ঘুম থেকে জেগে,পাশ ফিরতেই আমি খেয়াল করলাম আমার পাশে অচেনা এক ভদ্রলোক ঘুমিয়ে আছে। এখানে আমার স্বামীর আবিরের থাকার কথা ছিল। কিন্তু তার জায়গাই এই লোকটা কে হতে পারে ভেবেই আমি ভ্রু কুচকে ফেললাম। আবছা অন্ধকারে সব কিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। লোকটা সাদা পাঞ্জাবী পড়ে খাটের ঠিক মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। লোকটার অবয়ব দেখে আমি ভ্রু কুচকে আছি।। প্রচণ্ড ভয় আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে আবির কি আমাকে কারো হাতে তুলে দিয়েছে? মনের মধ্যে কথাটা বারবার না চাইতেও হানা দিচ্ছে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম কিন্তু ও আমার সঙ্গে এরকম করবে কখনও ভাবিনি। গতকাল আমাদের বিয়ে হয়েছে। দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্ক,তারপর বিয়ের পিঁড়িতে বসেছি। সারাদিন বিয়ে নিয়ে ঝামেলার জন্য রাতে আমি ক্লান্ত ছিলাম। আবিরের জন্য অনেক্ষণ অপেক্ষা করেছি তারপর আর কিছুই মনে নেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ।কথাগুলো আনমনে ভেবে চলেছে কুহেলী। ও তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে লাইট অন করলো। গোলাপ আর রজনী গন্ধা ফুলের সৌরভে সারা ঘর মৌ মৌ করছে। কুহেলী একপা দুপা করে বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। যা ভেবেছিল তাই একটা অচেনা মুখ।আবার ও ভাবলো, এই লোকটার সঙ্গেই কি ওর বিয়ে হয়েছিল নাকি আবির ওকে বিক্রি করে দিলো কোনটা? ভেবেই কুহেলীর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। বাবা নয়তো আবির যেকোনো একজন ওর সঙ্গে প্রতারণা করেছে কিন্তু কে করবে ওর জানা নেই।কন্তু আবির কিভাবে প্রতারণা করতে পারে? বিয়ের আগে বাসা থেকে বের হবার সময় আবিরের সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল। ছেলেটা হাসি মুখে বলেছিল,
-“আজ থেকে তোমাকে আর দূরে দূরে থাকতে হবে না। আমাদের মধ্যে থাকবে না কোনো বাধা নিষেধের দেওয়াল। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর অবশেষে তুমি আমার হবে।”
আবিরের বাকপটুতাতে কুহেলী মুগ্ধ। ছেলেটা খুবই সহজ সরল ওর পক্ষে কুহেলীকে ঠকানো সম্ভব না। এটা ওর বাবা মা করেছে। কিন্তু কখন এসব হলো বিয়ের অনুষ্ঠানে এতগুলো মানুষ কেউতো কিছুই বললো না? কুহেলী আর নীরব থাকতে পারলো না কাপা কাপা কন্ঠে এই অচেনা লোকটাকে ডাকলো,
-” এইযে শুনছেন? আবির কোথায়? আপনি আমার রুমে কি করছেন?”
কুহলীর কথা লোকটা শুনতে পারলো কি জানা নেই। লোকটা পাশ ফিরে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। নিস্তব্ধ রুম দেওয়াল ঘড়িটা খসখস শব্দ করে চলছে। লোকটার ভারী নিশ্বাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কুহেলী মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। এই মূহুর্তে কি করা উচিৎ বুঝতে পারছে না। বাইরে যাবে নাকি আবিরকে ফোন করবে। ফোন করবে কথাটা ভাবতেই মনে হলো গতকাল ফোনটা বাড়িতে রেখে এসেছিল। তিনটা বেজে চল্লিশ মিনিট ফজরের আযানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কথাটা ভেবে ও সোফায় গিয়ে বসলো। ফুলে ফুলে সজ্জিত পালঙ্কের মধ্যে লোকটা কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। কোহেলির ইচ্ছা করছে লোকটাকে ধাক্কা মেরে উঠিয়ে দিতে রাগ হচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গা অচেনা মানুষ এখানে রাগারাগি করা বোকামি হবে তবুও মন মানছে না। ও কয়েকবার ভেবে আবার উঠে আসলো তারপর ট্রি টেবিলের উপরে রাখা পানি নিয়ে লোকটার দিকে ছুঁড়ে দিলো এতে দ্রুত কাজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা উঠে বসলো। লোকটার চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্ন। মনে হচ্ছে জাগিয়ে দিয়ে কোহলি বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে। লোকটা বিরক্তি নিয়ে রাগীভাবে জিজ্ঞেস করল,
> কি হচ্ছে এসব, মজা করছো মাঝরাতে? থাপড়িয়ে তোমার মজা করা আমি বের করবো। আমাকে চিনো না?
