অদ্ভুত আসক্তি পর্ব -১৯+২০

#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_১৯ (মেইবি অ্যা প্রপোজাল)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

সকালের মৃদু আলো চোখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুললাম। মাথা ভার লাগছে ভীষণ। কিছুক্ষণ বসে থাকতেই হুট করেই মনে পড়লো কাল রাতের কথা। লোকটা আরহানের কথা বলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করিয়েছে। শেষবার যখন জিজ্ঞেস করলাম,“কি হচ্ছে এটা?”

লোকটা বাঁকা হেসে “ধোঁকা” বলেই আমার মুখের সামনে কিছু একটা স্প্রে করলো। এরপর… এরপর কি হয়েছিলো? উফফ! মনে পড়ছে না কেনো?

তখনই রুমে প্রবেশ করলো একটা মহিলা।
আমাকে বললো,“ম্যাম! আপনি উঠে পড়েছেন? ফ্রেশ হয়ে নিচে চলুন ব্রেকফাস্ট করতে। স্যার ডেকেছেন।”

মহিলাটি এই বাড়ির মেইড হবে হয়তো। কেনো যেনো প্রচুর রাগ হচ্ছে। তবুও শান্ত কন্ঠে বললাম,“আপনার স্যারকে ডাকুন।”

মহিলাটি “আচ্ছা” বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

কিছুক্ষণ বাদেই রুম নক করার সাউন্ড পেলাম। ততক্ষণে আমি বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি। ওপাশের লোকটি ভেতরে ঢুকতেই আমি তাকালাম।
নীলাভ চক্ষু দ্বয়ের এই সুদর্শন পুরুষকে দেখতেই মনে পড়লো ভার্সিটির নবীন বরণের দিনের কথা। মনে পড়ে গেলো, সেদিন রুদ্রের সাথে আরহানের সেই কথাগুলো।
চোখ দুটো বড় বড় করে মুখ ফুটে উচ্চারণ করলাম,“তৃষ্ণা!”

তৃষ্ণা মাথা নিচু করে হালকা হাসলো। এরপর বললো,“ইয়াহ! আই এম।”

হুট করেই রাগ এবং বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো আমার। সাথে ভয়ের সংমিশ্রণ আছেই। আমাকে ধোঁকা দিয়ে তুলে আনলো! কিছু করবে না তো আবার!

“দ’দেখুন! আপনি আমাকে এখানে এনেছেন কেনো?”

তৃষ্ণার সহজসরল স্বীকারোক্তি,“ভালোবাসি তাই..”

ভয় ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে বলে উঠলাম,“ভালো হচ্ছে না, আরহান জানতে পারলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে।”

ডোন্ট কেয়ার ভাবে জবাব দিলো,“আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি। আরহান আপনাকে ভালোবাসে কি না জানিনা, তবে আপনাকে আমার মতো এতো ভালোবাসতে পারবে না কেউ।”

আমি ভালোবাসায় বড্ড ভয় পাই। এর চেয়ে সুখের কিছু নেই, আবার এর চেয়ে যন্ত্রণার কিছু হতে পারে না। এর চেয়ে বড় পুরষ্কার কেউ পায়নি। এর চেয়ে ধারালো অস্ত্র এখনও তৈরি হয়নি।
হালকা আওয়াজে বললাম,“যেতে দিন আমাকে।”

“কিন্তু কেনো?”

“কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

“আপনি শুধু পাশে থাকবেন, আমার একার ভালোবাসাই আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট।”

“পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি? আমি বললাম তো ভালোবাসি না আপনাকে।”

তৃষ্ণার কণ্ঠস্বর হঠাৎ পরিবর্তন হলো। মাঝে তীব্র এক রাগের আভাস পাওয়া গেলো। বললো,“আমাকে মেনে নিলে সমস্যা কি? বারবার বলছি তো, আপনাকে ভালোবাসি আমি।”

আমি ভীত হয়ে বললাম,“আরহানের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে,এটা জানেন?”

