#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#কায়ানাত_আফরিন
#পর্ব__১৪
আফরা প্রবেশ করলো ছোট্ট কুটিরটিতে। ওর নিজের ভাষায় যেটাকে বলে হন্টেড হাউস।ফারহান টিশার্টের ওপর এপ্রোন পড়ে আছে। রোদে পোড়া সবল শ্যামবর্ণের চেহারা। শক্ত চোয়াল। ঘামের কারনে কপালে কালো নরম চুলগুলো দূর্বাঘাসের মতো লাগছে। আফরার মন উথাল-পাতাল করছে এমন অবর্ণণাতীত সৌন্দর্য দেখে। অজান্তেই মানুষটার চুলগুলোতে হাত ছোয়ার মতো ভয়ঙ্কর ইচ্ছে চলে আসছে বারবার। ফারহান আসলেই নিঃসন্দেহে ভীড়ের মাঝে এক নজর কাড়ার মতো ব্যাক্তিত্ব। ভাবতেই আফরার মনে এবার অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে থাকলো।
.
.
-কি ভাবছেন এতো?
ফারহানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে ধ্যান ভাঙলো আফরার। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,
-না,,,,,তেমন কিছু ভাবছি না।তো আপনি কি এপ্রোন পড়ে থাকবেন সারারাত?
-আরে না। সবে মাত্র ডিনার তৈরি শেষ করলাম। ওয়েট,,,,আমি খুলে আসছি।
বলেই কিচেনের দিকে চলে গেলো ফারহান। আফরা একপাশে আয়েশ করে বসলো সোফার নরম গদিতে। লেমন ফ্লেভারের রুম স্প্রের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে সারা ঘর। আফরা ইতিমধ্যে খেয়াল করলো সোফার পাশে বিশাল বুকশেলফ,,,,,ষেখানে বই কম ; মামলা-মোকাদ্দমার কাগজপত্র বেশি। হাতে গোনা কয়েকটা ইংরেজী গল্পের বাংলা অনুবাদ বই আছে,,আরও আছে কয়েকটা ল’বুক। ইতিমধ্যে ফারহান এসে জিজ্ঞেস করলো ,
-এখন ডিনার করবেন নাকি আরও কিছুক্ষণ পরে?
-এখনই করি। সেই দুপুরে লাঞ্চের পর আর কিছুই খাই নি।
মৃদু হাসলো ফারহান। তারপর ডাইনিং টেবিলে আফরার উদ্দেশ্যে চেয়ার খুলে মৌনস্বরে বলে ওঠলো,
-বসুন।
কথামতো তাই করলো আফরা। আজ ওর মনে কাজ করছে অন্যরকম এক প্রশান্তি। ওর বরাবর বসে পড়লো ফারহান। রাতের নিরঙ্কুষ আধার। এর মধ্যে ডাইনিং টেবিলের ওপর বরাবর হলদে লাইটের সংমিশ্রনে মোহাচ্ছন্ন লাগছে বেশ। আফরা চামচ নিয়ে আরামসে স্যুপ খেতে লাগলো। ফারহান আড়চোখে আফরাকে দেখছে বারবার। আসলে আফরার খাবার সম্পর্কে মন্তব্যের জন্যই ফারহান অপেক্ষা করছে। আফরাকে চুপ থাকতে দেখে ফারহানই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কেমন লাগলো ?
-উমমম……ট্যু গুড। তবে আপনি এত ভালো রান্না পারেন,,,,আগে তো বলেননি!
-আগে কি এ ব্যাপারে কোনো কথা হয়েছিলো আমাদের মাঝে?
