সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -২০+২১

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২০

“মাথা ঠিক আছে তোমার নোভা? কি বলছো ভেবে বলছো তো?”
মায়ের গম্ভীর কণ্ঠ শুনেও নোভা নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল।
স্থিরচিত্তে বলল,
“আমি ভেবেচিন্তেই বলছি মা।”
ফাহিমা করিম নিজের মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা রেখে বললেন,
“বয়স কত তোমার? আঠারো পেরিয়েছে কি? এখনই বিয়ের এত তাড়া কিসের? কে বিয়ে করবে তোমাকে? শুধু সুন্দর চেহারা দেখে কোনো ব্যক্তিত্ববান মানুষ তোমাকে বিয়ে করতে আসবে না। সুন্দরী ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা আছে তোমার বর্তমানে? শুধুমাত্র এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট কোনো মেয়ের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে না।”
নোভা দমে গেল না। বরং অধৈর্য হয়ে বলল,
“প্রয়োজনে রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা,সবজিওয়ালা যে কারো সাথেই বিয়ে দিতে পারো। আমি টু শব্দটিও করব না। তারাও যদি বিয়ে করতে রাজি না-হয় তবে রাস্তা থেকে ভিখিরি ধরে নিয়ে এসো। বিয়ের পর একসাথে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করব। সুন্দর চেহারা দেখে মানুষের মন গললে নিশ্চয়ই ভিক্ষা দেবে। তোমরাও না-হয় যেতে আসতে দু-এক পয়সা দিও। এতটুকু যোগ্যতা নিশ্চয়ই আমার আছে।”
ফাহিমা করিম হতবাক হয়ে মেয়ের বলা বাক্যগুলো গিলল।
আবরার হাঁটু গেড়ে বসে নরম গলায় বলল,
“কি হয়েছে বাবু? এভাবে উল্টাপাল্টা বকছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে? দাদাভাইকে বল। চামড়া ছিঁলে লবণ লাগিয়ে দেব।”
নোভা ঠোঁট বেকিয়ে হাসল।
আবরার পুনরায় বলল,
“বল না বোন আমার। কে কি বলেছে?”
নোভা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। আবরার কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি আমার বিয়ে দিয়ে তবে বাড়ি থেকে বের হবে। নইলে আমি তোমাকেও যেতে দেব না।”
“আচ্ছা বেশ। মেনে নিলাম। কিন্তু কাকে বিয়ে করতে চাও, সেটা তো বলো।”
নোভা আড়চোখে একবার রিফাতের দিকে তাকাল। বেচারার মুখ শুকিয়ে গেছে। ভয়ে, আতঙ্কে বাঁ’হাতে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
নজর ফিরিয়ে আবরারের দিকে মনোনিবেশ করে বলল,
“আমার কোনো পছন্দ নেই দাদাভাই। যাকে পাও তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দাও। তবে দেখবে ছেলে যেন রাজপুত্র না হয়। লোকে বলে আমি নাকি রাজপুত্র ডিজার্ভ করি। তাদের দেখিয়ে দিতে চাই রাজপুত্র নয়, সাধারণ একটা মানুষ ধরে এনেছে আমার দাদাভাই। তাকে নিয়েই আমি ভাল আছি। ভালো থাকতে পারি।”
আবরার হতবিহ্বল হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ইশারায় বোঝালো-কি হয়েছে?
ফাহিমা করিম মাথা নেড়ে বোঝালেন তিনি কিছু জানেন না।

