিন ভালোই বাসেনি।
পরের দিন বাড়ি থেকে যাবার সময় তনুর সবার থেকে বিদায় নিয়েছে। ফুপা তার মাথায় হাত রেখে বলল,

–‘যে কাজে যাচ্ছ সফল হয়ে ফিরো।’

ফুপু তো কেঁদে কেটে শেষ। ফুলি আপাকে ধরে তনুও কেঁদে ফেলল। ইহানকে এড়িয়ে গেছে সে। ইহান বুঝতে পারছিল না এক রাতে তনুর কী হয়েছে। কাল রাতেও তনু ওকে দেখা দেয়নি। তাহলে সেদিনের ওই কাজের জন্য তনু ওর উপর রাগ করেছে? তনুকে কিস করা ঠিক হয়নি তার। বাড়িতে কথা বলা যাবে না। এয়ারপোর্টে গিয়ে জানতে হবে।
গাড়িতে ওঠার সময় সাবিনা তনুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বলল,

–‘সাবধানে থাকিস মা। কখনও ভাবিস না তোর কেউ নেই। তুই আমার মেয়ে। আমি তোকে কতটা ভালোবাসি বুঝবি না তুই মা। পড়াশোনা শেষ করে আমার কাছে ফিরে আসবি তো? বল আসবি?’

–‘আসব ফুপু। আসব।’

গাড়িতে উঠেও তনু ইহানের সাথে কিছু বলল না। তনু পেছনের সিটে বসেছে। ইহান ড্রাইভ করে যাচ্ছে। কয়েকবার ঘাড় ফিরিয়ে তনুকে দেখেছে ও। কথা বলারও চেষ্টা করেছে। তনু কিছুই বলেনি।
এয়ারপোর্টে এসে ইহান তনুর হাত ধরে ফেলল। ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,

–‘কী হয়েছে তোমার? আমার সাথে কথা বলছ না কেন? তোমাকে জোর করে পাঠাচ্ছি বলে রাগ করেছ? এই তনু, তুমি আমার সাথে কথা না বলে এভাবে চলে গেলে এতগুলো দিন আমি কীভাবে থাকব?’

তনু শক্ত গলায় বলল,

–‘হাত ছাড়ুন।’

ইহান তনুর কথার ধরন দেখে হতভম্ব হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তনুকে বুঝতে পারছে না ও। কী হয়েছে তনুর। ওর মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে গেল।

–‘কি…

–‘আমাকে ছাড়ুন প্লিজ।’

–‘কেন? এই তনু, কী হয়েছে তোমার? আমার সাথে এরকম করছ কেন? কী দোষ করেছি আমি? বলো আমি কী করেছি।’

–‘হাত ছাড়ুন ইহান ভাই। লাগছে আমার।’

ফ্লাইটের এনাউন্সমেন্ট বেজে উঠল। একটু পরেই ফ্লাইট টেকঅফ করবে। তনু ইহানের কোন কথার জবাব না দিয়ে ইহানের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে হেঁটে ভেতরের দিকে চলে গেল। ইহান হতবিহ্বল হয়ে পেছন থেকে দাঁড়িয়ে তনুকে চলে যেতে দেখছে। তনু একবারও পেছন ফিরে ইহানকে দেখল না। এক সময় ইহানের দৃষ্টিতে আড়ালে চলে গেল ও। ইহানের চোখ থেকে টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি পড়ে গেল। তনু কেন তার সাথে এমন করল? কী অপরাধ ছিল তার? কোন অপরাধে তনু ওকে এভাবে শাস্তি দিল!
ইহানের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তার আশেপাশে এত মানুষ থাকা স্বত্বেও নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে একা মনে হচ্ছে। হঠাৎ আশেপাশের সবকিছুর অস্তিত্ব ভুলে গেল সে। চিৎকার করে উঠল ইহান।
হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ল। ওকে ঘিরে একটা জটলা তৈরি হয়েছে। ততক্ষণে তনু প্লেনে চড়ে দূর দেশে পারি জমিয়েছে।

পাঁচ বছর পর…

তনু একপা একপা করে পিছিয়ে যাচ্ছে। ইহান যতই তনুকে ধরার জন্য এগোচ্ছে তনু ততই তার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য পিছিয়ে যাচ্ছে। ওর পেছনে গভীর খাত। তনু খাতের একেবারে কিনারায় চলে গেছে। আর দু-তিন পা পেছনে হাঁটলেই পড়ে যাবে ও। ইহান ওর সামনে দু’হাত জড়ো করে কাকুতি মিনতি করছে।