ফারহান ভ্রু নাচিয়ে বললো। আফরা হেসে দিলো এবার। প্রতিউত্তরে বললো,
-তাও ঠিক। বাই দ্য ওয়ে ,,,,,থ্যাংকস এত ভালো রান্না সার্ভ করার জন্য।
-ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
মৃদু কন্ঠে বললো ফারহান। আফরা আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে ফারহানের কার্যকলাপ। ফারহান ডিসেন্টলি খাবার খেয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মাঝে মাঝে আফরার সাথে দু’তিনটা কথা বলছে। ফারহানের লালচে ঠোঁটজোড়ার অনাবিল সৌন্দর্যেরর দিকে না চাইতেও তলিয়ে যাচ্ছে আফরা। মাঝে মাঝে নিজের বোকামি কাজগুলো দেখে অবাক না হয়ে পারেনা সে। কেননা চুপচাপ ধরনের মানুষ বরাবরই অপচ্ছন্দ আফরার। অ্যামেরিকায় এ পর্যন্ত অনেকের সাথে ডেট করার অভিজ্ঞতা ওর আছে , আর যেই ছেলে একটু বেশি গম্ভীর ধরনের ছিলো তার সাথে আর কথা বাড়াতো না আফরা। তবে ফারহানের ক্ষেত্রে আফরা হয়ে গেলো ব্যাতিক্রম। ওর গম্ভীরতা আর সল্পভাষী ব্যক্তিত্বের মোহেই দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আফরা। ফারহান হঠাৎ খাওয়ার মাঝে খেয়াল করলো আফরা ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে। মিহি স্বরে বলে ওঠলো,
-এভাবে তাকিয়ে আছেন যে?
-আপনাকে দেখছি।
শুকনো কাশি দিলো ফারহান। আফরা বসে আছে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে । আবারও তাই বললো,
-রিলেক্স ফারহান। বি নরমাল। আপনাকে আমি জাস্ট দেখছি। খেয়ে ফেলি নি।
এমন মেয়ে ফারহান আদৌ দেখেছে কিনা ওর মনে পড়ে না। কেমন নিঃসংকোচ মেয়েটার কথাবার্তা। কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলো ফারহান। অতঃপর খাওয়া শেষ করে বললো,
-আমার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। বারান্দায় বসবেন?
-বসতে পারি।
-তাহলে আপনি হাত ধুয়ে আসুন। আমি বারান্দায় চেয়ার নিয়ে যাচ্ছি।
বলেই ফারহান বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। হাত ধুয়ে আফরাও চলে গেলো সেখানে।
.
.
আকাশটা আজ ঘোলাটে। মেঘের আবরণে রাতের আকাশটা অনন্য লাগছে। একটা তীব্র ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে আফরার নাকে। আফরা চেয়ারে আরামসে বসে আনমনে সে ঘ্রাণ নাকে টেনে নিলো। ফারহানও বসে আছে পাশে। নিশিরাতের মায়াবী আলোতে মানুষটাকে লাগছে এককথায় অনন্য।আফরা এবার বলে ওঠলো,
-আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য আপনার মনে আছে?
মৃদু হাসলো ফারহান। আড়ষ্ট গলায় বললো,
-মনে আছে। আপনার ভাষ্যমতে আমি নাকি আপনার সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাই আপনি চান আপনার সম্পর্কে নিজ থেকে আমায় বলতে।
-যাহ্! আপনার তাহলে মনে আছে।আচ্ছা, আপনি তাহলে বলুন তো আমার সম্পর্কে আপনি আসলে কি কি জানেন?
কিছু একটা ভেবে নিলো ফারহান। তারপর আফরাকে বললো,
-আপনি চাচুর দূর সম্পর্কের বোনের মেয়ে। পারিবারিক আর জন্মসূত্রে অ্যামেরিকার নিউইয়র্কেই বড় হয়েছেন। ছুটি কাটাতে দু’মাসের জন্য এসেছেন শ্রীমঙ্গলে।
চোখ ছোট হয়ে এলো আফরার। মুখ কালো করে বললো,
-ব্যস এতটুকুই জানেন?
-হ্যা! এর থেকে আর বেশি কি জানবো?
-মানে একটু চেষ্টাও করেননি আমার সম্পর্কে জানার?
আফরা কড়া স্বরে বললো।ফারহান নির্বিকারে প্রতিউত্তর দিলো,
-না।
অপমানে থমথম করছে আফরার মুখশ্রী। খোলা চুলগুলো তুলি দিয়ে আটকে রাগ নিয়ে বললো,
-আমার থেকে কিছু শেখা উচিত আপনার। আপনাকে দেখার পরপর আমার অনুমান আর চেষ্টার পরই আপনার সম্পর্কে জানতে পেরেছি।
-কি জানতে পেরেছেন একটু শুনি?
