অনুভবে তুই পর্ব -০৫+৬

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

রোজা মাথা নুইয়ে বলল, ‘কফি খাই না আমি। চা খাই।’

আদ্রিশ এবার চেঁচিয়ে ওঠল, ‘এসব কী শুরু করেছ তুমি? এটা খাবে না, ওটা খাবে না তো খাবেটা কী? আমাকে খাবে?’

সবাই অবাক হয়ে তাকালো। ইনায়াত সাহেব কড়া গলায় বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে? তোমাকে খাবে কেন? ও কী খাবে না খাবে সেটা তো তোমার মা-চাচীই দেখে নিচ্ছে। তুমি নিজের খাওয়া রেখে এরকম করছো কেন?’

‘ও যা শুরু করেছে তা টলারেট করতে পারছি না আমি। খেতে বসেও শান্তি নেই। কোথাও এতটুকু রিফ্রেশমেন্ট নেই!’

ইনায়াত সাহেব রেগে গেলেন। মুখখানা থমথমে অবস্থা ধারণ করেছে। একটা মেয়ের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় আদ্রিশ কী সেটা জানে না? অভদ্রতামির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ওর কথাবার্তা। যেখানে কারোর কোনো সমস্যা হচ্ছে না সেখানে আদ্রিশের এত কীসের সমস্যা হচ্ছে! বাবার সাথে মনোমালিন্য হওয়ার একপর্যায়ে আধখাওয়া ব্রেডটা প্লেটে রেখে না খেয়েই ওঠে পড়ল আদ্রিশ। যাওয়ার সময় উৎসকে বলে গেল, ‘তোর সাথে কথা আছে। সময় করে ঘরে আসিস।’

‘হুম, ঠিক আছে।’

ওদিকে রোজা পানসে মুখে সবটা দেখল। আদ্রিশের কথাবার্তা, রাগ, মুড কিছুই ও বুঝতে পারলো না। মিতালি ওর জন্য স্যান্ডউইচ করে নিয়ে এলো, সাথে কমলার জুস। নিশিতার বানানো গ্রীন টি’য়ের চায়ের কাপটাতে হালকা চুমুক দিতে দিতে রোজা জিহবা পুড়িয়ে ফেলল, তবে অতি সন্তপর্ণে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল। পাছে আবার আদ্রিশ এসে বলে, আমাকেও পুড়িয়ে ফেলো!

দ্রুত খাওয়া শেষ করে ঘরে চলে এলো রোজা। এসেই হাতমুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসলো। আদ্রিশের অদ্ভুত কান্ডকীর্তি ভাবতে গিয়ে প্রথমে মনোযোগ বসতে চাইলো না বইয়ের পাতায়, জোর করে সকল ভাবনাচিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার পর মনোযোগ এলো মনে। প্রশান্তিও বোধ হলো। এভাবেই কেটে গেল কয়েকটি ঘন্টা। পড়তে পড়তে কখন যে চোখ ঝাপসা হয়ে লেগে এসেছিল বুঝতেই পারেনি সে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় পিঠের ওপর সূচালো কোনো বস্তুর তীক্ষ্ণ খোঁচা অনুভূত হতেই একলাফে বিছানায় ওঠে বসলো। বিস্ফোরিত চোখে এদিকওদিক তাকিয়ে বড় করে হাফ ছাড়লো। শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘ফিহা আপু তুমি? আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।’

‘জানি তুই ভীতুর ডিম।’

রোজা সরু কন্ঠে বলল, ‘মোটেও নয়।’

ফিহা ব্যাঙ্গাত্মক সুরে হাসলো। তারপর বলল, ‘তুই ভীষণ সাহসী রোজা। এজন্য তুই এওয়ার্ড ডিজার্ভ করিস। এওয়ার্ডটা যদি আদ্রিশ ভাইয়ার হাত থেকে নিস, তাহলেই বোঝা যাবে কে সাহসী, কে ভীতু! ঠিক বলি নি রোজা?’

রোজা মুখ কালো করে বলল, ‘তুমি সবসময় ফাজলামো করো আপু। ওই লোকটার কথা প্লিজ বলো না। যাইহোক, ঘুমের মধ্যে এমন কেউ করে? যেভাবে পিন ফুটিয়ে ডাক দিলে আমি তো ভেবেছি কে না কে! ওফফ.. কোনো প্রয়োজন আছে?’

