স্বপ্নময়_ভালোবাসা ❤পর্ব ১৯+২০

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
পর্ব-১৯

পরদিন সকালে টিউশনিতে বের হই৷ ভাবলাম কোটবাড়ি থেকে বিশ্বরোড হেঁটেই যেতে পারবো,কিন্তু কিছু পথ যেতেই মনে হলো রথে হেঁটে ফিক্সড সময়ে পৌঁছাতে পারবো না।তাই আর উপায়ন্তর না পেয়ে একটা রিক্সা নিই।ভাড়াটা অনেক কষ্টে কমিয়ে টমিয়ে দশ টাকায় আনি।বিশ্বরোডে নামার পর ব্যাগ থেকে দশ টাকা বের করে রিক্সাওয়ালার দিকে এগিয়ে দিতেই তিনি খুব আকুতি গলায় বলে উঠেলেন,

“আপা,আর যদি পাঁচটা টাকা বেশি দিতেন তাহলে মার জন্যে ওষুধ কেনার টাকা হত।”

রিক্সাওয়ালার এ’কথাটি মুহূর্তে আমার ভেতরটায় একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো।চোখে অশ্রু এসে টলমল করতে থালে। নিজেকে অতিসংগোপনে যথেষ্ট সংযত করে তারপর বললাম,

“আপনার মার কী হয়েছে?”
“খুব জ্বর, আপা।দুই সপ্তাহ ধরে খুব জ্বর।কমতেছে না।টাকার জন্যে ঠিকমতো ওষুধও খাওয়াতে পারছি না।”

আমার মারও টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারি নি!টাকার কাছেই বা কেন পৃথিবীর সবথেকে “মা”- নামক প্রিয় শব্দটিকে হার মানতে হয়?খোদা তুমি কেন এতটা অবিচার করো?

ভাবতে ভাবতে চোখ বসে আসে।তারপর আবার ব্যাগের চেইনটা খুলি।ব্যাগে মোট পঞ্চাশ টাকা ছিল। সবগুলো টাকা রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে দিই।রিক্সাওয়ালা আমার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে।
বললাম,

“মার ভালো করে চিকিৎসা করেন।মা গেলে মা পাবেন না।যার গিয়েছে সে বুঝে!”
বলেই ওড়নার কোণা দিয়ে চোখের কিণারের পানি টুকু মুছে নিয়ে রিক্সাওয়ালাকে পাশ কেঁটে চলে আসি।

রিতি এবং প্রিয়াকে আজ তেমন ভালোভাবে পড়াতে পারিনি। তাদের মনোযোগ ধরে রাখতে তাদের সাথে মজার মজার কথা বলে তাদের সাথে সহজ হতে পারিনি অথচ আজ টিউশনে প্রথম দিন হিসেবে এটা আমার জন্যে খুব ইম্পর্ট্যান্ট ছিল।ওরা নিজ থেকে আমাকে যতগুলো প্রশ্ন করেছে শুধু উত্তর হ্যাঁ/না পেয়েছে।কোনোরকম ব্যাখ্যা পায়নি।হয়তো মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত এবং রাগও হয়েছে।
রিক্সা থেকে নামার পর থেকেই দুর্বোধ্য আমার মনে সবকিছু অবচেতন হয়ে রইলো ।প্রয়োজন বোধ জেনেও প্রয়োজন মনে হয় নি।মনে তখন একটাই অনুভূতি জাগ্রত ছিলো- মা!!ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে!কিছুক্ষণ হলো টিউশনটা শেষ করলাম।ঘোর মাখা চোখে ডানহাতে মোবাইলটা সামনে তাক করে টাইম দেখে নিই।বেলা এগারোটা বেজে তিরিশ মিনিট।বেরিয়েছি সেই আঁটটার শেষ দিকে।এখনো বাসায় ফিরতে পারিনি।মাথা বার কয়েক ঝাঁকি দিয়ে ওভারব্রিজের রেলিং ছেড়ে দিয়ে তার বাম পাশের সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে গেলেই হঠাৎ আকাশ সামনে পড়ে।আকাশ আমাকে দেখে কিছুটা ধাতস্থতা বোধ করে।তরহর চশমাটা খুলে আবার চোখে ভালোভাবে এঁটে নিয়ে বললো,

“তুই এখানে?”

