অনুভবে তুই পর্ব -০৩+৪

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩

রোজা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে ওঠে দাঁড়ালো। দুই ভাইয়ের মনোযোগ ওদের দিকে নেই। রোজা ধীরপায়ে দরজা পেরুতে গেলেই আদ্রিশ পেছন থেকে রাগী স্বরে বলল, ‘এই মেয়ে এই, তোমাকে যাওয়ার পারমিশন কে দিয়েছে? চুপচাপ এখানে বসে থাকো, তোমার সাথে হিসাব-নিকাশ বাকি আছে আমার।’

রোজা চমকে ওঠলো। আদ্রিশের ধমকি শুনে চুপচাপ নেহার পাশে গিয়ে বসল। নেহাও অসহায় চোখে তাকালো। ভাইয়ের মাথায় কী চলছে সেটা উৎসও বুঝতে পারলো না। রোজার চেহারা রক্তশূণ্য। ওর সাথে এই যমদূতটার কীসের হিসাব-নিকাশ? ও তো ভালো করে চেনেই না আদ্রিশকে। শুধু জানে নেহার বড় চাচার ছেলে। শাখাওয়াতের সাথে রোজা যে জোর গলায় কথা বলেছে এজন্য ওকে চড়-থাপ্পড় মারবে নাকি?

‘তোমাকে কী যেতে বলেছিলাম?’

আদ্রিশের প্রশ্ন শুনে রোজা ইতস্তত করে বলল, ‘না মানে শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছিলেন তাই আরকি!’

‘শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছি? দেখছো না এখানে কথাবার্তা চলছে।’

‘জি দেখছি।’

‘বসে থাকো এখানে।’

‘না মানে আমার ঘুম পেয়েছে, জরুরি কথা থাকলে বলতে পারেন।’

রোজার কথায় আদ্রিশের ভ্রু জোড়া আপনাআপনি কুঁচকে এলো। কুটিল চোখে চেয়ে থাকলো কতক্ষণ ওর দিকে। রোজা ভয় পেয়ে নেহার পাশে গুটিশুটি মেরে বসলো। আজকে ওর কী হয়েছে নিজেই বুঝতে পারছে না। এমনভাবে ঠাস ঠাস করে মাঝেমাঝে কথা বলে ওঠছে যেন ও কত এক্সট্রোভার্ট। কিন্তু তা তো সে নয়। আদ্রিশকে এমনভাবে দেখে উৎস বলল, ‘ভাই কি বলবা ওরে? ও তো ঘুমকুমারী, ওরে ঘুমাইতেই যাইতে দাও।’

আদ্রিশ উৎসের দিকে তাকালো। চিন্তিতমুখে উত্তর দিল, ‘নেহা-ফিহা আমাদের বোন হয়েও এত দুর্বল, আর এই মেয়েটা, এই তোমার নামটা যেন কী?’

রোজা বলার আগেই উৎস বলল, ‘ভাই, ওর নাম রোজা। আমার ছোট খালামনির মেয়ে।’

‘ওর বাবা স্কুলমাস্টার? হরষপুর গ্রামে যে তোর একজন খালু ছিল? ওনার মেয়ে?’ জিজ্ঞেস করল আদ্রিশ।

উৎস খানিকটা অবাক হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হুম। কিন্তু তুমি দেখি ডিটেইলস এ বলে দিলা?’

‘আরে, ডিটেইলস এ বলেছি কারণ আমি ওখানে গিয়েছিলাম তোর আব্বু মানে ছোট চাচার সাথে। এই মেয়েটা..রোজার দ্বিতীয় জন্মদিন ছিল বোধহয়।’

‘এত আগের কথা তোমার মনে আছে ভাইয়া? তোমার বয়স কত তখন?’ ফিহা বিস্মিত চাহনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘আট বছর। আর মনে না থাকার তো কোনো কারণ নেই, আদ্রিশ কখনো কিছু ভুলে না।’

রোজা শুধু ওদের কথা শুনছে। এই ছেলেটা ওর জন্মদিনে গিয়েছিল? ওর গ্রামের নামও জানে? বাহ! এত আগের ঘটনা কত অবলীলায় বলে দিলো যেন কালকের ঘটনা। আদ্রিশ তীক্ষ্ণ চোখে রোজাকে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কীসে পড়ো তুমি?’