ফিহা অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে হাসলো। মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, ‘বিকেল চারটা বাজে। দুপুরের খাবারটাও খাসনি। যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়, মা-চাচী তোকে ডাকছে।’

রোজা চোখ দুটো বড়বড় করে বলল, ‘আল্লাহ! বিকেল চারটা বাজে? আগে ডাকোনি কেন?’

‘তুই যে কুম্ভকর্ণ, তা কী আর আগে জানতাম? কতবার ডেকে গেল নেহা আপু। না পেরে এবার আমাকেই পাঠালো।’

রোজা চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়ল। ওয়াশরুমের দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘স্যরি স্যরি।’

সোনালি রোদ্দুরে চকমক করা আকাশে ওড়ে ক্লান্ত পক্ষীরা খাবার নিয়ে তাদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদ জানালা গলে আসছিলো আদ্রিশের ঘরের বারান্দায়, মেঝেতে। আছড়ে থাকা রোদের টুকরোগুলো অন্যরকম লাগছিল দেখতে। আদ্রিশ তটস্থ। বাড়ি থেকে বেরুনোই যেন ওর জন্য কষ্টসাধ্য, তাই অফিসেও যায়নি সে। মাথায় সারাক্ষণ চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে সরল একটা মুখ। তাতেই আরও অস্থির হয়ে ওঠছিল আদ্রিশ। অসুস্থ মনটা কোনো কাজেই মন বসাতে না পারায়, নিজেকে শান্ত কর‍তে ল্যাপটপে প্রয়োজন একটা আর্টিকেল মগ্ন হয়ে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল সে। হঠাৎ নিজের ঘরের দরজার বাইরে গুটুর গুটুর শব্দ শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’

‘আমি ভাই।’

উৎসের গলা শুনতে পেয়ে আদ্রিশ জোরালো কন্ঠে বলল, ‘ভেতরে আয়।’

ভেজানো দরজা ঠেলে উৎস ভেতরে ঢুকলো। গায়ে তার হাফহাতা টি-শার্ট, পরণে হাফ নেভি ব্লু প্যান্ট। চোখে আলস্য ভাব। আদ্রিশ পা গুটিয়ে ওকে বসতে বললো। উৎস বিছানার একপাশ টানটান করে ধপ করে বসে পড়লো। বসেই বিছানায় পড়ে থাকা সাময়িকীটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। আদ্রিশ হেলান দিলো বিছানার হেডবোর্ডে। ল্যাপটপের স্ক্রিন নামাতে নামাতে জিজ্ঞেস করল, ‘শাখাওয়াতের আপডেট কী?’

উৎস শান্ত গলায় বলল, ‘ডেঞ্জেরাস লোক। ভাবতেও পারবেনা ও কী ট্রিকস অবলম্বন করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল রাতে। তবে আমার ইন্টিলিজেন্ট ফ্রেন্ড’দের কাছে ওসব কিছুই না। ওরা সঠিক সময়ে ওকে ধরে ফেলেছিল। তারপর বেদম ক্যালানি দিয়ে সকালে ছেড়ে দিয়েছে।’

‘গুড।’

কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া সোজা করে আদ্রিশ জিজ্ঞেস করল, ‘যাইহোক, নেহার সাথে কথা হয়েছে তোর? কালকের ঘটনার পরে আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করি নি। সময় নেওয়া উচিৎ ওর।’

উৎস নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘আব্বু কথা বলবে। আর টেনশন নিও না, নেহা সবটা সামলে নেবে। ওই শাখাওয়াতের সাথে ওর যায় না। ফিহার সাথে কথা হয়েছে আমার, নেহা নাকি খুশিই হয়েছে বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়ায়। তাও একবার কথা বলবো আমি।’

‘হ্যাঁ, তাই বলিস। ওর জন্য আরও ভালো কেউ নিশ্চয়ই আসবে। ওসব কীটের কথা বাড়িতে যেন আর না তুলে বাবা-চাচাদের জানিয়ে দিস। সম্বন্ধ করার আগে খোঁজখবর না নিয়েই ওদের যত বাড়াবাড়ি। এখন থেকে ব্যাপারটা মাথায় রাখতে বলবি। নয়তো নেহার বিয়ের কথাই যেন এ বাড়িতে কেউ না তুলে।’

উৎস সায় জানালো, ‘ঠিক বলেছো ভাই।’

‘হুম।’

‘আরকিছু বলবে?’