আমি নৈঃশব্দে আকাশের দিকে তাঁকাই।ওভারব্রিজের সিড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা দুষ্কর।তাই নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে আকাশ তরহর এদিক ওদিক চোখ বুঁলায়।ফুট ওভার ছাড়া আর কোথাও ফাঁকা জায়গা দেখতে পায়নি। বললো,

“উপরে উঠ।উপরে খালি আছে।কথা বলা যাবে।”
কথার জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে আকাশের সাথে আবার উপরে যাই।আকাশ আমার পাশাপাশি দাঁড়ায়।গলায় খাঁকারি টেনে গলাটা খানিক পরিষ্কার করে নেয়।বললো,
“হঠাৎ বিশ্বরোড আসলি যে?”
“টিউশনি করাতে।”
“টিউশনি!”

আমি স্থির চাহনিতে আকাশের দিকে ফিরি। গলার স্বর খানিকটা স্বাভাবিক করে বললাম,
“হ্যাঁ।”
“সানা,টিউশনি করানো লাগবে না।তুই মেয়ে এতদূর আসাটা তোরজন্যে অনেকটা রিস্কি হয়ে যায়!আমি কুমিল্লায়ই দেখি তোরজন্যে ভালো কোনো স্কুলের জব ম্যানেজ করতে পারি কিনা।”
“আকাশ?আমি আরো বড় চাকরি করতে চাই।স্বপ্নটা এখন আমার নীচক ছোট নয়, অনেক বড়।যে টাকার অভাবে কত মা চিকিৎসা করাতে পারে না আমি সেই মায়েদের জন্যে বিনা চিকিৎসায় একটা হাসপাতাল করবো।যে মানুষগুলো টাকার গৌরবে মানুষদের মানুষ মনে করে না আমি তাদের প্রতিটি বাক্যের উচিত জবাব ফিরিয়ে দিব!তারজন্যে আমাকে যা যা করতে হয় আমি সব করতে রাজি!এই যে টিউশনি করায় বারণ করছিস না?তা কেন করছি জানিস?জব এক্সামের বই কিনে পড়তে!সামনে অনেক টাকার দরকার আমার,অনেক!আমি নিজের পায়ে দাঁড়াবো আকাশ!”

“তুই পারবি, সানা।শুধু নিজের মাঝে কনফিডেন্স রাখ।তবে তোকে এই মুহূর্তে একটা রিকুয়েষ্ট করি জানি না রাখবি কিনা তারপরও বলছি..।তোর ভালো জব না হওয়া পর্যন্ত আমি যদি তোর পাশে থেকে সবকুছিতে তোকে সাপোর্ট করি এই ধর বন্ধু হিসেবে?”
“সবকিছুতে সাপোর্ট করা লাগবে না আকাশ।এই যে সাহায্যের কথা বলেছিস এতেই আমি ঢের খুশি হয়েছি।আমি নিজে কষ্ট করবো আকাশ।নিজে কষ্ট করলে সেই পরিশ্রমে প্রসূতি মেলে।তাছাড়া,এ পর্যন্ত ত অন্যের ঘাড়ে বসে বসে খেয়েছি তা দেখতেই পেয়েছিছিস এখন কি হাল হয়েছে আমার!আমার মা গেল,আমার ছোট্ট এই জীবনটাকে নিয়ে কত হ্যালাফ্যালা হলো।যাইহোক,বাদ ওসব।তা সাপোর্ট করার কথা যেহেতু বলেছিস তাহলে আমাকে
কীভাবে থেকে কীভাবে পড়বো,ইন্টারভিউ অথবা যাই বলিস ওগুলাতে নিজেকে কীভাবে প্রেজেন্ট করবো ওই বিষয়গুলো আমায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝিয়ে দিস।আমি আবার ওই বিষয়গুলোতে খুবই নার্ভাস ফিল করি।বলতে পারিস গাইড লাইন দিবি আর কি।পারবি এটুকু করতে?”

