হঠাৎ ভালোবেসে ফেলেছি পর্ব ২৯+৩০

#হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি 💕
The_unexpected_love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-29

সবার মুখে আষাঢ়ের কালো ছায়া নেমে এসেছে।কনে কবুল বলছে না।বেশ কিছুক্ষণ থেকে বলা হচ্ছে কনেকে কবুল বলতে কিন্তু কনে কিছুতেই কবুল বলছে না।নানান মানুষ এবার নানানভাবে প্রনয় আহসান আর রাফিয়া আহসান কে কথা শুনাতে লাগলো খোটা দিলো।কেউ কেউ তো বলল,

-কি ব্যাপার কনে কবুল কেনো বলছে না?না কি আগের বারের মতো উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলবে যে,” বাবা আমি এই বিয়ে করতে পারবো না আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।”

সাথে সাথে কিছু মানুষের মধ্যে হাসির দুম লেগে যাচ্ছে। আসলে ভালো খারাপ মিলিয়েই তো মানুষ। কোনো জায়গায় পাচ জন মানুষ থাকলে সেখানে একজন অন্তত খারাপ মানুষ থাকবেই।পাচটা কথার মধ্যে অন্তত একটা কথা হলেও খারাপ হবেই।

প্রীতি চোখ বন্ধ করলো।সাথে সাথে চোখ থেকে টুপ করে কয়েকফোটা পানি পড়লো।এই বাড়ি এই মানুষ এই প্রিয়জনগুলোকে ছেড়ে ও কিভাবে থাকবে।নতুন পরিবেশে গিয়ে কি ও আদেও খাপ খাইয়ে নিতে পারবে?যে মানুষগুলোকে প্রত্যেক সেকেন্ডে সেকেন্ডে দেখার অভ্যাস। সে মানুষগুলোর সাথে মাসে একবার দেখা হবে কি না তার ই কোনো নিশ্চয়তা নেই।কিভাবে থাকবো আমি?

ভেবেই প্রীতির বুক ফেটে কান্না আসছে।স্নেহা প্রীতিকে আস্তে করে আবার বলল,

-প্রীতি বোন আমার কবুল বল প্লিজ।সবাই খারাপ বলছে।

প্রীতি চোখ খুলল।সামনের পানির থালাটার দিকে তাকালো।নীলাভের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে সেখানে।নীলাভ ও প্রীতিকে দেখতে পারছে এতোক্ষন যে প্রীতি কাদছিলো তাও নীলাভের চোখে পড়েছে।নীলাভ প্রীতির কান্নার কারন বুঝতে পেরে মুখ দিয়ে ইশারা করলো,

-প্লিজ কবুল বলো। আমি তোমাকে সময় পেলেই এ বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো।প্লিজ…….

নীলাভের অসহায় মুখটা দেখে প্রীতি কান্না ঠোঁট দিয়ে আটকে রেখে হেসে দিলো একটু।এরপর নীলাভের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

-কবুল কবুল কবুল….

চারিদিকে হৈ হৈ করে উঠলো। বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।

_________________________

বিদায় শেষ করে ওরা যাত্রা শুরু করেছে নীলাভের দাদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। এটা নীলাভদের বাড়ির নিয়ম।বিয়ে করে বউকে প্রথম দাদা বাড়িতে নিতে হয়।আর সেখানে সাতদিন থাকতে হয়।বিয়ে যেখানেই করুক না কেনো।

নীলাভ একটুও চায় নি এই এতো রাতে দাদা বাড়ির উদ্দেশ্যে রৌনা দিতে।প্রায় তিন ঘন্টার পথ।এদিকে প্রীতির অবস্থা ভালো না।

বিদায়ের সময় প্রায় সে এক ঘন্টা যাবত কান্না করে তারপর গাড়িতে উঠেছে।গাড়ি তে উঠেও কাদতে কাদতে অজ্ঞান হয়ে গেছে।নীলাভ প্রীতির জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করে নি।এখন জ্ঞান ফিরালে প্রীতি আবার কাদবে।