‘না। বাই দ্যা ওয়ে, তুই আজ যাসনি অফিসে?’

‘অফিসে যেতে ভাল্লাগেনা আমার।’

‘কেন?’

‘জানি না। আমি এভাবেই ঠিক আছি।’

‘তোর বন্ধুবান্ধবদের সবার চাকরি হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ, রেনন বাদে সবারই হয়েছে। ওরটাও হয়ে যাবে মনে হচ্ছে, সবই ঠিকঠাক। জাস্ট কিছু টাকা ঘুষ দিতে হবে।’ বিরক্ত গলায় কথাটা বলল উৎস।

আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকালো। তারপর বলল, ‘ঘুষ? এত পড়াশোনা করে ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে হবে?’

উৎস বাঁকা হেসে বলল, ‘বালের ঘুষ দিবে। রেননরে যে ব্যাটা ঘুষের জন্য ওরে চাপ দিতেছে ওর ব্যবস্থা করে ফেলছি। হারামিটারে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে বুঝাই দিব। ঘুষ চাওয়াটা যে কতবড় অন্যায় হাড়ে হাড়ে টের পাবে সে।’

আদ্রিশ প্রখর দৃষ্টিতে তাকায়, ‘তো? কী করবি?’

‘আমি কী করব? রেনন নিজেই করবে।’

ঠোঁট বাঁকালো আদ্রিশ, ‘ওহ আচ্ছা। বেশ ইন্টিলিজেন্ট তো তোরা!’

উৎস হেসে বলল, ‘এজন্যই তো আমাদের গ্রুপের নাম ইন্টিলিজেন্ট বয়েস গ্রুপ।’

অদ্ভুত নাম শুনে আদ্রিশ হালকা হাসলো। উৎসের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা হওয়ার পর সে ওঠে গেল। তখন বিকেল মরে এসেছে। গোধূলির লালচে আভা ফুটে আছে আকাশে। কোলের ওপর থেকে ল্যাপটপটা একপাশে নামিয়ে রেখে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো আদ্রিশ। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল সেরে বেরিয়ে এলো সে। বিছানার ওপর ভোঁ ভোঁ করে ভাইব্রেট হচ্ছে ওর ফোন। কলটা রিসিভ করার আগেই কেটে গেল। খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়, তাই কলব্যাক করল না সে। চেঞ্জ করে ড্রইংরুমে নেমে এলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে লক্ষ্য করল, মাঝারি আকারে ড্রইংরুমের সোফায় আড্ডা বসিয়েছে নেহা-ফিহা-রোজা। উৎসও আছে ওদের সাথে। আর আছে তাঁদের ফুপাতো বোন ইশা। আদ্রিশ সোজা হয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুটিল চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল ওদের। সবাই হাসি-ঠাট্টায় মশগুল থাকলেও রোজা নামের মেয়েটি চুপচাপ একপাশে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। পরণের লাল রঙের সালোয়ার-কামিজটি বেশ মানিয়েছে ওকে। অর্ধভেজা চুলগুলো চুপসে লেগে আছে গালে, গলায়। বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল রোজাকে। আদ্রিশ থমকালো। মেয়েটিকে নিয়ে যেন একটু বেশিই ভেবে ফেলছে সে। অজানা কারণে, অদ্ভুতভাবে কথায় কথায় রিয়েক্ট করে ফেলছে। আজ সারাটাদিন ওর মস্তিষ্কের একটা অংশে মেয়েটির মুখের প্রতিচ্ছবিটিই জায়গা করে নিয়েছিল। যদিও কাউকে বুঝতে দেয়নি ব্যাপারটা। আগে কখনো এরকম হয়নি তো ওর, এবার কী হলো? বিরক্ত হয়ে গেল আদ্রিশ। মনকে বলল, মেয়েটাকে নিয়ে আর ভাববে না সে। অতঃপর ভাবনাচিন্তার গতিরোধ করে আস্তে করে নিচে নেমে এলো। নতুন কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে রোজা আড়চোখে তাকালো। আবারও এই খ্যাটখ্যাটে লোকটাকে সামনে দেখে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা স্রোত বয়ে গেল। চুপটি করে বসে রইল একদম। আদ্রিশকে দেখতে পেয়ে বাকিরা সবাই খুশিই হলো। ইশা উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাইয়া কেমন আছ? তুমি এই সময়ে আজ বাসায়? আমিতো জানতামই না। এই তোমরা কেউ বলোনি কেন?’

