অতিরিক্ত চাওয়া পর্ব ১১

অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
১১

ঘুম ভাঙতেই, বিছানা থেকে লাফ মেরে উঠে দ্রুত মাকে খুঁজতে শুরু করেছে বেলি,
— মা রুমালটা দেখেছ? বিছানায় ছিলো তো?
খুশি চেয়ারে বসে এবং তাঁর কোলে বাবলু ঢুলে আছে, চোখ বুঝে ঢুলে থাকা বাবলু চিকন গলায় বলল,
— ঘুম থেকে উঠতেই রুমাল-রুমাল করছে, সন্দেহের বিষয় এটা মা! কড়া চোখে-চোখে রাখতে হবে!
— তুই চুপ থাক! পেয়েছিলে মা?
খুশি ছেলের ছোট-ছোট চুলে বিলি কাটতে কাটতে জবাব দিলেন,
— হ্যাঁ! বিছানার নিচে পড়েছিল! রুমাল তোর ব্যাগে রাখতে গিয়ে একটা গিফট দেখলাম যে, কিসের ওটা?
বাবলু ঘুম জড়ানো চোখ গুলো দ্রুত খুলে দাঁড়িয়ে গেলো,
— কিসের গিফট? কোথায়?
বেলির তো মনেই ছিলো না গিফটার কথা! সে দ্রুত পাশের রুমে রাখা ব্যাগ থেকে, গিফটা বের করে বিছানায় নিয়ে বসলো! গিফট খুলতে খুলতে মাকে খুলে বলল,
— তৃষ্ণা ভাইয়ার মামা আছেন না? রয়ুশ রয় আবির ? সে দিয়েছেন কাল ফিরার সময়!
বাবলু এক লাফে বেলির সামনে এসে বসলো! বেলি ততক্ষনে গিফট খুলে ফেলেছে! আই-ফোন? বেলি হাতে থাকা ফোনটির দিক কিছুক্ষণ নজর দিলো! আনন্দ বেলির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে, নেড়েচেড়ে দেখল,
— এমন দামী জিনিস গিফট করার কি প্রয়োজন?
বিমান মোবাইলের কথা শুনে দ্রুত হাজির! আনন্দের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে চিল্লাতে শুরু করলো,
— আব্বু এটা আই-ফোন ৮! আই-ফোন ৮ এ-র দাম জানো? আল্লাহ! ৭৯,৯৯৯ টাকা বর্তমানে! কি সুন্দর! পিকচার যে কি সুন্দর আসে আই-ফোনের!
বিমান ততক্ষণে ফোনের প্যাকেজিং খুলতে ব্যাস্ত! ফোন ওন করে আনন্দের দিক মুখ উজ্জ্বলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— আব্বু এটা আমি নি? বেলির তো ফোনের প্রয়োজন নেই!
আনন্দ বিরক্তির ভাবে ফোনটা বিমানের হাত থেকে নিয়ে বেলির দিক দিয়ে দিলো,
— এটা কেমন ভাবনা তোমার বিমান? বেলিকে দিয়েছে সেটা তুমি কিভাবে নিতে চাইছ?
— ওঁর তো এখন ফোনের প্রয়োজন নেই? আর ব্যাবহার ও তো করতে পারবে না! প্রয়োজন হলে, আমার ফোনটা ব্যাবহার করুক !
খুশি ভিজা হাত কাপড়ে মুছতে মুছতে এগিয়ে আসলো,
— এতো দামী মোবাইল গিফট করা উচিৎ হয় নি! আর যেহেতু করেছে ফিরত দেওয়া যাবে না! অপমানিত করা হয়ে যাবে! বেলিকে দিয়েছে বেলিই ব্যাবহার করবে! এভাবেও আর কয়েকদিন পর ১০ম শ্রেনীতে উঠবে, প্রয়োজন!
বিমান বেলির হাতের ফোনের দিক তাকিয়ে, মন খারাপ করে ফেলল,
— কিন্তু মা বেলি..
–চুপ হয়ে যা! তুই বেশি করছিস একদম!
