সেই তুমি💐
পর্ব -১১ +১২
Samira Afrin Samia
#Nipa
ইশিতা লোকটা কে দেখার জন্য অধির আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ইশিতা ক্যাবিনে আসছে এটা বুঝতে পেরে ইয়াশ পিছন ফিরে ইশিতার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। ইশিতা সামনে দাঁড়ানো লোক টা কে দেখে একটু চমকে গেল। আরে এটা তো সেই লোকটা যে ওই দিন ইশিতা কে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। যার গাড়ির সামনে ইশিতা এসে গেছিল। তিনি যদি ওই দিন ঠিক সময়ে ব্রেক না করতো তাহলে একটুর জন্য এক্সিডেন্ট হয়ে যেত। ইয়াশ ইশিতা কে দেখে ভুত দেখার মত চমকে গেল। সাথে সাথে বুকের মাঝে অজানা এক ব্যথা অনুভব করতে লাগলো। ও ই তাহলে ইশিতা?
ওই দিন তো নাম না জেনেই অনেক টা সময় দুজন সাথে ছিল। যে মেয়েটা কে দেখে জীবনের প্রথম ইয়াশ কিছু ফিল করেছিল তাকে আজ এভাবে এ অবস্থায় দেখবে তা ইয়াশ কল্পনা ও করেনি। ইয়াশের ভালো লাগা টা মনের মাঝে চেপে রেখে খুব কষ্টে স্বাভাবিক হয়ে বললো
— আপনি কি ইশিতা?
ইশিতা ইয়াশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে এই লোকটা এখানে কেন এসেছে? সেদিনের একটু সময়ের পরিচয়ে তো কারোর ই নাম জানা হলো না। তাহলে উনি কি ভাবে ইশিতার নাম জানলো?
আর আজ এখন এখানেই বা কেন এসেছে? কি এমন দরকারে অপারেশন হওয়ার আগেই ইশিতার সাথে কথা বলতে চায়?
ইশিতা ইয়াশের থেকে মামা নামিয়ে নিচের দিকে তাকে
— হুম আমি ই ইশিতা।
— আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। কিন্তু কথা গুলো এখানে বলা সম্ভব না। আপনি বাড়ি যান। আমি একটু পর আপনার বাসায় আসছি।
— জরুরি কথা?
কিন্তু এখন তো
— ডক্টরের সাথে আমার সব কথা হয়ে গেছে। ওরা আপনাকে এখনই রিলিজ করে দিবে। আপনি একটু সাবধানে বাসায় যাবেন। আপনার মামা মামীর সাথে ও আমার কথা হয়েছে।
ইয়াশ তড়িঘড়ি করে ক্যাবিন থেকে বের হয়ে গেল। ইশিতা কিছুই বুঝতে পারছে না। কি হচ্ছে এসব ওর সাথে। কে এই লোকটা? আর কি এমন কথা আছে ওর সাথে? মামা মামী কে কি বলে অপারেশন করানো থেকে আটকে দিলো?
ইয়াশ ফুল স্পিডে কার ড্রাইভ করছে। রাস্তায় কে আছে সামনে কি কিছু না দেখে পাগলের মত ড্রাইভ করছে। ইয়াশের চোখের কোণা বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি পড়ে গেল। রাগ হচ্ছে নিজের উপর। সে নিজের ভাইকে ঠিক ভাবে মানুষ করতে পারেনি। ওকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেনি। আদর ভালোবাসা দিয়ে ইফান কে একটা অমানুষ বানিয়ে তুলেছে। যে মেয়েদের সাথে এমন করে। মেয়েদের সন্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তাদের সন্মান করতে জানে না সে মানুষ না, মানুষ রূপি জানোয়ার। আর সেই মানুষ রুপি জানোয়ার টা আর কেউ না তার নিজের আপন ভাই। এটা ভেবেই ইয়াশের এখন ইফান কে খুন করতে ইচ্ছে করছে। ইয়াশ তো ইফান কে এমন ভাবে গড়ে তুলেনি। ছোট থেকে ইফানের এমন কোন আবদার, ইচ্ছে নেই যা ইয়াশ পূরণ করেনি। তাহলে ইফান কেন এমন হলো?
