অতঃপর সন্ধি পর্ব -১৬+১৭

#অতঃপর_সন্ধি (১৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘পুষ্পিতা আমি যদি তোকে আবারও বিরক্তি করি সহ্য করে নিবি?’

নিশ্চুপ রইলো পুষ্পিতা। নিরবতা ঘিরে রেখেছে তার চারপাশ।

‘মানুষের কিছু কিছু অনুভূতি অব্যক্ত। তুই আমার সেই অব্যক্ত অনুভূতি।’

নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছে পুষ্পিতা। গাল বেয়ে সমান্তরালে ঠকে যাওয়ার দুঃখ গড়িয়ে পড়ছে। তানজিফে কলিজা ছেদ করা কথায় কেন কাঁদছে তার জানা নেই। তানজিফ তো তাকে একতরফা ভালোবাসে। সে তো বাসে না।তাহলে তানজিফের কথাগুলো শুনে অন্তঃস্থলে থেকে থেকে ধঁক করে উঠছে। কোথাও নিজের অনুভূতি অপাত্রে দান করলো না তো? নিজের করা প্রশ্নের বানে জর্জরিত
সে।

‘পুষ্পিতা চুপ করে না থেকে কিছু বল না? আমি তোর হাতটা সারাজীবনের মতো ধরতে চাই। অধিকার দিবি? আমি তোকে সারাটা জীবন আগলে রাখবো। কারো মতো হাজারো স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝপথে ছেড়ে যাবো না। আমার শুধু তোকে চাই।’

বুক ভেঙে আসছে পুষ্পিতার। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। বুকের বাপশে যেন কেউ পাথর চাপা দিয়েছে। এমন অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। একনাগাড়ে হেঁচকি দিয়ে চলেছে।

‘আমি তোকে বলেছিলাম শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তোর অপেক্ষা করবো। আমি প্রতিটা রাতে প্রার্থনা করেছি আল্লাহ যেন কোনো একটা রাস্তা বের করে দেয় তোকে পাওয়ার জন্য।’

কথাগুলো বলতে কষ্ট হচ্ছে তানজিফের। ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে।

‘চোখ বন্ধ করলে যখন তোকে ওই ছেলেটার পাশে দেখতাম আমার বুকের ভেতরে যে যন্ত্রণা হতো তা বলে বুঝাতে পারবো না। একেকটা রাত আমার কাছে ঠিক কতটা দীর্ঘ ছিলো শুধু আমিই জানি।’

কানে মোবাইল ঠেকিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল পুষ্পিতা। এবার কান্নার শব্দ তানজিফ শুনতে পাচ্ছে। তানজিফ নিজের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর জন্য।

‘আমি তোকে বুকে নিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসতে চাই। আমার নির্ঘুম রাতের কষ্টগুলো পুষিয়ে নিতে চাই।’

পুষ্পিতা একটা কথার জবাব দিতে পারলোনা। মোবাইল বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তানজিফের কাতর স্বরে করা একেকটা অনুরোধ পুষ্পিতার বুকে প্রলয় বয়ে যাচ্ছে। খুব ভয়ংকর প্রলয়। বুকের নিপীড়িত ক্লেশ, যন্ত্রণা খোলা আকাশে বিলিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু তা বুকটাকেই আঁকড়ে ধরে আছে খুব শক্ত করে।

___________________

‘তোরে হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে ভার্সিটিতে নিয়ে আসলাম ক্লাস না করে সং হয়ে বসে থাকার জন্য?’

চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল জারিন। ভার্সিটির মাঠে হাঁটুর ভাঁজে মাথা গুঁজে বসে আছে পুষ্পিতা।

‘যে তোকে ছেড়ে দিতে দু’বারও ভাবেনি তার কথা চিন্তা করে কেন মানসিক চাপ বাড়াচ্ছিস?’

