হৃদয়হীনা পর্ব -০৮

#হৃদয়হীনা
Part–8
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

রাত তখন দশটা। মাথার উপর ফ্যান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অলস ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে যেন। শায়েরী এক পলক ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে,খুলে রাখা বইয়ের পাতায় মুখ ডুবালো। কিন্তু মনে মনে সে প্রচুন্ড অস্থির। অস্বস্তিতে ভরপুর তার মন। পড়ায় ঠিকমতো মন বসছে না তার৷ আহনাফকে এক ঝলক দেখার উছিলায় সে দু’বার পানি খাওয়ার নাম করে বাইরে গেছে। দু’বার তাকে বাবার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে দেখে এসেছে। বাবা তার বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স নিয়ে ওনার সঙ্গে আলোচনায় মশগুল। উনিও গম্ভীর মুখে বাবার প্রতিটা কথা গিলছে এবং মাঝেমাঝে টুকটাক এক-দুইটি কথা বলছে। শায়েরীর মেজাজ চটে যাচ্ছে। বউ রেখে শ্বশুড়ের সঙ্গে এতো কী কথা তার? আজব মানুষ!

সে এখনো বইয়ে ডুবে থাকলেও তার মন-মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল “আহনাফ হাসান”। অরগ্যানিক কেমিস্ট্রি আর মাথায় ঢুকছে না। তখনই খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হলো। সে চোখ তুলে না তাকিয়েও বুঝে যায় আহনাফ এসেছে। তার গায়ে মাখা পারফিউমের গন্ধটা নাকে এসে বারি খাচ্ছে।
আহনাফ এসেই মিনিট এক দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। এতে আজ কেন যেন তার হাসি পেল। সে হাসি চেপে রেখে বইয়ে নয়নজোড়া স্থির রাখলো।

আহনাফ ধীর গতি পায়ে, আস্তে আস্তে তার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়ালো। তারপর একটু ঝুঁকে মোবাইল চার্জে দেওয়ার জন্য সকেটে হাত দিল। পড়ার টেবিলের উপরে সকেট। শায়েরী পড়ার টেবিলে বসে থাকায় আহনাফের বেগ পেতে হচ্ছে সকেটে নাগাল পেতে তবুও সে চেষ্টা চালিয়ে গেল। এক সময়ে তার হাতের কব্জি গিয়ে শায়েরীর গলায় লাগলো। শায়েরী যেন শিউরে ওঠে।

আহনাফ ফোন চার্জে না দিয়েই দ্রুত সরে এসে বলে, “সর‍্যি।”

তখনই একটা বিষ্ময়কর ব্যাপার ঘটলো। শায়েরী বিরক্তি মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং আহনাফের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে চার্জে লাগিয়ে দিয়ে বলে উঠে, আমাকে বললেই তো পারতেন। দেখি আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন৷ কথা আছে আপনার সঙ্গে।

–” আমার সাথে কথা বলার টাইম আছে তোমার?”

শায়েরী হাসি-হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, আগে ফ্রেশ হয়ে নিন না!

আহনাফ তার দিকে মিনিট এক তাকিয়ে থেকে বাথরুমে গেল। বিশ মিনিট পর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল, শায়েরী রুমে নেই। পুনরায় সে হতাশ হলো।মেয়েটা এমন করছে কেন? তার ভেতরকার অনুভূতি সম্পর্কে কী সে অবগত নয়?

তবে তার চোখ গেল, বিছানায় রাখা টাওয়ালের উপর। সে বিড়বিড় করে বলে, “গরু মেরে জুতো দান!”

সে টাওয়াল দিয়ে মুখ মোছার জন্য আগাতেই থমথমে খেল। টাওয়ালের উপর ছোট একটা কাগজে ইংরেজিতে সর‍্যি লেখা৷ মুহুর্তের মধ্যে তার মন ভালো হতে লাগলো। সে সর‍্যি কার্ডে হাত বুলিয়ে নিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমু খেল কাগজটায়। নিজের এহেন কাণ্ডে সে নিজেই লজ্জা পেল। বারান্দা থেকে কারো পায়ের শব্দে সে চমকে উঠে বলে, ” শায়েরী, তুমি কি বারান্দায়?”