সন্দিহান কন্ঠ ফারহানের। আফরা অগোচরে একটা দুষ্টু হাসি দিলো। এইতো সুযোগ পেয়েছে ফারহানকে জব্দ করার। চেয়ার টেনে আরও কাছে গিয়ে বসলো আফরা। ফারহানের নিঃশ্বাস এবার যেন ক্রমে বন্ধ হয়ে আসছে। আফরা ফারহানের কাছে ঝুকে বললো,
-এইযে.,,,,আপনার এরোগেন্ট ক্যারেক্টারের জন্য এখানকার মেয়েরা নাকি আপনার জন্য পাগল। যারা জীবনেও কলেজে যায় না তারাও নাকি তখন কলেজে যায় যখন আপনি স্টুডেন্টসদের নিয়ে কলেজে স্ট্রাইক বা অন্য কোনো কাজ করতে যান। একবার এক মেয়ে নাকি আপনার বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো। আপনি যেই চড় দিয়েছিলেন,,,,,,মেয়ে নাকি সুসাইড করতে চেয়েছিলো।
ফারহান শান্ত ভাবে বসে আছে। গম্ভীর গলায় বললো,
-এসব আপনাকে কে বলেছে?
-তা না জানলেও চলবে মিঃ কমরেড।
আফরার মুখে চাপা হাসি। ফারহান কথাটি অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য বললো,
-আপনি কি করেন অ্যামেরিকাতে?
-ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন থেকে গ্রাজুয়েটেড। জব করতে চেয়েছিলাম। পরে মম জোর করে বিডিতে পাঠিয়ে দিলো। বললো দু’মাস এখানে থাকতে। তারপর নাহয় ওয়াশিংটন এ ফিরে গিয়ে জব করবো।
-আপনি আর আপনার মম-ড্যাড কি একসাথেই থাকেন?
-উহু! অ্যামেরিকায় ১৮ বছর হওয়ার পরই ছেলে মেয়েরা আলাদা থাকতে শুরু করে। আমিও তারপর জ্যাকসন হাইটস ছেড়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে শিফ্ট হয়ে যাই।
-উনাদের মিস করেন না?
গম্ভীর হয়ে গেলো আফরা। এতক্ষণের প্রাণোচ্ছল মুখটি নিমিষেই যেন অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। বাইরে বহমান শীতল বাতাস। নীরব মোহময় পরিবেশ। আফরা মৃদু স্বরে বললো,
-আমি তাদের মিস করতে চাই না ফারহান। তারা এমন মানুষ যারা আমারসবদিক খেয়াল রাখলেও কখনও ভালোবাসা দিতে পারেনি। এমনকি আমায় বাংলায় কথা বলতে পারার ক্রেডিটটাও আমার মমকে আমি দেই। তবে,,,,,,,,,সে কখনোই আমায় ট্রাস্ট করেনি। তার ভাষ্যমতে, আমি হলাম বিগড়ে যাওয়ার সন্তান। আমার একটা ছোট্ট ভুলের জন্যই উনি শাস্তিস্বরূপ আমায় বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।
ফারহান নীরবতায় সাথে শুনলো আফরার এক একটি কথা। কোনো একটি কারনে মেয়েটার প্রচন্ড অভিমান জমে আছে ওর মায়ের প্রতি। ফারহানের হঠাৎ কি হলো ও জানেনা। আফরার চোখের কার্নিশ বেয়ে যে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়েছিলো নিমিষেই তা হাত দিয়ে মুছে দিলো সন্তর্পনে। আফরা হতবাক। ফারহানের মতো আবেগহীন মানুষ যে এমন একটা কাজ করবে আফরা তা ভাবতেও পারেনি। ফারহান হঠাৎ আফরার উদ্দেশ্যে বললো,
-এবার আমি কিছু কথা বলবো। আপনি মনোযোগ দিয়ে শুনবেন তো?
ফারহানের কন্ঠে অদ্ভুত এক মাদকতা । সম্মোহিত হয়ে পড়লো আফরা। জড়ানো গলায় বলে ওঠলো,
-হুম।
-তাহলে শুনুন। বাবা-মা যা করে তা কখনোই খারাপের জন্য করে না। হয়তো বা সবার সন্তান লালন পালনের প্রক্রিয়া এক না । তবে কোনো বাবা-মা ই তার ছেলে মেয়ের খারাপ চায়না। আপনি জানেন,,,,আপনার মতো লাইফ লিড করার জন্য কত মানুষ হাহাকার করে? জানেন কত মানুষ বাবা-মা এর একদন্ড ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ওত পেতে বসে থাকে? কিন্ত হতভাগা সেসব মানুষের কপালে সেই ভালোবাসাই জুটে না। বড় হয় নিঃসঙ্গ মানুষের মতো। আজ আপনার বাবা-মা আছে। তাই আপনার কদর নেই। যদি আমার মতো এতিম হয়ে বড় হতেন,,,,,,,তবেই বুঝতেন বাবা-মা কি জিনিস!