আকাশ সহমর্মিতা এবং শান্তগলায় বললো,
” সানা,তোর যত সমস্যা,যা কিছু সব আমায় বলবি।আমি অলওয়েজ তোর পাশে আছি।”
“ধন্যবাদ,আকাশ।খুব খুশি হলাম।”
” আর সানা আরেকটা কথা বলতাম।”
“বল?”
“পৃথিবীতে কোনোকিছু নিয়ে কখনোই হতাশ হবি না।মানুষের জীবনে সমস্যা হয় ,কিন্তু প্রতিটি সমস্যার একেকটা সমাধানও থাকে।তুরাবকে নিয়ে হয়তো মাঝে মাঝে আপসেট হয়ে পড়িস।হুম আপসেট হওয়ার কথাই!আমি নিজেই স্বচোখে দেখেছি তুই ওর প্রতি কতটা সিরিয়াস ছিলি শেষ মুহূর্তে ওর এহেন বিহেভিয়ার কারো পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব কিনা তা জানি ন।তবে তোকে যেটা বলবো কখনো ভেঙ্গে পড়িস না।নিজেকে শক্ত রেখে যদি সামনের পথ চলতে সক্ষম হোস ইনসাল্লাহ সফলতা আসবেই!”

আকাশের কথাগুলো হৃদয়ে লাগলো।কিছুটা সেম্পেথির মাঝে উপদেশমূলক বাণী।
মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললাম,
“আমি ঠিক আছি আকাশ।ইনসাল্লাহ।দোয়া করিস।তা তুই কোথায় যাচ্ছিস এখন?”

“হাসপাতালের দিকেই যাবো।ওভারব্রিজ পাশ করে ওপাশে গাড়িতে উঠতে যাবো তার আগেই তোরসাথে দেখা হয়ে গেল।”
“আচ্ছা।তোর আবার দেরী হয়ে যাচ্ছে নাতো?”
“আরেহ নাহ।আজ ডিউটি নেই।কুমিল্লা ট্রান্সফার হয়েছি যে তার এন্ট্রি করা লাগবে।তাই যাচ্ছি।তাছাড়া উইকলি চেম্বারে ত তিনদিন বসবো।”
“ওহ।তা তোর বাসার সবাই কেমন আছে?”
“সব কথা এখানে দাড়িয়ে থেকে না বলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বলি?”

আমি ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে বললাম,
“আকাশ আমার অলরেডি অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।”
“বাসায় কাজ আছে?নাকি কোথায় যাবি?”
“রান্না করতে হবে!”
“তারমানে সকাল থেকে কিছুই খাস নি।রেস্টুরেন্টে চল!!”
“এই তোর সাথে দেখা হলে খালি রেস্টুরেন্ট রেস্টুরেন্ট।এটা ছাড়া আর কোনো কথা নেই!”

আকাশ ফিঁকে হেসে দেয়।বললো,
“রেস্টুরেন্টে রেস্টুরেন্ট যে বলি তা ক’দিন তোকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে পেরেছি,বল ত?”
“অনেকবারই নিয়েছিস।”
“অনেকবার?হা হা হা হা।মুখে দিয়ে বলেছি কিন্তু রেস্টুরেন্টের করিডোরে মনে হয় একবারের বেশি পা পড়ে নি।”
“এই একবার না!দুইবার!”
“দ্বিতীয়বারের কথা আমার মনে হয়।”

আমি অন্তঃগোপনে একটা ঢোকর গিলি।দ্বিতীয় দিনে ত আকাশের সাথে আমিতো খুব রূঢ় বিহেভ করলাম।ভাই এর সাথে আর কথা বাড়ালে লজ্জা পেয়ে যামু।এত কথা না বাড়িয়ে সাগ্রহে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ সানা!ভেবেই বললাম,
“চল,যামু।”
আকাশ বরাবরই সেই খুশি।।।