‘চাইলে সবকিছু পারা যায়?’ মাথা উঁচিয়ে অসহায়চিত্তে বলল পুষ্পিতা।

‘ঢং বাদ দে। মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। হয়ত সময় সাপেক্ষ। বছরের পর বছর সংসার করার পরও বিচ্ছেদ হয় মানুষের। তারাও আবার নতুন করে শুরু করে। অন্যকারো সাথে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। নিজের ভালো থাকার জন্য মানুষ সব করতে পারে। করতে হয়। হাজারো ঝড় ঝাপটার পরে নিজের জীবনটা নিজেকেই গুছিয়ে নিতে হয়।অন্য কেউ এসে গুছিয়ে দিয়ে যাবে না।’

‘বলা যতটা সহজ করা ততটা সহজ না। একটা মানুষ আরেকটা মানুষের সাথে চব্বিশ ঘণ্টা মানসিকভাবে এটাচড থাকার পর হুট করে কোনো কারন ছাড়াই যখন দূরে সরে যায়, তখন ওই পরিস্থিতির মধ্য যাওয়া কতটা যন্ত্রণাদায়ক শুধু সে জানে। তারপরও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি।’

পীড়িত মুখে কথা গুলো বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল পুষ্পিতা।

‘এখনো স্বাভাবিক আছিস কারন ভালো লাগা আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্যটা তুই করতে পারিসনি। তোর পছন্দের ব্যপারগুলো উনার মাঝে পরিলক্ষিত হতেই তুই বুঝে নিলি তুই উনাকে ভালোবাসিস। এরকম হাজারো ছেলে আছে। তার মানে কি তুই সবাইকে ভালোবাসিস?’

চোখ বড় বড় করে জারিনের দিকে প্রশ্নসূচক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতা। জারিনের কথা কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। জারিন পুষ্পিতার হাতটা ধরলো।

‘এমন না যে ভালোবাসলে তার মাঝে তোর পছন্দের সবগুলো দিক থাকবে। তোর অপছন্দের দিকগুলো মানিয়ে নেওয়াই হচ্ছে ভালোবাসা।’ খানিক চুপ থেকে পুনশ্চ বলল,

‘ভালোবাসায় স্যাক্রিফাইস থাকে কম্প্রোমাইজ থাকে।’

‘আমি মায়ানকে ভালোবাসি।’

‘তাহলে তানজিফ নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াতে চুপসে গিয়েছিলি কেন? তানজিফ যখন তোকে দেখেও মুখ ফিরিয়ে নিতো তোর মুখের ভাব গতি পাল্টে যেতো। তখন কেন বার বার বলতি ওর ভাব বেড়েছে? তোর তো খুশি হওয়ার কথা ছিলো। তুই মুখে বলতি এক কথা তোর চোখ জোড়া বলতো অন্য কথা।’

মাথা নিচু করে ফেলে পুষ্পিতা। তার কাছে এর কোনো উত্তর নেই।

‘বিরক্ত হওয়ার মাঝে তোর অনুভূতি ছিলো। যা তুই কখনো অনুভব করতে পারিসনি। তুই কখনো তানজিফের চোখের দিকে তাকিয়েছিস? তাকাসনি। যেই চোখে তোর জন্য হাজারো ভালোবাসা ছিলো। যে চোখে ছিল তোকে পাওয়ার তৃষ্ণা।’

________________________

বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে সবুজ ঘাসে আঁকিবুঁকি করে চলেছে পুষ্পিতা। তীক্ষ্ণ আর সূঁচালো চোখে পুষ্পিতা কে পর্যবেক্ষন করছে জারিন। এতোক্ষণের এতো কথা যেন পুষ্পিতা শুনতেই পায়নি এমন ভাব। পুষ্পিতার গা-ছাড়া ভাব দেখে দাঁত কটমট করছে সে। জারিন রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘এই মিডটার্মে যদি তোর জন্য আমার রেজাল্ট খারাপ হইছে তো, তোরে আমি খাইছি।’

‘কাল রাতে আমি একটারও উত্তর পাইনি পুষ্পিতা। আমার উত্তর চাই।’

মোটা ভারী গলার আওয়াজ শুনে মাথা তুলে তাকায় পুষ্পিতা। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তার। যেন কেউ খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যঘাত ঘটিয়েছে।

‘যেখানে উত্তর তোর জানা আর কি উত্তর দিবো?’