তৃষ্ণা একই কন্ঠে রাগের তেজ বাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ! ও সবসময় আমার সব কিছু ছিনিয়ে নিতে চায়, আমাকে হারাতে চায়। এজন্যই আপনাকে বিয়ে করেছে। কিন্তু আমি আরহানের কাছে হারতে পারলেও, আপনাকে হারাতে রাজি নই নয়নতারা।”

“ভুল। উনি আপনার কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিতে চায়নি। বরং আপনার কাছ থেকে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছে। আপনি তো সেদিন প্রথম দেখলেন আমাকে। আর আরহান! সে দুই বছর আগে থেকেই ভালোবাসে আমাকে।”

তৃষ্ণার কপাল কুঁচকে এলো। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে জোরপূর্বক হেসে বললো,“সে বাসুক। আপনি তো বাসেন না। তাই না? আর আপনার বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? বাচ্চার মা হলেও আমার আপনাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।”

“আপনি ভুল করছেন।”

“ভালোবাসা যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে আমি এমন সহস্র ভুল করতে রাজি আছি।”

স্থির চাহনি ফ্লোরে নিক্ষেপ করে বললাম,“আমি আরহানকে ভালোবাসি।”

কিভাবে বললাম জানিনা। তবে, বলে ফেললাম। আর অনুভব করলাম, এটা সত্যি।

সামনে তৃষ্ণার নীল চক্ষুর দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, তৃষ্ণা এরকম কথার জন্য প্রস্তুত ছিলো না।
অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,“সে ইট এগেইন…”

এতক্ষণের ভয় ভীতি সব ভুলে পুনরায় বললাম,“ভালোবাসি আরহানকে।”

গম্ভীর তৃষ্ণার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। দুই হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল গুলো খামচে ধরে মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বুলি আওড়ালো, “শিট! এবারও… এবারও…”

চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। মিনিট পাঁচেক পর চোখ খুললো। যেনো এই পাঁচ মিনিটে পুরনো অনেক কিছু কল্পনা করে নিলো।

আমার দিকে তাকালো তৃষ্ণা। এগিয়ে এলো খানিকটা। আমি দূরত্ব বজায় রাখতে সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেলাম।

আমার এমন করা দেখে তৃষ্ণা নিজেও দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে দুই হাত হালকা সামনে তুলে বললো,“ভয় পাবেন না। আমি কাছে আসছি না।”

শান্ত কন্ঠে এরকম কথায় ভয় কমলো। তবে গেলো না।

তৃষ্ণা পুনরায় বললো,“কিছু বলতে চাই। আই প্রমিজ, এটাই শেষ বার।”

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে তৃষ্ণা আমার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নজর ফ্লোরেই সীমাবদ্ধ রেখেই বললো, “জীবন আমাকে কিছু দিতে পারেনি। আমার পাওয়া জিনিসগুলো ছিনিয়েই নিয়েছে শুধু। তন্মধ্যে সবচেয়ে আকাঙ্খিত আপনি। জীবন সেই আপনিটাকেই আমার হতে দিলো না। এর জন্য রয়েছে শুধুই আফসোস!”

তৃষ্ণা হাঁটু মুড়ে আমার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নজর ফ্লোরেই সীমাবদ্ধ রেখে বললো,“আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার মিথ্যায় ঘেরা জীবনের একটি মাত্র সত্যি, আপনাকে ভালোবাসি।”

আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। তৃষ্ণা পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেনো কল দিয়ে বললো,“ম্যামকে বাড়ি দিয়ে এসো।”

এরপর আমার দিকে তাকালো। এই চোখে অনেক কিছু আছে। যা আমাকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু, আমি জানতে চাই না।

তখন তৃষ্ণা হালকা হাসলো। বড্ড অদ্ভুত এক হাসি ছিলো।
বললো,“বাইরে গাড়ি রাখা আছে। আমার লোক, আপনাকে সেইফলি আপনার বাড়ি দিয়ে আসবে।”

আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম না। পাশেই আমার ফোন রাখা ছিলো। নিয়ে জলদি বেরিয়ে পড়লাম।

___________________
বাড়ি ফিরতে ফিরতে তখন বেলা এগারোটা বেজে গেলো। বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেখেই মা পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে এলেন। আপাদমস্তক দেখে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।

এরপর আমাকে ছেড়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,“তুই কোথায় চলে গিয়েছিলি? ঠিক আছিস মা? আরহান তোকে বাড়ি থেকে বেরোতে না করে দিয়েছিলো না? কেনো গিয়েছিলি?”

মুহূর্তেই আরহানের কথা মাথায় আসায় জিজ্ঞেস করলাম,“আমি তো ঠিক আছি। তবে আরহান! উনি কোথায়?”