–‘তনু পেছনে যেও না। পড়ে যাবে তুমি। তোমার পেছনে খাত। দাঁড়াও প্লিজ। দাঁড়াও তনু।’

তনু তার কোন কথা শুনছে না। কাঁদতে কাঁদতে পিছিয়ে যাচ্ছে ও। ইহান কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কাতর গলায় সে এক কথাই বলে যাচ্ছে।

–‘যেও না তনু। পড়ে যাবে তুমি। তনু যেও না। প্লিজ তনু। যেও না।’

আর এক পায়ের দূরত্ব। এক পা পিছুলেই তনু খাতের নিচে চলে যাবে। ইহানের কোন কথা শুনছে না ও। ইহান বলতে বলতেই ওর চোখের সামনে তনু নিচে পড়ে গেল। ইহান পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের সামনে সব ঘটে গেল।
চিৎকার দিয়ে উঠে বসেছে ইহান। কুলকুল করে ঘামছে সে। ঢোঁক গিলতে গিয়ে বুঝতে পারল গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জিভ দিয়েও ঠোঁট ভেজাতে পারল না। ওর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সেই একই স্বপ্ন। পাঁচ বছর ধরে এই স্বপ্নটাই দেখে আসছে সে। এই স্বপ্নের ভয়ে কতগুলো রাত যে জেগে কাটিয়েছে ইহান। চোখ বন্ধ করলেই তনুকে দেখতে পায়। পাঁচটা বছর কেটে গেল। বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে নিল।
দেয়ালে ঝুলানো বড় ঘড়িটার দিকে ইহানের চোখ গেল। সাতটা বাজতে এখনও দুই মিনিট বাকি আছে। দরজার দিকে তাকাল সে। বিছানা থেকে উঠলো না। ঠিক দুই মিনিট পর ঘড়ির কাটা যখন সাতটার ঘরে তখনই দরজার দিয়ে হুড়মুড় করে হারুন এসে ঢুকলো। ওকে দেখে হাসলো ইহান। সময় লেট হবে কিন্তু হারুন কোনোদিনও লেট হবে না। ঘড়ি ধরে কাটায় কাটায় সব কাজ করে ও। ইহানকে জেগে থাকতে দেখে হারুন মৃদু হাসল।

–‘গুড মর্নিং স্যার।’

–‘গুড মর্নিং হারুন। আজকে কী কী প্রোগ্রাম আছে বলে ফেলো।’

হারুন তার হাতে ধরা ট্যাব খুলে ওতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,

–‘সকাল দশটায় নিউজ অল টাইম শো’তে আপনার একটা ইন্টারভিউ আছে। তারপর সারাদিন আর কোনো প্রোগ্রাম নেই। কাল কক্সবাজারে কনসার্ট আছে। আজ রাতেই আমাদের ফ্লাইট ধরতে হবে। ওখানে পাঁচ তারকা হোটেলে আপনার থাকার জন্য সব ব্যবস্থা হয়ে আছে। রাতটা রেস্ট নিয়ে…

–‘থামো, থামো। হয়েছে। শুনেই আমার জ্বর এসে যাচ্ছে। কক্সবাজার থেকে ফিরে আমি লম্বা একটা ছুটি নেব। বুঝেছ?’

ইহানের কথা শুনে আঁতকে উঠল হারুন।

–‘অসম্ভব স্যার। নেক্সট ওয়ান মান্থ আমাদের হাতে কোন ডেট নেই। প্রতিদিন আপনার কোনো না কোন প্রোগ্রাম আছে। ছুটি নেওয়া এক কথায় অসম্ভব। সবাই অগ্রিম পেমেন্ট করে দিয়েছে। ওগুলো অ্যাটেন্ড না করলে আপনার ইমেজে…

–‘চুপ। কোনো কথা না। আমি তোমার বস, না তুমি আমার বস? বসের মুখে মুখে কথা বলো। সাহস তো কম না।’

হারুন ফ্যাকাসে মুখে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

–‘সরি স্যার।’

ইহান খুব কষ্টে হাসি চাপলো। এই ছেলে না থাকলে একটা দিন চলতে পারবে না সে। তার ক্যারিয়ার লাটে উঠত। হারুনকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখে ও। তার খাওয়া, পরা থেকে শুরু করে কোন কাজটা এই ছেলে করে না? ইহান ওকে ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করে। ছেলেটা জীবনে উন্নতি করতে পারবে।

–‘বাড়ির খবর কী?’

