#হয়ত
পর্ব:- ১৫
.
আপন মানুষগুলো আমাদের ছেড়ে চলে গেলে আমাদের কষ্ট হবে; তাদের মৃত্যু আমাদের পীড়া দিবে এটাই স্বাভাবিক। কোন মানুষের দুই মিনিটের প্রাকটিক্যাল ভাষণ কখনোই সেই পীড়া কমাতে পারে না। বর্ষণ জানে তাপৌষিকে বলা তার কথাগুলো শুধু সেই পীড়ার উপর কিছুক্ষণের মলম মাত্র। আজ হয়তো তাপৌষি কাঁদবে না। তবে কালকে আবার কাঁদবে; কালকে না কাঁদলে তারপরের দিন কাঁদবে। তবে কাঁদবে নিশ্চয়। মনের ব্যাথা মুখের বুলি আর সহানুভূতি দিয়ে দূর করা যায় না যে।
তাপৌষির জন্য বর্ষণের খারাপ লাগছে। ঘরে আসার পর থেকে শুধু ঘরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পায়চারি করে চলেছে। বুকের বা’পাশে কেমন যেন ভার ভার লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ বিশ কেজি ওজন চাপিয়ে দিয়েছে। টেবিলের উপর রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়েও ভালো লাগছেনা ওর।
তাপৌষির কথাগুলো শুনলে যে কেউ কষ্ট পাবে; যে কারোর মনে সহানুভূতি তৈরি হবে। তবে বর্ষণের বুক পিঞ্জরে তাপৌষির জন্য সহানুভূতি নয় বরং অন্য রকম কোন অনুভূতি কাজ করছে। এই অনুভূতি বর্ষণের জন্য একে বারেই নতুন। জীবনের ছাব্বিশটা বসন্ত মেয়েদের থেকে দূরে দূরে থেকে কাটিয়েছে। প্রেম ভালোবাসা ওর জন্য নয়। কখনও কারও প্রেমেও পড়ে নি। হ্যাঁ, তবে নারীর সৌন্দর্যে ওই ও বিমুগ্ধ হয়েছে। সৌন্দর্যের প্রশংসাও করেছে। তবে তা দূর থেকে। নারী নামক গোলকধাঁধা ওর কাছে বরাবরই মিস্ট্রিয়াস।
.
আজকে কড়া রৌদ উঠেছে। শীতকালে এই কড়া রৌদও সবার ভালো লাগে। তাপৌষির যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্য মাঝ আকাশে দাপুটের সাথে রাজত্ব করছে। ঘরির দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠলো, “ওহ নো। আজকেও লেট!”
.
বর্ষণ চেয়েছিল একটু সকাল সকাল বের হতে। বটতলার ওখানে দুপুর করে মানুষের ভীড় জমে। মানুষ ভর্তি বাসে তখন আর কাউকে উঠাতে চায় না কন্ট্রাক্টর। কিন্তু পিছে একটা লেজ জুটলো। “অথৈ”।
গত একঘণ্টা ধরে বর্ষণ ওর জন্য ওয়েট করছে। খিদা নাই তাও ডাইনিং টেবিলে বসে বসে ফল খাচ্ছে। বর্ষন ভেবে পাচ্ছে না, গতকাল যখন অথৈর বাবা-মা ওকে নিয়ে যেতে চাইলো তখন গেলো না। ওনারা বেশ পীড়াপীড়ি করেছিল মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অথৈ নাকি আরও তিন চারদিন থাকবে বলেছিল। এখন আবার কী হলো?
আপেলের টুকরো টা মুখে তোলার সময় বর্ষণ তাপৌষিকে নামতে দেখতে পায়। পীঠ অবধি খোলা চুল, মুখে ঘুম ঘুম ভাব দারুণ লাগছে মেয়েটাকে দেখতে। কিন্তু তার কিছু সময় পর বর্ষণের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। রাগ উঠেছে ওর এই মেয়েটার উপর। দুটো কষে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
-‘ গুড মর্নিং। ‘
তাপৌষি মিষ্টি করে হেসে টেবিলে বসে। আজ মন ফুরফুরে লাগছে। সামনের বউল থেকে ওটস তুলে নিতে নিতে বর্ষণের দিকে তাকালো। ব্যাপার কী? লোকটাকে গুড মর্নিং দিল অথচ লোকটা কোন জবাব দিল না? এ কেমন ধাঁচের মানুষ রে বাবা!
