হৃদমাঝারে পর্ব -২০

#হৃদমাঝারে -[২০]

প্রায় অনেক্ষন ধরে অফিসার শিমুলকে দেখা যাচ্ছে না। মুন এদিক ওদিক খুজেও পেলো না তাকে। বাধ্য হয়েই ফারহানকে জিগ্যেস করা হলো। মাথা গম্ভীর গলায় বলল, একটু অপেক্ষা করো দেখতে পারবে। ফারহানের গলার গম্ভীরতার কারন বুঝতে পারলো না মুন। তবে এটা লক্ষ করেছে ফারহান বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ চুপচাপ বসে আছে। আড় চোখে মুনকে দেখে যাচ্ছে। ব্যাপারটা প্রথমে পাত্তা না দিলেও এখন মুন ফারহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

– আপনি ঠিক আছেন? ফারহানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো মুন। প্রতিউত্তরে ফারহান মুনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে বলে, আমার আবার কি হবে? ঠিক আছি আমি। মুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফারহান থানার ভিতরে অন্য একটা রুমে ডুকে গেলো। চেয়ার টেনে বসে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে বড় বড় করে শ্বাস নিতে লাগলো সে। এইভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর আবার উঠে দাঁড়ায় ফারহান। দরজার সামনে এসে মুনের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলে,

– আমি তোমার চোখে চোখ রাখতে পারছি না মেহরিমা। অপরাধবোধে আমার ভিতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমি ভুল করেছি, হ্যাঁ আমি অন্যায় করেছি তোমাকে বিশ্বাস না করে। তুমি ক্ষমা করবে তো আমায়।

শিমুলকে দেখতে পেয়ে মুন দ্রুত ওর সামনে আসার জন্যে পা বাড়ায়। কিন্তু পরক্ষণেই তার পা থমকে যায়। শিমুলের পিছনে আসা লোকটা দেখে চমকে উঠে মুন। মিঠু এতক্ষণ চুপচাপ বসে সবটা দেখলও এবার আগন্তুককে দেখা মাত্রই সেও উঠে দাঁড়ায়। তারপর তার সমনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

– একি রনি ভাইয়া! তোমাকে কেন পুলিশ এরেস্ট করলো? কি করেছো তুমি?

মিঠুর প্রশ্নের জবাবে রনি কিছু বলেনা শিতল দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে মুনের দিকে। মুনের চোখ-মুখে এখনো বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। ওর কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না রনিকে পুলিশ কেন গ্রেফতার করেছে। তখনি এখানে আসলো ফারহান। ফারহানকে দেখে রনি মাথা নিচু করে নিলো। আর ফারহান রনির দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। শিমুল কনেস্টবলকে নির্দেশ করলো রনিকে লকাপে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। শিমুলের কথায় কনেস্টবল রনিকে লকাপে নিয়ে যায়। মুন আর মিঠু এখনো বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিমুলের দিকে। মিঠু আর অপেক্ষা করতেই পারলো না সে শিমুলকে জিগ্যেস করলো,

– রনি ভাইয়া কি করেছে অফিসার? তাকে কেন এরেস্ট করেছেন?

– রনি ছিলো তোমার বাবার ডান হাত। শিমুল ফারহানের দিকে ঘুরে তাকায়। তারপর গলার স্বর শক্ত করে বলে, সিনিয়র পুলিশ কমিশনার ফাহাদ শিকদারের খুনি। যদিও সে খুনটা করেছিলো তোমার বাবার কথাতেই।

শিমুলের কথা শুনে মিঠু আর মুন দুজনেই চমকে উঠে। আর বাকি সবার মুখটা স্বাভাবিক। তারা হয়তো আগে থেকেই সবটা জানে। মুন মাথা ঘুরিয়ে ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহান এখনো শ্রীঘরের দিকে তাকিয়ে আছে।

১৪,
সেদিনের পর কেটে গেছে প্রায় এক মাস। এই এক মাস ফারহান মুন এনআর নার্সিংহোমকে ঘিরে ব্যাস্ত ছিলো। ডক্টর ইমরান খান আর তার দুই সহযোগী এবং রনিকে হাইকোটে তুলা হয়। সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ইমরান খান ও তার দুই সহযোগীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও রনিকে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা ধরে ছয় বছর জেল দেয়। সেদিন রনির স্ত্রী অনন্যা রনির বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষী প্রদান করে। এনআর নার্সিংহোম এখন পুলিশের দখলে। কেউ নার্সিংহোমের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। অগত্যা মুনের এখন কাজ বন্ধ। সে ট্রাই করছিলো অন্য কোন নার্সিংহোমে জয়েন করার জন্যে কিন্তু অর্ণার জন্যে পারে নি। সামনেই অর্ণার বিয়ে। তাই সে বলেছে এতদিন তো নিজের সাথে অনেক লড়াই করেছিস এবার একটু রেস্ট নি। তারপর বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে অন্যকোন নার্সিংহোমে জয়েন করবি। মুনের আর কি করার একমাত্র বান্ধুবির কথা মেনে সে বাসায় বসে আছে। এদিকে আসি ফারহানের কথায়, এনআর নার্সিংহোমের কাজ শেষে সে নিজের প্রফেশনাল লাইফে ফোকাস করেছে। সকাল থেকে বিকাল অব্দি তার সেনানিবাসেই কাটে। বিকালে ফিরে একটা ঘুম আর তারপর রাত জেগে কাজ করা। সপ্তাহে দুদিন তার ছুটি তবে এই দুইদিন সে তার ব্রাঞ্চের কাজে থাকে। আপাদত তাদের ব্রাঞ্চে এখন কোন কাজ নেই। তবুও সেখানে তাকে যেতে হয়। নিজের স্বপ্নের ব্রাঞ্চ বলে কথা। তবে এসবের মাঝে সে চেষ্টা মুনের সাথে যোগাযোগ করার। মুনকে সে সরি বলেছে কয়েকবার কিন্তু সে শুনেনি। প্রতিবার ফারহানকে এড়িয়ে চলেছে। এতে ফারহান বেশ রেগে গেলেও মুখে কিছু বলতে পারেনা কারন ভুলটা যে ওর নিজের। ফারহান চেষ্টা করছে মুনের মান ভাঙানোর। প্রতিদিনের মতো আজও অফিস থেকে ফিরে ঘুমিয়েছে ফারহান। মুখের উপর তরল কিছু পড়তেই ঘুম কেটে যায় ফারহানের। চট করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় রওনার ওর সামনে দাঁড়িয়ে বত্রিশ পাটি বের করে রেখেছে। ফারহানের চোখে বিরক্তি রেখা ফুটে উঠে। একহাত মুখে রাখে, তারপর রাওনাকের থেকে চোখ নামতেই ওর দৃষ্টি পড়ে রওনাকে হাতে। একটা জগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রওনাক। ফারহানের মুখে তরল কি পরেছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না ওর। দাত কটমট করে উঠে বসে। রওনাকে দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

