সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -১৮+১৯

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৮

“তোমার ছেলের আর কত অধঃপতন দেখার পর তোমার হুঁশ ফিরবে ফুপু?” শান্ত কণ্ঠে শুধালো ইভানা।
সাজিদের মা সাজেদা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। খানিক পরে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“কি করেছে বাবু?”
ইভানা ফোঁত করে শ্বাস ফেলল। মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বা হাতে ঘাড়ের পেছনে চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করে গম্ভীর গলায় বলল,
“নোভার সাথে তোমার ছেলে সেটাই করেছে যা বহুবছর আগে আমার সাথে করেছিল। শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছে তোমার ছেলে।”
সাজেদা বেগম সাজিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ও কি সত্যি বলছে বাবু?”
সাজিদ মাথা নিচু করে ফেলল।
ইভানা পুনরায় বলল,
“মা হিসেবে তোমার লজ্জা পাওয়া উচিৎ। ছেলেকে শাসন করা উচিৎ।”
সাজেদা বেগম সাজিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“মেয়েটাকে পছন্দ?”
সাজিদ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।
সাজেদা বেগম এবার ইভানার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওটা তো তোর ননদ তাই না? বিয়ে তো দিবিই। আমার বাবুর পছন্দ হয়েছে। তাই ওর সাথেই বিয়ে দিয়ে দে। আবরার কোথায়? তাকে ডাক। আমি কালই যাব প্রস্তাব নিয়ে।”
ইভানা হাত তালি দিতে দিতে বলল,
“বাহ! এই নাহলে মা। বাঁধিয়ে রাখার মত। তোমার ছেলের মত কুলাঙ্গারের কুকর্ম ঢাকতে তোমার মত একজন মা’ই যথেষ্ট। তুমি ভাবলে কি করে তোমার চরিত্রহীন ছেলের সাথে আমি নোভার বিয়ে হতে দেব। আর নোভাই বা কেন রাজি হবে?”
সাজেদা বেগম এবার চটে গেলেন। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“যোয়ান ছেলেপেলেদের এরকম একটুআধটু হয়েই থাকে। বিয়ের পর আর বাইরে নজর দেওয়ার সময়ই পাবে না।”
ইভানা এবার শব্দ করে হেসে উঠল।
“তোমার ছেলের কয়টা বউ পালার ক্ষমতা আছে ফুপু? আমার বেলাতেও ঠিক এভাবেই কথা বলেছিলে তুমি। এক ছেলের সাথে কত মেয়ের বিয়ে দিতে চাও তুমি? কি করে তোমার ছেলে? কত টাকা কামানোর মুরোদ আছে? নিজেই তো বাপের ঘাড় ভেঙে খাচ্ছে।”
“আমার স্বামীর কি কম আছে, যে আমার বাবুর একটা বউ পালার জন্য কাজ করতে হবে? যথেষ্ট রোজগার করে আমার স্বামী।”
“তাহলে তোমার স্বামীকেই আরেকটা বিয়ে করিয়ে নাও না। ফুপা রাজি তো আপনি?”
শান্ত কণ্ঠে বলা ইভানার কথা শুনে সাজেদা বেগম তেড়ে এলেন। কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ালেন তার স্বামী।
“তোমাকে বিয়ে করে আমার জীবনটা তো শেষ হয়েছেই। সাথে শেষ হয়েছে আমার ছোট ছেলেটার জীবনও। বড়টা তো তোমার মত জঘন্য মস্তিষ্কের। শুধুমাত্র তোমার আস্কারা পেয়ে পেয়ে আজ ও এত বাড় বেড়েছে। তোমার নিজের প্রতি মিনিমাম ঘেন্নাবোধ থাকলে এখন পর্যন্ত এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতে না। অথচ বড় বড় কথা বলে চলেছো। তুমি নারী জাতির কলঙ্ক। তোমার মত মহিলার জন্য আমার মত কিছু পুরুষ নারীদের ভুল বুঝে। ঘৃণা করে। আমার নিজের উপর ঘেন্না হয় এক কালে তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করার জন্য।”
সাজেদা বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার অবাকের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে ইফতি বলল,
“যে পেটে মামুর মত মানুষের জন্ম হয়েছে সেই পেটে তুমি কি করে ঠাঁই পেলে মা? মামুর ছিটেফোঁটাও কি তুমি নিতে পারলে না? কেন সবটা খারাপ নিয়েই তোমার জন্ম হয়েছে? না পেরেছো ভালো স্ত্রী হতে আর না ভালো মা। হ্যা তোমার বাবুর মনের মত মা অবশ্যই হয়েছো তুমি। আমার নয়। সেই ছোট বেলা থেকে আমি কেবল আমার বাবার ছায়াই পেয়েছি মাথার উপর। না পেয়েছি মা আর না বড় ভাই। বাবার মত আমারও ঘেন্না করছে তোমাদের। লোকে বলে কুপুত্র যদিও হয় কু মাতা কখনো নয়। তুমিতো কু মাতা’ই হলে মা। আই হেট ইউ মা। আই হেট ইউ।”