এবারও উৎস জবাব দিল, ‘ভাই, ও তো ফার্স্ট ইয়ারে এডমিশন নিয়েছে আমাদের এখানকার একটা ভার্সিটিতে। গ্রামে ভালো কলেজটলেজ নেই বলে খালু ওরে এখানে পাঠায়া দিসে।’

‘এখানে থেকেই পড়াশোনা করবে না-কি?’

‘হ্যাঁ। হোস্টেলে দিতে চেয়েছিল, আম্মু জোর করে এখানে নিয়ে আসছে।’

‘সেটাই। খালার বাড়ি থাকতে হোস্টেল কেন!’ নেহা আনমনা হয়ে বলল।

আদ্রিশ রোজাকে জিজ্ঞেস করল, ‘পড়াশোনায় কেমন তুমি? ভালো না খারাপ?’

রোজা বিরক্ত হলো। লোকটা এত কথা বলছে কেন? বাচাল নাকি? যেভাবে একটার পর একটা প্রশ্ন করছে মনে হচ্ছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে বসেছে। ও বলল, ‘জানি না।’

‘জানো না? পড়াশোনা করো না তুমি?’

‘জি করি।’

‘তাহলে বলতে পারছো না কেন?’

অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে রোজা উত্তর দিল, ‘এমনি বলতে পারছি না।’

‘তুমি পড়াশোনায় কেমন সেটা তো তুমিই বলতে পারবে। অন্য কেউ কী তোমার পড়া পড়ে দেয় যে, তুমি জানো না? নিজের ওপর কনফিডেন্স নেই?’

রোজা বিড়বিড় করে বলল, ‘আছে তো!’

‘তাহলে?’

রোজা বিরক্ত হলো। বলল, ‘আমি পড়াশোনায় তেমন ভালো নই।’

আদ্রিশ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘ভালো না? এই উৎস , তাহলে একটা গাধা মেয়েকে চাচী আমাদের বাসায় নিয়ে আসছে? ফেলটেল করলে তো মানসম্মান যাবে আমাদের!’

উৎস ধৈর্যহীন কন্ঠে বলল, ‘ভাই ওরে যেতে দাও। ও ঘুমাক, তোমার ইন্টারভিউর চাপে পইড়া সে চ্যাপ্টা হইয়া যাইতেসে। পরে আর খুঁইজা পাওয়া যাইবে না।’

আদ্রিশ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না পেয়ে চোখ গরম করে তাকালো উৎসের দিকে। আমতাআমতা করে বলল, ‘না মানে ভাই, রাত অনেক হয়েছে। সেজন্যই বলছিলাম আর কি। নেহা-ফিহা-রোজা’র তো কাল সকালে এক্সারসাইজ আছে।’

‘এক্সারসাইজ?’

উৎস ফিচেল হেসে বলল, ‘না মানে..’

‘স্টপ দিস ননসেন্স।’

আদ্রিশ নিজের রাগটা চেপে নিলো। তিনবোনের দিকে ফিরে বলল, ‘বাই দ্যা ওয়ে নেহা। তোরা শহরে থেকেও যতটা ভীতু, এই মেয়েটা তা নয়। তোর ওই সো কল্ড হবু বরটার মুখের ওপর যেভাবে প্রতিবাদ করেছে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু আরেকটু স্ট্রং হওয়ার দরকার ছিল, শেষ মুহূর্তে ওই কুত্তার বাজে কথা শুনে যেভাবে চোখের জল নাকের জল এক করছিল সেখানেই আউট…. ‘

রোজা অবাক। সেই সাথে উৎস আর নেহাও। ওই ঘটনার পুরোটা তো আদ্রিশকে বলে নি ওরা, আর না তো ও সেখানে ছিল। কিন্তু যেভাবে রোজার অবস্থা বর্ণনা করছে যেন ও সত্যিই সেখানে ছিল আর গভীর পর্যবেক্ষণের সহিত দেখছিল ওদের কান্ডকীর্তি! তাহলে কি ফিহা-ই ডিটেইলস বলেছে? কিন্তু কখন? বাড়ি আসার পর থেকে ওরা তো একসাথেই ছিল! নেহা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এসব তোমায় কে বলেছে ভাইয়া?’

