অঙ্গনে হৃদরঙ্গন পর্ব ৬

“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ৬
(নূর নাফিসা)
.
.
“কে? কে এখানে?”
কোনো সাড়া নেই। কয়েক সেকেন্ড পর বাথরুমের দরজার শব্দ হলে কিছুটা নিশ্চিত হয়ে দরজা খুললো। কারণ চোর ডাকাত হলে তো আর বাথরুমে আসবে না। পরক্ষণে সাদাফকে বাথরুমে হাতমুখ ধুতে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এবং বললো,
“খাবার আপনার ঘরে…”
“হুম? আমি এখন খাবো না।”
“ঘরে রেখে এসেছি যে।”
“আচ্ছা, ভালো। ঘুমিয়ে থাকো।”
শ্রাবণ মাথা নেড়ে চলে এলো। এবার অন্তত ঘুমানো সম্ভব তার পক্ষে। রাতে দেরিতে ঘুমানোর ফলে সকালে আজ তারও দেরি হলো ঘুম থেকে উঠতে। তবে সাদাফের আগেই উঠেছে। সে হাড়িপাতিল মাজছিলো, এমন সময় একটা লোক এসে সাদাফের দরজায় কড়া নেড়ে ডাকতে লাগলো। শ্রাবণ বাথরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওদিকে সাদাফও সাড়া দিয়েছে। তাই শ্রাবণ আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। লোকটার হাতে মাঝারি আকৃতির একটা রুই মাছ। সাদাফ বেরিয়ে এসে মাছটা শ্রাবণকে নিতে ইশারা করলো। আর মাছের বিলটা ধরিয়ে দিলো লোকটার হাতে। সাদাফ হাতমুখ ধুতে এলে হাড়িপাতিল দ্রুত ধুয়ে বেরিয়ে এলো সে। ভাত তো প্রায় হয়ে এসেছে কিন্তু তরিতরকারির কোনো ব্যবস্থাই করা হয়নি। বেলাও হয়ে আসছে অনেকটা। সে হাপিয়ে ঝাপিয়ে কাজ করছে। মিনিট পাঁচেক পরেই সাদাফের কণ্ঠে ভেসে এলো,
“শ্রাবণ…”
শ্রাবণ হাতের কাজ ফেলে তার সামনে উপস্থিত হলো। দেখলো সাদাফ বাইরে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সে বললো,
“আপনি কি চলে যাচ্ছেন? একটু অপেক্ষা করুন, ভাত হয়েই গেছে। তরকারিটা একটু…”
“আমি গত রাতে রাখা ভাত খেয়ে নিয়েছি। এদিকে এসো। কত জানি খরচ করেছিলে? একশো আশি টাকা না?”
“হ্যাঁ।”
“এই নাও। বিশ টাকা বোনাস দিলাম। খুশি তো?”
একশো টাকার দুইটা নোট ধরিয়ে দিয়ে তার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সে বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ পিছু ডেকে বললো,
“শুনুন, প্রতি রাতেই কি আপনি এতো দেরি করে বাড়ি ফিরেন?”
সাদাফ থেমে পিছনে তাকিয়ে বললো,
“কেন?”
“এখানে একা থাকতে রাতে আমার খুব ভয় হয়। কাজ না থাকলে আপনি একটু আগে ফেরার চেষ্টা করবেন।”
“সন্ধ্যা হতেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আর ভয় হবে না। আমার খাওয়ার চিন্তাও করার দরকার নেই। খাবার নাহয় আমি রান্নাঘর থেকে নিজে নিয়ে নিবো।”
“তারপরও ঘুম হবে না। কেমন নির্জন বাড়ি তো, ভয়টা দূর করতে পারি না। গত দুদিনে অনেক ভয় পেয়েছি।”
সাদাফ আর কোনো জবাব না দিয়ে চলে গেলো। টাকাটা ফিরিয়ে দেওয়ার কারণে শ্রাবণের মনে লোকটার প্রতি ইতিবাচক ভাবনা জন্মালো। তার ধারণা, লোকটার মনটা বেশ ভালো তবে রূপটা ভয়ংকর। টাকাটা আঁচলে বেঁধে শ্রাবণ এ ঘরে থাকা প্লেট পেয়ালা নিয়ে বেরিয়ে এলো। ভীষণ খারাপ লাগছে এই ভেবে, কাজের লোক থাকতেও লোকটাকে বাসি খাবার খেয়ে বের হতে হলো। এতো ঘুম আসে কোত্থেকে, সেটা ভেবে নিজের উপর চরম বিরক্ত সে!