-হুশশশ!
ফারহানকে কোনো কথা না বলতে দিয়ে হঠাৎ ওর মুখে আঙুল চেপে ধরলো আফরা।ফারহানের কথাগুলো বজ্রপাতের ন্যায় প্রতিটি কথা ওর কর্ণকুহরে বাজছে। হ্যাঁ, আফরার মনে প্রচন্ড অভিমান ওর বাবা-মা এর জন্য। কিন্ত ফারহানের কথার পরিপেক্ষিতে এমন কিছুই ভাবেনি ও। মানুষ আসলেই অদ্ভুত। যা পায় তার থেকেও দ্বিগুন বেশিই চায়। আফরা মিহি কন্ঠে বলে ওঠলো,
-বারবার নিজেকে নিঃসঙ্গ বলবেন না ফারহান। বিশ্বাস করেন, এই কথাটি একেবারে বুকে গিয়ে লাগে আমার।
ফারহানের মনে হঠাৎ উথাল-পাতাল ঝড় শুরু হলো আফরার কথায়। শান্ত হয়ে বসে আছে সে। আফরা সংযত করে নিলো নিজেকে। আবহাওয়াটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে তাই বলে ওঠলো,
-আমি তাহলে এবার আসি ফারহান।
ফারহান তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো । সম্ভীহান গলায় বললো,
-ঠিক আছে।
-থ্যাংক ইউ এত সুন্দর একটা ট্রিট দেওয়ার জন্য । সী ইউ এগেইন। গুড নাইট!
-গুড নাইট।
আফরা কুটির ছেড়ে এবার পা চালালো বাংলো বাড়িটির দিকে।
—————
রুমে এসেই আফরা বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। ফারহানের সাথে কাটানো কিছু মুহূর্তের কথা স্মরণ করতেই শরীরে টানটান উত্তেজনা কাজ করছে মনে। হৃদয়ে অদ্ভুত সব অনুভূতি গ্রাস করে নিয়েছে। চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠছে ফারহানের চেহারা। ইসসস! এই অনুভূতির নাম কি বলা যায়?
ইলাও তখন বালিশ নিয়ে আসলো আফরার ঘরে। আজ কথা ছিলো সারারাত আফরার সাথে শুয়ে শুয়ে গল্প করবে। কিন্ত আফরাকে এতটা ভাবনায় মশগুল হয়ে দেখে বিস্ময়ে ছেয়ে গেলো ইলার মুখ। আফরা খাটে শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। ইলা বসে পড়লো আফরার কাছে। মিহি গলায় বলে ওঠলো,
-আফরা আপু?
আফরার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ইলা বারকয়েক পুনরায় ডাকলো তবে তা খেয়াল করলো না আফরা। সে তো নিজের ভাবনায় মগ্ন। ইলা বুঝে ওঠতে পারছে ওর কি হয়েছে। তাই বিড়বিড়িয়ে বলে ফেললো , প্রেমে-ট্রেমে পড়েছে নাকি এই মেয়ে?
.
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব_১৫
-আফরা আপু , কি হয়েছে তোমার?
ইলার ডাকে হঠাৎ আফরার ধ্যান ফিরলো। ইলা ওর দিকে কিছুটা ঝুঁকে আছে। চোখে মুখে কৌতুহলতার ছাপ। যেন কোনো কিছুর উত্তর জানার জন্য মনে অধীর আগ্রহ। আফরা শুকনো কাশি দিলো একবার। হতভম্ব গলায় বললো,
-আমিতো ঠিক আছি। কি হবে আমার?
