হয়ত পর্ব ১৬

#হয়ত
পর্ব:- ১৬
.
দুপুরের খাবারের সময় দিশা এলো তাপৌষির ঘরে। তাপৌষি খাবো খাবো না করছিল। কিন্তু দিশা জোর করেই ওকে ধরে নিয়ে এলো নিচে। আজ ডাইনিং টেবিল গতদিনের মতো ভর্তি নেই। হয়তো বাকীরা নিজ নিজ বাড়ি ফিরে গেছে অথবা পাশের সেই মাটির বাড়িটায় আছে। একদিন এই মাটির বাড়ির ভিতরে ঢুকার ইচ্ছা আছে তাপৌষির। তবে দিশার দাদি তাপৌষিকে যেন সহ্যই করতে পারে না। বর্ষণকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তনয়া বেগম আর রৌদ বসে আছে টেবিলে। দিশা চেয়ার টেনে তাপৌষিকে বসতে বলল। নিজেও বসলো।
-‘ তাপৌষি তোমার প্রেসক্রিপশন এর লাস্ট ডেট সাত-আট মাস আগের। রিসেন্ট কোন ডাক্তার দেখাওনি?’
-‘ না ভাইয়া।’
তনয়া বেগম ভাত বাড়ছিলেন প্রত্যকের প্লেটে। আজ তিনি আলাদা খাবেন না। একসাথেই খাবেন। মানুষ মাত্র কয়জন বাসায়। কাল তো দিশা -রৌদও চলে যাবে ঢাকায়। তাপৌষি আসাতে একটু সুবিধা হয়েছে উনার। ছেলেমেয়েরা ঢাকায় থাকে। কতবার মা’কে নিয়ে যেতে চায়। তবে তনয়া বেগমের শাশুড়ি যেতে দিতে চান না। অবশ্য তনয়া বেগমেরও মন টানে না। তিন ছেলেমেয়ের থাকার জন্য ওদের বাবা একটা ফ্লাট কিনে দিয়েছে। দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় দেখাশোনা করে ওদের। বর্ষণটা অবশ্য এখন বেশি গ্রামেই থাকে। তবে ঢাকামুখী সেও। একা বাড়িতে অশান্তি লাগে তনয়া বেগমের। তাপৌষিকে একটা প্লেট দিতে দিতে তিনি বললেন,
-‘ তোমার বাবা কে ফোন দিয়েছিলাম। উনি ফোন ধরেননি। আসলে আমি চাচ্ছিলাম ঢাকায় তোমার মাইগ্রেনের চিকিৎসা করাতে। তোমার বাবার মতামত জানতে ফোন করেছিলাম। তুমি এক কাজ করো কাল দিশাদের সাথে ঢাকায় যাও। ওখানে ডাক্তার দেখিয়ে বর্ষণের সাথে ফিরে এসো।’
ওহ তারমানে ঝগড়ুটে লোকটা ঢাকায়। ভালোই হয়েছে। তাপৌষি এবার শান্তিতে থাকবে। হুহ, যাবেনা ও কোন ঢাকা ফাকায়। ওই বজ্জাত লোকটা যে এখন ঢাকায়। সেখানে যাওয়া ইম্পসিবল।
-‘ না খালামনি আমি রাজশাহী যেয়েই ডাক্তার দেখাবো। তোমরা প্লিজ এত উত্তেজিত হইও না। আমি ঠিক আছি।’
-‘ দেখো মেয়ের কাণ্ড। মাথা ব্যাথায় মরে যাচ্ছে আবার বলে ঠিক আছে! এখানে ভালো চিকিৎসা হয়। তুমি কি তোমার বাবার পারমিশন নিতে চাচ্ছ আগে? আচ্ছা এই ধরো ফোন। ফোন দাও বাবাকে।’
তাপৌষি ফোনটা হাতে নিল না। বরং আয়েশ করে ভাতের প্রথম লোকমা মুখে তুললো। চোখ বন্ধ করে চিবালো। তারপর বলল,
-‘ বাবার আজকে বিয়ে খালামনি। তাই আজ ভীষণ ব্যস্ত। যেকোনো ফোন ধরার মতো সময় এখন বাবার হাতে নেই।’
তাপৌষির কথাগুলো টেবিলে ছোট একটা বিস্ফোরণ ঘটালো। সবাই বড়বড় চোখ করে তাপৌষির দিকে তাকিয়ে আছে। আর তাপৌষি চোখ বন্ধ করে একটার পর একটা লোকমা গিলে চলেছে।
তনয়া বেগমের বুক ধড়ফড় করছে। কয়েক লোকমা খেয়েই তিনি উঠে পড়লেন। ঘরে যাবার আগে শুধু দিশাকে বললেন টেবিল গুছিয়ে খাবার ঢেকে রাখতে।
.
ঘরটা এখন দুপুর বেলায়ও অন্ধকার বলা চলে। সব পর্দা নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে বনবন করে। তনয়া বেগম বসে আছেন সেগুন কাঠের বিছানার উপর। ঘাম ছুটছে তার। প্রেশার বেড়েছে হয়তো। বিছানা থেকে উঠে টেবিলের উপর রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেলেন তিনি। তারপর ড্র‍য়ার থেকে ঔষধের বক্সটা বের করে একটা ফিক্সোকার্ড ৫০ খেলেন। তার এখন হাত-পা
কাঁপছে। আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন তিনি।
-‘ খালামনি আসবো?’
