সেই তো এলে তুমি পর্ব -৩৬ ও শেষ

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৩৬
#শেষপর্ব
#Saji_Afroz

কিছুদিন পর…
তায়শার জন্যে গরম স্যুপ করে নিয়ে এসেছে বুশরা। তাকে তা খাইয়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলে তায়শা তার হাত ধরে ফেলল। নিজের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তায়শাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো বুশরার। তবুও সে নিজেকে সামলে শুধু জিজ্ঞাসা করলো-
কিছু বলবি?
-এখন তো ক্ষমা করে দাও আমায়। মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছি। ভাগ্যিস মাইক্রোবাস কন্ট্রোল করতে পেরেছিল। যার কারণে বিভিন্ন স্থানে ক্ষত ছাড়া বড়ো কোনো আঘাত হয়নি।
-হাতে এখনো ব্যান্ডেজ করা।
-হাত টা কাটতে হয়নি এটা বেশি নয় কী?
-আবোল তাবোল কথা বলছিস কেনো?
-এমন কিছু হলেই মনেহয় ভালো হত। তোমাদের ক্ষমা পেতাম। আসলে আমি মরে গেলেই ভালো বেশি হত।
.
এইবার আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলো না বুশরা। তায়শাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
ফালতু কথা একদম বলবি না।
-তাহলে কী করব? এতবড়ো একটা এক্সিডেন্ট থেকে আসার পরেও তুমি আমার সাথে ভালো করে কথা বলছ না। মরে গেলে তো ঠিকই দুঃখ পেতে।
-তুই এতদিন রেস্ট এ ছিলি। আমি কী বকবক করব বল? তাছাড়া আমি ভাবতাম আমার সঙ্গ তোর পছন্দ হবে না।
-এমনটা না আপি। আমি তোমায় জেলাস করি না। যা করেছি নিহিরের জন্য। এখন তো আমাদের মাঝে ওই টপিক টা নেই। আমারও আর রাগ নেই।
-শুধু সেই টপিক কেনো। তোর সবকিছু বাদ দিতে হবে। নিজের উপরে ভরসা রেখে পড়াশোনা চালিয়ে যা। এত সুন্দর একটা মেয়ে তুই। দেখবি তোর নায়ক এমনিতেই চলে এসেছে। এত কারসাজি করার দরকার নেই। আজ যদি এই এক্সিডেন্টে তোর বড়ো কোনো ক্ষতি হত তবে কোনো ভালো ছেলে তোকে সঙ্গ দিতো? দিতো না। বরং সবাই এড়িয়ে চলতো। এখনো সময় আছে তায়শা নিজেকে শুধরে নে। আল্লাহ তোকে নতুন একটা জীবন দিয়েছে।
.
এই বলে বুশরা বেরিয়ে যায়। তায়শা তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল। এবং তা নিয়ে ভাবছে। আসলেই তো! সে আজ দুনিয়াতে নাও থাকতে পারতো। এত সুন্দর জীবনটাকে সে আর নষ্ট হতে দিতে পারে না। এসব থেকে দূরে সরে আসতে হবে তাকে। আর পাপের প্রায়শ্চিত্তও করতে হবে। হোক সেটা নিখিলের বলা কথাটি রাখার মাধ্যমে। কেননা সে গতকালই নাফিশা ও বুশরার কথোপকথন শুনেছিল। তারা ভেবেছিল তায়শা ঘুম। নাফিশা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, নিহিরকে তার মনে পড়ছে কি না।
বুশরা সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলেছিল, তার নাম যেন আর না নেওয়া হয়।
.
এতটুকুতেই তায়শা বুঝেছে নিহিরের প্রতি বুশরার ভালোবাসা। যা নাফিশার কাছ থেকে আড়াল করার জন্যে কোনো জবাব সে দেয়নি।
দু’জন ভালোবাসার মানুষকে এইভাবে সে কষ্ট দিতে পারে না। ভুল তো তাদের নয়। ভুলটা তায়শার নিজেরই। তার স্বভাবের জন্যই নিহির তাকে ছেড়ে বুশরার প্রেমে পড়েছে। বুশরাও নিজের অজান্তেই তাকে মন দিয়ে ফেলেছে। অন্তত এটা সে বিশ্বাস করে, তায়শা যদি নিহিরের হত তবে কখনোই বুশরা সেদিকে ফিরেও তাকাতো না!