পরদিন দুপুরে।গোসল করতে যাবো ঠিক এমন সময় টোয়া একগাদা বই নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়।বইগুলোতে চোখবুলিয়ে দেখি বিসিএস কনফিউশান,কম্পিটিটিভ অব এক্সাম,জুবায়েরস জিকে আরো অনেক ধরনের বই।সবগুলোই সরকারি জবের বই!বললাম,

“এতসব কবে কিনলি?জানালি না যে আমাকে?”
টোয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বইগুলো সামনে থাকা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো,
“আমার বই না।সবগুলো তোর বই।”
“আমার বই মানে?”
“আকাশ পাঠালো।জব এক্সামের প্রিপারেশন নিতি।”

চোখমুখ কুঁচকে বললাম,
“সে আবার আমার জন্যে খামোখা এতগুলা বই কিনতে গেলে কেন?”
“জানি না।ওরে জিগাইস।তা আমি গেলাম।ওহ শোন আরেকটা কথা!”
“কী?”
“তুই আজ টিউশনিতে যাওয়ার পর বাড়িওয়ালা আঙ্কেলে এসেছিলো।”
“বাড়িওয়ালা আঙ্কেল ত কয়েক মাসের বাসা ভাড়া পাওনা।তা কি বললো?”
“চারমাসের ভাড়া পাইবো।উনার বকেয়া ভাড়া সব পরিশোধ করতে।পরিশোধ করে দিয়ে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে!তোকে আর ভাড়া নাকি দিবে না।”
“চারমাসের?!চারমাসের ত অনেক টাকা টোয়া!আমি হঠাৎ এতটাকা কোথায় থেকে দিব?আর হঠাৎ কোথাই বা উঠমু!”

“কোথায় উঠমু মানে?তুই আমার বাসায় উঠবি!আর চারমাসের কত টাকা হবে মোট?”
“দশ হাজারের মতো!”
“তাহলে ত অনেক টাকা।!আচ্ছা, টেনশন নিস না। একটা ব্যবস্থা হবেই।যা গোসল করতে যা।”

টোয়া আমাকে চাপ মুক্ত করতে কত ভরসা বাণী শোনায়!এই মেয়েটা আমার পাশে না থাকলে,আর ওই আকাশ!আমি যে কবেই শেষ হয়ে যেতাম!হ্যা

আমি আলতো মাথা নেড়ে বাথরুমে আসি।বাথরুমের দরজা বন্ধ করে হাঁটু ভেঙ্গে অবচেতন মনে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদতে থাকি!এই টোয়া মেয়েটা আমাকে চাপ মুক্ত রাখতে কত ভরসা দেয়!এই মেয়েটা আর আকাশ না থাকলে আমি যে কবেই শেষ হয়ে যেতাম!হে খোদা এদের আমি এর প্রতিদানে কী দিব!দেওয়ার মতো ত কোনো সাধ্যই এখন আমার নেই!অনেক অনেক কৃতজ্ঞ রইল টোয়া আর আকাশ!অবিরাম মন থেকে তোদের প্রতি ভালোবাসা।

ক্লান্তি,দুঃখ ভরা মনে অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ার নিয়ে বাইরে আসি।টোয়া তখন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বইগুলো দেখতেছিল।আমি চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে ওর দিকে হেঁটে যেতেই টোয়া তাকালো।বললো,
“তুই গোসল করতেছিলি তখন কে যেন কল করে”
“রিসিভ করেছিস?”

