অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব ১১+১২+১৩

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#কায়ানাত_আফরিন
#পর্ব_১১

ঘুম থেকে উঠার পরপরই আফরা অনুভব করলো আজ রুমটা প্রচন্ড ঠান্ডা। জানালা দিয়ে বাতাস বয়ে আসছে হু হু করে। আকাশটাও খানিকটা মেঘলা। আফরা তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে ওঠে পূব দিকের বারান্দায় গেলো। ঘড়ির কাটা তখন সাতটা ছুই ছুই। কিন্তু মেঘের আড়ালো রৌদ্র যেন হারিয়ে গিয়েছে। পুব আকাশটা ভারী অন্ধকার। হয়তো ভারতের সীমান্তে ঝমঝম করে বৃষ্টি চলছে। আফরা বুদ হয়ে রইলো বাড়িটার পেছনে গভীর ঢালটির দিকে। ওই ঢালে স্পষ্ট কাউকে দেখা যাচ্ছে। আৎকে উঠলো আফরা। এই সকাল সকাল ওখানে আবার কে?অল্পক্ষণ পরই সেই মানুষটার চেহারা দেখে মৃদু অবাক হলো সে। ফারহান আছে ওই ঢালটিতে। হাতে কোদাল। পরনে সাদা হাফ হাতা টিশার্ট, কোমড়ের কাছে বেধেঁ রেখেছে নীল চেক শার্ট। এমন ভয়ঙ্কর পথে ফারহান কি করছে? ছেলেটার কি নিজের জানের ভয় নেই?আফরা একবার ভাবলো ডাক দিবে পরক্ষনেই মত পাল্টে নিলো। এখান থেকে কথাবার্তা না বলে সরাসরি কথা বলাটাই ভালো হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আফরা তাই অল্প মুহূর্তেই ব্যবধানেই দাঁত ব্রাশ করে নিচে চলে গেলো।
ঘরের ভেতরে যেই ঠান্ডাটা না লাগছিলো বাইরে সেই ঠান্ডাটা আরও ব্যাপক লাগছে আফরার। ভেজা স্যাঁস্যাতে মাটিতে পা রাখতেই সে অনুভব করলো চা পাতার কড়ালো ঘ্রাণ। ছোট ছোট টিলার ওপর কার্পেটের ন্যায় আচ্ছাদিত চা পাতা চমৎকার লাগছে। আফরা দ্রুতপায়ে ঢালের দিকে গেলো। ইলা ওকে এখানে আসতে নিষেধ করলেও সেসব কোনো পরোয়া করলো না। ফারহানকে দেখতে পেয়ে চেচিয়ে বলে ওঠলো,

-ও হ্যালো মিঃ কমরেড!

স্নিগ্ধ প্রভাতের এই প্রহরে মেয়ের মিষ্টি কন্ঠে ‘মিঃ কমরেড’ নাম শুনে চমকে উঠলো ফারহান। শব্দের উৎস খোঁজার জন্য কোদাল ছেড়ে মাথা উচু করতেই দেখলো ঢালের একেবারে ওপর প্রান্তে আফরা দাঁড়িয়ে। ভ্রু জোড়া বাকিয়ে ফেললো ফারহান। এই মেয়ের হঠাৎ এখানে আসতে ওর স্নায়ু যেন কাজ করছে না। আফরাকে তাই সে প্রশ্ন করলো,

-‘আপনি? এত সকালে এখানে কি করছেন?’

ফারহান কল্পনাও করতে পারবে না যেই আফরা নামের এই মেয়েটা ওর গম্ভীর মুখে ‘আপনি’ সম্বোধনটা শুনলে ঠিক কতটা উৎফুল্ল হয়। কেন হয়, তা আফরার নিজেও অজানা। মেয়েটা শুধু এতটুকুই জানে যে ফারহানের আকর্ষণীয় কন্ঠনালি দিয়ে যখন ‘আপনি’ শব্দটা আফরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসে সেটা অনেক মনোমুগ্ধকর।ফারহান এখনও তাকিয়ে আছে আফরার দিকে উত্তরের আশায়। কিন্ত আফরা নির্বিকার। ফারহান ভাবলো এই ভয়ঙ্কর ঢালে দাঁড়িয়ে মেয়েটার সাথে কথোপোকথন চালানো বিপদজনক। পা ফসকে নিচে পড়লে জান যাওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই আর যদি বর্ডারের কাছে ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীরা ওকে দেখে ফেলে সাথে সাথেই শ্যুট করে খাল্লাস!তাই ওপরে উঠে এলো ফারহান।

আফরা এবার জিজ্ঞেস করলো,

-ওখানে কি করছিলেন আপনি?

-আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন যে আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবো?

ফারহানের সন্দিহান কন্ঠ। আফরা মুখ ছোট করে ফেললো। তারপর জড়ানো গলায় বললো,

-বারান্দা দিয়ে আপনাকে ওখানে দেখেছিলাম। তাই কৌতুহল দমাতে না পেরে এখানে আপনাকে দেখতে এসে পড়ি।

আফরার কথায় বিব্রত হয়ে গেলো ফারহান। মেয়েটা কত স্বতস্ফূর্তভাবেই না বলে ফেললো ওর মনের কথা যে ফারহানকে দেখার জন্যই সে এখানে এসেছে। ফারহান অগোচরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েটা অন্যরকম। কথাবার্তায় কোনোরূপ কোনো জড়তা নেই, সবকিছুতেই প্রণোচ্ছলতার ভাব। ফারহান এখনও জানে না আফরার সম্পূর্ণ পরিচয়। আর এই মেয়েটা দুদিনের মধ্যেই ওর সব তথ্য জোগাড় করে ফেলেছে। ফারহান এবার বললো,

-আমার প্রতি আপনার এতই ইন্টেরেস্ট যে আধঘুমেই সাত সকাল এখানে চলে এলেন?

