অনুভবে তুই পর্ব -০১+২

রেস্টুরেন্ট ভর্তি লোকের সামনে নেহার গালে তাঁর হবু বর সজোরে থাপ্পড় মারলো। সঙ্গে সঙ্গেই ওর ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ ফুটে ওঠলো। নিজেকে ধাতস্থ করতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল নেহার। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আবারও চড় পড়লো ওর ডান গালে। পরপর দুটো থাপ্পড় খেয়ে আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল নেহা আর তাঁর বোনেরা। ভয়ে কাঠ হয়ে গেল ওরা। কোন কারণে তাঁর হবু বর শাখাওয়াত এরকম করছে নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কে সেটার আন্দাজ করতে পারল না নেহা। রেস্টুরেন্টে পরিবার নিয়ে লাঞ্চ করতে আসা সবাই অদ্ভুত চোখে ওদের দেখে যাচ্ছে। কারো ঠোঁটের কোণে হাসি। যেন চড় মারার ঘটনাটায় তারা খুব বেশি মজা পেয়েছে। লজ্জায়, অপমানে গা শিরশির করে ওঠলো নেহার। দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক, কিন্তু ওর মনে হচ্ছে অতি শ্রীঘ্রই জ্ঞান হারাবে। পেছনের দিলে কিছুটা হেলে পড়তেই নেহাকে ধরে ফেলল ওর কাজিন রোজা। খুব সাবধানে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো সে নেহাকে। এতক্ষণের পুরো ঘটনাটার চাক্ষুষ প্রত্যক্ষদর্শী ছিল রোজা। শাখাওয়াতের উগ্র ব্যবহারের কারণ খুঁজছিল সে। কিন্তু পরপর দু’বার নেহাকে থাপ্পড় খেয়ে নেতিয়ে পড়তে দেখে ওর শরীরের রক্ত যেন ছলকে ওঠলো। কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না ব্যাপারটা। খুব একটা কথা না বললেও এই পর্যায়ে এসে ও আর চুপ থাকতে পারল না। ফিহা’কে নেহার খেয়াল রাখতে বলে সে শাখাওয়াতের কাছ এসে দাঁড়ালো। ক্ষুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী সমস্যা আপনার? এরকম কেন করলেন আপুর সাথে?’

শাখাওয়াত গরম চোখে তাকালো ওর দিকে। পরক্ষণেই দৃষ্টি ঠান্ডা হয়ে এলো। ফিচেল হেসে বলল, ‘সমস্যা একটাই, আমি তোমার বোনকে বিয়ে করতে পারব না।’

রোজা চুপ করে কথাটা কর্ণগোচর করল। তারপর গলার স্বরটা উঁচুতে এনে বলল, ‘সেটা তো সরাসরি আপনার মা-বাবাকে জানিয়ে দিলেই পারতেন। রেস্টুরেন্টে ডেকে এনে সিনক্রিয়েট করার কী দরকার ছিল? আর সিনক্রিয়েট বলছি কেন? এটা তো অন্যায়, আপনি মহাঅন্যায় করেছেন আপুর সাথে।’

শাখাওয়াত আগের মতোই হাসলো। বলল, ‘এটা তোমার আপুর সাথে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অধিকার..’

কথাটা শেষ কর‍তে দিল না রোজা। তার আগেই রাগী স্বরে বলে ওঠলো, ‘কোনোক্রমেই এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার হতে পারে না। আপনার সাথে আমার বোনের এখনো বিয়ে হয় নি যে আপনি তাঁর গায়ে হাত তুলবেন, অপমান করবেন। আর কীসের অধিকার? হবু বর হতে পারেন, তাই বলে মাথা কিনে নেন নি যে, অধিকার বলে জঘন্য ব্যাপারটাকে চালিয়ে দিচ্ছেন।’

‘আই লাইক ইউ।’

রোজা বিস্মিত হয়ে গেল। মুখের কথা হারিয়ে গেল। নেহার দিকে একপলক দৃষ্টি ফেলে তারপর আবার শাখাওয়াতের দিকে তাকালো। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বললেন আপনি?’