টোয়া বইয়ের পেইজ বন্ধ করে আমার দিকে ফিরে সুঠামভাবে বসে বললো,
“ম্যাডাম,কারো পার্সোনাল কিছু ঘাটার অভ্যেস আমার একদম নাই।”
“আমার আর পার্সোনাল কী থাকবে?”
টোয়া চোখ টিপে বললো,
“না থাকার অসম্ভব ত কিছু নয়।আকাশও ত থাকতে পারে!”
“আকাশ?শোন,আকাশ শুধুই আমার একজন ভালো বন্ধু!বন্ধু ছাড়া ওকে এরআগেও কিছুই আর ভাববোও না।”
“দেখা যাবে,ম্যাডাম।দেখা যাবে।”
বলেই টোয়া গলার স্বর খানিক খাদে নামিয়ে আবার বললো,
“তাছাড়া,এমনিতে ত আকাশের রাস্তা এখন একদম ক্লিয়ার!”
“বেশি আগ বাড়িয়ে কথা বলতেছিস তুই!”
“ওইযে তোমার ফোন বাজছে।আমার সাথে ঝগড়া আর না করে কলটা ত রিসিভ করো,ম্যাডাম?”

টোয়ার দিকে ঝাঁড়ি চোখে তাকিয়ে বেখেয়ালে কলটা রিসিভ করি।হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে খালামণি কন্ঠস্বর!মুহূর্তেই আমার সারা শরীর রি রি করতে থাকে চরম এক ক্রোধ এবং ঘৃণায়।বললাম,
“কেন কল করেছেন?”

টোয়া আমার কথায় কাঠিন্যতা দেখে জিজ্ঞাসূচক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
খালামণি বললেন,
“এত ভাব নিয়ে কথা বলছিস কেন?যেভাবে কথা বলছিস আমাকে তোর পর কেউ মনে হয়?”
“পর ভালো।দুষ্ট প্রকৃতির আপনজন পরের থেকেও জঘন্য!কী বলতে কল করেছেন তা বলুন।নাহলে রাখছি!”
“ওই সম্পর্কটার কথা বাদ দিলে তুই আমার আপন মায়ের পেটের বোনের মেয়ে তোর উপর আমার দায়িত্ব অবশ্যই আছে।”
“তা কেমম দায়িত্ব, শুনি?”
“তুই ঢাকায় চলে আয়।আমাদের সাথে থাকিস!”

আমি তাচ্ছিল্য ভরা একটা হাসি দিই।বললাম,
“দায়িত্ব!মানবতা উদিত হলো অবশেষে!”
“তাহলে তুই আমাদের এখানে আসছিস না?”
“কথা মনে হয় আপনার কানে যায় না খালামণি!”
“হুম,যেটা আমি আগে আন্দাজ করেছিলাম!ওই আকাশ বেটার সাথে থাকিস এখন?এইজন্যে আমাদের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছিস না, তাইতো?তোর মতো বেশ্যাকে ওই আকাশও একদিন ছেড়ে চলে যাবে!আমার ছেলে রেখে চলে এসেছে না?!”
“খালামণি!কথাবার্তা সাবধানে বলবেন!আপনার মতো নীচক মানসিকতার মানুষ ছিঃ! আপনি এতটা জঘন্য আমার আগে জানা ছিল না!আর কখনোই আমাকে কল দিবেন না!”

বলেই কলটা কেঁটে দিয়ে তরহর ব্লক লিস্টে নাম্বারটা পাঠিয়ে দিই।মোবাইলটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে থমকে বিছানার উপর বসে যাই।টোয়া দৌড়ে এসে আমার কাছ ঘেঁষে বসে।
“তোর ওই দস্যু খালামণি টা কি বলেছে,সানা?কী বলেছে?

টোয়ার কথায় উত্তর জবাব না প্রদান করে খুবই জোরে একটা আর্তনাদ করে উঠি।যে চিৎকারে পাখিরা উড়তে ভুলে যায়,গাছের নড়নচড়ন পাতাগুলো থমকে যায় এবং আশপাশের সবকিছু মুহূর্তের জন্যে অসাড় দাড়িয়ে যায়!!

