সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -৩০

পর্বঃ৩০
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(গল্প কপি পোস্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)

এসাইনমেন্ট করতে করতে রাইদা দুপুরে খেতে ভুলে গেছে। ফোন বের করে ফুড পান্ডায় গিয়ে খুঁজতে থাকে কি অর্ডার দিবে।
বাহিরে গিয়ে খাবে ভেবে ফোনটা রেখে রাইদা আবারো কলম হাতে নেয় লেখার জন্য তখন দরজায় নক করার শব্দ হয়।

এই সময় কে এসেছে ভাবতে ভাবতে চলে যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখে সায়ন দাঁড়িয়ে আছে।

‘তাই তো বলি এই সময় তো অন্য কেউ আসার কথা না আসলে এই লোকই আসবে।’,বিরবির করে বলে রাইদা।

‘আজকে কি আমায় ফ্ল্যাটের ভেতরে আসতে দিবা না?’,সায়ন প্রশ্ন করে।

‘না আসেন আসেন নিজের ফ্ল্যাটই মনে করে আসবেন নো সমস্যা।’,সায়নকে ভেংচি দিয়ে বলে রাইদা।

‘আমারই তে ফ্ল্যাট আবার মনে করার কি আছে? নিচে রাখা ব্যাগটা নিয়ে আসো আমি এটাকে নিচ্ছি।’, সায়ন বলে।

‘কি বললেন? আপনার ফ্ল্যাট মানে?’,প্রথম কথাটা স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে আবারো জিজ্ঞেস করে রাইদা।

‘কিছু বলিনি তো বলেছি ব্যাগটা নিয়ে দরজা লাগাও।’

রাইদা এতক্ষণে খেয়াল করে সায়ন একটা বিশাল বাক্স নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে, দরজার সামনে একটা ব্যাগ দেখে সেটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

বিশাল বাক্সটা নিয়ে শোবার ঘরে চলে যায় সায়ন ব্যাগটা নিয়ে রাইদাও সায়নের পিছুপিছু যায়।

‘খাবারের ব্যাগ এখানে এনেছো কেনো? তুমি খাবারগুলো গরম করো আমি বাক্সটা খুলে হাত মুখ ধুয়ে আসি তারপর খেতে বসবো।’, বাক্সটা ফ্লোরে রেখে বলে সায়ন।

‘খাবার নিশ্চয়ই আপনার মা পাঠিয়েছে? উনি আবার এতো কষ্ট করতে গেলো কেনো আমি তো ম্যানেজ করে নিতাম।’, রাইদা অপরাধী ন্যায় বলে।

‘গতকালকে তুমি খাবার পছন্দ করেছো তাই মা আবার পাঠিয়েছে আমায় বলেছে তুমি চাইলে প্রতিদিন পাঠাবে। তুমি না খেতে চাইলে আমি বলে দিবো তাহলে আর কষ্ট করে রান্না করে পাঠাবে না।’

‘আরে না আপনার আম্মু ভালোবেসে দিলে আমি কেনো আপত্তি করবো।’,হেঁসে বলে রাইদা।

‘খাবার পাঠিয়েছে অথচ তুমি একটা ধন্যবাদ দিলা না এটা কিন্তু ঠিক না রি। উনি সকাল থেকে তোমার জন্য এতো রান্না করে তোমার উচিত ওনাকে ধন্যবাদ দেওয়া।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা ভাবনায় পড়ে যায়।

‘আপনাকে তো গতরাতে বলেছিলাম ওনাকে বলতে আপনি আমার কথাগুলো বলেননি?’

