অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব ৩৩+৩৪

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#পর্ব____৩৩
#কায়ানাত_আফরিন
-‘তোমার নাম রৌশিন না হয়ে বুকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া রৌদ্রময়ী রাখলে ভালো হতো৷ এই মেয়ে! তোমায় দুদিন ধরে কল দিচ্ছি, আর তুমি কিভাবে পারো পাষাণের মতো আমার, এই ফাহিম এর আড়ালে থাকার চেষ্টা করতে?’

রৌশিন নিজের স্বাভাবিক বাকবুদ্ধি হারিয়ে স্তম্ভিত হয়ে ছিলো কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছে ও কোনো ঘোরে আছে। এতক্ষণ সে বাস্তব জগতে থাকলেও মোবাইলে ধরার পর সেই বহুদিনের প্রিয় মানুষটার তোলপাড় করা কন্ঠ শুনে সে অন্য এক জগতে হারিয়ে গিয়েছে। কাল্পনিক উপন্যাসে আয়নার অপর প্রান্তে যেমন একটা দুনিয়ার উপস্থিতি অনুভব করা যয় ঠিক তেমন। রৌশিনের মনে হচ্ছে ও ভুল শুনছে। এটা হয়তো ওর ভুল শোনা নয়তো অপর প্রান্তের মানুষটি ফাহিম নয়। তাই সে দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি কি আসলেই ফাহিম ভাই জনাব?’

অপর পাশে ফাহিম যেন অবাক হয়ে গেলো। প্রশ্ন ছুড়লো,

-কার এতো সাহস আছে আমারই ফোনে সে তোমার সাথে কথা বলার দুঃসাহস করবে?

-তাও ঠিক।

রৌশিন কথাটি বলে ওঠলো মিনিনিয়ে। তবুও ফাহিমের হঠাৎ এমন আচরণ ওর শরীরে অদ্ভুত অনুভূতির জানান দিচ্ছে। জ্বরও যেন বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। ফাহিমের এ কথাবার্তার সাথে রৌশিন অনভিজ্ঞ। মূলত স্কুল লাইফ থেকেই ফাহিমের প্রেমে নিমজ্জিত ছিলো রৌশিন , তবে তা সবার অগোচরে। কথায় আছেনা কিশোরী মন বড় ভয়ঙ্কর, রৌশিনের ক্ষেত্রেও কিশোরী মনে ফাহিমের প্রতি প্রথম প্রেমানুরাগ ওকে পাগলপ্রায় করে দিয়েছিলো। কথা নেই কারন নেই হুট করে মারুফকে নিয়ে সে স্কুলের পর ছুটে চলতো ইলার বাসায় শুধুমাত্র ফাহিমের সাথে দেখা করার জন্য। তবে ফাহিম বরাবরের মতোই ছিলো খুব মিশুক, হাসিখুশি ধরনের ছেলে। দাম্ভিকতা বা গম্ভীরতার লেশটুকু ওর মধ্যে নেই। নিজের কথা আর উন্নত ব্যাক্তিত্বের মাধ্যমে অনেককেই নিজের ধ্যানে টেনে নিতে পারার মতো অসীম ক্ষমতা ফাহিমের থাকলেও রৌশিন ওর প্রতি আকর্ষিত হয়নি, মনের অন্তরালে জেগে ওঠেছিলো ফাহিম ভাইকে পাওয়ার মতো এক তীব্র আকাঙ্খা। তবে সেগুলো শুধুই এখন অন্তরের কথা। ফাহিম মৌনতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-জ্বর কমেছে তোমার?

রৌশিন আরও একধাপ অবাক হলো। ফাহিমের ছোট ছোট কথাগুলো ওকে বারবার চুপসে দিয়েছে। অনুভব করছে জ্বর বেড়ে যাচ্ছে শরীরে। তবুও সেদিকে পরোয়া না করে রৌশিন পাল্টা জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি কি করে জানলেন আমার জ্বর?