সেদিন রাতে বারোটার আগেই বাড়ি ফিরলো সে। তাকে খাবার দিয়ে এসে আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারলো শ্রাবণ। সকাল হতেই আবার ঝটপট নাস্তা করে বেরিয়ে গেছে। সারাদিনে আর খেতেও আসেনি। রাত গভীর হয়ে আসছে, শ্রাবণের চিন্তার শেষ নেই। লোকটার কোনো বিপদ হলো না তো! অন্যান্যদিন রাতে দেরিতে ফিরলেও তো দিনে কয়েকবার বাড়ি আসে। কিন্তু আজ তো একবারও এলো না! সেই সকালের রান্না করা খাবারই সারাটাদিন হাড়িতে গড়াচ্ছে। আজও আবার ভয় হতে লাগলো। তবে সেদিনের মতো বোকামি করে বসে থাকেনি আজ। সন্ধ্যার পরও যেহেতু ফিরছে না তাই শ্রাবণ সাদাফের রুমে এসে তালা নিয়ে দরজায় তালা আটকে চাবি নিয়ে নিজের রুমে এসে বসে রইলো। আজ চিন্তায় চিন্তায় ক্ষুধাও মজে গেছে৷ তাই খাওয়াও হলো না তার। মধ্যরাত হয়ে এলে শ্রাবণের রুমের দরজায় পরপর দুইটা থাপ্পড় পড়লো। শ্রাবণ চমকে উঠলো। আবারও থাপ্পড় পড়লো সাথে গলার আওয়াজ,
“শ্রাবণ…”
কণ্ঠটা কেমন অপরিচিত লাগলো কিন্তু শ্রাবণ তো শুধু সাদাফ ডাকে। সে দরজার কাছে এসে বললো,
“কে?”
“আমি। চাবি দাও।”
শ্রাবণ নিশ্চিত হয়ে দরজা খুললো। কেমন ক্লান্ত চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে লোকটা। হাতে সিগারেট জ্বলছে। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো,
“সারাদিন কোথায় ছিলেন? খেতেও এলেন না।”
“এক জায়গায় গিয়েছিলাম। চাবি দাও।”
বলতে বলতে দরজায় হেলান দিয়ে সিগারেট টানতে লাগলো। শ্রাবণ চাবি নিতে নিতে কয়েকবার তাকিয়ে তার অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করছে। কেন জানি মনে হচ্ছে সে স্বাভাবিক না। শ্রাবণ তার হাতে চাবি দিলেও সে এখনও দরজায় হেলান দিয়ে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। শ্রাবণ তার একপাশ দিয়ে কোনোমতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো তাকে খাবার দেওয়ার উদ্দেশ্যে। রান্নাঘরের দরজা খুলতে গেলে তার কাঁধে হাত পড়লো। শ্রাবণ ভয়ংকর কেঁপে উঠেছে তাই লাফিয়ে পেছন ফিরে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ফেললো। সাদাফ সামনে থেকেই তার কাঁধ চাপড়ে বললো,
“খাবার দিয়ো না। আমি খাবো না।”
কথাটা বলে হেলেদুলে নিজের ঘরে চলে গেলো। আজ হায়দার সাহেবের সাথে সেই জমি দেখতে গিয়েছিলো, ফিরেছে সন্ধ্যায়। কিন্তু বাড়ি না ফিরে দাবাঘরে কাটিয়ে দিয়েছে সময়। হাতে কিছু টাকা এলেই মাদকের নেশায় পড়ে যায়। ধরাবাঁধার কেউ নেই তার।
একটা মুহুর্তের জন্য যেন প্রাণহানি হয়ে যাচ্ছিলো তার। শ্রাবণ হাপাতে হাপাতে দ্রুত নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। লোকটা যে মাতাল অবস্থায় আছে বুঝতে এতোটা অসুবিধা হয়নি তার। যদি এখন আবার আসে, তখন কি করবে সে! সেই ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার ঘর থেকে তো তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার সাহসও পাবে না। শ্রাবণ বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে গলা ভিজিয়ে নিলো। তারপরও মনে হচ্ছে আবার শুকিয়ে গেছে। শুয়ে শুয়েও ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি সাদাফ এসে দরজা খুলতে বলবে তাকে! এই ভয়ে তার ঘুমের রাত আরও কেটে গেলো। অবশেষে শেষ রাতে ভয়ার্ত চোখ জোড়ায় ঘুম নেমে এসেছে। ঘুম ভাঙতে নিজেকে বোকা বলে আখ্যায়িত করলো সে। লোকটা তো ভালো, তার সম্পর্কে কেন মনে অযথা এমন ধারণা জন্মালো। সেসব লোক হলে তো সেদিন কিনেই রেখে দিতো তাকে।