“আপনি নোভার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছেন কিছু?”
পিনপতন নীরবতার অন্তিমকাল উপস্থিত হলো ইভানার রিনরিনে কণ্ঠস্বরে।
আবরার তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
“ভাবছি। ব্যাপারটা ভাবতে বাধ্য করছে। নোভা তো বাচ্চা নয়। বয়স খুব একটা না হলেও সে ম্যাচিউর। এরকম কথাবার্তা বলা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। বুঝতে পারছি না হঠাৎ এরকম ব্যবহারের কারণ। অবশ্য আমার বুঝার কথাও নয়। আমি তো আমার বাচ্চা নোভাটাকে রেখেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম। ওর বেড়ে ওঠা, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন কিছুই কাছ থেকে দেখতে পারিনি। মা’কে বললাম, মাও কিছু বুঝতে পারে নি।”
খানিকটা দম নিয়ে বলল,
“তুমি একটু দেখবে প্লিজ? শুনেছি মেয়েরা নাকি ভাবীদের কাছে মনের কথা শেয়ার করে। দেখবে? সাহায্য করবে তো আমায়?”
ইভানা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল।
“আমি আপনাদের কেউ নই তাই না? পরের বাড়ির মেয়ে কিনা। নোভাও নিশ্চয়ই আমার কেউ না, তাই না? সেজন্য এভাবে বলছেন। নোভা আমার নিজের বোন হলে তখনো এভাবে বলতেন?”
আবরার চকিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি এভাবে বলিনি। তুমি ভুল করছো। ভুল ভাবছ। ভুল বুঝছো আমাকে। তুমি আমার মানে আমি তোমার। আমি তোমার মানে আমার পরিবারও তোমার।”
ইভানা তবুও দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।
আবরার মুচকি হেসে ইভানার নাক টিপে দিল। কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল,
“আদর দিয়ে মান ভাঙাব?”
ইভানা লাফিয়ে দূরে সরে গেল। হড়বড় করে বলল,
“আমি নোভা কে দেখে আসছি।”
বলেই এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। আবরার পেছনে কুঞ্চিত ভ্রু যুগল সোজা করতে ব্যস্ত।

নোভা কম্বল মুড়ি দিয়ে বই পড়ছে। পুরোটা ভেতরে ঢুকে কেবল মুখটা বের করে রেখেছে। শীতকালটা তার এভাবেই কাটে। পৌষের পুরো সময়টা সে আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। শীতে কাবু হওয়ার দরুন ছোট থেকেই তাকে প্রায় তুলোয় মুড়িয়ে রেখেছেন ফাহিমা করিম।
নোভা দরজা নক করে বলল,
“আসব নোভাপু?”
নোভা মাথা উঁচু করে বলল,
“এসো ভাবি। অনুমতি নিতে হয় নাকি।”
ইভানা ভেতরে এসে নোভা কে দেখে হেসে বলল,
“ওরে বাপরে! তুমি তো এখনই প্যাকেট হয়ে গেছো। এরপর কি করবে? আরও শীত আসলে তখন?”
নোভা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। ইভানা অনিমেষ তাকিয়ে দেখল বিদেশিনী মেয়েটির মুগ্ধ করা হাসি।
“শীতের সময় আমার চোখগুলো ছাড়া একটা লোমও দেখতে পারবে না তুমি ভাবী।পারলে চোখেও মোজা পরতাম আমি। তখন কিভাবে পড়ি জানো? আমি পুরোটা কম্বলের ভেতরে চলে যাই। তারপর কম্বলের ভেতর লাইট নিয়ে বই নিয়ে পড়ি।”
ইভানা মুচকি হেসে বলল,
“গোসল করো তো? নাকি সেটাও শীতের আগে একবার আর শীতের পরে একবার?”
“ওফ ভাবী তুমি আমায় খেপাচ্ছাে। গোসল রোজই করি। গরম পানি আছে তো।”
ইভানা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নোভার মনের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করল। তবে এরমধ্যে একবারও নোভা বিয়ে সম্পর্কিত প্রসঙ্গ তুলে নি। ইভানাও নিজে থেকে কিছু বলল না।

“কিছু বলল?” নোভার রুম থেকে ফিরতেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল আবরার।
নোভা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আবরারের মুখোমুখি সোফায় পা তুলে বসল। আবরার পুনরায় বলল,
“কিছু বুঝতে পারলে?”
ইভানা আয়েশ করে বসে বলল,
“নোভা ঠিক আছে। সমস্যা খুব একটা জটিল বলে মনে হলো না। তবে অবশ্যই সে একটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আপনি একটু খেয়াল রাখুন ওর। প্রয়োজনে ক্লাস, কলেজের দিকে নজর রাখুন। আজকাল তো আবার সেখানে ঝামেলার শেষ নেই। ”
আবরার মাথা নাড়ালো।