-তোমার গুণোধর ভাই সাদ্দাফের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি।

রৌশিন এবার কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ফাহিম ভাই তবে সত্যিই ওর জন্য সাদ্দাফের কাছে খোঁজ খবর নিয়েছে? ফাহিম এবার বললো,

-মারুফের জন্মদিনের জন্য কত কি প্ল্যান করলে তোমরা। তারপর কি হলো? তুমি উধাও। ইলা-মারুফ কত ফোন দিলো তোমায় তুমি তো একবার বলতে পারতে যে তোমার জ্বর হয়েছিলো? ওদের কথাবার্তা শুনে আমি নিজেও তোমার জন্য একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম । তাই কিছু না ভেবেই সাদ্দাফকে কল দিয়ে জানতে পারলাম আমাদের রৌশিন ভাবুক রাণীর জ্বর।

ফাহিম কথাটা বেশ স্বাভাবিকভাবে বললেও রৌশিনের বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দ ক্রমাগত যেন বেড়েই চলছে। এ মাত্র কি বললো ফাহিম?ওকে সত্যিই তাহলে ভাবুক রাণী বলেছে? আসলেই তো সে ভাবুক। ফাহিমের রূপে-গুণে-কথার মোহে ভাবুক। ফাহিম নির্বিকারে বলে ওঠলো,

-শোনো বেশি চাপ নিতে হবে না। মোবাইল রেখে একটা প্যারাসিট্যামল খেয়ে শান্তির ঘুম দিবে। সকালেই আমি তোমার চেক আপ করতে আসবো। ডাক্তার হয়ে কি লাভ যদি নিজের মানুষদেরই যত্নাদি না করতে পারি?

রৌশিনের ফাহিমের সাথে কথা বলার আর সাহস হলো না। দ্রুত কল কেটে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বইলো ঠায় হয়ে। ওর পা দুটো অবশ হয়ে আসছে, হৃদয় উত্তেজনায় রীতিমতো ধুকপুক করছে, নিঃশ্বাস হয়ে আসছে রুদ্ধ।আজ কোন ফাহিমকে দেখলো সে? যে মানুষটার সাথে রীতিমতো দায়বদ্ধতা নিয়ে কথা বলত হতো আজ তার মধ্যে এতটা নিজস্বয়তা? রৌশিন ঢুলুঢুলু হয়ে ফিরে গেলো ওর বইয়ের রাজত্বের ছিমছাম ঘরটিতে। ওপাশের ঘরে মা বাবা ঘুমে বিভোর। বাবার নাক ডাকার শব্দওশোনা যাচ্ছে তবে রৌশিন পরোয়া করলো না। খাটে দুর্বলচিত্তে শরীর এলিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে নিলো কম্বল। ওর শরীর প্রচন্ড গরম। চোখ মুখ লাল হয়ে আসলেও কাজ করছে ভালোলাগা। রৌশিন বিড়বিড়িয়ে বললো,

-এই জ্বরে কোনো অনিশ্চয়তা নেই, আনন্দটাকে উপভোগ করার জন্য হুটহাট করেই এমন জ্বর আসা উচিত।

