হঠাৎ ভালোবেসে ফেলেছি পর্ব ৩১+৩২

#হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি💕
The_unexpected_love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-31

একজন বাইরের মানুষের কাছে নিজেদের ভেতরের কথা বলা প্রীতি মোটেও পছন্দ করে না।আর তা যদি হয় স্বামী স্ত্রীর। প্রীতি ‘না’বলতে গিয়েও মুচকি হেসে বলে উঠলো,

-তুমি যদি আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে তাহলে আমার ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পড়া পানি দেখতে পেতে।আর এতো সকালে স্বামীর সোহাগ ছাড়া তো আর এমনি এমনি গোসল করি নি তাই না?

রাইসা চোখ বড় করে প্রীতির দিকে তাকালো।কিছু বলতে যাবে তখনি প্রীতি আবারো বলে উঠলো,

-তুমি কি বলো তো আপু?এসব কথা কেউ বলে?এভাবে কথা বলে কি কেউ লজ্জা দেয়?

রাইসা প্রীতির কথা শুনে দাতে দাত চেপে চোখ বন্ধ করলো।বেশ খানিক পরে চোখ খুলল। রাইসার চোখ টা অনেক লাল রঙ ধারন করেছে।প্রীতি অন্যদিকে তাকালো।রাইসা প্রীতির দিকে তাকিয়ে গর্জিত গলায় বলে উঠলো,

-দুদিনের মেয়ে হয়ে তুমি নীলাভকে কীভাবে হাত করলে?আমি এতোবছরেও তা পারলাম না।

প্রীতি আবারো মুচকি হাসলো।বলল,

-তোমার ভালোবাসায় খুত ছিলো।কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিলো।আর আমার ভালো বাসায় কোনো খুত ছিলো না।আমি যে মুহুর্তে বুঝতে পেরেছি আমি নীলাভকে ভালোবাসি সে মুহুর্তে ওকে নিজের করে নিয়েছি।আমার ভালোবাসায় কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই।আমার ভালোবাসা শুধুই নীলাভময়।আর কিচ্ছু না।

প্রীতি অন্যদিকে ঘুরে তাকালো।

রাগের মাথায় রাইসা দিশা কিনারা না পেয়ে পাটার উপরের শিল টা হাত দিয়ে গড়িয়ে দিলো।প্রীতি যেই এদিকে তাকালো ওমনেই ওর পায়ে শিলনোড়া টা ঠাস করে পড়লো।

এতো ভারী বস্তু এতো উপড় থেকে পড়ায় প্রীতি নীলাভ বলে এক গগনধারীনি চিতকার দিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো।’ও মাগো’ বলে প্রীতি আরেকবার চিল্লালো।ঘটনার আকস্মিকতায় রাইসা মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর ও তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেলো।

নীলাভ খেতে বসেছিলো।হঠাৎ প্রীতির এমন চিতকার ওর কানে এলে সব কিছু ফেলে রান্নাঘরে এসে দাড়িয়েছে।

প্রীতি অচেতন হয়ে পড়ে আছে।পা থেকে ক্রমাগত রক্ত বের হচ্ছে প্রীতির। রক্তে ভেসে গেছে চারিপাশ।পা যে বেশ ক্ষত হয়েছে তা বুঝা যাচ্ছে।

প্রীতিকে এমন অবস্থায় দেখে নীলাভের দুনিয়াদারি ঘুরছে।ও এগোবার শক্তি পর্যন্ত পাচ্ছে না।শরীর যেনো বরফ হয়ে গেছে।অবশ হয়ে আসছে পুরো শরীর। ক্রমাগত ঘাম ছুটছে নীলাভের।

নীলাভের পেছন পেছন এসে দাড়িয়েছে নীলা চৌধুরী নীলাভের ফুফি তৌফিক চৌধুরী নীলাভের চাচা চাচি ভাই বোন সবাই।