“উইল ইউ বি মাই গার্লফ্রেন্ড?”
ইভানা চকিতে তাকালে আবরার মুচকি হেসে বলল,
“বৈধ গার্লফ্রেন্ড। হবে? প্লিজ!”
ইভানা হাই তুলে দু-হাত দুদিকে মেলে দিতেই আবরার সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“প্রথম দিনেই হাগ করতে চাইছো?”
ইভানা হাই তোলা হা করা মুখ অকস্মাৎ বন্ধ করে ফেলল। বিস্মিত গলায় বলল,
“সিরিয়াসলি? এটাই মনে হলো আপনার? হাই তুলছিলাম আমি।”
আবরার ঠোঁট কামড়ে হাসল।
“হাগ করতে চাইলেও আমি কিছু মনে করতাম না। একমাত্র গার্লফ্রেন্ড বলে কথা।”

“আমি কিন্তু ইয়েস বলিনি।”

“বলে দাও।”

“এত তাড়াতাড়ি? মাত্র তো প্রপোজ করলেন। একটু ঝুলে থাকুন। আমি সময় নেই। ভাবি। ভাবতে ভাবতে দিকবিদিক ভুলে যাই। তবেই না সময় হবে উত্তর দেওয়ার।”

“তখন উত্তর টা হ্যা হবে তো?”

“সেটা তো সময় বলবে বেবস্।”

আবরার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“বেবস্! সেটা আবার কি?”
ইভানা চমৎকার হাসল।
আবরারের নাক টিপে দিয়ে বলল,
“আমার মাথা আপনার মুন্ডু।”

ঘড়ির কাঁটা একটার ঘন্টা পেরিয়েছে মিনিট দশেক আগে। গভীর ঘুমে মগ্ন পৃথিবীতে জেগে আছে কিছু রাতজাগা নিশাচর প্রাণী। আর কিছু মনুষ্য প্রজাতি। যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে চলেছে ভালবাসা নামক অনুভূতি। প্রেমের অনলে দগ্ধ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

খুট করে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে নোভা চকিতে তাকাল। ড্রিম লাইটের আবছা রোশনাইয়ে কল্প পুরুষ কে দেখতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ ওঠে বসল। রিফাত দরজা বন্ধ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বিছানার কাছাকাছি দাঁড়াল। কম্বল টেনে সরিয়ে দিতেই নোভা অল্প আওয়াজে বলল,
“কি করছো রিফাত ভাই?”
রিফাত উত্তর দিল না। পুরুষালী শক্তি প্রয়োগ করে কম্বল টেনে সরিয়ে ফেলল। নোভা পুনরায় নিজেকে আবৃত করতে চাইলে বিছানা থেকেই ছুঁড়ে ফেলে দিল।
নোভা বিস্মিত গলায় বলল,
“পাগলামি করছো কেন রিফাত ভাই? তুমি তো চলে গিয়েছিলে সন্ধ্যায়। এখন কিভাবে এলে?”
রিফাত বিছানায় বসে শক্ত থাবায় নোভার বাদামী রঙা চুলের গোছা ধরে বলল,
“আমি পাগলামি করছি? তুই কি করছিলি তখন?”
নোভা চোখ বন্ধ করে ফেলল। রিফাতের হাত আলগা করার চেষ্টা করে বলল,
“রিফাত ভাই লাগছে আমার। ছাড়ো প্লিজ।”
রিফাত ছাড়ল না। বরং আরও খানিকটা চেপে ধরে মুখ বরাবর নোভার মুখ এনে বলল,
“এখন লাগছে! আমাকে যে তখন থেকে আঘাত করেই যাচ্ছিস, তার বেলায়?”
নোভা চোখ খুলল। ব্যথার মাঝেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তাই! তোমারও লাগে নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি রোবট।”
রিফাত দম নিল। হাতের বাঁধন থেকে চুলের গোছা আলগা করে দিল। গলদেশ থেকে কাঁপা কাঁপা হাতটা চিবুক স্পর্শ করল। তীব্র পুরুষালী কঠিন স্বরটা খাদে নামিয়ে বলল,
“আমার কি হবে?”
নোভা কেঁপে উঠল। ভেতরে অবস্থায়মান নারী সত্তাটাও নড়ে উঠল। কিন্তু সেসব বাইরে প্রকাশ না করে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“তোমার কিছুই হবে না রিফাত ভাই। আমার হবে। বিয়ে করব, বাসর হবে। বছর ঘুরতেই বাচ্চা হবে। একে একে বছর গড়াতে থাকবে আর সেই হিসেবে বাড়তে থাকবে আমার বাচ্চার সংখ্যা।”
নরম কোমল রিফাত পুনরায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। তিন আঙুলে গাল চেপে ধরে বলল,
“আমি ছাড়া তোকে কেউ ছোঁবে না। কেউ না।”
নোভা মুচকি হাসল। বলল,
“ছোঁবে। একশবার ছোঁবে হাজার বার ছোঁ…”
পুরো কথাটা শেষ করার আগেই মুখটা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেল। নাহ! মুখ বন্ধ হয় নি। বন্ধ হয়েছে কণ্ঠস্বর। কালচে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠল গোটা শরীর। কিন্তু সময় পেরোতেই গলদেশের ফর্সা চামড়াটুকু পিষ্ট হলো ঠোঁটের চাপে। দগ্ধ হলো উত্তপ্ত নিশ্বাসের তাপে। কণ্ঠদেশে তীব্র জ্বলন অনূভুত হতেই অস্ফুটে বলল,
“জ্বলছে রিফাত ভাই।”
কানে তুলল না বোধহয় সে। তাই তো জ্বলনটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল। যার দরুন কণ্ঠনালী বেদ করল তার আর্তচিৎকার।