“তোকে খুঁজতে বেরিয়েছে।” —বলেই মা উচ্চকন্ঠে নিশাকে ডাকলেন। নিশা এসে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।

কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“ভাবি! কোথায় ছিলে তুমি? জানো ভাইয়া তোমাকে খুঁজতে খুঁজতেই পাগল হয়ে গিয়েছে। এতোটা কাতর অবস্থায় ভাইয়াকে কখনো দেখিনি।”

মা নিশাকে বললেন,“আরহানকে কল দিয়ে বল, বীনি বাড়ি ফিরেছে।”
নিশা তখনই আরহানকে কল দিলো।

নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিলাম। মাথাটা ব্যাথা করছে। হঠাৎ সেখানে আরহান প্রবেশ করলেন। দ্রুত পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে তড়িৎ গতিতে জড়িয়ে ধরলেন। অপ্রস্তুত আমি এখন আরহানের বুকে। উনার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। হৃদপিন্ড অনেক দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। যেখানে আমার হৃদযন্ত্র থমকে গিয়েছে।

“এখন… এখন আমি বেঁচে গেলাম। আরেকটু হলে, সত্যিই মরে যেতাম।”
কাতর ও অস্থির কণ্ঠস্বর আরহানের। বুকটা ধুক করে উঠলো। সত্যি তো! আরহান আমাকে অনেক খুঁজেছেন। উনার এই অস্থিরতা তো আমারই জন্য।

মিনিট দশেক পর আমাকে ছাড়লেন। এতক্ষণ মুখ লুকোনো থাকলেও, এখন চেহারায় লজ্জার রেশ ফুটে উঠেছে।
আরহান আমার এই লাজে রাঙা মুখের পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,“না করেছিলাম না? বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করেছিলাম না? কেনো বেরোলে?”

চকিতে চাইলাম আরহানের পানে। আরহান আমার সাথে কখনোই রাগ দেখাননি। আজ প্রথম উনার কন্ঠে এমন তেজ লক্ষ্য করাতে স্থির নয়নে তাকিয়ে রয়েছি। এতে আরহানের রাগ বাড়লো বৈ কমলো না।
আমার দুই বাহুতে ঝাঁকিয়ে বললো,“কিছু জিজ্ঞেস করেছি না? আজ যদি ঐ তৃষ্ণা কিছু করে দিতো?”

কেঁপে উঠলাম। সাথে ভয় ও পেয়ে গেলাম। এই আরহানকে চিনিনা আমি।

“স্পিক আপ..”

আবারও কেঁপে উঠলাম। আরহান এই রাগ নিয়ে কখনো কথা বলেননি আমার সাথে।
তাই আর সময় অপচয় না করে ব্যক্ত করলাম,“তৃষ্ণা বলেছিলো আপনার ক্ষতি করে দিবে। এজন্য গিয়েছিলাম।”

“আর তাই তুমি বিশ্বাস করে নিলে? এতোটা গাঁধা কী করে হলে? বাড়িতে কাউকে না বলে চলে গেলে!”

আমি অশ্রুসজল নেত্রে চেয়ে রইলাম। কী করে ভাবতাম তখন অতো কিছু? তৃষ্ণা যে আরহানের ক্ষতির কথা বলছিলো।

আরহান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলেন। বেড সাইড টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেলেন।

হুট করেই আরহান তাকালেন আমার দিকে। চাহনিতে অন্য কিছু রয়েছে।
অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“আমার ক্ষতি করে দেবে বলে তুমি গিয়েছিলে?”

“হুঁ..”

“কেনো?”

আমিতো এখনও আরহানের নতুন রূপ দেখতে পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে আছি। তাই অতো কিছু না ভেবে উত্তর করে যাচ্ছি। কিন্তু শেষের এই ‘কেনো’ টা আমাকে বোঝালো আরহান আমার মুখ থেকে কথা বের করতে চাচ্ছে।
আমি চুপ হয়ে গেলাম।

আরহান পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,“তৃষ্ণার কাছ থেকে পালিয়ে আসলে কী করে? যতদূর ওকে চিনি, ওর হাত থেকে পালানো অসম্ভব।”

“পালাইনি।”

আরহান সজোরে বলে উঠলেন, “হোয়াট?”

কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বললেন,“না পালালে এলে কি করে? এখন আবার এটা বলো না যে তৃষ্ণা নিজেই তোমাকে ফেরত পাঠিয়েছে। কারণ এটা সম্ভব নয়।”

“তৃষ্ণা নিজেই আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে।”

আরহান অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললেন,“ইম্পসিবল….”

“জানিনা আমি কিছুই। তবে আমার কোনো ক্ষতি করেননি উনি। ইন ফ্যাক্ট আমার হাত অবদি ছুঁয়ে দেখেননি। সকালে জ্ঞান ফিরতেই তৃষ্ণা আমাকে বলে, উনি আমাকে ভালোবাসেন….”

“এক মিনিট! তৃষ্ণা তোমাকে ভালোবাসে?”

“উনি তো তাই বললেন।”

আরহান কপালে হাত রেখে আস্তে বুলি আওড়ালেন, “ওহ্ গড! সেই আগে থেকেই ওর কেনো আমার জিনিসটাই পছন্দ হওয়া লাগে!”

আরহান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,“ভালোবাসে! তাহলে তোমাকে ছেড়ে দিলো কেনো?”

“কারণ আমি বলেছি, আমি উনাকে ভালোবাসি না।”

“শুধু এজন্যেই ছেড়ে দিলো?”

“নাহ্!”

“তবে?”

“আমি বলে দিয়েছি,‘আমি আরহানকে ভালোবাসি’। তাই ছেড়ে দিলো।”

“সত্যি ভালোবাসো আমায়?”

আরহানের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শুনে খেয়ালে এলো আমি কী বলেছি।

চলবে….!#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_২০ (বর্তমানের দরজায় অতীতের করাঘাত)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

ফটোফ্রেম সামনে রেখে ফ্লোরে বসে আছে তৃষ্ণা। গম্ভীর মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সামনের এই ছবিতে আছে তৃষ্ণার মম, ড্যাড ও তৃষ্ণা। একবার পুরো ছবিতে হাত বুলিয়ে নিলো। অধর যুগল কম্পিত হয়ে বলে উঠলো,“আজ আমারও একটা পরিবার থাকতো। আজ আমিও ভালোবাসা পেতাম। ভাগ্য প্রতিবার আমার সর্বস্ব ছিনিয়ে না নিলেও পারতো।”

দশ বছর আগে…….
একদিন তৃষ্ণা কলেজ থেকে ফিরেছিলো। উদাস মুখ তার। সেদিন কলেজে প্যারেন্টস মিটিং ছিলো, কিন্তু তৃষ্ণার গার্ডিয়ান যায়নি। ওর সব ফ্রেন্ডসদের বাবা মা এসেছিলো। শুধু তৃষ্ণার কেউ যায়নি।

সেদিন ওর মামনি বাড়িতে ছিলো না। দীপ্তির সাথে ওর স্কুলে ছিলো বিধায় বাড়িতে শুধু ওর মম-ড্যাড ও সার্ভেন্টস ছিলো। সার্ভেন্টস সব নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।

তৃষ্ণার রুমের আগেই ওর মম-ড্যাড এর রুম পড়ে বিধায়, তাদের রুম ক্রস করেই নিজের রুমে যেতে হয়। সেভাবেই যাচ্ছিলো।

হঠাৎ কারো উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পা জোড়া সেখানেই থমকে যায়। না চাইতেও ভেতরের কিছু কথা কানে আসে। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে তৃষ্ণা ভেতরে দেখতেই ওর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না তৃষ্ণা।

ওর ড্যাড ওর মমকে থাপ্পড় মারলো। ওর ড্যাড এই জীবনে কোনদিন ওর মমের গায়ে হাত তোলেনি। সেই আজ…

লুকিয়ে কথা শোনা ঠিক না। তবে চমকিত তৃষ্ণা এখন হতভম্ব হয়ে আছে।

ভেতরে ওর ড্যাড, আশরাফ সরকার বললো,“আমি তোমার থেকে এসব আশা করিনি তানিয়া।”

হাতের কিছু ছবি, যেগুলোতে তৃষ্ণার মম, তানিয়ার আর একটা অপরিচিত লোকের অন্তরঙ্গ মুহুর্ত ক্যাপচার করা আছে, সেগুলো মুখের উপর ছুড়ে ফেলে বললো,“এগুলো দেখো। আরো কিছু বলার আছে তোমার?”