নীলা চৌধুরী প্রীতির এই অবস্থা দেখেই একটা চিতকার দিলো।প্রীতি তার মেয়ের মতো বা তার থাকেও বেশি আপন।সেই প্রীতির চারিপাশে আজ এতো রক্ত এতো…।নীলা চৌধুরী চোখের সামনে এতো রক্ত সহ্য করতে পারলেন না।শরীর তার নিস্তেজ হতে শুরু করলো।তার মাথা ঘুরাচ্ছে।নীলা চৌধুরী মাথা ধরে অচেতন হয়ে গেলেন।তৌফিক চৌধুরী এসে স্ত্রী কে ধরলেন।

তৌফিক চৌধুরী নীলাভের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

-তাড়াতাড়ি প্রীতির কাছে যাও।অনেক ব্লিডিং হচ্ছে ওর।দেরি করলে কিন্তু ক্ষতি হয়ে যাবে।

নীলাভ এক দৃষ্টিতে প্রীতির দিকে চেয়ে আছে ওর কানে যেনো কিছুই ঢুকছে না।সবাই কাদছে।সবাই।নীলাভ দরজায় এমন ভাবে দাড়িয়েছে যার জন্য কেউ ভেতরে যেতেও পারছে না।
বেশ কিছুক্ষণ পর নীলাভ নিস্তেজ শরীরে কাপা কাপা পায়ে ভেতরে ঢুকলো।

প্রীতির কাছে গিয়ে প্রীতির মাথাটা কোলে নিলো।প্রীতির হাত টা ধরতেই নীলাভ দেখল রক্ত। অস্ফুটস্বরে নীলাভ বলে উঠলো,

-এতো রক্ত! এতো রক্ত!

নীলাভের চাচি তাড়াতাড়ি করে এসে প্রীতির চোখে মুখে পানি দিলেন।কিন্তু কোনো লাভ হলো না। প্রীতির জ্ঞান ফিরছে না।নীলাভ ঠায় বসে আছে।নীলাভের ফুফি নীলাভের কাধে হাত রাখলেন।নীলাভ চকিতেই প্রীতির মুখের দিকে তাকালো।কত কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা!আমার ওর অবস্থা দেখে এতোটা কষ্ট হচ্ছে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তাহলে ওর কত কষ্ট হচ্ছে।তারাতারি প্রীতির ট্রিটমেন্ট করতে হবে তারাতাড়ি।
নীলাভ উঠে দাড়াতেই খেয়াল করলো এটা রান্না ঘর।প্রীতির থেকে একটু দূরেই একটা শিলনোড়া পড়ে আছে।উপরে পাটার উপর হলুদ অর্ধ বাটা হয়ে পড়ে রয়েছে।নীলাভ এসব দেখে জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

-আমার প্রীতি রান্না ঘরে কি করছিলো?কে বলেছিলো ওকে রান্না ঘরে আসতে?ও হলুদ বাটছিলো কেনো? প্রীতির এ অবস্থা কীভাবে হলো?

নীলাভ পাগলের মতো চিতকার করছে।সবাই নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কারন এটা বাড়ির নিয়ম ছিলো।এতে কারোর দোষ নেই।এতোক্ষনে নীলা চৌধুরীর ও জ্ঞান ফিরে এসেছে।ছেলের এমন চিতকার শুনে নীলা চৌধুরী উঠে এসে ছেলের হাত ধরে বলে উঠলো,

-বাবা এসব পরে হবে তুই আগে প্রীতিকে ঘরে নিয়ে যা।

নীলাভের টনক নড়লো।ও তারাহুরো করে প্রীতিকে কোলে তুলে নিলো।নীলাভের কান্না আসতে চাইছে।অনেক কান্না।বুক ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইছে।তনয়ের সাথে বিয়ের সময় ও এতোটা কষ্ট হয় নি।কারন তখন প্রিয় মানুষটাকে চিরতরে হারানোর ভয় ছিলো না।তনয়ের সাথে বিয়ের সময় যতটা না নীলাভ কেদেছে কষ্ট হয়েছে তার চেয়ে হাজার গুন বেশি কষ্ট হচ্ছে আজ কাদছে ও…ভালোবাসা হারানোর আতঙ্কের কষ্ট পাচ্ছে নীলাভ।

নীলাভ চোখ টা মুছে হন্তদন্ত হয়ে প্রীতিকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরের পথে ছুটলো।আর চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

-তাহসিন….তাহসিন..