আদ্রিশ জবাব দিল, ‘ভালো আছি। ওদেরকে আমিই ডিস্টার্ব করতে মানা করেছিলাম। তুমি কখন এলে?’

‘এইতো একটু আগে। এসেই সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।’

‘ওহ।’

ইশা এবার আবদার জানালো, ‘চলো না একটা গেম খেলি।’

‘নাহ।’

‘প্লিজ ভাইয়া, এখানে আমরা ছয়জন আছি, প্লিজ চলো না!’

গেইম খেলার কথা শুনে চুপসে গেল রোজা। না করতে সে পারবে না এখন। গুণে দেখল আদ্রিশসহ এখানে ওরা ছয়জন। ঢোক গিললো রোজা। এই লোকটা ওদের সাথে খেলবে নাকি? না খেললেই ভালো। মুখ ভার করে আদ্রিশের কাছ থেকে ‘না’ উত্তরটি শোনার অপেক্ষায় আছে ও। আদ্রিশ রোজাকে দেখল। মেয়েটি কী ওকে ভয় পায় নাকি? মুখখানা যেভাবে করে আছে মনে তো তাই-ই হয়। সে বাঁক হাসলো। কখনো এসব আবদার রাখেনা সে। কিন্তু আজ রোজাকে একটু বিব্রত করার উদ্দেশ্যেই যেন আদ্রিশ ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর প্রদান করল। সবাই হৈ হৈ করে ওঠল। এত সহজ তোষামোদে যে কাজ হয়ে গিয়েছে ভেবেই পুলকিত হলো ইশা। নেহা-ফিহা-উৎস খাতা-কলম নিয়ে ছক কাটতে ব্যস্ত হয়ে গেল খেলার উদ্দেশ্যে। আদ্রিশ গা ছাড়াভাবে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। মেয়েটি আজ সারাদিন মাথার ভেতর ঘূর্ণিঝড় বইয়েছে। এবার একটু নিস্তার দরকার, মেয়েটিকেও জ্বালাবে সে! রোজার কাঁচুমাচু মুখখানি দেখে ওর ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। এবার কী করবে মেয়ে?
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

সন্ধ্যে নেমে গেছে অনেক আগেই। খাতায় ছক কেটে খেলাটা বেশ জমে ওঠেছে। যার যার নামের পাশে তাঁদের পয়েন্ট বসানো হচ্ছে। সর্বশেষে যোগ করে দেখা হবে মোট পয়েন্ট। তার ওপর নির্ধারিত হবে বিজয়ী। সবাই খেলাটা বুঝলেও রোজা কিছুতেই এই অদ্ভুত খেলার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। বাড়িতে আগে কত চোর-পুলিশ খেলেছে, কই এমন তো হয় নি। যদিও এই খেলার সাথে ওটার কোনো মিল নেই। তবে এখানে রাজা-প্রজার একটা ব্যাপার আছে। উৎস টোকেন চাল দিচ্ছে। সবার সামনে রোজাও গোমড়া মুখে বারবার টোকেন ওঠাতে লাগলো। রোজা ছাড়া ওদের বাকি সবারই, একবার না একবার রাজা-রানী-মন্ত্রী-সেনাপতি-উজির ওঠছে। সবচেয়ে কম পয়েন্ট প্রজাতে। রোজার বারবার এটাই উঠছে। ফলে ওর দখলে সবার চেয়ে কম পয়েন্ট। মনে মনে ভয়ানক রাগ হচ্ছে আদ্রিশের ওপর। কারণ সবার আগেই সে টোকেন দখল করে নেয়, আর রোজা সবার পরে। এই নিয়ে নয়বার আদ্রিশ রাজা হলো। আর একবার ওঠলেই সে উইনার। খেলার নিয়মানুযায়ী যে হারবে তাকে শাস্তি পেতে হবে উইনারের ইচ্ছানুযায়ী। সেক্ষেত্রে রোজাকেই পানিশমেন্ট পেতে হবে। আর এটা ও কিছুতেই চায় না।