–‘ভালো। তবে আপনার মা আপনার উপর ভীষণ রেগে আছে।’

–‘থাকারই কথা। বাড়ির সামনে থেকে রিপোর্টার গুলো নড়েছে?’

–‘এইজন্যই আপনার মা আপনার উপর রেগে আছে। কেউ বাড়ি থেকে বেরই হতে পারে না। আপনার বাবা,মা এমনকি আপনার ভাই। সবাইকে ধরে ধরে ইন্টারভিউ নিচ্ছে। আপনার সম্পর্কে এই প্রশ্ন, ওই প্রশ্ন। হাজার প্রশ্ন। আপনার বাবা ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। উনাকে নিয়ে আমার ভয় হয়। মাথা গরম করে কোন রিপোর্টার এর উপর হাত তুলে ফেললই সমস্যা। ওরা আপনার পরিবারকে নিয়ে যা-তা লিখবে।’

ইহান হাসল। বাবা ওরকম কিছুই করবে না। তার আজকের এই খ্যাতি দেখে কেউ যদি সবচেয়ে বেশি খুশি হয় তাহলে সেটা বাবা। এক সময় ইহানের গানবাজনা নিয়ে বাবা রাগ করত। আজ এই গানবাজনাই তাকে কত উপরে তুলে দিয়েছে। সে এখন স্টার। লোকেরা তাকে দেখতে তো পারে। কিন্তু কেউ ছুঁতে পারে না। ইহান শব্দ করেই হেসে ফেলল। বাবার সাথে রাগ করে সৌরভের বাড়িতে উঠেছিল ও। ইহান বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,

–‘সৌরভ! সৌরভ যেন এখন কোথায় আছে?’

তার এই নামডাক খ্যাতি বন্ধুদের থেকে তাকে অনেক দূরে সরিয়ে এনেছে। বাবা মা’র সাথেও সেই দূরত্বটা লক্ষ করতে পারে সে। কিছুই আগের মত নেই। ইহান হারুনকে বলল,

–‘আমার একটা বন্ধু ছিল। সৌরভ নাম ওর। খোঁজ নাও তো ও এখন কোথায় আছে। আজকের ভেতরে যেন ওর খোঁজ পাই। যাও এখন।’

–‘স্যার আমি আপনার ড্রেস বের করে রেখেছি। বাইরে গাড়িও রেডি। আপনি চেঞ্জ করে নিন। ব্রেকফাস্টে আজ কী খাবেন স্যার?’

ইহান ত্যাড়া চোখে হারুনকে দেখল। ছেলেটা এই প্রশ্ন প্রতিদিন করবে। অথচ সে যা বলে দিবে খাবার টেবিলে সেসবের কিছুই দেখতে পাবে না।

–‘যদি বলি হট কফি, আইসক্রিম, আর বিরিয়ানি খাব। দেবে তুমি খেতে?’

–‘বেশি ঠান্ডা, গরম খেলে আপনার ভয়েস বসে যাবে। তখন প্রব্লেম হবে।’

–‘তাহলে জিজ্ঞেস না করে রোজ যা দাও। আজও তা-ই দিও।’

–‘সরি স্যার। আর জিজ্ঞেস করব না। আপনি কি দুপুরে বাড়ি যাবেন?’

–‘হ্যাঁ। মা’র রাগ ভাঙাতে হবে। ইন্টারভিউ শেষে সোজা বাড়ি ফিরব।’

–‘ঠিক আছে স্যার।’

হারুন চলে যাবার আগে একবার ফিরে তাকাল। কিছু জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত করছে ও। ইহান ওকে দেখে জিজ্ঞেস করল,

–‘কিছু বলবে?’

–‘আজও কি ওই স্বপ্নটা দেখেছিলেন?’