____________

সকালে আফরা সবার নজর এড়িয়ে ধীরপায়ে চলে গেলো ফারহানের কুটিরটির কাছে। এখন ভোর সকাল। আলো আশপাশে সর্বত্র ফুটেছে মাত্র। বাইরে ফুরফুরে হাওয়ার সাথে অদূরেই বনের কাছে পাখির কিচিরমিচির শান্ত নীরব সকালকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। আফরা চুলগুলো কাটা ব্যান্ড দিয়ে আটকে নিলো। পরনে নাইট ড্রেসে পাল্টে হাটুর নিচ পর্যন্ত সাইজের একটা লম্বা স্কার্ট আর লেডিস শার্ট পড়লৌ। এত সকালে এসব পড়ার কোনো মানেই হয়না। তবুও পড়ে নিলো ফারহানের জন্য। ফারহান স্বভাবতই সকালে ওঠার মানুষ। আর আফরা চায়না ওর সামনে বিচ্ছিরি ভাবে যেতে। ফারহানের কুটিরটির কাছে যেতেই দৃঢ় হয়ে এলো গিটারের টুং টাং শব্দ। ক্রমেই সেটা আরও মোহনীয় হচ্ছে। ফারহান যে গিটার বাজাতে পারে এটা সম্পর্কে অবগত আফরা। তবে ফারহান তখনই গিটার বাজায় যখন ওর মন হয়তো খুব ভালো থাকে , নয়তো খুব খারাপ। তবে এখন গিটার বাজানোর কারন কি? আফরা হাজার ভেবেও খুঁজে পেলো না এর প্রতিউত্তর। অতঃপর দু’কদম এগিয়ে যেতেই দেখলো বারান্দায় বসে আছে ফারহান। শরীর এলিয়ে দিয়েছে ছোট চৌকিটিতে। ওর পরনে সাদা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। টিশার্টটি হাফ হাতা থাকায় হাতের নীল রগ গুলো দৃশ্যমান আফরার কাছে। ফারহান আফরার উপস্থিতি টের পেয়ে থমকে গেলো। আঙুল চালানো বন্ধ করে দিলো । গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠলো,

-কেনো এসেছেন আপনি?

আফরা এর উত্তর দিতে পারলো না। সে তো এসেছে এত ভোরে শুধুমাত্র তার কমরেড সাহেবকে দেখার জন্য। কিন্ত এটা কি আদৌ মুখ ফুটে বলা সম্ভব? সেই সাথে ওর অভিমানও হলো এই দাম্ভিক মানুষটার প্রতি? কিভাবে পারে ‘কেনো এসেছেন’ এই প্রশ্নটি করতে? সে কি জানে না তার এ কথাগুলো ক্ষতবিক্ষত করে দেয় আফরাকে? তাই সে রূঢ় স্বরে বললো,

-মর্নিং ওয়াক করতে এসেছি।

-এভাবে স্কার্ট পড়ে? ব্যাপারটা স্ট্রেইন্জ না?

বলেই ভ্রু কুচকে তাকালো ফারহান। আফরা স্তম্ভিত। বোঝা গেলো , ভালোই ফ্যাসাদে পড়েছে। তবুও সে হাল ছাড়লো না। বলে ওঠলো,

-আমি অনায়াসেই এভাবে স্কার্ট পড়ে মর্নিং ওয়াক করতে পারি । বুঝেছেন?

-হুম বুঝেছি। আপনি তো আবার ইন্টারন্যাশনাল উইয়ার্ড গার্ল।আপনাকে দ্বারা সবই সম্ভব।

অপমানে থমথমে হয়েওঠলো আফরার মুখখানা। তবে ফারহান পাত্তা দিলো না। এটাই ওর প্রাপ্য ছিলো। বিগত দু’দিন নিজেকে ঘরবন্দী করে ফারহানের তীব্র নজর থেকে দূরে রেখে অনেক বড় ভুল করেছে আফরা। ওর সর্বপ্রথম ভুল ছিলো ফারহানের পাষাণ মনে একটা মেয়ের জন্য দুর্বলতা তৈরি করা। তারপর দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো ফারহানকে দৃষ্টিনেশায় কাঙাল করে রাখা। যেটার হেস্তনেস্ত ফারহান করেই ছাড়বে। এদিকে আফরার কান্না পাচ্ছে। যেই মানুষটার জন্য এত সকালে সুন্দর পোশাক পড়ে এলো সেই মানুষটাই ওকে ‘ইন্টারন্যাশনাল উইয়ার্ড গার্ল’ এর উপাধি দিয়ে দিলো? আফরা হঠাৎ এগিয়ে ফারহানের টিশাল্ট টেনে নিয়ে এলো নিজের কাছে। রুক্ষমেজাজে বললো,

-আই অ্যাম নট অ্যা উইয়ার্ড গার্ল। উইয়ার্ড ম্যান ইজ ইউ। ইউ আর মাই ফিলিংস ম্যান! হোয়াই ইউ ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড? আই,,,,,,,আই উইল কিল ইউ। ইফ ইউ অ্যাগেইন সে ইট , আই উইল কিল ইউ মিঃ ফারহান জুবায়ের।