লাস্টবার চাল দিলো ইশা। খপ করে আদ্রিশ একটা টোকেন তুলে নিল, পানিশমেন্ট থেকে বাঁচার জন্য রোজাও তড়িঘড়ি করে একটা কাগজ তুললো। কিন্তু ফলাফল ‘শূন্য।’ বরাবরের মতো আদ্রিশ রাজা আর সে প্রজা হলো। সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট নিয়ে এগিয়ে গেল আদ্রিশ, হেরে গেল রোজা। সবাই যখন হইহই করে খেলা উপভোগ করছিল রাগে-ক্ষোভে রোজার গা জ্বলে যাচ্ছিল। উল্লাসে মেতে ওঠা সবাইকে ওর শত্রু বলে মনে হচ্ছিলো। রোজা চোখ নামিয়ে চুপ করে বসে রইল। আদ্রিশ সবাইকে চুপ থাকতে বলে রোজার উদ্দেশ্যে বলে ওঠল, ‘খেলায় তুমি হেরেছ, আমি জিতেছি। সো এখন আমি যা পানিশমেন্ট দেব তা-ই মানতে হবে তোমাকে।’

অনেকক্ষণ মৌন থাকার পর রোজা মাথা তুললো। নিষ্প্রভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ক কী পানিশমেন্ট?’

আদ্রিশ চিন্তাভাবনা করলো কী শাস্তি দেওয়া যায়। তেমনকিছু না পেয়ে বলল, ‘আমার খুব পছন্দের একটি খাবার রান্না করে খাওয়াতে হবে তোমাকে।’

‘কী রান্না?’

‘কাচ্চি বিরিয়ানি।’

রোজা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি বিরিয়ানি রান্না করতে জানি না।’

‘সিরিয়াসলি?’

‘জি।’

‘খেতে পারো?’

রোজা অপমানিত বোধ করলো আবারও। ইশা রোজার অবস্থা দেখে হাসছে। রোজার দিকে একপলক তাকিয়ে আদ্রিশ তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘এই মেয়ে, আমার দিকে তাকাও। চোখ নামিয়ে বসে আছ কেন?’

আড়ষ্ট হয়ে রোজা বলল, ‘কই না তো!’

ইশা এবার বলে উঠলো, ‘এখানে বসে থাকা সবাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বুঝেছ? তুমি কী ভাইয়াকে ভয় পাও নাকি?’

রোজা চুপ থাকলো। প্রতিউত্তর দেওয়ার আগেই ইশা আবার বলল, ‘তুমি এত ভীতু কেন? ভাইয়াকে এত ভয় পাওয়ার তো কিছু হয়নি। আসার পর থেকে তোমাকে লক্ষ্য করছি, তুমি চুপটি করে বসে আছো!’

ফিহা গলার স্বরটা নামিয়ে বলল, ‘আমাদের রোজা এমনই রে। ভীতুর ডিম একটা।’

রোজা দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো ফিহার দিকে। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে গলার স্বর নরম করে ফিহাকে বলল, ‘আমি ভীতু না।’

নেহা-ফিহা-উৎস ওর এক্সপ্রেশন দেখে হেসে ফেলল। ইশা কন্ঠে নম্রতা এনে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি বলতে চাইছো তুমি সাহসী? এনি প্রুফ?’

