সেই তো এলে তুমি পর্ব -৩২+৩৩

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৩২
#Saji_Afroz

নওয়াজ বাড়িতে প্রবেশ করার সময় হোঁচট খেয়ে মেঝেতে প্রায় পড়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনি তাকে তার মা ধরে ফেললেন। তিনি চিন্তিত কণ্ঠে বললেন-
আহ বাবা! সাবধানে চলাফেরা কর।
.
দরজার সাথে লেগে নওয়াজের পা খানিকটা ছিড়ে গেছে। যেখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। তা দেখে তিনি তানিশাকে চেঁচিয়ে ডাকলেন। নওয়াজ বলল, ওকে ডাকছ কেনো?
-তুই এসে বস তো। পায়ে কেটেছে দেখেছিস?
-সামান্যই!
.
তানিশা দেখে বলল-
সামান্য কিছু থেকেও বড়ো কিছু হতে পারে।
আপনি বসুন আমি আসছি।
.
এই বলে ভেতর থেকে তানিশা ফার্স্ট এইড বাক্স নিয়ে আসে। খুব যত্ন করে নওয়াজের ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে তাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। এরপর নওয়াজকে রুমে গিয়ে আরাম করতে বলে।
নওয়াজ রুমে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। তার মাথায় অনেককিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। কীভাবে কী করবে এই নিয়ে চিন্তিতও রয়েছে সে। কিডন্যাপের মতো কাজটা কী নিজে করবে না কি কাউকে ঠিক করবে? নাহ … লোক ঠিক করলে নানা ধরনের ভেজালে পড়তে হয়। টাকা পয়সাও খরচ হয়। নিহিরের মতো বড়ো মানুষ যদি এমন কাজ করতে পারে, সে কেনো পারবে না! তায়শার সহযোগিতায় কাজটা সহজ হতে পারে। তবুও চিন্তাটা থেকে যায়। এমন কাজ যে আগে কখনো করেনি নওয়াজ।
এসব ভাবতে ভাবতে নওয়াজের মাথা ভার হয়ে আসে। চারদিক ঝাপসা দেখছে সে। মুহুর্তের মাঝেই মাথা ব্যথা শুরু হয় তার। মনে হচ্ছে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করছে। নিজের মাথা দু’হাতে চেপে ধরে মা কে ডাকলো নওয়াজ। তিনি ওয়াশরুমে থাকাতে শুনতে পাননি। তানিশা শুনে ছুটে আসলো। নওয়াজকে এভাবে দেখে ঘাবড়ে যায় সে। কাছে এসে বলল-
কিছু লাগবে আপনার?
-এক কাপ গরম চা। আমার মাথাটা ব্যথা করছে। বোধহয় চা খেলে ভালো লাগবে।
.
তানিশা তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে আসলো। দ্রুত চা বানিয়ে নওয়াজের কাছে ছুটে যায় সে।
নওয়াজ তাকে দেখে উঠে বসে। সময় নিয়ে চা পান করে শুয়ে পড়ে। তানিশা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখলো নওয়াজের চোখ পেয়ে পানি পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। ব্যথার যন্ত্রণায় নওয়াজ ছটফট করছে।
তানিশা নিজের রুমে এসে একটা টাইগার বাল্ম নেয়। এরপর নওয়াজের কাছে এসে তার মাথার কাছে বসে পড়ে৷ মাথায় তা লাগিয়ে দিতে থাকলে নওয়াজ বলল, কী করছ?
-মাথা টিপে দেব৷ ভালো লাগবে।
-মা কে পাঠাও। তুমি যাও।
-আমি আপনার সাথে রোমান্স করছি না যে আপনার লজ্জা লাগবে। মাথা টিপি দিচ্ছি জাস্ট। এই সামান্য কাজে মা কে কেনো দরকার?
-বকবক করে আমার মাথা খেওনা। এমনিতেই ব্যথা করছে।
-আমি শুরু করেছি? চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আমার কাজ আমায় করতে দিন।
.