খুশি কথাটা বলে চলে গেলো! আনন্দ বেলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো,
— সিম লাগবে আমার আম্মির? [ বেলি মাথা দুলালো ] পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট কর! তাহলে সিম কিনে দেবো ! এখন যাও পড়তে বস ! সামনে পরিক্ষা! [ বাবলুকে উদ্দেশ্যে করে, ] তুইও পড়তে বস! স্কুল যাওয়ার আগ পর্যন্ত টেবিল থেকে উঠবে না দু’জনই!

মাহফুজের দোকানে বসে চা খাচ্ছে বেলি! পাশেই বসে রুটি খাচ্ছে টাম্মি! নিজের জন্য চা বানিয়ে আরাম করে বসলো মাহফুজ,
— কেমন আছিস? কেমন বেড়ানো হলো?
মাহফুজের কথায় বেলির তৃষ্ণার কথা মনে পড়ে গেলো! চা খেতে খেতে জবাব দিলো,
— ভালো আছি! মনে হয়েছিলো স্বপ্নের দুনিয়ায় ছিলাম! তাহলে ভাবো কতটা ভালো বেড়ানো হলো!
— চেয়ারম্যান দের বাড়ি গেছিলি না?
বেলি একটু চুপ থেকে মাথা নাড়ালো!
— কেমন আচরণ করলো?
বেলির ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি,
— অনেক ভালো! ভাবি, তৃষা তারপর আবিদ ভাইয়া তো পুরো আনন্দের প্যাকেট!
— ভাবি? সোলাইমানের বউ?
— হ্যাঁ!
— আমার সাথে কামারখালি দেখা হয়েছিলো! ব্যাবহার চমৎকার!
— সত্যি !
অনেকক্ষণ যাবত শীলা লজ্জিত ভঙ্গিতে স্কুল মাঠে বসে রয়েছে! পাশে বেলি বসে বিস্কিট খাচ্ছে! শীলার ভাব-ভঙ্গি দেখে ভ্রু-উঁচু করে প্রশ্ন করলো,
–হয়েছেটা কি? কখন থেকে রঙঢঙ দেখাচ্ছিস যে?
শীলা লাজুক চোখে বেলির দিক তাকালো,
— আ..আমি..আমি প্রেম করছি!
বেলির হাতের বিস্কিট পড়ে গেল,
— প্রেম? কার সাথে? কবে থেকে?
শীলা মুচকি হেসে, বেলির দিক ফিরে বসলো,
— আমাদের পাশের বাড়ির খালা আছেন না? তার বোনের ছেলে রিয়াজ! উত্তর দিকে থাকেন! ইন্টারের ফাইনাল এক্সাম দিয়েছেন! কাল থেকে কথা চলছে!
— ওয়াও! কেমন দেখতে?
— সুন্দর! তোর সাথে দেখা করতে চাচ্ছে! চল আজ যাই ওঁর সাথে দেখা করতে!
বেলি একটু চুপ থেকে, দুই হাত তালি দিয়ে উঠলো,
— হ্যাঁ হ্যাঁ! চল দেখা করবো! তাহলে তো আমার জিজু সে!
শীলা লাজুক হাসলো,
— ৪ টার দিকে রেডি হয়ে ব্রিজের সামনে আসবি! আমি ওঁকে আসতে বলে দিব!
— নানার দোকানে থাকব! ওখানে নামবি !
বাড়ি ফিরবার সময় বেলি আড়চোখে রাস্তায় নজর বোলাচ্ছে! নজর বুলিয়ে নিজের মাথায় টোকা দিলো,
— আরে নেই,নেই, গাধি বেলি! সে নেই! তুই তারপরও কেনো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিস?
নিজেকে নিজে বলেও বেলির চোখ থেমে নেই! তাঁর ছোট মন মানছে না! সারা রাস্তায় সে আড়চোখে নজর বুলিয়েছে! সেটা খেয়াল করে শীলা প্রশ্ন করলো,
— কাউকে খুঁজছিস নাকি?
— না.. নাহ তো!
বাবলু পিছন থেকে চিপ খেতে খেতে বলল,
— শাকিব খানকে খুঁজে চলেছে! জানো শীলা আপু কাল রাত্রে বেলি বারবার বলছিল, ‘ এতো হ্যান্ডসুম কেনো আপনি সাকিব ‘!