ইয়াশ শহর থেকে বেশ দূরে একটা নিরিবিলি জায়গায় এসে ইফান কে ফোন করে এখানে আসতে বলে।
ইয়াশের কথা মত ইফান কিছুক্ষণের মধ্যে ইয়াশের বলা জায়গা টায় এসে যায়।
ইয়াশ কারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ দুটো আগুনের গোলার মত লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে ইফান কে সামনে হাতের কাছে পাওয়ার সাথে সাথেই কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নিবে।
ইফান ইয়াশের কাছে এসে চোখ থেকে কালো সানগ্লাস টা খুলে হাতে নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে
— হ্যা ভাই বল। হঠাৎ করে এখানে ডাকলি কেন?
ইয়াশ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে। দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে
— ইশিতা কে?ইফান ইয়াশের মুখে ইশিতার নাম শুনে ভয় পেয়ে তোতলাতে লাগলো।
— ভাই কো,,কোন ই..ইশিতা?
— ইশিতা নামের কয়টা মেয়ের সাথে তোর রিলেশন আছে?
— ভাই এসব কি বলছিস তুই?
— আমি কি বলছি তা বুঝতে পারছিস না তাই তো?
বুঝবি কি করে মেয়েদের বেড রুম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পর তো তাদের কথা মনে না রাখাটা ই স্বাভাবিক। ইফান বুঝে গেল ইয়াশ সব জেনে গেছে এখন ইয়াশের সাথে মিথ্যে বললে উল্টো ইয়াশ রেখে যাবে। ইফান এমনিতে ইয়াশ কে ভিষণ ভয় পায়।
— ভাই ওই মেয়েটার কথা তোকে কে বলেছে?
— তাহলে মনে পড়লো ওই মেয়ের কথা। চিনতে পারছিস তাহলে ইশিতা কে?
— তুই কার কাছ থেকে কতটা শুনছিস তা জানি তা। তবে ওই মেয়েটা একদম সুবিধার না। ছেলেদের নিজের ভালোবাসার জালে ফাঁসায়। আমার সাথে ও ভালোবাসার নাটক করে ভার্সিটির সবার সামনে আমাকে অপমান করেছে।
— আর তুই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ওকে প্রেগন্যান্ট বানিয়ে এখন ওকে একা ছেড়ে দিছিস।
আমি ছোট থেকে তোকে এটা শিক্ষা দিছি তাই না রে?
তোর কাছ থেকে শিখবে হবে কিভাবে প্রতিশোধ নিতে হয়। তুই তো খুব মহান একটা কাজ করেছিস। মা জানলে কতো খুশি হবে এটা জানিস তুই?
— ভাই
— সেটআপ তোর মুখ থেকে আমি ভাই ডাকটা শুনতে চাই না। যে মেয়েদের সন্মান করতে জানে না সে আমার ভাই হতে পারে না।
— ভাই তুই জানিস না ও একটা ক্যারেক্টারলেস মেয়ে।
— হুম ওই মেয়েটা তো ক্যারেক্টারলেস ই হবে। সে তার ভালোবাসার মানুষ টা কে বিশ্বাস করেছিল তাই সে ক্যারেক্টারলেস, সে তোর মিষ্টি কথায় ভুলে তোর হাতে তার সব কিছু তুলে দিয়েছে তাই সে ক্যারেক্টারলেস।
ওই মেয়েটা যদি ক্যারেক্টারলেস হয় তাহলে তুই কি?
একটা মেয়ের ভালোবাসা নিয়ে খেলা করে,তার বিশ্বাস ভেঙে, তার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে, তার নামে কলঙ্কিনী দাগ লাগিয়ে এখন তাকে সমাজের মানুষের কথা শুনার জন্য একা ছেড়ে দিয়ে তুই তো খুব মহান হয়ে গেলি তাই না?
— ভাই আমার কথা টা তো শুনবি?