‘তাহলে রাতে এভাবে কাঁদছিলি কেন?’

‘আমার মন চেয়েছিল কেঁদেছি।তোর সমস্যা?’

‘অবশ্যই সমস্যা।’

কথা বাড়াল না পুষ্পিতা। চুপ করে বসে রইলো। জারিন দুজনের কথার কিছুই বুঝলো না। বোকার মতো চেয়ে রইলো। তানজিফ ব্যাগটা পাশে রেখে ধপাস করে বসে পড়লো।

‘অধিকার দিলে আমি কখনো তোকে বিগত দিনগুলোর জন্য কথা শুনাবো না।’

‘বিয়ে করতে পারবি আমাকে?’ উদাসীন, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল পুষ্পিতা।

পুষ্পিতার আকস্মিক কথায় যেন বাজ পড়লো জারিনের মাথায়। অবাক নেত্রে চেয়ে রইলো পুষ্পিতার পানে।

‘বিয়ে করার জন্য নিশ্চয়ই অধিকার চাইছি?’

‘প্রথম প্রথম এমন বড় বড় কথা সবারই থাকে। মাস ছয়েক পরে সবই ফুউউস হয়ে যায়। ছেড়ে দে ভাই। আমার একবার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে।’

‘ধরলে সারাজীবনের জন্য আকঁড়ে ধরবো। মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার জন্য না।’

‘কি করিস তুই? বিয়ে করলে কি খাওয়াবি?’

‘কেন তুই কি প্রতিদিন এক মণ চালের ভাত খাস?’

নাক উঁচু করে পুষ্পিতা তানজিফের দিকে তাকায়। জারিন মিটিমিটি হাসছে।

তানজিফ আরো একটু এগিয়ে বসল। হাত বাড়িয়ে পুষ্পিতার হাতটা ধরতে গিয়েও ধরলো না। কোমল গলায় বলল,

‘সবাই তো ক্যারিয়ার আর পরিবারের দোহাই দিয়ে ছেড়ে চলে যায়। আমি না হয় তোর হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের ক্যারিয়ার গড়লাম। আর ক্যারিয়ার গড়তে না পারলে বড় কোনো শপিং মলের সামনে বসে দুইজন মিলে ভিক্ষা করবো। হবে না?’

তানজিফের চোখের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতা। হুট করে মায়ানের বলা শেষ কথাটা মনে পড়ে গেল, ‘ব্রাইট ফিউচার দেখে ছাড়তে চাইছেন না?’

একজন ব্রাইট ফিউচার হবে বলে পুষ্পিতাকে ছেড়ে গেলো।আরেকজন পুষ্পিতার হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাইছে। দুইটা কথার বেড়াজালে আটকে গেলো পুষ্পিতা। অপলক তাকিয়ে আছে তানজিফের দিকে। কিন্তু মাথার উপরে ঘুরঘুর এগুলো।

তানজিফ এবার সাহস করে পুষ্পিতার হাতটা আলতো করে ধরলো। পুষ্পিতার চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে আকুল, কাতর স্বরে কন্ঠনালী দিয়ে উচ্চারণ করলো,

‘আমার হৃদয় ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত করা তোর চোখের পানি মুছে দেওয়ার অধিকার চাইছি। দিবি সেই অধিকার?’