‘বলেছে না, লাইভ দেখেছি। তোরা কী আমায় বোকা ভাবিস?’

নেহা থতমত খেয়ে বলল, ‘না না..’

আদ্রিশ রেগে বলল, ‘ফিহার ফোনে দেখেছি। লাইভ টেলিকাস্ট। আমার তখন ইচ্ছা করছিল তোর গাল চড়ায়া লাল করে দিই নেহা। এত ন্যাকামি কোথা থেকে শিখেছিস তুই? দিতে পারিস নাই ওই কুত্তার মুখের ওপর ঘুষি?’

নেহার মুখ চুপসে গেল। ফিহা এতটা পাজি ও ভাবতেই পারে নি৷ তখন তো নিজে কিছু করলোই না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিল আবার আদ্রিশকেও নাকি এসব দেখিয়েছে। কখন করলো এই মেয়েটা এসব? নেহা রাগ নিয়ে ফিহার দিকে তাকিয়ে দেখল ও মিটিমিটি হাসছে। নিজে ভালো সাজা হচ্ছে এখন! যত্তসব। আদ্রিশ ওদেরকে আরো খানিকক্ষণ ধমকাধমকি করলো। অতঃপর উৎসের কথায় ওদেরকে ছেড়ে দিলো। রোজা একছুটে সবার আগে ঘরে চলে গেল। বিছানায় বসে হাফ ছাড়তে ছাড়তে বিড়বিড় করল, ‘পাগলছাগল কোথাকার। হিসাবনিকাশ তো নয় যেন যমদূত এসেছে শেষ নিঃশ্বাসটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য!’

নেহা রাগান্বিত হয়ে ঘরে এসেই ফিহার সাথে ঝগড়া লেগে গেল। ওদের এসবে বিরক্ত হয়ে রোজা বলল, ‘তোমাদের বাসায় থাকব না আমি আপু, এরকম অদ্ভুত যমদূতের সাথে এক বাড়িতে থাকা অসম্ভব।’

নেহা অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলছিস তুই রোজা?’

রোজা মিনমিন করে বলল, ‘ আমি তোমাদের বাসায় থাকব না আপু, কালই হোস্টেলে চলে যাব। এই লোকটার সামনে দ্বিতীয়বার পরতে চাই না। এভাবে কারো সাথে কেউ কথা বলে?’

নেহা ওর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলো। শান্ত গলায় বলল, ‘আরে তুই নতুন তো, তাই ভাইয়া এমন করেছে। আমাদের ভাইয়া এতোটাও খারাপ নয়, যতটা তুই ভাবছিস।’

‘এত খিটমিটে কেউ হয়? যেভাবে কথা বলছিল যেন, এক্ষুনি থাপ্পড় মেরে দেবে আমাকে।’

‘আজব, তোকে কেন থাপ্পড় দিবে?’ ফিহা বললো।

‘তোমার ভাইয়ের চাহনি দেখলেই মনে হয় গলা টিপে ধরবে। উৎস ভাইয়া তো এমন নয়। ওনাকে কী ছোটবেলায় করল্লার রস খাইয়ে দিয়েছিল? মধু দেয় নি মুখে?’

রোজার কথা শুনে ফিহা হেসে বলল, ‘ভাইয়ের সামনে গিয়ে বল না, থাপ্পড় দিয়ে তোর গালের মাংস ফাটিয়ে দেবে।’

‘থাপ্পড় খাওয়ার শখ নেই ফিহা আপু।’
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪

নেহা ওর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলো। শান্ত গলায় বলল, ‘আরে তুই নতুন তো, তাই ভাইয়া এমন করেছে। আমাদের ভাইয়া এতোটাও খারাপ নয়, যতটা তুই ভাবছিস।’

‘এত খিটমিটে কেউ হয়? যেভাবে কথা বলছিল যেন, এক্ষুনি থাপ্পড় মেরে দেবে আমাকে।’

‘আজব, তোকে কেন থাপ্পড় দিবে?’ ফিহা বললো।

‘তোমার ভাইয়ের চাহনি দেখলেই মনে হয় গলা টিপে ধরবে। উৎস ভাইয়া তো এমন নয়। ওনাকে কী ছোটবেলায় করল্লার রস খাইয়ে দিয়েছিল? মধু দেয় নি মুখে?’

