সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -১৬+১৭

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৬

“এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনে
এই রাত তোমার আমার
তুমি আছো আমি আছি তাই
অনুভবে তোমারে যে পাই
তুমি আছো আমি আছি তাই
অনুভবে তোমারে যে পাই
শুধু দুজনে
এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের।”

ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে মনোলোভা সুরে গাওয়া গানটি শ্রবণ করল নোভা। অনুভব করল হৃদয় গহীনে থাকা সুপ্ত অনূভুতি দ্বারা। কিঞ্চিত সময় পর এগিয়ে এসে নমনীয় গলায় বলল,
“রিফাত ভাই।”
“নোভা, তুই এখানে কেন এখন?” নিস্তব্ধ রজনীতে চাঁদের আলোয় আলোকিত ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে বলল রিফাত।
নোভা মলিন কণ্ঠে বলল,
“চন্দ্রবিলাশ করতে এসেছি। বুঝতে পারি নি তুমিও থাকবে।”
রিফাত সময় নষ্ট না করে বলল,
“তাহলে আছিস কেন এখনো? চলে যা।”
“সত্যি কি এই চাঁদ তোমার আমার রিফাত ভাই?”
রিফাত কণ্ঠে তেজ ঢেলে বলল,
“তুই কি পাগল? চাঁদ কি তোর ভাই তোর নামে লিখে দিছে? এটা কেবল গানেই শোভা পায় নোভা। বাস্তবে চাঁদের মালিকানা কেউ পায় না। তাই পাগলামি না করে নিচে যা। আত্নীয় বাড়ি এসেছিস মনে রাখিস। তোর ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি এটা। সিনক্রিয়েট করিস না।”
নোভা মলিন হাসল।
“আমি সবসময় সিনক্রিয়েট করি তাই না রিফাত ভাই? আমি একটা অসহ্য মানুষ। আসলে আমার এখানে আসাই উচিৎ হয়নি। ভাবির অনুরোধ ফেলতে পারি নি তাই আসতে বাধ্য হয়েছি। তোমাকে জ্বালানোর জন্য সরি রিফাত ভাই। আমি এক্ষুণি চলে যাচ্ছি। আর বিরক্ত করব না।”
রিফাত কিছু বলার আগেই নোভা পিছু ফিরে চলে যেতে উদ্যত হয়। রিফাত স্থির গলায় বলল,
“নোভা দাঁড়া।”
নোভা শুনল কিন্তু মানল না। বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
দু’পাশ এগিয়ে এসে হাত ধরে ছাদের এক কোণে রাখা পানির ট্যাংকের সাথে চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আমাকে ভিলেন বানানোর খুব সখ তোর?”
নোভা কিছু বলল না। কেবল নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে প্রিয় মুখটা দেখতে থাকল।
রিফাত বাহুতে চেপে ধরে ঝাকিয়ে বলল,
“কথা বল ইডিয়ট। ভাইয়ের কাছে গিয়ে এখন বলবি বাড়ি চলে যেতে চাস? কারণ জানতে চাইলে কি বলবি? তোর চেয়ে বয়সে বুড়ো একজন কে ভালবেসে দেবদাসী হয়ে গেছিস? চুপ করে থাকবি না। উত্তর দে।”
নোভা দাঁতে দাঁত চেপে হাতের ব্যথাটুকু গিলে ফেলে বলল,
“আমি পাগল হতে পারি কিন্তু স্বার্থপর নই। আমার নিজের জীবনে সুখের অভাব থাকলেও অন্যের সুখ দেখে আমার জ্বলে না। তাই দাদাভাইয়ের জীবনের সুখের মূহুর্তটুকু নষ্ট করার মত বোকামি আমি করব না।”
বলতে বলতে চোখের কোণ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। রিফাত বুঝতে পেরে হাত ছেড়ে মাথা নিচু করে বলল,
“সরি।”
নোভা তাচ্ছিল্য হাসল। রিফাত বাহুতে হাত রাখতে গেলে নোভা হাত উঁচিয়ে থামিয়ে বলল,
“কোনো দরকার নেই। নোভা আর যাই হোক সহানুভূতি নিতে পারে না।”
রিফাত কিছু বলার আগেই ছাদে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়ে হাত টেনে পানির ট্যাংকের অপর প্রান্তে চলে গেল। নোভা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হলো?”
“হুসস। কেউ এসেছে মনে হচ্ছে।”
“তাতে কি হয়েছে? আসতেই পারে। সেজন্য পালানোর কি হলো?”
রিফাত কপাল চাপড়ে বলল,
“আরে গাধা এটা তোর বাড়ির ছাদ নয়। এখানে অনেক আত্নীয় স্বজন আছে। তারা তোকে আমাকে এভাবে দেখে আকাশ কুসুম ভেবে ফেলবে। গসিব বানাতে তো বাঙালির সময় লাগে না। চরিত্রে কালি লাগিয়ে দিলে কি হবে?”
নোভা হাসল। শূন্যে তাকিয়ে বলল,
“তাতেও যদি কালো হতে পারতাম!”
রিফাত শুনেও না শোনার ভান করে বলল,
“কিছু বললি?”
নোভা মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। রিফাতও আর কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল দূর আকাশের পূর্ণ চাঁদখানার দিকে।

