অতঃপর সন্ধি পর্ব -১০+১১+১২

#অতঃপর_সন্ধি (১০)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

আচমকা বাস থেমে যাওয়ায় বাসে হইহট্টগোল পড়ে গেল। কেউ কেউ সামনে গেলো কি হয়েছে দেখার জন্য। তবে পুষ্পিতার ধ্যানজ্ঞান বাসে না বাসের বাইরে। কেউ একজন রাস্তার পাশে হুডি পড়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্পিতা চিনে ঐ একজন কে। মলিন আর বিবর্ণ আনন জুড়ে একখন্ড খুশির ঝলক দেখা দিলো। জানালার কাঁচ খুলে দিতে ঠান্ডা হাওয়া শরীর স্পর্শ করল তা। ঠান্ডা হাওয়ায় স্নিগ্ধ স্পর্শে চোখ বুঁজে নিলো সে। আর সাথে এক অন্তরীক্ষ সমান ভালো লাগা মনের মধ্যে বিচরণ করছে তার।

‘জারিন আমাকে একটু আড়াল কর তো।’

জারিন কথার মানে বুঝল না। প্রশ্নসূচক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো।

‘আহা! আমাকে একটু আড়াল কর। তাহলে বুঝবি কেন বলেছি।’

জারিন মাথা নাড়িয়ে বাঁকা হয়ে বসল। পুষ্পিতা ব্যাগের উপরের চেইন খুলে মোবাইল বের করল। কোনো একটা নাম্বারে ডায়াল করে কানে ধরল মোবাইল। কয়েক সেকেন্ড বাদে ফিসফিসিয়ে বলল

‘আপনি এখানে?’

‘আপনাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছিল।’ মায়ানের গলা স্পষ্টই শুনতে পেল জারিন। বাইরের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল মায়ান পুষ্পিতার জানালা বরাবর দাঁড়িয়ে।

আতংকিত চোখে এদিক ওদিক তাকালো পুষ্পিতা। পুনরায় ফিসফিসিয়ে বলল,

‘কোনো কারসাজি করে কি আপনি বাস থামিয়েছেন?’

পুষ্পিতার ছেলেমানুষী প্রশ্নে শব্দহীন হাসলো মায়ান।

‘না, বললাম না তোমায় দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছিলো। আর মেইন রোডে উঠতে হলে বাস এই রাস্তা দিয়েই যাবে। সেজন্য এখানে আধঘন্টা আগে দাঁড়িয়ে আছি।’

লজ্জা মিশ্রিত কোমল স্বরে মুচকি হেসে পুষ্পিতা আবারও বলল,

‘আপনি পাগল? এই শীতে এমন করে কেউ?’

‘হয়তো করে না। আবার এর থেকেও বেশি করে। তবে এখানে বাস থামা পুরো আনএক্সপেক্টেড ছিলো। আমার দাঁড়িয়ে থাকা সার্থক। লাক সবসময় আমার ফেভারে থাকে।’

‘আপনাদের মাথা।’

‘কথা বলবেন না প্লিজ। আপনাকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নেই।’

কান থেকে মোবাইল নামিয়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো পুষ্পিতা। বাইরে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেলো মায়ানের। এবারে যেন আরো মিইয়ে গেলো।

এতক্ষণ মায়ানের বলা প্রতিটা কথাই শুনতে পেয়েছে পুষ্পিতা। পুষ্পিতার ত্রপায় মুড়ানো মুখের দিকে তাকিয়ে বাইরে এক পলক তাকাল। মায়ান এইদিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে সে। চোখ বন্ধ করে সীটে মাথা এলিয়ে দিতে তানজিফ কর্কশ, রূঢ় কন্ঠে বলল,

‘এই যে শিশুরা, আপনাদের পানির বোতল, কেক আর বিস্কুটের প্যাকেট। আর এগুলো কিনার জন্যই এখন বাস থামিয়েছে।’

তানজিফের ঠেঁটানো কথায় চমকে উঠে জারিন আর পুষ্পিতা। দু’জনে ভয়ে থুথু দেয় বুকে।

‘গাধা এভাবে কেউ কথা বলে? আর একটু হলে হার্ট অ্যাটাক করতাম।’

‘আমি কি করে জানবো আপনাদের মাছের কলিজা।’

বলেই চলে গেলো সে। তানজিফ চলে যেতেই মুখ ভেঙালো পুষ্পিতা।

বাস ছেড়েছে। পুষ্পিতা জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখল মায়ানও তার দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইল বেজে উঠলো তার। রিসিভ করতে মায়ান বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘জানালা মাথা বের করবেন না ফুলবানু। দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা থাকে। জানালা আটকে গায়ে ভালো করে চাদর জড়িয়ে নিন। শীতের রাতে বাসের বাতাসে ঠান্ডা লেগে যাবে।’

বিস্তীর্ণ হাসলো পুষ্পিতা।

‘যথাআজ্ঞা মহারাজ।’

‘রাখছি তবে। নিজের যত্ন নিবেন ফুলবানু। যেমন হাসিখুশি যাচ্ছেন এর থেকেও বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে ফিরবেন।’

মোবাইল রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো পুষ্পিতা।

‘উনার এই নিরব ভালোবাসা আর কেয়ার গুলো আরো বেশি মুগ্ধ করে। দেখলি কেমন হুট করে সারপ্রাইজ দিয়ে দিল। সত্যি বলতে আমারও না উনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল।’

পুষ্পিতার কথায় চোখ বন্ধ করে হাসলো জারিন। কোনো ভণিতা ছাড়াই বলল,

‘উনার নিরব ভালোবাসা আর কেয়ার দেখতে পেলি তবে তানজিফের ভালোবাসাটা কেন দেখলি না?’