‘খাবার পাঠিয়েছে তেমার জন্য আর আমি প্রশংসা করলে ভাববে না তাকে খুশি করতে মিথ্যা বলছি? কাউকে উপহার দিলে তার থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার আশায় কিন্তু আমরা থাকি।’

‘তাহলে এখন আমি কি করতে পারি? আপনার আম্মু এতো কষ্ট করে রান্না করেছে আমি কোনো ধন্যবাদ দিলাম না নিশ্চয়ই সে মন খারাপ করেছে।’,রাইদা মুখ কালো করে বলে।

‘তুমি চাইলে কল করে ধন্যবাদ জানাতে পারো এতে মা অনেক খুশি হবে।’,সায়ন বাক্সটা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলে।

রাইদা সায়নের দিকে হাত বাড়ায়।

‘দিন আপনার ফোনে কল লাগিয়ে আমি আপনার মাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
রাইদার কথা শুনে সায়ন দেরি করে না সাথে সাথে ফোন বের করে মিসেস রিনাকে কল দেয়। রান্নাঘরে গিয়ে রাইদা খাবারের ব্যাগটা রাখে।

‘হ্যালো মা তোমার বউমা কথা বলবে।’,মিসেস রিনা কল রিসিভ করে সায়ন বলে।

রুমে শুয়ে ছিলেন মিসেস রিনা সায়নের এমন কথায় শোয়া থেকে উঠে বসে ফোনটা ভালো করে কানে দেন।

‘হ্যা দে জলদি।’,খুশি হয়ে মিসেস রিনা বলেন।

রান্নাঘর থেকে রাইদা এসে সায়নের থেকে ফোনটা নিয়ে কানে দেয়।

‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি, কেমন আছেন?’,রাইদা জিজ্ঞেস করে।

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম মা। তোমার কল পেয়ে এখন আমি অনেক ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?’,মিসেস রিনা উৎসাহিত হয়ে বলেন।

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনার রান্না করা খাবার খেয়ে এখন আর বাহিরের খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘খাবার গুলো তোমার ভালো লেগেছে? সব আমি নিজ হাতে রান্না করেছি শুধু তোমার জন্য। আজকে কিন্তু কচুর শাক রান্না করে দিয়েছি খেয়ে জানিয়ো কেমন লাগলো।’

‘আপনার রান্না অনেক মজা আমার অনেক ভালো লেগেছে। আমি রান্না জানি না তবে বেশ বুঝতে পারছি আপনি অনেক ভালোবেসে আমার জন্য রান্নাগুলো করেছেন। ধন্যবাদ দিয়ে আপনার ভালোবাসকে ছোট করতে চাই না।’

‘আরে মা কি বলো তুমি আমার একমাত্র বউমা তোমাকে না খওয়ালে কাকে খাওয়াবো। সারাজীবন তো ছেলে-মেয়েকে রান্না করেই খাওয়ালাম এখন তুমি বাসায় আসলে শুধু তোমায় রেঁধে খাওয়াবো। শুনো তোমার যা খেতে ইচ্ছে করে সায়নকে বলবা আমি রান্না করে পাঠিয়ে দিবো একদম লজ্জা পাবা না। রওশন যেমন তোমার মা আমিও তোমার মা হই তবে শ্বাশুড়ি মা।’

মিসেস রিনার শেষের কথাটা শুনো রাইদা লজ্জা পায়।

‘ঠিক আছে জানাবো এখন তাহলে রাখছি।’

‘ঠিক আছে মা ভালো থেকো আর মাঝে মাঝে আমাকে কল দিও।’

‘আচ্ছা ভালো থাকবেন।’
কথা শেষ করে সায়নের দিকে ফোন বাড়িয়ে দেয় রাইদা, সায়ন উৎসুক দৃষ্টিতে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো। রাইদা ফোন ফেরত দিতেই সায়ন ফোন কানে দেয়।

‘হ্যা মা পরে কল দিচ্ছি তোমাকে।’
সায়নের কথার বিপরীতে অপরপাশ থেকে মিসেস রিনা কি জবাব দিলো তা রাইদা শুনতে পায় না। কল কেটে সায়ন আবারো বাক্সটা খুলে পেপারে মোড়ানো কিছু বের করে। পেপার গুলো খুলে ফেললে ভেতর থেকে একটা বিশাল আয়না বের হয়।