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল,
-‘ আমি আপনাকে গুড মর্নিং জানিয়েছি।’
-‘ তো?’
-‘ তো মানে? আপনারও উচিত আমাকে গুড মর্নিং জানানো। ‘ কথাটা বলেই এক চামচ ওটস মুখে তুলে নিল তাপৌষি। এটা ওর দিশা আপুর হাতের রান্না। ওটসে দিশা মিটবল দেয়। একটু ঝালঝাল। বেশ মজা লাগে খেতে।
-‘ আমার তোমাকে গুড মর্নিং দিতে ইচ্ছে করছে না।’
-‘ কেন?’
-‘ কারন তুমি আমাদের জন্য ব্যাড মর্নিং বয়ে আনার প্ল্যানিং করছো।’
-‘ কিছুই বুঝছি না।’
-‘ কালকে রাতের জামা পাল্টাওনি কেন? ভেজা জামা পড়ে ঘুমিয়েছ। জ্বর সর্দি কাশি হলে তোমার বাপে তো দোষ আমার মা’কেই দিবে। মা তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে যে।’
তাপৌষির ফর্সা মুখ লাল হয়ে আসছে। কান্না পাচ্ছে ওর। বর্ষণ ওর সাথে এমন রূঢ় আচরণ কেন করছে? ভালো ভাবেই তো এ কথা বলা যেত।
-‘ খালামনি নিয়ে আসে নি। কমলাপুর রেলস্টেশন অবধি আমি একাই এসেছি। দুপুর ২:৩০ এ ট্রেন ছিল। আপনাকে টেনশন করতে হবে না। আমি অসুস্থ হবো না আপনাদের এখানে।’
কথাটা বলেই দৌড়ে দোতলায় নিজের ঘরটাতে চলে আসলো তাপৌষি। আজ অনেক অনেক অভিমান জমেছে ওর মনে। বর্ষণ এই নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো ওর সাথে এমন রূঢ় আচরণ করলো। মনে মনে শপথ করলো, আর কখনোই কথা বলবে না এই লোকটির সাথে। অতিরিক্ত ইগো লোকটার। মনে মনে জানা কয়েকটা গালিও দিয়ে নিল।
.
তাপৌষির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল বর্ষণ। তাপৌষির রাগ করার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ও। কিছুক্ষণ পর নিজেই নিজেকে বলল,” যা বাবাহ! ভালোর জন্যই তো বকলাম। ঢঙি মেয়ে একটা। বাপ-মায়ের এক মেয়ে হওয়াতে ঢঙ যেন উপচে পড়ছে। ফাজিল, আবেগি মেয়ে অভিমান করেছে। ঢঙ সব ঢঙ।”
তারপর হঠাৎ মনে পড়ল গতকাল রাতে ওদের মাঝকার কথোপকথন। “শীট ম্যান।” দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো বর্ষন। আজকের দিনে তাপৌষিকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হয়নি। মেয়েটার মন এমনিতেই ভালো না। দুতলায় উঠার সময় পিছে ডাক পড়ে ওর।
-‘ আমি রেডি।’
-‘ হুম চলো অথৈ। ‘
মনে মনে বলল, আজ আর তাপৌষির রাগ ভাঙানো হলো না। আবার নিজেই বিরবির করে বলল, রাগ নয়, তাপৌষি অভিমান করেছে। এইটুকু পুচকে মেয়ের অভিমান হয়েছে বর্ষণের উপর। বাসে উঠার পরও তাপৌষি নামটা বর্ষণের মস্তিষ্কের মাঝে কাঁকাড়ার মতো চেপে রইল। সমস্ত পথ ও শুধু মিটিমিটি হেসেছে আর সেদিনের তাপৌষির প্রশ্ন গুলো মনে করেছে।
.
.
.চলবে…