— তোর কোন কথা টা শুনতে বলছিস তুই?
তুই জানিস আজ ইশিতা এ্যাবরেশন করাতে গেছিল।
— ওর ইচ্ছা হলে ও এ্যাবরেশন করাবে এটা আমার জানার কি আছে?
— তোর জানার কিছু নেই? তুই ওই বাচ্চা টার বাবা ইফান। ওটা তোর সন্তান। তুই কি করে এমন কথা বলছিস। তুই চাস না তোর সন্তান পৃথিবীতে আসুক?
— ওহ ভাই! আমি শুধু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এমনটা করেছি। সন্তানের বাবা হবার জন্য না। আর আমার ওই বাচ্চার টার প্রতি কোন আগ্রহ নেই। ওর দুনিয়াতে আসুক বা না আসুক। ইশিতার ইচ্ছে হলে ও বাচ্চা টা কে জন্ম দিবে না হলে এ্যাবরেশন করিয়ে নিবে।
— তুই সব কিছু এতো সহজে বলছিস কিভাবে? তোর কাছে ওই মেয়েটার সন্মান কিছুই না। তোর প্রতিশোধ টা ই সব।
— আমি ওর মত একটা বাজে রাস্তার মেয়েকে কখনও বিয়ে করবো না।
ইফানের মুখে ইশিতার সম্পর্কে এমন কথা শুনে ইয়াশের রাগ চরম সীমায় পৌঁছে গেল। ইয়াশ আর নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। ইফানের কলার ধরে ইফান কে মারার জন্য হাত উঠিয়ে নিলো।
ইয়াশ ছোট থেকে আজ পর্যন্ত কোনো দিনও কোনো কিছুর জন্য ইফানের গায়ে হাত তুলে নি। ইফান অনেক বড় ধরনের ভুল করে ফেললেও ইয়াশ ইফান কে কখনও মারে নি। ইয়াশ ইফান কে মারতে গিয়েও হাত নামিয়ে নিলো।
— কি হলো ভাই মার। তুই একটা ক্যারেক্টারলেস মেয়ের জন্য আমার গায়ে হাত তুলতে নিছিলে।
ইয়াশ ইফানের র্শাটের কলার ঠিক করে দিয়ে ইফানের কাঁধে হাত রেখে একদম স্বাভাবিক কন্ঠে
— চল ভাই। যা হয়েছে তার জন্য ইশিতার কাছে হ্মমা চেয়ে ওকে মেনে নে।
— ভাই তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?
অসম্ভব আমি ওই মেয়ের কাছে মাফ চাইবো তো দূর আমি কখনও ওর মুখ আমার চোখের সামনে দেখতে চাই না। ওকে মেনে নেওয়া তো অনেক দূরের কথা।
তোর ইচ্ছা হলে তুই আমাকে মারতে পারিস। এমনকি বাসা থেকে ও বের করে দিতে পারিস তার পর ও আমি ইশিতা কে বিয়ে করবো না।
— এটাই তোর শেষ কথা?
— হ্যা এটাই আমার শেষ কথা। আর এটাই ফাইনাল।
— ঠিক আছে। তাহলে আজকের পর থেকে তুই তোর মত করে ই থাকিস। আর কখনও তোর পাশে আমাকে পাওয়ার কথা কল্পনা ও করিস না। আজকের পর থেকে তুই কোথাও আমার ভাই হবার পরিচয় টা পাবি না।
— তুই যদি একটা মেয়ের জন্য আমাকে নিজের ভাই বলে পরিচয় দিতে না চাস তাহলে আমার ও কোনো প্রব্লেম নাই। যেটা তোর ইচ্ছা। তুই যেমন চাইবি তেমনই হবে।
ইফান চলে গেল। ইয়াশ ইফান কে বুঝাতে পারলো না। ইয়াশ রাগে নিজের গাড়ির কাছে কয়েক টা ঘুষি মারলো।
ইয়াশের কথায় ডক্টর ইশিতা কে রিলিজ করে দিলে ইশিতা মামা মামীর সাথে বাড়ি চলে আসে। হসপিটাল থেকে আসার পর থেকে ইশিতার মনে বার বার ওই এক প্রশ্ন ই উঁকি দিচ্ছে। কে ছিল লোকটা?