ধপ করে চোখের পাতা মেলে তাকায় পুষ্পিতা। স্তম্ভিত চোখে দৃষ্টিপাত করলো জারিনের দিকে ।

‘উনি ঠিকই বলেছেন। লাক সবসময় উনার ফেভারেই থাকে। না হলে দেখ, কেউ একজন তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তোর পিছু পিছু কত বছর ধরে ঘুরছে আর উনি সেটা এসেই পেয়ে গেলো।’

চেহেরা জুড়ে থাকা হাসির ঝলকটা একেবারে উধাও হয়ে গেলো পুষ্পিতার। বিবর্ণমুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন।

_______________________

যতক্ষণে পুষ্পিতাদের বাস কক্সবাজার এসে পৌঁছেছে, ততক্ষণে অন্ধকারে নিমজ্জিত ধরনী সূর্যের মিষ্টি রোদে ঝলমলে করছে। বাসের সবাই ক্লান্ত লম্বা এই জার্নি করে। রুম বুক করা হলো হোটেল সী পেলেসে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো একরুমে চারজন করে থাকবে।

সবাই ফ্রেশ হয়ে আধঘন্টার মতো রেস্ট নিয়ে বিচে এসেছে। যে যার মতো সময় কাটাচ্ছে। পুষ্পিতা সোনালি রোদে চিক চিক করতে থাকা বালুর উপর বসে আঁকিবুঁকি করতে লাগে। মাঝে মাঝে সৈকতের শান্ত ঢেউ তার পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। এবার ঢেউয়ের একটা ছোট্ট ঝিনুক তার পায়ের কাছে এসে ঠেকল।
সে হাতে নিলো সযত্নে। ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ।

পুষ্পিতার পাশে ধপ করে বসে পড়ল জারিন।

‘কিরে বসে আছিস যে? মুড অফ?’

পুষ্পিতা জারিনের কাঁধে মাথা রাখল আলতোভাবে।

‘তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?’

‘না।’ বিরস মুখে বলল পুষ্পিতা।

‘তাহলে?’

‘ঘুম পেয়েছে ভীষণ। একটু না ঘুমালে বিকেলে হিমছড়ি যেতে পারবো না।’

‘তাহলে রুমে চল।’

______________________

দিবালোকের তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। হিমছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার এটাই মুখ্য সময়। তিনটে জিপ ভাড়া করা হয়েছে। মোটামুটি তিনটে জিপই হয়ে যাবে। একে একে সবাই জিপে উঠে বসল।

মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে হিমছড়ির উদ্দেশ্যে জিপ চলছে ক্ষিপ্র গতিতে। প্রতিটি জিপের সবাই হই-হল্লোড় করছে। রাস্তার একপাশে সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা উঁচু নিচু পাহাড়। কখনো কখনো দেখা মিলছে পাহাড়ের মাঝে থাকা ঝর্ণার। অন্যপাশে সমুদ্রের নীল জলরাশি দেখে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই। নানা রকম পাখির কলতানে সবাই বিমুগ্ধ। জিপের গতির সাথে সাথে সবাই সুরের ঝংকার তুলল,

‘দূর দ্বীপবাসিনী,
দূর দ্বীপবাসিনী,
চিনি তোমারে চিনি
দারচিনিরও দেশে, তুমি বিদেশিনী গো
সুমন্দ ভাষিনী,,,,,’

সবার সাথে ঠোঁট নাড়ছে পুষ্পিতাও। গানের কথার সাথে মুখাবয়ব পরিবর্তন হচ্ছে৷ কখনো ঠোঁট বিস্তীর্ণ করে মিষ্টি হাসছে কখনো বা ভ্রু উঁচিয়ে তাল মেলাচ্ছে।

পুষ্পিতার দিকে তীক্ষ্ণ, প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তানজিফ। অপলক, অনিমেষ। অকস্মাৎ চোখে চোখ পড়ল পুষ্পিতার। হকচকিয়ে গেল তানজিফ। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। পুষ্পিতাও গানে মনযোগ দিলো। পরপর কয়েকবার পুষ্পিতা তানজিফের দিকে তাকিয়েছে। তবে তানজিফ তাকায়নি একবারও। সে মনকে বুঝালো হয়তো এমনিতেই চোখাচোখি হয়েছে।

রাস্তায় দুপাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছকে পিছনে ফেলে জিপ এসে থামল হিমছড়ি পর্যটনকেন্দ্রের সামনে। টিকিট কেটে সবাই ভেতরে ঢুকল। পর্যটনকেন্দ্রে আরো পর্যটকদের আনাগোনা। কপালে হাত রেখে উপরের দিকে তাকাল পুষ্পিতা। অসহায় চিত্তে বলল,

‘এতো সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠবো কেমনে রে জারিন? আমার তো এখনই পা ভেঙে আসছে।’

পুষ্পিতাকে টানতে টানতে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে গেলো জারিন। প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে উৎফুল্ল গলায় বলল,

‘যাত্রা শুরু করার আগে ভেঙে পড়লে চলবে? একটু কষ্ট না করলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করবি কেমনে?’