ইভানা আবরার ছাদে আসতেই আবরারের চোখ পড়ল শ্যামলের উপর। ছাদের এক কোণে সে প্রেয়সীর ঠোঁটে নিজের আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত। মূহুর্তেই নজর সরিয়ে ইভানার দিকে তাকাল আবরার। ইভানা আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওইদিকে চলুন। ওখানে চাঁদের আলো বেশি মনোমুগ্ধকর।”
আবরার হকচকিয়ে গেল। বাঁধা দিয়ে বলল,
“না না এখানেই ঠিক আছে। এখানেই থাকো।”
ইভানা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন? ওখানেই যাব আমি। চলুন।”
আবরার মৃদুস্বরে বলল,
“এখানেই থেকে যাও না কাঁচাগোল্লা। পাছে তুমিই লজ্জা পাবে।”
ইভানা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই দুজন কে দেখে নজর ফিরিয়ে আবরারের দিকে তাকাল। আবরার ঠোঁট কামড়ে হাসছে। ইভানা অন্য দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসল।

“যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে।
চাঁদের আলোয় বন্ধু আমার মেতেছিল গভীর চুম্বনে।”

আবরারের উচ্চ স্বরে বলা শব্দ বার্তা শ্যামলের কর্নকুহরে পৌঁছাতেই শ্যামল পেছন ফিরে তাকাল। সায়মা লজ্জায় উল্টোদিকে ফিরে তাকিয়ে আছে। শ্যামল পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
“যেরকম ভাবছিস সেরকম কিছু নয়। আসলে ওর চোখে ময়লা পরেছিল। তাই আরকি…”
আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুই একজন বিবাহিত পুরুষ কে চুমু আর ময়লা বের করার পার্থক্য বুঝাচ্ছিস?”
ইভানা চোখ বড় বড় করে তাকাল আবরারের দিকে।
শ্যামল হেসে বলল,
“হ্যা তুমি তো এখন রোমান্স কিং হয়ে গেছো।”
আবরার লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলল,
“যার বউ বাসর রাতেই বলে আমি কি কাছে আসব তার রোমান্স কিং না হয়ে উপায় আছে?”
ইভানার চোখ এবার বিস্ফোরিত হলো যেন। গোল গোল করে তাকিয়ে রইল।
আবরার সুযোগ বুঝে চোখ টিপে ঠোঁট পাউট করে দেখালো।
ইভানা সায়মার কাছে যেতে যেতে বিরবির করে বলল,
“অসভ্য, ইতর, বদমাস লোক কোথাকার।”

সায়মা হেসে হেসে বলল,
“আমি কি কাছে আসব?”
ইভানা চোখ পাকিয়ে তাকালে সায়মা শব্দ করে হেসে উঠল। কিঞ্চিৎ সময় পর বলল,
“সত্যিই বলেছিলি নাকি? তারপর কি কি হলো রে?”
ইভানা মুচকি হাসল। বলল,
“ঘোড়ার আন্ডা হয়েছে।”
সায়মা বিস্মিত হয়ে বলল,
“কিছুই হয় নি?”
ইভানা মাথা নাড়ালো।
“হয় নি। হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। যেই লোক একটু ছুঁই বলে কেবল হাতে চুড়ি পরিয়ে দেয় তার দাঁড়া কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।”
সায়মা অবাক হলো না। বরং প্রসন্ন হয়ে বলল,
“এরা সব বন্ধুরাই কি এমন?”
ইভানা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
“গড নোস। তবে ইন্টারেস্টিং। প্রেম প্রেম টাইপ সম্পর্ক। হাসবেন্ড নয় ঠিক। প্রেমিক প্রেমিক ব্যাপার আছে তার মধ্যে ।”
“প্রেমে পড়ছিস তবে?’
ইভানা মুচকি হাসল।
” ইভানারা প্রেমে পড়ে না।”