.
.
আরও কিছুদিন কেটে যায়। বুশরা নিজেকে অনেকটা স্বাভাবিক করে নেয় এই কয়েকদিনে। বাবার পছন্দকে গুরুত্ব দিতে চায় সে। কিন্তু কেন যেন মন মানছিল না। অনেক কষ্টে মনকে মানাতে বাধ্য হয় সে। বারবার একটা কথাই সে স্মরণ করেছে। পিতা-মাতা সন্তানের জন্য যা করেন তা মঙ্গলের জন্য করেন। তাদের খুশি রাখলে মহান আল্লাহও খুশি হোন। তাই বুশরা বাবার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেবে ঠিক করেছে। আর আজ তাকে দেখতে আসবে। এই প্রথম কোনো পাত্রের সামনে যাবে বুশরা।
হালকা বেগুনী রঙের সাধারণ কাজের একটা গাউন পরেছে সে। ওড়নাটা মাথায় দেওয়ার কারণে দেখতে আরও ভালো লাগছে তাকে। বুশরা সাজতে পছন্দ করে না। কিন্তু নাফিশার জোরাজোরিতে সামান্যতম হলেও আজ সাজতে হয়েছে তার।
মেহমানদের জন্য নানা আয়োজন করেছেন তার বাবা। আলিয়া খাতুনকেও বেশ আন্তরিক দেখাচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে দেখে ভালোই লাগছে বুশরার। বাবা থাকতে থাকতেই সম্মানের সাথে অন্য বাড়ি যাওয়া তার জন্য শ্রেয়।
অবশেষে পাত্রপক্ষ চলে আসলো। নাফিশা তাকে নিতে আসলে সে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু চলতে গিয়েও থেমে যায় সে। আবার সেই পিছুটান! কেনো! এই মুহুর্তেই কেনো তার নিহিরকে মনে পড়ছে!
এ ক’টা দিন নিহির তার সাথে কোনো যোগাযোগের চেষ্টা করেনি। অবশ্য কোনো সুযোগও ছিল না। বড়োলোকের কাছে বুশরা কী আশা করে? এ বাড়ি এসে তাকে রাজি করাবে? এসব কেবল দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু না।
নিজেকে প্রস্তুত করে আবারও কেনো এই সময়টাতেই অপ্রস্তুত মনেহচ্ছে বুশরার!
.
-কী হলো আপি?
.
নাফিশার ডাকে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে বুশরা। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে তার সাথে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে যায় সে।
মাথা নিচু করে সে পাত্রপক্ষের সামনে আসলো। একটা মহিলা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো সে-
কেমন আছ মা বুশরা?
.
তার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই আরও অবাক হয় সে। সেনোয়ারা বেগম এখানে! আর ঠিক পাশেই বসে আছে নিহির।
বুশরা তাকে সালাম জানিয়ে বলল-
আপনারা?
.
তিনি বুশরার সামনে এসে নিজের গলায় থাকা চেইনটি খুলে তাকে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন-
আমরা তোমার জন্যই এসেছি। নিহিরের বউ বানাতে চাই তোমাকে।
.
বশর হেসে বললেন-
এই হলো আমার পছন্দের পাত্র। তোরা চাইলে একে অপরের সাথে কথা বলতে পারিস। তোদের সম্মতি ছাড়া কিছুই হবে না।
.
বুশরা কথা বলতে রাজি হলে তাদের আলাদা রুমে নেওয়া হলো। বুশরা রাগী কণ্ঠে বলল-
আপনাকে নিষেধ করার পরেও কেনো এমনটা করতে গেলেন?
-বিয়ে তো ঠিকই করছ দেখছি, আমাকে করলে ক্ষতি কী?
.
এই প্রথম নিহির বুশরাকে তুমি করে বলেছে। বিষয়টা খেয়াল করেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বুশরা বলল-
আপনি জানলে কখনোই করতাম না।
-কেনো?
-দেখুন এতকিছু আমি বলতে পারব না। এই বিয়েটা আমি করতে পারব না।
.
নিজের গলা থেকে চেইন খুলে নিহিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
এটা নিয়ে যান।
-এটা আমি দিইনি। যে দিয়েছে তাকেই দিও। ফ্যামিলি গতভাবে এসেছে ফ্যামিলি গত ভাবেই তুমি তোমার মতামত জানাও।
-আমি জানিয়ে দিচ্ছি।
-তোমার কাছে আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই?