‘এটা কীসের জন্য?’,রাইদা সায়নকে প্রশ্ন করে।

‘এই ফ্ল্যাটে কোনো আয়না নেই তাই।’,আয়নাটা রুমের এক পাশে সেট করার সময় জবাব দেয় সায়ন।

‘আছে তো আলমারির এক পাশে। ‘

‘ঐটুকু আয়নাতে তোমায় পুরো দেখা যায় না তাই এই আয়না এনেছি। এখানে দাঁড়ালে তোমাকে সম্পূর্ণ দেখা যাবে।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা গিয়ে আয়নার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের সাথে আয়নার উচ্চতা মাপতে থাকে।

‘এই আয়নার উচ্চতা আমার সমান। এতো পারফেক্ট উচ্চতা কীভাবে মিলালেন?’
রাইদার প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না সায়ন।

‘আয়না তো হয়ে গেছে এখন একটা সাইড ড্রয়ার আর বসার জন্য মিলিয়ে একটা ফোমের সিট আনতে হবে।’,আয়নার দিকে তাকিয়ে সায়ন বলে।

‘সবই বুঝলাম কিন্তু অন্যের ফ্ল্যাটে ভাড়া থেকে এগুলো কেনো কিনছেন? আমি তো এমনিতেই দু’দিন পর নিজের বাসায় ফিরে যাবো তখন কি করবেন এগুলো?’, সায়নের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে রাইদা।

‘ওহ বাসার ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেছো? সমস্যা নেই তুমি চলে গেলে আমার বউ এগুলো ব্যবহার করবে।’

সায়নের কাছ থেকে এমন উত্তর পেয়ে রাইদা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

‘মানে? বউ আবার আসলো কই থেকে?’

রাইদার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে সায়ন হেঁসে দেয়।

‘তুমি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না, বাসায় ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেছো? এতো জলদি বাসায় ফেরার কথা বলছো যে।’

‘আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি আমি কেনো উত্তর দিবো?’

‘রাইদা রাফায়েতের কি হিংসা হচ্ছে? আর ইউ জেলাস?’,রাইদার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে সায়ন।

‘আম নট জেলাস ফর ইউ ইমতিয়াজ সায়ন। ‘,কথাটা বলে সায়নকে ধাক্কা দিয়ে রাইদা রান্নাঘরে চলে যায়।

রাইদার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে সায়ন।

বসার ঘরে রাইদা আর সায়ন খেতে বসেছে তখন রাইদার ফোন বেজে উঠে। খাবারের প্লেট টি-টেবিলে রেখে রাইদা বিছানা থেকে ফোনটা নেয়। ফোন হাতে নিয়ে দেখে মান্নান রাফায়েত কল দিয়েছে।

‘হ্যা বাবা বলো।’,কল রিসিভ করে রাইদা বলে।

‘তুই আর জামাই কি বাসায় আছিস?’,মান্নান রাফায়েত জিজ্ঞেস করেন।

‘আছি কিন্তু কেনো?’

‘তোর মা বললো বিকালে তোর ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখতে চায় তুই কীভাবে আছিস আর সত্যিই সংসার পেতেছিস নাকি?’

‘কি বলো তোমার বউ এখানে আসবে? তুমি ও আসবা?’

‘আমাকেই তো ওরে নিয়ে আসতে হবে। শোন আমি তোরে কল দিয়ে জানিয়েছি এটা যেনো রওশন না জানে তাহলে বুঝিস তো ও ঝামেলা করবে। তোরা এমন ভান করবি যে কিছুই জানতিস না। ঠিকানাটা বল আমি কাজ সেরে বাসার দিকেই যাবো, বাসায় গিয়েই রওশনকে নিয়ে বের হবো।’

বাসার ঠিকানা দিয়ে কল কেটে দেয় রাইদা।

‘খাওয়া শেষ করে আপনি নিচে গিয়ে কিছু নাশতা কিনে আনুন।’,সায়নকে গিয়ে বলে রাইদা।

‘কেনো? কে আসবে?’,সায়ন প্রশ্ন করে।

‘বাবা আর তার বউ আসবে। বাবা বললো হুট করেই তার বউ এসে দেখতে চাচ্ছে আমার সংসার কেমন চলে।’

‘এখন আমি নাশতা এনে রাখলে তো শ্বাশুড়ি বুঝে যাবে আমরা জানতাম সে আসবে তাই চুপ করে খাওয়া শেষ করে বসো। যখন শাশুড়ী আসবে তখন গিয়ে আনবনি।’

সায়নের কথা শুনে রাইদা নিজের খাওয়া শেষ করে।

..