–‘পাঁচটা বছর ধরেই তো দেখছি। কোনো রাত তো বাদ যায়নি। ভবিষ্যতেও বাদ যাবে বলে মনে হয় না।’

–‘ওহ। সরি স্যার। আসছি আমি।’

হারুন চলে গেলে ইহান চোখ বন্ধ করে নিল। পাঁচটা বছর। তনুর সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। ওইদিন ওভাবে কেন তনু চলে গিয়েছিল তা অবশ্য অনেক পরে জেনেছে ও। জেনে রাগ হয়েছে। তনু ওকে ভালোবেসেছিল। অথচ তার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেনি। এখন তনু কেমন আছে? কী করছে ও? ইহান মাথা ঝাঁকিয়ে তনুর খেয়াল সরিয়ে দিল। তনু তার সামনে এসে ক্ষমা চাইলেও ইহান ওকে ক্ষমা করবে না। পাঁচ বছরে তনু ওকে যে কষ্ট দিয়েছে। ইহানও তাকে শোধে আসলে তা ফিরিয়ে দিবে।#সুখের_পাখি

৫৪
টিভি শো-তে দশটায় ইহানের ইন্টারভিউ ছিল। কিন্তু সে পৌঁছুতে পৌঁছুতে দেরি করে ফেলল। যার ফলে দশটার ইন্টারভিউ সাড়ে দশটায় নেওয়া হচ্ছে। হারুন গাড়িতে বসে ঘড়ি দেখে করুণ মুখ করে বলেছিল,

–‘স্যার অলরেডি দশ মিনিট লেট হয়ে গেল। রাস্তায় যে জ্যাম তাতে মনে হচ্ছে না এগারোটার আগে আমরা পৌঁছুতে পারব। আরও আগে বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল। ঢাকা শহরের রাস্তা…

ইহান তাচ্ছিল্যের সাথে হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মত করে বলল,

–‘মাত্র দশ মিনিট লেট! তুমি জানো, আমি তিন ঘন্টা লেট করে গেলেও ওরা হাসিমুখে বলবে স্যার তিন ঘন্টা তো কিছুই না। অথচ মনে মনে আমার জাতিগোষ্ঠী তুলে গালাগালি দিয়ে শেষ করে ফেলবে।’

হারুন কিছু বলল না। ইহান সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। একটা সময় ছিল যখন সে লোকের ধারে ধারে ঘুরতো। কেউ তাকে একটা সুযোগ দিতে চাইতো না। ডেটের পর ডেট দিয়ে যেত। অথচ কাজের কাজ কিচ্ছু না। ইহান হাল ছাড়েনি। সেসময় ভেঙে পড়লে ওই ইহান কোনোদিনও আজকের ইহান হতে পারতো না। কতগুলো মানুষের উপর জেদ থেকেই সে আরও চেষ্টা করে গেছে। বাবা কোনোদিনও তাকে বিশ্বাস করেনি। গান খেয়ে সে ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে এটা বাবার ভাবনার বাইরের বিষয় ছিল। তনু বলতো, আপনার গানের গলা ভাল, ইহান ভাই। চালিয়ে যান। আঠার মত লেগে থাকুন, দেখবেন আপনার কিছু হবে।
কিন্তু সেই তনুও শেষ পর্যন্ত তার পাশে থাকল না। পৃথিবীটাই স্বার্থপর মানুষ দিয়ে ভরা। এখানে কেউ কারো আপন হতেই পারে না।
ইহান উপস্থাপকের সামনে ইন্টারভিউ দিতে বসেছে। আজকের অনুষ্ঠানটা লাইভ দেখানো হবে। ওর ফ্যানরা চাইলে কল করে সরাসরি ওকে নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারবে। ইহানকে ওদের মনের কথা জানাতে পারবে।
উপস্থাপক বলে যাচ্ছে।

–‘সুপ্রিয় দর্শক, আমাদের মাঝে এখন যিনি উপস্থিত আছেন তাকে দেশের কে না চিনে? দীর্ঘ চারটা বছর ধরে লাখো ফ্যানদের মনে রাজ করে চলেছেন যিনি। একেক পর এক হিট গান দিয়ে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে…

লোকটা আরও অনেক কিছু বলে চলেছে। এসব কথা শুনে ইহানের হাই উঠছে। হারুন ক্যামেরার পেছনে তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। হারুনের উপর ইহানের চোখ গেলে দেখল হারুন অনুরোধের চোখে তাকে দেখছে। গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসল ইহান। বিরক্তি চেপে হাসল। লোকটা বলছে,