-আপনি আমায় ভালোবাসবেনও কেনো? কী আছে আমার মাঝে! তায়শার ধারে কাছেও আমি পড়িনা।
-শুধু রূপ কী গুণ হয় মানুষের? তোমার কাছে যা কাছে তায়শার কাছে কেনো, কোনো মেয়ের মাঝে আমি দেখিনি। তাই তো তোমাকেই আমার চাই।
-কিন্তু আমি আপনাকে চাই না।
-এইভাবে না করতে পারছ আমাকে?
.
বুশরা আর কিছু বলল না। নিহির বলল-
ঠিক আছে। তুমি যা চাও তাই হবে। আমি আর তোমার কাছে আসার চেষ্টা করব না।
.
এই বলে নিহির বেরিয়ে যায়। বুশরা চেয়ে থাকে তার পথের দিকে। এটা কী করলো সে! নিহিরকে ফিরিয়ে দিয়ে এত কেনো খারাপ লাগছে তার! তার মানে সে নিহিরকে ভালোবেসে ফেলেছে?
.
.
নিহির বাসায় প্রবেশ করলে তার মলীন মুখ দেখে নিখিল বলল-
মুখ এমন হয়ে আছে কেনো?
.
সেনোয়ারা বেগম বললেন-
তখন থেকে আমিও এটা জানতে চাইছি।
.
নিহির শান্তস্বরে বলল-
বুশরা বিয়ে করতে চায়না আমায়।
.
নিখিল অবাক হয়ে বলল-
কেনো?
-এত ঝামেলার পর সে এ বাড়ি আসতে চায়না।
.
সেনোয়ারা বেগম বললেন-
ওর অভিমানের জায়গাটা আমি বুঝছি। কিন্তু এতে তোমার দোষ কোথায়? দোষ তার নিজের বোনের।
-এটাই সমস্যা। এই দোষের ভয়েই হয়তো গুটিয়ে রয়েছে বুশরা। সে চায়না তায়শা নতুন করে আর কোনো অন্যায় করুক।
.
.
-আপি এটা তুমি কেনো করলে?
.
নাফিশার করা প্রশ্নে বুশরা জবাব দিলো-
তায়শার জন্য। আমি চাইনা আমার আর নিহিরের বিয়ের কথা শুনে সে আবার কোনো ঝামেলা করে নিজের ক্ষতি করুক। হাজার হোক, সে আমার বোন। ও কতটা জেদি আমি জানি। সেইজন্য আমি না করলাম এখন বাবাকে। নিহির স্যারকেও বলেছি। তবে সেনোয়ারা আন্টিকে এখানেই না করলে তাকে অসম্মান করা হত। পরে চেইনটা ফেরত পাঠাব। তবে নাফিশা আমি একটা কথা বুঝছি না, বাবা কীভাবে চেনে নিহিরকে? আর ফুফুই বা এত শান্ত কীভাবে রইলেন?
-তায়শার জন্যে।
.
পেছনে ফিরে বাবাকে দেখে যতটা না অবাক বুশরা হয়েছে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে তার বলা কথাটি শুনে। বুশরা বলল-
মানে?
.
তিনি ভেতরে এসে বললেন-
সেদিন তায়শা আমাকে সব খুলে বলে। নিহিরের ব্যাপারে বলে। এর আগে সে নিহিরের সাথে যোগাযোগ করেছিল। নিহির তোকে বিয়ে করতে চায় আর তায়শার মতে তুইও না কি ওকে পছন্দ করিস। এইজন্যই তায়শা আমার আর নিহিরের কথা বলিয়ে দেয়। আমারও বেশ ভালো লাগে ছেলেটাকে। তাই এইভাবে তোকে সারপ্রাইজ দিলাম। কিন্তু তুই দেখছি না করে দিচ্ছিস। এমনটা করার কারণ তায়শা? সে তো নিজেই সব ঠিক করলো।
.
বুশরা কী বলবে বুঝে উঠে না পেরে তায়শার কাছে ছুটে গেল। নাফিশা হেসে বশরকে বলল-
এইবার দুই বোনের মধ্যে সব মনোমালিন্য দূর হবে।
.