বেলি বাবলুকে মারার উদ্দেশ্যে তেড়ে গেলো! বাবলু দৌড়ে আগে চলে যাচ্ছে! পিছনে শীলা পেট ধরে হেসে চলেছে!
শীলা টমটম থেকে নেমে একটু আগাতেই দেখল, বেলি টাম্মিকে রুটি খাওয়াচ্ছে নানার দোকানের সামনে বসে! মাহফুজ ভাত মেখে খাচ্ছে আর কথা বলে যাচ্ছে! টাম্মিকে রুটিতে মগ্ন করে, ধীরে-ধীরে বেলি শীলাকে নিয়ে সাইড হয়ে গেল,
— রিয়াজ চলে এসেছেন! দ্রুত যেতে হবে!
বেলি দুষ্ট হেসে বলল,
— বাবাহ, এ-তো সাজুগুজু! সুন্দর লাগছে!
শীলা লজ্জা পেয়ে যায়!

নৌকাতে উঠে বেলির চোখ গেলো, সেই গালে টোল ওয়ালা মাঝির উপর! মাঝি বেলিকে দেখেই বড় এক হাসি দিলো! বেলির ঠোঁটে হাসির সীমানা নেই,
— কীগো পিচ্চি তোমার সেদিনের রাগী সাথী কই?
বেলির মনটা ত্যানা হয়ে গেলো,
— শ..শহরে গিয়েছেন!
শীলা ভ্রু-উঁচু করে বেলির দিক তাকালো,
— সাথী কেডা?
— তৃষ্ণা ভা..ভাইয়ার কথা বলছে!
শীলা মাঝির দিক রাগী হওয়ার ভান করে তাকিয়ে বলল,
— কে রাগী? সে মোটেও রাগী না! কতটা নম্র-ভদ্র সে জানেন ! [ একটু ভেবে ] কিন্তু বেলির সাথে কেনো রেগে থাকে সেটা অজানা!
বেলি নদীর ঢেউয়ের দিক তাকিয়ে! আয়েশার কথা গুলো কানে বেজে যাচ্ছে! তৃষ্ণার ঘুমানো মুখটা ভেসে উঠছে তাঁর চোখে! অদ্ভুত এক অনুভূতির সাগরে সে! তৃষ্ণার সামনে গেলে ভয়-লজ্জায় কুঁকড়ে যায়! তেমনি তৃষ্ণাকে দেখতে না পেয়ে এক আজব অনুভূতিতে নড়ে উঠছে! কি করলো তৃষ্ণা তাঁকে?
কামারখালি পৌঁছাতেই নৌকা থেকে নেমে হাটা ধরেছে দু’জন! হঠাৎ বেলির রুহ কেঁপে উঠছে বারবার! রুহ কাঁপার কারণ হচ্ছে, যদি তৃষ্ণা দেখে? আবার ভাবছে আরেহ সে তো নেই! কিভাবে দেখবে? আর দেখলেই বা কি? হু
কিছুক্ষণ যাবত বেলির মনে হচ্ছে কেউ তাঁকে দেখছে! তাঁদের হয়তো কেউ অনুসরণ করছে! অদ্ভুত অনুভূতিতে বেলি চারপাশে ভালোভাবে নজর বোলালো! কাউকে না দেখতে পাড়ায় নিজের মনের ভুল বলে উড়িয়ে দিলো!
রেস্টুরেন্টের অনেকটা আগে কিছু বাইক দাঁড়িয়ে! বাইকে বসে সিগারেট খাচ্ছে কতোগুলো ছেলে! গুন্ডাদের মতো দেখাচ্ছে! শীলা বেলির হাত ধরে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ ওখান থেকে ছেলে একটা তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ালো! বেলিকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে বলল,
— আমার সাথেও থাকো একদিন, তৃষ্ণা রাজ কতো দেয়? তাঁর থেকে বেশি দেব!
পিছনের ছেলে গুলো হো হো করে হাসতে লাগলো! বেলির শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো! মাথা নিচু করে দ্রুত হেঁটে যাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো! আবারও বেলির সামনে গুন্ডা ছেলেটি আসতে চাইলে, অন্য একটি ছেলে বেলির সামনে হাজির হয়,
— বড্ড বেড়েছিস? ভাই জানলে তোর মাথা শরীর থেকে আলাদা করে দেবে!