দরজায় নক করার শব্দ হলে বিছানা থেকে নেমে রাইদা গিয়ে দরজা খুলে। দরজায় রওশন আরা আর মান্নান রাফায়েত দাঁড়িয়ে আছে। রাইদা অবাক হওয়ার ভান করে দু’জনকে দেখে।

‘হঠাৎ তোমরা? কি মনে করে এলে? আসো ভেতরে আসো।’,দরজা থেকে সরে রাইদা বলে।

মান্নান রাফায়েত মিষ্টির ব্যাগ রাইদার হাতে দেয়।

‘কে এসেছে বউ?’,শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে হাই তুলে জিজ্ঞেস করে সায়ন।

‘আপনার শ্বাশুড়ি আর শ্বশুড় এসেছে।’,হাসি আঁটকে রাইদা সায়নকে বলে।

রওশন আরা আর মান্নান রাফায়েত ঘরে ঢুকে। দরজা লাগিয়ে রাইদা রান্নাঘরে চলে যায়।

‘আরে শ্বাশুড়ি মা আসসালামু আলাইকুম আসেন বসেন।’,সায়ন অবাক হওয়ার ভান করে বলে।

‘তোমার গায়ের গেঞ্জি উল্টো কেনো পরছো?’,রওশন আরা গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করে।

‘আসলে শাশুড়ী মা দুপুর বেলা বউয়ের সাথে ঘুমাচ্ছিলাম তো তাই এই অবস্থা। ‘,সায়ন লজ্জা পাওয়ার ঢং করে বলে।

সায়নের কথা শুনে রাইদা রান্নাঘরে মুখে হাত দিয়ে হাসতে থাকে।

মান্নান রাফায়েত কেশে সোফায় বসে। রওশন আরা চোখ বড়বড় করে তাকায়।

‘তোমার বাবা মা ভদ্রতা শেখায়নি? কোথায় কি বলতে হয় জানো না? রিনা নিজের ছেলেকে শিক্ষা দিতে পারলোনা।’, রওশন আরা সায়নকে ধমক দিয়ে বলে

‘আমার কি দোষ শাশুড়ী মা আপনিই তো প্রশ্ন করলেন আমি উত্তর দিলাম।’,সায়ন মুখটা বাচ্চাদের মতো করে বলে।

পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগে রাইদা রান্নাঘর থেকে বের হয়। রওশন আরা ফ্ল্যাটের রুম ঘুরে দেখতে থাকে।

‘নিচে গিয়ে আপনার শ্বশুড় -শ্বাশুড়ির জন্য কিছু নিয়ে আসেন জলদি।’,সায়নকে বলে রাইদা।

‘শ্বাশুড়ি আপনি বসুন আমি যাবো আর আসবো।’,কথাটা বলে সায়ন নিজের মানিব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যায়।

‘কেমন ছেলে গেঞ্জিটা ঠিক করে পরে বের হলো না। তুই এই ছেলের সাথে কীভাবে সংসার পেতেছিস বুঝি না।’,রওশন আরা রাইদাকে বলে।

‘সংসার যেহেতু আমি পেতেছি আমাকেই বুঝতে দাও, আমার বিষয়ে তোমার মাথা ঘামিয়ে নিজের ঘুম নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। তা হঠাৎ কি মনে করে এলে? আমার কথার সত্যি মিথ্যা যাচাই করতে এলে?’,রাইদা রওশন আরাকে প্রশ্ন করে।