–‘সো মিস্টার ইহান, আপনার ভক্তরা অলরেডি কল, মেসেজ করে আমাদের ইনবক্সে ভরিয়ে ফেলছে। দর্শকদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাচ্ছি, আমরা সবার কমেন্ট পড়ব। আপনার পছন্দের সিঙ্গারের কাছে কোন প্রশ্ন থাকলে আপনি এই নাম্বারে কল দিতে পারেন। এখন আমরা আজকের ফার্স্ট কল নিতে যাচ্ছি। দেখা যাক কে সে ভাগ্যবান/ভাগ্যবতী যে আমাদের রকস্টার ইহানের সাথে কথা বলবে।’

ইহান তার ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে হাসিমুখে এক এক করে ভক্তদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। সবগুলো প্রশ্ন ছেলেমানুষী টাইপ। মানুষ ওকে এতটা ভালোবাসে জেনে ইহান সত্যিই স্তম্ভিত। তার পছন্দের রঙ কী? তার পছন্দের খাবার কী? তার পছন্দের জায়গা? কী করতে ওর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। আরও কতশত প্রশ্ন। ইহান মজার সাথেই এসবের উত্তর দিয়েছে।
অনেকে কল করে সরাসরি তাকে প্রপোজ করে বসেছে। ইহান হেসে ফেলে এড়িয়ে গেছে।

–‘ও মাই গড! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি আপনার সাথে কথা বলছি! ও গড!’

–‘প্লিজ ডিয়ার বিশ্বাস করুন, আপনি আমার সাথেই কথা বলছেন।’

–‘ইহান আপনি প্লিজ আমার জন্য একটু হাসবেন! প্লিজ, প্লিজ। একটু হাসুন। একবার আমার নামটা আপনার কন্ঠে বলুন।’

ইহান ভেবে পাচ্ছে না, সত্যিই কি সে এত মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? এই অনুষ্ঠানে বসার আগেও সে বিরক্ত ছিল। অথচ মানুষ গুলো তাকে নিয়ে কতটা কৌতূহলী! তার সম্পর্কে জানার কত আগ্রহ!
অন্য একজন বলল,

–‘আই লাভ ইউ, ইহান। তোমার সবগুলো গান আমার মুখস্থ। তোমার একেকটা গান আমার হাজার বারের উপরে শোনা।’

–‘থ্যাঙ্ক পূজা। তোমার জন্য এত্তগুলো ভালোবাসা রইল।’

–‘আচ্ছা তোমার গাওয়া গানের মধ্যে থেকে কোন গানটা তোমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের? তোমার প্রিয় গানটার নাম বলো প্লিইইইজ।’

ইহান মৃদু হেসে বলল,

–‘আমি যখন যে গান গাই, সেসময়ের জন্য সেটাই আমার প্রিয় হয়ে যায়।’

হারুনকে দেখে মনে হচ্ছে সে স্যারের উপর ভীষণ খুশি। স্যারের যে এত ধৈর্য তা হারুনের জানা ছিল না। সে এক কথার বেশি দুই কথা বলে ফেললেই স্যার ঝাড়ি দেয়। আজ স্যার তো সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেই সাথে কী মিষ্টি মিষ্টি উত্তর দিচ্ছে। একেবারে যেন চিনির রসে ডুবানো কথা।

–‘ইহান, আমরা সবাই তোমার সবকিছুই জানি। তুমি কী পছন্দ করো। তোমার অপছন্দের কাজ কী। সবকিছু। শুধু একটা কথা তোমার কোন ফ্যানরাই জানে না। আর সেটা হলো, তোমার প্রিয় মানুষটি কে? তার নাম কী? সে কোথায় থাকে এটা জানতে চাইব না। আমরা শুধু এটুকু জানতে চাই তোমার পছন্দের কেউ আছে?’