#চলবে#অতঃপর_সন্ধি (১৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

আঙুলের ফাঁকে কলম গুঁজে সেই কলম কে নাচাচ্ছে পুষ্পিতা। পুরো মনোযোগ তার বইয়ে। ফাইনাল ইয়ার পড়াশোনার চাপটাও বেশি। দৈবাৎ মায়ানের স্মৃতি মস্তিষ্কে বিচরণ করতেই কলম রেখে দিলো বইয়ের উপর। অনুভূতি যেন ডানা মেলে ঝাপটানো শুরু করলো মনের আনাচে-কানাচে। চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে রইলো। সমস্ত কায়া যেন পুষ্পিতার অসাড় হয়ে এলো। নড়ার বিন্দুমাত্র শক্তি পেলো না। একটু একটু করে মিলিয়ে যাওয়া ক্ষ’তটা পুনরায় মাথা চারা দিয়ে উঠছে। অদৃশ্য র’ক্ত’ক্ষ’র’ণ হচ্ছে সেই ক্ষ’ত হতে। ঘায়ের গভীরতা খুব বেশি। বুকের ভেতর জ্বলছে। পুষ্পিতা কি ভেবে বালিশের তলা থেকে মোবাইল বের করলো। মায়ানের রেস্ট্রিকটেড করে রাখা আইডিতে গেলো। হয়তো বা স্যরি লেখা থাকবে সেই আশায়। তবে যা দেখলো তাতে যেন ক্ষরিত র’ক্তের মাত্রা বাড়লো ক্রমান্বয়ে। ঝাপসা হয়ে এলো তার চোখ। নিমিষ ফেলতেই গাল স্পর্শ করলো নেত্রজল। চোখের ভুল ভেবে পুনরায় পড়লো মায়ানের প্রেরিত বার্তা।

‘বান্ধবীকে দিয়ে কল করিয়েছেন আপনার হয়ে ওকালতি করতে? এই আপনার আত্মসম্মান? ছেলের কি অভাব পড়েছে যে আপনার আমাকেই লাগবে? নাকি ভবিষ্যত সুখের আশায় আমায় ছাড়তে চাইছেন না?’

নিচে লেখা, দিস পার্সোন ইজ নট এভেইলেভল।

চোখ জোড়া মুদে আসছে পুষ্পিতার। যতটুকু অনুভূতি অবশিষ্ট ছিলো আজ সেটাও বিলীন হয়ে গেলো। আর বাকিটুকু শুধু ঘৃণা।

_______________________

ক্লাস রুমে সবার সাথে গানের সুর মিলিয়েছে জারিন।

‘বন্ধুরা এলোমেলো
মুঠো ভোরে নিয়ে এলো
আনকোরা সূর্যের লাল
কলেজের ঘাসে ঘাসে
হুল্লোড় ক্যাম্পাসে
একমুঠো ছুটির সকাল।’

হনহনিয়ে পুষ্পিতা এসে জারিনের সামনে দাঁড়াল।পুষ্পিতার চোখ দিয়ে যেন অগ্নি ঝরছে। জারিন হাসিমুখে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’

পুষ্পিতা ক্লাসের কাউকে পরোয়া না করে কষিয়ে চড় বসিয়ে দিলো জারিনের গালে। আকস্মিক, অতর্কিত অভিক্রমণে জারিন আহাম্মক হয়ে গেলো। হাসিখুশি, আনন্দঘন পরিবেশ মুহুর্তেই থমথমে হয়ে গেলো। সবার মুখের খুশির ঝলক সরে গিয়ে আঁধার নিমজ্জিত হয়ে গেলো এক লহমায়। উপস্থিত সকলের চোখেমুখে প্রশ্নের ছড়াছড়ি। গালে হাত রেখে পুষ্পিতার দিকে নিমেষহীন চোখে তাকিয়ে আছে জারিন।

‘নিজেকে খুব চালাক মনে করিস তুই?’ কান্নামাখা স্বরে বলল পুষ্পিতা। জারিন তখনো নির্বোধ, বেকুবের মতো পুষ্পিতার দিকে চেয়ে রইলো। ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো পুষ্পিতা। পুষ্পিতা চোখ মুছে জারিনের হাতটা শক্ত করে ধরলো। টানতে টানতে নিয়ে গেলো বাইরে। বাইরে গিয়ে পুষ্পিতা জারিনের হাত ছেড়ে দিলো।

‘আমার পিছু পিছু আসবি। তোর সাথে আমার বোঝাপড়া বাকি।’

জারিনও বাধ্য মেয়ের মতো পুষ্পিতার পিছু পিছু যেতে শুরু করলো। পুষ্পিতার এমন অদ্ভুত আচরণ কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না।

ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের পিছন দিকটায় এসে থামল পুষ্পিতা। তার পিছনে জারিনও এসে দাঁড়াল।

‘তুই মায়ানের সাথে কেন কথা বলেছিস?’ বলে জারিনের চোখের দিকে তাকাল পুষ্পিতা। মাথা নুইয়ে ফেলে জারিন। পুষ্পিতা পুনরায় ব্যগ্র, কাতর স্বরে বলল,

‘আমার জন্য কেন অপমানিত হতে গেলি? তুই আমার বান্ধবী কম বোন বেশি। আর কোথাকার কে তোকে আমার জন্য কথা শুনিয়ে দিলো।’ কন্ঠনালী অসহায়ত্বের ছাপ পুষ্পিতার।

জারিন পুষ্পিতার গালে হাত রাখে আলতো করে। বিষন্ন মুখে মৃদুস্বরে বলল,

‘বান্ধবী কম বোন বেশি। সেজন্য বোনের কষ্টটা আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তোর প্রাণহীন, নির্জীব চোখ, মলিন মুখ আমার কাছে বি’ষে’র মতো ছিলো। তাই,,,,

‘তাই? তাই কি করলি? গলা ধরে এলো পুষ্পিতার। বিলম্ব না করে জারিনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।
চক্ষে পানি টইটম্বুর। দু’পাপড়ির আলিঙ্গনে গাল স্পর্শ করবে সেই পানি।

‘যেন তোদের দূরত্ব মিটে।’

‘যে মানুষটা নিজে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে সে আর কখনো আমার কাছে আসবে না। আমাদের সন্ধির বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। সে মানুষটা আমার না।’

আচমকা করতালির শব্দে জারিনকে ছেড়ে দিলো পুষ্পিতা। সামনে তানজিফ।

‘মেয়েরা আসলেই অদ্ভুত। একজন তোকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে সেদিকে তোর খেয়াল নেই।আর যে তোকে চাইছে না বার বার তার কাছেই ছুটে যাচ্ছিস। আসলে কি বলতো আমার ভাগ্যটাই খারাপ। শত চেষ্টা করেও আমার আবেগ অনুভূতি তোকে বুঝাতে পারছি না।’ বিবর্ণমুখ তানজিফের। আরো দু’পা এগিয়ে এলো সে।

‘আমার অনুভূতির গভীরতা কখনো মাপার চেষ্টা করেছিস পুষ্পিতা?’

মাথা নুইয়ে ফেলে পুষ্পিতা। নিস্তেজ হাসলো তানজিফ। চোখেমুখে হতাশার ছাপ।

‘কখনো যদি মাপার চেষ্টা করতি হয়তো তলিয়ে যেতি। তুই নিজেও জানিস আমি তানজিফ তোকে কতটা ভালোবাসি। তুই বুঝেও না বুঝার ভান করিস। এইচএসসি দেওয়ার পর বাবা চেয়েছিল আমি যেন বাহির থেকে পড়াশোনা কমপ্লিট করি। আমি শুধু তোর কাছাকাছি থাকার দেশে রয়ে গেলাম। সাবজেক্ট আমার জন্য পড়তে কষ্টকর হয়ে পড়বে জেনেও আমি পড়ছি।তুই আমার র’ক্তে মিশে গিয়েছিস।’

নিজের মনের জমানো কথাগুলো বলে চলে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো তানজিফ। সামনের দিকে পা দিয়েও দিলো না। পিছন ফিরে বেদনার্ত কন্ঠে বলল,

‘আমার অনুভূতি আমি তোর হাতে তুলে দিলাম। আজকের পর আমি আর তোকে ভালোবাসি বলবো না। অপেক্ষায় থাকবো তোর মুখে শুনার জন্য।’

_____________________

হাসপাতালের করিডোরে বসে অনবরত কেঁদে চলেছে পুষ্পিতা। আশহাব শেখ এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা আশংকাজনক। অপারেশন থিয়েটারে আছেন। ওটির বাইরে দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে দাঁতে নখ কাটছে তানজিফ। গায়ের শার্ট তার র’ক্তে মাখামাখি।