তাহসিন সেখানেই উপস্থিত ছিলো।নীলাভের ডাকে তাহসিন দরকারী সব জিনিস নিয়ে নীলাভের রুমে ছুটলো।ইতিমধ্যে ও নিজে একটা ডাক্তার কে ফোনও করে দিয়েছে।

____________________________

রুম টাকে গোটা একটা হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছে নীলাভ।প্রীতির জ্ঞান এখনো ফিরেনি।তাহসিন ডাক্তার কে ডেকে এনেছে সাথে দুজন নার্সও।প্রীতির পা টা ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করার পর ডাক্তার বলে উঠলো,

-পা টা মারাত্মক ভাবে থেতলে গেছে।দুটো নখ ভেঙে গেছে।প্লাস্টার করতে হবে।কোনো হাড় ভেঙেছে কি না বুঝতে পারছি না।নীলাভ চৌধুরী আপনি যদি আপনার ওয়াইফ কে হাসপাতালে ভর্তি করতেন তাহলে ভালো হতো।

নীলাভ প্রীতির এক হাত ধরে বসে আছে।প্রীতির দিকে তাকিয়ে সে নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠলো,

-আমি আমার ওয়াইফের জন্য বেস্ট টাই করবো ডাক্তার।এখান থেকে ভালো একটা হাসপাতাল যেতেও মিনিমাম তিন ঘন্টা লাগবে।আর আমি একটুও চাইছি না এতোটা জার্নি করে ওকে এই অবস্থায় নিয়ে যেতে।যত ডাক্তার নার্স লাগে আপনি এখানে নিয়ে আসুন আংকেল।

ডাক্তার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে প্রীতিকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে আর পা টাকে ভালো মতো পরিষ্কার করতে লাগলো।

রাইসা একবার এসে দরজার ফাক দিয়ে উকি দিলো। রুমের আনাচে কানাচে নানান ধরনের ওষুধপত্র আর ডাক্তারি সব জিনিস পড়ে আছে।সব মানুষ কেমন জানি এলোমেলো হয়ে আছে।নীলা চৌধুরী নিশ্চুপে চোখের জল ফেলছেন।আর নীলাভ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রীতির মুখের দিকে।প্লাস্টার করা শেষে ডাক্তার বলে উঠলো,

-রুম টা ফাকা করেন। আর নীলাভ চৌধুরী,আপনার ওয়াইফের কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।প্রপার রেস্টে রাখবেন আপনার ওয়াইফ কে।সবসময় খেয়াল রাখবেন।কেউ যেনো উত্তেজিত না করে উনাকে।আর পা টাকে নাড়াতে না করবেন।দুই তিন পর নাড়াতে বলবেন।আর যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা ব্যাক করে ভালো একটা হসপিটালে আপনার ওয়াইফ কে এডমিট করুন।

নীলাভ শুকনো ঠোঁট দুটো জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে বলে উঠলো,

-ওকে ডাক্তার।আর নার্সকে আপনি নিয়ে যান।নার্স লাগবে না।আমি চাইছি না কোনো অপরিচিত মানুষ নিয়ে রিস্ক নিতে।আমি আর আমার মাই ওর খেয়াল রাখতে পারবো।ধন্যবাদ।