সকাল বেলা ইভানা, নতুন জামাই সহ কাছেই এক ফুপুর বাড়ি বেড়াতে যায়। শয্যাশায়ী হওয়ায় আসতে পারেন নি তিনি। মিনিট দশেকের দুরত্ব হওয়ার আজই ছুটে তাকে দেখতে। আবরারের এরপর সময় হবে কি-না সেটা তো জানা নেই।
সকলে যাচ্ছে শুনে নোভাও যেতে রাজি হয়। কিন্তু রিফাত কে যেতে দেখে ইচ্ছে টা লুকিয়ে ফেলল। অজুহাত দিয়ে বলল সে যাবে না। অগ্যতা তাকে রেখেই রওয়ানা হলো সবাই।

মন খারাপ কাটাতে ছাদে আসতেই দেখতে পেল সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে। নোভা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বলল,
“মিস বিদেশিনী দাঁড়াও।”
নোভা মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। নিচু গলায় বলল,
“কিছু বলবেন?”
সাজিদ এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“হ্যা। একটু সময় পাওয়া যাবে?”
নোভা দু’হাত গুঁজে বলল,
“বলুন।”
” আমি ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলতে পারি না। আসলে আমার তোমাকে ভাললাগে। আমি বোধহয় তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি।”
নোভা ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“হয়ে গেছে? এবার আমি যেতে পারি?”
নোভার এহেন কথায় সাজিদের পুরুষ সত্তায় আঘাত লাগে। ইগো হার্ট হয়। তবুও নরম গলায় বলল,
“আমি সত্যি তোমাকে ভালবাসি। একটু বোঝো।”
বলতে বলতে নোভার গালে হাত রাখে।
নোভা তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট মিস্টার সাজিদ। কথায় কথায় গায়ে হাত দেওয়া ছেলে আমার দুচোখের বিষ।”
সাজিদ কড়া গলায় বলল,
“কই তোমার রিফাত ভাই যখন হাত দেয় তখন তো কিছু বলো না? আমার বেলায় কেন? আমি তো তার থেকে যথেষ্ট স্মার্ট। নাকি তার কাছ থেকে দাদন খেয়েছো? কেবল তার সাথেই বেড শেয়ার করার অঙ্গিকার করেছো? শালা এলেম আছে বলতে হয়।কালা পাঠার মত চেহারা নিয়ে মালডা ধরছে কি।”
সাজিদের গালে স্বশব্দে চড় বসিয়ে অগ্নিঝড়া দৃষ্টি মেলে বলল,
“রিফাত ভাইকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে পায়ের স্যান্ডেল খুলে পেটাবো তোকে আমি। রিফাত ভাইয়ের নাম উচ্চারণ করার যোগ্যতাও তোর নেই।”

সাজিদ এবার কুপিত হলো। নোভার দিকে এগিয়ে গিয়ে একহাত চেপে ধরে ছাদের দরজা বন্ধ করে বলল,
“এবার খোল তোর পায়ের স্যান্ডেল।”
নোভা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“ছাড় বলছি। দাদাভাই জানতে পারলে তোর ধর থেকে মুন্ডু আলাদা করে ফেলবে জানোয়ার।”
সাজিদ উচ্চশব্দে হেসে বলল,
“আমি ভয় পেলাম, মারাত্মক ভয়। আমাকে আপনার আঁচলের তলায় ঠায় দিন মাতা। না না আঁচল নয় ওড়নার নিচে। পারলে জামার নিচেও দিতে পারেন।”
বলেই আবার হাসল সাজিদ।
বদ্ধ উন্মাদের মত আচরণ করতে দেখে নোভা ভয় পেল। হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চেঁচিয়ে উঠল ‘দাদাভাই’ ও ‘রিফাত ভাই’ বলে।
সাজিদ অন্য হাতে নোভার মুখ চেপে ধরে বলল,
“এবার কোথায় যাবে? এবার তো সুন্দরীর দেহে আমার আভিজাত্য ফুটে উঠবে।”
নোভা অসহায় হরিণীর ন্যায় চেয়ে রইল। মনে মনে আওড়াতে লাগল কেবল একটা নাম। “আল্লাহ”।

চলবে….