আফরা যেন নিজের মধ্যে নেই। সে এতটাই রেগে আছে যে বাংলা বলতে ভুলে গিয়েছে। মুখ দিয়ে ফারহানকে অজস্র গালাগাল দলেও ফারহান হো হো করে হেসে ওঠে বসে পড়লো চেয়ারে। আফরা হতভম্ব। অগোছালো চুলের এই মায়াবীনির যেন এই পাগল বাঙালি ছেলেটার আচরণ ভাবুক করে তুলেছে। ফারহান নিজের চুলগুলো পেছনে ঠেলে বলে ওঠলো,

-আপনাকে রাগাতে আমার যেমন ভালোলাগে, আপনাকে রাগলে আমার আরও বেশি ভালোলাগে। এখন থেকে আরও বেশি রাগাবো কেমন?

আফরা দাঁড় কিড়মিড় করে বলে ওঠলো,

-আপনি একটা খারাপ।

-খারাপটা হয়েছি শুধুমাত্র আপনার জন্যই।

ফারহানের নির্বিকার প্রতিউত্তরে আফরা কিছু বললো না আর । যেভাবে এসেছিলো,সেভাবেই চলে গেলো । তবে মুখোমুখি হলো ইলার সাথে। ইলা, ফাহিম সবাই রৌশিনদের বাড়িতে যাচ্ছে। এত সকালে কেনো ওদের বাড়িতে যাচ্ছে সেটা আফরাকে ভাবিয়ে তুললেও সে প্রশ্ন করলো না। রাজি হলো ওদের সাথে যেতে। ফাহিম এবার ইলাকে জিজ্ঞেস করলো,

-ফারহানকে ডাক দে তো! জিজ্ঞেস কর , ও যাবে কি-না।

আফরা ফারহানের নাম শুনে তেলেবগুনে জ্বলে উঠলেও কিছু বললো না। বিড়বিড়িয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো , ‘মরে গেছে ওই গোমরামুখোটা!’
.
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#পর্ব____৩৪
#কায়ানাত_আফরিন
পিটপিট করে চোখজোড়া খুললো রৌশিন। দেখলো কেউ ওর দিকে খানিকটা ঝুঁকে গহীন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে ওকে। ওর শরীর কিছুটা দুর্বল। তাই চোখ খোলা মাত্রই অবয়বটিকে স্পষ্ট না দেখে খানিকটা অস্পষ্ট দেখতে পেলো। রৌশিন নিঃশ্বাস ফেললো বারকয়েক। শক্তি জুগালো নিজের দুর্বল শরীরে। কয়েক সেকেন্ড পরই ওর ঘোলাটে দৃষ্টি হয়ে আসতে লাগলো স্পষ্ট। কিছু অবয়বটিকে নিজের সদ্য ঘুমফোটা চোখে দেখা মাত্রই যেন চরম রকমের অবাক। রৌশিন প্রথমে আনমনে চিমটি কাটলো নিজেকে। মনে হলো এসব বুঝি স্বপ্ন, সেদিন নাটকে স্বপ্না নামের যেই চরিত্রটি অভিনয় করেছিলো সেই স্বপ্নার মতোই স্বপ্ন। রৌশিন হতাশা গ্লানিতে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠলো,

-রৌশিন রে ! জ্বর তোকে ভালোই কাবু করে ফেলসে। নাহলে এসব আজগুবি জিনিস দেখতি না।

পরক্ষণেই ও ভালোমতোই টের পেলো এ কোনো স্বপ্ন নয়। সত্যিই ফাহিম এসেছে এখানে। খাটের পাশে উদ্বিগ্ন হয়ে বসা ওর মা। পায়ের কাছে তেরছাভাবে মারুফ আর ইলার উপস্থিতিও টের পাচ্ছে। ফাহিম রৌশিনের প্রেশার মেপে দেখলো যে প্রশার ফল করেছে। জ্বরটা আগের মতো নেই। শরীরে ঘাম লক্ষ্য করাতে বুঝতে পারলো হয়তো জ্বর সারা শুরু করেছে। রৌশিনের কপালে আলতো ভাবে হাত রাখলো ফাহিম। কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-শরীরটা কেমন লাগছে তোমার রৌশিন?