আসলেই তানিশার হাতের ছোঁয়াই নওয়াজের মাথাটা হালকা হয়ে যাচ্ছে। সে আরামে চোখ বুজে নেয়। আড়াল থেকে সেই দৃশ্য দেখে নওয়াজের মা এর চোখে পানি চলে আসে। দুটিকে কত ভালোই না মানিয়েছে। সারা জীবন যদি তারা একসাথে থাকতো!
.
.
বুশরা বাড়ি প্রবেশ করতেই তায়শা তাকে আটকালো। সে ব্যঙ্গ করে বলল-
ভেবেছিলাম তোমায় আসতেই দেবে না নিহির।
-তিনি বাসায় ছিলেন না।
-নাহলে বুঝি আটকাতেন?
.
এই বলে হাসলো তায়শা। বুশরাও মুচকি হেসে বলল, সে তো তোকেও আটকায়নি। কই! আমি তো এভাবে হাসিনি! বরং তোর দুঃখে দুঃখ পেয়েছিলাম।
-দুঃখ পেয়ে নিহিরকে বিয়েই করে নিচ্ছ?
-করিনি তো! একবারও আমি বলেছি তাকে বিয়ে করব বা করতে চাই? তিনি বলেছেন। আর সেইজন্য দায়ী তুই নিজেই।
-তুমি কী চাচ্ছ? চুপচাপ তোমাদের লীলা খেলা দেখে যাব আমি?
-লীলা খেলা আর আমি! ওটাই তুই ভালো খেলতে পারিস বোন। আমার চাওয়া না চাওয়া তে কী আসে যায়? আমি তো চাই তুই এখন এসব খেলা-টেলা বাদ দিয়ে ভালো হয়ে যা। আর অন্যের লাইফ নিয়ে পড়ে না থেকে নিজের লাইফটা গোছানো শুরু কর।
.
এই বলে বুশরা ভেতরে চলে যায়। তায়শা রাগে গিজগিজ করতে করতে বলল-
আচ্ছা তাই! আমি তো ভালো হব না। যতদিন না তুমি আমাকে ভালো হতে দিচ্ছ ভালো আমি হব না। তোমাকেও দেখে নেব আমি।
.
পেছন থেকে এসব শুনে নাফিশা বলল-
এর আগেও তুই বুশরা আপির নামে আজেবাজে কথা বলে ওর ভালোবাসাটা ছিনিয়ে নিয়েছিস। এসব করে নিজেরই ক্ষতি হয়েছে তোর। হয়নি? তবুও তোর শিক্ষা হবে না?
.
নাফিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুশরার কাছে যায় তাকে শান্তনা দিতে।
তায়শা কিছু একটা ভেবে তার পিছু নেয়।
নাফিশার সাথে সেও বুশরার পাশে এসে বসলো। বুশরার চোখে পানি। তায়শাকে দেখে চোখের পানি লুকোনোর চেষ্টা করলো সে। আর অভিমানী স্বরে বলল, আবার কেনো এসেছিস?
-ক্ষমা চাইতে।
.
নাফিশা ও বুশরা দু’জনেই অবাক চোখে তায়শার দিকে তাকালো। তায়শা বলল, আসলে আমি রাগ থেকে এসব বলেছি। এখন তো তুমি ফোনটাও ফেরত দিয়ে এসেছ। আর কোনো রাগ আমার মধ্যে নেই। যা করেছি তার জন্য লজ্জিত। সবটা নিহিরকে পাওয়ার জন্য করেছিলাম। এখন ওসব থেকে সরে আসতে চাই আমি। প্লিজ আপু মাফ করে দাও। আগের মতো হয়ে যাই আমরা। প্লিজ?
.
তায়শার কথা শুনে বুশরার নরম মনটা সহজেই গলে গেল। বোনকে আদরে জড়িয়ে ধরলো সে। তায়শাও গভীর মমতা অনুভব করলো বুশরার প্রতি।
সে যা করতে চলেছে তা সঠিক না কী ভুল তা সে জানেনা। শুধু জানে, এতে করে বুশরা নওয়াজকে ফিরে পাবে আর তায়শা নিহিরের মনে জায়গা করার আরেকটা সুযোগ পাবে! আর এইজন্য বুশরার সাথে ভালো হয়ে যাওয়াটা তার প্রয়োজন ছিল। নাহলে কাজটা করতে তার কষ্ট হবে।
.