শাখাওয়াতের ঠোঁটে ক্রুর হাসি। বাঁ-চোখটা টিপে দিয়ে বলল, ‘বাবা-মা তোমার বোনকে পছন্দ আমার জন্য পছন্দ করেছে। জোর করে আজ আবার দেখাও করতে পাঠিয়েছে। আমি বিয়ে করতে চাই না ওকে। ওর সাথে আমার যায় না, দেখেই তো রাগ পেয়ে গেল আমার। আর রাগ হলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না আমি। এই যে, এখনো তোমার বোন এখানে আছে ইচ্ছা করছে আরও থাপ্পড় মেরে বিয়ের শখ ঘুচিয়ে দিই! তবে এখানে এসে তোমার মতো একটা সাহসী, স্ট্যান্ডার্ড মেয়েকে দেখে প্রথম দেখায়ই যে প্রেমে পড়ে যাব, সেটা তো ভাবি নি। আই লাইক ইউ এন্ড লাভ ইউ!’

রোজা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এসব কী বলছে লোকটা? সত্যিই কী সে আজ সাহস দেখিয়ে এতগুলো কথা বলে ফেলেছে লোকটাকে? ওকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাখাওয়াত একটু এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল, ‘বসো, বসে কথা বলি আমরা?’

রোজা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো। ব্যগ্র কন্ঠে শাখাওয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার সাহস হয় কী করে আমার হাত ধরার?’

‘এভাবে তাকাতে হয় না, বুকের ভেতর ব্যথা হয় তোমার চোখের ওই নেশায়!’

রোজার কান ঝাঁ ঝাঁ কর‍তে লাগল। বিষ ঢেলে দিয়েছে যেন কেউ! তীক্ষ্ণ কন্ঠে সে বলল, ‘আপনার মতো লো ক্লাস মেন্টালিটির একজনের সঙ্গে আপুর বিয়ে ঠিক হচ্ছিলো ভাবতেই আমার ঘৃণা হচ্ছে।’

শাখাওয়াত ক্রুর হাসি হেসে বলল, ‘আমার বেড পার্টনার হিসেবে তোমায় দারুণ মানাবে।’

রোজা বিস্মিত, কুন্ঠিত, লজ্জিত, হতভম্ব! নেহা আর ফিহাও শাখাওয়াতের এই কথাটা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছে। এত নীচ একটা লোকের সাথে ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে, ভাবতেই বাবার ওপর রাগ হলো ওর। মাথার ভেতর তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে কোনোমতে একটা ম্যাসেজ লিখলো সে তাঁর ভাইকে। টেক্সট সেন্ড করে ওঠে আসলো নেহা। পরণের শাড়িটা ঠিক করে নিয়ে রোজাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো। রোজার চোখে টলমল পানি। সে কোনোদিন কারো কাছ থেকে এমন জঘন্য কথা শুনে নি। শাখাওয়াত একটা চেয়ারে বসে কোল্ড কফির স্ট্র’তে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘তো? কী খাবে বলো? আর ভেবে এখনি বলে দাও আমার সাথে কখন মিট করবে তুমি? বিয়ে করতে চাইলেও বলতে পারো বা অন্য কিছু চাইলেও আমি রাজি। আ’ম স্ট্রং ম্যান। অনেক সুবিধা পাবে এরজন্য, হতে পারে সেটা টাকা বা সামথিং…’

নেহা ঘৃণাভরা কন্ঠে বলল, ‘ফার্দার আমার বোনকে আপনি এসব কথা বলেছেন তো, ভালো হবে না!’

শাখাওয়াত ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল, ‘ওহ আই সী? তুমি? লাইক সিরিয়াসলি? যে নিজেই আমার হাতের থাপ্পড় খেয়ে ভদ্রমেয়ের মতো তা হজম করে নিয়েছ, সেই তুমি আমায় হুমকি দিচ্ছ?’

নেহা চেঁচিয়ে ওঠল, ‘হ্যাঁ, দিচ্ছি। আমি এতক্ষণ চুপ ছিলাম কারণ সিনক্রিয়েট না হয় সেজন্য। ভদ্র পরিবারের মেয়ে তো, রাস্তার কুকুরের মতো সব জায়গায় নিজেকে উপস্থাপন করতে পছন্দ করি না।’

শাখাওয়াত শক্ত কন্ঠে বলল, ‘তুমি আমায় কুকুর বলছ? এডভান্টেজ কী তুমিও চাও নাকি? বিজনেসম্যান দেখে লোভে পড়ে গেছ?’