-হুম। তো বলুন ! কি করছিলেন ওখানে?

আফরার সহসা উত্তর শুনে ঠোঁট টিপে হাসলো ফারহান। তারপর বলে ওঠলো,

-বর্ষার মৌসুম তো, তাই পানি নামানোর জন্য নিচে রাস্তা করে দিচ্ছিলাম। নাহলে এখানে পানি জমে গেলে নিচের থেকে জোঁক এসে পড়ে।

-জোঁক?

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আফরা। ফারহান সাথে সাথেই বললো,

-হ্যা জোঁক। শুধু জোকঁ না এখানে অজগর সাপও আসে মাঝে মাঝে। আপনি আসার দু’দিন আগে এই এলাকার লোকরা সীমানাপ্রাচীরের সামনে অজগর মেরে এসেছিলো।

আফরার চোখ মুখ কিছুটা গম্ভীর, এককথায় প্রতিক্রয়াহীন। ফারহান বুঝতে পারলো না যে আফরা আদৌ ভয় পেয়েছে কি-না। তবুও আগ বাড়িয়ে সে বললো,

-তবুও আপনার ভয় পাওয়ার সমস্যা নেই। চাচু আগেই আমায় দিয়ে এখানে কার্বোলিক এসিড ছিটিয়ে দিতে বলেছিলো যাতে সাপ ত্রিসীমানায় আর না আসে। সুতরাং ভয় পাবেন না।

-আপনি নিশ্চিত যে কার্বোলিক এসিড দিলে সাপ আসেনা?

আফরার নির্লিপ্ত প্রশ্ন। কথা আটকে আসলো ফারহানের । তাই জিজ্ঞেস করলো,

-হঠাৎ এ প্রশ্ন করলেন যে?

আফরা ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে মলিন হাসলো। তারপর বলা শুরু করলো,

-এনাকন্ডা মুভি দেখেছিলেন?সেখানে সাপ আসাতে সবাই অনেক কার্বোলিক এসিড ছিটিয়েছিলো কিন্ত কোনো লাভ হয়নি। তাই কার্বোলিক এসিড ছিটালে যে সাপ চলে যায় এটা ভ্রান্ত ধারনা। তবে এটা সত্যি এর স্মেল সাপ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেনা।

-তা নাহয় হবে।আমরা শ্রীমঙ্গলের মানুষ এ সাপ জোঁকের ব্যাপারে অভ্যস্ত। আপনি না। তবুও টেনশন নেয়ার দরকার নেই। বাড়ির দোতলায় সাপ জোঁক ওঠবে না।

-আর আপনার ক্ষেত্রে?

আফরার কথাটি বুঝতে পারলো না ফারহান । তাই অবাকস্বরে বললো,’মানে?’

-আপনি তো থাকেন ঢালের পাশে ছোট এই কাঠের নিচতলা ঘরে। আপনার যদি কিছু হয়ে যায়?

আফরার তটস্থ কন্ঠ। ফারহান বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো আফরার দিকে। ঘর্মাক্ত বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দটা ক্রমশই অনুভব করতে পারলো সে। এই প্রথম……..২৯ বছর বয়সের এই জীবনে দাদুর পর প্রথম কেউ ওর কথা চিন্তা করলো। তটস্থ কন্ঠে বললো,’যদি কিছু হয়ে যায়?’ ফারহানের কাছে আপন মানুষের ভালোবাসার অভিজ্ঞতা কম। তাই সদ্য কিছুদিন যাবৎ পরিচিত এই ভিনদেশি বাঙালি মেয়ে ছোট একটি কথা দ্বারা ফারহানের মনে কিরূপ প্রভাব ফেলেছে তা দুজনের কাছে যেন এক বিল্ময়। ফারহান মৃদু হেসে বললো,

-আমার আর কি হবে? এট এনি চান্স যদি কিছু হয়েও যায় তাহলে দেখার মতো কেউই নেই। কারন আমি মানুষটাই নিঃস্ব।

ফারহানের কথা শুনে ওর খানিকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো আফরা। সম্মোহনী দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে ফারহানের ক্লান্তিমাখা মুখটার দিকে। ফারহানের চুলগুলো এলোমেলো। হাতে সামান্য মাটি লেগে আছে। নাকের কাছে জমে আসে ঘাম। তবুও মানুষটা কি সুন্দর। ছেলেটার চওড়া বুকের ঘামে ভেজা টিশার্টটা সহসাই কাউকে আকর্ষণ করতে পারবে। আফরা গম্ভীর গলায় বললো,

-কেউ কখনও একা পৃথিবীতে আসে না। ওপরওয়ালা প্রত্যেক মানুষের জন্যই একজন না একজনকে না একজনকে পাঠায়। হয়তো আপনার সেই অজানা কেউ হুট করে এসে আপনার বুকে বাসা বেধেঁ ফেলবে। দূর হয়ে যাবে সেই সব নিঃসঙ্গতা!