নীলাভের দৃষ্টি বাইরের অন্ধকারে আকা বাকা রাস্তার উপর।ও সেই দৃষ্টি ফেলে প্রীতির দিকে তাকালো।নীলাভের বুকে প্রীতি পড়ে আছে।মেয়েটার মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে।মনে হচ্ছে অনেক কিছু ছেড়ে এসেছে।আর কোনো দিন ওই মানুষগুলোর সাথে কথা হবে না।নীলাভ প্রীতির মুখ থেকে চুল সরিয়ে দিলো।প্রীতিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই নীলাভ খেয়াল করলো প্রীতির নাকের নথ টা বারবার ঠোঁটে গিয়ে ঠেকছে।নীলাভ প্রীতির নথ টা আস্তে করে খুলে দিলো।
প্রীতিকে আবার বুকে জড়িয়ে বাইরে দৃষ্টি রাখলো নীলাভ।

,

নীলাভরা এসে গেছে।নীলাভ প্রীতির চোখে পানি দিয়ে ওর জ্ঞান ফিরালো।জ্ঞান ফিরে আশেপাশে সব কিছু দেখেই প্রীতি হকচকিয়ে উঠলো।নীলাভের চাচী ফুফুরা কনেকে নামালো।

প্রীতির পা টলছে।ঠিক মতো দাড়াতে পারছে না।মাথাটা ঝিমঝিম করছে।সব নিয়ম কানুন শেষে যেই প্রীতিকে ঘরে ঢুকানো হবে।ওমনি নীলাভ এসে প্রীতিকে কোলে তুলে নিলো।

বড়রা সবাই লজ্জা পেয়ে ভেতরে চলে গেছে।আর আশেপাশের সব ছেলেমেয়েরা হৈ হৈ করে উঠলো।হাত তালি দিচ্ছে। সিটি বাজাচ্ছে।

প্রীতি হাটতেই পারছিলো না।মনে হচ্ছিলো শরীরের শেষ শক্তি টুকু শেষ। নীলাভ কোলে নেওয়ায় প্রীতি বাধা দিলো না।যেনো ও কথাই বলতে পারছে না।প্রীতি বলতে চাইছে ‘ নামান আমাকে, বড়রা দেখছে।’ সেটুকুও বলতে পারছে না।গলায় সব কথা ঝট পাকিয়ে থেমে যাচ্ছে।হাল ছেড়ে দিয়ে নীলাভের বুকে চুপটি করে পড়ে রইল প্রীতি।

,

নীলাভ প্রীতিকে ঘরে এনে খাটে বসিয়ে দিলো।নীলা চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। তার সাথে আছে নীলাভের ফুফু আর নীলাভের ফুফাতো বোন রাইসা।নীলা চৌধুরী অস্থির কন্ঠে বলে উঠলেন,

-কি হয়েছে?কি হয়েছে প্রীতি মায়ের?

নীলাভ প্রীতিকে পানি খাইয়ে নীলা চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-মা ও কাল রাতে খেয়েছিলো।এরপর আজ সারাদিন কিচ্ছু খায় নি।তারপর এতো কান্না কাটি করেছে তাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।একটু খাব…..

ছেলের কথা পুরোটা না শুনেই নীলা চৌধুরী ছুটে চলে গেলেন খাবার আনতে।তখনি রাইসা শরীর জ্বালানো ভাবে তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলে,

-ঘরে পা রাখতে না রাখাতেই এই অবস্থা?বাকি জীবন কি করবে?ছি ছি ছি!বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে বরের কোলে চড়ে আসলে বলি তোমার কি লজ্জা নেই?