– এই সময় আমার রুমে কি করছিস। বেড়িয়ে যা বলছি।

– বেড়িয়ে যাবো মানে কি? তুই ভুলে গেছিস আজ আমাদের বের হওয়ার কথা? মরার মতো শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছিস। উঠ, উঠ বলছি। না-হলে এবার শাওয়ার এনে তোর মাথায় ধরবো বলে দিলাম।

– আমি কোথায় যাচ্ছি না তুই যা-না। তোর বিয়ের শপিং, সাথে আবার তোর উডবি, আমি তোদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হতে যাব কেন?

– কেমন জানি পুড়া পুড়া গন্ধ পাচ্ছি। নাক সিটকে বলল রওনাক।

– এটা বেড রুম রান্নাঘর নয় যে কিছু পুড়ে যাবে।

– সে আমিও জানি। তবে আমার সিক্সস্যাান্স বলছে এটা মব পুড়া গন্ধ। রওনাকে ফারহানের দিকে ঝুকে দাঁড়ায়। অতঃপর বলে, কি ভাই পুড়ছে নাকি তোর মনটা।

– এরকম কিছুই না।

-সত্যিই তাই।

– হুম।

– তাহলে চলে। এবার লেট হয়ে যাবে। তারপর দু-বোন মিলে আমার বারোটা বাজাবে। রওনাক উঠে দাঁড়িয়ে ফারহানকে তাড়া দিতে লাগলো। ফারহান ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে রওনাক আবার বলল, অর্ণা আর মুন দুজনেই আসছে। রাওনাকের কথা শুনে ফারহান মনে হয়ে হাতে চাঁদ পেলো। তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। স্মিত হেসে বলল, আমাকে যেতেই হবে। হুম। মাথা নাড়িয়ে বলল রওনাকে। ফারহান আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায়।

পুরো শপিংমল ঘুরা শেষ অথচ এখনো অর্ণা বিয়ের শাড়ি পছন্দ করতে পারলো না। মুন একবার বলেছিলো লেহেঙ্গা নিতে কিন্তু অর্ণা জেদ ধরে বসেছে সে বিয়েতে শাড়িই পরবে। মুন অর্ণার পিছন পিছন ঘুরে হাপিয়ে উঠেছে। রওনাক আর ফারহান দুজনে অনেক আগেই শপিংমল থেকে বেড়িয়ে গেছে। ফারহান যাওয়ার আগে শুধু এইটুকুই বলেছে, তোমাদের মতো আমাদের পা এতটা স্ট্রং নয় তাই তোমাদের মতো করে এত হাটতে পারবো না। তোমাদের শেষ হলে একটা কল দিও আমরা এসে নিয়ে যাবো। তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওরা চলে যায়।

জলপাই কালারের একটা বেনারসি দেখছে অর্ণা। এপর্যন্ত যতগুলো বেনারসি সে দেখেছে তার মধ্যে এটাই তার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগছে। অর্ণা মুনকে কিছু বলতে যাবে তখনি দেখলো মুন একমনে সামনে তাকিয়ে আছে। অর্ণা মুনের দৃষ্টি অনুসরণ করে দৃষ্টি রাখতে দেখতে পেলো মুন একটা লাল বেনারসি দেখছে। অর্ণা মুনের হাত স্পর্শ করে বলে,

– কিরে কোথায় হাড়িয়ে গেছোস? তুই কি ওই লাল বেনারসিটা নিবি?

– আমি কেন বেনারসি নিবো। বিয়েটা তোর তুই ওটা নিতে পারিস।

– কে বলতে পারে যদি সেদিন তোর বিয়েটাও হয়ে যায়।

– এমনটা কখনো হবে না। তুইকি এই বেনারসিটা নিবি।

– না, আমি আমার বিয়ে লাল বেনারসি পরলো না।

– প্রবলেম কি তোর? সবাইতো বিয়েতে লাল বেনারসি-ই পরে।

– আমি পড়বো না। কারন। লাল রং বিপদের সংকেত, দুর্ঘটনা, উষ্মা, ক্রুরতা ও যুদ্ধের প্রতীক হিসেবেই বেশি পরিচিত। আর আমি কিনা বিয়েতে লাল বেনারসি পরবো। কখনো না। মুখ ঘুড়িয়ে অন্য দিকে তাকালো অর্ণা। মুন হা করে তাকিয়ে রইলো অর্ণার দিকে। এই মেয়ে বলে, কতদূর পর্যন্ত ভেবে রেখেছে। এসব তো কখনো ওর মাথাতেই আসেনি।

চলবে,,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here