‘আরে আমরা বেরিয়েছিলাম ঘুরতে এদিক দিয়ে যচ্ছিলাম তোর বাবা আমাকে জোর করে নিয়ে এলো বললো চলো মেয়ের বাসা দেখে আসি। আমার তো মোটেও ইচ্ছে ছিলো না আাসার।’,রওশন আরা আমতাআমতা করে বলে।

রওশন আরার কথা শুনে মান্নান রাফায়েত থতমত খায়।

‘তা দুপুরে কি রান্না করেছিলি?’,রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলে জিজ্ঞেস করে রওশন আরা।

‘সায়নের মা খাবার পাঠিয়েছিলে তা খেয়েছি।’,রাইদা জবাব দেয়।

রাইদার জবাব শুনে রওশন আরা অবিশ্বাস্য চোখে তাকায়।

‘বাহ্ তোর শ্বাশুড়ি এতো ভালো হলো কবে? নাকি রান্না করে খাইয়ে তোরে বশে রাখতে চাচ্ছে? আমার জানান মতে রিনা অনেক অহংকারী।’

‘আমি রান্না করতে পারিনি না তাই সায়নের মা রোজ রান্না করে পাঠায়। ব্যক্তিগত ভাবে সে কেমন তা আমার জানার প্রয়োজন নেই।’,রাইদা জবাব দেয়।

কিছুক্ষণ পর অনেকগুলো খাবারের ব্যাগ হাতে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে সায়ন।

রাইদা খাবারের ব্যাগগুলো নিয়ে রান্না ঘরে চলে যায়। বিছানায় রওশন আরা আর মান্নান রাফায়েত বসে ছিলো। বসার ঘর থেকে একটা সোফা টেনে সায়ন তাদের সামবে বসে।

‘তা কাজকর্ম কিছু করো নাকি সারাদিন বাসায় ঘুমাও?’,সায়নকে জিজ্ঞেস করে রওশন আরা।

‘কি যে বলেন শ্বাশুড়ি মা কাজ করলে কি বউয়ের কাছে থাকতে পারতাম নাকি? এখন তো আমার অফিসে থাকার কথা কিন্তু আমি যেহেতু বাসায় তার মানে কাজ করি না।’

সায়নের কাছ থেকে জবাব পেয়ে রওশন আরা হাসি দেয়।

‘ও তার মানে তুমি বেকার? সেই জন্যই ফ্ল্যাটে জিনিসপত্র নেই একদম। তো এই ফ্ল্যাট ভাড়া কে দিবে নিশ্চয়ই আমার মেয়েকে দিয়ে দেওয়ানোর চিন্তা করছো?’, রওশন আরা তাচ্ছিল্যের সুরে জিজ্ঞেস করে।

‘আমি তো ভেবেছি আপনারা ফার্নিচার যৌ*তু*ক দিবেন তাই কিনে আর টাকা নষ্ট করলাম না।’,সায়ন জবাব দেয়।

‘ফার্নিচার না হয় দিলাম কিন্তু তুমি কি এভাবে বেকার থেকে আমার মেয়ের পয়সায় খাবা নাকি?’

‘কেনো তোমরা যৌ*তু*কে যেই টাকা দিবা সেই টাকা দিয়ে ও ব্যবসা করবে।’, রওশন আরার কথার জবাব দেয় রাইদা।

রাইদার মুখে এমন কথা শুনে রওশন আরা মুখ কালো করে ফেলে।

সায়ন টি-টেবিল টেনে তার উপর খাবারের বাটিগুলো রাখতে রাইদাকে সাহায্য করে।

‘আচ্ছা তুমি এসব কথা বাদ দাও না। সায়ন ওর বাবা অফিসেস কাজ করে তোমাকে তো বলেছিলাম তাও কেনো জিজ্ঞেস করছো বুঝলাম না।’, মান্নান রাফায়েত বিরক্ত হয়ে রওশন আরাকে বলে।

‘শ্বশুড় বাড়িতে কি যাবি না নাকি এই ফ্ল্যাটে সংসার করে জীবন পার করবি?’,রওশন আরা রাইদাকে আবারো প্রশ্ন করে।