একটা একটা সিঁড়ি ভেঙে উঠছে সবাই। কেউ কেউ ছবি তুলছে। কেউ একটু জিরিয়ে আবারও উপরে উঠছে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জন্য আর কয়েকটা সিঁড়ি বাকি ধপ করে বসে পড়ল পুষ্পিতা। সমানে হাঁপিয়ে চলেছে।

‘আমি আর পারছি না ইয়ার।’

‘আমিও আর পারছি না।’ ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে জারিনের গলা। সেও সমানে হাঁপিয়ে চলেছে।

পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তানজিফ। তার চেহেরায় ক্লান্তির লেশমাত্র নেই।

‘তোদের রেস্ট নেওয়া হলো? আমি আধঘন্টা আগে চূড়ায় পৌঁছে যেতাম।’

‘ভাই তুই এতোগুলা সিঁড়ি বেয়ে এখনো স্বাভাবিক আছিস কি করে?’

‘তোদের জন্য আমাকেও পাঁচ মিনিট পর পর জিরিয়ে নিতে হয়েছে।’

‘তাহলে এতো পকরপকর না করে আরো একটু জিরিয়ে নে।’

তানজিফের কথায় দপ করে মাথায় রাগ চেপে গেলো পুষ্পিতার।কর্কশ গলায় বলল,

‘আমরা বলেছি আমাদের পিছু পিছু আসার জন্য? নিজে নিজে এসেছে এখন খোঁটা দিচ্ছে।’

‘কারন আমি আঙ্কেলকে কথা দিয়েছি দাঁতওয়ালা বাবুদের আগলে নেওয়ার জন্য।’

পুষ্পিতা দাঁতে দাঁত পিষে রুক্ষ স্বরে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই জারিন ধমকে উঠলো।

‘এই তোরা চুপ করবি?’

_________________________

তিনশত সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। চূড়ার উপর উঠে সাগর আর পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকন করে এতোক্ষণের এতো কষ্ট যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো।

সাগরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দু-হাত মেলে দিলো পুষ্পিতা। পাহাড়ের এই নির্মল বায়ু লম্বা নিঃশ্বাসের ভেতরে টেনে নিলো। চোখ বন্ধ করে এই পাহাড়ি পরিবেশ আর পাখির কিচিরমিচির অনুভব করার চেষ্টা করল।

‘তিনশত সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠার কষ্ট সার্থক।’

তানজিফ পুষ্পিতা অজান্তে ক্যামেরা তাক করে তার দিকে। তন্মধ্যে জারিন এসে সামনে দাঁড়ায়। ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে রয় তানজিফের দিকে। নির্জীব হেসে ক্যামেরা নামিয়ে নিতেই জারিন হাত ধরে ফেলে। জারিন মুচকি হেসে চোখের ইশারা করে ছবি তোলার জন্য।

মুক্ত বাতাস অনুভব করার বিশেষ মুহূর্ত তানজিফ তার ক্যামেরাবন্দি করেছিল হয়তো তা কখনো জানতে পারবে না পুষ্পিতা।
#অতঃপর_সন্ধি (১১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

ঝর্না বেয়ে পানি পড়ছে তার নিজ গতিতে।

‘বর্ষাকালে ঝর্নার ভিউ সেই থাকে। তখন ঝর্ণা দেখে একেবারে মন ভরে যায়।’

সানির কথায় সবাই সায় জানালো।

‘এখন ঝর্ণায় খরা চলছে।’

তানজিফের কথায় সবাই একযোগে হাসতে লাগে।

‘শীতকাল হানিমুনওয়ালা ওয়েদার। অথচ ঝর্ণা ঘুমায়।হইলো কোনো?’

‘তুই বর্ষাকালে হানিমুন করলে তোরে কেউ ধরে রাখবে? আর বর্ষাকাল তো ভালোবাসার সময়।’

সানি তানজিফের পিঠে চাপর মে’রে বলল,

‘শা*লা তুই করিস বর্ষাকালে হানিমুন।’

‘হানিমুন করতে কাল লাগে না। বউ লাগে বউ। আমি বউয়ের সাথে এসে এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করবো। এমন তো না যে খোলামেলা পরিবেশে,,,, ‘

চোখ তুলে সামনের দিকে তাকায় তানজিফ। পুষ্পিতা তার দিকে ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তানজিফ আর কথা বাড়ালো না। ক্যামেরার লেন্সে মনযোগ দিলো।

‘সবাই কেমন ঝর্ণায় ভিজতেছে। চল না জারিন তুই আর আমিও ভিজি।’

জারিনের আগেই জবাব দিল তানজিফ।

‘ভিজা এলাউ তবে হাত আর পা। এর বেশি কিছু ভেজানো যাবে না।’

ভ্রু উঁচিয়ে জারিন সাবলীল ভাষায় বলল,

‘এলাউ কেন হবে না। সবাই তো ভিজতেছে।’

‘আমি তো সবার কথা বলিনি। আমি জাস্ট তোদের দু’জনের কথা বলেছি। তোদের ভেজা এলাউ না।’ তানজিফের সহজসরল স্বীকারোক্তি।

‘আমি তো ভিজবোই।’ একরোখা হয়ে বলল পুষ্পিতা।

‘তবে আমার হাতের সবগুলো চড় আপনার গালে পড়বে। ভালোবেসে ছোঁয়ার অধিকার তো পাইনি। আঙ্কেলের দেওয়া অধিকারটা না হয় কাজে লাগালাম।’