কি কারনে ওই লোকটা ইশিতা কে এ্যাবরেশন করাতে দিলো না?
আজিম সাহেব ও সালেহা বেগম বাড়িতে ছোট খাটো আয়োজন করছে। সালেহা বেগম তো দৌঁড়া দৌঁড়ি করে এটা সেটা রান্নার ব্যবস্থা করছে। এসবের কিছুই ইশিতার মাথায় ঢুকছে না। কি হচ্ছে এসব। আজ অনেক দিন পর আজিম সাহেবের মুখে একটু হাসি ফুটেছে। আজিম সাহেব সালেহা বেগম কে বলছে
— অবশেষে মনে হয় সব কিছু ঠিক হবে। আমাদের মেয়েটা একটু সুখের মুখ দেখতে পারবে। ওর নামের বদনাম টা ও ঘুঁচে যাবে। আর ওর সন্তান টা ও এ পৃথিবীতে আসতে পারবে।
সালেহা বেগম চুলায় রান্না বসাতে বসাতে
— ঠিকই বলেছো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এ কয় দিনে খুব ঝড় বয়ে গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে। অনেক কিছু সহ্য করেছে এই অল্প সময়ে।
ইয়াশ কারে বসে আছে। কি করবে ও এখন?
হসপিটাল থেকে আসার সময় তো ইশিতার মামা মামী কে বলে এসেছিল ইফান কে নিয়ে উনাদের বাসায় যাবে। ইশিতার সাথে ইফানের বিয়ে দিবে। সব কিছু আবার আগের মত ঠিক করে দিবে। কিন্তু এখন কিভাবে সব কিছু ঠিক করবে? ইফান তো ইশিতা কে বিয়ে করতে রাজি না।
মাগরিবের আযান হয়ে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আজিম সাহেব বার বার বাইরে তাকিয়ে দেখছে ইয়াশ ইফান কে নিয়ে আসলো কি না। সালেহা বেগম আজিম সাহেবের কাছে গিয়ে।
— এতো চিন্তা করছো কেন?
ইয়াশ তো বলেছে ও ইফান কে নিয়ে আসবে।
— কখন আসবে রাত হয়ে গেল এখনও তো ওদের আসার নাম নেই।
তখনই গাড়ির শব্দ পেয়ে সালেহা বেগম ঘর থেকে বের হয়ে আসলো
— ওই দেখো ইয়াশ এসেছে। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইয়াশ বাড়ির ভেতরে আসলো। আজিম সাহেব ইয়াশ কে একা দেখে ইয়াশের কাছে গেল
— ইফান কোথায়? ও কি পিছনে আসছে?
ইফান আসছে তো বাবা?
এটা বলে আজিম সাহেব হু হু শব্দ করে কেঁদে উঠলেন।
আজিম সাহেব কে কাঁদতে দেখে ইয়াশ আজিম সাহেবের হাত ধরে।
— কাঁদবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো কথা দিয়েছি সব ঠিক করে দিবো।
আপনাদের সবার সাথে আমার কিছু কথা আছে বিশেষ করে ইশিতার সাথে।
সবাই ইশিতার রুমে দাঁড়িয়ে আছে। ইশিতা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আজিম সাহেব চেয়ারে বসে আছে। ইয়াশ ইশিতা কে উদেশ্য করে
— আমার ভাই আপনার সাথে যা করেছে তার কোন হ্মমা নেই। আমি এটা বলবো না আপনি ওকে হ্মমা করে দেন।
আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ। আমি ওকে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি করাতে পারিনি।
ইশিতা জানতো ইফান রাজি হবে না। ইফান অনেক জেদি ও যতদিন নিজের চোখে রিহার সত্যি টা সামনে না দেখবে ততদিন কারোর মুখের কথাতে ই বিশ্বাস করবে না।
আজিম সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন
— রাজি হয়নি মানে?