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২১

সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে হলুদ গাদার রঙিন কলি। সূর্যের আলো সরাসরি পড়ায় ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে সে দৃশ্যপট। কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের তীর্যক রশ্নি বারান্দা গলে প্রবেশ করছে সাজসজ্জা বিশিষ্ট ঘরগুলোতে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে শীতের শীতল রূপ পরখ করছিল ইভানা। শীত সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে সুন্দর দিনের শুরুটা উপভোগ করছিল সে। খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে রুমে পদার্পণ করল।
আবরার কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ইভানা ডাকতে চেয়েও ইতস্তত বোধ করল। অগ্যতা খুলে রাখা চুলগুলো হাত খোঁপা করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ধোঁয়া উঠা কফির মগ হাতে নিয়ে কিচেন থেকে ঘরে ফিরে এলো ইভানা। আবরার তখনো ঘুমের অতলে হারিয়ে আছে। ইভানা গলা খাঁকারি দিল। কিন্তু বাবুর কোনো নড়নচড়ন অবধি নেই।
খানিকটা উঁচু গলায় বলল,
“শুনতে পাচ্ছেন? উঠুন। মা কফি পাঠিয়েছেন।”
আবরার নড়েচড়ে মাথাটা কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে নিল।
ইভানা কোমরে হাত রেখে সরু দৃষ্টিতে তাকাল।
বিছানার একপাশে বসে ইতস্তত করে কম্বলের উপর দিয়ে ধাক্কা মেরে বলল,
“এবার তো উঠুন। আপনি ইচ্ছে করে করছেন এমন তাই না? দু’দিন পর তো চলেই যাবেন। একটু তো পরিবার কে সময় দিন। নাকি পড়ে পড়ে ঘুমিয়েই দুদিন কাটিয়ে দেবেন?”
আবরার ঘুমের ভান ছেড়ে মাথা বের করল কম্বল সরিয়ে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি চলে গেলে খারাপ লাগবে তোমার? মিস করবে আমায়?”
ইভানা আবরারের চোখের দিকে তাকাল। চোখ জোড়ায় স্পষ্ট আকুতি দেখতে পাচ্ছে সে। নির্নিমেষ তাকিয়েই রইল।
আবরার পুনরায় বলল,
“বলো না কাঁচাগোল্লা। মিস করবে আমায়?”
ইভানা নজর সরিয়ে নিল। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“জানিনা।”
আবরার হাসল। মুগ্ধতার হাসি। হাই তুলে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“তুমি প্রেমে পড়ছো বউ। বিন্দু বিন্দু করে জমা হচ্ছে মনের ঘরে। অচিরেই তা সিন্ধুতে পরিণত হবে।”
ইভানা কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল পলক না ফেলে।
টের তো সেও পাচ্ছে। তেইশটা বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর চব্বিশতম বসন্ত বোধহয় তার জন্য প্রেম নিয়ে আসছে। শুধু প্রেম নয়। ভয়ংকর প্রেম। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে সমুদ্র যেমন উত্তাল হয় ঠিক তেমন উত্তাল হতে শুরু করেছে তার মনের প্রেম সমুদ্র।
ইভানার তাকানো দেখে আবার ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কি দেখছো এমন করে ? নজর দিয়ে দিচ্ছো একেবারে।”
ইভানা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কে ভাই আপনি? টম ক্রুস নাকি পাওলো দিবালা?”
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“আবরার ফাইয়াজ। একদম এক্সট্রা অরডিনারি।”
ইভানা ভেংচি কেটে কফি মগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“নিন। ঠান্ডা হয়ে এলো বোধহয়।”
আবরার হেসে মগ হাতে নিয়ে বলল,
“তুমি বানিয়েছো?”
“না, আমি যাওয়ার আগেই মা বানিয়ে ফেলেছিলেন।”
“মা এমনই। যতক্ষণ সুস্থ আছে তোমাকে কিচেনের আশেপাশেও বোধহয় যেতে দেবে না। একটু ভালবেসো তাহলে মাথায় তুলে রাখবে। ”
ইভানা চমৎকার হেসে বলল,
“আমি বোধহয় পৃথিবীতেই স্বর্গসুখ পেতে চলেছি।”
আবরার নিজের গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে বলল,
“আগে আবরার ফাইয়াজ এর ভালবাসা গ্রহণ করতে শেখো। তখন বুঝবে সুখ কাকে বলে, কত প্রকার এবং কি কি। প্রয়োজনে প্রত্যেক প্রকারের সংজ্ঞাসহ উদাহরণও দেখিয়ে দেব। শুধু একবার ভালবাসো।”