“আবরার যদি জানে তোর বাড়িতে এসে তোর ভাই দ্বারা তার বোন ধর্ষিত হতে হতেও হয় নি। তাহলে তোকে নেবে? নেবে না রে। লাথি মেরে ফেলে চলে যাবে।”
সাজেদা বেগমের কথা শুনে ইভানা মুচকি হাসল। বলল,
“তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? কি ভাবছ? আবরারের ভয় দেখালে আমি ভয়ে সিটিয়ে যাব? সংসার ভাঙার ভয়ে? যে সংসার শুরুই হলো না এখনো, সেই সংসারের ভয়ে আমি এত বড় সত্যি চেপে যাব? কখনো না। আবরার কে আমি নিজেই বলব। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।”

ইভানা নিজের ফোন থেকে আবরার কে কল করার আগেই মাকসুদা খানম ইভানা কে থামিয়ে বলল,
“ব্যাপারটা কি ঠিক হচ্ছে? আবরার যদি তোকে ভুল বুঝে?”
ইভানা পুনরায় মুচকি হাসল।
“আমি যতদূর তাকে চিনেছি সে এমন মানুষ নয় মা। এরকম ঠুনকো ভুল বুঝাবুঝিতে সে আমাকে রেখে যাবে না। আই থিংক রেখে যেতে সে পারবে না।”
“ঠিক বলেছি না বাবা?” ইয়াসিন মোন্তাজের দিকে তাকিয়ে বলল ইভানা।
ইয়াসিন মোন্তাজ মৃদু হেসে সায় জানালেন।
ইভানা পুনরায় ফোনের দিকে তাকাতেই আবরার গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কল করার প্রয়োজন নেই ইভানা। আমি চলে এসেছি। ইনফ্যাক্ট অনেকক্ষণ আগেই এসেছি। না চাইতেও অনেক কিছু শুনেও ফেলেছি।”
ইভানাসহ উপস্থিত প্রতিটি মানুষ চমকে উঠে আবরারের দিকে তাকাল।
ইভানা এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“আই’ম সরি। আমার দায়িত্ব আমি রক্ষা করতে পারি নি…”
আরও কিছু বলার আগেই আবরার হাত উঁচিয়ে বলল,
“এটা তোমার ভুল নয়। আশা করছি সরি শব্দটার অপব্যবহার করবে না।”
ইভানা বিস্মিত হয়ে পুনরায় কিছু বলার আগেই আবরার ইয়াসিন মোন্তাজের চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমি পুলিশ কল করলে কি আপনার আপত্তি আছে বাবা?”
“আমার আপত্তি নেই।” হুট করেই বলে উঠলেন সাজিদের বাবা।
আবরার গম্ভীর কণ্ঠেই বলল,
“এটা আপনারই করা উচিৎ ছিল এবং তা বহু আগেই।”
বলে ফোন করল নিকটস্থ থানায়।
রিফাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আশা করছি তাকে উত্তম মধ্যম কিছু দেওয়া হয়েছে?”
রিফাত মুচকি হেসে মাথা নোয়ালো।
নোভার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই নোভা উড়ন্ত ফড়িং এর ন্যায় আছড়ে পড়ল ভাইয়ের বুকে। আবরার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
“দাদাভাই খুব পঁচা তাই না? সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় উপস্থিত থাকতে পারে না। এমন দাদাভাই থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো তাই না?”
নোভা আবরারের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। গাল ফুলিয়ে বলল,
“বকে দেব?”
আবরার হেসে বোনের কপালে চুমু এঁকে দিল।