আফরা শুধু দেখতেই সুন্দর না……কথাবার্তাও সুন্দর। একটা অন্যরকম টান আছে মেয়েটার মধ্যে। ফারহান আফরার সম্মোহনী কথার প্রতিউত্তরে কিছু বললোনা। তবে নিজের জীবনের এক গোপন বিষয় আবিষ্কার করলো ফারহান। ওর অবচেতন মনের ধারনা ছিলো যে সে হৃদয়হীন মানুষ। অনুভূতি, আবেগ এসব ফারহানের জন্য না। কিন্ত আফরা এসে ওর ধারনাকে ওলট পালট করে দিলো। অজান্তেই মেয়েটার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে ফারহান। অজান্তেই এই প্রথম রাজনীতির বাইরে একটা নতুন জগত আবিষ্কার করেছে।

আফরা হঠাৎ বললো,

-আপনি এমন কেনো?

-কেমন?

-এইযে গম্ভীর ধাঁচের। বেশ কয়েকদিন তো হয়েই গেলো আপনাদের এখানে আমি এসেছি অথচ আপনি আমার সম্পর্কে কিছুই জিঙ্গেস করলেন না। আর না আপনার হন্টেড হাইসে আমায় দাওয়াত দিয়েছেন।

-হন্টেট হাউস?
ফারহানের চোখ-মুখে বিস্ময়। আফরা বিরক্ত হলো ফারহানের মুখে বিস্ময় দেখে। তাই একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে বললো,,,,,,

-নাহলে কি বলবো হ্যাঁ? ভালো করে দেখুন। অনায়াসেই এখানে একটা হলিউড মুভির শুটিং করা যাবে।

-আই সি। তো কি করতে পারি আপনার জন্য মিস আফরা?

ফারহানের বিদ্রুপ কন্ঠ। আফরা মেকি হেসে বললো,

-বেশি কিছু না। জাস্ট আজ রাতে আমায় ডিনারের জন দাওয়াত দিবেন। আর আপনি তো আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আমার মনেও হয়না যে আপনার জানার বিষয়ে কোনো আগ্রহ আছে। তাই ডিনারের সময় আমি নিজ থেকে আমার সম্পর্কে আপনার কাছে সব বলবো।

-সব?

-জ্বি হ্যাঁ।তো সারাদিন মানুষের সেবা করুন মিঃ কমরেড। রাতে কিন্ত এই অতিথির অ্যাপায়ন করতে হবে।

ফারহান ঠোঁট চেপে হাসলো এবার। মাথা দুলিয়ে বললো,’ঠিক আছে।’

শীতল বাতাস। বাতাসের তালে মাথার ওপর ধূসর মেঘের আস্তরণ সাঁ সাঁ করে ছুটে চলতে মগ্ন। এসকল দৃষ্টি নান্দনিক দৃশ্য থেকেও আফরার কাছে অপরূপ লাগলো ফারহানের ঠোঁট চাপা হাসি। উহ ! ডিনার না বলে ব্রেকফাস্ট বললেই মনে হয় ভালো হতো। তাহলে আরও কিছুক্ষণ মানুষটার সৌন্দর্য হয়তো উপভোগ করা যেতো।
.
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#পর্ব_১২
#কায়ানাত_আফরিন
ফারহানের সাথে কথা শেষ করে বাড়িতে প্রবেশ করতেই মিসেস নাবিলার মুখোমুখি হলো আফরা। খানিকটা সন্দিহান চোখে উনি তাকিয়ে আছেন আফরার দিকে। সময়বিলম্ব না করে আফরাকে প্রশ্ন করলেন,

-এত সকালে ওখানে কেনো গিয়েছিলে আফরা?ওই জায়গায় যে যাওয়া নিষেধ , ইলা তোমায় কিছু বলেনি?

ইলা বলেছিলো আফরাকে কথাটি । তবে সে কর্ণপাত করেনি। আফরা তাই বললো,

-আসলে আন্টি………ফারহানকে ওই ঢালের মধ্যে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তাই সেখানে চলে যাই কথা বলতে। এছাড়া আর কিছু না।

-বলো কি? ফারহান তো আমাদের ওর জায়গার ধারপাশেও ঘেষতে দেয় না। আর তোমায় কিছুই বলেনি?,,,,,,,,,স্ট্রেন্জ!

মিসেস নাবিলার তাচ্ছিল্যেভরা কন্ঠ। আফরা থেমে থেমে একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলো,

-উনার জায়গার ধারপাশে ঘেষতে দেয়না মানে?এগুলো সম্পূর্ণটা আপনাদের জায়গা না?

-সেটা নাহয় ফারহান থেকেই জিজ্ঞেস করে নিও।

আফরা মৌন থাকলো। মিসেস নাবিলার মনে ক্ষোভ থাকলেও প্রসঙ্গটি এড়িয়ে দিতে চাইলেন। তাই ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটিয়ে বললেন,

-এখন নাস্তা করবে…..?

-আসলে , আন্টি…….আমি এই সময়টা একটু বাইরে ঘুরতে যেতে চেয়েছিলাম।নাস্তা করেই যাবো তবে কেউ গাইড দিলে ভালো হতো। ফারহানকে বলবো কি না ভাবছি……..