বি.দ্র. যারা এই পর্বটা পড়বেন তারা কাইন্ডলি কমেন্ট করবেন। পেজের রিচ একদম লো।৷ প্রয়োজনে স্টিকার কমেন্ট করুন।#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৭

পিপাসার্ত এক জোড়া আঁখি প্রিয় মুখটা এক নজর দেখার জন্য হন্নে হয়ে খুঁজছে এ ঘর থেকে ও ঘর। এ বারান্দা থেকে ও বারান্দা। পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নোভার দেখা না পেয়ে দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ল রিফাত। মুখে হাত চেপে নিজেকে সামলে পকেট হাতড়াল। ফোন বের করে কল দিতেই বেজে উঠল নোভা ও সায়মার জন্য বরাদ্দ করা ঘরে। পুনরায় সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করল ফোনটা। বিছানার এক কোণে অবহেলার সহিত পড়ে আছে। মেয়েটাকে বেখেয়ালি বলার সুযোগও পেল না। তার আগেই মনে পড়ল ছাদের কথা। হন্তদন্ত হয়ে ছুটল সেদিকেই।
একের পর এক সিঁড়ি ডিঙিয়ে দরজার কাছে পৌঁছাতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল রিফাত। ছাদের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! এরকমটা তো সচরাচর দেখা যায় না। চিন্তার ভাজ কপালে জায়গা করে নিল মূহুর্তেই। ফিরে আসতে চেয়েও দরজায় কড়া নেড়ে গলা বাড়িয়ে বলল,
“নোভা ভেতরে আছিস?”
ভেতর থেকে কোনো শব্দ এলো না।
রিফাত পুনরায় বলল,
“ভেতরে থাকলে সাড়া দে নোভা। টেনশন হচ্ছে আমার।”

ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে নোভা রিফাতের কণ্ঠ শুনে দেহে প্রাণ ফিরে পেল। কিন্তু দরজা যে ভেতর থেকে বন্ধ। কিছু বলার আগেই সাজিদ মুখে হাত চেপে দরজার উল্টো দিকে নিয়ে গেল টেনে হিঁচড়ে। গায়ের ওড়না পড়ে রইল ধুলোমাখা ছাদের মেঝেতে।
নোভার মুখসহ গলা চেপে ধরে নিচু গলায় বলল,
“একটা শব্দ করলেও জানে মেরে ফেলব। তোকেও, তোর নাগর কেও। চুপচাপ থাক। এমনিতেও তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না আজ। তাই চুপচাপ মেনে নে। আমার খায়েশ মিটিয়ে দে। মন ভরে গেলে তোকে এমনিতেই ছেড়ে দেব। চুপচাপ থাকবি কেউ জানবে না। লোকে জানলে বদনাম তোরই হবে। আমি ছেলে মানুষ। আমার পশমের নাগাল পাওয়ারও কারো সাধ্য নেই।”
নোভা ধস্তাধস্তি থামিয়ে দিল। অকারণ শক্তি অপচয় করে লাভ নেই। তাই সাজিদের কথা মেনে নেওয়ার কথা বোঝাতে চোখের ইশারায় বলল মুখ ছেড়ে দিতে।
সাজিদ মৃদু হেসে বলল,
“তেজ শেষ?”
নোভা মাথা উপর নিচ করে সায় জানালো।
সাজিদ কনফিউজড হয়ে বলল,
“চেঁচাবে না তো?”
নোভা মাথা নাড়ালো।
সাজিদ মুখ থেকে হাত সরালেও দু’হাতে আঁকড়ে ধরে রাখল নোভার কাঁধের কিছু অংশ।
নোভা সুযোগ বুঝে সাজিদের হাত টেনে শক্ত করে কামড় বসিয়ে দিল। সাজিদ অপর হাত আলগা করতেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“রিফাত ভাই।”
পরপর উচ্চ স্বরে ডাকতে ডাকতেই ছুটল দরজার দিকে। সাজিদ পেছন পেছন দৌড়ে এসেও নাগাল পেল না। তার আগেই নোভা দরজার ছিটকিনি খুলে ঝাপিয়ে পড়ল প্রিয় মানুষটার প্রশস্ত বুকে। পিঠের কাপড় আঁকড়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল।
রিফাত টাল সামলাতে পাশের দেয়ালে হাত রাখল। সাজিদ নোভার পেছনে দাঁড়িয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে।
রিফাত নোভার পিঠে হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“কিচ্ছু হয় নি পিচ্চি। আমি চলে এসেছি তো। শান্ত হও।দেখ রিফাত ভাই চলে এসেছে। এতক্ষণ ডাকছিলে তো আমাকে। দেখ সত্যি সত্যি এসেছি আমি। কান্না থামাও।”