তেজ দেখিয়ে পুষ্পিতা সামনের দিকে অগ্রসর হতে তানজিফ মৃদুস্বরে কন্ঠনালী দিয়ে উচ্চারণ করল,

‘এখানে আমরা ছাড়াও আরো পর্যটক আছে। আর আমাদের মাঝেও কার নজর কেমন আমরা জানি না। আর শরীরে পানির স্পর্শ লাগলে প্রতিটা ভাঁজই,,, ‘

কথা অসম্পূর্ণ রেখে পুষ্পিতার দিকে তাকাল। পুষ্পিতা তানজিফের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে।দৃষ্টি তার সামনে নিবদ্ধ রেখে একেবারে স্থির। তানজিফ পুনশ্চ বলল,

‘আমি কি বলতে চেয়েছি নিশ্চয়ই বুঝেছিস? আমি চাই না কেউ তোদের দিকে খারাপ নজরে দেখুক।’

দিনের শেষবেলা।পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হচ্ছে সূর্য । একটু একটু করে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে ধরনীতে। পাহাড়, ঝর্ণা আর সমুদ্রের সৌন্দর্য, মাধুর্যতা উপভোগ করে এবার হোটেলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। ইনানি বিচ যাওয়ার কথা থাকলে সময় কুলালো না।

একে একে সবাই জিপে উঠে বসল। আবারও মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে জিপ ক্ষিপ্র গতিতে ছুটছে।

‘দরিয়ানগর পয়েন্টে প্যারাসাইলিং করে। কাল প্যারাসাইলিং করতে যাবি তোরা?’

তানজিফের প্রশ্নে ছেলেরা আগ্রহ দেখালেও মেয়ে তেমন সাড়া দেয়নি।

‘তবে মেয়েরা থাক। আমার সব ছেলেরা সকাল দশটায় প্যারাসাইলিং করতে যাবো দরিয়ানগর পয়েন্টে।’

পুষ্পিতা জারিনের হাতটা শক্ত করে ধরে ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘আমার না প্যারাসাইলিং করার খুব শখ। আমি যাবো তোদের সাথে। পাখির চোখের সমুদ্র দেখবো।’

‘লা’শ নিয়ে পরে টানাটানি করতে পারবো না।’

যেই উৎফুল্ল নিয়ে কথাটা বলেছিল পুষ্পিতা তা নিমিষেই মিলিয়ে গেলো। মন খারাপেরা একত্রিত হয়ে চোখেমুখে।

‘সব জায়গায় না না। এমন হলে বাবাকে বলে দিতি আমাকে আর কক্সবাজার পাঠাতো না।’

মাহমুদ বলল,

‘ওর যদি সাহস থাকে তাহলে তোর সমস্যা কোথায় তানজিফ?’

তপ্ত শ্বাস ফেলে তানজিফ।

‘ওকে করিস প্যারাসাইলিং। তবে সাবধান।’

‘তাহলে সকালে না গিয়ে বিকেলে যাই? ইনানি বিচ থেকে ফেরার পথে? তাহলে সূর্যাস্তও দেখতে পাবো।’

__________________

সারাদিনের ঘুরাঘুরিতে ক্লান্ত সবাই। যে যার মতো শুয়ে আছে। কেউ কেউ ঘুমিয়ে কাদা। ডাকলে হু হা করে সাড়া দিয়ে আবারও গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে।

পুষ্পিতা চুপিসারে মোবাইল নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সমুদ্র থেকে বয়ে আসা হিম শীতল হাওয়া শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ায় যেমন শীত শীত অনুভব হচ্ছে তেমনি ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে মন। পুষ্পিতা প্রথমে আশহাব শেখের নাম্বারে কল করল। পাঁচ মিনিট কথা বলে মোবাইল হাতে নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। নিস্তব্ধ রজনীতে উর্মিমালার নিনাদ শুনায় ব্যস্ত সে। মোবাইল নিনাদিত হতেই আঁতকে ওঠে সে। বিস্তর হেসে রিসিভ করে কানে ঠেকাল।

‘ফুলবানুর ঘুরাঘুরি শেষ হলো? নাকি এখনো কক্সবাজার ঘুরছেন?’

‘আপাতত রেস্টে আছি। কাল সকালে আবারও শুরু হবে।’

চুপচাপ নিজেদের অনুভব করায় ব্যস্ত চুপ। কিছু বলার কথা খুঁজে পাচ্ছে না। নিঃশব্দতা ভাঙে পুষ্পিতা।

‘ঢাকা তে আমি নেই। নিশ্চয়ই মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করা হচ্ছে?’

অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগ শুনে চাপা হাসলো মায়ান।

‘আর কি অভিযোগ আছে ফুলবানু?’

একটু আহ্লাদী স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘আপাতত বিগ বিগ অভিযোগ এটাই।’

‘আশপাশে যেহেতু আমার ফুলবানু নেই।সেক্ষেত্রে একটু আধটু মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করাই যায়।আফটার অল সে দেখার চান্স নাই তো।’

নাকের ডগা লাল হচ্ছে রাগে।চক্ষু জোড়ায় ও সমানতালে রাগ আর ক্ষোভের ছড়াছড়ি। রাগে আর ক্ষোভে নিঃশ্বাসের গতিও বাড়ছে তুল্যরূপে।

‘আপনি কি কাঁদছেন নাকি রাগে সাপের মতো ফুস ফুস করছেন?’