আপনার দায়িত্ব ছিল ওকে বুঝানোর। এখন কি আপনি বড় অংকের টাকা আমাদের মুখে ছুঁড়ে ফেলে আমাদের মুখ বন্ধ করতে এসেছেন।ধনী রা এটা ছাড়া আর কি ই বা পারে?
— আমি ইশিতা কে বিয়ে করতে চাই। যদি আপনারা রাজি থাকেন তাহলে।
চলবে…
সেই তুমি💐
পর্ব -১২
Samira Afrin Samia
#Nipa
শেষমেশ ইশিতা আর ইয়াশের বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। ঘরোয়া ভাবে কাজী ডেকে খুব সাধারণ ভাবেই বিয়েটা হয়েছে। ইশিতা প্রথমে রাজি ছিল না এমনকি ইশিতার মামা আজিম সাহেব ও এ বিয়েতে রাজি ছিল না। অনেক চিন্তা ভাবনার পর আজিম সাহেব বিয়েতে মত দিলেন এবং ইশিতা কে ও রাজি করালেন। ইশিতা এখন যদি বিয়েতে রাজি না হয় তাহলে ওর পেটের সন্তান কে দুনিয়াতে আনতে পারবে না। ইয়াশের মত সব কিছু জেনে এখন কোনো ছেলে ইশিতা কে বিয়ে করতে আসবে না।
বিয়ের কাজ শেষে কাজী সাহেব চলে গেল। আজ ইশিতা আর ইয়াশ বিয়ের পবিত্র বাঁধনে আবদ্ধ হলো।আজ থেকে ইশিতা মিসেস ইশিতা হয়ে গেল। ইশিতা ইয়াশের বউ হিসেবে নতুন পরিচয় পেল। আজ থেকে ইশিতা আর ইয়াশের এক সাথে পথ চলা শুরু হবে। ইশিতা ইয়াশের সাথে এক নতুন জীবনে পা দিবে। যে জীবনের ভবিষ্যত কি হবে, যে জীবনে ইশিতার জন্য কি অপেক্ষা করছে সে সম্পর্কে ইশিতার বিন্দু মাত্র ধারণা নেই। ইশিতা এখন আর নিজেকে নিয়ে ভাবে না। তার সাথে যা সবার হবে এটা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই ইশিতার। এমনিতেই ওর সাথে অনেক কিছু হয়ে গেছে আর কিছু হবার বাকি নেই। তাই আর ইশিতার ভয় ও নেই।
খুব জোরাজুরির পর ইয়াশ সবার সাথে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য বের হতে নিলো। রাতে সবাই খেলে ও ইশিতা কিছু খায়নি। আজিম সাহেব ও সালেহা বেগম ইশিতা কে বিদায় দিচ্ছে। রুনা,রুমি দৌঁড়ে ইশিতার কাছে এসে
— আপু তুই কি একেবারে চলে যাচ্ছিস?
— না রে তোদের ছেড়ে আমি একেবারের জন্য কোথায় যাবো? তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে?
— তুই আমাদের সাথে দেখা করতে আসবি তো?