.
নওয়াজের ঘুম ভাঙে সন্ধ্যায়। আজ সারাটা দিন ঘুমিয়েছে সে। ঘুম ভাঙতেই উঠে বসলো নওয়াজ। মাথাটা হালকা লাগছে তার। ব্যথা একেবারেই চলে গেছে। কী অসহ্য যন্ত্রণা টায় হচ্ছিল!
হঠাৎ তানিশার আগমন ঘটলো। নওয়াজকে উঠে বসতে দেখে সে বলল-
এখন কেমন লাগছে?
-ভালোই।
-ব্যথা আছে?
-নাহ নেই।
-চা দিই?
-ভালো হয়।
-খিদে পায়নি? খাননি কিছু।
-পেয়েছে কিছুটা।
-আচ্ছা। নাস্তা রেডি করে রেখেছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।
.
তানিশা চা নাস্তা টেবিলে সাজায়। এরপর রান্নাঘরে গিয়ে রাতের খাবার তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
নওয়াজ ফ্রেশ হয়ে আসলে তার মা বলল-
মেয়েটা সারাদিনে কতবার যে তোর রুমে গিয়ে উঁকি মেরেছে!
.
নওয়াজ ভ্রু কুচকে বলল-
কেনো?
-তুই উঠেছিস কি না, কোনোকিছুর প্রয়োজন কি না; তোর খারাপ লাগছে কি না এসবের জন্য। কতক্ষণ তোর মাথা টিপেছে জানিস! তুই তো ঘুম। পরে আমি গিয়ে নিয়ে আসলাম ওরে। এরপর আবার নাস্তা তৈরী করে রেখেছে।এখন গেছে রাতের খাবার রান্না করতে। সারাদিন কিছু খাসনি বলে তোর প্রিয় রান্না করতে গেল। যাতে পেট ভরে খেতে পারিস।
-এসবের কোনো প্রয়োজন নেই মা। এত মায়া বাড়িও না। তিন মাস শেষ হলেই সব শেষ।
.
কথাটি শুনে তার মুখে অন্ধকার নেমে এলো। এই ছেলের মন কী গলবে না কখনো!
.
.
নিহির বাসায় এসে জানলো, বুশরা তার ফোন ফেরত দিয়ে গেছে। সেনোয়ারা বেগম ফোনটি নিহিরের তাকে দিয়ে চলে গেলেন।
ফোন হাতে নিয়ে অভিমানি চোখে তাকিয়ে রইলো নিহির। বুশরা তাকে ফোন ফেরত দেবে এটা অন্তত জানাতে পারতো! সে এমনটা করেনি। হয়তো কোনো সমস্যা পড়ে সে এটা করেছে। কিন্তু তার সমস্যা কী তা নিহিরকে জানানো যায় না? এখনো কী এতটুকুও সে বুশরার আপন হয়ে উঠতে পারেনি?
.
.
রাতে তায়শার ফোন পেয়ে নিজের রুমের বারান্দায় চলে আসে নওয়াজ। তায়শা বলল, সব ঠিকঠাক। ওর কাছে ফোনও নেই। আপনি কখন কাজটা করতে পারবেন?
-যত দ্রুত সম্ভব আমি করতে চাই। যদিও কিডন্যাপের মতো কাজ আমি প্রথমবার করতে যাচ্ছি, কিন্তু ভালোবাসার মানুষকেই তো কাছে আনব তা ভেবে সাহস পাচ্ছি। যাই হোক, বুশরাকে কিন্তু গাড়ি অবধি তোমাকেই আনতে হবে।
-হ্যাঁ আনব আমি। কিন্তু বাকি কাজ আপনার।
-তবে কাল বিকেলে প্লান করো।
-শিওর?
-হু। ওকে কাছে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছে আর দমিয়ে রাখতে পারছি না। কিছুদিনের জন্য দু’জনে অনেক দূরে চলে যাব।
-ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি। আপনিও তৈরী হয়ে নিন। কাল কথা হচ্ছে।
.