প্রিয় মানুষ! তার তো একজনই প্রিয় মানুষ ছিল। কিন্তু সে তো এখন নেই। প্রশ্নটা শুনে হারুনকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। স্যার এর কী জবাব দিবে? ফ্যান গুলো মাঝে মাঝে এমন সব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসে। স্যার পাবলিক ফিগার বলে কি স্যারের পার্সোনাল কোনোকিছু থাকতে পারে না!
ইহান বলল,

–‘প্রিয় মানুষ! প্রিয় মানুষ কার না থাকে? আমার মতে পৃথিবীর সব মানুষেরই একজন প্রিয় মানুষ থাকে। এই থাকাটা জরুরি। সেই মানুষটাকে সে হয়তো প্রকাশ্যে পছন্দ করে। নয়তো গোপনে। ব্যক্তিজীবনে আমরা যা-ই করি, দিনশেষে ওই মানুষটাকে ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে যাওয়ার মাঝেও একটা সুখ আছে। হয়তো সে স্বপ্নেই সুন্দর। বাস্তবে না-ই বা পেলে। তাতে আফসোস কী!’

ইহানের কথা শুনে সবাই হাত তালি দিতে লাগল। খুশিতে হারুনের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। স্যার এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে?

–‘তুমি কি এবার দেশে ফিরে যাবে তনু?’

তনু একগাল হেসে বলল,

–‘হ্যাঁ। এখানে যে কাজের জন্য এসেছিলাম তা হয়ে গেছে।’

জয়ন্তী চোখ গোলগোল করে বলল,

–‘মানে?’

–‘ এ দেশে ডিগ্রি নিতে এসেছিলাম। তা তো হয়ে গেছে। এবার ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যাব। বুঝেছ।’

–‘তুমি চলে গেলে তোমাকে খুব মিস করব।’

–‘আমিও। তুমি যখন দেশে যাবে তখন আমার সাথে দেখা কোরো।’

–‘কীভাবে? আমি কোলকাতায় থাকি। তুমি বাংলাদেশে। দূরত্বটা অনেক দূর।’

জয়ন্তী, এখানে আসার পর এই একটি মেয়ের সাথেই তনুর ভাব হয়েছে। কোলকাতার মেয়ে। মেয়েটা ভীষণ মিশুক। তনুর সাথে যেচেই কথা শুরু করেছিল ও। এখন তনু চলে যাবে শুনে সবথেকে বেশি সে-ই কষ্ট পাচ্ছে। ওরা কথা বলতে বলতে পেছন থেকে আর একটি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

–‘টনু, হেই ট্যানু…

–‘ওইযে তোমার নামের পিন্ডি চটকাতে এসে পড়েছে।’

কথাটা বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসল জয়ন্তী। তনু ফোঁস করে দম ফেলে বলে উঠল,

–‘এই পাঁচ বছরেও বুঝতে পারলাম না, ও আমাকে টনু ডাকে? ঠনু ডাকে? নাকি ট্যানু, ত্যানু?’

–‘তোমাকে তো যাহোক একটা ডাকে। আমার তো পুরো নামই বাদ দিয়ে দিয়েছে। জয়ন্তীর জয়টাও ডাকে না। কীসব জে টে ডাকে।’

ওরা দু’জনই একসাথে হাসলো। বিশাল শরীরের ছোটখাটো হাতির বাচ্চাটা ওদের দু’জনের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে আসছে। ওকে হাতির বাচ্চা নাম অবশ্য জয়ন্তী দিয়েছে। ওর কথা, মানুষ এত মোটা কী করে হতে পারে! নিশ্চয় আগের জন্মে ও হাতি ছিল। ব্যস্ত! এর পর থেকেই ওর ডাকনাম হাতির বাচ্চা। স্যামি এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। একটুকু পথ হেঁটে এসে হাঁপাচ্ছে ও। এদেশে স্যামিই তনুর একমাত্র ছেলে বন্ধু। অবশ্য ওর মাঝে ছেলেদের কোন আচরণই লক্ষ করা যায় না। বড় বড় গাল দু’টোর চাপে ওর ছোট হয়ে আসা চোখ দু’টো তনুকে দেখছে। স্যামি তার ভাঙা ভাঙা বাংলায় তনুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–‘টুমি বাংলাদেশ ফিরে যাবেএ?’