মিসেস নাবিলার মনে একটি আশার সঞ্চার হলো। তাই উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠলো,

-ফারহান কেনো ,,,আমার ছেলে ফাহিম আছে না?আজ ওর অফ ডে। ব্রেকফাস্ট করে ওর সাথেই নাহয় সারাদিন ঘুরো।

আফরা সম্মতি জানালো । ওর কাছে ঘুরাটাই মুখ্য। ফারহান বা ফাহিম কে আসবে এ নিয়ে ওর মনে কোনো মাথাব্যাথা নেই। তবে মিসেস নাবিলার এ নিয়ে প্রচন্ড সমস্যা আছে। তিনি কিছুতেই ফারহান আর আফরার এত মেলামেশা মেনে নিতে পারছিলেন না।আফরা মেয়েটাকে তিনি মনে মনে পছন্দ করে রেখেছেন ফাহিমের জন্য। একে তো মেয়ে অ্যামেরিকার সিটিজেন। ফাহিমের সাথে বিয়ে হলো ফাহিম আর ইলা দুজনেরই ভবিষ্যত উজ্জল হয়ে যাবে। তবে এসব ভাবনা তিনি একান্তেই মনে পুষে রেখেছেন। তিনি আগে চাইছেন যে ফাহিম আর আফরা একান্তে কিছু সময় কাটাক, তবে বাঁধ সেজেছে ফারহান। এই কিছুদিনে ফারহান আফরার সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলছে মিসেস নাবিলার মনে হয়না ফারহান আদৌ কোনো মেয়ের সাথে এতটা সময় কাটিয়েছে। আর যাই হোক , ফারহান সম্পত্তির ভাগ নিয়ে জিতলেও এবার মিসেস নাবিলা আফরার ক্ষেত্রে কোনো হেলফেল করবে না।

——
ব্রেকফাস্ট শেষে আফরা রেডি হয়ে নিয়ে এসে দেখলো ফাহিম সোফায় বসে আছে। আগের মতো ফর্মাল লুক নেই। একটা চেক টিশার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স। গলার কাছে সানগ্লাস ঝুলছে। আফরাকে দেখেই সে হাসি ঝুলিয়ে বললো,

-তো…….রেডি মিস?

-হ্যাঁ।

-চলুন তাহলে। আগে বলুন তো , আপনি কোথায় যেতে চান?

-বিডিতে আমি থাকি নাকি আপনি থাকেন,,,,,,, যে জায়গার না ভালোমতো বলতে পারবো?

ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো আফরা। বিনিময়ে ফাহিম বিদ্রুপ হাসি হাসে। ফর্সা মুখে হাসিটা আবছা ভাবে ফুটে ওঠেছে। আফরা একমনে ফাহিমের দিকে তাকিয়ে থাকলো। অজিন্তেই ফাহিমের চেহারাটি এরিকের সাথে মিলে যায়। পার্থর্ক্য একটাই, এরিকের আই লেন্স ব্লু আর ফাহিমের ব্ল্যাক। ফাহিম আফরাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,

-এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?

-আপনার চেহারা আমার ফ্রেন্ড এরিকের মতো।

আফরার কাট কাট উত্তর। ফাহিম চোখ ছোট ছোট করে বললো,

-শুধুই ফ্রেন্ড নাকি বয়ফ্রেন্ড?

-উহু! জাস্ট ফ্রেন্ড।তবে সে আমায় ভালোবাসত। ইভেন এখনও বাসে। তবে আমার মনে ওর প্রতি কোনো ফিলিংস না থাকায় আর এগোয়নি।

ফাহিম মলিন হাসলো। আফরা মেয়েটাই এমন যাকে সহজেই সবাই পছন্দ করতে পারে।

-তো চলুন তাহলে। আজকে একটু দূরে হোটেল সাইটে যাই। সেখানে অনেক সুন্দর সুন্দর ভিউ পয়েন্ট আছে। ঘুরাঘুরি শেষে লাঞ্চও সেড়ে আসতে পারবেন কোনো অ্যামেরিকান রেস্টুরেন্ট থেকে।

আফরার চোখ চকমক করে ওঠলো। এখানে কিছুদিন যাবত বাঙালি খাবার খেয়ে ভালো লাগলেও এগুলোতে সে অতটা অভ্যস্ত না। মুচকি হেসে এবার বললো,

-আচ্ছা তাহলে বের হই।

——–

আকাশে রৌদ্রের ছটাক নেই বললেই চলে। ধীরে ধীরে কালো মেঘগুলো পূর্ব দিকে ঘনীভূত হচ্ছে। কালো রঙের প্রাইভেট কার এগিয়ে চলছে ভিউ পয়েন্টের দিকে।আফরা গাড়ির কাচ নামিয়ে দিলো এবার। গাড়ির হিমশীতল এসির হাওয়া থেকে প্রকৃতির ঠান্ডা বাতাস ওর গায়ের লোম তুলে দিচ্ছে। আহা! এ যেন এক অনাবিল সৌন্দর্য। আফরা পূব দিকে তাকিয়েই ফাহিমের উদ্দেশ্যে বললো,

-সকালেও দেখেছিলাম ওখানে এত মেঘ জমে থাকতে। এখনও সরছে না যে?