রৌশিন প্রতিবারই অনুভব করে ফাহিমের মুখে ওর নাম শুনার মধ্যে অন্যরকম এক মাদকতা আছে। ওর কন্ঠটা জানি কেমন। নরম , ভরাট তবে প্রানবন্ত ধরনের। শুনলেই একটা দার্শনিক টাইপ ফিলিং আসলেও দর্শনের উচ্ছিষ্ট টুকুও ফাহিমের মধ্যে নেই। কথা আছে না, মানুষের পাঁচটা আঙুল সমান হয়না। ফাহিমও ঠিক তেমন। ও প্রকৃতিপ্রেমী না, ফিলোসফি , সাহিত্য , কবিতা ,বইনেশা এগুলো ফাহিমের মধ্যে অনুপস্থিত। এককথায় রৌশিনের বিপরীত মুখী মানুষ বললেই চলে। তবুও রৌশিনকে ওর ভালোলাগে , কারন ফাহিম সামাজিক। খুবই মিশুক আর উচ্ছ্বাসিত মানুষ সে।রৌশিনের প্রতিউত্তর না পেয়ে ফাহিম পরন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস করলোনা ওকে। হয়তো শরীরটা এখন সেরে ওঠেনি। রৌশিনের মা আহাজারি কন্ঠে বলে ওঠলেন,

-কি হলো আমার মেয়েটার? সারাদিন গুমশুম হয়ে থাকে। হুটহাট জ্বর বাধিয়ে ফেলে। এতদিন পর কাল জ্বর সেরে রাতে আবার জ্বর এলো। কেনো, ডাকতে পারলি না আমাকে? তোর মা কি মরে গিয়েছিলো?

-আহা খালা বকেন না তো ওকে। ও তো এমনিতেও চাপা স্বাভাবের মেয়ে।

-তুমিই বুঝাও ওরে বাবা। পাগলিয়ে গেসে মেয়েটা।সারাদিন একলা একলা কিসব ভাবে আল্লাহ মালুম!

রৌশিন উঠে বসলো এবার। ফাহিম ব্যাগ্র হয়ে বলে ওঠলো,

-তোমার ওষুধ কিন্ত সব ঠিকমতো লিখে দিয়েছি। এখন বেড রেস্ট নাও। সাদ্দাফ ওষুধ নিয়ে আসবেদুপুরে তোমার জন্য। ঠিকাছে?

ফাহিম ইলা মারুফ আরও কিছুক্ষণ সময় কাটালো রৌশিনের সাথে। রৌশিন ওপর দিয়ে একটু ভাবহীন থাকলেও ভেতরে ছুটে যাচ্ছে আনন্দের ঝড়। রৌশিনের মা আগেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওদের রেখে চলে গিয়েছিলো। হঠাৎ ফাহিম ইলা আর মারুফকে বললো বাহিরে আফরা আর ফারহানের কাছে যেতে। ও কিছু জরুরি কথা বলবে। ইলা আর মারুফ বাধ্য হয়ে তা-ই করলো। রৌশিন ফাহিমের এরূপ কান্ডে কিছুই বুঝতে পারছে না।ফাহিম এবার এবার বসে পড়লো আফরার মুখোমুখি হয়।চোখে অল্পবিস্তর সন্দিহান রেশ। রৌশিন ভড়কে গেলেও নিজেকে শান্ত রাখলো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফাহিম জিজ্ঞেস করলো,

-এবার বলোতো? কাকে ভালোবেসে এমন জ্বর বাঁধিয়েছো?

রৌশিন নিষ্পলক হয়ে রইলো। কি বলবে এটা সে ভেবে পাচ্ছে না। ফাহিমের চোখে মুখে সীমাহীন কৌতুহলতা।তাই সে আবার বললো,

-আরে বলে ফেলো মেয়ে। ভালোবাসা কোনো পাপ না। এইযে, আমিও তো পছন্দ করি আফরাকে।

প্রথম কথাটা শুনে রৌশিন যেমন প্রতিক‍িয়া করেছিলো শেষ কথাটি শুনে সে যেন আরও স্তব্ধ হয়ে গেলো। অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি আফরা আপুকে পছন্দ করেন ভাইয়া?