লোকটার ধমক শুনে কোহলির প্রচন্ড রাগ হল। ওকে ঠকিয়েছে তারপর আবার ওকে থাপ্পর মারতে চাইছে মগের মুল্লুক পেয়েছে কুহেলি এবার চিৎকার করে বলল,
> আবির কোথায়,আপনি এখানে কি করছেন আমার সঙ্গে চিট করেছেন আপনি।
কুহেলী একদমে কথাগুলো বলে থামল।।লোকটা ভ্রু কুঁচকে বললো
> আবির কে? কার কথা বলছ তুমি? >
>আবির আমার ভালোবাসা, আমার স্বামী, যাকে আমি গতকাল বিয়ে করেছি এই ঘরে আবিরের থাকার কথা ছিল কিন্তু আপনি কি করছেন এখানে?
ওর কথায় লোকটা মনে হচ্ছে অবাকই হলো। কুহেলী প্রশ্ন করে থেমে নেই ওর হাত পা কাপছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। বিয়ে নিয়ে মানুষের কতো করম চিন্তা থাকে। ও আর আবির ভেবেছিল এই রাতে ওরা হাতে হাত রেখে শপথ নিবে কখনও কাউকে ছেড়ে যাবে না। পাশে একটা নদীর আছে সেখানে চুপিচুপি গিয়ে জোছনা দেখবে। ভালোবাসার রঙে দুজন দুজনাকে রাঙিয়ে দিবে। কিন্তু কোথায় কি? এই লোকটা তৃতীয় পক্ষ হয়ে ওদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর এখন এমন ভাব করছে মনে হচ্ছে কিছুই জানেনা। লোকটার কথায় কুহেলীর ধ্যান ভাঙলো,
> আমি কোনো আবির টাবিরকে চিনি না ঠিক আছে? সারাদিন অনেক ঝামেলার মধ্যে ছিলাম তাই ক্লান্ত আছি। শুনো তোমাকে আমি শখ করে বিয়ে করিনি নেহায়েত আম্মা বলেছিল তাই করেছি। ওসব বিয়ে নিয়ে আমি ভাবিনা। দেখতে তো ফুলোন দেবী।
> আমি সত্যি বলছি আমার আপনার সঙ্গে না আবিরের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আর ও বিয়ের আগেও বলেছিল আমাদের বাড়িতে বর সেজে আসছে তাহলে এইটুকুর মধ্যে ও কোথায় হারিয়ে গেলো।
কুহেলী নরম কন্ঠে লোকটার সঙ্গে কথা বলল সঠিক উত্তরের আশায়।
> যখন বিয়ে পড়ানো হয় তখন তো পাত্রের নাম বলা হয়।আপনি কি না শুনেই কবুল বলেছিলেন নাকি? ভালোবাসাই অন্ধ হয়ে কানে তালা মেরে বসে ছিলেন অদ্ভুত মেয়ে।
লোকটার এরকম ছন্নছাড়া কথা শুনে কুহেলীর আরও জোরে কান্না পেলো। কি হবে এখন? বিয়ের সময় ঠিকঠাক শুনেছিল কি এখন আর মনে পড়ছে না। ওর এমন কান্নাকাটি দেখে লোকটা নিজের ফোনটা ওর দিকে এগিয়ে দিলো।
> বাড়িতে আর আবিরকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখুন। আচার্য মহিলা দেখছি আপনি। একমাস ধরে বিয়ের প্লানিং চলছে। গায়ে হলুদ শপিং এতকিছু হলো তবুও জানেনা বিয়ের পাত্র কে।
কুহেলী লোকটার থেকে ফোনটা নিয়ে আবিরকে ফোন করলো কিন্তু কল গেলোনা।। ও এবার নিজের বাড়িতে ফোন করলো। একবার রিং হতেই রিসিভ হলো। কুহেলী কিছু বলতে গেলো তার আগেই ওপাশ থেকে ওর বাবা ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
> মা সব ঠিক আছেতো? এখন ফোন করেছিস?