দাঁতে দাঁত চেপে রইলো পুষ্পিতা। কোনো উত্তর করলো না।

‘আপনাকে কাঁদলে পেত্নীর মতো লাগে আর রাগলে ইচ্ছে করে,,,,,,’

‘কি ইচ্ছে করে?’

‘আরো বেশি ভালোবাসতে।’

রাগের আভা সরে গিয়ে ধৃষ্টে লজ্জারা ভীর জমায়।

‘আপনি সত্যি অন্য মেয়েদের সাথে?’

শব্দবহুল হাসলো মায়ান।

‘একজনাতে খুব বাজে ভাবে আটকে গিয়েছি। অন্য মেয়েদের দিকে তাকানোর সময় নেই।’

__________________

সকালের ঝলমলে রোদে চোখ পিটপিটিয়ে চাইলো পুষ্পিতা।রোদের ঝলকানিতে চোখ মেলে রাখা দায় হয়ে পড়েছে । শোয়া থেকে উঠে বসে সে। সকালে কিছু একটা করার কথা ছিলো। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। মনে পড়তেই চিৎকার করে ডাকল জারিনকে। কাঁদো কাঁদো মুখ তার। পলক ফেললে টুপ করে পানি গাল স্পর্শ করবে।

ওয়াশরুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে এলো জারিন। মুখে ব্রাশ।

‘এমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?’

রোদন করে উঠলো পুষ্পিতা।

‘আজকে সূর্য উদয় দেখার কথা ছিলো আমাদের।’

‘নিজেই জাগনা পাই নাই। ব্রাশ করতেছি দেখছ না?’

থমথমে বিষন্ন মুখে বসে রইলো পুষ্পিতা।

‘পরের বার আসলে তখন দেখিস। এখন ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে। নাস্তা করে আমরা বার্মিজ মার্কেট যাবো। আমাদের হাতে আজকের দিনটাই। রাত দশটায় আবারও চিরপরিচিত ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো আমরা।’

একটা একটা করে দোকান ঘুরে দেখছে সবাই। কেউ তাঁতের জামা নিচ্ছে, কেউ বা তাঁতের শাড়ি। পুষ্পিতা তিনটে তাঁতের জামা নিলো আর তার মায়ের জন্য নিলো একটা তাঁতের শাড়ি। আর সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী যেটা হলো বার্মিজ আচার নিলো। কয়েক রকমের আচার নিয়ে নিলো সে। রোদের তীক্ষ্ণতা বাড়ার সাথে সাথে সবাই হোটেলে ফিরল। আজ ইনানী বিচ যাওয়ার কথা।

________________

ইনানী বিচের বেলাভূমিতে পা রাখল তানজিফেরা। ইনানী বিচে প্রবাল পাথরের ছড়াছড়ি। ছোট ছোট ঢেউয়ের সাথে মিষ্টি বাতাস মন শরীর একেবারে শীতল হয়ে যাচ্ছে।

পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পিতা। স্বচ্ছ পানির নিচে বালি চিকচিক করছে। কক্সবাজারের মতো এতো ভিড় নেই এখানে।

একদম পানির কাছে গিয়ে বালি দিয়ে ছোট্ট একটা ঘর বানানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস চালাচ্ছে তানজিফ। যতবারই উপরের দিকে বালি দেয় ততবারই ভেঙে যায়। কয়েকবার চেষ্টার পর ঘর বানাতে সফল হলো সে। কয়েক সেকেন্ড বাদে ছোট্ট একটা ঢেউ এসে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো বালুকণা গুলো। উষ্ণ শ্বাস ফেলে তানজিফ।

‘আমার কপালটাই এমন। কোনো কিছুই হয় না। শুরু করার আগেই নিঃশেষ হয়ে যায় নয়তো হারিয়ে যায়।’

পানি পা ভিজিয়ে ছোট ছোট কদম ফেলে এইদিকে আসছিল পুষ্পিতা। তানজিফের বলা কথাটা তার কর্ণকুহরে পৌঁছে গেলো।

‘ভুল জায়গায় সময় নষ্ট করলে তা দিন শেষে কষ্টের কারন হবেই।’

____________________

এবার পালা প্যারাসাইলিং করার। আধঘন্টা আগেই সবাই পৌঁছে গেছে পাঁচটি পাহাড়ের প্রাণকেন্দ্র দরিয়ানগর পয়েন্টে। অনেকেই আকাশে পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। তবে তা শুধু দশ থেকে বারো মিনিটের জন্য। তানজিফ মাত্রই প্যারাসাইলিং করে নেমে এসেছে।

‘অন্যরকম এক অনুভূতি ছিলো। এতো তাড়াতাড়ি নামাইলেন কেন? আরো কয়েক মিনিট রাখলে কি আপনাগো বারা ভাতে ছাই পড়তো?’ বলে সে একটু সাইডে এসে দাঁড়াল।

আরো একজন ছেলে এগিয়ে যেতে পুষ্পিতা প্রফুল্ল গলায় বলল,

‘এবার আমি যাবো প্লিজ। আমার আর তর সইছে না।’

একটা ছেলে সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে পুষ্পিতাকে। সে উত্তেজিত, অতি আবেগাপ্লুত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যাচ্ছে সে। ঝারি দিলো তানজিফ।

‘ভালো করে ব্রিফিং দেখ। নাহলে মাঝ সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা লাগবে।’