ইলা যেন আফরার কথা কোনোক্রমেই বিশ্বাস করতে পারলো না। সে তখনও আফরার দিকে তাকিয়ে আছে চোখজোড়া ছোট করে। তারপর বলে ওঠলো,
-উহু! আমার তো তা মনে হয় না। আচ্ছা বাদ দাও এসব কথা। কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
বলেই ইলা বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়লো আফরার পাশে। আফরা বিস্ময় নিয়ে ইলার কার্যকলাপ দেখেছে। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বললো,
-ফারহানের হন্টেড হাউজে ছিলাম।
ইলা এবার যেন নড়াচড়া করা বন্ধ করে দিলো। এতটাই অবাক যে চোখের পলক ফেলে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করছে বারবার। আমতা আমতা করে এবার বলার চেষ্টা করলো,
-ক-ক-কি? কি ব-বললে তুমি? ফারহান ভাইয়ের সাথে ছিলে! আই কান্ট বিলিভ।
-কেন বিলিভ করতে পারবে না?
আফরার সন্দিহান কন্ঠ। ইলা গায়ে কাথা মুড়িয়ে প্রতিউত্তরে বললো,
-কারন ফারহান ভাই এমন একজন মানুষ যার সাথে মানুষ দু’মিনিটের বেশি থাকতে পারেনা তার দাম্ভিক আর চাপা স্বভাবের জন্য। ভাইয়ের কাছে মুখ্য বিষয় হলো রাজনীতি আর এটাই তার বউ বাচ্চা সব। সেদিকে ফারহান ভাই কিভাবে তোমার সাথে এত আলাপ চালাচ্ছে তা তো আমি ভেবেই পাচ্ছিনা।তো কি করলে এতক্ষণ ?
বলেই আফরার দিকে আরও চেপে শুয়ে পড়লো ইলা। আফরা ঠোঁট কামড়ে হাসছে। ইলার কৌতুহল দেখে মজা রাখছে বেশ। তারপর সে বললো,
-তেমন কিছু না। আমরা জাস্ট একসাথে ডিনার করেছি। যদিও আমি নিজ থেকেই আগ্রহী ছিলাম এ ব্যাপারে কারন ফারহান অমন মানুষ না। এন্ড ইউ আর রাইট ,,,ফারহান খুবই গম্ভীর আর চাপা স্বভাবের মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া মুখে দু’তিনটা কথা বেশি বলে না। এরকম মানুষদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি কিন্ত এই প্রথম আমি আমার লাইফ রুল ব্রেক করলাম ফারহান জুবায়ের নামের এক মানুষের প্রতি মোহে পড়ে।
বলেই থামলো আফরা। ইলা কৌতুহল না দমিয়ে প্রশ্ন করলো,
-এর মানে তুমি প্রেমে পড়েছো ভাইয়ের…..তাই না?
আফরা নিশ্চুপ। এর উত্তর সে নিজেও জানেনা। বসার ঘরের গ্রান্ড ফাদার ক্লক থেকে ঢং ঢং শব্দ হচ্ছে বারবার। এর মানে এখন মধ্যরাত। ঠিক ১২ টা বাজে। এসময় ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হলেও আফরার হৃদয়ে চলছে অন্যকিছু। তপ্ত শ্বাস ফেলে আফরা মৃদু গলায় বললো,
-আমি ফারহানের মোহে পড়েছি ইলা,,,,প্রেমে না। মোহ আর প্রেম এক জিনিস না। তাছাড়া ফারহান এমন একজন মানুষ যে সবার নজরই কেড়ে নিতে পারে।
-আচ্ছা তা তো বুঝলাম। কিন্ত ফাহিম ভাইকে তোমার কেমন লাগে?যেকোনো একটাকে ধরে ফেলো আপু। তুমি কত লাকি বসে বসেই এত সুন্দর দুইজনকে পেয়ে যাচ্ছো…….
হেসে ফেললো আফরা। তারপর ইলার কান টেনে বলে ওঠলো,
-বেশি পাকনামি করতে হবে না। আমার কাছে প্রেম ট্রেম সব টাইম পাস। কিছু দিনের জন্য এসেছি। তারপর আমার আসল জায়গায় ফিরে গিয়ে কাজে মন দেবো। তখন না থাকবে কোনো ফারহান,,,,,,না থাকবে কোনো মোহ!