— আচ্ছা?
~ রাত্রে দেখবো তোকে!
ছেলেটি বেলির দিক তাকিয়ে মিষ্টি হাসলো,
— চলুন আপনি! কোথায় যাবেন ভাব..! মানে কোথায় যাচ্ছিলেন?
— রেস্টুরেন্ট!
শীলা বেলির হাত টেনে সামনে নিয়ে যেতে লাগলো! কিন্তু বেলি যেতে যেতে শুনতে পেলো ছেলেটি মোবাইল কানে নিয়ে বলেছে,
–হ্যালো তৃষ ভাই?
রেস্টুরেন্টে বেলি শীলার নিউলি বয়ফ্রেন্ড কে দেখে না চাইতেও হেসে ফেলল! ছেলেটা বড্ড ভদ্র! বেলিকে ছোট বোন বলে সম্বোধন করতে লাগলো! যেটা বেলির কাছে এক সুন্দর গান মনে হচ্ছিলো!
শীলা আর রিয়াজ ওপার পাশে বসেছে! দু’জন দিব্বি কথা বলছে! বেলি যখন কোল্ড ড্রিংক মুখে দেবে, তখনই সেই ছেলেটি হাজির! ছেলেটি শুধু মিষ্টি হেসে, হাতের ফোনটা বেলির দিক এগিয়ে দিলো! ইশারায় কথা বলতে বলল! ভ্রু-উঁচু করে বেলি একবার ফোনের দিক আরেকবার ছেলেটার দিক তাকাচ্ছে! ছেলেটি আবার ইশারা করতে বেলি ফোনটা নিয়ে কানে ধরলো,
— সাহস কি করে হয় এপারে আসার? বড় হয়ে গেছিস? থাপ্পড় দিয়ে দাঁত সব ফেলে দেবো! আমি ওখানে থাকলে তোর পা ভেঙে দিতাম!
তৃষ্ণার রাগী চিৎকারে বেলি ভয়ে থম হয়ে যায়,
স্তব্দ বেলি আড়চোখে ছেলেটির দিক তাকিয়ে মিনমিন গলায় বলল,
— এভাবে কথা বলছেন কেনো? চেঁচাচ্ছেন ক..কেনো?
— তো? তোকে চুমু খাব?
বেলি চোখ বন্ধ করে ফেলে,
— হ্যাঁ, খাব আসতে দে আমায়! এখন তুই রাকিবের সাথে বাড়ি যাবি! ও পৌঁছিয়ে দেবে! রাত্রে এসে তোকে দেখছি আমি!
বেলি ফোন রাকিবকে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো! শীলা দ্রুত দাঁড়িয়ে বেলিকে প্রশ্ন করলো,
— কি হয়েছে?
— আমি যাচ্ছি! স্কুলে খুলে বলবো নি!
রাকিবের পিছুপিছু বেলিও হাটা ধরলো! লাউডস্পিকার ওন করায়, বেলি স্পষ্ট তৃষ্ণার গর্জন শুনে কেঁপে উঠলো,
— কোন মা*র**দ ছিলো?
রাকিব ধীর আওয়াজে জবাব দিলো,
— ভাভাই ইলিয়াস ছিলো!
— কি বলেছে বেলিকে? ডিড হি টাচড হার?
— ভাই আপনি শান্ত হ..
— উত্তর দে!
— বলেছে ‘ ওর সাথে একদিন থাকতে, আপনে ভাবিরে কতো টা..টাকা দেন, তার থেকে বেশি ও দেবে ‘ এটা বলছে! না টাচ করেনি, আমি চলে এসেছিলাম!
— গ্রাম থেকে জেনো মাদারিরবা** বেরোতে না পারে!

বাড়িতে ফিরে বেলি শুধু ভয়ে কাঁপছে, সন্ধ্যায় টাম্মিকে খুঁজতে না গিয়ে বাবাকে পাঠিয়েছে! আজ পারতে আর ঘর থেকে বেরোবে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here