নেহার রাগ চড়ে ওঠলেও সন্তপর্ণে তা সামলে নিলো। চোখ বুজে শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে বলল, ‘নাহ, কুকুর তো তাও ভালো। আপনি নর্দমার কীটের চেয়েও জঘন্য। যেখানেসেখানে কিলবিল করে ওঠেন। লো মেন্টালিটির ক্লাসলেস লোক!’

শাখাওয়াত রেগে গেল। ইতোমধ্যে রেস্টুরেন্টের অসুস্থ পরিবেশ দেখে অনেকেই তাঁদের পরিবার নিয়ে ওঠে গেছে। তবুও দু-চারজন যুবক বসে শাখাওয়াতের রঙ-তামাশা আর রোজাদের অপদস্থ হওয়া দেখছে!
কেউ আবার ওদেরকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।
রোজা ব্যাপারটা কোনোক্রমেই সহ্য করতে পারলো না। রেস্টুরেন্টের পরিবেশটা ওর কাছে জঘন্যতম একটা জায়গা বলে মনে হচ্ছে। ম্যানেজার, ওয়েটাররাও কিছু বলছে না৷ এ পর্যায়ে এসে শাখাওয়াত হিংস্র গলায় বলল, ‘আমি ক্লাসলেস? হোয়াট ডু ইউ মিন? তুমি কী ভাবছো আমার টাকাপয়সা নেই? আমার যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে!’

রোজা এবার চেঁচিয়ে বলল, ‘টাকাপয়সা আছে, তবে মনুষ্যত্ব নেই। যেটা সবচেয়ে দামী জিনিস!’

শাখাওয়াত রাগে কফির মগটা উপুড় করে টেবিলে ফেলে দিলো। বসা থেকে দাঁড়িয়ে রোজার দিকে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল। রোজা ভড়কে দু-পা পিছিয়ে গেল। নেহা আর ফিহা ভয় পেয়ে গেল। শাখাওয়াত রোজার গালে নিজের গাল ঘষতে যাবে ঠিক তখনই কে যেন পেছন থেকে শাখাওয়াতকে লাথি মারলো। আর ও ছিঁটকে গিয়ে পড়লো রোজার পায়ের ওপর। হতভম্ব হয়ে চোখ তুলে তাকালো রোজা। সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেহার ভাই উৎস আর তার বন্ধুদের দল। রক্তবর্ণ গাঢ় চোখে তাকালো উৎস রোজার দিকে। অতঃপর নেহার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোরা তিনজন গাড়িতে গিয়ে বস। এই অজাতকুজাতের ক্লাস আমি নেব!’

উৎসে’র চার বন্ধুও সমস্বরে বলে ওঠল, ‘তোরা যা নেহা। এরে দেইখা নিব আমরা।’

রোজা তখনো নড়লো না জায়গা থেকে। উৎস বিরক্তি নিয়ে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘কী সমস্যা তোর? বলছি না গাড়িতে গিয়ে বস? শুনছিস না কেন? না-কি এক থাপ্পড় মারব?’

রোজা এবার ছলছল কন্ঠে বলল, ‘এ এই লোকটা আমাকে ওর জঘন্য হাতে ছুঁয়েছে, ও ও ভালো লোক নয়..’

উৎস ওর অবস্থাটা বুঝতে পেরে গালে হাত রাখলো। কন্ঠে নম্রতা এনে বলল, ‘দরকার হলে ওর হাত কেটে নেব আমি, তুই কাঁদিস না৷ প্লিজ গাড়িতে গিয়ে বস, ড্রাইভার চাচা পৌঁছে দেবে তোদের।’

উৎস ফিহা আর নেহাকে গমগমে গলায় আদেশ করলো রোজাকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসতে। রোজা ওর হাত চেপে ধরে বলল, ‘ও ওনি বলেছেন আমার সাথে রাত কাটাতে চান, নেহা আপুকেও থাপ্পড় মেরেছেন.. লোকটা জঘন্য ভাইয়া, প্রচন্ড জঘন্য!’