“আপনার প্রপোজাল এক্সেপ্টেড।”

“এখনই! রাতেই তো বললে কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখতে চাও।”

“এমন একটা মানুষের গার্লফ্রেন্ড হওয়াও সৌভাগ্যের। আমি সেই পরম সৌভাগ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাই না।”

“ইসসস! আট বছর আগে কেন বললে না!

ইভানা বুঝতে না পেরে বলল,
” মানে? আট বছর আগে কি করে বলতাম? তখন তো আমি বাচ্চা। বোধহয় এইট-নাইনে পড়ি।”

“কিছু না। শোনো না আজ একবার পাসপোর্ট অফিসে যাব। এগারোটার দিকে রেডি থেকো।”
ইভানা মাথা নেড়ে বলল,
“ওকে।”

নোভা কলেজের জন্য রেডি হয়ে ডাইনিং এ বসতেই রাতের ব্যাপারটা কুটকুট করতে লাগল মাথার ভেতরে। ফাহিমা করিম মেয়ের সামনে খাবার দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“শরীর ঠিক আছে মা? কলেজে আজ না গেলে হবে না?”
নোভা রুটির টুকরো মুখে পুরে দিতে দিতে বলল,
“শরীর খারাপ হলো কখন আমার? আমি তো বরাবরই ফিট এন্ড ফাইন। কলেজে যাব না কেন?”
ফাহিমা করিম নোভার মুখোমুখি বসে বললেন,
“শরীর ঠিক থাকলে কাল ওভাবে বিয়ের কথা বলতে না। আমি তো তোমাকে চিনি। হয় শরীর খারাপ ছিল নয় মন।কোনটা?”
নোভা মাথা নিচু করে ফেলল। আমতা আমতা করে বলল,
“সরি মা। মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল কাল। আর বলব না। আগামী পনেরো বছরে বিয়ের নামই নেব না।”
ফাহিমা করিম আতঙ্কিত হওয়ার ভান করে বললেন,
“সে-কি! বিয়ে না করলে কিভাবে হবে? আমি তো রিফাত কে বলেছি আমাদের বাসার সামনের রোডে যে লোকটা সবজি বিক্রি করে তাকে ধরে নিয়ে আসতে। এখন তুমি বিয়ে করতে না চাইলে আমার সম্মান খোয়া যাবে তো।”
নোভা বিস্মিত গলায় বলল,
“তুমি মজা করছো আমার সাথে মা?”
ফাহিমা করিম হাসলেন। বললেন,
“একটুখানি। সবটুকু শেষ করে তবে বের হবে।কেমন?”
নোভা মাথা নাড়ালো। ফাহিমা করিম উঠতেই বলল,
“মা রিফাত ভাই কোথায়?”

