স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
পর্ব-২১
গাড়ির শব্দ আর চারপাশে কোলা ব্যাঙ্গ ডাকার শব্দ ছাড়া এই মুহূর্তে কিছুই শুনা যাচ্ছে না।রাতের সুনসান নিরবতার বুক চিরে ছুটে যাচ্ছে ধবধবে সাদা একটি কার।সেই কারটিতে এখন আমি এবং আকাশ দুজনে পাশাপাশি বসে আছি।কারো মুখে কোনো শব্দ নেই।দুজনেই উন্মাদ,হতভম্ব এবং নির্জীব,যেন কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্যে আমরা কেউই প্রস্তুতি ছিলাম না।মোটেও না!এই যে গাড়ি ফিরতি সে তার গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছে তা জানতে কোনোরকম কৌতূহল বোধ করিনি।একবারের জন্যে আকাশকে জিজ্ঞেসও করিনি,”আকাশ আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?”
গাড়ি ছুটছে,পুরোদমে ছুটছে।ছুটতে ছুটতে একটা মুহূর্তে গাড়িটি এসে একটা জায়গায় থামে।আকাশ গাড়ি থেকে নেমে আমার দিকে ফিরে খুবই শান্ত এবং স্বাভাবিক গলায় বললো,
“সানা?নাম।”
এবার আমার ধ্যাণ ফিরে।আমি নৈঃশব্দে ভদ্র মেয়ের মতো গাড়ি থেকে নামি।সামনে তাকিয়ে বিস্তর একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আকাশের দিকে কিঞ্চিৎ ফিরতেই আকাশ হেসে দিয়ে বললো,
“এটা আমাদের বাড়ি,সানা।”
আমার মাঝে কোনোরকম ভাবাবেগ হলো না।তারপর আমি হাটি হাটি পায়ে আকাশের সাথে বাড়ির মেইন ফটকের দিকে এগিয়ে যাই।আকাশ কলিংবেল চাপতেই ভেতর থেকে কোনো একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দেয়।উনি আকাশের সাথে আমাকে দেখে অনেকটা খানিকটা চমকে যাওয়া অবস্থা।তা দেখে আকাশের মাঝে তেমন ভয় এবং দ্বিধার রেখা স্ফুটিত হলো না,পরিবর্তে সে কুটিল হেসে ফেললো।বললো,
“এতদিন না বললে একটা বউ চাই তোমার,একটা বউ চাই!এখন তোমার জন্যে বউ নিয়ে আসলাম!”
মুহূর্তের মধ্যে ভদ্রমহিলার চোখমুখে রাঙ্গা হয়ে যায়।ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে উৎফুল্ল মনে আওয়াজ করে বলতে থাকেন,
“আফিয়া,আসাফ তোরা কোথায়?তাড়াতাড়ি ডাইনিং এ আয়।দ্যাখ আকাশ কাকে নিয়ে এসেছে!”
দুজনে এক ঝটাকে এখানে এসে হাজির হয় ।দুইজনকে চিনতে আমার তেমন বেগ পেতে হয়নি।আকাশের থেকে আগেই শুনেছিলাম তার বাবা নেই। তারা ভাইবোন তিনজন।ভাই দুইটা এবং বোন একটা।আফিয়া দুই নাম্বার।আসাফ ছোট।আর সে সবার বড়।আফিয়া উৎসুক মুখ করে বললো,
“আরে এ ত সানা আপু,না ভাইয়া!”
মুহূর্তে একটা বিষম খাই। তারমানে আফিয়া আমাকে চেনে!কিন্তু কীভাবে?নিশ্চয়ই আকাশ আগে কখনো একে আমার ছবি দেখিয়েছিল এবং আমার ব্যাপারে কিছু বলেও ছিল।নাহলে এভাবে চেনার কথা না।আকাশের মা হেসে দিয়ে বললো,
“পরিচয় পর্ব সব পরে হবে।আগে বউমাকে ভেতরে নিয়ে আয়!”
আফিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে আসে।আনন্দের সহিত আমাকে যথাসম্ভব সাদরে বরণ করে।তবে আমি তাদের এই ব্যাপারটাতে খুব অবাক হলাম।হুটহাট আকাশ আমায় এভাবে নিয়ে আসলো, সেখানে ত উনাদের রাগ হওয়ার কথা।ছেলেকে বকাঝকা করার কথা।এই বিয়ে মানবে মানবে না বলে শরগোল সৃষ্টি করার কথা। তা না করে উল্টো উনারা…..!পৃথিবীতে এখনো এমন অমায়িক, নির্ভেজাল,শান্ত মনের মানুষ আছে তা আমার জানা ছিল না!সত্যিই আমি খুব অবাক!
রাত দশটার দিকে আফিয়া আমাকে রুমে নিয়ে আসে।আমি বিছানার দিকে তাঁকিয়ে দেখি পুরো বিছানা ফুলের বাহারে সজ্জিত!আফিয়া খানিক হাসার চেষ্টা করে বললো,
“ভাবী,আমি এবং আসাফ তাড়াতাড়ি কী সাঁজালাম না সাঁজালাম ওতোটা সুন্দর হয়নি।প্লিজ কিছু মনে করো না।”
আমি নৈঃশব্দ্যে আফিয়ার দিকে তাকাই।আফিয়া আবারো হাসে।তারপর একটা দৃঢ় শ্বাস ছেড়ে বললো,
“যাইহোক ভাবী সবকথা কাল হবে।আমি এখন গেলাম।খুব রাত হয়ে গেছে।থাকো। ভাইয়া চলে আসবে।আবার ভয় পেও না কিন্তু।”
আমি আফিয়ার কথায় না চাইতেও হেসে ফেলি।আফিয়া আমার নাকের সাথে তার নাকটা ঢলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
এবার আমার ভেতরটা নড়ে উঠে।এতক্ষণে মনের সব রাগ,জেদ,কষ্ট,অভিমান,দুঃখ সবকিছু ধুমড়েমুচড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে।দু’চোখ দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকে।এটা কী হয়ে গেল?এটা ত হওয়ার কথা ছিল না!এমনটা ত আমি কখনই ভাবী নি!!মুহূর্তে ঝটকা তুফানের মতো সবকিছু লন্ডবন্ড করে দিয়ে গেল!হে আল্লাহ,আমার জীবনের সাথে কেন এমন করো?কেন আমায় এত অগ্নি পরিক্ষায় ফেলো!
কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ি।এরমাঝে আকাশ ভেতরে ঢুকে।আমি বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তরহর চোখের পানি মুছে নিই।আমি মন খারাপ করেছি কি করিনি তা আকাশ বুঝলো কিনা জানি না।তবে সে খানিক সময় চুপ থেকেছিল দৃষ্টিটা আমার দিকে স্থির রেখে।তা আমি না দেখে নিলেও অনুভব করতে পেরেছি। নিস্তব্ধতার মাঝেই আকাশ গলায় খাঁকারি টেনে শান্ত গলায় বললো,
“সানা?”
আমি জবাব দিই নি।আমার নিশ্চুপতা দেখে আকাশ আবারো খানিক চুপ থাকলো।তারপর বললো,
“আমি খুবই দুঃখিত,সানা!আজ এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে সত্যি আমি কখনোই ভাবি নি!”.