বারান্দা থেকে জবাব আসে, হু৷

সে একবার ভাবলো যাবে না বারান্দায়। ক্ষণেই কি সব ভেবে নিজ থেকেই বারান্দায় যেতেই আরেকদফা বিষ্মিত হলো। হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সে।শায়েরী বিয়ের সেই লাল বেনারসি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো কোমড় পর্যন্ত ছাড়ানো। আহনাফ তাকে দেখতেই চোখ অক্ষিকোটরের বাইরের আসতে চাইছে যেন। হার্টবিট ফেল হতে হতে সে রক্ষা পেল।

শায়েরী নিরলস ভঙ্গিতে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

আহনাফ বলে উঠে, “কী করছো এখানে? বারান্দায় এতো শীতের মধ্যে পাতলা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঠাণ্ডা লাগবে না?ভেতরে আসো।”

শায়েরী ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। মেয়েটার মন নিশ্চয়ই খারাপ। মুখ কালো হয়ে আছে৷

আহনাফ কোমল গলায় বলে, “কিছু হয়েছে নাকি?”

— আপনি কী আমাকে ইগনোর করছেন?

–” ইগনোর আবার কী জিনিস?খায় না মাথায় দেয়?”

শায়েরীর ভারী অভিমান হচ্ছে৷ সে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে উঠে, আপনার সঙ্গে আমি খুব মিসবিহেইভ করি জন্য ইগনোর করছেন?

আহনাফ ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো, “হু।”

শায়েরী সঙ্গে সঙ্গে নিজের দুইহাত দিয়ে দুটো কান ধরে বলে, সর‍্যি। আসলে আমি অনেক আপসেট ছিলাম। এইজন্য…….

— আদৌ কী আমি জানতাম যে তুমি পরীক্ষা দাওনি?

— সর‍্যি৷

আহনাফ বলে উঠে, সর‍্যি দিয়ে হবে? হু?সর‍্যি কী খাওয়া যায় যে পেট ভরবে ?আশ্চর্য কান ধরে কেন দাঁড়িয়ে আছো?বিয়ের শাড়ি পরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী?হাত নামাও।

শেষের দিকে কথা দুটো আহনাফ ধমকে বলে উঠে।

শায়েরী সঙ্গে সঙ্গে কান জোড়া থেকে হাত নামিয়ে ফেলে। ততোক্ষণে শায়েরীর একদফা কান্না করা শেষ।

আহনাফ তা উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে যেতে ধরলে শায়েরী পেছনে থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আপনি যাবেন না প্লিজ৷

কথাটা শুনে আহনাফ থমকে যায়। আজকে রাত এগারোটার পর সে চিটাগংয়ের উদ্দেশ্য রওনা হচ্ছে। খবরটা সে খাওয়ার টেবিলে সবাইকে জানিয়েছে।

আহনাফ রাগ দেখিয়ে বলে, “আমার থাকা বা না থাকায় তোমার কিছু আসে-যায়?সবসময়ই তো আমার থেকে পালায় পালায় বেড়াও।”

এই কথা শুনে শায়েরী শায়েরী ভেউ ভেউ করে কেদে দিল।

আহনাফ তড়িৎগতিতে তার দিকে ফিরে, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,
” মহারানী সবসময়ই আমাকে কষ্ট দিবে কিন্তু তাকে একটু ধমক দিলেই নাকের পানি চোখের পানি এক করে দিবে।”

শায়েরী এবার সামন থেকেই আহনাফের বুকে হুমড়ি খেয়ে হিচকি তুলে বলে, বলছি না সর‍্যি আমি!

আহনাফ তাকে খুব সাবধানে আগলে নিয়ে নরম গলায় বলে, “বউ জন্য মাফ করতে মন চাচ্ছে। আফটার ওল একটামাত্র বউ তুমি! সেই বউকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হয় না। কেবল আদর দিতে মন চায়।”

আহনাফের আদরমাখা কণ্ঠ শুনেও শায়েরী কান্না করে দিল। তা দেখে সে ভ্রু কুচকে বলে, “ভারী মুশকিল তো! ধমক দিলেও কাঁদো, আদর করলেও কাঁদো! আমি মানুষটা যাই কোনদিকে?

শায়েরী তার কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে হেসে দিল।
আহনাফ তাড়া দিয়ে বলে, আর কাঁদিও না আমার শার্ট ভিজে নায়াগ্রা ওয়াটার ফলস হয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতে হবে।

শায়েরী তার শার্ট খামচে বলে, যাওয়াটা প্রয়োজন?

— ভীষণ। তাছাড়া আমি থাকলে তোমার পড়াশোনায় ডিস্টার্ব হবে।

— আপনি কী বাচ্চা যে আমাকে বিরক্ত করবেন?