—————-
আজ ২২ ই জুন। বাংলা তারিখ হিসেব করলে আষাঢ়ের ৬ তারিখ। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ সকালটা বেশ পরিষ্কার। ক্ষণে ক্ষণে পাখিরা শুভ্র আকাশে উড়াল দিচ্ছে বিরতিহীনভাবে। আফরা সিদ্ধান্ত নিলো আজ মর্নিং ওয়াক করবে এই পিচঢালাই চা বাগানের পথ দিয়ে। ফাহিমের সাথে আগেই কথা বলে রেখেছিলো এ ব্যাপারে যাতে আফরার সাথে সঙ্গ দিতে পারে। কেননা ফাহিম বরাবরই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। তাই সকালে এরকম একটা মানুষের সাথে মর্নিং ওয়াক করলে মন্দ হবেনা।
আফরা ট্রাউজারের পকেটে মোবাইল ঢুকিয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে দিলো। পায়ে হোয়াইট কেডস পড়ে দ্রুতপায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো বাহিরের দিকে।অল্পবিস্তর নীল আকাশের মাঝ দিয়ে উড়ে যাওয়া শুভ্রমেঘের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ আফরা। দেখতে ভালোলাগছে এই পুন্জ পুন্জ মেঘ।আফরা এবার আশেপাশে তাকালো ফাহিম আছে কিনা। একপাশে পেয়েও গেলো। আফরা সেখানে দ্রুতপায়ে যেতেই হঠাৎ পা থামিয়ে দেয় ফাহিমের পাশের ব্যাক্তিটিকে দেখে। মানুষটা ফারহান। ধূসর রঙের ট্রাউজার আর সাদা টিশার্ট পড়েছে। বুকের একপাশে ‘Adidas’ এর লোগো ঝুলানো। পায়ে কালো কেডস পড়েছে। আফরা জানতো ফর্সা মানুষদের নাকি কালোরঙে চমৎকার মানায়। তবে শ্যামবর্ণের মানুষদের ধূসর আর সাদা রঙের সংমিশ্রনে এতটা দুর্দান্ত লাগে ফারহানকে দেখে তা আয়ত্ত করে নিলো সে।
গতরাতের ওদের কাটানো মুহুর্তগুলোর কথা মনে পড়ে লজ্জাও লাগছে বেশ। ইসস! তখন ওরকম করে না বললেই মনে হয় ভালো হতো। সকল অস্বস্তির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আফরা এগোলো ফাহিম আর ফারহানের উদ্দেশ্যে। মুচকি হেসে বলে ওঠলো,
-গুড মর্নিং এভরিওয়ান!
-মর্নিং!
প্রতিউত্তরে বললো ফাহিম। তবে ফারহান নিশ্চুপ। আফরার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ফারহানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো আফরা। নিজেকে দেখে নিলো একপলক। না! সবকিছু তো ঠিকই আছে। তবে মানুষটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো? আফরা তাই সরাসরি প্রশ্ন করলো,
-এনি প্রবলেম ফারহান? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?
-আপনিও কি মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছেন আমাদের সাথে?
ফারহানের কাট কাট প্রশ্ন। ফাহিম হঠাৎ ফারহানের এরূপ আচরণে অবাক। তাই বিষয়টা সামাল দেওয়ার জন্য বললো,
-ওহ! তোমায় বসতে ভুলে গিয়েছিলাম। আফরাও আসলে আমাদের সাথে মর্নিং ওয়াকে যাবে।
ফারহান আবার নিজের বড় বড় চোখ দিলে পর্যবেক্ষণে করে নিলো আফরাকে। এই দৃষ্টিতে কোনো অশ্লীলতা না থাকলেও একরাশ তীব্রতা ছিলো। একজন বাঙালি মেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিব্রত হয়ে পড়ে এমন দৃষ্টিতে । তবে আফরার মধ্যে এমন কোনো বিষয় লক্ষ করা গেলো না।সে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়ভাবে। বেশ কিছুক্ষণ মৌনতা কাটানোর পর আফরা বিরক্তি নিয়ে ফারহানকে বললো,
-গতকাল আমি আপনাকে এভাবে দেখছিলাম বলে কেমনটা করেছিলেন। এবার আমায় এভাবে দেখছন কেন? খেয়ে ফেলবেন নাকি?
