#হঠাৎ_হাওয়া
#সুমনা_ইসলাম
#পর্বঃ০৭
রিকশা চলছে ধীরগতিতে। ফারহান আর নিরু বিভিন্ন কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে আছে দুজনেরই। আর দূর থেকে একজন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তার রাগ ওদের প্রতি নয় বরং নিজের প্রতি।
ওরা চোখের আড়াল হতেই ব্যক্তিটিও সেখান থেকে সরে গেল।
দশ মিনিট বাদেই নিরু আর ফারহান বাসায় ফিরে এল। ফ্রেশ হয়ে দুজনেই মায়ের সাথে বসে লাঞ্চ করে নিল। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ফারহান অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। আর নিরু রুমে বসে আছে। ওর শাশুড়ি ঘুমিয়েছেন।
ফারহান বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনো রিকশা না পেয়ে হাঁটতে লাগলো। দুপুরবেলা তাই রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। দু’মিনিট হাঁটতেই একটা মেয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। ফারহানের মেয়েটাকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না।
মেয়েটা একটু হেসে বললো, “কেমন আছেন?”
ফারহান কপাল কুচকে বললো, “আপনি?”
“ওহ, চিনতে পারলেন না? অবশ্য মনে রাখার মতোই কেউ নই আমি। যাইহোক পরিচয়টাই না-হয় আগে দিয়ে নিই। আমি শ্রাবণী।”
ফারহান এবার বুঝতে পারলো মেয়েটা কে। এই তো সেই শ্রাবণী যার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তখন দু-এক বার দেখা হয়েছিল তাই চেহারাটা তেমন মনে নেই। নামও তো ঠিকভাবে মনে ছিল না। এখন শুনে মনে পড়েছে।
ফারহান সৌজন্যমূলক হেসে বললো, “জ্বি, চিনতে পেরেছি।”
“কেমন আছেন বললেন না কিন্তু।”
“এইতো বেশ ভালো। আপনি?”
“ভালো। আসলে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।”
ফারহান অবাক হয়ে বললো, “ক্ষমা! কিন্তু কেন?”
মেয়েটা মুখে কাচুমাচু ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো, “আসলে আমার তখন তেমনটা করা উচিত হয়নি। আসলে আবেগের বশে কী করেছিলাম ততোটা ভেবে করিনি। আমার আপনাদের সম্মানের কথা ভাবা উচিত ছিল।”
“সেসব আমি অনেক আগেই ভুলে গেছি। আর এতদিন পর এসব কথা তুলে তো কোনো লাভ নেই তাই না? আর এভাবে কথা বলাটা ভালো দেখাচ্ছে না। আমি অফিসে যাচ্ছি। হাতে সময় বেশি নেই। আসছি। ভালো থাকবেন।”
ফারহান যাওয়ার আগেই শ্রাবণী বললো, “শুনলাম বিয়ে করেছেন।”
ফারহান হাসিমুখে বললো, “হ্যাঁ, এইতো সপ্তাহখানেক হলো।”
“ওহ, আচ্ছা। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে। যান।”
“হুম।” বলেই ফারহান হাঁটতে শুরু করলো। শ্রাবণীর সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার নেই এখন।
ফারহান চলে যেতেই শ্রাবণী রাগে ফেটে পড়লো। রাগে নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। মনে মনে বলছে, “সব হয়েছে আমার দোষে। সব ভেবে চিন্তে পালানো উচিত ছিল। আজকে ওই মেয়েটা যে পরিমাণ সুখে আছে সেরকমই সুখে থাকতে পারতাম আমি। অভাবের মধ্যে থাকতে হতো না ওই ছোটলোকটার কাছে। যে আমার চাহিদা পূরণ করতে পারে না তার সাথে কি-না পালিয়ে গিয়েছিলাম। আবারো সব ঠিক করার একটা উপায় তো বের করতেই হবে। এই সংসার আমার করে নেব আমি। যেকোনো মূল্যেই হোক।” একটা শয়তানি হাসি দিয়েই সেখান থেকে চলে গেল সে।
__________________
সন্ধ্যার পরপরই পড়ার টেবিলে বসে ফারহানের কথা ভাবছে নিরু। সারাক্ষণ শুধু তার চিন্তাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ফারহানের সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ছে নিরুর।
সেদিন যখন ফারহানরা তাকে দেখতে গিয়েছিল সেদিন তো নিরু একদম জড়সড় হয়েই ছিল। প্রচন্ড নার্ভাস ছিল। ফারহানের দিকে তো প্রথমে ভালোভাবে তাকায়ই নি। কিন্তু যখন তাদের একটু আলাদা করে কথা বলতে দেওয়া হয় তখন দেখেছিল। ফারহান মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। আর নিরু মাথাটা নিচু করে ছিল। একবার দেখাতেও তার মুখটাই শুধু চোখের সামনে ভাসছিল। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ তবুও যেন চোখ ফেরানো দায়। নিরুও যে একদম আহামরি ফর্সা এমনটা কিন্তু নয়। তবে চেহারার গঠন মাশা আল্লাহ।
“নিরু?”