রাতের খাবারের পর নওয়াজের জন্য গরুর দুধ গরম করে তার রুমে এসেছিল তানিশা। তার শরীর খারাপ বলে নিজে বের হয়ে গরুর দুধ খুঁজে এনেছে সে।
কিন্তু এখানে এসে তায়শার সাথে নওয়াজের ফোনে কথোপকথন শুনে ফেললো তানিশা। সে টেবিলের উপরে দুধের মগটা রেখে নিজের রুমে চলে আসে।
ধপাস করে বিছানার বসে পড়ে সে।
নওয়াজের মন পেতে এই ক’দিন কী না করেছে সে! কিন্তু কী হলো? ফলাফল শূন্য। তানিশার ভালোবাসার কোনো মূল্যই তার কাছে নেই। বুশরাতেই আঁটকে আছে সে। তাই তো তাকে কিডন্যাপ করে হলেও পেতে চায় নওয়াজ। এসব ভেবে কাঁদতে থাকে তানিশা। কী করবে বুঝতে পারে না সে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে সকালে। ঘুম ভাঙতেই এক লাফে উঠে বসে তানিশা। বুশরার বলা কথাগুলো মনে পড়ে তার। বুশরা তো নওয়াজকে চায় না এখন। তাকে জোর করা নওয়াজের উচিত হচ্ছে না। তানিশা যখন সত্যিটা জেনেছে বুশরাকে তার জানানো প্রয়োজন। এই ভেবে বুশরাকে ফোন দেয় তানিশা। ফোন বন্ধ পেয়ে হতাশ হয় সে। এরপর সোজা চলে যায় ছাদে। সেখানে সে পায়চারি করতে থাকে, যদি বুশরার দেখা পায়!
বুশরার ফোনে হয়তো চার্জ শেষ। এই ভেবে তাকে মেসেজ পাঠিয়ে দেয় তানিশা। সে লিখলো-
জরুরী কথা আছে। আপনাকে কিডন্যাপের প্লান করেছে তায়শা ও নওয়াজ। প্লিজ বাড়ির বাইরে যাবেন না। আর আমার সাথে দ্রুত যোগাযোগ করুন।
.
মেসেজটা পাঠিয়ে কিছুটা শান্তি অনুভব করলো তানিশা। কিন্তু আফসোস! সে জানেনা বুশরার ফোন তার কাছেই নেই এবং তা আর চালু হবে না!
.
চলবে#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৩৩
#Saji_Afroz

অস্থির সময় পার হচ্ছে তানিশার৷ বুশরা তার ফোন এখনো চালু করেনি। আজই ফোনটা বন্ধ থাকতে বলল?
একবার ভাবলো, বুশরার বাসায় যাবে সে। মনে মনে এটাই ঠিক করে নিলো। যদিও কখনো ও বাড়ি সে যায়নি। যায়নি বলে যে কখনো যেতে পারবে না এমনটা না! আজ যাবে। বুশরার বাসায় গিয়েই তাকে সবটা খুলে বলার সিদ্ধান্ত নেয় তানিশা।
সে মনে মনে দুপুরের সময়টাকে নির্ধারণ করে রাখে বুশরার বাসায় যাওয়ার জন্যে।
.
.
বুশরা, তায়শা ও নাফিশা অনেকদিন পর একইসাথে একই রুমে ও একই বিছানায় ঘুমিয়েছে। সবকিছু আগের মতো হয়ে গেছে দেখে বুশরা ভীষণ আনন্দিত।
তায়শার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তার মায়া হলো। কী মিষ্টি মেয়েটা! লোভে পড়ে এসব করে ফেলেছে সে। কিন্তু মেয়েটা এটাই বুঝলো না, এই রূপ নিয়ে লোভ নয় একটা ভালো মন তৈরী করার প্রয়োজন ছিল। তাতে করে সে যা চায় তার দ্বিগুণ পেত। আফসোস! মেয়েটা তা বুঝলো না। তাই প্র‍থমে আশিক ও পরে নিহিরের মতন কাউকে হারালো।
নিহিরের কথা মনে পড়তেই বুশরার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
প্রতিদিন একবার হলেও নিহির ফোন দিয়ে তার খবর নিতো। এখন সেটা আর হয়ে উঠবে না।
কাল রাগ করে ওভাবে হুটহাট ফোন ফেরত দিয়ে আসাটা তার উচিত হয়নি। অন্তত নিহিরকে একটা ফোন করে সব জানাতে পারতো। নিহির নিশ্চয় মনে কষ্ট পেয়েছে!