ইশার মজার ছলে বলা কথাটা সবাই ধরতে পারলেও রোজা সিরিয়াসলি নিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘নো।’

উৎস ছাড়া বাকি সবাই আরো একদফা হেসে ফেলল। আদ্রিশ বিরক্ত হয়ে ধমক দিল ওদের। মেয়েদের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি ব্যাপারটা ওর ভালো লাগে না। হাসাহাসির ব্যাপারটা শেষ হতেই আদ্রিশ শাস্তি হিসেবে রোজাকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্যই বললো। ওদিকে রোজা মুখ গুঁজে আছে। পারবে না বলে রাজি হচ্ছে না, আবার মুখ ফুটে কিছু বলছেও না দেখে ইশা বিরক্তই হলো। একপর্যায়ে বলল, ‘থাক ভাইয়া, ওকে অন্যকিছু দাও। শেষে দেখা যাবে হাত-পা পুড়িয়ে কয়লা হয়ে বসে আছে। হাজার হোক, বাড়ির গেস্ট বলে কথা।’

ইশার কথা যুক্তিসম্মতই মনে হলো সবার। বিচারবিবেচনা করে অবশেষে মত পরিবর্তন হলো আদ্রিশের। হাত-পা পুড়িয়ে ফেলার কথাটা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন চমকে ওঠেছে। কারণটাও অজানা। হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটা ওকে অকারণেই ভয় পায়। তখনি ওর মাথায় কুটিল বুদ্ধি এলো। এটা নিয়েই কিছু একটা শাস্তি দিলে মন্দ হবেনা। আদ্রিশ ধীর কন্ঠে বলল, ‘সেকেন্ড এন্ড লাস্ট, রাত বারোটায় একা ছাদে যেতে হবে। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে তুমি সাহসী। ওকে? আর এটা যদি না পারো, তাহলে রান্নাটাই করতে হবে। কোনোটাই না করলে এর থেকে ভয়ানক শাস্তি পেতে হবে। আফটার অল আমি বলেছি, কোনো প্রকার কথার নড়চড় হলে তোমায় দেখে নেব…’

বিরিয়ানি রান্নার চেয়ে নিজেকে সাহসী প্রমাণ করাটাই বেশি সহজ বলে বোধ হলো রোজার। সেজন্য তাড়াতাড়ি করে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘জি, রাজি আমি রাজি।’

আদ্রিশ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বলে, ‘ভেরি গুড।’

এরপর ওদের আড্ডা ভেঙ্গে গেল। যে যার মতো ঘরে চলে গেল। হাতমুখ ধুয়ে সন্ধ্যের নাস্তা করার জন্য মিনিট বিশেক পর আবারও জমায়েত হলো টিভির আসরে। উৎস, রোজা, নেহা-ফিহা, ইশা ওদের মনোযোগ টেলিভিশনে। তখন অফিস থেকে ফিরলেন ইনায়াত সাহেব, ইমতিয়াজ সাহেব। কাপড়চোপড় পালটে ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে এসে জড়ো হলেন দুই ভাই। ওদেরকে বসার জায়গা করে দিল উৎস। নিজে ওঠে গিয়ে কার্পেটে পা মুড়িয়ে বসে পড়ল। তারপর ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘বড়চাচী, আব্বুরা এসেছে। নাস্তা দিয়ে যাও।’

ইমতিয়াজ সাহেব বললেন, ‘ভাবীকে ডাকছিস কেন? তুই গিয়ে নিয়ে আয়।’

‘আমি?’

‘কেন? কী সমস্যা?’

উৎস অস্ফুটস্বরে বলল, ‘যাচ্ছি।’

বাবার ধমক শুনে উৎস ওঠে যেতে চাইলো। কিন্তু তার আগেই মিতালি ট্রে’ নিয়ে ঢুকলো। পেছনে আরেকটা ট্রে’তে করে দু-প্রকারের বিস্কিট, মিষ্টি, আর পাস্তা সাজিয়ে নিয়ে এলেন নিশিতা। সবার হাতে হাতে প্লেট তুলে দিলেন তিনি। সবাইকে দেওয়া শেষ করে মিতালি রোজার কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নাকি মিষ্টি পছন্দ করো না? নিশিতার কাছ থেকে জানলাম তুমি ভীষণ ঝাল পছন্দ করো?’

‘জি।’

‘আমিও খুব ঝাল পছন্দ করি। এ বাড়ির কেউ-ই তেমন ঝাল খায় না। ওদের জন্য তরকারিতেও ঝাল দিতে পারি না। তাই নিজের হাতে তোমার জন্য একটু ঝাল করে হালিম রান্না করেছি আমি। খাবে তো?’