প্রীতি চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে গেলো।ও অনেক কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কিছু বলতে পারলো না।নতুন বউ হয়ে এতো কথা মানায় না।এমনি বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই এতোগুলা কথা শুনলো।প্রীতির এখন মনে হচ্ছে কেনো ও বিয়ে করলো কেনো?মেয়েরা কি বাবা বাড়িতে থাকতে পারে না?বিয়ে হলেই কি বাবার বাড়ির সাথে মেয়ের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়?

নীলাভ রাইসার কথায় শান্ত ভাবে বলে উঠলো,

-বউ টা তো আমার? না কি তোর?বউ যেহেতু আমার তো ভালো মন্দ আমাকেই বুঝতে দে।লজ্জা আছে কি নেই সেটা নাহয় আমি আর আমার মা বাবাই বুঝে নিবো।তোর নাক না গলালেও চলবে।

নীলাভ ঘুরে তাকালো প্রীতির দিকে।প্রীতির চোখের পানি আলতো হাতে মুছে দিয়ে কিছু মনে পড়ার মতো আবারো রাইসার দিকে ঘুরে বলল,

-ওও হ্যা আর একটা কথা।এখানে এতো গুলো বড় মানুষ আছে তোর মা মানে আমার ফুফু চাচি সবাই আছে কেউ তো কিছু বলল না তুই কেনো মাঝখান থেকে ফুড়ন কাটছিস।ছোট ছোটোর মতোই থাকিস।না হলে আমার হাতের চর একটাও মাটিতে পড়বে না।

রাইসা কান্না মাখা গলায় বলল,

-এই চর দিয়েই তো তুমি আমায় মেরেছো। একদম শেষ করেছো আমায়।

বলেই রাইসা দৌড়ে চলে গেলো।রাইসার পেছন পেছন নীলাভের ফুফু ও গেলো।নীলাভ সেদিকে পাত্তা দিলো না।কিন্তু প্রীতি একদম অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে এখনো রাইসার যাওয়ার পথে।রাইসার শেষ কথাটায় প্রীতির বুকটা কেমন ছেত করে উঠেছিলো।

রাইসা মেয়েটা দেখতে শুনতে খারাপ না।উচা লম্বা বডি সবদিক থেকেই সুন্দর। কিন্তু বয়স ভালোই হয়েছে তা বুঝা যায়।

নীলা চৌধুরী এসে খাবার দিয়ে গেলেন আর নীলাভকে বললেন প্রীতিকে খাইয়ে দিতে তার এখন অনেক কাজ তা না হলে তিনি নিজেই প্রীতিকে খাইয়ে দিতেন।নীলাভ ভাত মেখে এক লোকমা প্রীতির মুখের সামনে ধরলো।প্রীতি ঝড়ের বেগে খেয়ে নিলো।তার খুব খিদে পেয়েছিলো।খেতে খেতেই প্রীতি ঘুরে বসে এবার নীলাভের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

-এই আপুটার নাম কি?

নীলাভ-রাইসা।

প্রীতি মুখ গোল করে বলল,

-ওওও,আচ্ছা আপুটা আমার থেকে বড় তাই না?

নীলাভ ভাত মেখে বলে উঠলো,

-শুধু বড় না অনেক বড়।আমার থেকে মাত্র এক বছরের ছোট তাহলে তোমার থেকে মিনিমাম পাচ ছয় বছরের বড় হবে।

প্রীতির মুখটা আপনা আপনি হা হয়ে গেলো।নীলাভ প্রীতির মুখে ভাত ঢুকিয়ে দিলো।প্রীতি খেতে খেতে আবার বলল,

-দেখে বুঝা যায় না।

নীলাভ -দিনে দু বেলা পার্লারে গেলে কাউকেই দেখা বুঝা যাবে না।

প্রীতি ফিক করে হেসে দিলো।বেশ কিছুক্ষন নীলাভের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ নীলাভের গাল টা টেনে বলে উঠলো,