রোজার কথা শুনে ফিহা হেসে বলল, ‘ভাইয়ের সামনে গিয়ে বল না, থাপ্পড় দিয়ে তোর গালের মাংস ফাটিয়ে দেবে।’

‘থাপ্পড় খাওয়ার শখ নেই ফিহা আপু।’

‘তাহলে এ বাড়ি থেকে যাওয়ার কথা মুখেও আনবি না।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে বলল রোজা।

ফিহা হেলেদুলে ড্রেসিংটেবিলের সামনের টুলটাতে গিয়ে বসলো। খোপায় মোড়ানো চুলের ভাঁজ খুলে তাতে চিরুনি বুলাতে বুলাতে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘শোন রোজা, খালুজানকে অনেক রিকুয়েষ্ট করে মা রাজি করিয়েছে তোকে নিজের কাছে রাখবে বলে। কখনো তুই এসেছিস আমাদের বাসায়? আসিস নি। এখন তুই চলে গেলে মা কষ্ট পাবে। আর সামান্য একটা ব্যাপারে তুই এরকম রিয়েক্ট করছিস কেন আজব? আর একান্তই যদি তোর এখানে থাকতে মনে সায় না দেয় তাহলে, আমি ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলে দেব তুই ওকে কি বাজে বলেছিস, তারপর যখন ধরে দিবে না তখন বুঝবি আদ্রিশ ভাইয়া কী জিনিস।’

রোজা ফিহার কথা শুনলো মনোযোগ দিয়ে। ক্ষিপ্র কন্ঠে বলে ওঠলো, ‘আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো আপু?’

ফিহা গা ছাড়া ভাবে উত্তর দিল, ‘মনে কর তাই।’

রোজা অনেকটা কাঁদোকাঁদো ভঙ্গিতে নেহার দিকে তাকালো। অসহায় গলায় বলল, ‘ফিহা আপু কী বলে দেখেছো? আমাকে জোর করে আটকাতে চাইছে।’

ফিহার বুদ্ধিমত্তা দেখে মনে মনে প্রশংসা করে নেহা। ওর বোনের মাথায় যে কত রকমের কুটিল বুদ্ধি আছে সেটা দেখে মাঝেমধ্যে ও নিজেই অবাক বনে যায়। তবে রোজাকে আটকানোর জন্য যে ট্রিকস অবলম্বন করেছে সেটা খুবই প্রশংসার যোগ্য! নেহা রোজার কথা না শোনার ভঙ্গিতে বলল, ‘তো? কী করবে? তুই যদি আরেকবার প্যানপ্যান করিস আমি নিজেই গিয়ে ভাইয়াকে বলে দেব, তারপর দেখিস মজা।’

রোজা হতবিহ্বল হয়ে বলল, ‘আপু তুমিও!’

নেহা হাই তুলতে তুলতে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো। কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল, ‘কথা বাড়াস না। শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে।’

‘তুমি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছো নেহা আপু। আমি তোমাদের বাসায় থাকতে চাই না।’

নেহা কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুই বললো না। পাশ ফিরে শুয়ে চক্ষুমুদিত করল। ততক্ষণে ফিহা চুল বাঁধা শেষ করে ওঠে দাঁড়ালো। বেড সাইডের বাতিটা নিভিয়ে দিতে দিতে খানিকটা রাগমিশ্রিত কন্ঠে রোজার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তুই এমন কান্ড করছিস যেন আদ্রিশ ভাইয়া বাঘ নয়তো ভাল্লুক। এই তোকে কিছু করেছে? জাস্ট রেগে একটু প্রশ্ন করেছে, তাতেই তুই এসব শুরু করেছিস রোজা। আমাদের তো মাঝেমধ্যে মাথায় চাটি মারে, তবুও তো এমন করি না। যত্তসব৷ তুই এখনি যদি ঘুমাতে না যাস, আমি সত্যিই ভাইয়ার কাছে উলটা পালটা কথা লাগিয়ে দেব। ভাইয়ের হাতে চড় খাইলে বুঝবি সে কী জিনিস! যা ঘুমা বলছি..’