‘যাবো সময় হলে,বিয়ে হলো এখনো এক মাসও হয়নি এতো তাড়া কিসের।’,রাইদা জবাব দেয়।

‘তোর শ্বাশুড়ির সাথে আমার দেখা করা তার সাথে আমার কথা আছে।’,রাইদার থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে রওশন আরা।

‘ঠিক আছে দেখা করাবো কিন্তু কিছুদিন পর।’,রাইদা জবাব দেয়।

‘রি কথা পরে বলো আগে শ্বশুড়িমাকে খেতে দাও। শ্বাশুড়ি নেন খান।’,সায়ন ব্যস্ত গলায় বলে।

মান্নান রাফায়েতকে বলার আগেই নিজে নিয়ে খেতে শুরু করে।

‘আমি এসব খাবো না চা খাবো।’,রওশন আরা বলে উঠে।

‘আপনার মেয়ে তো চা বানাতে পারে না আর তখন বললে এনে দিতাম। আচ্ছা আপনি বসুন আমি দোকান থেকে আনছি।’,সায়ন বলে।

‘আমি দোকানের চা খাই না আর আমার মেয়েকে জীবনেও রান্নাঘরে পাঠাইনি তাই ও রান্না পারে না।’,রওশন আরা সায়নের কথার পিঠে বলে।

‘আমি আমার জীবন কাটিয়েছি হোস্টেলেই তাহলে আমায় রান্নাঘরে কীভাবে পাঠাতে? এখনো নিজের ভুলটা শিকার করলে না।’, রাইদা গম্ভীর গলায় বলে।

‘চিন্তা করবেন না শ্বাশুড়ি মা আমি দরকার হলে রান্না শিখে আপনার মেয়েকে রান্না করে খাওয়াবো।’,মা মেয়ের কথার মধ্যে সায়ন বলে উঠে।

‘আমার মনে হয় আমাদের এখন উঠা উচিত সন্ধ্যা হয়ে আসছে।’,সায়নের দিকে তাকিয়ে মান্নান রাফায়েত বলে।

‘শ্বশুড় মশাই রাতে খেয়ে যান বাসায় গিয়ে ঝামেলার কি দরকার।’,সায়ন মান্নান রাফায়েতের হাত ধরে বলে।

‘না বাবা তোমার শ্বাশুড়ির রান্না ছাড়া বাহিরের খাবার আমি খেতে পারি না।’,আঁড়চোখে রওশন আরার দিকে তাকিয়ে বলে মান্নান রাফায়েত।

‘এক কাজ করি আমি বাজার করে আনছি শ্বাশুড়ি রান্না করুক কি বলো রি ভালো হবে না?’,রাইদাকে প্রশ্ন করে সায়ন।

রাইদা কি উত্তর দিবে বুঝতে পারে না। রওশন আরা মেয়ের মুখের দিকে তাকায় জবাব শোনার অপেক্ষায়।

‘হ্যা আনেন বাজার যদি সে রান্না করে তাহলে।’, ইতস্তত করে রাইদা বলে।

‘শ্বাশুড়ি আমি আর শ্বশুড় মশাই বাজারে যাচ্ছি আপনারা মা মেয়ে থাকেন। শ্বশুড় মশাই চলেন।’
সায়ন কথাটা বলে বসার ঘরে যায়। সায়নের পিছন পিছন মান্নান রাফায়েত ও যায়।

‘বাবা থাকুক আপনি যান শুধু।’,রাইদা বলে উঠে।

‘না আমিও জামাইয়ের সাথে যাবো,জামাই চলো।’
দরজা খুলে মান্নান রাফায়েত আর সায়ন বেরিয়ে যায়।

দরজা লাগিয়ে রাইদা শোবার ঘরে এসে বিছানায় বসে। রওশন আরা চোখ ঘুরিয়ে মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