-আমার বর।

নীলাভ চকিতেই তাকালো প্রীতির দিকে। ‘আমার বর’ এই একটা শব্দে কতটা অধিকার মিশে রয়েছে কতটা ভালোবাসা মিশে রয়েছে ভাবতেই নীলাভের বুকে নদীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে।নীলাভ একটু মুচকি হেসে বলে উঠলো,

-আমি তো তোমারই বর।আর তুমি আমার বউ…শুধু আমার… নীলাভের বউ তুমি।মিসেস নীলাভ চৌধুরী…

প্রীতি একটা চমৎকার হাসি দিলো।যেই হাসিতে রয়েছে এক রাশ সুখ তৃপ্ততা আর ভালোবাসা।

____________________________

-আমার বুকে আগুন জ্বালিয়ে তোমরা এখানে সুখ করবে ভালোবাসা করবে?কক্ষনো না।আমি এটা কক্ষনো হতে দিবো না।জ্বালিয়ে দেবো ছাড়খার করে দিবো।যা আমি পাই নি।তার সুখ তোমাকেও পেতে দেবো না প্রীতি। দেখে নিও…

___________________________

সকালে প্রীতি নীলাভের বুকে নিজেকে আবিষ্কার করলো।কাল রাতে প্রীতি ওভাবেই ঘুমিয়ে গেছে।শরীর অনেক ক্লান্ত ছিলো।

এখন ভোর ছয়টা বাজে।গ্রামের বাড়িতে ভোর ছয়টাই অনেক।প্রীতি নীলাভকে আস্তে করে ধাক্কা দিলো।সাথে সাথে নীলাভ চোখে খুলে মুচকি হেসে আচমকা বলে উঠলো,

-রাতে বাসর ও করতে দেও নি।ফাকি দিয়ে ঘুমিয়ে গেছো।এখন কি আমাকে একটু ঘুমাতে দেবে না?

প্রীতি নীলাভের বাহুতে হালকা চর মেরে বলে উঠলো,

-আমি উঠবো।গোসল করবো।কিন্তু আমি তো চিনি না এখানে ওয়াশরুম কোথায়?

নীলাভ -কেনো আমাদের ঘরে তো এটাচ ওয়াশরুম আছে।কেনো তুমি দেখোনি?

প্রীতি -ওহ হো নাতো।আমি আরো ভাবলাম।গ্রামের বাড়িতে তো কলপাড় থাকে।তাই আপনাকে জাগালাম।সরি আপনি ঘুমান।

নীলাভ -তুমিও ঘুমাও।

নীলাভ যেই প্রীতিকে টান দিতে যাবে।ওমনি প্রীতি খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল,

-পাজি গোমড়ামুখো।

বলেই ওয়াশরুমে চলে গেলো।আর নীলাভ কম্বল মুরি দিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো।
#হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি 💕
The_unexpected_love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-30

প্রীতি গিয়ে একবার রান্না ঘরে উকি মারলো।নীলা চৌধুরী কাজ করছে।প্রীতি নীলা চৌধুরীকে দেখে রান্না ঘরে হাসি মুখে এগিয়ে গেলো।নীলা চৌধুরীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,

-ভালো আন্টি…..

নীলা চৌধুরী প্রথমে খুশি হলেও পরে থমথমে গলায় বললেন,

-ভালো আন্টি না ডেকে ভালো মা ডাকলে মনে হয় আমি বেশি খুশি হতাম।

প্রীতি নীলা চৌধুরীকে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হালকা চিৎকার করে বলে উঠলো,

-ভালো মা।

প্রীতি চিল্লিয়ে নিজের মুখে নিজেই হাত দিলো।নীলা চৌধুরী ও ফিসফিস করে বলে উঠলেন,

-আস্তে আস্তে।এটা গ্রাম। বাড়িতে গিয়ে চিল্লাচিল্লি করিস এখানে চিল্লাচিল্লি করলে লোকে খারাপ বলবে, মা।বুঝেছিস?