ইভানা সাজেদা বেগমের সামনে গিয়ে আয়েশ করে বলল,
“আমি বরং আমার শ্বাশুড়ি মা’কে ফোন করি কেমন? তুমি আমার শ্বাশুড়ি কে বলো এসব কথা। তাহলে তোমার জায়গাটাও নাহয় পাকাপাকি করা যাবে। চৌদ্দ শিকের পেছনে!”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৯

দ্বিতীয় বারের মত শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে গোছগাছ করছে ইভানা। প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ আগেই। তবুও একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাকে বলে।
আলমারির একপাশে বাবার কিনে দেওয়া সাদা রঙা বার্বি ফ্রক দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়ল। অতি যত্ন করে আগলে রাখা কাপড়ের তৈরী এক টুকরো আবেগ হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে মৃদুস্বরে বলল,
“কেন এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলাম বাবা! কি হত আরও কিছু সময়, আরও কিছু বছর তোমাকে এভাবে কাছে পেলে! কি হত আরও খানিকটা সময় তোমার ছায়াতলে আশ্রয় দিলে! এ কেমন নিয়ম বাবা! যে নিয়ম বাবা মেয়েকে আলাদা করে দেয় সেই নির্দয়, নিষ্ঠুর নিয়মের বেড়াজালে তো আমি জড়াতে চাই নি। কেন জড়ালে আমায় মা? আমি তো সহ্য করতে পারছি না এই বিচ্ছেদ। দম যে আঁটকে আঁটকে আসছে। নিশ্বাসগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। কি করে সহ্য করব আমি মা? কি করে পারলে তুমি এই মরণ যন্ত্রণা সহ্য করে সুখের সংসার সাজাতে…”

ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ পেতেই পুনরায় আলমারিতে বন্দী করল টুকরো টুকরো আবেগগুলোকে। আবরার ইভানাকে আলমারি ঘাঁটতে দেখে হঠাৎ মনে পড়ার মত বলল,
“ওহ ইভানা, তোমার প্রয়োজনীয় কাগজগুলো সাথে নিয়ে নিও আজই।”
ইভানা পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আজই! কেন?”
“পাসপোর্ট অফিসে যাব কাল। তোমার পাসপোর্ট বানাতে হবে তারপর ভিসার কাজের জন্যও লাগবে।”
ইভানা চমকে উঠল। ঘাবড়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন!”
আবরার বুঝতে না পেরে বলল,
“কি? কিসের কথা দিয়েছিলাম?”
ইভানা নিজেকে সামলাতে চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো করে ফেলল। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে সময় নিয়ে চোখ খুলল।
আবরারের চোখে চোখ রেখে স্থির গলায় বলল,
“আপনি কথা দিয়েছিলেন এবং এই শর্তে বিয়েটা হয়েছে যে আমি আপনার সাথে ইতালি যাব না। আপনি মেনে নিয়েছিলেন। আর মেনে নিয়েছিলেন বলেই বিয়েটা হয়েছে। নইলে পৃথিবী রসাতলে গেলেও আমি আপনাকে বিয়ে করতাম না। এখন বিয়ে হয়ে গেছে বলে আপনি কথার খেলাপ করতে পারেন না। প্রয়োজনে সব কাগজ আমি আগুনে জ্বালিয়ে দেব।”
আবরার বুকে হাত গুঁজে সরু চোখে তাকিয়ে রইল। ইভানা আকুতি মিশ্রিত গলায় পুনরায় বলল,
“আমি সত্যি যাব না। যেতে চাই না প্লিজ। একটু বুঝুন।”
আবরার দৃষ্টি সরালো না। তবে পরিবর্তন করল। সরু দৃষ্টি সময়ের পরিক্রমায় পরিণত হলো রোমান্টিক দৃষ্টিতে ।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ইভানার দিকে। ইভানার পিছিয়ে গিয়ে আলমারির সাথে সেঁটে গেল। আবরার ইভানার দুপাশে দু-হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে নিচু গলায় বলল,
“কেন মেয়ে? তুমি কি চাওনা স্বামীর সাথে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ভালবাসায়, আলাপে, আদরে মাখামাখি করে কাটাতে? চাওনা শীতের রাতে বিড়ালছানার মত গুটিশুটি মেরে আমার তপ্ত বুকের উষ্ণতা মাখতে? নাকি চাওনা আমায় তোমার প্রেমের উষ্ণতায় ভিজিয়ে দিতে? কোনটা চাওনা মেয়ে?”
ইভানা মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে রইল। আবরারের বলা প্রতিটি কথা যেমন তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে ; ঠিক তেমনি নাড়িয়ে দিয়েছে তার বলা প্রতিটি কথার সাথে ত্যাগ করা উষ্ণ নিশ্বাসগুলো। কানের খানিকটা নিচে এসে তপ্ত বায়ুগুলো কাঁপিয়ে দিয়েছে তার শরীর থেকে অন্তরাত্মা পর্যন্ত।
আবরার পুনরায় কিছু বলার আগেই ইভানা ঠোঁটের উপর কম্পিত হস্তের আলতো স্পর্শ করে থেমে থেমে বলল,
“আমি চাই। কিন্তু এখানে। ভিনদেশে নয়।”
প্রথম বার প্রিয়ার হাতের স্পর্শ নিজ ওষ্ঠে অনুভূত হতেই আবরার চমকে উঠল। সাথে চমকাল তার ঘন হয়ে আসা গলায় থেমে থেমে বলা কথাগুলো শুনে। সে চায়! চায় তার ভালবাসাগুলো গ্রহণ করতে। এর বেশি একজন স্বামী রূপী প্রেমিকের কি’বা চাওয়ার থাকতে পারে? কিছু না। কিচ্ছু না। আবরারের ইচ্ছে করল উড়াল দিতে। নীল আকাশের ঠিক মাঝখানটায় একজোড়া শুভ্র ডানা মেলে উড়তে।

আবরার মুখের উপর থেকে হাত সরালো। তবে ইভানার হাতটা ছাড়ল না। দু’হাতের মুঠোয় পুরে বলল,
“যদি এই নরম হাতটায় একটা চুমু দেই তুমি কি কিছু মনে করবে বউ?”
ইভানা অবাক হয়ে তাকাল। এমনও কেউ হয়! এভাবেও কেউ বলে!
আবরার ইভানার মুখ দেখে কিছু ঠাওর করতে পারল না। তাই মৃদু হেসে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ইট’স ওকে। নো প্রবলেম।”
ইভানার হাতটা মুক্ত হতেই ইভানা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পরক্ষণেই কাঁপা কাঁপা হাত দুটো উঁচু করে আবরারের দিকে বাড়িয়ে দিল। আবরার প্রশ্নাত্নক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে ইভানা মাথা নিচু করে বলল,
“আমি বাঁধা দেই নি।”
আবরার হাসল। প্রশান্তির হাসি। কিছু পাওয়ার আনন্দ খেলে গেল তার চোখেমুখে।
দু’হাতে আঁকড়ে ধরে মাথা নিচু করে পরপর ঠোঁট ছোঁয়াল নরম কোমল হাত দুটোর উল্টো পিঠে।
ইভানা বন্ধ নেত্র যুগলে আরও কিঞ্চিৎ পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করল। অনবরত কাঁপতে থাকা ওষ্ঠ যুগল চেপে ধরল একে অপরকে। হাতের নিচে বিরাজমান শক্ত পোক্ত হাত দু্টোকে খামচে ধরে নিজের ভেতরে চলা অনুভূতির জানান দিল স্বামী নামক মানুষটিকে।