-কারন ওই সাইটে ভারতের চেরাপুঞ্জি নামের একটা বিখ্যাত এরিয়া আছে। বলা বাহুল্য সাউথ এশিয়ায় গড়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় চেরাপুঞ্জিতে । তারপর হলো শ্রীমঙ্গল।

-সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকার এটাই একটা মজা। একাধারে দু দেশের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

ফাহিম মুচকি হেসে গাড়ির গতিপথ পাল্টে নিলো এবার। চা বাগানের ঢাল দিয়ে আকাবাকা পথগুলোর বাকে ভালোলাগছে অনেক।মাঝে মাঝে বিশাল বড় বড় গাছের কয়েকটি বন দেখা যাচ্ছে। আফরা সেই সৌন্দর্যে বুদ হয়ে ফাহিমকে প্রশ্ন করলো,

-ফাহিম এটা কি?

-কাঠবন।

-বাহ! কাঠবন তো বেশ চমৎকার। আচ্ছা, অন্যবন আর কাঠবনের পার্থক্য টা কেমন যেন বুঝলাম না। বিস্তারিত বলেন তো!

ফাহিম ঠোঁট ভিজালে মৃদুভাবে। আফরার দিকে তাকিয়ে ছোট প্রতিউত্তরে বললো.

-কাঠবন তো কাঠবনই । এর থেকে বেশি আর কি ডিসক্রাইবলি বলবো?

মনক্ষুন্ন হলো আফরার। ফাহিমের কাছ থেকে এমন প্রতিউত্তর সে আশা করেনি।আফরা ঠোঁট কামড়ে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো। ফাহিম মজার মানুষ হলেও প্রকৃতি আর ভ্রমণপিপাসু বিষয়টা ওর মধ্যে নেই। আফরার একবার মনে পড়লো ফারহানের কথা। ফারহান মানুষটা গুরুগম্ভীর বটে , তবে তার সাথে কথাবার্তায় আফরা এক অনাবিল শান্তি অনুভব করে।

মোবাইলের রিং বাজাতে আফরার ভ্রু কুচকে এলো। স্ক্রিনে ওর মম এর নম্বর ভেসে ওঠছে। আফরা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো এতে। এতদিন পর তাহলে ওর কথা মনে পড়েছে। আফরা কল কেটে মেসেজ করে দিলো,’বাইরে আছি মম! এখন কল দিও না।’

টেক্সটটা সেন্ড করেই আফরা মোবাইল ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। মম এর কথা বিন্দুমাত্র ভাবতে চায়না সে।

——
ফারহানের মাথাটা যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে। কপালের রগ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে রইছে।ফারহানের এই অবস্থা দেখে ওর বিশ্বস্ত দুই মানুষ শামসু আর সাব্বির চুপ হয়ে রইলো। শুকনো ঢোক গিলছে বারবার।
কিছুক্ষণ আগে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এক নেতার লোকের সাথে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে ফারহানের। বিষয়টা ছিলো সরকারের টাকাকে কেন্দ্র করে। এবার বৃষ্টিপাতের হার বেশি থাকাতে সমগ্র সিলেটে বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই প্রত্যেক গ্রামপ্রধান সরকারের কাছে আবেদন করেছে টাকার জন্য যাতে বাঁধ বাধিয়ে পানি নিয়ন্ত্রনে আনতে পারে। সেই টাকা নিয়ে জালিয়াতি করেছে ইউনিয়ন পরিষদের লোকজন। বাজেটের তিনভাগের একভাগ ব্যয় করে বাকি দুইভাগ নিজেরা গ্রাস করে নিয়েছে। ফারহানের কানে এ ব্যাপারে দুটো কথা আসতেই ফারহান প্রতিবাদ করতে গেলো। অতঃপরই শুরু হলো সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে ফারহানকে শামসু আর সাবহবির টেনে হিচড়ে নিয়ে আসে। কেননা ফারহানের বিরুদ্ধে অলরেডি স্টুডেন্ট স্ট্রাইকের জন্য চারটা কেস পড়েছে। আরকেটা কেস পড়লে পুলিশ এবার ওকে জেলে ঢুকিয়েই নিস্তার পাবে।তাই ফারহানকে নিয়ে এলো তারা। এবার ফারহান গাড়ির পেছনের সিটে শরীর এলিয়ে বসে আছে। ড্রাইভিং সিটে রয়েছে সাব্বির আর পাশে শামসু।শামসু তটস্থ গলায় বললো,

-ভভ-ভাই আপনি শান্ত হন। ওই বদমাশ নেতাগুলার লেইগা আপনি চেইতা আছে ক্যান? মানুষগো দিয়ে ওগুলারে মাইরা আমি শান্ত হোমু। শালা খবিসের বাচ্চা কোথাকার!

বিরক্ত হলো ফারহান। তাই শান্ত গলায় বললো,

-আমার সামনে অকথ্য ভাষা ব্যবহার করবে না শামসু।

শামসু নীরব হয়ে গেলো। সাব্বির এবার বললো,

-আচ্ছা ভাই আপনারে ঠান্ডা করবার জন্য এক জায়গায় নিয়া যাই।বিলাতি হোটেল। খাওনের যেই স্বাদ,,,, আঙুল খাইয়া ফেলতে ইচ্ছা করে। আমি আপনারে খাওয়াবো নে।

ফারহান হ্যাঁ না বলার আগেই সাব্বির গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে গেলো সেখানে।