“সে তো চলে গেছে কালই। কেন?”

নোভা চমকে উঠল। বলল,
“আর আসে নি?”

“না তো। আজ অফিস জয়েন করতে হবে বলল। কত করে থাকতে বললাম। কথাই শুনল না ছেলেটা। সকালে খেয়ে যেতে বললাম তাও আসল না। ছেলেটা দিনকে দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। শুধু পালাই পালাই করে।”

নোভা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনটা খচখচ করছে তার। যদি রিফাত চলেই যায় তবে রাতের ঘটনাটা কি? স্বপ্ন? স্বপ্ন এত জীবন্ত হয়?

নোভা কিছু বলছে না দেখে ফাহিমা করিম চলে গেলেন।
কিয়দংশ সময় পর আবরার এসে মুখোমুখি বসে বলল,
“কি ব্যাপার বাচ্চা একা একা খাচ্ছো কেন? আমাকে ডাকলেই পারতে। আমিও তো খাব।”
নোভা মুচকি হেসে বলল,
“তুমি আবার এত সকালে খাওয়া শুরু করলে কবে থেকে? তোমার তো বারোটার আগে মুখে খাবার রুচে না দাদাভাই।”
আবরার নোভার প্লেট থেকে এক টুকরো শুকনো রুটি মুখে নিয়ে বলল,
“আজ তোমার সাথে বের হবো।”
নোভা বিস্মিত হয়ে বলল,
“কলেজে যাবে?”
“হুম। কেন? কোনো সমস্যা?”
“না না সমস্যা কেন হবে? চলো না মজাই হবে। ভাবী কেও নিয়ে চলো।”
আবরার হেসে বলল,
“তাহলে মাকেও নিয়ে যাই। রিফাত কেও আসতে বলি। তাহলেই ষোলো কলা পূর্ণ হবে। একদম ফুল ফ্যামিলি”
নোভা ঠোঁট বেকিয়ে হাসল।
আবরার কিছু একটা মনে পড়ার মত করে বলল,
“কাল রাতে অত জোরে চিৎকার কেন করছিলে?”
নোভা চমকে উঠল। আমতাআমতা করে বলল,
“কখন দাদাভাই?”
“ওই তো দুইটার দিকে।দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে গিয়ে দেখলাম ঘুমাচ্ছো। অথচ তার অল্প কিছুক্ষণ আগেই চিৎকার করে সবার ঘুম ভাঙিয়েছিলে।”
নোভা জোর করে হেসে বলল,
“বোধহয় ভূতের স্বপ্ন দেখেছিলাম। খুব পঁচা একটা ভূত। তেঁতুল গাছের ভূত। মাথায় তিনটে শিং ওয়ালা ভূত।”
আবরার হেসে বলল,
“ভূতটা কালো নাকি সাদা?”
নোভাও হাসল। বলল,
“বেগুনি কালার ভূত দাদাভাই।”