কথাটা শুনেই মাথায় আগুন ধরে গেল উৎস’র। রোজাকে ঠেলে গাড়িতে ওঠিয়ে দিলো নেহাদের সাথে। শেষ বিকেলের মরা আলোয় উৎস অনিমেষ চাহনি মেলে ওদের চলে যাওয়া দেখল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে। ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলল, ‘হারামিটার এত শখ তোকে বেড পার্টনার বানানোর? ওর সেই শখ যদি ঘুচিয়ে না দিই তবে আমি উৎস না।’

উৎসের আদেশে ওর চার বন্ধু আশফি, ইমাদ, মাহিদ, রেনন মিলে রেস্টুরেন্ট থেকেই তুলে এনেছে শাখাওয়াতকে। নিয়ে আসা হয়েছে রেনন, ইমাদ’দের ফ্ল্যাটে। আর রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়ে এসেছে কেন তারা প্রতিবাদ করেনি। শাখাওয়াত এ ঘটনায় খানিকটা ঘাবড়ে গেল। ওকে বসিয়ে রাখা হয়েছে ফ্লোরে। উৎস হাতমুখ ধুয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো শাখাওয়াতের সামনে। আঁৎকে ওঠল শাখাওয়াত। নেহা, রোজাদের সামনে নিজেকে যতটা স্মার্ট দেখাচ্ছিল, সেটা ফুরুৎ করেই উবে গেল। উৎস ওর গাল খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, ‘কী বলেছিলি তুই? আমার বোনদেরকে তুই বেড পার্টনার বানাতে চাস? তোর এত বড় স্পর্ধা? তোর মতো কুত্তাকে তো গুলি করে মারা উচিৎ আমার। কিন্তু না, সেটা করব না। তোর মতো বেজন্মা কুত্তাদের মেরে হাত নষ্ট করতে চাই না। তোকে কী শাস্তি দেওয়া যায় বল তো?’

ইমাদ আর রেনন বলল, ‘শালার বেশি কুড়কুড়ানি না? দিয়া দে বুকের ওপর একটা ঘুষি। সব কুড়কুড়ানি বাইর হইয়া যাইবো।’

উৎস হিংস্র কন্ঠে বলল, ‘ঠিক বলছিস। তবে ঘুষিটা বুকে নয়, ওর মেইন পার্টে যাবে! কীরে নর্দমার কীট, ওটা না থাকলে কী করবি এবার?’

শাখাওয়াত দস্তুর মতো জমে গেল। ভয়ার্ত কন্ঠে আমতাআমতা করে বলল, ‘ম ম মা মা মানে?’#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব__২

উৎস হিংস্র কন্ঠে বলল, ‘ঠিক বলছিস। তবে ঘুষিটা বুকে নয়, ওর মেইন পার্টে যাবে! কীরে নর্দমার কীট, ওটা না থাকলে কী করবি এবার?’

শাখাওয়াত দস্তুর মতো জমে গেল। ভয়ার্ত কন্ঠে আমতাআমতা করে বলল, ‘ম ম মা মা মানে?’

‘মানে বুঝিস না শালা? তুই বাচ্চা? ওয়েট, বুঝাই বলি। তোর যেটায় বেশি কুড়কুড়ানি সেটা যদি না থাকে তাহলেই তো সব কুড়কুড়ানি শেষ, সবকিছু থেকে মুক্তি পাবি। তোর শুভাকাঙ্খী হয়ে এটুকু কাজ তো আমরা করতেই পারি। কী বলিস তোরা?’

ইমাদ ডানহাতে টেবিলের ওপর চাপড় মেরে উৎসের কথায় সায় জানালো। তীব্র শব্দে কেঁপে ওঠলো শাখাওয়াত। মুখে কিছু বলতে পারলো না। উৎসের অগ্নিদৃষ্টি পরখ করার দ্বিতীয়বার সাহস হলো না ওর। নেহাদের অপদস্ত করতে গিয়ে যে এমন পরিস্থিতিতে পড়বে সেটা ভাবেই নি সে। উৎস আর ওর বন্ধুদল যে এতটা হিংস্র সে মোটেও কল্পনা করেনি। সত্যিই কী ওর এই অবস্থা করবে ওরা? শাখাওয়াতের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠলো। সে আমতাআমতা করে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা, কেন এরকম করছো?’

উৎস সজোরে গালে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘আমার বোনদের সাথে কী নোংরা ব্যবহার করেছিস মনে নেই? চেহারা দেখে তো মনেই হয় না, তুই একটা ইতর। টাকার লোভ দেখাস আমার বোনদের? কেন রে? আমরা কী ভিক্ষা করে ওদের বড় করেছিলাম? তোর মতো কীটের সাথে আমার বোনের বিয়ে দেব? এরচেয়ে ভালো তোকে জবাই করে, বস্তায় মুড়িয়ে নদীতে ফেলে দেওয়া, যাতে দ্বিতীয়বার এসব করার সাহস না দেখাস। শালা বাস্টার্ড!’