রোজা মুখ কালো করে বসে রইল। ফিহা আড়চোখে দেখল ওকে। যেন কৃষ্ণবর্ণের একরাশি মেঘ রোজার শুভ্রসুন্দর মুখখানি ঘিরে রেখেছে। খোলা জানালার কপাট দিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়ায় কপালের কাছের ছোট চুলগুলো এদিকসেদিক ওড়ছে। ফিহা আড়ালে ঠোঁট চেপে হাসলো। গ্রামে বড় হওয়া তাঁর এই বোনটি যে ভীতুর ডিম সেটা ওরা খুব ভালো করেই জানে। তবুও শাখাওয়াতের সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলেছে তাতে ওরা বেশ অবাকই হয়েছে বলা যায়। যে মেয়েকে ঠেলে-ধাক্কিয়েও কথা বলানো যায় না, সে আজ কীভাবে এত এত কথা বললো সেটা মেমোরিতে রেখে দিতেই নিজের ফোনে ভিডিও করেছিল ফিহা। খালুজান-আদ্রিশের ফোনে পাঠিয়েছিল সে। ফিহা মুচকি হেসে নেহার বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে পড়লো। রোজা গুটিশুটি মেরে ওদের দু’বোনের মধ্যিখানে শুয়ে পড়তেই নেহা-ফিহা ওকে দু-দিক থেকে জাপ্টে ধরল। গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে রোজা মৃদুস্বরে বলল, ‘ফ্রি তে কোলবালিশ পেলে এমনই বুঝি হয়! তোমারা দুই বোন নির্ঘাত আমায় তুলো ভাবছো!’

‘বিড়বিড় করে এত কী কথা বলছিস রোজা? ঘুমিয়ে পড় না…’

রোজা ঘূর্ণায়মান ফ্যানটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনে বলে উঠলো, ‘নেহা আপু, তোমার বিয়েটা যে ভেঙ্গে গেল সেটা কী আমার জন্য?’

নেহা-ফিহা মাথা উঁচিয়ে তাকালো। রাগমিশ্রিত কন্ঠে নেহা জবাব দিল, ‘তোকে কে বলেছে?’

‘কেউ না। গ্রামে এরকম কান্ড হলে বলতো এক বোনের জন্য আরেক বোনের বিয়ে ভেঙ্গেছে। যার জন্য ভেঙেছে সেই মেয়েকে তখন অপয়া, অশুভ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়। আচ্ছা এই ঘটনা যদি গ্রামে ঘটতো তাহলে আমাকেও সবাই এরকম বলতো, তাই না?’

ফিহা ধপ করে ওঠে বসলো। রোজা চমকালো। ফিহা কড়া কণ্ঠে বলল, ‘আসলেই কী তোর জন্য বিয়ে ভেঙ্গেছে না-কি? ওই ছেলে নিজেই তো নেহা আপুকে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। সেজন্য আপুকে সবার সামনে অপমান করেছে। আরে ও তো একটা ছ্যাছড়া, অশিক্ষিত লোক। তুই যখন প্রতিবাদ করতে গেলি
দেখলি না কেমন অসভ্যতামি করলো? দরকার হলে আমার বোনকে কখনোই বিয়ে দেব না। এর সাথে সংসার করার চেয়ে আইবুড়ো হয়ে জীবন কাটানো অনেক ভালো।’

‘না মানে আমি ভাবছিলাম..’

নেহা বিরক্ত হয়ে ধমকে বলল, ‘এই তুই চুপ করবি? এই লোকটাকে প্রথম থেকেই আমার সুবিধার মনে হচ্ছিলো না। তার মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে যা গুণগান গাইতো সবকিছু অতিরিক্ত লাগতো আমার। ওই যে বলে না, ফাঁকা কলসি বাজে বেশি, তেমনই। বিয়েটা ভেঙ্গেছে একদম ঠিক হয়েছে। তাছাড়া দেশে কী ছেলের আকাল পরেছে যে আমার বিয়ে হবে না? তুই এত ভাবছিস কেন! আর একটা কথাও বলবি না। চুপচাপ ঘুমা রোজা…’