বলেই আকাশ এবার কিছুটা ইতস্তত বোধ করে।গলার স্বরটা শিশুসুলভ করে অত্যন্ত অপরাধ ভঙ্গিতে বললো,
“আমি জানি তারজন্যে তোর মন খুব খারাপ।আর হ্যাঁ মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। হুটহাট এরকম একটা পরিস্থিতি যে কারো পক্ষেই সহজে মেনে নেওয়া খুব কঠিন।এ ট্রমাটা কেঁটে উঠতে হয়তো তোর সময় লাগবে,আবার হয়তোবা কেঁটে উঠবেও না। প্লিজ তারজন্যে তুই আমাকে ভুল বুঝিস না।আমি আসলেই দুঃখিত! আর হ্যাঁ,আরেকটা কথা!তুই হয়তো ভেবেছিস তোর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে বিধায় আমি তোর সামনে স্বামীর অধিকার খাটাবো!তোকে আমি ভালোবেসেছি সেই কলেজ থেকে এটা মানলাম। তাই বলে এমন কিছু করবো ওইরকম ছেলে আমি নই,সানা। তুই তোর সিকিউরিটি ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিত থাকিস।যতদিন তুই আমাকে মন থেকে না চাইবি ততদিন আমি কখনোই তোর কাছে স্বামীর অধিকার নিয়ে আসবো না!আগে যেমন বন্ধু ভেবেছিস এখনও ঠিক সেইম সেইভাবেই থাকবো।তবে হ্যাঁ আমি অপেক্ষা করবো সেদিনের জন্যে যেদিন তুই আমাকে মন থেকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবি।আর তুই খুব ক্লান্ত।উঠে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আস।আমি একটু বেলকনিতে যাচ্ছি।”
বলেই আকাশ বেলকনির দিকে যায়।আমি ছলছল চোখে আকাশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি।কয়েক সেকেন্ড পর সন্তপর্ণে উঠে দাঁড়াই।ফ্রেশ হতে বাথরুমে যাই।বাথরুম থেকে বেরুতেই আকাশ বললো,
“তুই বিছানায় ঘুমা।আমি সোফায় ঘুমাচ্ছ।আর যদি কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে বলবি।ঠিক আছে?”
খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বলে আকাশ বিছানা থেকে একটা বালিশ টেনে নিয়ে সোফায় যেয়ে ওপাশ হয়ে শুয়ে পড়ে।
আমি আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা দৃঢ় নিঃশ্বাস ছাড়ি।তারপর ধীরভাবে বিছানায় যেয়ে ড্রিম লাইট অন রেখেই শুয়ে যাই।।
সকালবেলা আফিয়ার কন্ঠস্বরে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।তাকিয়ে আফিয়া কৌতূহল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।জিহ্বায় দিয়ে গলা ভিঁজিয়ে বললো,
“কী ভাবী,বাসরটা কেমন হলো?”
আমি খানিকটা ধাতস্থতা বোধ করি।চোখমুখ কুঁচকে আনতেই আফিয়া হেসে দিয়ে বিষয়টাকে সহজাত করে বললো,
“আরেহ বলতে চাইলাম যে তোমার ঘুম কেমন হলো?”
আমি চোখমুখ এবার স্বাভাবিক করে হেসে দিয়ে মাথা নাড়ি।আফিয়া বললো,
“তোমাকে ভাইয়া সেই কলেজ লাইফ থেকে ভালোবাসে এসেছে।ভাইয়াকে প্রায়ই তোমার কথা জিজ্ঞেস করতাম।জানো কি বলতো?বলতো- জানি না!জানি না, জানি না বলে সেই অজানাকে আজ আমাদের সামনে হাজির করলো!আহা ভাবী, ভাইয়া যে কি একটা সারপ্রাইজ আমাকে দিল আমি কত্ত খুশি হলাম তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।আর সবথেকে বড় কথা হলো ভাইয়া তার ভালোবাসাকে এতবছর পর নিজের করে পেল।আচ্ছা,আগে তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং আসো।মা সেই কখন তোমার জন্যে নাস্তা নিয়ে বসে আছে!আর জানো বলদ ভাইয়াটা কি করছে?”
আমি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আফিয়ার দিকে তাকাই।বললো,
“বলদ টা নিজে আগেভাগে খেয়ে নিয়ে হাসপাতালে ডু মারলো।একটু অপেক্ষাও করলো না তোমার জন্যে!”
“এখন ক’টা বাজে?”
“ন’টা এখনো বাজে নি।তবে কয়েক মিনিট পর ন’টার কাঁটায় টিকটিক করবে।”
“আমার জন্যে বসে থেকে হাসপাতালের দেরী হয়ে যেত না?হয়তো এজন্যে চলে গেছে।” বলেই হাসলাম।
“দেরী হলে হত!নতুন বউকে কেউ এভাবে রেখে চলে যায়?আজ আসুক বাসায় আচ্ছামত মারবো!বলদের যম!”