ফারহানের ডাকে নিরু ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। এতক্ষণ আনমনা হয়ে ভাবছিল তাই খেয়ালই করেনি যে ফারহান এসেছে।
ফারহান টাই খুলতে খুলতে বললো, “কী এত ভাবছিলে?”
“আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা। ওহ না। আপনি তো আমাকে আগেই দেখেছিলেন। আমি যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছি সেই দিনটার কথা ভাবছিলাম।”
“এত ভাবছো আমাকে নিয়ে! আবার প্রেমে টেমে পড়ে যাও নি তো?”
“আপনি যান আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। শুধুশুধুই কীসব কথা বলছেন।”
ফারহান ভ্রু উঁচিয়ে বললো, “শুধুশুধু বললাম না-কি? আমার তো তাই মনে হলো। না-হয় তো তুমি সোজাসুজিই না বলে দিতে তাইনা?”
নিরু রুমের বাইরে যেতে যেতে বললো, “আমি চা নিয়ে আসছি আপনার জন্য।”
ফারহান একটু জোড়েই ডাকলো, “নিরু?”
নিরু পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো, “কী?”
“এখন আর চা এনো না। আসার সময় পাশের দোকান থেকে চা খেয়ে এসেছি।”
“ওহ, আচ্ছা। তাহলে আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। ঘেমে গেছেন। ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই?”
“উঁহু, সেরকম কিছু নয়। অভ্যাস হয়ে গেছে। তোমার পড়া থাকলে পড়তে বসো।”
“না কোনো পড়া নেই। আজকেই তো ফার্স্ট ক্লাস ছিল। আমি বারান্দায় যাচ্ছি। ভালোই হাওয়া দিচ্ছে।”
“হুম, যাও। আসছি।”
ফারহান ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে নিরুর পাশে দাঁড়ালো। সে মনে মনে ভাবছে, “আজকে শ্রাবণীর সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টা কী নিরুকে জানানো উচিত? ও যদি বিষয়টা অন্যভাবে নেয়? আর কেমন ভাবেই বা নিবে? উনার সাথে তো আর আমার এতদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না। বলেই ফেলি। কিচ্ছু লুকাবো না।”
ফারহান সোজাসুজি বলে দিল, “আজকে রাস্তায় শ্রাবণীর সাথে দেখা হয়েছিল।”
নিরু ভ্রু কুচকে বললো, “কোন শ্রাবণী?”
“যার সাথে প্রথমে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার নাম শ্রাবণী। কাল নামটা ঠিকভাবে মনে ছিল না তাই বলতে পারিনি।”
“ওহ। কী বললো?”
ফারহান শুরু থেকে সবটা নিরুকে বললো।
সব শুনে নিরু বললো, “ওহ, তাহলে উনি উনার ভুলটা বুজতে পেরেছে এতদিনে?”
ফারহান মেকি হেসে বললো, “তার ভুলটা এখন আমার কাছে ঠিকই মনে হয়। পালিয়ে গিয়ে ঠিকই করেছিল। পালিয়ে গেল বলেই তো তোমাকে বিয়ে করতে পারলাম। না পালালে কী আর এই সুযোগটা আসতো?”
নিরু কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু হাসলো।
__________________
পরেরদিন শুক্রবার। নিরু আর ফারহান আজ বাড়িতেই আছে। তবে ফারহানের মা-বাবা আজ গ্রামের বাড়িতে যাবেন। ওনাদের ইচ্ছা ছিল ছেলের বিয়ের পর ক’টাদিন গিয়ে থেকে আসবেন নিজেদের আপন ঠিকানায়। বহুদিন ধরে শহরে থাকলেও মাটির টান কী আর ভোলা যায়? তাইতো সকালে উঠেই গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে নিরুর শাশুড়ি। নিরুও তাকে হাতেহাতে সাহায্য করছে। গোছগাছ প্রায় শেষের দিকেই। ফারহান গেছে একটা সিএনজি ডাকতে।
সকাল এগারোটার দিকে রওনা হলেন তারা। যাওয়ার সময় নিরুর শাশুড়ি ওকে বলে গেছে, “তোমাকে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। সংসার তো এখন তোমারই। আমরা আর ক’দিনই বা বাঁচবো। সংসার এখন থেকে তোমাকেই সামলাতে হবে। নিজের আর আমার ছেলের খেয়াল রেখো। আমরা কিছুদিন পরেই ফিরে আসবো। ভালো থেকো।”
নিরুও হাসিমুখে জানিয়েছে, “সবকিছুরই খেয়াল রাখবো মা। আপনারা দেখে শুনে যাবেন আর পৌঁছানোর পর একটু কল করে জানিয়ে দিয়েন।”
_________________
বিকালে ড্রয়িংরুমে বসে নিরু আর ফারহান সিনেমা দেখছে। পুরো বাড়িতে ওরা ছাড়া আর কেউ নেই। ফারহান টিভির দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিরুর দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে আছে। এই একবার হাত ধরছে তো আবার চুল ধরে এলোমেলো করে দিচ্ছে।
ফারহান আবারো চুলে হাত দিতেই নিরু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আপনি কী করছেন বলুন তো?”