ডাক্তার উঠতে উঠতে বলল,

– যখন দরকার পড়বে আমাকে ফোন দিবেন।কন্ডিশন বেশি সিরিয়াস হলে হসপিটালে এডমিট করবেন।ব্যান্ডেজ এ ময়লা বা পানি লাগাবেন না।ইনফেকশন হয়ে যাবে।আর সবাই রুম টা ফাকা করে দিন।

ডাক্তার বেরিয়ে গেলো।উপস্থিত সবাই আস্তে আস্তে ঘর ফাকা করে চলে যেতে লাগলো।রাইসা দরজায় দাঁড়িয়ে প্রীতির দিকে এক গুচ্ছ ঘৃণার সহীত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো।

,

প্রীতিকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো নীলাভ।চোখ মুখ অন্ধকার দিয়ে আসছে ওর।কিছুক্ষনের জন্য মনে হয়েছে পুরো পৃথিবীটা থমকে গেছে।এ মেয়েটাকে ছাড়া তার একটা মুহুর্ত চলতে চাইছে না।নীলাভ প্রীতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আর কখনো চোখের আড়াল করবে না সে প্রীতি কে।নীলাভ প্রীতির হাত টা ধরতেই দেখলো হাতের তালু লাল আঙ্গুল গুলোও লাল।নীলাভ প্রীতির দুটো হাত ই সামনে এনে দেখলো দু হাত ই লাল।আঙ্গুল এ যে ফোসকা পড়েছিলো তা বুঝা যাচ্ছে।নীলাভের মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।ও চিল্লিয়ে নীলা চৌধুরীকে ডাকলো।

ছেলের এমন চিতকারে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন নীলা চৌধুরী। মাকে দেখে নীলাভ প্রীতির হাত দেখিয়ে বলে উঠলো,

-ওর হাত কীভাবে পুড়লো মা?আমার অগোচরে তোমারা ওকে দিয়ে এতো কাজ করিয়েছো?আমার প্রীতির কিছু হলে কে দায় নেবে তখন?কাউকে ছাড়বো না আমি মনে রেখো।আমার প্রীতির কিছু হলে কাউকে ছাড়বো না।

নীলা চৌধুরী প্রীতির হাত টা ভালো মতো দেখে নিয়ে ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,

-প্রীতিকে আজ সকালে পায়েস রাধতে দিয়েছিলো তোর ফুফি।এটা নিয়ম ছিলো।

নীলাভ দাতে দাত চেপে বলে উঠে,

-মাই ফুট।নিয়ম নিয়ম নিয়ম।কিসের নিয়ম হ্যা?যেখানে মানুষের জীবন মরনের প্রশ্ন সেখানে কীসের নিয়ম?

নীলা চৌধুরী ছেলের কথায় কিছু বললেন না।একটা মলম বের করে প্রীতির হাতে দিয়ে দিতে লাগলেন।প্রীতির হাতে ফোসকা পুরোপুরি ভাবে যায় নি তাই বাটার সময় ফোসকা গুলো গলে গেছে।বাজে অবস্থা।

নীলাভ নীলা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় নরম সুরে আবার বলে উঠে,

-মা, ওর জ্ঞান কেনো ফিরছে না মা?আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে মা।

নীলা চৌধুরী নীলাভের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ‘ঠিক হয়ে যাবে সব ‘ বলে চলে গেলো। নীলাভ আবার বিছানায় নিজের গা টা হেলে দিলো।
#হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি💕
The_unexpected_love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-32

টিপটিপ করে চোখ খুলছে প্রীতি। আধো আধো চোখেই প্রীতি অনুভব করলো ও কারোর বুকে শুয়ে আছে।প্রীতি পুরোপুরি ভাবে তাকালো।নীলাভ ওকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।প্রীতির মাথাটা খুব ভারী লাগছে।মাথার ভেতর দপদপ করে জ্বলছে।পা টাও নাড়াতে পারছে না।পায়ের ব্যাথা টা যেনো সারা শরীরময় ছুটে বেরোচ্ছে।

প্রীতি একটু নড়ে উঠলো।সাথে সাথে নীলাভ জেগে গেল।প্রীতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিলো টের ই পায় নি।নীলাভ উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,

-জ্ঞান ফিরেছে তোমার।আলহামদুলিল্লাহ। এখন কেমন লাগছে?পায়ে কি খুব বেশি ব্যাথা করছে?