আমার হাসি পেয়ে যায় খুব আফিয়ার এহেন কথায়।আফিয়া যে খুব দুষ্ট,আর মিশুক টাইপের আমি বুঝতে পারলাম!তরপর আফিয়ার সাথে কথা শেষ করে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসি।আকাশের মা আমাকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে আমাকে চেয়ারে বসান।নাস্তার প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বলেন,
“জানো,মা?আকাশ যখন ডাক্তারিতে জয়েন করে তখন ওকে প্রায়ই বলতাম একটা বিয়ে করার জন্যে,নিজের সংসার ধরার জন্যে!অথচ এই মাথামোটা ছেলেটা আমার কথা পাত্তাই দিত না।আর শুধু এটাই বলতো,বিয়ে করলে ত দেখবা!তখন এই কথাটা কোন মায়েরই শুনতে ভাল্লাগতো বলো ত!তবে এখন আমার খুব ভালো লাগছে তোমাকে দেখে!আমার ইচ্ছেটা পূরণ করলো!তবে হ্যাঁ,আর কয়েকমাস পর আমি কিন্তু তোমার এবং আকাশের বিয়েটা আবার পুনরায় ধুমধাম করে দিব!আশপাশের সবাইকে দাওয়াত করবো।আমার আদরের ছেলে বলে কথা!”
আমি হাসি ছাড়া একথার পিঠে অন্যকথা বলতে পারি নি!
সন্ধের পর আকাশ বাসায় ফিরে।হাতে রাখা ব্যাগটা সোফার উপর রেখে ঘাম ভেজা শার্টটা খুলে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগুতে এগুতে বললো,
“দ্রুত বই নিয়ে বস আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
কিঞ্চিৎ অবাক হলেও আমার স্টাডির প্রতি ওর সিরিয়াসনেস দেখে বেশ ভালো লাগলো।আমি সাবলীলায় বই নিয়ে চেয়ার টেনে বসি।কম্পিটিটিভ বইটা খুলে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পর এরইমাঝে আকাশ বেরিয়ে আসে।ওর অস্তিস্তে আমার ভেতরটায় অজানা এক সংকোচ, লজ্জা ভেতরটায় তোলপাড় হচ্ছে।আকাশ আমার সাইড থেকে চেয়ারে বসে নিয়ে খানিক্ষন জিকে বইটা ঘাটাঘাটি করে আমার দিকে দৃষ্টি এঁটে।বললো,
“সানা,তুই খুব আনইজি ফিল করছিস?”
আমা কাঁপা চোখের পাতায় আকাশের দিকে তাকাই।বার দুয়েক ঢোক গিলে বললাম,
“নাহ,নাহ আমি ঠিক আছি।”
আকাশের আমার কথা বিশ্বাস হলো না।বললো,
“সানা,আমি কাল রাত তোকে বললাম না তুই আগে আমাকে যেমন বন্ধু ভেবে এসেছিস এখনও তাই ভাবিস।এভাবে হলে তুই প্রিপারেশনে এগুতে পারবি না।বললি না ভালো জব করবি?ভালো জব করতে হলে কষ্ট করতে হবে!খুব কষ্ট!”
আমি ছলছল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।আকাশের কথাগুলো খুবই নর্মাল ছিল।চোখমুখে কোনো রকম ভঙ্গিমা ছিল।একদম সাদামাটা!!
তারপর থেকে আকাশের সামনে প্রতিদিন বই নিয়ে পড়তে বসি।একটা মুহূর্তে ধীরস্থির ভাবে মনের সব জড়তা,সংকোচ কেঁটে যেতে থাকে।
স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
পর্ব-২২
দিন কেঁটে মাস চলে আসে।আকাশের মাঝে একঝাঁক ব্যস্ততা চেপে বসে।তার কুমিল্লা মডার্ন হাসপাতালের ট্রান্সফার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাকে আগামী রোববারই ঢাকায় ব্যাক করতে হবে!এখন চিন্তা তার আমাকে নিয়েই!আমাকে কুমিল্লায় রেখে যাবে নাকি সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে যাবে!আর ঢাকায় নিয়ে যেতে চাইলেও আমি যাবো কিনা এ নিয়ে তার মনের কিণার কাণারে উসখুস করছে!অনেকবার এ ব্যাপারে সে আমাকে বলতেও চেয়েছিল কিন্তু সাহস নামের শব্দটি আর তারমাঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নি!