ইয়াশ পাশ থেকে
— হুম অবশ্যই আসবে। আমি নিয়ে আসবো তোমাদের আপুকে তোমাদের সাথে দেখা করার জন্য।
আজিম সাহেব ইয়াশের কাছে এসে
— তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ। তুমি আমার মেয়েটা কে কখনও কষ্ট পেতে দিও না বাবা। এমনিতেই আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।
— আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি কখনও ইশিতা কে এতো টুকু ও কষ্ট পেতে দিব না।
সালেহা বেগম আঁচল দিয়ে চোখ মুখে কান্না মাখা কন্ঠে
— ও আমাদের নিজের মেয়ে না। আমরা তো ওর বাবা মা ও না। পরেও কোন দিন আমরা ওকে নিজের মেয়ে থেকে কম মনে করিনি। ওর বাবা মা মারা যাবার পর ছোট থেকে ও আমাদের সাথে আমাদের মেয়ের পরিচয়ে বড় হয়েছে।
— একদম চিন্তা করবেন না মামী। আজ থেকে ইশিতার সব দায়িত্ব আমার। ওর চোখে কোন দিন ও এক ফোঁটা পানি আসতে দিব না। জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত ওর খেয়াল রাখবো। আমি থাকতে কোন কষ্ট ইশিতা কে স্পর্শ করতে পারবে না। ওর প্রাপ্ত সন্মান টুকু আমি ওকে পাইয়ে দিব। ইশিতার এতটুকু অসন্মান হবে এমন কোনো কাজ আমি কখনও ই করবো না। ইশিতার মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকবে এটা আপনাদের কাছে আমার ওয়াদা।
ইয়াশের প্রতিটা কথা শুনে আজিম সাহেবের মন ভরে গেল। আজিম সাহেব আজ সস্তির নিশ্বাস নিতে পারবেন। আজিম সাহেব আজ এমন একজনের দেখা পেয়েছেন যে ইশিতা কে উনার থেকে ও বেশি ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে।ইশিতা আর ইয়াশ সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। রাত প্রায় দশ টা বাজে। ইয়াশ কার ড্রাইভ করছে ইশিতা পাশের সিটে বসে আছে। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে ও ল্যামপোস্টের আলোতে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ইয়াশ এক দিক দিয়ে অনেক খুশী। যে মেয়েটাকে প্রথম দেখাতেই সে মন হারিয়েছিল আজ সে মেয়ে তার পাশে বসে আছে তার বউয়ের পরিচয় নিয়ে। এখন থেকে সারা জীবন তার পাশে, তার সাথেই থাকবে। আবার ইশিতার দিক থেকে ভেবে ও কষ্ট হচ্ছে। একজন কে ভালোবেসে অন্য কাউকে বিয়ে করা এটা এতোটা সহজ কাজ না। কিন্তু পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আজ ইশিতা কে এ কাজ টা ও করতে হয়েছে। আর ইশিতার জন্য তো এটা অনেক কঠিন সিধান্ত ছিল। কারণ সে যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে সে হলো তার ভালোবাসার মানুষটা যে তাকে ধোঁকা দিয়েছে তার ই নিজের আপন বড় ভাই। পুরোটা রাস্তায় দুজন নিরবতা পালন করে গেছে। কেউ কোনো কথা বলনি।দু’জনই চুপচাপ কারে বসে আছে।বাসায় এসে গেলে ইয়াশ কার থেকে নেমে গিয়ে কারের দরজা খুলে ইশিতা কে নেমে আসতে বলে। ইশিতা কিছুক্ষণ ইয়াশের দিকে তাকিয়ে থেকে কার থেকে নেমে আসে। ইয়াশ ইশিতা কে নিয়ে মেইন ডোরের সামনে গিয়ে কলিংবেল বাজায়। ইশিতা এদিক সেদিক তাকিয়ে চারপাশ টা দেখার চেষ্টা করলে রাতে অন্ধকারে কিছুই তেমন ভালো ভাবে দেখতে পারেনি।
ভেতর থেকে নাজমা চৌধুরী কলিংবেলের শব্দ শুনে নিচে এসে মেইন ডোর খুলে দিলে ইয়াশ কে দেখতে পায়।
— ইয়াশ তুই আজ এতো রাত করলি কেন? কোনো দিনও তো নয়টার বেশি সময় অবধি বাইরে থাকিস না।
— মা একটু জরুরী কাজ ছিল।
— ফোন করে তো একবার জানাতে পারতি।
ইয়াশ পিছনে ফিরে ইশিতা কে ডেকে আনে
— এদিকে আসো ইশিতা।
ইশিতা ইয়াশের পিছন থেকে একটু সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশের সাথে একটা মেয়েকে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না।
— ও কে ইয়াশ?
— মা ও তোমার বউ মা।
— বউ মা?