—–
আজ অনেকদিন পর বিফ স্টেক মুখে দিয়েছে আফরা। যদিও স্বাদ একদম নিউ ইয়র্কের সেই বিফ স্টেকটার মতো হয়নি তবে এত মন্দও হয়নি। আরামে খাচ্ছে সে। সামনেই মুখোমুখি বসে আছে ফাহিম। ও অ্যামেরিকান হোয়াইট পাস্তা খাচ্ছে। আশেপাশে অনেক ট্যুরিস্টদের সমাগম। ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট না হলেও বেশ জনপ্রিয় আর এদের সার্ভিসও ভালো। আফরা এক বাইট নিয়ে ফাহিমকে বললো,

-লাঞ্চটা কিন্ত দুর্দান্ত হয়েছে। থ্যাংক ইউ ফর ইউর ট্রিট।

এরই মধ্যে একই রেস্টুযেন্টে প্রবেশ করলো সাব্বির শামসু আর ফারহান। দুপুর টাইম হওয়াতে একটু চাপটা বেশি। এককোণে খালি পেয়ে তিনজন সিটে বসে পড়লো। অর্ডার দিলো সাব্বির। ফারহান সেগুলো পরোয়া না করে মোবাইলে কার সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলাপণে মশগুলো।হঠাৎ সাব্বিরের চোখ গেলো হেসে ওঠা এক সুন্দরী রমনীর ওপর। দাঁত কেলিয়ে সে বললো,

-ওই শামসু! মাইয়্যাটা সুন্দর না!

শামসুও তাকালো সেদিকে। সেও জোর লাগিয়ে বললো,
-আসলেই তো! হাসি তো ঝইড়া পড়তেসে।

ফারহান এসব কথা বরাবরই এড়িয়ে চলে। চোখ গরম করে সে বলে ওঠলো,

-এখানে এসব লেইম কাজ করার জন্য আসছো স্টুপিট?চুপচাপ বসো…….

-আরে ভাই! আপনি একবার দেখেন তো।

ফারহান সেখানে তাকাতেই অবাকের প্রান্তে পৌছে গেলো। চোখ ছোট হয়ে এসেছে ক্রমশ। আফরা আছে সেখানে। একটা ছেলে সাথে আছে। ওর চেহারা সাব্বির-শামসু কেউই দেখেনি। তবে ফারহান নিশ্চিত এটা ফাহিমই হবে। ফারহান বিড়বিড়িয়ে বললো,’আফরা এখানে হঠাৎ কি করে?’
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#কায়ানাত_আফরিন
#পর্ব_১৩
ফারহানকে হঠাৎ সেই মেয়ের দিকে এতটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখজোড়া ক্রমশ যেন ছোট হয়ে আসলো সাব্বির আর শামসুর। কেননা ফারহানের এমন দৃষ্টির সাথে দুজনেই অপরিচিত। বলা বাহুল্য , ফারহান গম্ভীর ধাঁচের মানুষ। নিজের কাজে আত্ননিয়োগ করতেই ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মানুষদের প্রতি নজর দেওয়ার মতো ফুরসত যেন এই সুদর্শন যুবকটির নেই। শামসু সন্দিহান কন্ঠে সাব্বিরকে বললো,

-এই সাব্বির! ভাইয়ের কি হইলো আবার?

-কে জানে?আমি নিজেও তো বুঝতেসি না।

আফরা তখন এখানকার সব জনপ্রিয় খাবারগুলোর বিষয় নিয়ে ফাহিমের সাথে মশগুল ছিলো। হঠাৎ এক কোণে চোখ পড়তেই আফরার আলাপচারিতা বন্ধ হয়ে যায়।এত শোরগোল আর এত মানুষের ভীড়ে মানুষটার অবাকমিশ্রিত তীক্ষ্ণ চাহিনী সহজেই নজর কাড়ার মতো। মানুষটা ফারহান। শ্যামবর্ণের গায়ে কালো শার্টের আবরণ , উপরের দুটো বোতাম খুলে সানগ্লাস ঝুলিয়ে রেখেছে। হাতে মোটা বেল্টের খয়েরি ঘড়ি,আর বরাবরের মতোই কানে ব্লুটুথ ইয়ারফোন। ঠোঁটকোলের স্মিত হাসি আর এমন রূপ দেখে আফরা অনুভব করলো ওর বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দ যেন ক্রমশই বেড়ে চলছে।ফাহিম আফরাকে এতটা অন্যমনষ্ক হতে দেখে বললো,

-এনি প্রবলেম আফরা?

ফাহিমের কথার দিকে আফরার ধ্যান নেই। সে বিস্ময় নিয়ে ফারহানের উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে ‘হ্যালো’ বলে। এদিকে দুদিকে বসে থাকা শামসু আর সাব্বির তো খুশিতে আটখানা। দাঁত কেলিয়ে শামসু সাব্বিরকে বললো,

-ঐ সাব্বির দেখ ! মাইয়্যাটা আমায় ‘হ্যালো’ বলসে…….