পরদিন আমি বেলকনির ধর্নাতে জামাকাপড় শুকাতে দিচ্ছিলাম।এমন সময় আকাশ আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়।গলায় খানিক খাঁকারি টেনে স্বাভাবিক গলায় বললো,
“সানা?তুই কি ফ্রী আছিস এখন?”
আমি চালিত হাত বন্ধ করে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাঁকাই।আকাশ দ্বিধা ভরা চোখমুখে নিজেকে মনে মনে যথেষ্ট গুছিয়ে নিয়ে আমাকে বললো,
“ইয়ে মানে…তোর সাথে একটা কিছু কথা বলার ছিল!”
আমি হাতের জামাটা ধর্নায় রেখে ওর দিকে ফিরে বললাম,
“বল।আমি ফ্রী আছি।”
“পরসু আমায় ঢাকা যেতে হচ্ছে।কুমিল্লায় ফিক্সড টাইমটা আগামী পরসু শেষ হবে!আর আমি ত চলে গেলে তোর পড়াশুনায় প্রবলেম হবে।ওদিক দিয়ে বিসিএস,ব্যাংক জবের সার্কুলার ছাড়ারও সময় হয়ে গেছে।বলতে গেলে তোর প্রিপারেশনটা হাতে গোনা! এই সময়টুকুতে এখন তোকে শুধু দমবন্ধ করে পড়তে হবে!আর যদি কুমিল্লায় থাকিস তাহলে নিজেকে যথেষ্ট প্রিপেয়ার্ড করতে পারবি ত?”
“আমি কি বলছি আমি কুমিল্লায় থাকবো?”
আমার এহেন কথায় আকাশের হেঁচকি উঠে যায়।সে তার চোখের থাকা চশমাটা আবার ঠিক করে নেয়।অনেকটা অপ্রস্তুত বোধ হয়ে বললো,
“নাহ নাহ ঠিক আছে।ঢাকায় যাস।তোর প্রিপারেশন ভালো হবে!আমি মাকে জানিয়ে দিচ্ছি তুই ঢাকায় যাবি।”
বলেই আকাশ আর দাঁড়ায় নি।সে এক সপাটে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।আমি স্থির চাহনিতে সেদিকে তাঁকিয়ে থাকি।ঢাকায় যাওয়ার মনস্থিরটা করেছি নিজের কথা ভেবেই!এই মুহূর্তে আকাশের গাইডলাইনটা আমার খুবই দরকার!সময় অল্প!আর পরিক্ষা সব ত ঢাকায়ই হবে!তাই একেবারে সব সুবিধা ঢাকায় যেহেতু পাবো তাহলে কুমিল্লা থাকাটা এখন অর্থহীন।!আর হ্যাঁ,আমার শহরে আমি ফিরবো তার আগে নিজেকে যোগ্য করে! এর আগে নয়!যে সানা এখন সবার মুখে মুখে বেশ্যা,সে সানাই ইনসাল্লাহ একদিন একজন গর্বিত মানুষ হয়ে সবার সামনে এসে দাড়াবে !এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা!!