.
এই ভেবে বুশরা শোয়া থেকে উঠে বসলো। আজ ভালো ঘুম হয়েছে তার। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসে নাস্তা বানাতে শুরু করলে তায়শা আসলো। তাকে দেখে বুশরা বলল, তুই এত সকালে? তাও আবার রান্নাঘরে!
-কী নাস্তা বানাবে?
-ভাবছি পরোটা করি। কাল রাতের আলু ভাজি আছে।
-আমি পরোটা বানানো শিখব। শেখাবে?
.
বুশরা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল-
এই আমি কাকে দেখছি!
-আরে শিখতে হবে না! আর তুমি একা একা কত দিনই বা করবে? তাছাড়া তোমার বিয়ের কথা চলছে। বিয়ে হয়ে গেলে আমাকে আর নাফিশাকে তো মা কে সাহায্য করতে হবে। জানো? যখন তুমি ছিলে না মা এর কত কষ্ট হয়েছে!
.
নাফিশা ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল-
কি যে হয় এই তায়শা আপুর। আমাকেও ডেকে দিলো আজ।
.
তাকে দেখে বুশরা হেসে বলল-
তুইও এসেছিস!
.
তায়শা বলল-
হু। কারণ আজ আমরা তিন বোন মিলে সকালের নাস্তা বানাব। এই আপি আমি কিন্তু ভালো ডিম ভাজি করতে পারি। সবার জন্য ডিম ভাজি করব।
.
নাফিশা বলল-
আর আমি বানাব চা।
.
এই বলে সবাই কাজে লেগে পড়লো।
এসব দেখে বুশরার চোখে কোণায় পানি চলে আসলো। তার বোনেরা বড় হয়ে যাচ্ছে!
.
.
নওয়াজের মা ভেবেছিলেন, সকালের নাস্তাটায় তানিশায় বানাবে। যেহেতু এই কয়েকদিন সমস্ত কাজ সেই সামলাচ্ছে। কিন্তু বেলা করে ঘুম থেকে উঠেও রান্নাঘরে এসে কোনো নাস্তা বা তানিশাকে না দেখে চিন্তিত হলেন তিনি। তার রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন শরীর ঠিক আছে কি না তা দেখার জন্য। এসে দেখলেন তানিশা রুমের মাঝে পায়চারি করছে।
তিনি বললেন, তোর শরীর ঠিক আছে?
.
খালাকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো তানিশা। তিনি অবাক হয়ে বললেন-
নওয়াজ কিছু বলেছে তোকে?
.
তানিশা তাকে ছেড়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন-
কিছু না বলেও উনি আমাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছেন। আমার থেকে আলাদা হওয়ার সমস্ত রাস্তা খুঁজে বের করছেন। আচ্ছা খালা? আমি তো বউ হয়ে উঠার চেষ্টা করেছি, তিনি কেনো একটাবার আমার বর হওয়ার চেষ্টা করলেন না?
.
এসবের উত্তর নেই তার কাছে। শুধুমাত্র ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কথা তিনি বলতে পারলেন না।
.
.
বেলা হয়ে গেছে কিন্তু নিহির অফিসে যায়নি। সেনোয়ারা বেগম এসে তার খবরাখবর নিয়ে গেছেন। নিহির শুধু জানালো, আজ যেতে তার ইচ্ছে করছে না।
কিন্তু ব্যাপারটা একটু হলেও নিখিল বুঝেছে। হয়তো বুশরা ফোন ফেরত দেওয়াতে ভাই এর মন খারাপ।
মন তো নিখিলেরও খারাপ। নাহলে এত তাড়াতাড়ি তার ঘুম ভাঙে! চিন্তায় ঘুমোতে পারে না সে। বারবার মনেহচ্ছে বুশরাকে মনের কথা জানাতে। কী যে করবে সে!
.