ফারহান সোজাসাপ্টা ভাবে উত্তর দিল, “আমি আমার বউয়ের চুল ধরছি।”
“আবার এলোমেলো করছেন কেন?”
“একটু এলোমেলো করলে কিচ্ছু হবে না। এক মিনিট। তুমি বসো। আমি তোমার মাথায় তেল দিয়ে দেবো।”
“তেল দিতে ভালো লাগে না আমার।”
“ভালো না লাগলেও দিতে হবে। আমি দিয়ে দেবো। নাহলে দেখবে চুল পড়ে পড়ে মাথা টাক হয়ে যাবে।”
“হবে না।”
ফারহান নিরুর আর কোনো কথা না শুনেই তেল আনতে রুমে চলে গেল। তেল এনে নিরুর মাথায় লাগিয়ে দিয়ে একটি বিনুনি করে দিল।
বিনুনিটা দেখে নিরু অবাক স্বরে বললো, “আপনি আবার বিনুনিও করতে পারেন?”
ফারহান একটু ভাব নিয়ে বললো, “অবশ্যই পারি।”
“শিখলেন কীভাবে? মানে ছেলেরা তো সচরাচর বিনুনি করতে পারে না।”
“মাকে দুই-তিন বার করে দিয়েছিলাম তাই মনে আছে।”
“ওহ।”
“হুম, চলো ছাদে যাই। বসে বসে আর ভালো লাগছে না।”
“আচ্ছা চলুন।”
নিরু আর ফারহান ছাদে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো৷ দুজনের দৃষ্টিই নিচের দিকে। তবে কেউ কোনো কথা বলছে না।
হঠাৎ নিরু নিচের রাস্তায় থাকা গাছের আড়াল থেকে একজনকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অতিদ্রুত ফারহানকে বললো, “দেখুন, ওখানে কে যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।”
ফারহান নিরুর কথা মতো সেদিকে তাকানোর আগই সেই লোকটা উধাও হয়ে গেল।
ফারহান কাউকে দেখতে না পেয়ে বললো, “কই? কেউ নেই তো। তুমি হয়তো ভুল দেখেছো।”
নিরুর স্পষ্ট মনে আছে সে কাউকে দেখেছিল তবে পরেরবার আর না দেখতে পেয়ে তেমন কিছু ভাবলো না। রাস্তায় কত মানুষই তো দাঁড়াতে পারে।
নিরু সেই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বললো, “আচ্ছা ছাদে কোনো ফুলগাছ নেই কেন?”
“পরিচর্যা করার মানুষ নেই তাই ফুলগাছ লাগানো হয়নি। তুমি চাইলে এনে দিতে পারি।”
নিরু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, “আচ্ছা, তাহলে এরপরের দিন অফিস থেকে আসার সময় নিয়ে আসবেন।”
ফারহানও মৃদু হেসে সায় জানালো।
সন্ধ্যার খানিকক্ষণ আগেই ওরা নিচে নেমে এলো। আর ছাদে থাকতে ভালো লাগছিল না। কেমন যেন গুমোট ভাব চারদিকে। হয়তো রাতে বৃষ্টি হতে পারে।
ফারহান একটু বাইরে গেছে। বলেছে সন্ধ্যার একটু পরেই ফিরে আসবে। তাই নিরু রান্নাঘরে গেছে রাতের খাবার রান্না করতে। হঠাৎ ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসায় চেয়ারের উপরেই রেখে দিল ফোনটা। এভাবে বারবার কল আসায় একবার রিসিভই করে ফেললো।
নিরুকে কিছু বলতে না দিয়েই ওপাশ থেকে একজন পুরুষালী কণ্ঠে বললো, “ফোন ধরতে এত লেট করছিলে কেন সোনা?”
নিরু রেগে গিয়ে বললো, “কে আপনি? এইসব কী ধরনের কথা বলছেন?”
ওপাশ থেকে মৃদু হাসির স্বর ভেসে এলো। “আমাকে চিনতে পারছো না তুমি? তাহলে তো খুব শীঘ্রই চেনানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”
সাথেসাথেই ওপাশ থেকে কল কেটে গেল।
নিরু চিন্তিত হয়ে রইলো। কে কল করেছিল? লোকটা কে? আর এমন সব কথাই বা বলছিল কেন?
#চলবে__??
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করে পাশে থাকবেন।]