‘তুমি সত্যিই এই ছেলেকে পছন্দ করো? তোমার মনে আছে এই ছেলে তোমাকে কত বিরক্ত করেছিলো কল দিয়ে। ছেলেটার কথাবার্তা তখনও বেয়াদবের মতো ছিলো এখনো আছে।’,নরম স্বরে রাইদাকে বলে রওশন আরা।

‘হঠাৎ তুই এর বদলে তুমি বলে কথা বলছো আবার গলার স্বরও পাল্টে গেছে তোমার দেখছি, কাহিনী কি?’, রওশন আরার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে রাইদা।

‘ছোট বেলায় তোকে কষ্ট দিয়েছি এখন আমি চাইনা বাকি জীবন তুই কষ্ট পাস। আমার মনে হয় এই ছেলের সাথে এক ছাদের নিচে তোর থাকার পূর্বে আরেকবার ভাবা উচিত ছিলো। এখনো দেরি হয়নি তুই আমাদের সাথে বাসায় ফিরে চলো পরে তোর যদি ইচ্ছে হয় ওর পরিবারের সাথে আমরা কথা বলে তোকে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।’

রওশন আরার কথা শুনে রাইদা ভাবনায় পড়ে যায়।

‘তুই চিন্তা করিস না আমি আর তোকে কোনো বিষয় নিয়ে কথা শোনাবো না। তোকে নিয়ে আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে তাই বললাম বাসায় ফিরে চল।’,রওশন আরা আবারো বলে।

‘ঠিক আছে আমি ভেবে দেখবো বিষয়টা।’,রাইদা জবাব দেয়।

রওশন আরা মেয়ের জবাব পেয়ে খুশি হয়। আরো নানান কথা বলতে থাকে কিন্তু সেগুলো রাইদার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না সে একটু আগে মায়ের বলা কথাগুলো ভাবতে থাকে।

..

ঘন্টা খানেক পর দরজায় নক করার শব্দ হলে রাইদা গিয়ে দরজা খুলে। সায়ন আর মান্নান রাফায়েত গল্প করতে করতে দু’হাতে ভর্তি ব্যাগ নিয়ে বাসায় প্রবেশ করে।

রওশন আরা শাড়ীর আঁচল গুঁজে রান্না ঘরে গিয়ে বাজার গুলো বের করে কাজ শুরু করে। মান্নান রাফায়েত গিয়ে স্ত্রী কে সাহায্য করে। রাইদা রান্নাঘরে যেতে নিলে সায়ন হাত ধরে টান দেয়। শোবার ঘরের দরজা চাপিয়ে রাইদার কোমড় এক হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে। আরেক হাত দিয়ে রাইদার চুল গুলো কানে গুঁজে দেয়।

‘সরুন বিরক্ত লাগছে আমার।’,বিরক্তিকর স্বরে রাইদা বলে।

‘হুট করে তোমার আবার কি হলো? শ্বাশুড়ি মা কিছু বলেছে?’, চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে সায়ন।

‘কিছু হয়নি আমার হয়েছে আপনার। আমি ঠিক করেছি আজকে বাসায় ফিরে যাবো।’

‘এতো জলদি ফিরবে কেনো আরো কিছুদিন থাকো।’,গলার স্বর নরম করে সায়ন বলে।

‘সমস্যা নেই বাসায় ফিরলেও আপনার সাথে যোগাযোগ থাকবে।’,সায়নকে নিজের থেকে সরিয়ে বলে রাইদা।

সায়ন রাইদাকে পিছন থেকে জড়িয়ে রাইদার ঘাড়ে মুখ গুঁজে। সায়নের স্পর্শে মৃদু কেঁপে উঠে সে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চোখ বন্ধ করে নেয় রাইদা।

‘বউ তুমি এখন কোথাও যাবা না এখানেই থাকবা দরকার হলে শ্বশুড় -শ্বাশুড়িকে বলবো থেকে যেতে তারও আমি আমার বউকে যেতে দিবো না।’, জড়ানো কন্ঠে বলে সায়ন।

‘আপনি কিন্তু এখন পাগলামি করছেন এটা কথা ছিলো না আমাদের মধ্যে।’