প্রীতিও ফিসফিস করে নীলা চৌধুরীর কানে কানে গিয়ে বলল,

-বুঝেছি।এখন বলো আমি কি রান্না করবো?কিন্তু আগেই বলছি আমি কিন্তু কিছুই পারি না।সব আমায় দেখিয়ে দিতে হবে।

নীলা চৌধুরী প্রীতির গালে হাত রেখে মুচকি হেসে বলে উঠলেন,

-তোকে কিছুই করতে হবে না মা।তুই অনেক ভালো।তোকে দেখে কেউ বলবেই না যে তুই নতুন বউ।আমি আমার ছেলের জন্য একদম ঠিক পাত্রী পছন্দ করেছি।খাটি হিরা নিয়ে এসেছি আমি।

প্রীতি নীলা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,

-আর আমি যে এতো ভালো মা পেয়েছি।আমিও তো বুঝতেই পারছি না যে আমি শশুড় বাড়ি এসেছি।এবার তুমি বলো আমি কি রান্না করবো?

নীলা চৌধুরী থালা বাসন ঠিক করতে করতে বললেন,

-আরে বাবা তোকে কিচ্ছু করতে হবে না।আমি কাজ করি তুই দেখ।

রান্না ঘরে নীলাভের ফুফু প্রবেশ করলেন।নীলা চৌধুরীর কথা শুনে ফেললেন।তিনি বলে উঠলেন,

-এ কি করছো নীলা।তুমি জানো না নতুন বউয়ের প্রথম দিন পায়েস রাধতে হয়?এটা নিয়ম।

নীলা চৌধুরী চমকে ননাসের দিকে তাকালেন।অপরাধী সুরে বলে উঠলেন,

-ভুল হয়ে গেছে আপা।কিন্তু প্রীতি তো এসবে অভ্যস্ত…

নীলাভের ফুফি নীলা চৌধুরীর কথা না শুনে প্রীতির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলেন,

-তুমি পারবে না মা পায়েস রাধতে?আমি তোমাকে বলে দেবো কীভাবে রাধতে হয়।

প্রীতি মুচকি হেসে বলে উঠলো,

-আমি পারবো ফুফি তুমি চিন্তা করো না।ভালো মা, ভেবো না আমি পারবো।আমাকে একটু দেখিয়ে দিলেই আমি পারবো।

নীলাভের ফুফি প্রীতিকে সব বুঝিয়ে দিলো কীভাবে পায়েস রাধতে হয়।
কিন্তু বাধ সাজলো রান্না উনুনে করতে হবে।প্রীতি উনুন চেনে ঠিক ই কিন্তু এটা কীভাবে জ্বালাতে হয় তা জানা নেই।নীলাভের ফুফি রহিমা খালাকে হাক ছেড়ে ডেকে উঠে বললেন,

-উনুন টা জ্বালিয়ে দিতে।

উনুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পর ই নীলাভের ফুফি প্রীতির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। প্রীতি পায়েস রাধতে বসলো।

,

পায়েস রাধা শেষ করে প্রীতি বুঝতে পারছে না।এখন কি করবে? উনুন টা বন্ধ করবে কীভাবে?বাড়িতে তো এভাবেই তার মা রান্না করে।গ্যাসের চুলা টা অফ করে হাড়ি নামিয়ে ফেলে।কিন্তু এখানে কিভাবে করবে?প্রীতি ভাবছে।অনেক ভাবছে।তবুও কিছু বুঝতে পারছে না।

শেষে পায়েস প্রায় পুড়তে শুরু করলে প্রীতি আর কূলকিনারা না পেয়ে হাত দিয়েই হাড়ি টা নামিয়ে ফেলতে ধরলো।

প্রীতি হাত থেকে হাড়ি টা ঠাস করে মাটিতে ছেড়ে দিলো।অল্প একটু পায়েস ছিটকে গেলো।প্রীতির হাত অসম্ভব জ্বালা করছে মনে হচ্ছে কেউ মরিচ ডলে দিয়েছে।প্রীতি হাত দুটো সামনে এনে দেখলো হাতের তিন তিনে ছয়টি আঙ্গুল লাল টকটকে হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে রক্তরা ফেটে বের হতে চাইছে।