প্রীতি চোখ মুখ খিচে একবার মাথা নাড়ালো।যার অর্থ ব্যথা করছে। নীলাভ প্রীতির পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবার প্রীতির দিকে তাকালো। অনুতপ্ত কন্ঠে বলল,

-পা নাড়াতে পারছো না তাই না?

প্রীতি অসহায় ভাবে নীলাভের দিকে তাকালো।এরপর বলে,

-ওয়াশরুমে যাবো।

নীলাভ প্রীতির হাত ধরে বলে,

-চলো, আস্তে আস্তে উঠো তাহলে।আমি কোলে নিয়ে তোমাকে ওয়াশরুমে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো।

প্রীতি মাথা নাড়ালো।নীলাভ প্রীতিকে কোলে তুলে নিলো।প্রীতি নীলাভের গলা দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নীলাভের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।নীলাভ প্রীতির কপালে একটা চুমু দিয়ে প্রীতিকে ওয়াশরুমে দিয়ে এলো।

,

প্রীতি ওয়াশরুম থেকে বের হলে নীলাভ আবার প্রীতিকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।নীলাভ যেতে ধরতেই প্রীতি নীলাভের শার্ট খামচে ধরে বলল,

-এখানেই থাকেন না।

প্রীতির হাত নিজের শার্ট থেকে ছাড়িয়ে প্রীতির হাতে চুমু দিয়ে নীলাভ বলে,

-তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি।কিছুই তো খাও নি।
-আমি খাব না।
-পারমিশন চাই নি।আমি খাবার নিয়ে আসছি।

_________________________________

রাতেও নীলাভ প্রীতিকে খাইয়ে দিলো।সারাদিন প্রীতি নীলাভের বুকে শুয়ে ছিলো। নীলাভ প্রীতিকে একটু ও নড়াচড়া করতে দেয় নি। আর প্রীতিও নীলাভকে কোনো জায়গায় যেতে দেয় নি।নীলা চৌধুরী তৌফিক চৌধুরী নীলাভের ফুফি বারবার এসে দেখে গেছে প্রীতিকে।তাহসিন একবার এসে ড্রেসিং করে দিয়ে গেছে।

নীলাভ প্রীতির মাথায় পরম আদরে বিলি কেটে দিতে দিতে শীতল কন্ঠে বলল,

-পায়ে ব্যাথা টা কীভাবে পেয়েছো? শিলনোড়া টা তোমায় পায়ে কীভাবে পড়লো?

নীলাভের এমন প্রশ্নে প্রীতি কি জবাব দিবে ভেবে যাচ্ছে।সত্যি কথা বললে নীলাভ এখন আবার ঝামেলা করবে।চিল্লাচিল্লি করবে।যা প্রীতি এ মুহূর্তে একদমই চাইছে না। অনেক ভেবে চিন্তে প্রীতি বলে,

-আমি তো এসব আগে কখনো করি নি।তাই অসতর্কতাবশত শিল টা পায়ে পড়ে গেছে।

নীলাভ ভ্রু কুচকে বলে,
-সত্যি।

প্রীতি মাথা ঝাকালো।নীলাভ আবারো বলল,

-আর কখনো যেনো কোনো কাজ করতে না দেখি।দেখে শুনে চললে কি হয় তোমার?ঝামেলা বাধিয়েই রাখো সবসময়।ঝামেলা…