-আরে না। আমারে হ্যালো বলছে সে। তোর যেই চেহারা……তোরে ভালোমতো দেখলে তো মাইয়্যা ডরে পালাইবো।

ঠোঁট টিপে হাসলো ফারহান। দুজনের কথাবার্তা শুনে চোখে-মুখে ব্যাঙ্গাত্নের ছাপ। এই গর্দেভ দুটো বুঝতে পারিনি যে অপরূপ সুন্দরী এই মেয়েটি ফারহানের উদ্দেশ্যে সম্বোধন করেছে। তবুও ফারহান কিছু বললো না। সেও ঠোঁট চেপে হাত নাড়িয়ে অভিবাদন জানালো আফরাকে যা সাব্বির-শামসু খেয়াল করেনি আফরার দিকে তাকিয়ে থাকার কারনে।

আফরার হাত নাড়ানো দেখে পেছনে ফিরলো ফাহিম আগন্তুকটিকে দেখার জন্য। সেখানে ফারহানকে দেখে সেও স্মিত হাসলো। প্রফুল্লস্বরে বললো,

-আরে ফারহান ! তুমি এখানে হঠাৎ?

-লাঞ্চ করতে এসেছিলাম।

ফারহানের শীতল প্রতিউত্তর। এদিকে আফরা নামের অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটার সাথে ফারহানের ছয় মাসের ছোট কাজিন ফাহিমকে দেখে মুখ কালো হয়ে গেলো শামসু আর সাব্বিরের। সাব্বির হাহাকার করে বললো,

-ইয়া মাবুদ! এই ছোকরা এদিকে কি করে?

-ওই আস্তে বল…….ফারহান ভাই যদি শোনে , তুই ফাহিম ভাইকে ছোকরা কইছস , তোরে ধইরা পিটাইবো।

ফিসফিস করে বললো শামসু।ফাহিম কিছু বলার আগেই আফরা মৃদু স্বরে ফারহানকে বললো,

-যদিও আমাদের লাঞ্চ শেষ পর্যায়ে,,,,,,,,,আপনিও চাইলে জয়েন হতে পারেন ফারহান।

-ইটস ওকে। আমরা এখানেই ঠিক আছি।

হঠাৎ শামসু-সাব্বির ফিসফিসিয়ে বললো,
-ভাই না কইরেন না। এত সুন্দর মেয়ে আপনাকে লাঞ্চের জন্য ডাকছে আর আপনি?আমি থাকলে সাথে সাথেই রাজি হয়ে যেতাম।

ফারহানের মজা লাগছে ওদের এমন কান্ড দেখে। যদি এই দুই সাগরেদ জানে যে আফরা মেয়েটা আজ ওর বাসায় ডিনার করতে আসবে তবে তো পাগলই হয়ে যাবে। তবুও ফারহান মৌনতা কেটে বললো,

-ঠিক আছে। আপনার কথা রাখলাম আফরা।

-থ্যাংক ইউ। আর এইযে,,,,,,দুই সিপাহী!আপনারাও আসেন।

শামসু আর সাব্বিরের খুশি আর দেখে কে। তারপর কথামতো ওরা তিনজন বসে পড়লো ফাহিম আর আফরার সাথে। আফরা লাঞ্চ শেষ করে ডেজার্ট হিসেবে একটা চীজ কেক অর্ডার দিলো। ফারহান কথাবার্তা না চালিয়ে লাঞ্চ করছে শান্তভাবে। ফাহিম এবার ফারহানের উদ্দেশ্যে বললো,

-তো ফারহান! ইদানীং তো দেখাই যায় না তোমায়। দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

-এজ অলয়েজ যেমন যায়।

-স্ট্রাইক নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি?

কথাটি একটু আস্তে বললো ফাহিম যাতে আফরা নজর দিতে না পারে। ফারহান বুঝতে পারলো ফাহিমের চিন্তিত হওয়ার কারন। ব্যস্ততার জন্য খুবই কম কথা বলার সময় পায় ফাহিম আর ফারহান। বাড়িতেও পারিবারিক সংঘর্ষ আর মিসেস নাবিলার ক্রোধের শিকার হয়ে দুজন কথা বলতে পারে না। স্ট্রাইক বা অন্য কোনো ঝামেলা হলে ফারহান প্রায়ই আঘাতপ্রাপ্ত হয়…দিনের সময়ে ফারহান অনায়াসে ফাহিমের চেম্বারে গেলেও মধ্যরাতে ফারহানকে জানালা টপকে ফাহিমের ঘরে যেতে হয়। সেরাত স্ট্রাইকে পুলিশের আঘাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ফারহান জানালা টপকে ফাহিমের কাছে আসতে চেয়েছিলো কিন্ত দেখা হয়ে যায় আফরার সাথে। ফাহিম হয়তো কোনোভাবে জেনে গিয়েছে যে সেরাতে ফারহান আঘাত পেয়েছিলো। তবে আফরার কথাটি এড়ানোর জন্য ফারহান শীতল কন্ঠে বলে,

-রিলেক্স ফাহিম। আমি সেরাত ডক্টরের কাছে চলে গিয়েছিলাম।

ফারহানের কথা শুনে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো ফাহিম।মাঝে মাঝে নিজের মায়ের অদ্ভুত সব কাজকর্মের জন্য এই মানুষটার সঙ্গে দুরত্ব হয়ে গিয়েছে ওর। এতটাই দুরত্ব…….যা কখনোই কাটিয়ে তোলা যাবে না।
.
.
লাঞ্চ সেড়ে সবাই বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে।দুপুরের কড়া প্রহর ঢলে বিকেল নেমেছে। তরতাজা বাতাসের সমন্বয়ে মোহময় পরিবেশ। ফারহান মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আমি তাহলে এবার আসছি…..