ঢাকায় ব্যাক করার একদিন পরই আকাশ আমাকে একটা কোচিং সেন্টারে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয় শর্ট টাইম প্রিপারেশনের জন্যে।কোচিং সেন্টারটা বেশি দূরে নয়। আকাশের ফ্ল্যাট থেকে দুই তিন মিনিটের পথ।আমি নিয়মিত সেখানে ক্লাস করা শুরু করি।উনাদের প্রতিটি লেকচার শিট মনোযোগ সহকারে বুঝে নিয়ে বাসায় এসে তা পুনর্বার পড়ি।আবার পড়ি।তারপর আবার পড়ি।এভাবে মোট সাতবার পড়ি।একরাতে একটা শিট শেষ হয়।পরে আবার এক্সট্রা ম্যাথ,জিকে,বাংলা ব্যাকরণ ইত্যাদি।আর আকাশ প্রতিটি টপিকসের পেছনে পেছনে হিংস দেয়।আমার প্রতিটি পড়ার প্রতিটি অক্ষরে আকাশেরও একটু জিরন্তি নেই।সে হাসপাতাল থেকে ছুটে আসলেই আমার বই নিয়ে বসে।যেখানে আমি আমার পড়া নিয়ে খুব বেশি সিরিয়াস হবার কথা সেখানে সে!ব্যাপারটা খুবই রিডিকিউলাস!যদিও ওর এহেন কাজে মনে মনে খুব খুশি হই তবে আমাকে নিয়ে ওর এত ভাবাটা খুব রাগও হয়!আমি তার কি হই?নাথিং!এমনকি এখনো ওকে আমার শুধু বন্ধুই মনে হয়।কাগজে কলমে আমাদের বিয়ে হয়েছে এই বিষয়টা এক মুহূর্তের জন্যেও আমার মাথায় আসে না।ভাবি ঠিক আগের মতনই সব!আমাকে এখনো পাগলের মতো ভালোবাসে,আর আমি জাস্ট ওকে বন্ধু ভাবি!সত্যি কথা বলতে আমি এখনো আকাশকে মন থেকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারছি না!
দেখতে দেখতে বিসিএস-এর সার্কুলার ছেড়ে দেয়!সেদিন আকাশ অস্থির মনে বাসায় ফিরেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে।গুগলে সার্চ দিয়ে এ’বছরের বিসিএসের বিষয়াদি সংক্রান্ত সব জেনে নেয়।তারপর আমার দিকে ফিরে বললো,
“আবেদন করে ফেলি!”
এ’কথাটি শুনামাত্র আমার মেরুদন্ড বরাবর একটা শীতল হাওয়া বয়ে যায়।”বিসিএস আবেদন”-কথাটিতে কেনজানি আমার ভেতরটায় একটা অজানা আতঙ্ক আর ভয় চেপে বসে!এখন থেকে ত প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে কত হাজার আবেদন পড়া শুরু হবে।হাজার হাজার প্রতিযোগী প্রতিযোগীতার জন্যে মাঠে নামবে!তাদের মাঝে পারবো?
যদি এটাকে পেয়ে যাই!!ইসস তখনতো সবাই বিসিএস ক্যাডার বলবে!!!
এক মুহূর্তের জন্যে আমার অস্তিত্বটা ভাবনার ঘোরে হারিয়ে যায়।
“আবেদন করা শেষ!”
আকাশের কথার শব্দে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসি।হালচোখে বললাম,
“শেষ?!”
“হুম।”
“শোন,আর মাত্র একমাস সময় আছে।এই এক মাসে মন-প্রাণ উজাড় করে তোকে শুধু পড়তে হবে।কোনো কাজ করা যাবে না।শ্যামলী আপা আছেন উনি ঝাঁড়মোছার সাথে সাথে এখন থেকে রেঁধেও দিয়ে যাবেন।তোর শুধু ঘুম,পড়া আর খাওয়া!এছাড়া,কিচ্ছু না!মনে থাকবে?”
“মাত্র এই তিনটা কাজই,আর কিছু না!”
“জীবনে অনেক কিছু করার সময় পাবি।কিন্তু একবার যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সময় হারিয়ে যায় তখন তা আর ফিরে পাবি না।পরে আফসোস করা লাগবে!আমার দিকে দ্যাখ!সংসারে বাবা ছিল না,কতটা কষ্টের ছিল আমাদের সংসার।সংসারের প্রতিটি মুহূর্ত মনে হত যেন এক একটা বিভীষিকা!আমি খুব কষ্ট করেছি!সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছি আমাকে ডাক্তার হতেই হবে তা যেকোনো মূল্যেই!আমার চোখের পানি একদিন স্বর্গতূল্য করবো!আজ পেরেছি,বল?”