তানজিফের ধমকে ভেঙচি দেয় পুষ্পিতা। প্যারাসুট বেঁধে দেওয়া হলো। স্পিডবোট তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তীব্র গতিতে সে একটু একটু করে উপরে উঠছে। সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। প্রথমে একটু একটু আকাশে উড়া চমৎকার অনুভূতির সৃষ্টি করলেও পরে এটা রূপ নেওয়া ভয়ে। পুষ্পিতার হাত পা কাঁপতে শুরু করে । হৃদপিণ্ড ধুকপুক করছে খুব ক্ষীপ্র গতিতে। নিচের দিকে তাকালেই আত্মা কেঁপে ওঠছে তার। এক পর্যায়ে সে কান্না শুরু করে দেয়।

নিচ থেকে সবাই ভাবলো পুষ্পিতা আকাশে উড়া খুব এনজয় করছে। তারাও হাত নাড়িয়ে চিৎকার শুরু করলো।

তানজিফের ভেতরটা কেমন খচখচ করছে। সে দৌড়ে গিয়ে একজন কে বলল প্যারাসুট নামানোর জন্য। তিনিও ব্যপারটা বুঝতে পেরে সময় শেষ হওয়ার আগেই প্যারাসুট নামানোর ব্যবস্থা করলেন।

একটু একটু করে প্যারাসুট নিচের দিকে নামছে। পুষ্পিতা ভয়ে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। দুচোখ ভেজা তার। ভয়ে কাঁদছে সে। সবাই দৌড়ে গেল সেইদিকে। বালি স্পর্শ করেছে পুষ্পিতার পা। জারিন গিয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করল। পুষ্পিতার দৃষ্টি সেইদিকে না। তার দৃষ্টি তানজিফের দিকে। দিক বেদিক না ভেবে পুষ্পিতা আষ্টেপৃষ্টে তানজিফকে জড়িয়ে ধরে।

তানজিফ অনুভব করল পুষ্পিতার শরীর কাঁপছে। হৃদপিন্ডও ওঠানামা করছে খুব দ্রুত গতিতে। বার বার ফাঁকা ঢুক গিলছে সে।

তানজিফ পুষ্পিতার মাথায় হাত রেখে আশ্বস্তের স্বরে বলল,

‘এই জন্য আমি নিষেধ করেছিলাম। করলি তো বেশি পাকনামি।’

_______________

প্যারাসাইলিং এর পর্ব শেষ। এবার সূর্যাস্ত দেখার পালা। লালাভ সূর্যটা একটু একটু নিচের দিকে নামছে। সৈকতের এপার থেকে মনে হচ্ছে হয়তো ওপারে সূর্য তলিয়ে যাচ্ছে। সূর্য যত নিচের দিকে যাচ্ছে ধরনীর উজ্জ্বলতাও ক্ষীণ হয়ে আসছে।

সবাই বিভিন্ন ভাবে সূর্যকে ছোঁয়ার ভান করে ছবি তুলছে। তবে হাসি নেই শুধু পুষ্পিতার মুখে। সে হাত ভাঁজ করে অপলক তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। চোখ বন্ধ করলেই তখনকার দৃশ্য ভাসছে চোখে।

জারিন কাঁধে হাত রাখতেই সে চমকে তাকাল। জারিনও পুষ্পিতার পাশাপাশি দাঁড়ায়।

‘তানজিফকে জড়িয়ে ধরায় অনেকে কানাঘুঁষা করছে।’

কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো না পুষ্পিতা।

‘ভয় পেয়েছি সেজন্য ধরেছি। এখানে কানাঘুঁষার কি আছে?’৷ কিয়ৎকাল চুপ থেকে পুষ্পিতার সহজসরল স্বীকারোক্তি।

‘তোর সামনে তো আমিও ছিলাম। আমাকেও ধরতে পারতি।’

‘ওই মুহুর্তে সেই বিরক্তিকর মানুষটাকে আমার সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আর বিশ্বস্ত মনে হয়েছিল।’
#অতঃপর_সন্ধি (১২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

ঢাকা ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। পুষ্পিতা গায়ে চাদর জড়িয়ে নিলো ভালোমতে।

‘জারিন আমার প্যাকিং শেষ। একটু বিচ থেকে হেঁটে আসি। আর কখনো কক্সবাজারের মুখ দেখবো কি না কে জানে। তুই যাবি?’

জারিনের তখনো গোছগাছ শেষ হয়নি। সে ব্যস্ত গলায় জবাব দিলো,

‘আমার প্যাকিং শেষ হয়নি। তুই যা। আর শুন তাড়াতাড়ি ফিরবি। বাস কিন্তু দশটায় ছাড়বে। মোবাইল নিয়ে যা সাথে করে।’

বিচে ধীর পায়ে হাঁটছে পুষ্পিতা। বাতাসে চুলগুলো উড়ছে এলোমেলো ভাবে। হাঁটতে হাঁটতে মুখোমুখি হয়ে যায় তানজিফের। তানজিফ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে পুষ্পিতার ডাকে পা থেমে যায় তার। অনড় রইলো সে।

‘তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।’ পুষ্পিতার কোমল কন্ঠস্বর।

‘কিন্তু আমার তোর সাথে কোনো কথা নেই।’ রূঢ় স্বরে বলল তানজিফ।

‘তোর ভাব দেখানোটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’

পুষ্পিতার প্রশ্নে নিশ্চুপ রইলো তানজিফ। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পুষ্পিতা পুনরায় বলল,

‘হাম্বেল রিকুয়েষ্ট করছি। চল না প্লিজ।’