তুই বিয়ে করেছিস? হঠাৎ করে এভাবে বিয়ে করার মানে কি? তুই ওকে পছন্দ করিস তা আমাকে জানালে আমি নিজেই তোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওদের বাড়ি যেতাম।
— হুম। মা এখন কিছু জিঙ্গেস করো না। আগে ওকে ভিতরে নিয়ে যাও পরে আমি তোমাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলবো।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশ কে অনেক বিশ্বাস করে। ইয়াশ কোনো দিন ভুল কিছু করবে না এটা ভেবেই আর কিছু জিঙ্গেস না করে ইশিতা কে ভেতরে নিয়ে যায়। ইশিতা ভেতর এসে এক নজর বাড়ি টার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। অনেক বড় বাড়ি। ঠিক রাজা বাদশাহদের বাড়ির মত। সব কিছু কতো গুজগাজ। ইশিতা এমন বাড়ি খুব কম ই দেখেছে। নাজমা চৌধুরী ইশিতার কাছে এসে
— তোমার নাম কি মা?
ইশিতা মাথা নিচু করা অবস্থায় খুব আস্তে করে উত্তর দিলো
— ইশিতা।
— বাহ! বেশ সুন্দর নাম তো। তা তোমার পরিবারে কে কে আছে?
— মামা মামী আর ছোট দুই মামাতো বোন।
— তোমার বাবা মা?
— উনারা বেঁচে নেই। আমার যখন সাত বছর বয়স তখন উনারা কার এক্সিডেন্টে মারা যায়।
ইশিতার বাবা মা নেই এই কথা শুনে নাজমা চৌধুরীর ইশিতার জন্য খুব মায়া হচ্ছে। নাজমা চৌধুরী ইশিতার কাছে এসে ইশিতার হাতে ধরে
— বাবা মা নেই এটা ভেবে মন খারাপ করো না মা। আজ থেকে আমি তোমার মা। আমার ও নিজের কোনো মেয়ে নেই। তুমি আমার বউ মা হয়ে না আমার মেয়ে হয়ে থাকতে পারবে না?
পারবে না আমাকে নিজের মা মনে করতে?
ইশিতা নাজমা চৌধুরীর কথা শুনে উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
— পাগলী মেয়ে কাঁদছো কেন। একদম কান্না করে না।
ইয়াশ পিছন থেকে বলে উঠলো।
— মা মেয়ের কান্নাকাটি পরে হবে। এখন আমি অনেক র্টায়াড। আমি রুমে যাচ্ছি তোমরা থাকো।
এটা বলে ইয়াশ সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। নাজমা চৌধুরী পিছন থেকে
— ইশিতা কে ও সাথে নিয়ে যা। ইশিতা ও তো র্টায়াড হয়ে গেছে।
ইয়াশ পিছনে না তাকিয়ে কোনো কথা কানে না নিয়েই নিজের রুমে চলে গেল।
— দেখো কান্ড! পাগল ছেলে নিজের বউ কে একা রেখে নিজে কি সুন্দর রুমে চলে গেল।
আচ্ছা মা তুমি ও রুমে যাও। ফ্রেস হয়ে নেও রাত তো অনেক হলো। চলো আমি তোমাকে তোমার রুম চিনিয়ে দেই।
ইয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে একটা টাওজার পড়ে টাওয়াল টা কাঁধে ঝুলিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। ইয়াশ টাওয়াল দিয়ে এক হাতে চুল মুছতে মুছতে অন্য হাত দিয়ে ওয়ারড্রব থেকে গেঞ্জি বের করতে নিচ্ছিল। তখনই ইশিতা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করে।
ইয়াশ একটা গেঞ্জি হাতে নিয়ে ইশিতার দিকে না তাকিয়ে গেঞ্জি টা পড়তে পড়তে
— এখন থেকে এটা তোমার ও রুম। তাই নিজের রুমে আসার আগে নক করে আসার দরকার নেই।
ইশিতা একটু সময় নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে রুমের ভেতর আসে।
— তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও আমি একটু নিচে থেকে আসছি।
ইশিতা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।
চলবে….