আকাশের এমন উৎসাহমূলক বাণীতে আমি আরেকটু উদ্দীপ্ত হই।হাঁপিয়ে যাওয়া থেকে প্রাণটা আবার আশার ডানা মেলতে থাকে।ইয়েস আমাকে পারতেই হবে!তারপর থেকে পুরোদমে আবার পড়া শুরু।দিন যেয়ে রাত আসতো কখন টেরই বলতেই পেতাম না,যতক্ষণ না আকাশ আমাকে টাইমটা বলতো!!
এভাবে চলতে চলতে প্রিলিমিনারি পরিক্ষা চলে আসে।এম সিকিউতে বসি।পরিক্ষাটা দিই।আজ দেড়মাস।শেষ হলো।আর আজই রেজাল্ট বের হবে।আমি রুমের দরজা, লাইট,ফ্যান সব অফ করে হাত-পা গুঁটে বিছানার এককোণে বসে আছি।আর দিকে দিকে কেঁপে উঠছি আতঙ্ক! আতঙ্ক !জানি না কী রেজাল্ট আসে!নাকি ফেইল মেরে ডাব্বা কাইত করে ফেলেছি!আকাশ সেই সকাল থেকেই আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে আসছে কিন্তু কিছুতেই আমি আশ্বস্ত হতে পারছি না।
আকাশ দরজায় এসে আরেকবার ডু মেরে যায়,
“সানা,প্লিজ?এরকম করে না!দরজা খোল!আমার বিলিভ ভালো কিছু হবে!বি পজিটিভ,সানা!বি পজিটিভ! ”
“আগে রেজাল্ট আসুক তারপর বোঝা যাবে!”
আকাশ আবারো ব্যর্থ মনে ডাইনিং চলে যায়।সোফায় বসে আবারো ল্যাপটপ ঘুটঘুট!কিছুক্ষণ এভাবে কাঁটার পর আকাশ আবারো দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়!গলা উঁচিয়ে বললো,
“এখন আড়াইটা বাঁজে।”
আড়াই টা!তারমানে এখন রেজাল্ট পাবলিসড করে দিয়েছে!আবারো একঝাঁক ভয় এবং আতঙ্ক বুকের ভেতরটা কেমন যে করছে বলতে পারছি না!নাহ আমি কিছুতেই রেজাল্ট দেখবো না,কিছুতেই নাহ।খারাপ কিছু আসলে মরেই যাবো!নাহ সানা,নাহ দেখিস না, দেখিস না!!!ভাবনা মাঝে আকাশ বলে উঠলো,
“কংগ্রাচুলেশনস,সানা!!!”
এবার আমি চমকে উঠি।মুহূর্তে শরীরটা অসাড় হয়ে যায়!দরজার দিকে পুরোভাবে নিজেকে স্থবির রেখে আকাশের আবারো একফোঁড় কথা ভেসে আসে,
“সানা,তুই প্রিলিমিনারিতে সিলেক্ট হয়েছিস!!কংগ্রেটস,সানা!কংগ্রেটস!”
থমথমে পায়ে হেঁটে যেয়ে এক সপাটে দরজা খুলে ফেলি!বললাম,
“আকাশ,সত্যি?”
আকাশ কিছু না বলে আমার হাত ধরে নিয়ে সোফার দিকে নিয়ে যায়।ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে আমার সামনে ধরে।আমি ছোট ছোট চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকাই।সুন্দর করে লেখা রেজাল্ট বক্সের পাশে লেখা- পাসড!
লেখাটি দেখেই মুহূর্তের জন্যে আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়।এ যেন মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি!সত্যি আমি পেরেছি?আমি পেরেছি?ইয়েস!সানা এবার নেক্সট লিখিত এক্সাম এবং ভাইবার জন্যে প্রিপারেশন নে!!