__________________

বালির উপর জুতো বিছিয়ে তার উপর বসে আছে পুষ্পিতা আর তানজিফ। ঢেউয়ের কলকল ধ্বনি শ্রবণগ্রন্থিতে ধাক্কা দিচ্ছে বারংবার। আজকের পর আর উর্মিমালার নিনাদ শোনা হবে না এতো কাছ থেকে।

‘আন্টি আর মা বান্ধবী সেই ছোটবেলা থেকে। তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন এতোটাই অটুট যে আজও তারা একসাথে। তুই আর আমি কি এমন বন্ধুত্ব গড়তে পারি না? ভুলে যা মাঝের সবকিছু। আমিও ভুলে যাবো।’

পুষ্পিতার কথায় তানজিফ হাসলো৷ তবে সে হাসির কোনো শব্দ হলো না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা মুঠোবন্দি করল সে। নিপীড়িত বালুকণা মুঠোর চাপ সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে এলো মুঠোবন্দি আঙ্গুলের ফাঁকফোকর দিয়ে। সেদিকে তানজিফ চেয়ে রইলো অনিমেষ।

‘যখন থেকে আমি অনুভূতি নামক শব্দটার মানে বুঝি তখন থেকেই আমার কাছে অনুভূতি মানে তুই। কেউ ভালোবাসার কথা বললে আমি চোখ বন্ধ করলে তোকেই অনুভব করি বারংবার।’

ঘাড় কাত করে পুষ্পিতার দিকে চাইল সে। চোখে চোখ পড়তেই পুষ্পিতা হকচকিয়ে গেল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।

‘তুই আমাকে বার বার রিজেক্ট করে গিয়েছিস। তারপরও আমি তোর কাছে গিয়েছি তোর মুখ থেকে পজিটিভ কিছু শোনার জন্য। হয়তো আমার ভালোবাসা তোর চোখে পড়েনি। ইট’স ওকে। আমি ভালোবাসি বলে তুইও ভালোবাসবি এমন তো না। কিন্তু,,,,

গলা ধরে এলো তানজিফের। শব্দগুলো ভেঙে ভেঙে আসছে। নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য পরপর কয়েকটা ফাঁকা ঢুক গিলে।

‘তোর সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব গড়া মানে নিজেকে নিজে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া। বুকের ভেতরটা আমার দুমড়ে মুচড়ে যায়। তুই আমার না ভাবলে বুকের ভেতরে কেমন জ্বলন শুরু হয়। দুনিয়াটা কেমন অন্ধকার হয়ে যায়। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে এখন অব্দি আমার যত্নে গড়া ভালোবাসা কেউ একটু একটু করে নিজের করে নিচ্ছে। এই বিশ্রী অনুভূতি কখনো ব্যক্ত করা যায় না আর না যাবে। আমার অদৃশ্য যন্ত্রণাগুলো শুধু আমার। কেবলই আমার। ভালো আছি তুই আমার থেকে দূরে আছিস বলে। আধ শুকনো ঘা টা আবার তাজা করিস না। আমি সহ্য করতে পারবো না।’

মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে পুষ্পিতার। একজন কূল হারা মাঝি মাঝসাগরে যেমন অসহায় তারও নিজেকে এমন লাগছে। শরীরে বল পাচ্ছে না বিন্দুমাত্র। অস্থিরতার সাথে গাল বেয়ে পানি পড়ছে।
কারো অনুভূতি এতটা প্রখরও হয়?’ নিজেকে প্রশ্ন করলো সে। কিন্তু মন মস্তিষ্ক কোনো জবাব দিলো না। জং ধরেছে সেখানে ।

‘এই যে তুই আমার পাশে বসে আছিস, আমার বুকের ভেতরের তোলপাড়টা শুধু আমি বুঝতে পারছি। সেই তোলপাড়ের দামকা হাওয়া কখনো তুই টের পাবি না। বন্ধুত্বের অযুহাতে অন্যায় আবদার করিস না। আমি রাখতে পারবো না।’

চেপে রাখা কান্নাটা মৃদু শব্দে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো পুষ্পিতার। তানজিফ শুনলো কিন্তু কিছু বললো না। এভাবে কেটে গেলো কয়েক সেকেন্ড কয়েক মিনিট। পুষ্পিতার কান্না থেমেছে।

‘তা বিয়ে করছিস কবে?’

পুষ্পিতা এক পলক তানজিফের দিকে চাইল।

‘মায়ান আগে অনার্স কমপ্লিট করুক।দেড়মাস পরে ফাইনাল। এরপর জব খুঁজবে। আমিও অনার্স কমপ্লিট করি। এর মাঝেও চাকরির ব্যবস্থা না করতে পারলে আমি মাস্টার্স করবো।’

‘ওহ’ বলে তানজিফ চুপ রইলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখলো।

‘এখন সবাই খাবে। হোটেলে যা। খাওয়ার পর আমরা রওনা দিবো।’

উঠে দাঁড়ায় পুষ্পিতা। সামনের দিকে কদম ফেলার আগে তানজিফ আবারও ডাকল।

‘পুষ্প?’

ফিরে তাকায় পুষ্পিতা।

কোনো জবাব না দিয়ে তানজিফ পুষ্পিতার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পিতা হয়তো তানজিফের মনের কথা বুঝতে পারলো। একগাল হেসে বলল,

‘কি বলবি? আমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবি তাই তো?’

দুপাশে মাথা দুলায় তানজিফ।

‘না।’

‘তবে?’