নোভার কান্না থামল না। বরং বেড়ে গেল। অগ্যতা রিফাত নোভা কে নিয়েই ছাদের উপর পা রাখল। সাজিদ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনি গেলে কিভাবে হবে ভাই? আমার পিচ্চিকে শান্ত করার সময়টুকু অন্তত দিন। তারপর নাহয় চলে যাবেন। আপনার ঋণ শোধ করার সুযোগ তো দিন। বেশি সময় নেব না। জাস্ট পাঁচ মিনিট। কথা দিচ্ছি।”
বলে পেছনে ফিরে দরজায় আবার ছিটকিনি টেনে দিল রিফাত।
ছাদের দরজা বন্ধ দেখে সন্দেহ হলেও সাড়াশব্দ না পেয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় রিফাত। কিন্তু ছাদে হওয়া একটা হালকা শব্দ তার কানে আসে। পুনরায় ফিরে এসে দরজায় কান পেতে রয়। পরক্ষণেই নোভা চেঁচিয়ে ডেকে উঠে। এরপর আশ্রয় নেয় তার বক্ষপিঞ্জরে।

সাজিদের উপর থেকে নজর সরিয়ে নোভার মুখটা দু’হাতের আঁজলায় তুলে নরম গলায় বলল,
“শান্ত হবি না? আর কত পোড়াবি?”
নোভা চোখ মেলে তাকাল। হিচকি তুলতে তুলতে বলল,
“ও ও আমাকে..”
কথা শেষ না করে আবারও হু হু করে কেঁদে ফেলল।
রিফাত দু’হাতে আগলে নিল বুকের সাথে। মাথার উপর থুঁতনি ঠেকিয়ে বলল,
“আমার পিচ্চি তো এত ভঙ্গুর নয় নোভা। সে তো কামিনী ফুল নয়। যে একটু ছোঁয়াতেই ঝরে যাবে। শান্ত হয়ে বল আমাকে। কি করেছে জানোয়ারটা?”
নোভা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ওভাবেই বুকের সাথে লেপ্টে থেকে বলল,
“আমার ওড়না।”
রিফাত এবার নোভার দিকে নজর দিল। ওড়না নেই বুঝতে পেরে আশেপাশে তাকাল। অদূরেই মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে দেখে কড়া চোখে সাজিদের দিকে তাকাল।
সাজিদ রিফাতের চোখের দৃষ্টিতে সামান্য কেঁপে উঠল। রিফাত থেকে নজর সরিয়ে দ্রুত পায়ে ওড়না হাতে তুলে এগিয়ে দিল রিফাতের দিকে। রিফাত ওড়নাটা ঝেড়ে নোভার মাথায় বউয়ের মত করে দিয়ে বলল,
“এবার চুপচাপ সিনেমা দেখ, কেমন?”
নোভা গায়ের সাথে ওড়না জড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
“ওর মুখটা ভেঙে দাও রিফাত ভাই। হাতটাও।”
রিফাত ভ্রুকুটি করে তাকাল নোভার দিকে। পরক্ষণেই সাজিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,
“কি কি করেছিস ডিটেলসে বল।”
সাজিদ ঢোক চেপে ইনিয়েবিনিয়ে বলল,
“আমি কিছু করিনি ভাই। উনিই আমাকে সিডিউস করার চেষ্টা করছিল।”
নোভা তৎক্ষনাৎ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল। মানুষ কত তাড়াতাড়ি রং বদলাতে পারে তা স্বচক্ষে প্রথমবার দেখল।
রিফাত দু’হাত বটে বলল,
“তাই! আর কি করেছে উনি?”
“ওই তো আমাকে একা দেখে ছাদের দরজা বন্ধ করে দিল। গায়ের ওড়না ফেলে দিয়ে আমার কাছে আসতে চাইল। আমি বাঁধা দিয়েছি, তবুও…”
রিফাত সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“বাঁধা কেন দিলেন ভাই? মেশিনে জোর নেই?
নোভা বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল রিফাতের দিকে। তার বলা বাক্যগুলো ঠিক হজম হচ্ছে না নোভার।
সাজিদ মাথা নিচু করে বলল,
” আমি ভদ্রলোক ভাই। এসব মেয়েদের উটকো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। তাই বাঁধা দিয়েছি।”
নোভা এবার চেঁচিয়ে উঠল। উচ্চ স্বরে বলল,
“ও মিথ্যে বলছে রিফাত ভাই। আমি এসব কিছুই করিনি।”
রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“তুই কি আমাকে তোকে চেনাচ্ছিস? তোর থেকে তোকে আমি বেশি চিনি। তোর শরীরের প্রতিটি লোমকূপও আমার নখদর্পনে। তাই নিজেকে জাহির করার প্রয়োজন নেই। অন্তত আমার সামনে।”
নোভা বিস্মিত হলো। মানুষটা এভাবে বলল!
রিফাত এবার সাজিদের দিকে তাকাল।
“সাজিদ আহমেদ ! পাক্কা মেয়ে বাজ। সোজা কথায় কাজ নাহলে জোরজবরদস্তি করার পুরনো রেকর্ড আছে। যা শুরু হয়েছে বহু আগে থেকেই। আত্নীয় স্বজনের মধ্যেও এই অভিযোগের কমতি নেই। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি জীবনে বহু প্রেমের সম্পর্কে জরিয়েছে সাজিদ আহমেদ। সম্পর্ক শুধু বিছানা পর্যন্ত টেনে নেওয়া অবধি। আর যারা রাজি হয় না তাদের সঙ্গে চলে জবরদস্তি। নোভা কি তাদের দলেরই কেউ?”
সাজিদ রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে বলল,
“ও আমাকে সিডিউস করেছে।”
রিফাত আর ধৈর্য রাখতে পারল না। মুখ বরাবর ঘুষি মেরে বলল,
“ও তোকে সিডিউস করেছে কুত্তার বাচ্চা? ওই এক রত্তি মেয়ে তোকে সিডিউস করেছে? আরে গাধার বাচ্চা, ওর দিকে আমি সোজা চোখে তাকালেই ও লজ্জায় মরে যেতে চায়। আর তোর মত জানোয়ার কে ও সিডিউস করেছে। আমাকে শেখাবি তুই?”
এলোপাতাড়ি চড় থাপ্পড় মেরে মেঝেতে ফেলে দিল। বুকের উপর পা তুলে বলল,
“এখন যদি তোর জান কেড়ে নেই, পারবি নিজেকে বাঁচাতে? বল পারবি?”
সাজিদ পা ধরে বলল,
“এবারের মত মাফ করে দেন ভাই। আমি আর কোনো মেয়ের দিকেই তাকিয়ে দেখব না। কথা দিচ্ছি ভাই। এবারের মত ছেড়ে দিন।”
রিফাত নোভার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর কোনো অভিযোগ আছে?”
নোভা মাথা নিচু করে বলল,
“ও তোমাকে কালা পাঠা বলেছে।”
রিফাত এত কিছুর মাঝেও হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল,
“কালা কে কালা বলবে না তো ধলা বলবে?”
নোভা চোখ তুলে তাকাল। কঠিন গলায় বলল,
“বলবে না। কেউ তোমাকে কিচ্ছু বলবে না। ওকে ওঠাও। হিসেব বরাবর করতে হবে। এখনো কিছুটা বাকি।”
সাজিদ ওঠে দাঁড়াতেই নোভা স্বশব্দে চড় বসিয়ে দিল। সাজিদ রক্তলাল চোখে তাকাতেই বলল,
“চোখ গেলে দেব একদম। নিচে তাকা। তাকা বলছি। এটা আমার রিফাত ভাই কে কালা পাঠা বলার জন্য। আর কখনো বলে দেখিস জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব।”
রিফাত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে নোভার কীর্তিকলাপ দেখতে লাগল। নাজুক রমণীর মূহুর্তেই বদলে যাওয়া রণচণ্ডী রূপ দেখে বিস্ময়ের সহিত বিরবির করে বলল,
“তোর আর কত রূপ আছে নোভা! কত রূপে কত ভাবে আমায় পোড়ানোর ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিস তুই!”

দরজা খুলতেই ইভানা কে দেখে রিফাত হতভম্ব হয়ে গেল। নোভাও চমকে উঠল। সাজিদ এখনো দেখতে পায় নি ইভানা কে।
ইভানা গম্ভীর গলায় বলল,
“কি হয়েছে এখানে?”
নোভা রিফাত একে অপরের দিকে তাকাল। সাজিদ ইভানার কণ্ঠ শুনে পিছিয়ে গেল দু’পা।
নোভা পুনরায় বলল,
“কি হয়েছে এখানে? আমি তো জানতে চাইছি নাকি? কি হচ্ছিল এতক্ষণ ভেতরে? ছাদের দরজা কেন বন্ধ ছিল? আমি জানতে চাই। এক্ষুণি।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here