রোজা মিতালির দিকে তাকালো। কী সুন্দর মিষ্টি করে কথা বলছে ওর সঙ্গে। আর এই মহিলাটির ছেলেই কি-না ওই আদ্রিশ! কত তফাৎ মা-ছেলের মধ্যে। নিশতা যতটুকু খেয়াল রাখছে রোজার প্রতি, তারচেয়ে কোনো অংশেই কম খোঁজ নিচ্ছেন না তিনি। শ্রদ্ধায় ভরে ওঠলো রোজার মন। হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো মিতালির কথায়। কেন যেন না কথাটি বলতে পারেনি সে। মন্থর কন্ঠে সে বলল, ‘খাবো।’

মিতালি হেসে বলল, ‘খুব ভালো মেয়ে তুমি রোজা। আমাকে তুমি চাচী ডেকো, নেহাদের মতো।’

রোজা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা চাচী।’

মিতালি রান্নাঘরে গিয়ে হালিমের বাটি নিয়ে এলো। ঝাল হালিমের সুগন্ধ হাওয়ায় ভাসছে। রোজা খুব তৃপ্তি নিয়েই সেটা খেতে লাগল। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলো ইশা। মিতালি আর রোজার কথাটুকুও সে শুনেছে৷ পুরো ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করে পাশে বসা ফিহাকে নিচুস্বরে বলল, ‘তোমার বোন আর বড় মামানীর মাঝে কী কেমিস্ট্রি দেখেছো? ঘটনা কী?’

ফিহা গালে হাত রেখে সন্দেহী কন্ঠে বলল, ‘আমিও তাই ভাবছি!’

‘তোমার বোনটা কিন্তু অনেক মিষ্টি।’

ধোঁয়া ওঠা কফির মগে ছোট চুমুক দিয়ে ইশার পানে তাকালো ফিহা। উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘মানে কী বুঝাতে চাইছিস?’

ইশা রহস্যময়ী হাসি হেসে বলে, ‘তুমি যা ভাবছো তাই!’

‘আমি কী ভাবছি?’

‘ভাইয়া রোজার প্রতি একটু ডেস্পারেট, মনে হয় না তোমার?’

‘উৎস ভাইয়া?’

ইশা চোখ বড় বড় করে তাকালো। দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে অবসন্ন কন্ঠে বলল, ‘আদ্রিশ ভাইয়া।’

ফিহা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো, ‘বলিস কি! তুই এতকিছু কেমনে জানিস? ইশা…’

ইশা চোখ টিপে হাসলো, ‘পর্যবেক্ষণ, লাস্ট কয়েকটা ঘন্টা গভীর পর্যবেক্ষণের সহিত এটাই বুঝতে পারলাম আদ্রিশ ভাইয়া রোজার প্রতি একটু ডেস্পারেট।’

‘কেমনে কি বইন? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। দু’দিনও হয়নি ভাইয়া আর রোজার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। আমরাই কিছু ধরতে পারলাম না আর তুই কিছু সময়ের মধ্যেই বুঝে গেলি এসব?’

‘হু গেলাম।’

ফিহা এদিকওদিক দেখে নিয়ে বলল, ‘ক্লিয়ার করে বলতো!’

ইশা হাতের মগটা রেখে দিল। তারপর গলা নামিয়ে বলতে লাগল, ‘তুমিই বলো, ভাইয়া কোনোদিন খেলতে রাজি হয়েছে আমাদের সাথে? আজ ওকে জোর করতে হলো না, একবার বলাতেই এমনভাবে রাজি হয়ে গেল যেন রোজা খেলছে বলেই সে খেলতে রাজি হয়ে গেল। খেলার সময়ও আমি লক্ষ্য করেছি ভাইয়ার চাহনি, অন্যরকম মুগ্ধতা দেখেছি রোজার জন্য! নয়তো ভাবোই না, অন্য কারোর রান্না সে কোনোদিন খেতে চায়? ছোট মামানির হাতের রান্নাই তো খায়না, সেখানে রোজার? পরে কী সহজ ডেয়ার দিয়েছে দেখলে তো?’

ফিহা চিন্তিতমুখে বলল, ‘এর মানে কি এটাই যে, ভাইয়া রোজার জন্য কিছু অনুভব করে?’

‘এক্সাক্টলি এটাই বুঝাতে চেয়েছি তোমায়।’

‘বুঝেতে পেরেছি!’

[
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here