চলবে…স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
পর্ব-২০

সন্ধের পর এক কাপ চা খেয়ে পড়ার টেবিলে বসি।আকাশের দেওয়া জব প্রিপারেশন বইগুলো এক এক করে হাতে নিয়ে খানিক উল্টেপাল্টে দেখতে থাকি।কিন্তু তাতে যতই চোখ যায় ততই আমার চোখ উল্টে আসে!মাথাটা পুরাই উন্মাদ!কেমন কঠিন কঠিন শব্দ লেখা।একেবারে দাঁত ভাঙ্গা অবস্থা!এর একটা অক্ষরও মাথায় ঢুকে নি!তারউপর গাদাগাদা পড়া!বিরক্ত হয়ে বইয়ের সাটার বন্ধ করে তা আবার একপাশে রেখে দিয়ে কপাল চাপড়াতে থাকি!
আচ্ছা,এই যে কিরিবিরি লেখা কিছুই বুঝতেছি না।কীভাবে শুরু করে কীভাবে পড়বো এর কোনো থিউরি মাথায় আসছে না তাহলে আমি কি খুব বোকা?একেবারেই বোকা!?

“হুম,তুই বোকা।এক কথায় হাঁদারাম।হাঁদারাম ত বুঝিস তাই না?”

কারো কন্ঠস্বর শুনে পাশ ফিরে তাঁকাই। আকাশ চোখ কুঁচকে রেখে আলমারি টা বরাবর সুঠাম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ওর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই ও এদিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,

“কালিসাঁজে বাসা একলা একটা মেয়ে এভাবে দরজা খোলা রাখে?”
“বুঝলাম না?”
“দরজা খোলা রেখে পড়তে বসেছিস কেন?আমি দরজায় করাঘাত করতেই দরজা খুলে গেল!”
“কী দরজা খোলা ছিল?বন্ধ করিনি?”
“তা তুই ই ভালো জানিস!”

চোখমুখ কুঁচকে এনে জোরে একটা জিভ কাঁটি।ইস বেখেয়ালে আজ দরজাটাই বন্ধ করতে ভুলে গেলাম।এমন মনভোলা স্বভাব কবে যে হলো?দিনেক দিন খেয়ালি হব, তা না।উল্টো অঘামগা হচ্ছি!ভাবনার মাঝেই আকাশ আবার বললো,

“এরকম আর কখনো করবি না! ঠিক আছে?”

আমি অপরাধ ভঙ্গিতে আলতো মাথা নাড়ি।তারপর বললাম,
“আর যে বইগুলো দিলি আমার ত দাঁত ভাঙ্গা অবস্থা! কিছুই বুঝতেছি না!”
আকাশ টেবিলের সামনে থেকে একটা চেয়ার টেনে সেখানটায় বসতে বসতে বললো,
“সেজন্যেই ত আসলাম।ওপাশে বস।আর কম্পিটিটিভ বইটা দ্রুত বের কর!”

আমি সড়াৎ করে চেয়ারে ধপসে বসে যেয়ে তরহর বইটা আকাশের দিকে এগিয়ে দিই।আকাশ বইটা হাতে কিছুক্ষণ বিচক্ষণ চোখে ঘাটাঘাটি করে নিয়ে ফের আমার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় এবং শান্ত গলায় বললো,
“এত পড়া দেখে ভয় পেয়েছিস, তাই তো?”
“হু।”
“সব পড়তে হবে না।”
“কেন?”
“সবগুলো থেকে প্রশ্ন আসে না কিছু স্পেসিফিক টপিকস ছাড়া।এখন সেগুলোই তোকে দাঁগিয়ে দিব।”

এভাবে আকাশ আমায় আরো দুই তিনটা বইয়ের ইম্পর্ট্যান্ট টপিকগুলো দাঁগিয়ে দেয় আর তারসাথে সেগুলোর ব্যাসিক বুঁঝিয়ে দেয়!আমি মনস্থির এবং মনোযোগ সহকারে সবটা শুনে নিই।তবে,একসাথে সবগুলো বিষয় শুধু আমার নয়,যেকোনো বিজ্ঞ ব্যক্তিরও মাথায় লোড হবে না এটা স্বাভাবিক!তা আকাশ বুঝলো।তাই বললো,

“চাপ নিস না।আমিতো আছি।দরকার হলে লাগাতর কয়েকদিন এসে তোকে বিষয়গুলো পূর্ণ ধারাবাহিকতায় বুঝিয়ে দিয়ে যাবো।ঠিক আছে?”
আমি হেসে ফেলি।বললাম,
“তুই সত্যিই খুব ভালো রে!”