-হুম করি। শুরুতে এমন কোনো ফিলিং ছিলো না। তবে দু’দিন আগে হুট করে মা বললো যে আফরার বাবার কাছে আমার আর আফরার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তখন থেকেই আমি একটু নজর দিলাম আমার ফিলিংসের প্রতি। আমার মনে হয়না আফরার এতে আপত্তি থাকতে পারে। ‘কজ ও আমার সাথে প্রচুর ফ্রেন্ডলি। তবুও , দেখা যাক।

কথাগুলো রৌশিনের বুকে তীরের মতো বিধছিলো। শুরতে আফরাকে ওর হিংসে হলেও এখন নিজের ভাগ্যের পরিহাসে খারাপ লাগছে। ও মেকি হাসি দিয়ে বলে ওঠলো,

-ভালোবাসা চাইলেই পাওয়া যায় না ফাহিম ভাই। তাই আমি কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। তাই কারও ভালোবাসায় বুদ হয়ে জ্ব‌র আসার তো প্রশ্নই ওঠে না।

________________________

ফারহান গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে। ফাহিম অনেক জোরাজোরি করেছিলো ওদের সাথে রৌশিনদের বাড়ির ভেতরে যেতে। কিন্ত ও শুনলো না। বাহিরে পিচঢালাই পথে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো নির্বিকার ভাবে। অদূরেই ছিলো আফরা। এতক্ষণ রৌশিনের মায়ের সাথে কথা বলার প্রচেষ্টায় ছিলো, কিন্ত পারলোনা। রৌশিনের মায়ের কথাবার্তায় একধরনের সিলেটি টান আছে, যেটা আফরার বুঝতে একটু না, মোটামুটি অনেক সমস্যাই হয়েছে। তাই কোনোমতে কথা বলে সে রৌশিনের সাথে কথা বলে শেষমেষ চলে গেলো ফারহানের কাছে। ফারহান নীরব, নিশ্চল। আজ ছেলেটা একটা সাদা রঙের শার্ট পড়েছে। সাথে অফ হোয়াইট জিন্স। শ্যামবর্ণের গায়ে এমন উজ্জ্বল রঙের সৌন্দর্য আসলেই বর্ণণাতীত। চুলগুলোও শ্রীমঙ্গলের শেষ সীমানার উত্তর গাঁয়ের হাওয়ার দাপটে উড়ে যেতে ব্যস্ত সমানতালে। আফরা কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলো সেদিকে। তারপর এগিয়ে যেতেই ফারহান মিনমনিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-দেখা করা হয়েছে?

-হুম, আপনি যাবেন না?

-আমি কেনো যাবো দেখা করতে?

-তাহলে এসেছেনই বা কেনো?

আফরা কাট কাট গলায় এ প্রশ্ন করতেই ফারহান ভ্রু কুচকালো৷ কেনো যেনো মনে হচ্ছে মেয়েটা রেগে আছে। রেগে আছে বললে ভুল হবে,,হয়তো মনে অভিমান জমেছে। সকালের আফরার সাথে ওর কথোপকথন গুলো মনে পড়তেই ফারহান বুঝে নিলো কেন এই অভিমান৷ ভালো লাগে ওর এই বিদেশীনি কে রাগাতে। তাই তো আবার ছুটে এলো এখানে। ফারহান ঠোঁট চেপে বলে ওঠলো,

-আপনি কি ভেবেছেন যে আমি আপনার রাগ ভাঙানোর জন্য এসেছি এখানে?

অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো আফরা। আড়নজরে ফারহানকে বারকয়েক দেখে অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে বলে ওঠলো,

-না তো! আমি……….আমি এমন কেনো মনে করবো?