নিহির অনেকক্ষণ যাবত বুশরার ফোনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিছু একটা ভেবে সে ফোনটা চালু করলো। নিহির দেখলো, বুশরার কন্টাক্ট লিস্টে তার নাম্বার ছাড়া আর কারও নাম্বারই নেই! এতে করে অবাক হয় নিহির।
গ্যালারি ঘুরেও কোনো ছবি নিহির পেল না। অবশ্য ছবিসহ ফোন তাকে দেবে না এটা জানে নিহির।
কী মনে করে মেসেজ অপশনে যায় নিহির। সাথে সাথেই তানিশার পাঠানো মেসেজটা পায় সে। যা দেখে চমকে উঠলো নিহির৷
সে সাথে সাথেই তানিশাকে কল ব্যাক করে। সবটা তার জানা প্রয়োজন। এদিকে তানিশা বুশরার ফোন পেয়ে আনন্দিত হয়ে উঠে। কিন্তু কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয় সে। পরিচয় জানতে চাইলে নিহির বলল-
দেখুন বুশরার ফোন আমার কাছে। সব কথা তো আর বলা এখুনি সম্ভব না। আপনি আমাকে প্লিজ সবটা খুলে বলুন। আমি বুশরাকে কিডন্যাপ হতে দিতে পারি না।
.
অপরিচিত এই ব্যক্তিটিকেই ভরসা করতে হলো তানিশাকে। তার কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে, বিষয়টা নিয়ে কতটা চিন্তিত সে!
তানিশা তাকে সবটা খুলে বলল। নিহির বলল-
গাড়ি কোন জায়গায় দাঁড়াবে এটা জানেন?
-এটা আমি জানিনা ঠিক।
-প্লিজ যেভাবেই পারুন তা জানার চেষ্টা করুন। বাকি সব আমি ম্যানেজ করব। নওয়াজ ও তায়শার এই প্লান ভেস্তে দেব আমি।
-জি আমি চেষ্টা করছি।
.
ফোন রেখে পেছনে ফিরে নিখিলকে দেখে উত্তেজিত হয়ে সব খুলে বলল নিহির। নিখিল বলল-
সবই বুঝলাম। কিন্তু তুমি কেনো এতটা উত্তেজিত হচ্ছ ভাইয়া?
-আমি বুশরাকে কিডন্যাপ হতে দিতে পারি না।
-কেনো?
-কারণ ওকে আমার চাই।
.
কথাটি বলে থেমে যায় নিহির। মুখ ফসকে এ কী বলে ফেললো সে। নিখিল মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো-
ভালোবাসো তাকে?
.
নিহির কিছু বলল না। নিখিল ভাই এর কাঁধে হাত রেখে বলল-
বুশরার মতো মেয়েকে হারাতে দিও না। ওদের হাত থেকে ওকে বাঁচিয়ে নিজের করে নাও।
.
এই বলে নিখিল ভাই এর রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ভীষণ হালকা লাগছে তার।
তার জন্যই তো এই ভাইটা তায়শাকে কিডন্যাপ করার প্লান করেছিল। তার খুশির জন্য নিহির সব করতে পারে। চাইলে সে তায়শাকেই বিয়েটা করে ফেলতে পারতো। কিন্তু করেনি। ভাইকে কষ্ট দিয়েছে বলে তাকে ক্ষমা করেনি নিহির। আর এমন ভাই এর জন্য এতটুকু নিখিল করতে পারবে না? অবশ্যই সে পারবে। বুশরাকে ভুলে যাবে সে। এসব ভুলে এই জীবনে সেও কিছু করতে চায়। দেশের বাইরে গিয়ে ভালো কিছু করতে চায় নিখিল। এরপরেই বিয়ে-সাদির ভাবনা মাথায় আনবে এর আগে নয়।
.
.
নওয়াজ ঘুম থেকে উঠার পরেই তার রুমের পাশে ঘুরঘুর করছে তানিশা। সে জানতে পারলো, নওয়াজ একটি গাড়ি ভাড়া করেছে। গাড়িওয়ালাকে সে তার বাড়ির ঠিকানা দিলো। পরক্ষণেই তায়শাকে ফোন দেয় নওয়াজ। তাকে জানায় মেসেজে ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছে।
এই বলে নওয়াজ গোসল সারতে গেলে তানিশা তার রুমে আসে। ফোনে লক দেখে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তানিশার। কিছুক্ষণ ভেবে সে পাসওয়ার্ড ‘বুশরা’ লিখে চেষ্টা করলো। সাথে সাথেই লক খুলে যায়!