তখন তানজিফ চলে আশার পর পুষ্পিতার মোবাইলে আননোন নম্বর হতে কল আসে একটা। জারিনকে কিছু না বলে হন্তদন্ত হয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসে। আধঘন্টা বাদে স্পটে পৌঁছে আশহাব শেখের র’ক্তা’ক্ত দেহ দেখে দু-চোখে আঁধার দেখে পুষ্পিতা। কি করবে না করবে ভেবেই যেন গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো। দিক বেদিক না ভেবেই তানজিফকে কল করে।

জারিনের কাঁধে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিয়েই যাচ্ছে পুষ্পিতা। থামার নাম নেই। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য জারিন এটা ওটা বলে যাচ্ছে। বাবার রক্তাক্ত মুখের সামনে কন্যার কোনো কথা কি বুঝ মানে। উপায়ন্তর না পেয়ে তানজিফ পুষ্পিতা সামনে এসে দাঁড়াল। পুষ্পিতা তানজিফের হাতটা খপ করে ধরে সেখানেই কপাল ঠেকাল। জারিন চোখের ইশারায় তানজিফকে বলল পুষ্পিতাকে একটু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। অন্যহাতে পুষ্পিতার মাথায় হাত রাখে তানজিফ। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল,নরম গলায় বুঝাল,

‘মা আন্টিকে নিয়ে আসছে হাসপাতাল। তোকে এই রূপে দেখলে আন্টিকে সামলানো দায় হয়ে যাবে। নিজেকে একটু শক্ত কর। আমাদের থেকেও আন্টির পাশে তোর দাঁড়ানোটা বেশি জরুরি। ফারদিনকেও সামলাতে হবে।’

মাথা তুলে পুষ্পিতা। উড়না দিয়ে চোখ মুছে নিলো ভালো করে।

‘আমি আর কাঁদবো না।’ বলেই নিরব হয়ে গেলো। বাদে বাদে হেঁচকি দিচ্ছে। তানজিফের চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও কেঁদে দিলো। তানজিফ সযত্নে পুষ্পিতার চোখের পানি মুছে দিলো।

‘কাঁদে না। আঙ্কেল একদম সুস্থ হয়ে যাবে।’

তানজিফ মুখের কথা শেষ করতে পারলো না, এর আগেই হাসপাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে তানজিফের পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়লো আফসানা হক। তানজিফ তড়িঘড়ি করে উনাকে ধরলেন।

‘পুষ্পিরে তোর বাবার কিছু হলে আমি বাঁচবো না।’

তানজিফ উনাকে বসালো। আপাতত সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।

______________________

অন্ধকারে নিমজ্জিত ধরনী। আশহাব শেখ কে আইসিউতে শিফট করা হয়েছে। রাত পেরোলেই কেবিনে দেওয়া হবে।

পুষ্পিতা জারিনের কাঁধে হাত রাখতেই কেঁপে উঠল সে।

‘বাবার বিপদ তো কেটে গিয়েছে। বাসায় চলে যা। আবার কাল সকালে আসিস। নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবি।’

‘তুই অসুস্থ হবি না?’

‘জানি না। তবে জানি আমার তোদের মতো বন্ধু আছে। যারা বিপদে সবার আগে ঝাপিয়ে পড়ে।’

‘আল্লাহ না করুক আমার ক্ষেত্রে এমন হলে তুইও আমার মতো করতি।’

‘হাসপাতালে এতোজন হয়তো এলাউ করবে না। বাসায় যা শাওয়ার নে। হালকা লাগবে।’

আফসানা হকের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল পুষ্পিতা। আফসানা হক মেয়েকে চোখের সামনে দেখে আবারও কান্নার জন্য উদ্যত হতেই পুষ্পিতা উনার গালে হাত রাখে।

‘কাঁদে না মা। বাবা আবারও সুস্থ হয়ে যাবে। তুমি আন্টির সাথে ফারদিনকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। আমি আছি এখানে।’