শাখাওয়াত দমে গেল। এই ছেলে আবার সত্যিই ওকে জবাই করে ফেলবে না তো? এদের পাঁচজনের সাথে সে কখনোই পেরে ওঠবে না। তবুও সে মাফ চাইলো। কম্পিত কন্ঠে বলল, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে ভাই, আমাকে যেতে দাও তোমরা। আর কোনোদিন এরকম করব না। আমাকে ছেড়ে দাও, যা চাইবে তাই দিব।’

শাখাওয়াতের এই কথায় সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকালো। আশফি বসা থেকে ওঠে ওর প্যান্ট-শার্টের পকেট খুঁজে ওয়ালেট, ফোন নিয়ে নিলো। ওয়ালেট চেক করে দেখল সেখানে বেশকিছু টাকা। গুণে দেখল প্রায় পাঁচ হাজার টাকা, ফোনটাও দামী। হঠাৎ সাইড বাটনে চাপ পড়তেই ফোনের ওয়ালপেপার দেখে ‘নাউজুবিল্লাহ’ বলে চিল্লিয়ে ওঠলো। ইমাদ বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘চেঁচাস কেন শালা?’

আশফি জিভ কেটে উৎসের দিকে তাকালো। বলল, ‘দেখ কী নোংরা পিক এর ফোনে, এইজন্যই শালার বেশি কুড়কুড়ানি।’

উৎস ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে এক আছাড় মারলো। ঠাস শব্দ তুলে সেটা কয়েক পার্টে ভাগ হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। শাখাওয়াতের চেহারা রক্তশূন্য। আশফি হাতের টাকাগুলোর দিকে চেয়ে বলল, ‘নিচে একজন বুড়ো দাদা থাকে না? ওনারে দিয়া আসি? কিছু কিনতে ওনার কাজে লাগব। এই শালায় তো মনে হয়, এসব দিয়া রাইতে ফুর্তি করব। কী বলিস দোস্ত?’

উৎস বলল, ‘যা, দিয়ে আয়।’

শাখাওয়াত খানিকটা ভরসার সুরে বলল, ‘টাকা-পয়সা, ফোন তো নিয়ে গেছ। এবার ছেড়ে দাও আমায়।’

রেনন ধপ করে টেবিলের ওপর বসে পড়লো। ওর হাতে একটা আপেল। মুখ ‘হা’ করে সেই আপেলে বড় একটা কামড় বসাতে বসাতে মেয়েলি কন্ঠস্বর নকল করে বলল, ‘ছেড়ে দিব? এভাবে বলে না বাবু। তুমি আজ সারারাত আমাদের এখানে স্পেশাল যত্নে থাকবা।’

‘স স্পেশাল যত্ন মা মানে?’

‘বুঝতে পারো নি, তাই না সোনামণি? ওকে দাঁড়াও বুঝিয়ে বলছি।’

রেনন টেবিলের ওপর থেকে নেমে দাঁড়ালো। আপেলটা রেখে দু’হাতের মুঠো শক্ত করে শাখাওয়াতের নাক বরাবর একটা ঘুষি মারলো। কিঞ্চিৎ পিছিয়ে দেওয়ালে বারি খেল শাখাওয়াত। মাথার পেছনটায় ভোঁতা একপ্রকার ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতেই রেনন ওর দু’গাল বাচ্চাদের মতো জোরে টেনে দিলো। শাখাওয়াতের মনে হলো ওর গালের মাংস ভেদ করে হাড্ডিতে বুঝি আঁচড় কাটছে কেউ। ব্যথায় চোখমুখ কুচঁকে ফেলল। হাতদুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকায় সে ছটফট করতে লাগলো রেনন ওকে ছেড়ে দিলো। ওর মুখের ওপর থু থু মেরে বলল, ‘এটাই আমাদের স্পেশাল যত্ন সোনামণি। লাগবে আরেকটু যত্ন? বলো তো করে দিই!’