-কোথায় যাচ্ছো ফারহান?
ফাহিম জিজ্ঞেস করলো।

ফারহান মৃদু প্রতিউত্তরে বললো,
-ব্যাংকে যাচ্ছি টাকা তুলতে।

ফাহিম এবার আর কিছু বললো না ফারহানকে। আফরার উদ্দেশ্যে বললো,

-তো চলুন এবার। আপনাকে বাসায় ড্রপ করে চেম্বারে চলে যাবো।

-ওকে। আপনি পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে আসুন। আমি এখানেই দাঁড়াই।

ফাহিম তাই চলে গেলো গাড়ি আনতে। সাব্বির আর শামসুও ইতিমধ্যে সেখানে গিয়েছে। রেস্টুরেন্টের এক কোণের এই ভিউ পয়েন্টটি এককথায় চমৎকার। দমকা বাতাসে আফরার খোলা চুলগুলো আলোড়ন সৃষ্টি করছে ফারহানের মনে। তবুও প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে। আনমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে সাব্বির আর শামসুর আসার অপেক্ষা করতে লাগলো। আফরা ঠোঁটে সুক্ষ্ণ হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। হাত জোড়া পেছনে আকড়ে বারবার দেখছে ফারহানকে। একপর্যায়ে ধৈর্যহীন হয়ে বললো,

-এইযে মিঃ কমরেড?

জনসমাগমে আফরার এভাবে কমরেড ডেকে ওঠাতে ফারহানের চোখজোড়া ক্রমশ সুক্ষ্ণ হয়ে এলো। তাই মোবাইল পকেটে গুজে তীক্ষ্ণ গলায় বললো,

-এভাবে সবার সামনে কমরেড ডাকার মানে কি?

-তো কমরেড কে কমরেড বলবো না তো কি অন্যকিছু বলবো? যদিও আপনার আরেকটা আছে। রেইনকোর্টম্যান!

আফরার চোখেমুখে দুষ্টু হাসি। ফারহান হাল ছেড়ে দিলো। এই মেয়ের সাথে কথায় পেরে ওঠা বড়ই দুষ্কর । আফরা এবার কিছু একটা ভেবে এগিয়ে এলো ফারহানের কাছাকাছি। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,

-রাতে কিছু আপনার হন্টেড হাউজে আসছি মিঃ কমরেড।

ফারহানের মেরুদন্ড দিয়ে যেন ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো আবার। হৃদস্পন্দন ক্রমশই যেন বেড়ে যাচ্ছে। ফাহিম গাড়ি নিয়ে আসাতে আফরা মৌনভাবে চলে গেলো এবার। যাওয়ার আগে ফারহানের দিকে তাকিয়ে গেলো একপলক। ফারহান স্মিত হাসে আফরার এমন কাজে।

——–
চারিদিকে নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার। ওপাশের বাশঝাড় থেকে কেমন যেন ভুতুড়ে শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে। দরজাটা খোলা রেখেছে ফারহান। তাই পূব দিকের হাওয়া দরজা বরাবর বারি খেতে মগ্ন। পর্দা উড়ে চলছে হালকাভাবে। ফারহান নিজের দৈনন্দিন কাজ শেষ করে দ্রুত বাড়ি ফিরে এলো আজ। একটা ঠান্ডা গোসল সেরে জলপাই রঙের টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার পড়ে নিলো। ফারহান যদিও গোছালো মানুষ তবুও অতিথি আসবে বসে দুই রুমের এই ছোট ঘরটি আবার গুছিয়ে নিলো।রাতের খাবারের জন্য রান্না করেছে অনেক ধরনের খাবার। ফারহান জানেনা যে আফরা বাঙালি খাবারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে কি না তাই সে ইটালিয়ান ফুড রান্না করলো। টমইয়াম স্যুপ সাথে বেড ক্রাম্ব আর ইটালিয়াল রেড সস পাস্তা। আজ একা থাকে বলেই এত ধরনের রান্না জানে সে। হঠাৎ মিসেস নাবিলাকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করলো এই প্রসঙ্গের জন্য।

-আসতে পারি মিঃ কমরেড?

মেয়েলি সুরে পিছনে ফিরে দরজার দিকে তাকালো ফারহান। আফরা দাঁড়িয়ে আছে। একটা হালকা গোলাপি রঙের কূর্তি পড়াতে সুন্দর লাগছে তাকে। ফারহান মৃদু হেসে বললো,

-অবশ্যই।

আফরা প্রবেশ করলো ছোট্ট কুটিরটিতে। ওর নিজের ভাষায় যেটাকে বলে হন্টেড হাউস।ফারহান টিশার্টের ওপর এপ্রোন পড়ে আছে। রোদে পোড়া সবল শ্যামবর্ণের চেহারা। শক্ত চোয়াল। ঘামের কারনে কপালে কালো নরম চুলগুলো দূর্বাঘাসের মতো লাগছে। আফরার মন উথাল-পাতাল করছে এমন অবর্ণণাতীত সৌন্দর্য দেখে। অজান্তেই মানুষটার চুলগুলোতে হাত ছোয়ার মতো ভয়ঙ্কর ইচ্ছে চলে আসছে বারবার। ফারহান আসলেই নিঃসন্দেহে ভীড়ের মাঝে এক নজর কাড়ার মতো ব্যাক্তিত্ব। ভাবতেই আফরার মনে এবার অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে থাকলো।

.
.
.
.
#চলবে……..ইনশাআল্লাহ

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here