-আর আপনি গোমড়ামুখো।

প্রীতি অন্যদিকে ঘুরে একটা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। হাফ ছেড়ে বাচলো।মিথ্যা বলা কতোটা কঠিন।একটার জন্য সাতটা মিথ্যা কথা বলতে হয়।প্রীতি নীলাভের বুকে আবার চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকলো।বিয়ের পর এটা ওদের দ্বিতীয় রাত।কাল ও প্রীতি ঘুমিয়ে পড়েছিলো অসুস্থ হয়ে আর আজ ও হাত পা ভেঙে বসে আছে।

,

নীলাভ উঠে দরজা লাগিয়ে দিয়ে এলো।প্রীতির কাছে এসে বিছানার চাদর ঠিক করলো।বালিশ ঠিক করে দিলো।সেই মুহুর্তেই প্রীতি নীলাভের গেঞ্জির কলার আকড়ে ধরলো।নীলাভের নীল চোখ জোড়ায় নিজের গাঢ় বাদামী চোখ জোড়া স্থির করলো।নীলাভ হেলে আছে প্রীতির উপর। প্রীতির হাতের উপর নীলাভ হাত রেখে বলল,

-কি হয়েছে?

প্রীতি নীলাভের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-একটু আদর করবেন?

প্রায় সাথে সাথে নীলাভ প্রীতির কপালে গভীর ভাবে একটা চুমু দিলো।প্রীতি চোখ বন্ধ করলো।নীলাভ প্রীতির ঠোটে আরেকটা চুমু দিলো।প্রীতি কেপে উঠলো। নীলাভ প্রীতির দু গালে চুমু একে দিলো।প্রীতির সর্বাঙ্গে কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে।গরম হয়ে উঠছে সারা শরীর।প্রীতি কাপাকাপি দেখে নীলাভ মুচকি হেসে বলে উঠলো,

-করেছি আদর। এবার ছাড়ো।

প্রীতি নীলাভের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলল,

-অনেক বেশি আদর চাই প্লিজ…..
-প্রীতি কি বলছো তুমি? তোমার মাথা ঠিক আছে?
-প্লিজ….

প্রীতির এমন অনুনয় বাক্যে নীলাভ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।প্রীতির পাশে শুয়ে প্রীতিকে বুকে টেনে নিলো।প্রীতির কপালে আবারো চুমু দিয়ে বলল,

-তুমি অসুস্থ। তুমি সুস্থ হও এরপর অনেক অনেক আদর করবো ভালোবাসবো।
-আমি এখনি ভালোবাসা চাই।
-প্রীতি তুমি বুঝতে কেনো চাইছো না?তোমার পায়ের এই কন্ডিশন। এরমধ্যে কীভাবে কি?প্লিজ তুমি একটু সুস্থ হও একটু…. এরপর অনেক অনেক ভালোবাসবো।

প্রীতি ঘোমট মেরে শুয়ে থাকলো নীলাভের বুকে।পা টা হঠাৎ করেই জ্বালা শুরু করে দিয়েছে।চিলিক পেরে জ্বলে উঠছে বার বার।প্রীতি নীলাভের শার্ট খামচে ধরলো।নীলাভ প্রীতিকে শক্ত করে বুকে টেনে কিছু ভালোবাসার পরশ দিলো।প্রীতি পরম শান্তিতে আস্তে আস্তে নীলাভের বুকেই ঘুমিয়ে গেলো।

প্রীতি ঘুমিয়ে গেলে নীলাভ প্রীতির গালে আরেকটা চুমু দিয়ে প্রীতির পায়ের দিকে তাকালো।পা টা প্লাস্টার করা।প্রেয়সীর একমাত্র প্রথম আবদার টাই নীলাভ রাখতে পারলো না।উহু…আবদার নয় এটা তো তার অধিকার।স্ত্রীর অধিকার ভালোবাসার অধিকার।নীলাভ একবার অসহায় ভাবে প্রীতির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকালো।কতটা নিষ্পাপ লাগছে তার প্রীতিকে।কতটা আবেদনময়ী মমতাময়ী লাগছে।এমন একটা মেয়েকে কি কেউ কষ্ট দিতে পারে?