“নোভা! নোভা! কোথায় তুই?”
রিফাতের চিন্তিত কণ্ঠ শুনে নোভা তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। হুরমুর করে ওঠে দরজা খুলে বলল,
“রিফাত ভাই, কি হয়েছে?”
রিফাত কড়া গলায় বলল,
“দরজা বন্ধ করে কি করছিলি তুই?”
ড্রেসআপ দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখনো এভাবে কেন তুই? বাড়ি ফিরবি না? আজও এখানেই থাকতে চাচ্ছিস নাকি?”
নোভার দুঃখে নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। ছেলেটা কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ল। রিফাত তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে গালে কপালে হাত ছুঁয়ে বলল,
“কি হয়েছে তোর? জ্বর বাঁধিয়েছিস? কই তখন তো ছিল না।”
নোভা আয়েস করে বসে বলল,
“কখন রিফাত ভাই?”
“ওই তো যখন তুই আমাকে জড়ি…না কিছু না। যাইহোক জ্বর তো আসে নি। তাহলে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে কেন?”
নোভা রিফাতের কথা কানে না তুলে নিজের মত বলল,
“আজ আমাকে তোমার বুকে আশ্রয় দিয়েছিলে রিফাত ভাই। যেখানটায় মাথা রেখে আমি সারাজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখি। আজ আমি আমার স্বপ্ন ছুঁয়েছি রিফাত ভাই। আমার জন্য আজ ঈদ। ঊনত্রিশ রোজার শেষে হওয়া ঈদের আনন্দ হচ্ছে আমার। ঊনত্রিশ রোজা কেন বললাম জানো রিফাত ভাই? ত্রিশ রোজার শেষে যে ঈদ আসবে এটা সবাই জানে। কিন্তু ঊনত্রিশ রোজার শেষে ঈদটা অপ্রত্যাশিত আনন্দের। আমার কাছে আজকের প্রাপ্তিটা অপ্রত্যাশিত। যদিও আগের ঘটনাটা নিকশ কৃষ্ণ আঁধার।”
কিছুটা সময় থেমে দম নিয়ে পুনরায় বলল,
“জানো রিফাত ভাই, আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় মরে যাব আজ। আর বেঁচে গেলেও ছাদ থেকে লাফিয়ে নিজের অতি মূল্যবান প্রাণটা বিসর্জন দিতে হবে। ভেবেছিলাম হয়তো আর তোমার এই বিরক্তি মাখা মুখটা দেখতে পাব না। দাদাভাই কে দাদাভাই বলে ডাকতে পারব না। মা’য়ের বুকেও আর ফেরা হবে না। কিন্তু যখন দিশেহারা আমি বাঁচার পথ খুঁজছিলাম ঠিক তখনই দূত হয়ে তুমি এলে। তোমার অতিপরিচিত ভরাট কন্ঠের শব্দ শুনে আমি দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম। তখন তুমি না এলে হয়তো এতক্ষণে আমার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে।”

হঠাৎ করেই রিফাত রেগে গিয়ে বলল,
“চড়িয়ে গাল লাল করে দেব বেয়াদব মেয়ে।”
নোভা হাসল। চওড়া হাসি।
রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“পাগলের মত হাসছিস কেন?”
নোভা পুনরায় হাসল। খানিক বাদে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে নমনীয় গলায় বলল,
“বলে দাও না ভালবাসো।”
রিফাত চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। পরক্ষণেই গলা ঝেড়ে বলল,
“তোকে বলেছিলাম আমার গার্লফ্রেন্ডের কথা। নোরা। ও আসবে কয়েকদিনের মধ্যেই। এলে তোর সাথে পরিচয় করাব। তাহলে তোর ভুল ধারণা ভাঙবে।”
নোভা সরু দৃষ্টিতে তাকাল। তাকিয়ে থাকা অব্যাহত রেখে বলল,
“আমি রেডি হব। তোমার গার্লফ্রেন্ড নিশ্চয়ই চায় না তুমি অন্য মেয়ের চেঞ্জ করা হা করে গিলো। সেটাও আবার তোমার অর্ধেক বয়সী একটা মেয়ে।”