‘তোর ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। এক তরফা ভালোবেসে আমি যে আকাশসম যন্ত্রণা ভোগ করছি বিচ্ছেদ হলে তুই তা সহ্য করতে পারবি না।’

__________________

পুষ্পিতারা কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফিরেছে আজ দুইদিন। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে পুষ্পিতা। নাস্তা করার জন্য আফসানা হক বার কয়েক ডেকে গিয়েছেন। ঘুমের জন্য চোখ মেলে রাখা হয়ে পড়েছে পুষ্পিতার। ফোনের বিকট শব্দে শোয়া থেকে সোজা বসে পড়ে সে। ঘুমের জন্য ঢুলছে সে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখল মায়ানের কল। রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে ঘুমো ঘুমো গলায় বলল,

‘বলেন।’

‘এখনো ঘুমোচ্ছেন?’

সে আবারও জবাব দিল, ‘হুম।’

‘শুনুন, আপনার সাথে এইবছর আর আমার দেখা হচ্ছে না।’

ঘুম ছুটে গেলো পুষ্পিতার।সোজা হয়ে বসল সে।

‘কেন আর দেখা হবে না?’

‘না, আমাদের আবার নতুন বছর দেখা হবে। আমি আজ বাড়ি যাবো। পরশু নাকি শিমুল কে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।’

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বলে মায়ান এই বছর আর দেখা হবে না কথাটা এজন্য বলেছে। এতোক্ষণে বুঝতে পারলো পুষ্পিতা।

‘মাস খানিক পর তো পরীক্ষা তখন আর যাওয়া হবে না।তাই এখন বেশ কয়েকদিন থেকে আসবো।’

‘আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?’

‘এখন?’

‘হুম।’

‘কিন্তু আমি তো প্যাকিং করছি।’

‘এতোকিছু জানি না। আপনি আধঘন্টার মাঝে আপনি আসেন।’

কফি-শপের একদম কর্নারে বসে আছে পুষ্পিতা আর মায়ান। পুষ্পিতা ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। দ্রুতবেগে ব্যাগ থেকে দু’টো থ্রি-পিস বের করে টেবিলের উপর রাখল।

‘আপনার ছোট দুই বোনের জন্য।’

মায়ান স্তম্ভিত। বিস্মিত, আশ্চার্যান্বিত চোখে পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘হা হয়ে থাকলে মশা ঢুকবে।’

নিজেকে সামলে নিলো মায়ান।

‘এসব কেন?’

‘ভালো লেগেছে তাই। এখন যেতে পারেন। আপনার কাজ শেষ।’

‘আপনি তো বড্ড সুবিধাবাদী। নিজের কাজ শেষ বলে চলে যেতে বলছেন।’

‘তো বসে থাকেন আপনি। আমি চলে যাই।’

‘চুপচাপ বসে থাকেন। যে ক’দিন দেখা হবে না সেগুলো আগে পুষিয়ে নেই।’

______________

সময় তার নিজ গতিতে চলে। চোখের পলকে আরো একটা করে বছর শেষ হয়ে গেলো। তানজিফের ফাইনাল শেষ। তবে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে সে।।বৈশাখে শিমুলের বিয়ে। সেজন্য আরো কয়েকটা টিউশনি নিয়েছে। চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুষ্পিতাকে তেমন একটা সময় দিতে পারছে না সে।কেন সময় দিতে পারছে না কারনটা জানা পুষ্পিতার। তাই এটা নিয়ে পুষ্পিতার কোনো অভিযোগ নেই

ফারদিনকে পড়াচ্ছে মায়ান। খুব মনযোগ দিয়ে অংক বুঝানোর চেষ্টা করছে।

পুষ্পিতা মায়ানকে একটা নজর দেখার জন্য ফারদিনের রুমের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। কোনো অজুহাতে রুমে ঢুকতে পারছে না। নাস্তাও আফসানা হক দিয়ে গেলে একটু আগে। খুব সন্তর্পণে এদিক ওদিক তাকিয়ে পর্দা ফাঁক করে মায়ানকে একটা নজর দেখে নিলো। আবারও এদিক ওদিক তাকাল আফসানা হক আসছে কি না তা দেখার জন্য। পর্দাটা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে আবারও মায়ানের দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল পুষ্পিতার। হকচকিয়ে গেল সে। মায়ান ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি?’

জিভে কামড় দেয় পুষ্পিতা। তাড়াতাড়ি করে পর্দা টেনে দিলো।

পুষ্পিতার এহেন কান্ডে বিস্তীর্ণ হাসলো মায়ান। মায়ানকে হাসতে দেখে ফারদিন প্রশ্ন করল,

‘ভাইয়া হাসছেন কেন? আমার ম্যাথ কি হচ্ছে না?’

ফারদিন যে সামনে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল মায়ান। নিজেকে সামলে নিলো সে।

‘হয়েছে, ম্যাথ সম্পূর্ণ করো।’

লজ্জায় বালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো পুষ্পিতা। অকস্মাৎ মোবাইল টুং করে শব্দ হলো। মোবাইল হাতে নিলো সে।মায়ান মেসেজ করেছে।

‘এভাবে লুকিয়ে পর্দার আড়াল থেকে দেখছেন কেন ফুলবানু? সাহসী মেয়েদের মতো কাছে এসে বলবেন, ‘আপনি সোজা হয়ে বসুন আমি আপানকে দু’চো ভরে দেখবো।’ আফটার অল মনে প্রানে মানুষটা তো আমি আপনারই।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here