অবশেষে উপায় না পেয়ে তানিয়া বলে ফেললো, “হ্যাঁ। এগুলো সত্যি। সব সত্যি।”

সঙ্গে সঙ্গে আশরাফ, তানিয়াকে আবারও থাপ্পড় মারলো।
“ছিঃ! তোমার এতো বড় একটা ছেলে আছে। তবুও?”

“এই তুমি কোন সাহসে আমার গায়ে হাত তোলো? আর আমার যা ইচ্ছে তাই করবো আমি। ইট’স মাই লাইফ।”

“তুমি বাড়াবাড়ি করছো তানিয়া।”

“বাড়াবাড়ি আমি না, তুমি করছো। তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে আমার সখ-আহ্লাদ সব ভেস্তে গিয়েছে। আমার জীবনটা নরক হয়ে গিয়েছে। সব কিছুতেই ছেলে ছেলে করো। আমার জাস্ট ঐ ছেলেকে সহ্য হয়না। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও তো আশরাফ।”

আশরাফ অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি কি আদৌ মা? কি করে নিজের ছেলেকে নিয়ে এভাবে বলো? বাচ্চা হলে তার দায়িত্ব নিতে হয়, খেয়াল রাখতে হয়, নজরে নজরে রাখতে হয়। এটাকে বন্দী জীবন বলে না।”

“আমার কাছে এটাই বন্দী জীবন।”

“আর এই লোকটার কাহিনী কি? এসব কি তানিয়া?”

“আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই।”

রাগী আশরাফের রাগ তুঙ্গে উঠে গেলো। আর এদিকে তানিয়াও কম না । দুজনের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তানিয়া পাশে ফলের ঝুড়ি থেকে ছুরি নিয়ে সোজা আশরাফের পেট বরাবর আঘাত করে। মুহূর্তে এমন আক্রমণের জন্য আশরাফ সরকার পেটে হাত রেখে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে।

দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের প্রাণ প্রিয় ড্যাডের এমন অবস্থা দেখে চিৎকার দেয় তৃষ্ণা। তখন তানিয়া মাথা ঘুরিয়ে দরজার সামনে তৃষ্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য তানিয়ার এখন কোনো কিছু খেয়াল নেই। প্রমাণ লুকোনোর তাগিদে হাতের ছুরি নিয়ে তৃষ্ণার দিকে অগ্রসর করে। তৃষ্ণা ওর দিকে এগোতে থাকা তানিয়ার মধ্যে নিজের মমকে নয়, নিজের ড্যাড এর খুনিকে দেখতে পাচ্ছে। যখনই তানিয়া ছুরিকাঘাত করতে যাবে, তখনই তৃষ্ণা ওর পাশের ফুলদানি সোজা ওর মমের মাথায় মারে। সঙ্গে সঙ্গে তানিয়া মাথায় হাত রেখে মেঝেতে পড়ে যায়।

তৃষ্ণা হুঁশে আসে। সতেরো বছর বয়সী তৃষ্ণার নেত্র সম্মুখে এখন ভেসে আছে তার মম ও ড্যাড এর লাশ। সেদিন তৃষ্ণা কান্না করেনি। একটুও না। শুধু বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। সে যে নিঃস্ব হয়ে গেলো। এতিম হয়ে গেলো তৃষ্ণা।
​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

তৃষ্ণার মামনির বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো। এমনিতে এই বাড়ি নিরব থাকে সবসময়। তবে আজ তার কাছে এই নিরবতাটা ভয়ংকর লাগছে। দীপ্তিকে রুমে দিয়ে সে তৃষ্ণার রুমের দিকে রওনা হলো।

তৃষ্ণার মম-ড্যাডের রুমের সামনে পৌঁছতেই তার পা জোড়া থমকে যায়। খোলা দরজার মুখ বরাবর তাকাতেই এই বিধ্বস্ত পরিবারকে দেখে সে চোখ বড় বড় করে ফেলে। রক্তাক্ত আশরাফ আর তানিয়ার লাশের মাঝ বরাবর তৃষ্ণা পাথরের ন্যায় বসে আছে।