সকালে নাস্তার টেবিলে নেহার পাশে কাচুমাচু হয়ে বসে খাচ্ছিলো রোজা। পরোটার সাথে দেওয়া হয়েছে হাঁসের ডিম। যেটাতে ওর এলার্জি আছে আর পরোটা ওর মোটেও পছন্দ না। কিন্তু এই কথাটাই সে মুখফুটে খালা বা নেহাকে বলতে পারছে না সে। কারণ টেবিলের একপ্রান্তে বসে নাস্তা খাচ্ছে আদ্রিশ, ওর বাবা, উৎস, ফিহা, ওদের বাবা। সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করছে নেহার মা নিশিতা, আদ্রিশের মা মিতালি। খেতে খেতে আদ্রিশ পর্যবেক্ষণ করছিল সবাইকে। যখন দেখলো রোজা কিছু খাচ্ছে না, আনমনা হয়ে বসে আছে তখন ধমকের সুরেই সে জিজ্ঞেস করল, ‘এই মেয়ে? খাচ্ছো না কেন? কখন থেকে এভাবে বসে আছ? সমস্যা কী?’

আদ্রিশের কন্ঠস্বর পেয়ে সবাই একপলক ওকে দেখে নিয়ে রোজার দিকে তাকালো। এতগুলো মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে আছে ভাবতেই অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল রোজা। তাড়াহুড়ো করে পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুরলো। সবাই আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল। ওর খাওয়া দেখে নেহা অদ্ভুতচোখে তাকিয়ে রইল। জিজ্ঞেস করল, ‘ডিম নিলি না যে? শুকনো পরোটা কেউ খায় নাকি? পানি খা, নয়তো গলায় আটকে যাবে।’

রোজা বিড়বিড় করে বলল, ‘পরোটা খাই না আপু, হাঁসের ডিমে এলার্জি আছে আমার।’

সবাই খাওয়ায় মনোযোগী। আদ্রিশ কুটিল চোখে বসে দেখছিল রোজার কান্ডকারখানা। ওর মৃদুকন্ঠে বলা কথাটি অন্যরা না শুনতে পেলেও, আদ্রিশ ঠিকই শুনতে পেল। বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইল রোজার দিকে। জোর গলায় বলল, ‘ডিম-পরোটা খাও না, এটা বলতে তোমার প্রবলেমটা কোথায়?’

আবারও সবাই ওদের দিকে তাকাল। আদ্রিশের বাবা ইনায়াত সাহেব ওকে বললেন, ‘তুমি মাথা ঘামিও না। মিতালি-নিশিতা যাও তো, রোজার জন্য কিছু একটা করে নিয়ে আসো। আমি লক্ষ্য করেছি, মেয়েটা অনেকক্ষণ খাবার নিয়ে বসে আছে, খেতে পারছে না।’

আদ্রিশ বাবার কথা শুনে বলল, ‘এজন্য চুপ করে বসে থাকবে? যেটায় ওর সমস্যা সেটা বলে দিলেই তো হয়। আমাদের বাড়িতে কি খাবারদাবার নেই নাকি? রিডিকিউলাস!’

রোজা লজ্জিত। আদ্রিশের কথাগুলো ওর ভালো লাগছে না। সবার সামনে এভাবে কথা শুনানোর মানে কী! লোকটা কী চিরকালই এমন? খ্যাটখ্যাট করে কথা বলে? আদ্রিশের মা মিতালি এসে ওকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কয়টা স্যান্ডউইচ করে দিই? ডিম ছাড়া?’

ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে রোজা বলল, ‘না না দরকার নেই।’

নেহা ধমক দিয়ে বলল, ‘বড়চাচী ওর কথা শুনো না। স্যান্ডউইচ খাবে ও।’

নিশিতা কফির মগ এগিয়ে দিলো রোজার দিকে। বলল, ‘কফিটা খা৷ ততক্ষণে স্যান্ডউইচ করে দিচ্ছি!’

রোজা মাথা নুইয়ে বলল, ‘কফি খাই না আমি। চা খাই।’

আদ্রিশ এবার চেঁচিয়ে ওঠল, ‘এসব কী শুরু করেছ তুমি? এটা খাবে না, ওটা খাবে না তো খাবেটা কী? আমাকে খাবে?’

সবাই অবাক হয়ে তাকালো। ইনায়াত সাহেব কড়া গলায় বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে? তোমাকে খাবে কেন? ও কী খাবে না খাবে সেটা তো তোমার মা-চাচীই দেখে নিচ্ছে। তুমি নিজের খাওয়া রেখে এরকম করছো কেন?’

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here