তায়শা সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। মেডিসিন চলার কার‍ণে তার ঘুম বেশি হচ্ছে। অবশ্য এমনিতেও ঘুমোতে ভালোবাসে তায়শা।
নিজের দিকে এভাবে অপলকভাবে বুশরাকে তাকিয়ে দেখে তায়শা বলল-
কী হয়েছে? এইভাবে তাকিয়ে আছ যে?
.
বুশরা তার পাশে বসে বলল-
বাবাকে কী বলেছিস তুই?
-কোন বিষয় এ?
-নিহিরের।
-ওহ! যা সত্যি তাই বললাম।।সে তোমাকে পছন্দ করে আর তুমি তাকে।
-আমি করি তোকে কে বলল?
-সব কথা মুখে বলতে হয় না। সারপ্রাইজ কেমন দিলাম? বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলো?
-নিষেধ করে দিয়েছি।
-কেনো?
-আমি চাইনা বাইরের কারও জন্য আমাদের মাঝে আর কোনো ঝামেলা হোক।
.
তায়শা বুশরার হাত ধরে বলল-
সত্যিকারের ভালোবাসাকে কখনো ঠেলে দিতে নেই। আমি আশিককে ঠেলে অনেক বড়ো ভুল করেছি। আজ বিয়েটা হয়ে যেত, অনেক সুখী হতাম। এতকিছুর পরেও সে ফিরে এসেছিল। কিন্তু আমি…
যাই হোক আপি, আমি খুব ভেবে দেখেছি। আমি যা করছি এসব পাগলামি ছাড়া কিছুই না। জোর করে কাউকে যেমন আঁটকে রাখা যায়না তেমনি জোর করে কারও মন থেকে কাউকে মুছেও ফেলা যাবে না। মনের মধ্যে আর কষ্ট চেপে রেখো না। নিহিরের কাছে যাও। এই কয়েকদিন সে কতটা কষ্ট পেয়েছে জানো? ঠিকমত খেতে পারতো না, ঘুমোতে পারতো না। ফাহমিদা আন্টির পাশে গিয়ে আবোলতাবোল বলতো।
আমায় এসব নিখিল বলেছে।
.
এসব শুনে বুশরার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। তায়শা বলল-
আমি নিজেকে বদলাতে চাই। দু’টো ভালোবাসার মানুষকে এক করা দিয়েই নাহয় আমার নতুন যাত্রা শুরু হোক!
.
বুশরা পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলো তায়শাকে৷ তায়শা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল-
তাড়াতাড়ি যাও। নাহয় দেখবে নিহিরের অবস্থাও ওর মা এর মতন হয়ে যাচ্ছে!
.
.
-বুশরাকে নিয়ে আসবে বলেছিলে? এখনো আনছ না কেনো?
.
ফাহমিদা বেগমের প্রশ্নে নিহির জবাব দিলো-
সে আসবে না। সে এখনো নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথা ভেবে চলেছে মা।
-কিন্তু তুমি বলেছিলে ওকে আনবে।
-যদি না আসতে চায় আমি কী জোর করতে পারি?
.
-আবারও কিডন্যাপ করতে পারছেন না?
.
দরজার পাশে বুশরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলো নিহির। বুশরা ভেতরে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরেন ফাহমিদা বেগম। সে ফাহমিদা বেগমের কপালে চুমু খেয়ে বলল-
এইতো এসেছি আমি।
-আমি জানতাম আমার ছেলে আমার কথা রাখবে।
.
নিহির বলল-
চেইন ফেরত দিতে এসেছ বুঝি?
-চেইনটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। এটা জানাতে এসেছি।
.
বুশরার কথা শুনে হেসে ফেললো নিহির।
সেনোয়ারা বেগম ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললেন-
মিয়া বিবা রাজি যখন কাজি ডাকতে দেরী কীসের? বিয়েটা সেরেই ফেলো এইবার।
.
লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে বুশরা। নিহির রুম থেকে বেরুতে বেরুতে বলল-
তুমিই সব ঠিক করো।
.
.
নিহিরের বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে বুশরা। ভেতরে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনি তার পথ আঁটকায় নওয়াজ। তাকে দেখে বুশরা বিরক্তভরা কণ্ঠে বলল-
পথ আটকালেন কেনো?