তৃষ্ণার কাছে যেতেই সে তার মামনির দিকে চোখ তুলে তাকায়। নীলাভ চক্ষুদ্বয় ভয়ংকর লাগছিলো। সময় নিয়ে একে একে পুরো ঘটনা খুলে বলে তৃষ্ণা। সবটা শোনার পর, তার মামনি তৃষ্ণার দ্বারা খুন করার ব্যপারের সবগুলো প্রমাণ নষ্ট করে দেয়। অবশেষে সে রাতে পুলিশ এলে বলা হয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির আগমনের জন্য তারা একে অপরকে আঘাত করে। সেদিন তৃষ্ণার, ওর নিজের মমকে খুন করার ব্যাপারে ওর মামনি ব্যতীত আর কেউ জানতে পারে না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ধামাচাপা পড়ে যায়।

সেবার খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিলো,“বিশিষ্ট শিল্পপতি আশরাফ সরকার, তার সহধর্মিণী তানিয়ার পরকীয়ার ব্যাপারে জানতে পারায়, দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। অবশেষে স্বামী ও স্ত্রী, দুজন দুজনার দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে।”

অতঃপর এতিম তৃষ্ণার জীবনে ওর মায়ের মতো মামনি থাকা সত্বেও, সে চলে যায় বাজে দিকে। নেশা দ্রব্য তার নিত্যদিনের সাথী ও সুন্দরী রমণী তার আসক্তি হয়ে যায়। একবুক কষ্ট নিয়ে গানের দিকে ঝুঁকে যায়। আর সেই লোকটি, যার সাথে তার মমের একটা সম্পর্ক ছিলো। অবৈধ সম্পর্ক ছিলো অবশ্য। তাকে পরপারে পাঠানোর মাধ্যমে মাফিয়া কিংডমে প্রবেশ হয় তৃষ্ণার।
কোনো একদিন নেশাদ্রব্য পাচারের সময় আরহান, তৃষ্ণার গ্যাংকে ধরে ফেলে। এই থেকে শুরু হয় শত্রুতা।
​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

অতীতের পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে তৃষ্ণা এখন হাঁপাচ্ছে । বড্ড ভয়ংকর ছিলো তার কাছে, নিজের মম-ড্যাডকে ওমন অবস্থায় দেখা। তৃষ্ণা পাশ থেকে একটা ছুরি নিয়ে, ফ্রেমের বা পাশে, ওর মমের ছবিতে আঘাত করে। ফ্রেমের কাঁচ ভেঙ্গে যায়। ঐ কাঁচের উপর দিয়ে তৃষ্ণা ওর মমের মুখশ্রীতে হাত বুলায়। ভাঙ্গা কাঁচ হাতে লাগায়, রক্ত বের হয়ে ছবিতে, তানিয়ার মুখের উপর লাগে। তৃষ্ণার ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে হাতে। এর চেয়েও অধিক যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে বুকে। তৃষ্ণা হাসলো।

উচ্চস্বরে হেসে বললো,“আমার সব কিছু ছিনিয়ে নিলে তুমি মম। তুমি খুনি। শুধু ড্যাডের না। আমার সুখের ও। তাই তোমার মুখের উপর এই রঙটা খুব মানায়। এটাই মানায় তোমার সাথে।”

____________________________
“সত্যি ভালোবাসো আমায়?”

আরহানের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শুনে খেয়ালে এলো আমি কি বলেছি। এতক্ষণ আরহানের কথায় কষ্ট লাগলেও এখন লজ্জা লাগছে। এভাবে কিভাবে বলে দিতে পারলাম?

লজ্জায় ইতিমধ্যে আমার গালে রক্তিম আভা ছেয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গ এড়াতে অন্য কিছু বলা সম্ভব না এখন। তাই সম্পূর্ণ আরহানকে এড়াতেই প্রস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ভাবনা মাফিক যেতে নিলেই, আরহান আমার হাত ধরে টেনে পুনরায় নিজের সামনে দাঁড় করালেন।

“শুকতারা? ডু ইউ লাভ মি? সিরিয়াসলি?”

আরহানের কণ্ঠস্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে, উনি চমকেছেন। পুনরায় মুখশ্রী ভাব গম্ভীর করে বললেন,“তৃষ্ণার হাত থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যে বলেছিলে নাকি?”

আমার এতক্ষণের লাজুক ভাবটাও উনার মুখশ্রীর সঙ্গে পাল্টে গেলো। উনি ভুল বুঝছেন তো। আমি ভালোবাসি উনাকে। কিন্তু মুখ ফুঁটে বলবো কি করে?