লিখিত এক্সামের জন্যে প্রিপারেশন নিতে থাকি।সেই আগের মতোই পড়া আর পড়া।লিখিত এক্সামেও বসি।রেজাল্ট আসে।লিখিত এক্সামে সিলেক্ট হই!!সেই মুহূর্তের অনুভূতিটা প্রিলিমিনারি এক্সাম থেকেও বেশি চমক যেটার অনুভূতি এখন আমি বলে বুঝাতে পারবো না।
তারপর আসে ভাইভা!!জানি না আল্লাহ আমার প্রতি কেন এতটা সদয় হয়েছেন?কেন আমার দিকে এতটা চেয়েছেন?আমি বরাবর ভাইভাতেও সিলেক্ট হই!!কিছুক্ষণ আগে হলো ভাইভার রেজাল্ট দিলো!এখন আমি টুপটুপ চোখের পানি ফেলছিনআকাশের সামনে! আমার এতটাই এতটাই খুশি লাগছে যে আমি অতি সুখটা সইতেও পারতেছি না এই মুহূর্তে! কেন এত আনন্দ হচ্ছে?কেন অতি সুখে কেঁদে দিচ্ছি তার কারণ নিজেও জানি না!
আকাশ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।দৃঢ় গলায় বললো,
“কষ্ট করেছিস তার মিষ্ট পেয়েছিস!আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখেছিস পড়তে পড়তে কেমন কাঠ পোড়া হয়েছিস?কাঁদতে হবে না আর । চার রাকাআত নফল নামাজ পড়ে নিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর!আর আমার মিষ্টি রেডি রাখ তাড়াতাড়ি! আমি বাথরুম থেকে আসছি।”
শেষ কথাটা চোখ টিপ দিয়ে বলেই আকাশ বাথরুমের দিকে চলে যায়।
এবার আমার চেতনাটা স্বতঃস্ফূর্ত জাগ্রত হয়!এই আকাশটার জন্যেই আজ আমি এখানে আসতে পেরেছি !এই মানুষটা পাশে ছিল বলেই এমন অসম্ভাব্য একটা স্বপ্ন বিধাতা আমাকে নিজ হাতে দিয়েছেন!সাত সাতটা মাস এই মানুষটাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি!কতটা কষ্ট করলো আমার জন্যে অথচ এতদিনে এই মানুষটাকে আমি এতদিনে চিনতেই পারি নি!নাহ আর পারবো না এই মানুষটাকে কষ্ট দিতে, কিছুতেই নাহ!এই মানুষটাই আমার জীবনের….
ভাবতে ভাবতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যাই।দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই আকাশকে জোরে আঁকড়ে ধরি।আকাশ আমার এহেন কান্ডে বরাবর বাকরুদ্ধ! আবেগ ময়তা কন্ঠে বললাম,
“নাহ আকাশ আমাকে আর কষ্ট দিস না!আমি আর নিতে পারছি না,প্লিজ?”
আকাশ আমায় তার দুই বাহুডোরে খুব শক্ত করে জোরে চেপে ধরে।ধরার মাঝেই তার কোলে তুলে নেয়।তারপর ধীরপায়ে হেঁটে বিছানার শুইয়ে দেয়।আমি চোখবুঁজে লাজুকতা কন্ঠে বললাম,
“এতদিন বলেছিলি না?বিসিএস ক্যাডার হলে তোর জন্যে উপহার রেডি রাখতাম?আজ আমিই তোর জন্যে বড় উপহার!নিজের সম্পত্তিটাকে নিজের করে নে!আর কোনো বাঁধা দিব না!”
আকাশ এ কথার পিঠে কিছু না বলে তার হীম হাতটা আমার মুখের উপর এগিয়ে কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে একটা চুমু লাগিয়ে দেয়!তারপর ধীরেভাবে মুখটা ঠোঁটের সামনে বরাবর রেখে অনবরত তাতে কিস করতে থাকে।আমি দু’হাত শক্ত করে চাদরের সাথে আঁটকে ধরে রাখি।আমার নিস্তেজ শরীরটা আকাশের দখলে চলে যায়।আজ মনে হলো সে আমার স্বামী!!!
চলবে….
চলবে….