ফাহিম বোকার ন্যায় আফরা উদ্ভট কথার শুনে ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহান একটু অপ্রস্তুত হলেও সামলে নেয় নিজেকে। এই মেয়ে ভারি সাংঘাতিক। অন্য চার-পাঁচটা মেয়ের মতো লজ্জার ছিটাংশ এর মধ্যে নেই। যা বলে কাঠ কাঠ গলায় বলে ফেলে। এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার নিজের কথা দিয়ে ফারহানকে বাকশূণ্য করে ফেলেছে আফরা যা এই রাজনীতির জীবনে অন্য কেউ করতে পারেনি। আর এই ভিনদেশী মেয়েতো অন্যরকম।
-আপনি কাইন্ডলি আপনার টপসটা চেন্জ করে আসুন।এটা বাংলাদেশ। আপনি চাইলেই স্লিভলেস টপস পড়ে যেখানে সেখানে মর্নিং ওয়াক করতে বেরোতে পারবেন না।
মৃদু গলায় বলে ওঠলো ফারহান। মনোহরী চোখের প্রখর দৃষ্টি এখনও নিবদ্ধ করে রেখেছে আফরার দিকে। আফরা অল্পবিস্তর অবাক হয়ে নিজেকে পরখ করে নিলো পুনরায়। মর্নিং ওয়াকের জন্য বরাবরের মতো ট্রাউজার আর স্লিভলেস টপস পড়েছে। ফারহানের কথাটি অজান্তেই ইগোতে লেগেছে ওর। অপমানে থমথম করছে ওর মুখখানা। দাঁতে দাঁত চেপে এবার বললো,
-টপস না পড়লে পড়বোটা কি শুনি?
-হাফ হাতা টিশার্ট পড়ুন।
-আমার সব টিশার্ট লন্ড্রিতে দিয়েছি আজ। যদি জানতাম যে আপনার জন্য স্লিভলেস টপস পড়তে পারবো না তবে আগেই আর এখানে আসতাম না।
আফরার রাগ লাগছে প্রচন্ড। এককথায় রাগে শরীর রি রি করছে। ওর কোনো কাজে বাঁধা দেওয়াটা কখনোই সে পছন্দ করেনা। আর এই অসভ্য মানুষটা কিভাবে ইনডাইরেক্টলি ওকে বাধা দিলো। ফারহান বুঝতে পারলো না এখানে রাগ করার মতো কি আছে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে তাই বলে ওঠলো, ‘স্ট্রেইন্জ গার্ল!’
আফরা বাংলোর ভেতর ঢোকবে তখনই ফারহান ফাহিমকে বললো,
-ফাহিম ! তুমি এখানে দাঁড়াও আর আফরাকেও দাঁড়াতে বলো। আমি আসছি।
বলে নিজের ছোট কুটিরটির দিকে পা চালানো ফারহান। আফরাকে সরাসরি না বললেও ফাহিমকে বলাতেই আফরা দাঁড়িয়ে গেছে। দু’মিনিটের মধ্যে একটা ডার্ক চকলেট টিশার্ট নিয়ে আসলো ফারহান। আফরাকে তা ছুড়ে মারতেই আফরা তা ক্যাচ করে ধরে ফেললো। হঠাৎ এভাবে টিশার্ট ছুড়ে মারাতে আফরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। ফারহান পকেটে হাত গুজে শীতল গলায় বললো,
-পাঁচ মিনিটের মধ্যে এটা পড়ে আসুন। আমি আর ফাহিম গেটের কাছে অপেক্ষা করছি। জলদি!
আফরা কিছু বলতে যাবে ফারহান পা চালিয়ে চলে গেলো গেটের কাছে। ফাহিমও গেলো সাথে সাথে। আফরার ফারহানের কথাগুলো বুঝতেই সময় লাগলো বেশ। কপালে পড়েছে সামান্য ভাঁজ। উহ্! মানুষটা এমন কেনো? এতক্ষণ উল্টাপাল্টা কথা শোনালো আর এখন নিজেই ওর টিশার্ট পড়তে দিলো আফরাকে। ভাবতেই আফরার গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো অজান্তেই!!!
.
.
.
#চলবে……..ইনশাআল্লাহ!!
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।
.
.
#চলবে……..ইনশাআল্লাহ
নোটবার্তা: ঈদের ছুটি কাটাতে গ্রামে এসেছি আমি। তাই গতকাল উপন্যাসটি দিতে পারিনি।আজ তাড়াহুড়ো করে লিখাতে রিচেক করা হয়নি। তাই ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।
[কার্টেসী ব্যাতিত কপি করা নিষেধ]