নীলাভ চোখ বন্ধ করলো।নীলাভের মস্তিষ্কে আজকের পুরো দিনটা ভাসতে লাগলো।সব কিছু একবার শুরু থেকে ভেবে নিয়েই নীলাভ চোখ খুলে তাকালো।তার মস্তিষ্কে এখন একটা কথাই ঘুরছে তা হলো প্রীতির পায়ে শিলনোড়াটা কি সত্যি অসতর্কতাবশত পড়েছে?না কি কেউ ইচ্ছে করে ফেলেছে?

______________________________

আবারো একটি নতুন সূর্য উকি দিচ্ছে।নতুন একটা সকাল দেখার সুযোগ করে দিয়েছে আল্লাহ।

প্রীতি ঘুমাচ্ছে।নীলাভ উঠে পড়লো।প্রীতিকে জাগালো না।কাল সারারাত প্রীতি উলোট পালোট করেছে মাঝে মাঝে ব্যাথায় আহ উহ শব্দ করেছে।একটু নড়তেই পায়ে ব্যাথা পেয়েছে।ব্যথায় একবার জ্বর এসেছে আবার কমেছে।সারারাত প্রীতি ঠিকমতো ঘুমাতে পারে নি।

নীলাভ উঠে ফ্রেস হয়ে ঘরের বাইরে পা রাখতে না রাখতেই রাইসাকে দেখতে পেলো।সাথে সাথে নীলাভ গম্ভীর ভাবে ডাকলো,

-রাইসা….

রাইসা থেমে গেলো।চোখ মুখ কুচকে ফেলল সে।রাইসা পিছন ফিরে তাকালো।নীলাভের দিকে চোখ পড়তেই সে চোখ সরিয়ে নিল। এই ভয়ংকর চোখজোড়ার দিকে সে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। রাইসার চাহনি অস্থির।হাত মোচড়ামুচড়ি করছে।সারা শরীর ঝনঝন করে কাপছে।এদিক ওদিক বার কয়েক তাকালো।

-তাহলে কি প্রীতি সব কিছু জানিয়ে দিয়েছে?

কথাটা ভেবেই রাইসা একটা ঢোক গিলল।চলে যেতে ধরলো।নীলাভ বুকে দু হাত ভাজ করে আবারো গম্ভীর সুরে ডেকে উঠলো।রাইসা চোখ মুখ খিচে থমকে দাড়ালো। নীলাভ পেছন থেকে এসে বেশ শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,

-প্রীতির পায়ে আঘাত লাগলো কীভাবে?

রাইসা তোতলানো স্বরে বলে,

– আআআমি কিকক জানি? তোমার বউ তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করো কীভাবে ব্যাথা পেয়েছে।

-আমি তো জিজ্ঞেস করেছি।

রাইসার ঘাম ছুটে যাচ্ছে।ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে ও।নীলাভের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রাইসা বলে উঠলো,

-সসসব ববলে দিয়েছে?

নীলাভ বাকা হেসে বলে উঠলো,
-সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?

রাইসা প্রায় সাথে সাথে তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো,

-মিথ্যা মিথ্যা বলেছে তোমার বউ। কি মিথ্যুক মেয়েই না বিয়ে করেছো তুমি?কীভাবে ফাসিয়েছে গো তোমাকে?রুপের ঝলকে….