আহনাফ হামি তুলে বলে, ” জামাই পাশে থাকলে শয়তান ভর করে মনে। তখন পড়তে মন বসতে না।”

শায়েরী নড়েচড়ে উঠে তার কথায়। আহনাফ হালকা করে তার কোমড় চেপে ধরে তাকে নিজের বুকের সাথে এক প্রকার মিশিয়ে নিয়ে নাকে নাক ঘষে বলে, “মেবি আই ফল ইন লাভ উইথ ইউ।”

-শায়েরী মাথা উচিয়ে অভিমানী গলায় বলে, মেবি?

আহনাফ তাকে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না।পুনরায় তাকে নিজের কাছে টেনে এনে,খুবই মোলায়েম ভাবে তার ওষ্ঠ জোড়ায় আলতো করে পরশ একে দিতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

সেদিন রাতে আহনাফ চিটাগং যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা দেয়। পরীক্ষার আগের সাত দিন শায়েরী দিন-রাত ভুলে পড়ায় মন দেয়। আহনাফ দূরে থাকলেও প্রথম একটা দিন তার পড়ায় এক ফোটা মন বসে নি।

___________________

কলেজের এক্সাম দিয়ে বের হলো সবেমাত্র শায়েরী৷ পরীক্ষা তুলনামূলক ভালোই হয়েছে জন্য মন ভালো তার। পরীক্ষা দিতে গিয়ে হাপিয়ে গেছে সে। গলা ভেজাতে পারলে মন্দ হয় না। সে গুটি গুটি পায়ে কলেজ গেট অতিক্রম করতেই পা-জোড়া থেমে যায় তার। চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে সে রীতি মধ্যে পিলে চমকে উঠেছে। আনন্দ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। প্রায় সাতদিন পর সরাসরি দেখছে মানুষটাকে। এই সাতদিনে একটু শুকিয়ে গেছে সে।

কলেজের গেটের সামনে সানগ্লাস, মাস্ক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। চেনার উপায় নেই এটা সেলিব্রিটি আহনাফ হাসান। তবুও এক দেখায় শায়েরী তাকে চিনে ফেললো!

সে গুটি গুটি পায়ে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। জনাব গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে৷

শায়েরী দুষ্টুমি করে বলে, গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প করছেন নাকি?

আহনাফ তার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকিয়ে চমৎকার করে হাসলো। মাস্ক পরা সত্তেও তা ঠাওর করতে পারলো শায়েরী৷

আহনাফ সানগ্লাসটা খুলে বলে, গার্লস কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে দেখার অভিজ্ঞতাটা কিন্তু মন্দ না!তোমাদের কলেজের মেয়েগুলো দারুন।

একথা শোনামাত্র শায়েরীর নাক লাল হতে লাগলেই আহনাফ দ্রুত গাড়ির সিটের দরজা খুলে বলে, “মহারানী, ভেতরে বসুন।বাইরে কি গরম। ”

শায়েরী ভেতরে উঠে বসতেই, আহনাফ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে, এক্সাম কেমন হলো?

— আলহামদুলিল্লাহ।

— লাঞ্চ করি চল?

— উহু। আজকে না। আজকে স্যার বাসায় আসবে পড়াতে৷

— ওহ। ঠাণ্ডা কিছু খাবে?

— কোক খেতে পারি৷

— শুধু কোক?

— হু।

— আচ্ছা।

আহনাফ গাড়ি থেকে নেমে কোক কিনে এনে শায়েরীকে দিল। শায়েরী এক চুমুক খেয়ে তার দিকে বোতল এগিয়ে দিল। আহনাফ স্মিত হেসে কোকের বোতলের চুমুক দিয়ে বলে, ” তোমার এইচএসসি এক্সাম কবে?

— দেড়মাস পর৷

— শায়েরী আমাকে ইন্ডিয়া যেতে হবে। মেবি তোমার পরীক্ষার সময়ও ওখানেই থাকতে হবে৷

শায়েরীর মন খারাপ হয়ে গেল। আহনাফ বলে উঠে, “তোমার স্বপ্ন পূরনে যেন কোনকিছুই বাঁধা না হয়। আমি কাছে কিংবা দূরে থাকি সবসময়ই আছি তোমার পাশে।”

শায়েরীর কানে আমি আছি কথাটা বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতে লাগে। অদ্ভুত ভালো লাগায় ছেয়ে যায় হৃদয়।

চলবে।

[ আজকে আরেকটা পর্ব দিলে পড়বেন আপনারা?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here