> আব্বু এখানে আবির নেই। তুমি না বলেছিলে আবিরের সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে। আর আবিরের বাবা মাও তো আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল তাহলে ও কোথায়? এই লোকটা কে আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
> কি বলছিস মা, আবির আবার কে? তোর মাথা ঠিক আছে তো? তুই মনে হয় স্বপ্ন দেখেছিস। ওসব না ভেবে ঘুমিয়ে যা সকালে তো ভাইয়া তোকে দেখতে যাবে।
কথাটা বলেই ওর বাবা এনায়েত সাহেব ফোনটা কেটে দিলেন। কুহেলী ফোনটা নিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। কি হচ্ছে ওর সঙ্গে কিছুই ও বুঝতে পারছে না। বাবা কখনও মিথ্যা বলেন না কিন্তু উনি কেনো বললেন আবির নামের কাউকে উনি চিনেন না। কুহেলী ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে লোকটা ওর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
> পানিটা খেয়ে নাও। আর শুনো আমি চাইনা আমার বিবাহিতা বউ বারবার কোনো পর-পুরুষের নাম উচ্চারণ করুক। আমি কেনো পৃথিবীর কোনো স্বামীই চাইবে না তার বউ প্রেমিকের নামে বিলাপ করে কান্নাকাটি করুক। সমাজে আমার সম্মান আছে।
কুহেলী অসহায় চোখে লোকটার দিকে তাকালো। ভয়ানক রাগী সেই দৃষ্টি। এই চোখে ওর জন্য ভালোবাসা বা করুণা কিছুই ও খুজেঁ পেলো না। কুহেলী মনে মনে বলল ” আবির কোথায় তুমি ফিরে আসো আমি তোমার জায়গা কাউকে দিতে পারবোনা। কেনো করলে এরকম?
কুহেলীর বোবা কান্না ওর বুকের মধ্যে আরও যন্ত্রণা দিচ্ছে। সত্যিই কি আবির নামে কেউ আছে নাকি নেহায়েত কুহেলীর মনে আবির নামে কারো অবয়ব তৈরী হয়েছিল কল্পণাতে?নাকি ওর বর্তমান স্বামী আবিরকে ভাগিয়ে নিজে বিয়ে করছে। আবার এমনো হতে পারে ওর বাবা আবিরের জায়গাই এই লোকটার সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছেন? কুহেলী এখন ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণায় কাতর।। এভাবেই ফজরের আজান হয়ে গেলো। কুহেলী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষ করে ও লোকটাকে আর পেলো না। হয়তো বাইরে চলে গেছে। কুহেলীর মন অশান্ত হয়ে আছে এমন সময় ওর মনে হলো বাইরে কিসের একটা শব্দ হচ্ছে। কুহেলী তাড়াতাড়ি করে জানালায় গিয়ে উঁকি দিলো।চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না অথচ রাস্তার উপর সামান্য আলো বিরাজমান। সেই আলোতে ও লক্ষ করলো রাস্তায় একটা মালবাহী ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন অদ্ভুত টাপের লোক ধরাধরী করে একটা মানুষের লাশ গাড়িতে তুলছে। অজানা ভয়ে কুহেলীর শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো।
(গল্পটা ভৌতিক টাইপের)
চলবে
অজানা পৃথিবী
কলমে লাবণ্য ইয়াসমিন।