আরহান পুনরায় বললেন,“জানো আমার অবস্থা কি হয়ে গিয়েছিলো? একেতো আমি এই শহরে ছিলাম না। তার উপর রাতে ওরকম একটা ঘটনা। মাথা নস্ট হয়ে গিয়েছিলো আমার। কিভাবে যে পুরোটা পথ এসেছি আমি, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। আমার সব লোক লাগিয়ে তোমাকে খুঁজেছি। কিন্তু…. আই এম সরি শুকতারা। আমার আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো।”

মিনিট খানেক আরহানকে দেখে আমি উনার হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নোট প্যাড আর একটা কলম নিয়ে কিছু লিখলাম। এরপর আরহানের হাতে দিয়ে দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করলাম।

আরহান কাগজের লেখা গুলো পড়ে হাসলেন। প্রাপ্তির এক হাসি হাসলেন।

সেখানে লেখা ছিলো,“আপনাকে ভালোবাসি কি না বলতে পারবো না। শুধু বলতে পারবো‚ আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা মানেই আপনি।”
​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

________________________
এতো দিন অনেক খোঁজ করার পর অবশেষে আরহান তাকে পেলো। মাত্র রুদ্রের কল আসায় আরহান রুদ্রের বলা এড্রেসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এই চারদিন সিলেটে ছিলো আরহান। সিলেটে যাবার মূল উদ্দেশ্য সেই মানুষটাই ছিলো।

অতঃপর রুদ্রের বলা এড্রেসের সামনে পৌঁছতেই আরহান চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলে। কারণ সে এখন ‘টি এস ইন্ডাস্ট্রিজ’ এর মেইন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

দ্রুত পায়ে অফিসের ভেতরে ঢুকলো। গার্ডস এতে কোনো ঝামেলা করেনি। কারণ সে এখানে ‘দ্যা মাফিয়া কিং এ.এ.কে’ নামে আসেনি। এসেছে আরহান পরিচয়ে।

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আরহান মনে মনে বললো,“পৃথিবী আসলেই গোল। যাকে এতদিন ধরে এতো দূর দূরান্তে খুঁজে এলাম, সে আমার কাছাকাছিই ছিলো।”

ভেতরে ঢুকে একজনকে জিজ্ঞেস করলো,“মিসেস শেফালী আহমেদ এর কেবিন কোনটা?”

লোকটি বললো,“ম্যামের কেবিন, থার্ড ফ্লোরের একদম শেষের দিকে।”

আরহান আবারও সেদিকে গেলো। কেবিনের সামনে পৌঁছিয়ে ডোর নক করতেই ওপাশ থেকে “কাম” বলায়, আরহান প্রবেশ করলো।

একটা আধ বয়স্ক মহিলা বসে বসে কিছু ফাইলস চেক করছে। আরহান এগিয়ে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পড়লো।
মহিলাটি একবার আরহানের দিকে তাকিয়ে পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগী হয়ে বললো,“কি প্রয়োজন?”

“আপনাকে।”

“কেনো?”

“অতীত জানতে চাই।”

মহিলাটি থমকে গেলো। হুট করেই মাথার ভেতর পুরনো সব ঘটনা এসে জড়ো হয়। আরহানের দিকে চোখ তুলে তাকায়। এবার আর চোখ সরায়না।

জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে কেনো বলতে যাবো?”

“অতীত যখন বর্তমান নষ্ট করতে আসে, তখন সেই অতীতকে আগে নষ্ট করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন সেই অতীত জানা। তাই এসেছি।”

আরহানের কথায় মহিলাটি কেমন যেনো হাসফাঁস করা শুরু করলো। ভেবেছিলো তার অতীতের সমাপ্তি সেখানেই হয়েছে। কিন্তু না, সে আবারও তার দরজায় করাঘাত করলো।

“আমি আপনাকে কিছু বলতে বাধ্য নই।”

আরহান জানতো, এতো ইজিলি সবটা জানতে পারবে না। তাই বিদ্রুপ স্বরে বললো, “মেয়ে বেঁচে আছে নাকি মরে গিয়েছে, এটা জানতে চান না?”

“মানে?”

মহিলাটির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করা প্রশ্নে আরহান হাসলো। ঠোঁটের হাসির রেখা বিদ্যমান রেখেই বললো,“আগে আপনি বলুন। এরপর আমি বলছি..”

​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

চলবে…!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here