পাশেই বাটিতে পানি দেখতে পেয়ে প্রীতি তাতে হাত ডুবালো।

প্রীতি ঠোঁট চেপে রয়েছে।কাদতে চাইছে না ও একটুও। কিন্তু আপনা আপনি চোখ থেকে পানি পড়ছে।প্রীতি অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখে নীলা চৌধুরীকে ডাক দিলো।হাত দুটো শাড়ির আচলের নিচে লুকিয়ে রাখলো যাতে কেউ কিছু না বুঝতে পারে।

নীলা চৌধুরী প্রীতির ডাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন যেনো তিনি প্রীতির ডাকের অপেক্ষায় ই ছিলেন।

নীলা চৌধুরী প্রীতির পাশে বসলেন।প্রীতি অনেক কষ্টে মুচকি হাসলো।নীলা চৌধুরী প্রীতির দিকে তাকিয়ে থমথমে মুখে বলে উঠলেন,

-কি রে মা শরীর খারাপ লাগছে?

প্রীতি মাথা নাড়ালো যার অর্থ না।নীলা চৌধুরী আবারও বলে উঠলেন,

-তাহলে কি শাড়ি পড়ে কষ্ট হচ্ছে?

প্রীতি নীলা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠলো,

-অভ্যাস নেই তো ভালো মা।তাই একটু কষ্ট হচ্ছে।চিন্তা কর না ঠিক হয়ে যাবে।

নীলা চৌধুরী প্রীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ পড়লো পায়েসের দিকে।তিনি খুশি হয়ে বললেন,

-পায়েস বানানো শেষ?

প্রীতি একবার পায়েসের দিকে চেয়ে বলে উঠলো,

-হমম শেষ।

নীলা চৌধুরী পায়েস টাকে কাছে নিয়ে এসে বললেন,

– বাহ!অনেক সুন্দর গন্ধ আসছে তো।

নীলা চৌধুরী এবার একটু চেখে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলেন,

-উমমম…এতো সুন্দর পায়েস তো আমিও বানাতে পারি না আর তুই কীভাবে বানালি তাও প্রথমবার?

প্রীতি -আমার হাতের প্রথম রান্না যদি খেতে পচা হতো তাহলে আমি আর জীবনেও রান্না করতাম নাহ।

নীলা চৌধুরী প্রীতির হাত ধরে বলে উঠলেন,

-আচ্ছা চল সবাইকে তাহলে পরিবেশন করে দিবি।

প্রীতি ব্যাথায় কুকড়িয়ে উঠলো। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে রাখলো।চোখের কোনা দিয়ে টপ করে এক ফোটা জল পড়লো।তবুও মুখ দিয়ে একটু ও টু শব্দ করলো না।হাতে ওর ফোসকা পড়ে গেছে।প্রীতি জোরপূর্বক হেসে নীলা চৌধুরীর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠলো,

-ভালো মা।তুমি একটু পায়েস টা পরিবেশন করে দিবে প্লিজ?তুমি তো জানোই আমি এসবে অভ্যস্ত নই যদি আবার উলটা পালটা কিছু করে ফেলি?বাড়ি গিয়ে সব কিছু তোমার কাছে থেকে শিখে নিবো নি?