শাখাওয়াত ভীত চোখে তাকিয়ে রইল। উৎস হুঙ্কার দিয়ে বন্ধুদের বলল, ‘এরে সারারাত আটকে রাখ৷ খাবার দিবি না। সকালে ছেড়ে দিবি। আজকের কথা মনে থাকলে ভবিষ্যতে এসব করার দুঃসাহস দেখাবে না। শালা কুত্তা।’

ইমাদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘নেহা বাসায় গিয়ে আংকেলরে এসব বলছেনি? ওনার তো জানা দরকার।’

‘কি জানি! এই তিন বোকা কী করছে! ভাগ্যিস নেহা টেক্সট করেছিল ঠিক সময়ে, নয়তো বোকাগুলা এর ফাইজলামির শিকার হতো। আমি আসি, বাসায় যেতে হবে।’

‘আচ্ছা, আমরা এরে সামলায় নেব।’

নিঃস্তব্ধ পৃথিবীর পূর্বাকাশে ঝলমলে আলো ছড়াচ্ছে শুক্লাদ্বাদশীর চাঁদটা। পুরো আকাশ ঘিরে রেখেছে কোটি কোটি তারা। অন্ধকার এই রাত্রির আকাশখানি মনোযোগ দিয়ে অবলোকন করছে উৎস। হালকা ফিনফিনে হাওয়া গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ওর। মনোযোগে ভাটা পড়লো ফোনের কম্পনে। ভাইব্রেশন মুডে থাকা ফোনটি পকেটের ভেতর যেন হাত-পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। উৎস দ্রুতগতিতে ফোনটা বের করে স্কিনে তাকাতেই ‘আদ্রিশ ওয়াজিদ’ নামটি দেখল। তাঁর বড় চাচার ছেলে। উৎস কলটি রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে আদ্রিশের তীক্ষ্ণ কন্ঠ শোনা গেল, ‘নেহাদের সাথে যে ছোটলোকটা অসভ্যতামি করেছে ওটার কী ব্যবস্থা নিয়েছিস?’

উৎস প্রশ্নটার জন্য প্রস্তত ছিল না। আদ্রিশ যে বোনদের সাথে অন্যায়-অসভ্যতামি মেনে নিতে পারবে না সেটাও ভালো করে জানে। আদ্রিশের হাতে পড়লে এতক্ষণে শাখাওয়াতের যে কী অবস্থা হতো ভাবতেই হাত কেঁপে গেল ওর। সেজন্য আগেভাগেই ও সবটা সামলে নিয়েছে, যাতে কোনো অঘটন না ঘটে যায়। কিন্তু ওকে জানালো কে এসব? ফিহা বাঁদরটা নিশ্চয়ই! উৎস হেসে আদ্রিশের প্রশ্নের জবাবে বলল, ‘ওর ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে গেছে ভাই। তুমি চিন্তা করো না।’

আদ্রিশ শুনলো। একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় ছোটলোকটা? কী ব্যবস্থা নিয়েছিস?’

উৎস ঢোক গিলে বলল, ‘হাত-পা ভেঙ্গে আটকে রেখে আসছি।’

আদ্রিশ স্বস্তি পেল যেন। হালকা গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে গমগমে স্বরে বলল, ‘গ্রেট।’

‘রাখি ভাই?’

‘বাসায় আয় তাড়াতাড়ি।’

‘আসছি।’

ফোন কলটি কেটে দিলো উৎস। হাফ ছেড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বাইরে মনোযোগ দিলো। চারপাশের অন্ধকার কাটিয়ে এক টুকরো আলোকিত চাঁদ ঠিক আকাশের মাঝখানে এসেছে। মায়াবী আলোয় পৃথিবীকে যেন ভাসিয়ে নিচ্ছে অন্য কোনো রাজ্যে! বাড়ি পৌঁছাতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল ওর। ডাইনিং থেকে পানি খেয়ে লিভিংরুমের দিকে পা বাড়ালো উৎস। গিয়ে দেখলো নেহা, ফিহা আর রোজা বসে আছে। তিনজনের মাথা নিচু, দৃষ্টি কার্পেটের ওপর। আদ্রিশ ভলিউম কমিয়ে টিভি ছেড়ে রেখেছে, কিন্তু কিছুই দেখছে না। চোখের দৃষ্টিতে রাগ ফুটে আছে। হঠাৎ উৎসকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে আদ্রিশ বলল, ‘তোর এই বোনটা বেশি চালাকি শিখে গেছে না? আমাকে না জানিয়ে তোকে টেক্সট করেছে। কত বড় সাহস হয়েছে বুঝতে পারছিস?’