তারপর থেকে আকাশ আমায় লাগাতর সন্ধের পর সময় দিতে থাকে।দিনে আসতো কিন্তু এতে অনেকে তা খারাপ চোখে দেখবে ভেবে আকাশ রাতের বেলায়ই সতর্কতা অবলম্বন করে আসে,যাতে কেউ না দেখে।আর টোয়া ত আমার সাথে থাকেই।

আজও আসে পড়াতে।আমি আকাশকে চেয়ারে বসতে বলে কিচেনে আসি চা বানাতে।অবশ্য আকাশের জন্যে চা’টা প্রতিদিন টোয়াই বানায়।কিন্তু আজকে টোয়ার বাসা কী একটা ঝামেলা হওয়ার কারণে সে আর সন্ধে আসতে পারে নি।
তাড়াহুড়ো করে পাতিলে পানি নিয়ে তাতে চিনি মিক্সড করে চুলায় বসিয়ে দিই।এরইমাঝে একদল মহিলা-পুরুষ আমার বাসার দিকে ছুটে এসে দরজায় প্রবলভাবে করাঘাত করতে থাকে।আমি কেঁপে উঠি।বার কয়েক বুক ধরে নিঃশ্বাস নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

“ক-কে এখানে?”
“আমরা! দরজা খোল!”

আমি বার কয়েক ঢোঁক গিলি।আবারো দরজায় প্রবল জোরে ঝাঁকি পড়ে।ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
“বললাম না?মাগি দরজা খুলবো না?ভিতরে পরপুরুষ আছে পরপুরুষ সেইজন্যে!”

কথাটা শুনামাত্র আমি আঁতকে উঠি!কন্ঠটা হাজেরা দাদীর কন্ঠের মতো লাগছে।কিন্তু হাজেরা দাদী আমাকে এসব কথা কেন বলছে?

“ওই মাইয়া দরজা খোল বলছি!নাহলে খারাপ হবে বলে দিলাম!”
আমি এবার সত্যিই ভয় পেয়ে যাই।হঠাৎ এলাকার লোকজনের এত হুলস্থূল!তবে কী উনারা আমাকে এবং আকাশকে নিয়ে সন্দেহ করেছে ব্যাপারটা এটা নয়তো?ইয়া মাবুদ!নাহ ব্যাপারটা উনারা যাই ভাবুক আমার উচিত উনাদের বুঝানোর!চুপ মেরে থাকলে,দরজা না খুললে তিলকে তৈল বানাবে।ভেবেই তরহর দরজা খুলে কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনারা ভেতরে ঢুকে পড়ে আর দ্রুতপদে ডাইনিং এ যেয়ে আকাশের সামনে দাঁড়ায়।আকাশ প্রচন্ড অবাক হয়ে যায় হঠাৎ এখানে এতগুলো মানুষের আগমণে!তবে কী জন্যে?
আকাশের মনে এমন প্রশ্নবাণের উসখুস লেগে যায়।এলাকার একজন বয়স্ক লোক বলে উঠেন,

“এই ছেলে,এই মাইয়ার সাথে তোমার আজ ক’দিন ধরে এসব চলছে?”
“মানে?”
“পরপুরুষ সাথে অন্য মাইয়া রাত কাঁটলে তাকে কি কয়? তা খুলে বলা লাগবো?”
আকাশ এবার অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়!তরহর চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে বললো,

“চাচা,আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।আমরা দু’জন বন্ধু।ওর চাকরি চলছে।তাই আমি ওকে জাস্ট বন্ধু হিসেবে কিছু পড়া দেখাতে এসছি!”
হাজেরা দাদী বলে উঠলো,
“এই ছ্যামড়া মিথ্যায় কয়!রোজ রাতে এই ছ্যামড়া এই মেয়ের কাছে আসে। আমি নিজ চোখে দেখেছি!”