নীলা চৌধুরী প্রীতির গালে হাত রেখে মিস্টি হেসে বললেন,

-আচ্ছা আমি ই সবাইকে পরিবেশন করে দিচ্ছি। তুই যে রাধতে পেরেছিস এটাই অনেক।তুই তাহপল এক কাজ কর নীলাভকে ডেকে তুল।

প্রীতি সায় দিলো।নীলা চৌধুরী চলে গেলে প্রীতিও নিজের ঘরে গেলো।নীলাভ এখনো ঘুমুচ্ছে।মনে হচ্ছে ৩-৪ রাতের ঘুম আজ ই ঘুমাচ্ছে।

প্রীতি পা টিপেটিপে রুমে ঢুকে নিজের ব্যাগ থেকে মলম টা বের করলো।তারপর আস্তে করে হাতে লাগালো আর বারবার ফু দিতে লাগলো।প্রীতি নীলাভের ঘুমন্ত মুখের দিকে একবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।

প্রীতির অনেক জ্বলছে।নীলাভকে কিছু বলতে পারছে না।নীলাভকে বললে নীলাভ এখনি সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে।কেনো প্রীতিকে রান্না ঘরে যেতে দেওয়া হলো?কেনো প্রীতিকে দিয়ে কাজ করানো হলো?তাই প্রীতি ঝামেলা করতে চাইছে না।

প্রীতি আস্তে আস্তে গিয়ে চুপচাপ গুটিসুটি মেরে নীলাভের পাশে গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো।আস্তে আস্তে প্রীতি নীলাভের বুকে মুখ ডুবালো।

হাতের জ্বালাটা থাকলেও মনের ব্যাথা টা যেনো কমেছে।অনেক শান্তি লাগছে এবার।বেশ ভালো লাগছে নীলাভের বুকে।মনে হচ্ছে দুনিয়ায় সব সুখ আল্লাহ স্বামীর বুকে ঢেলে দিয়েছেন।প্রীতি পাচ মিনিট শুয়ে থেকে যেই উঠতে যাবে।ওমনি নীলাভ আষ্ঠেপৃষ্ঠে প্রীতিকে জড়িয়ে ধরলো।প্রীতি নীলাভের মুখের দিকে তাকালো।নীলাভ মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে।প্রীতি একবার নিজের হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে আবার নীলাভের দিকে তাকালো।তারপর চুপচাপ নীলাভের বুকে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো।

নীলাভ ও প্রীতিকে পরম আদরে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।

,

প্রায় দশ মিনিট পর প্রীতি আস্তে করে বলে উঠলো,

-আটটা বাজে উঠুন।

নীলাভ চোখ খুলে বলল,

-অনেক বেজে গেছে।

প্রীতি -হমম।ছাড়ুন। আমি উঠবো।আপনি ফ্রেস হয়ে আসুন…

নীলাভ -আচ্ছা যাও তাহলে।

প্রীতি উঠতে নিলেই নীলাভ আবার আটকে প্রীতির ঠোটের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঠোঁটের উপরে পরপর তিনটে চুমু দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

-এবার যাও।

প্রীতি চোখ বড় বড় করে নীলাভের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো যে কি হল? ওর মতিষ্কে টনক নড়তেই ভো দৌড় দিয়ে চলে গেলো।

_______________________________

প্রীতি হলুদ বাটবে।
এ বাড়ির নিয়ম নতুন বউকে হলুদ বাটতে হয়।প্রীতি আগে কখনো এমন জিনিস দেখেই নি।শিল পাটা কি তা ওর মস্তিষ্ক চেনা না।ও তো বাড়িতে ব্লেন্ডার মেশিন দেখেছে।যেখানে ওর মা ভাবী মসলা বাটতো।

প্রীতিকে মসলা বাটতে হবে দেখে নীলা চৌধুরি থমথমে মুখ করে রেখেছেন।তিনি প্রীতির বাবাকে কথা দিয়ে এসেছিলেন যে প্রীতিকে বাড়ির মেয়ে করে নিয়ে যাচ্ছেন বউ করে নয়।আর এদিকে প্রীতিকে কত খাটুনি খাটতে হচ্ছে।নীলা চৌধুরীর কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