-‘ কে? ওহ তাপৌষি? আসো।’
-‘ আপনার কী শরীর খারাপ লাগছে?’
-‘ একটু প্রেশার বেড়েছে। মাথা ভার ভার লাগছে।’
-‘ আমি মাথা টিপে দিব?’
-‘ দাও।’
.
দিশা টেবিল গুছাচ্ছিল। রৌদ এখনো খাচ্ছে। শুধু যে খাচ্ছে তা নয়। টেবিলে মাংসের হাড্ডি ফেলে দিশার কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
-‘ ছোট ভাইয়া আমি কিন্তু মা’কে বলে দিব তুমি আমাকে কাজ করতে দিচ্ছ না। মা’য়ের বকা তখন সামলাতে পারবে না।’
-‘ বলবি তো। নারী রাজাকার একটা। রাজাকারদের মতো কথা লাগাস মায়ের কাছে। ‘৭১ এর রাজাকাররা পাকিস্তানিদের কাছে কথা পাঁচার করতো আর এখন তুই মায়ের কাছে কথা পাঁচার করিস। কে বলল, ১৯৭১ এর পর দেশ থেকে রাজাকার হারিয়ে গেছে? সব রাজাকারদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে? তোকে কারও চোখে পড়লো না? এ বড়ই দুর্ভাগ্য বাঙালির। এখন দে এক গ্লাস পানি দে।’
দিশা মুখ বেকিয়ে গলার স্বর বিকৃত করে বলল,
-‘ এহ! নারী রাজাকার বলতে কিছু নাই।’
-‘কে বলে নারী রাজাকার ছিল না ?
মার্চ ২৩, ১৯৭২ সালে দৈনিক পূর্বদেশ(বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস এ সংরক্ষিত)পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়,তৎকালীন অর্থ মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান। সেখানে দালাল আইনে গ্রেফতারকৃত মোট ৯ হাজার ৪৯৩ জন আসামী ছিল, যারা কোন না কোন ভাবে দেশের বিপক্ষে গিয়ে পাকীদের গণহত্যায় মদদ যুগিয়েছে। সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল এদের মধ্যে ৫০ জন নারীও ছিল যারা পাকিস্তানীদের সহচরী হিসেবে কাজ করায় দালাল আইনে গ্রেফতার হয়েছিল।এছাড়া সারা দেশে দালাল হিসেবে যে লিস্ট করা হয়েছে ছিল সেখানে ৬২ জন নারীর কথা উল্লেখ ছিল। (সূত্র:- মুক্তমনা ব্লগ).. বুঝেছিস? ‘
দিশা হা করে চেয়ে আছে রৌদের দিকে। এত বড় ভাষণ দেওয়ার কারন বুঝে পাচ্ছে না ও। আসলে ওর ভাই দুটো এমনই। যখন যেখানে পারবে সেখানে নিজেদের জ্ঞানের বাক্স খুলে বসবে। টেবিলের উপর পানি ভর্তি জগটা রেখেই দিশা গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। পাগলের বাড়ি এটা। সব পাগলের বাস। ও নিজেও না জানি কবে পাগল হয়ে যায়!
.
-‘ তাপৌষি একটা কথার সত্যি সত্যি উত্তর দিবে?’
-‘ কী কথা খালামনি?’
-‘ তনিমার মৃত্যুর পিছনে কী তোমার বাবা দায়ী? ‘
তাপৌষির হাত থমকাল। বাবার সাথে মা’য়ের মতের দ্বন্দ্ব চলছিল এটা সঠিক। তবে মা’য়ের মৃত্যুর আসল কারন কী তা তাপৌষি নিজেও জানে না।
-‘ আমি জানি না খালামনি।’
-‘ তোমার মা আত্মহত্যা কেন করেছিল?’
তাপৌষির চোখে বিন্দু বিন্দু পানি জমছে। কান্না পাচ্ছে তার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
-‘ জানি না খালামনি। মাথা ব্যাথা কমেছে? আমি একটু ঘরে যেতাম। ‘
-‘ হুম যাও। ‘
তাপৌষি যাওয়ার পরও তনয়া বেগমের অন্তরের খচখচানি টা গেল না। বোনটা তার অকালে চলে গেল, মেয়েটার বয়স অল্প। তার উপর বাপে আবার আরেকটা বিয়ে করছে। বাচ্চা মেয়েটার কপালে কেমন সৎ মা জুটছে কে জানে? আচ্ছা তাপৌষিকে এখানে রেখে দিলে কেমন হয়? দিশাদের সাথে থেকে পড়াশোনা করবে। ঢাবিতে তো ওয়েটিং এ আছেই। আর শেষ পর্যন্ত ওখানে না হলে প্রাইভেটে ভর্তি করিয়ে দেওয়া যাবে। এতে কিছুটা হলেও তনয়া বেগম তো নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবেন।
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here