আর বলতে পারলো না তার আগেই গালে ঠাস করে একটা চর পড়লো। রাইসা পড়ে যেতে ধরলো। তবুও নিজেকে সামলিয়ে নিলো। গালে হাত দিয়ে যেই মাথা টা সোজা করলো ওমনি ওর বাম গালে আরেকটা চর পড়লো।নীলাভ এতো জোরে চর মারলো যে রাইসার কাছে মনে হচ্ছে ওর গাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসবে।অনেক জোরে চরের শব্দ হয়েছে। যার কারনে নীলাভের ফুফি নীলা চৌধুরী তৌফিক চৌধুরী সবাই হাজির হয়েছেন।

নীলাভ আরেকটা চর মারতে গেলেই নীলাভের ফুফি নীলাভকে ধরে বলে উঠলো,

-কি হয়েছে বাবা?ওকে মারছিস কেনো?

নীলাভ সাথে সাথে ফুসে উঠলো।ভয়ংকর চোখে তাকালো ওর ফুফির দিকে।নীলাভের ফুফি আতকে উঠলো।এই দুইদিনে সবাই নীলাভের যে রাগ দেখেছে নীলাভের জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত ও এতো রাগ কেউ দেখে নি।নীলাভ বরাবরই শান্ত শিষ্ট বদ মেজাজি ছেলে।কিন্তু এমন চিৎকার চেচামেচি মারামারি করার ছেলে সে না।

নীলাভ বলে উঠে,

-তোমার মেয়েকে নিয়ে আজকেই এ বাড়ি থেকে চলে যাবে তা না হয় শুধু তোমার মেয়েকে পাঠিয়ে দেবে।আমার বউয়ের আশপাশ দিয়ে যেনো ওকে আমি না দেখি। তাহলে ওর জান এক জায়গায় রাখবো আর শরীর আরেক জায়গায় রাখবো।

নীলা চৌধুরী ছেলের রাগের কথায় চটে গেলেন।বলে উঠলেন,

-বড়দের সাথে এ কেমন বেয়াদপি তোমার নীলাভ?কি হয়েছে কি?

নীলাভ চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

-কাল প্রীতির পায়ে রাইসা শিল ফেলেছে।রাগের বশে জেদের বশে।কি আমি মিথ্যা বলছি বল?

নীলাভের ফুফিও এবার রাইসাকে ঝাকাতে ঝাকাতে প্রশ্ন করলো।বেশ কয়েকবার বলার পরও রাইসা মুখ খুলল না।নীলা চৌধুরী বার কয়েক বলাতেই রাইসা চেচিয়ে বলে উঠলো,

-হ্যা হ্যা আমি ই ফেলেছি। আমি নিজেই ফেলেছি।তোমার বউকে আমার সহ্য হয় না।যে জায়গায় আমার থাকার কথা ছিলো আজ ও সেখানে। আমি তোমাকে ভালোবাসি।তুমি ওকে ছেড়ে দেও।আমার কাছে এসে পড়ো প্লিজ…

নীলাভ তাচ্ছিল্য ভাবে ঘৃণার দৃষ্টিতে রাইসার দিকে তাকিয়ে বলে,

-কতটা নিকৃষ্ট বেহায়া মেয়ে হলে এতোগুলো বড় মুরুব্বি মানুষের সামনে একটা বিবাহিত ছেলেকে এসব বলে।ফুফি,তোমার মেয়েকে তুমি আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও নাহলে আমি ওকে খুন করবো।এই বাড়ির আশেপাশেও যেনো ওকে না দেখি।

নীলাভের ফুফি রাইসাকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলে।আর রাইসা বারবার চিল্লিয়ে বলছে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি নীলাভ। তুমি আমার কাছে এসে পড়ো।ওই মেয়েকে ছেড়ে দেও।নীলাভ আমাকে আটকাও।বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিও না আমাকে।’

কেউ আটকালো না রাইসাকে।নীলা চৌধুরী একটা বড় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন ,

-তুই কীভাবে জানলি যে রাইসাই প্রীতির পায়ে শিলনোড়া টা ফেলেছে?
-আমি তো অনুমান করেছিলাম।বাকি টা ও নিজেই বলে দিলো।

চলবে🙂
চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here