উৎস এসে বসলো সিঙ্গেল সোফার হাতলে। তারপর বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে থাক। তোমাকে তো ওরা ভয় পায়। আমি তো সামলে নিয়েছি ব্যাপারটা।’

আদ্রিশ ঝাঁঝালো স্বরে বলল, ‘আমি কী বাঘ নাকি ভাল্লুক যে ভয় পায়? যত্তসব নাটক। আর এরা কী বাচ্চা? তিন তিনজন মেয়ে ওই কুত্তাটাকে মিলে বেধড়ক পিটাতে পারে নাই? খুকী সেজে থাকলে নর্দমার কীটরা এভাবেই অপদস্ত করবে৷ যত্তসব অপদার্থ..’

উৎস শান্ত গলায় বলল, ‘থাক ভাই। যেটা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। তো? আব্বুরা কী বললো?’

আদ্রিশ কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিল, ‘ডাস্টবিনের সাথে বিয়ে দেবে কে? ক্যান্সেল।’

‘ওহ, যাক ভালোই।’

অতঃপর আদ্রিশ আর উৎস শাখাওয়াতের অবস্থা-ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে লাগল। নেহা অধৈর্য হয়ে গেল। কিন্তু আদ্রিশ ওদেরকে যেতে অনুমতি দেয় নি। আর না পেরে নেহা ওর পাশে বসা ফিহাকে ফিসফিস করে বলল, ‘সব তোর জন্য। ভাইকে এসব কাহিনী বলতে গেলি কেন?’

ফিহা নিচুকন্ঠে বলল, ‘ওই শাখাওয়াতটার ওপর রাগ হচ্ছিলো আমার। তাই আদ্রিশ ভাইয়ার হাতে মার খাওয়াতে ইচ্ছা করছিল!’

‘ইচ্ছা করলেই তুই বলে দিবি? জানিস না ভাই কেমন? ছোটলোকটাকে মেরেই ফেলতো!’

‘সেটাই হওয়া দরকার ছিল!’

‘চুপ থাক তুই।’

ফিহা মুখ কালো করে বলল, ‘ভালো করেছি বলে দিয়েছি।’

ওদের ফিসফিসানি রোজার কানেও পৌঁছালো। সে ভীতগ্রস্ত হয়ে বসে আছে সোফার এক কোণে। আদ্রিশকে সে অজানা কারণেই ভয় পাচ্ছে। লোকটার সামনে প্রচন্ড অস্বস্তিবোধ করে সে। আধঘন্টা যাবৎ ওর সামনে বসে আছে ভাবতেই ঘেমে ওঠলো সে। এত শাসন করে বোনদের কেউ? তাও আবার চাচাতো বোনদের? নেহা-ফিহা দুজনেই ভয় নিয়ে বসে আছে। তবে ওদের মধ্যে ফিহা আদ্রিশকে একটু কমই ভয় পায়। রোজা এবার নেহার দিকে চেপে বসে কানে কানে বলল, ‘এই লোকটা এত কড়া কেন আপু? আমার ভয় করছে, যদি চড় মেরে দেয়? আমাকে যাওয়ার সুযোগ করে দাও প্লিজ। মাথা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে আমার!’

‘ঘুম পেলে চলে যা।’ ফিহা বললো।

রোজা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে ওঠে দাঁড়ালো। দুই ভাইয়ের মনোযোগ ওদের দিকে নেই। রোজা ধীরপায়ে দরজা পেরুতে গেলেই আদ্রিশ পেছন থেকে রাগী স্বরে বলল, ‘এই মেয়ে এই, তোমাকে যাওয়ার পারমিশন কে দিয়েছে? চুপচাপ এখানে বসে থাকো, তোমার সাথে হিসাব-নিকাশ বাকি আছে আমার।’

রোজা চমকে ওঠলো। আদ্রিশের ধমকি শুনে চুপচাপ নেহার পাশে গিয়ে বসল। নেহাও অসহায় চোখে তাকালো। ভাইয়ের মাথায় কী চলছে সেটা উৎসও বুঝতে পারলো না। রোজার চেহারা রক্তশূণ্য। ওর সাথে এই যমদূতটার কীসের হিসাব-নিকাশ? ও তো ভালো করে চেনেই না আদ্রিশকে। শুধু জানে নেহার বড় চাচার ছেলে। শাখাওয়াতের সাথে রোজা যে জোর গলায় কথা বলেছে এজন্য ওকে চড়-থাপ্পড় মারবে নাকি?

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here