-তাহলে তো ভালোই। এমন কিছুই মনে করবেন না। কারন ফারহান জুবায়ের কারও রাগ ভাঙাতে অভ্যস্ত নন।

ফারহান কথাটি বলো দাম্ভিক কন্ঠে। আফরার মনে চাপা ক্ষোভ জমলো। এই মানুষটা সবসময়ই থাকে কিভাবে ওকে হেয় করা যায়। ফাহিম আর ইলা আসলে ঠিকই বলে, এই লোকটার সাথে যেচে যেচে কথা বলা উচিত। তন্মধ্যে এসে পড়লো ইলা আর মারুফ। ফারহান মৌন ভাবে ইলাকে জিজ্ঞেস করলো,

-ফাহিম কোথায়?

-একটু পরে আসছে।

এদিকে মারুফ তো বারবার আফরাকে দেখে যাচ্ছে। কি সুন্দর একটি মেয়ে। হাসলে যেন মুক্তা ঝরে পড়ে। মারুফের হিসেবে এই মেয়ে যদি মুভি করতো নিঃসন্দেহে হিট হয়ে যেতো। ইলা দেখছে মারুফের এই আহাম্মকি দৃষ্টিটা। তাই দাঁত দাঁত চেপে ওকে বললো,

-আফরা আপুরে বড় বইনের নজরে দেখ আহাম্মক ! তোর সাথে কখনোই তার যাবেনা।

-আরে আমি কি কইসি যে আমার সাথে আপু যাইবো। দেখতে ক্ষতি কি? নিঃসন্দেহে উনার মতো সুন্দরী এই জনমে আর দেখতে পারুম না।অ্যামেরিকান তো না-ই।

সকালের বাতাসটা কিছুটা শীতল। উত্তুরে হাওয়ার সমাগমে আশপাশের বিশাল বিশাল কাঠ গাছগুলোর পাতা নড়ে অদ্ভুত শব্দ সৃষ্টি করছে। চায়ের রাজ্যের এই তো একটা সৌন্দর্য। দেখলেই মাথা কেমন যেন ঝিম ধরে যায়। আফরার ভালো লাগলেও গায়ের লোম কেনো যেন খাড়া হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে ঐই শীতল আবহাওয়াটা ও‌র পরনে পাতলা শার্টটির সঙ্গে মানানসই একেবারেই না। আজ দিনটাই খারাপ ভাবে শুরু হয়েছে। যার জন্য সুন্দর পোশাল পড়লো তার কোনো ধ্যান নেই বরং ঠান্ডায় কাপাকাপি করছে সে। হঠাৎই নিজের গায়ে একটা উষ্ণ আবরণ দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। মাথাটা চট করে ঘুরাতেই মুখোমুখি হলো একেবারে ফারহানের কাছে। ফারহান ওর ঠিক বরাবর দাঁড়িয়ে আছে, অনেকটাই কাছাকাছি। আফরা বুঝতে পারেনি যে ফারহান গায়ে ওর নিজের শার্ট জড়াতে গিয়ে এতটা কাছাকাছি এসে পড়বে তাহলে আফরা কখনোই মাথা চট করে ঘুরাতো না। ফারহানের দৃষ্টি নিচে থাকলেও আফরা ওর মুখোমুখি হওয়াতে গহীন দৃষ্টিতে দেখে নিলো আফরার মুখ। জড়ানো গলায় বললো,

-পড়ে নিন এটা। আমার জন্য এটা পড়ে এসেছেন আর তা পড়ে আপনার ঠান্ডা লাগছে এটা কি আর মেনে নেওয়া যায়?

ধক করে ওঠলো আফরার হৃদয়। ফারহানের কন্ঠে জড়ানো কেমন এক আড়ষ্ট অনুভূতি। এর মানে ফারহান কি জানতো এই জামাটি পড়ার উদ্দেশ্য? আফরার এখন নিজেকে নিতান্ত বোকা মনে হচ্ছে। ওর এমন পাগলামির জন্য কি ভাবছে ফারহান কে জানে?
.
.
.
~চলবে……ইনশাআল্লাহ

[।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here