জমি দেখতে যাওয়ার দিন হায়দার সাহেব মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত করেছিলেন। দিশার গায়ে হলুদের দিন আবার সাদাফ এখানে এলো। দাওয়াতের উদ্দেশ্যে আসেনি, এসেছে তার কাজে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। গেইট দিয়ে ঢুকতে হলে শত লোকের চোখে পড়তে হবে। তাই সে বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই দারোয়ানকে পাঠালো হায়দার সাহেবের কাছে। একবার এসে বললো, হায়দার সাহেবকে খুঁজে পায়নি। সাদাফ রাস্তার ধারেই পায়চারি করে একটা সিগারেট শেষ করে আবার এসে দারোয়ানকে ডেকে দিতে বললো। কিন্তু দারোয়ান নিজে না গিয়ে অন্য একটা লোককে পাঠালো৷ লোকটা গিয়েছে পর্যন্তই জানা, ফিরে আসার আর খবর নেই। এইবার সাদাফ নিজেই বাড়িতে প্রবেশ করলো। লোকেদের চোখে পড়লেও তার চোখে পড়েনি কোনো লোককে। কেননা তেমনভাবে সে কারো দিকে তাকায়ই নি। সোজা চলে এসেছে দোতলায়। সোফায় সেজেগুজে বসে আছে দিশা। পাশে কথাবার্তা বলছে কিছু মেয়েলোক। তাদের অনুষ্ঠান এখনো শুরু হয়নি। কেউ কেউ এখনো সাজুগুজু নিয়ে ব্যস্ত। দরজার পাশে এসেও যেন থেমে গেলো সাদাফ৷ ভেতরে চোখ বুলালো হায়দার সাহেবের খোঁজে। দিশা তাকে দেখে কিছুটা অবাকই হলো। একটু খুশি মনোভাব নিয়ে উঠে এসে বললো,
“আরে আপনি! এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন।”
“আপনার বাবা কোথায়?”
“বাবা তো নিচেই ছিলো।”
“ওহ্, দেখলাম না তো।”
“আপনি এসে বসুন, আমি কাউকে দিয়ে ডেকে পাঠাচ্ছি।”
দিশা উঠে যাওয়াতে ভেতরে থাকা মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ তাকিয়েছে সাদাফের দিকে। দিশার বড় বোন জিজ্ঞেস করলো,
“কে তিনি?”
দিশা ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিলো,
“তুমি চিনবে না। বাবার পরিচিত। বাবার কাছেই এসেছে। আপনি আসুন না ভেতরে…”
“না, নিচে দেখছি আমি…”
“দেখতে হবে না। আমি কল করছি। আপনি এসে বসুন।”
“না, এখানেই ঠিক আছি। আপনি কল করুন।”
“আচ্ছা।”
দিশার মা সাদাফকে দেখে যেন বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো। দিশা তার রুমের দিকে গিয়ে রুম থেকে দুইটা মেয়েকে বের করে দিয়ে কানে ফোন ধরে কথা বলতে বলতে আবার বেরিয়ে এলো। ফোন রেখে সাদাফের উদ্দেশ্যে বললো,
“আপনি ওই রুমটায় গিয়ে বসুন। বাবা আসছে।”
“না, এখানেই অপেক্ষা করি।”
“আরে আসুন না, কেউ নেই সেখানে।”
সাদাফ এবার সোজা সেই রুমে চলে গেলো। দিশা একটা মেয়েকে বললো, খাবারের ব্যবস্থা করতে। তারপর সে নিজেও চলে এলো এই রুমে। দরজা খোলাই রেখেছে, কিন্তু বাইরের কোলাহলের কারণে নিশ্চয়ই তাদের কথা কেউ শুনতে পাবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here