“তোমার স্বামী ভিনদেশে কোনো ভিনদেশিনীর সাথে সংসার পেতেছে কি-না সেটা দেখার জন্যও তোমার একবার যাওয়া উচিত কাঁচাগোল্লা।”
ইভানা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ভিনদেশিনী! আচ্ছা! কি ভেবেছেন? এটা বললে আমি সুরসুর করে চলে যাব? কখনো না। যাব না আমি।”
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“তিন মাসের জন্যও না? বছরে তিনটি মাস? আমার জন্য। প্লিজ! বাকি নয় মাস তোমার দেশ কে দাও। পরিবার কে দাও। তিনটে মাসও কি আমার প্রাপ্য নয়?”

“আপনার সারাজীবনই প্রাপ্য। কিন্তু এভাবে কিভাবে? আমি বুঝতে পারছি না।”

“আমি ছ’মাস পরপর আসতে পারব। সেটাও মাত্র পনেরো দিন। বছরে ত্রিশ দিনে তো আমার তোমাকে দেখেই মন ভরবে না। বাকিগুলো তো দূর আসমানে। কিন্তু তুমি যদি যাও তিনমাসের জন্য যেতে পারবে। সারাবছর না হলেও চারভাগের এক ভাগ পেয়েই না-হয় আমি সুখী হলাম। যাবে?”
ইভানা মাথা নোয়ালো। মৃদুস্বরে বলল,
“আপনি খুশি হবেন?”
আবরার একপ্রস্ত হেসে বলল,
“বাঁধভাঙা খুশির জোয়ারে ভাসব।”
ইভানাও হাসল। বলল,
“তবে তাই হোক।”

রিফাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে মৌনতাকে বরণ করে নিয়েছে। কিন্তু মন মস্তিষ্কে চলছে অহরহ কথাবার্তা, ভাবনা। সকালে ইভানা আবরারের সাথে বের হওয়ার পর নোভাকে না দেখে শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে ফিরে আসে। বাসায় ঢুকে নোভার খোঁজ করতে করতে ছাদে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানেই বিধ্বস্ত অবস্থায় পায় তাকে। তখনকার ঘটনাগুলো চোখের পর্দায় ভেসে ওঠতেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তার। এত যত্নে বেড়ে ওঠা ফুলে স্পর্শ করে কলঙ্কিত করতে চাওয়ার অপরাধে আরও কয়েক প্রস্ত আঘাত করতে ইচ্ছে করছে কালপ্রিটটাকে। ছোট্ট ফুলটার হুহু করে কান্নার শব্দগুলো এখনো বোধহয় দূর দুরান্ত থেকে ভেসে আসছে কর্নকুহরে। রিফাত কানে হাত চেপে ধরল। অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল একাকী, নীরবে।

একদিন বাড়ির বাইরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে নোভা। নিজ বাসায় পৌঁছেই ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মূহুর্তেই ভেসে উঠল সেই প্রশস্ত বুকের মালিকের মুখটা। নোভার চোখে সুদর্শন পুরুষের মুখ। কানে ভেসে এলো সেই শব্দগুলো- কিচ্ছু হয় নি পিচ্চি। তাকাও আমার দিকে। শান্ত হও।
ফট করে চোখ খুলে ফেলল। পাশেই ফাহিমা করিম কে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমি বিয়ে করতে চাই মা।”

ড্রয়িং রুম ক্রস করে এগিয়ে যাওয়া তিনজোড়া পা থমকে গেল। আবরার ইভানা অবাক হয়ে তাকালেও রিফাত তাকাল বিস্ফোরিত নয়নে।
ফাহিমা করিম অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন,
“কি বললে?”
নোভা পুনরায় বলল,
“আমি বিয়ে করতে চাই।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here