রাইদার কথার জবাব না দিয়ে সায়ন মুখ তুলে রাইদার গালে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়ায়।

‘কয়েকটা দিন এখানে থাকো এরপর সারাজীবন বাপের বাড়িতে থেকো আমার কোনো সমস্যা নেই শুধু এই কয়েকদিন কষ্ট করো।’,রাইদার কানে ফিসফিস করে কথাটা বলে সায়ন।

রাইদাকে ছেড়ে রুমের দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে যায় সায়ন। রাইদা মূর্তির ন্যায় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে যায় রাইদা।

‘এই লোকটা নিজে তো পাগল যা শুরু করেছে আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে মনে হচ্ছে। লোকটার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।’,বিরবির করে রাইদা বলে।

রাইদাকে বিরবির করে কিছু বলতে দেখে সায়ন ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়। রাইদা কেনো জবাব না দিয়ে মান্নান রাফায়েতের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে রান্না শেষ হয়। সকলে মিলে ফ্লোরে খেতে বসে। রওশন আরা সকলকে খাবার বেড়ে দেয়। রাইদা হাসিমুখে খেতে থাকে। রাইদাকে খুশি দেখে মান্নান রাফায়েত খুশি হয়।

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে মান্নান রাফায়েত আর রওশন আরা বাসায় ফেরার জন্য বের হয়। সায়ন ও তাদের সাথে যায় গাড়ি করে বাসায় পৌঁছে দিতে।

সায়ন যেতেই রাইদা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দরজা লাগিয়ে বন্ধুদের কল দেয় বিস্তারিত ঘটনা বলতে।

রাত সাড়ে বারোটার দিকে দরজায় নক করার শব্দ হলে রাইদা কিছুটা ভয় পায় কারন এতো রাতে কেউ আসার কথা না। ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

‘রি দরজা খুলো জলদি।’,দরজার অপরপাশ থেকে সায়ন বলে।

দরজা খুলে রাইদা দেখে সায়ন দাঁড়িয়ে। রাইদাকে পাশ কাটিয়ে শোবার ঘরে চলে যায় সায়ন। দরজা লাগিয়ে রাইদাও যায়।

‘আপনি এতো রাতে এখানে কেনো এসেছেন? বাসায় যান এক্ষুণি।’,রাগী কন্ঠে সায়নকে বলে রাইদা।

‘ইচ্ছে করে আসিনি তো বাসার সবাই দাওয়াত খেতে গেছে আর আমার কাছে চাবি নেই কীভাবে বাসায় যাবো বলো। একটাবার আমাকে জানায়নি এখানে আমার তো কিছু করার নেই। তুমি থাকতে না দিলে আমার তো রাস্তায় রাত কাটাতে হবে। তুমি কি চাও আমি রাস্তায় রাত কাটাই?’, অসহায় চেহারা করে সায়ন বলে।

‘কিন্তু এখানে তো একটা বিছানা আপনি কোথায় ঘুমাবেন?’

‘কোথায় আবার এই বিছানায় ঘুমাবো। এই পাশে আমি আর ঐ পাশে তুমি ঘুমাবা। শুভ রাত্রি বউ আমার ঘুম পেয়েছে।’
কথাগুলো বলে সায়ন বিছানার এক পাশে শুয়ে পরে। রাইদা আহাম্মকের মতো সায়নের কান্ড দেখে তাকিয়ে থাকে। কোল বালিশটা মাঝে রেখে অপরপাশে শুয়ে বিরবির করতে থাকে রাইদা।
রাইদার কান্ডে সায়ন মিটমিট করে হাসতে থাকে। সায়ন উঠে রুমের লাইট বন্ধ করতে নিলে রাইদা প্রতিবাদ করে। শেষে লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পরে দু’জনে।


চলবে..
(বড় পর্ব দিয়েছি আশা করছি কমেন্টে আপনাদের মন্তব্য পাবো। অবশ্য গল্প পড়ে লাইক,কমেন্ট করবেন অনুরোধ রইলো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here