-সরি বলার জন্য। যা করেছি তার জন্য লজ্জিত।
.
বুশরা শান্তস্বরে বলল-
ভুল বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক। তানিশা ক্ষমা করেছে তো?
-সে তো রাগ করে সেই যে বাপের বাড়ি গেল আর এলই না।
-সে কী!
-হু। এইবার খুব বেশি অভিমানী হয়ে উঠেছে সে।
-চিন্তা করবেন না চলে আসবে। সামনে আমার বিয়ে। বিয়েতে দাওয়াত দিলে নিশ্চয় আসবে সে। তখন আর যেতে দেবেন না।
-কিন্তু তুমি কীভাবে শিওর হচ্ছ সে আসবে?
-আমি বলেছি যখন আসবে।
.
এই বলে বুশরা চলে যায়। নওয়াজ বুঝতে পারলো না, তানিশা কেনো বুশরার বিয়েতে অবশ্যই আসবে? একে অপরকে এতটাও যে চেনে এমনটাও নয়। বরং বুশরাকে এড়িয়ে চলার কথা তানিশার। কেননা নওয়াজের ভালোবাসার মানুষটি ছিল বুশরা। হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েও ব্যর্থ হয়ে যায় নওয়াজ।
.
.
দেখতে দেখতে কাঙ্ক্ষিত সেই দিনটি চলে আসলো। বুশরা ও নিহিরের বিয়ের দিন। পারিবারিক ভাবে বসেই দুই পরিবার খুব দ্রুত বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেছে।
আজ বুশরা খুব সেজেছে। লাল বেনারসি পরেছে সে। শ্যামবর্ণের মেয়েদের সাজলে অনেক ভালো লাগে এর প্রমাণ হলো বুশরা। অবশ্য নিহিরের কাছে সে এমনিতেই সুন্দর।
স্টেজে হাসিখুশি মুখ নিয়ে বসে আছে বুশরা ও নিহির। তায়শা বিয়ে বাড়ির কাজ সামলাতে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ নিখিলের সাথে ধাক্কা লাগে তার। তাকে দুঃখিত বলতেই নিখিল বলল-
ধন্যবাদ।
-কেনো?
-আমার কথাটা রাখার জন্যে।
-মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে আমি বুঝতে পেরেছি, এই জীবনটা ক্ষণস্থায়ী। কখন কী হয় বলা যায় না। কী লাভ যেটা হওয়ার না সেটার পেছনে ছুটার! কীইবা লাভ আমি যতটুক না ততটুক কোনো কষ্ট ছাড়াই পাওয়ার? যা করেছিলাম ভুল। এসব ভুলে এইবার ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে চাই। স্টুডেন্টও ওতো খারাপ না আমি।
-গুড ডিসিশন। আমিও এমনটা ভেবেছি। বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
-ওহ ফাইন!
.
স্টেজে তাকিয়ে নিখিল বলল-
ওদের দু’জনকে একসাথে অনেক ভালো লাগছে তাই না?
-হু। অনেক ভালো।
.
.
গোলাপি রঙের কাতান শাড়ি পরেছে তানিশা। তাকে দেখার পর থেকেই বারবার তার কাছে আসছে নওয়াজ। কথা বলার চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। সে নওয়াজকে এড়িয়ে চলছে।
নওয়াজ তার হাত ধরে টেনে স্টেজের পেছনে ফিরে আসে তাকে। তানিশার মুখটা চেপে ধরে বলল সে-
হুশ! এখন তো বুশরার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তবুও কী সমস্যা?
.
তানিশা নিজের মুখ থেকে নওয়াজের হাত সরিয়ে বলল-
বিয়ে হচ্ছে বলেই বুঝি আমার পেছনে ঘুরছেন?
-এর আগে থেকেই তো ঘুরছিলাম। বিশ্বাস করো ভালোবেসে ফেলেছি তো।
.
নওয়াজকে এক ঝাটকায় নিজের কাছ থেকে সরিয়ে তানিশা বলল-
দেরী হয়ে গেছে নওয়াজ ভাই!
.
.
বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। বুশরাকে বিদায়ও দেওয়া হয়েছে৷ আলিয়া খাতুন বুশরার জন্য এইবার যা করেছেন সবটায় মন থেকে। মা মরা মেয়েটা তাকেই মা মনে করতো। কিন্তু তিনিই সন্তান থাকার কারণে বুশরার কদর বুঝলেন না। এসব বলে প্রলাপ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। তাকে শান্তনা দিচ্ছে নাফিশা। তায়শার চোখেও পানি। ছোট থেকে কোলেপিঠে করে যেই বোনটা মানুষ করেছে তার বিরুদ্ধে কতই না ষড়যন্ত্র করেছিল সে। আজ তার ভালোবাসার মানুষের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিতে পেরে আনন্দিত সে।
নিহিরও তায়শার কাছে কৃতজ্ঞ। তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে অনেক আগেই। বশর তায়শার কাঁধে হাত রেখে বলল-
বোনের মতো একটা কাজ করেছ। দেখবে তুমি অনেক সুখী হবা মা।
.
তায়শা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল-
আপি যা করেছে আমার জন্য এটা তো কিছুই না।
-তুমি না বললে আমি অন্য কোথাও মেয়েটার বিয়ে ঠিক করে ফেলতাম। মেয়েটা আমার সারাজীবন চাপা কষ্ট নিয়ে থাকতো।
-এখন তো আপনি চিন্তামুক্ত?
-একদম। নিশ্চিতে বিদেশে যেতে পারব এইবার।
.
.
ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে নওয়াজ। তানিশাকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো সে। অবাক হয়ে বলল-
তুমি?
-এসেছি খুশি হওনি? না কী মনে মনে আর কাউকে পটানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলে?
-মেয়ে পটানো অনেক কষ্টের কাজ। এত সুন্দরী, ভালো বউ থাকতে ওই কষ্ট আর করতে চাই না।
.
তানিশা হাসে। নওয়াজ এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে।
-আসতেই হত। কারণ আমি আপনাকে মন থেকে ভালোবেসেছি নওয়াজ ভাই।
-আবারও নওয়াজ ভাই?
-উহু! নওয়াজ!
-এইবার ঠিক আছে। তাহলে আজ রাতে দু’টো বাসর হবে।
-মানে?
-নিহির ও বুশরার। আর তোমার ও আমার।
.
তানিশা লজ্জায় গুটিসুটি মেরে নওয়াজের বুকে মুখটা লুকোলো।
.
.
নিহিরের রুমটা ঘুরেফিরে দেখছে বুশরা। যদিও বাসর ঘর সাজানো রয়েছে। কিন্তু গুটিসুটি মেরে বিছানার উপরে বসে থাকতে তার ইচ্ছে করছে না।
এই বাড়িতে যখন এসেছিল কখনো ভাবেনি সে এই বাড়ির বউ হবে। নিহিরের বউ হবে এমনটাও কী ভেবেছিল?
নিহিরের হালকা কাশির শব্দ শুনে পেছনে ফিরে তাকায় বুশরা। নিহির এসে বলল-
সেই তো এলে তুমি, তবে কেনো এত কষ্ট দিলে আমায়?
-কষ্ট কী আমি পাইনি? পেয়েছি তো। জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি নিহির স্যার। আর পেতে চাই না।
.
বুশরাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে নিহির বলল-
নিহির স্যার না, বলো নিহির। আর কষ্ট? মনে রেখো, আজ থেকে এই শব্দটা তোমার জীবন থেকে মুছে গেছে।
.
নিহিরের কথা শুনে তার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। একটা ভুল সিদ্ধান্তে নিহিরের মতো কাউকে হারাতো সে। নিহির তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল-
কী হলো আবার?
.
বুশরা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল-
আমি এখন থেকে স্যার ডাকব না কিন্তু তুমি আমায় এখন থেকে ম্যাডাম ডাকবে। বলো রাজি?
.
নিহির এক গাল হেসে বলল-
ঠিক আছে আমার ম্যাডাম।
.
দু’জনে বারান্দায় আসে। চাঁদ দেখতে দেখতে গল্প করে তারা। বুশরা চাঁদ দেখছে আর নিহির বুশরাকে। সত্যিই বাহ্যিক সৌন্দর্য্য কেবল দেখতে সুন্দর। কিন্তু মনের সৌন্দর্য থাকলে সবকিছুই সুন্দর হতে বাধ্য হয়। তবুও আফসোস! আমরা বাহ্যিক সৌন্দর্য এর পেছনেই ঘুরি!
.
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here