তিনি প্রীতিকে এবার বেটে দেখিয়ে দিলেন।প্রীতিও নীলা চৌধুরীর দেখা দেখি বাটতে শুরু করল।কিন্তু একবার শিল পিছলে এদিক যাচ্ছে তো একবার ওদিক যাচ্ছে।প্রীতি কিছুতেই বাটতে পারছে না।হাতে ব্যালেন্স থাকছেই না।নীলা চৌধুরী বার কয়েক দেখিয়ে দেওয়ার পর প্রীতি সক্ষম হলো।কোনো কাজ দু তিনবার দেখিয়ে দিলেই সেটা প্রীতি পারে।প্রীতি হলুদ বাটা শুরু করলো।

নীলা চৌধুরী প্রীতি কপালে চুমু দিয়ে নিজের চোখ মুছলেন।প্রীতিকে এভাবে কাজ করতে দেখতে তার একটু ও ভালো লাগছে না।এসব যদি নীলাভ জানে তাহলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।

প্রীতি নীলা চৌধুরীর দিকে মিস্টি হেসে বলে উঠলো,

-ভালো মা।তুমি এবার গিয়ে একটু রেস্ট নেও।অনেক কাজ করেছো সকাল থেকে তুমি।আমি এখন পারবো।

নীলা চৌধুরী প্রীতির গালে হাত দিয়ে বলে উঠলেন,

-আমাকে ক্ষমা করে দিস মা।

সাথে সাথে প্রীতি নীলা চৌধুরীকে নিজের কনুই দিয়ে নীলা চৌধুরীকে ধরে বলল,

-ছি! ছি! এসব কি বলছো?তুমি আমার মা।তুমি ক্ষমা কেনো চাচ্ছো?তাছাড়া এটা তো আমার সংসার।

নীলা চৌধুরী প্রীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-হম এটা তোর সংসার মা।সুখী হো তুই।

প্রীতি নীলা চৌধুরীকে জোর করে পাঠিয়ে দিলো।

পুরো রান্না ঘরে এখন ও একা। কেউ নেই।প্রীতি একবার নিজের হাতের দিকে তাকালো।হাত টা অসম্ভব লাল হয়ে গেছে।ফোসকা গুলো মলম দেওয়ার ঘন্টা খানিকের মধ্যেই অনেকটা মিলিয়ে গেছে।কিন্তু হাতের আঙ্গুল গুলো লাল হয়ে আছে।তার মধ্যে আজ প্রথম প্রীতি হলুদ বাটছে।ওর তো রীতিমতো হাত ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে এখন হাতের তালুতেও ফোসকা পড়বে।

,

প্রীতি একা একা গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে কাজ করছে।এর মাঝেই ও কারোর উপস্থিতি টের পেলো।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই রাইসাকে দেখতে পেলে প্রীতি।

প্রীতি প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও এবার জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলো,

-কিছু চাই আপু?

রাইসা একটা আপেল নিয়ে খেতে খেতে বলল,

-চাই তো অনেক কিছুই কিন্তু তুমি কি দিতে পারবে?

প্রীতি আবারো হেসে জবাব দিলো,

-আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে তো আমি অবশ্যই দিবো আপু।কিন্তু তুমি যদি এমন জিনিস চাও যেটা ছাড়া আমি ই নিজেই থাকতে পারবো না বাচতে পারবো না সেটা তো আর তোমাকে দিতে পারবো না তাই না।

প্রীতি আবারো হলুদ বাটায় মনোযোগ দিলো।রাইসা পাটার পাশে হাত ঘুরাতে ঘুরাতে হঠাৎ বলে উঠলো,

-তোমাদের মধ্যে কি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে?

প্রীতি বাটা থামিয়ে দিয়ে চকিতেই অদ্ভুত ভাবে তাকালো।রাইসার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-দুজন দুজকে ভালোবাসি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ার জন্য এটাই যথেষ্ট নয় কি?

রাইসা বাকা হেসে বলে,

-তার মানে বলতে চাইছো তোমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় নি?

চলবে❤️
চলবে🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here