আমার দু’চোখ দিয়ে টলটল পানি পড়তে থাকে।কান্না মিশ্রিত গলায় বললাম,

“নাহ, দাদী নাহ!সেরকম কিছু না।প্লিজ দাদী আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিবেন না!”
“এই মাগি,চুপ কর তুই!তাই তো বলি কারণ ছাড়া ত কারোরে এমনি এমনি কেউ দোষ দেয় না!কারণ ত অবশ্যই থাকে।ওর চরিত্রে যে দোষ আছে একজন্যে ওর আগের স্বামী ওরে তালাক দিয়েছে!”

হাজেরা দাদীর সাথে অন্যরা সবাইও একাগ্রতা প্রকাশ করে জোর আওয়াজ তুলতে থাকে।ঘটনার আকস্মিকতায় আকাশ হতবিহবল!সে কি বলে এদেরকে থামাবে নিজেই বুঝেছে না।আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে শুধুই কাঁদছি।শরগোলের মাঝে আবার আরেকজন সবাইকে হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“সবাই শুনেন,সবাই শুনেন?”

সবাই মুহূর্তে থেমে যেয়ে আগ্রহ চোখে লোকটির দিকে তাকায়।
“এরা দু’জন যেহেতু এমন কুকর্ম করে ফেলছে তাহলে এর একটা ফয়সালা করতে হবে!”
“কেমন ফয়সালা?”
“এটা আমাদের এলাকা।আমাদের এলাকার একটা ইজ্জত আছে এবং আমাদের নিজেদেরও।তাছাড়া,এর বয়সী এলাকায় আরো অনেকগুলো মেয়ে এখনো অবিবাহিত আছে!ওদেরও বিয়ে দেওয়া লাগবে।এই মেয়ে যে কাজ করছে এর জন্যে উপর্যুক্ত শাস্তি!”
“কী?”
“এদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে এই এলাকা ছাড়া করা!যাতে ভবিষ্যৎতেও যদি কেউ আমাদের এলাকা নিয়ে কথা তুলে তখন বলতে পারবো ওরা স্বামী-স্ত্রী!”
“কেরামত সাহেব আপনার মতামতটা যুক্তিযুক্ত! একদম সঠিক একটা মতামত দিয়েছেন।আর দেরী না করে এখনই কাজী ডেকে এদের বিয়ে পড়িয়ে দাও।”

সাথে সাথে সবাই “হ্যাঁ হ্যাঁ” বলে উঠলো!
“যান এখনই কাজী ডেকে এনে এদের দুজনেকে বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে এখান থেকে বিতাড়িত করে দেন!”

কথাটি শুনামাত্রই আমি ব্যথিত চোখে আকাশের দিকে তাকাই।আকাশ হতভম্ব চোখে আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। দু’পাশে মাথা নেড়ে আকাশকে বলতে চেয়েছি,
“আকাশ,না!ওদের থামা!”

কিন্তু আর বলা হলো না।কিছুক্ষণ বাদেই কাজী চলে এলো।সবার যাতাকলে পড়ে বিয়েটা হয়ে গেলো!!!!

বিয়ের কাজ শেষ হওয়া মাত্রই টোয়া চলে এলো!এসেই দেখলো এই কান্ড!আমি টোয়াকে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে দিই!টোয়াও আমাকে জড়িয়ে ধরে তার মুখটা আমার কানের কাছে এনে বললো,
“এতদিনে গ্রামবাসীরা একটা ভালো কাজ করলো!যাক গ্রামবাসীদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

আমি মুহূর্তে টোয়ার উপর রেগে যাই।টোয়া শব্দ করে হেসে দেয়!!!

চলবে….
(মেয়েটা কবে যে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করবে,উফস!!!আর হ্যাঁ,গল্পটা রমজানের আগে আগেই শেষ করার চেষ্টা করবো।হ্যাপী রিডিং)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here