আফসানা হক বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন,

‘আমি তোর বাবাকে রেখে আমি কোথাও যাবো না।’

‘বাবাও অসুস্থ আবার তুমিও যদি অসুস্থ হও আমরা দুই ভাইবোন কোথায় যাবো মা? ভোর হলে আবার এসো।’

‘আন্টি পুষ্পিতা ঠিক বলেছে। আপনি মায়ের সাথে চলে যান।’

পুষ্পিতা উঠে দাঁড়াতেই ওড়নায় টান পড়ে তার। ফারদিন বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফোলা ফোলা চোখমুখ তার।

‘আমি আম্মুর সাথে যাবো না। আমি তোমার সাথে আব্বুর কাছে থাকবো।’

____________________

অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। সেদিনের পর হতে গত হয়েছে সাড়ে সাতটি মাস। পুষ্পিতার গ্রাজুয়েশন শেষ। মাস্টার্সে ভর্তি হবে ক’দিন বাদে। এক্সিডেন্টের পর থেকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটেন আশহাব শেখ।

ডিনার টেবিলে বসে আছে সবাই। পুষ্পিতা একটু পরে পরে আশহাব শেখের কপালে কাঁটা দাগটার দিকে তাকাচ্ছে আর তপ্ত শ্বাস ফেলছে। ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না তার।

এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে আফসানা হক। উৎফুল্ল গলায় বলল,

‘আজ দুপুরে মায়ান জাপান থেকে কল করেছিল। আমাদের সবার খবরাখবর নিলো। ফারদিনের পড়াশোনা ব্যপারে জিজ্ঞেস করলো।’

মায়ানের নাম শুনে চোখেমুখে কাঠিন্য দেখা দিলো পুষ্পিতার।মুহুর্তেই মাথায় র’ক্ত চেপে গেলো।

‘আসলেই ছেলেটা খুব ভালো। ব্যবহারও অমায়িক। কত ভালো ফিউচার। এমন একটা ছেলের হাতে পুষ্পিতাকে তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্তে মরতে পারতাম। আমার মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয়।’

ব্যস পুষ্পিতা নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারলো। আশহাব শেখের কথায় তেতে উঠলো।

‘ফিউচার ভালো হলেই তোমার মেয়ে সুখী হবে? তুমি জানো? একটা বেকার দেশে পড়াশোনা করেছে এমন ছেলে তোমার মেয়েকে সুখী করতে পারবে না? ফিউচার ভালো না দেখো কে তোমার মেয়েকে চায়। আর কে তাকে সুখী করতে পারবে।’

‘পুষ্পিতা বাবার সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? এই শিক্ষা আমি দিয়েছি?’

‘তোমরা কেন একজন সফল ছেলেকেই খুঁজো? যে ছেলেটা বেকার সেই ছেলের কথা কেন ভাবতে পারো না? বরং একটা বেকার ছেলের পাশে থেকে একটা মেয়ে যখন তার ক্যারিয়ার গুছিয়ে দিবে তখন মেয়েটার মর্ম বুঝে।’

‘যখন মা হবে তখন বুঝবে কেন করে এমন। প্রত্যেক বাবা মা তার সন্তানকে সুখী দেখতে চায়।’

___________________

রুমে এসে তানজিফের নম্বরে ফোন লাগালো। রাগে গা রিঁ রিঁ করছে তার। ফোন রিসিভ হতেই তানজিফ কে কিছু বলতে না দিয়ে কর্কশ গলায় বলল,

‘তুই আমার উত্তরের আশায় ছিলি না? আমি তোকে সাতদিন সময় দিলাম। এই সাতদিনের মধ্যে তুই পরিবার নিয়ে আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবি। সাতদিনের এক সেকেন্ড পরে এলেও তুই আমাকে আর পাবি না। আমার তোর পাশে থেকে তোর সফল ক্যারিয়ারের সঙ্গী হতে চাই। প্রমাণ করতে চাই সব মেয়ে ব্রাইট ফিউচার দেখলে জোর করে থাকে না। একটা বেকার ছেলের হাতও মেয়েরা ধরে।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here