নোভার সাথে কলেজে গেলেও এগারোটার মিনিট দশেক আগে কলেজ ছেড়ে বাড়ির পথে প্রত্যাগমন করল আবরার।
বাড়ি ফিরতেই দেখল নোভা রেডি হয়ে বসে আছে। আকাশি আর সাদা রঙের মিশেলে একটা তাঁতের শাড়ি। সোনার গহনায় জড়িয়ে নববধূর মতোই দেখাচ্ছে তাকে।
পিনপতন নীরবতাময় কক্ষে ইভানা মৃদুস্বরে বলল,
“এখন বের হবেন?”
আবরার পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ইভানার মুখোমুখি দাঁড়াল। নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে গভীর স্বরে বলল,
“একবার জড়িয়ে ধরার অনুমতি চাই। শুধু একবার। একটাবার।”
ইভানা নিচের দিকে তাকিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল।
আবরার পুনরায় বলল,
“এখন জড়িয়ে না ধরলে আমি বোধহয় বাঁচব না কাঁচাগোল্লা। কথা দিচ্ছি প্রেমে ফেলব না। একবার জড়িয়ে ধরলে কেউ প্রেমে পড়ে না। একবার প্লিজ।”
ইভানা তবুও কিছু বলল না। মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে রইল।
আবরার পিছু হটতে চাইল। পা ফেলে পেছনে সরতে লাগল। ইভানা তা দেখে মৃদু স্বরে বলল,
“আমি আবার শাড়ি পড়তে পারব না। সাবধানে….”
বলতে দেরি কিন্তু আবরারের ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসতে দেরি হয় নি। দেরি হয় নি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিতেও।
প্রথমবার! প্রথমবারের মত নিজের অতি সাধনায় অর্জিত মানুষটাকে বক্ষপিঞ্জরে জড়িয়ে নিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ল আবরার। পিঠের উপর আলতো করে মেলে রাখা হাতটা মাথার পেছনে চেপে বুকের সাথে পিষে বিরবির করে বলল,
“তোমার ছোঁয়া এতটাই শান্তি দেবে, জানতাম। জানতাম আমি।”

ইভানা চোখ বুজে অপর মানুষটার বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ শুনছে কান পেতে। তারা যেন ক্রমাগত একটা শব্দই উচ্চারণ করছে -ইভানা, ইভানা এবং ইভানা।
এতক্ষণ ফেলে রাখা হাতটা আস্তে আস্তে উঁচু করে আবরারের পিঠের উপর আলতো করে ছোঁয়ালো। বন্ধ চার জোড়া চোখের ও তিরতির করে কাঁপতে থাকা দু’জোড়া ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল কিছু প্রাপ্তির খুশি।

দু-হাতের আঁজলা ভরে ইভানার মুখশ্রী তুলে অনিমেষ তাকিয়ে রইল আবরার। ইভানাও আজ লাজ, সংকোচ ভুলে চোখে চোখ মিলিয়েছে।
কিয়ৎক্ষণ পর আবরার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“আমার কাঁচাগোল্লা। আমার। শুধু আমার।”
ইভানা চোখ খুলল। খুব কাছ থেকে দেখল একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষটির পুরুষালী মুখাবয়ব। নাসারন্ধ্র বেদ করল তীব্র পুরুষালী ঝাঁঝালো গন্ধ।
আবরার তাকাতেই ইভানার নজর কাড়ল তার চোখের কার্নিশে চিকচিক করতে থাকা নোনাজলটুকু। হাত বাড়িয়ে আঙুল ছুঁয়ে দিল সেখানে। আঙুলের মাথায় জলটুকু দেখিয়ে বলল,
“কি এটা?”
আবরার অন্য দিকে তাকাল। অক্ষিপল্লব ঝাপটে মৃদু হেসে বলল,
“প্রাপ্তি। আজ নয়, একদিন বুঝবে। সেদিনটা আর দূরে নেই । খুব কাছে।”

“আপনি কাল রাতে আমার ঘরে এসেছিলেন?”
রিফাত ভ্রুকুটি করে তাকাল। সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
“তুই কি আমার চরিত্র নিয়েও টানাটানি করবি নোভা?”
নোভা পুনরায় বলল,
“কাল এসেছিলেন?”
রিফাত ধীর গলায় বলল,
“নাহ। তোর বিয়ের আগে পর্যন্ত আর যাব না ঠিক করেছি।”
নোভা স্তব্ধ হয়ে গেল। তবে সবটাই স্বপ্ন ছিল? কেন এত জীবন্ত? মনে হচ্ছে তার ছোঁয়া এখনো গলদেশে লেপ্টে আছে। ক্ষণে ক্ষণে জ্বলছে। দগ্ধ হচ্ছে প্রখর অনুভূতি দ্বারা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here