তনু হেসে সাহেবদের মত স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল,

–‘তোমাকে বাংলা বলতে হবে না। বাংলা ইংরেজি মিক্স করে তুমি যে জগাখিচুরি পাকাও তা আমার পক্ষে হজম করা সম্ভব নয়।’

ওর কথা শুনে জয়ন্তী খিলখিল করে হেসে ফেলল। স্যামি মন খারাপ করে পরের বার ইংরেজিতেই বলল,

–‘তুমি বাংলাদেশে গিয়ে কী করবে? এখানেই তো থেকে যেতে পারো।’

–‘না স্যামি। আমি এখানে থাকতে পারি না। এটা আমার দেশ না। আমার দেশ বাংলাদেশ। ওখানে আমার প্রিয়জনেরা আছে। ওরা আমার ফেরার অপেক্ষা করছে।’

–‘ওখানে তোমার কে কে আছে?’

–‘ফুপু আম্মা, ফুপা, ফুলি আপা, ইহান ভা…

বলতে বলতে থেমে গেল তনু। ইহান ভাই! উঁহু, ইহান ভাই তার জন্য মোটেও অপেক্ষা করে নেই। সে হয়তো শান্তিকে ফিরে পেয়েছে। ওরা লক্ষ করল তনু কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। সেদিন চলে আসার পর ইহান ভাই তার কোন খোঁজ নেয়নি। সে-ও যে নিয়েছে এমনটা না। তনু নিজেকে ইহানের মায়া থেকে বের করে আনতে চেয়েছে। পাঁচ বছরেও কতটুকু পেরেছে সে তা জানে না। তবে ইহান ভাইয়ের জন্য এখনও তার মন কাঁদে। ইহান ভাইয়ের কথা মনে পড়লে এখনও বুকের ভেতর কষ্ট হয়।
তনু ভাবছে দেশে ফিরে গিয়ে কী করবে ও? ইহান ভাই নিশ্চয় এখনও তার অপেক্ষায় বসে থাকেনি। এতদিনে সে বিয়ে করেছে। ছেলেমেয়ের বাবাও হয়ে গেছে হয়তো। পাঁচটা বছর তো আর কম সময় না। এই পাঁচ বছরে পৃথিবী কতটা পাল্টেছে। ইহান ভাই পাল্টাবে না এমনটা কি হতে পারে?

আহান কোনোরকমে রিপোর্টারদের টপকিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে আসে। এই জ্বালা আর সহ্য করার মত না। ইহানের ফ্যানরা ওকে জ্বালাচ্ছে কেন? ইহানের ভাই হয়ে সে কি পাপ করে ফেলেছে! কোনো জায়গায় গেলে শান্তি পাওয়া যায় না। দেখা যাচ্ছে তার চেম্বারে রোগী কম তার ভাইয়ের পাগল ভক্তরাই বেশি ভিড় করছে। এরকম চলতে থাকলে নিশ্চয় কিছু করে বসবে ও। সাবিনা ছেলেকে ফুঁসতে দেখে বললেন,

–‘তোর আবার কী হয়েছে?’

–‘আমার কী হয়েছে! আমার খুশিতে মরে যেতে ইচ্ছে করছে! তোমার গুনধর ছোট ছেলের জন্য আমার কাজকর্ম বন্ধ করে বাড়ি বসে থাকতে হবে।’

–‘কেন, ইহান আবার কি করেছে?’

–‘কী করেছে এটা জিজ্ঞেস না করে, কী করেনি ও সেটা জিজ্ঞেস করো। আজ চেম্বারে এক মেয়ে এসে সরাসরি আমাকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়ে বসেছে। আমাকে সে কেন বিয়ে করতে চায় জানো? আমার বউ হলে ইহান ওর দেবর হবে। আমাদের বাড়িতে থেকে চব্বিশ ঘণ্টা ইহানকে দেখতে পারবে। ইহান তো তাকে কোনোদিনও বিয়ে করবে না। এতো এতো মেয়ে তার জন্য পাগল। তাই সে সেকেন্ড অপশন হিসেবে আমাকে বিয়ে করবে। আমার তো ইচ্ছে করছিল ইনজেকশন মেরে ওর মাথা থেকে ভূত নামিয়ে দিই। কী ফাউল মেয়ে দেখেছ!’

আহানের কথা শুনে সাবিনা হো হো করে হাসতে লাগল। আহান বিরক্ত হয়ে বলল,

–‘ইহানকে এই পেশায় যেতে কে বলেছিল মা! বাড়ির সামনে থেকে প্রেস নড়ছে না। আসতে যেতে হাজার প্রশ্ন। এসব আমার অসহ্য লাগছে।’

চলবে🌼
#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here