পাগল প্রেমিক যে এই কাজই করবে ধারণা করেছে তানিশা। জলদি ফোন থেকে তায়শাকে পাঠানো ঠিকানাটা নিয়ে নেয় সে। এরপর পাঠিয়ে দেয় নিহিরকে।
নিহির তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলো-
বাকি কাজ আমার!
.
.
-কেনো না করছিস আপি? তোকে আমার সাথে যেতেই হবে।
.
নাফিশার জন্মদিন সামনে। তায়শা তার জন্য উপহার নেবে। তাই সাথে বুশরাকেও যেতে বলছে। কিন্তু বুশরার শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। তাই সে যেতে নারাজ। আগামীকাল যাওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু আজই তো সব প্লান করলো তায়শা। আগামীকাল হলে নওয়াজের অসুবিধে হবে। গাড়ি অবধি ঠিক রেখেছে সে। তায়শা বায়না করতে লাগলো বুশরার কাছে আজই যাওয়ার জন্যে। সে বলল-
আমার খুব বের হতে মন চাচ্ছে। চল না প্লিজ! তোমারও ভালো লাগবে।
.
তায়শার জোরাজোরিতে বুশরা যেতে রাজি হয়। আর এই সুখবর তায়শা জানিয়ে দেয় নওয়াজকে।
.
.
বিকালে বুশরাকে নিয়ে বেরুই তায়শা। প্রথমে তারা শপিং করে নেয়। এরপর তায়শা বুশরাকে জানায়, এই শপিংমল এর পেছনে একটা ফুচকার দোকান খুলেছে। ওখানে ফুচকা খেতে যাবে তারা।
.
বুশরা জানতো না পেছন সাইডটা একেবারেই ফাঁকা। তাই সে তায়শার সাথে সেদিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু এখানে এসে আশেপাশে কোনো দোকান বা মানুষ না দেখে বুশরা বলল-
একেবারেই নির্জন জায়গাটা।
-দোকান ছিল আপি। দাঁড়াও আমি খবর নিই। তুমি এখানেই থাকো।
.
এই বলে তায়শা সরে যায়। একটু বাদেই বুশরা অনুভব করলো, কেউ পেছন থেকে তার মুখ চেপে ধরেছে! চারপাশ ঝাপসা দেখছে সে। এরপর আর কিছু অনুভব করতে পারে না সে। বুশরা জ্ঞান হারালে সেখানে একটি গাড়ি এসে উপস্থিত হয়। তাকে গাড়িতে তোলা হয়। আচমকা তায়শা এসে পড়ে। সে নিহিরকে দেখে চমকে উঠে বলল, তুমি!
-হু আমি।
-বুশরা আপি কোথায়?
-যেখানে থাকা উচিত সেখানেই যাচ্ছে।
.
গাড়ির ভেতরে তাকিয়ে তায়শা বলল-
তুমি আবারও তাকে কিডন্যাপ করছ?
-সেইবার ভুলে করেছিলাম। এইবার ইচ্ছেকৃত ভাবে করছি।
.
তায়শা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল-
এত ভালোবাসা! ক’দিন আগে আমাকেও বাসতে৷ সেটাও কিন্তু ফুরিয়ে গিয়েছিল।
-এইবার ফুরাবে না। কারণ আমি তোমার সৌন্দয্যের প্রেমে পড়েছিলাম। এটা ছাড়া তো আর কোনো গুণ তোমার মধ্যে বিদ্যমান নেই। তাই অতি সহজেই ভুলে গেছি। আর এখন আমি বুশরার মায়ায় পড়েছি, তার ব্যক্তিত্ত্বের প্রেমে পড়েছি। তাই তার কাছেই আজীবন আঁটকে রইবো আমি।
.
এই বলে নিহির গাড়িতে উঠে বসে চালাতে শুরু করে। তায়শা চিৎকার করে গাড়ির পেছনে ছুটতে থাকে এতে কোনো লাভ হবে না জেনেও!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here