অনুভবে তুই পর্ব -০৭+৮

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

সেদিন রাত নয়টার দিকে একটি ফোন আসে আদ্রিশের। খুব জরুরি একটা কাজে ওকে এখনি কোথাও যেতে হবে। আদ্রিশ এটা মোটেও আশা করে নি। বিরক্ত হয়ে সেই কাজের উদ্দেশ্যে বাইরে বেরিয়ে যায় সে। সবার মন খানিকটা খারাপ হলেও রোজা মনে মনে স্বস্তি পায় এটা ভেবে যে, রাত বারোটায় একলা ছাদে ওঠে নিজেকে সাহসী প্রমাণ করতে হবে না। অন্তত এই লোকটার কাছে। মনে মনে আদ্রিশের গোষ্ঠী উদ্ধার করা শেষ করে ঘরে এসে খোশমেজাজে বই নিয়ে বসলো রোজা। ড্রইংরুম থেকে আসার সময় নিশিতাকে বলে এককাপ চা-ও বানিয়ে নিয়ে এসেছে। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গভীরভাবে মন দিলো বইয়ের পাতায়। নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারে ঢাকা প্রকৃতি। ফুরফুরে বাতাস জানালা দিয়ে বইছিল, পর্দাগুলো ওড়ছিল নৌকার পালের মতো। তখনি দরজায় খট করে শব্দ হলো। নেহা-ফিহা দু’বোন একসাথেই ঘরে ঢুকলো। ইশা নিচতলায় মিতালি-নিশিতার সাথে বসে কথা বলছে, তাই সে আসেনি। নেহা ঘরে ঢুকেই সোজা চলে গেল ওয়াশরুমে। হাতমুখ ধুয়ে রুমে এসে তোয়ালেটা এমনভাবে ছুড়ে মারলো যে, সেটা রোজার চায়ের কাপের ওপর পড়ল। কিছুটা চা ছলকে পড়ল রোজার ডানহাতে। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে কী ঘটে গেল ঠাহর করতে পারল না রোজা৷ হাতে জ্বলুনি অনুভূত হতেই মৃদু আওয়াজ করল। নেহা ততক্ষণে দৌড়ে এলো ওর কাছে। ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘ইশ, কতখানি পড়েছে। আমি খেয়াল করি নি। স্যরি রে রোজা। ওফফ কি যে করি না আমি!’

রোজা চোখ বন্ধ করে জবাবে বলল, ‘আরে থাক না আপু।’

‘কী বলিস তুই? খুব বেশি জ্বলছে? জায়গাটা লাল হয়ে গেছে।’

‘না বেশি না।’

রোজার কথায় বিরক্ত হলো নেহা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওর হাত লাল হয়ে আছে, আর মেয়েটা কি সুন্দর করে বলছে কিছু হয় নি। নেহা ওকে টেনে ধরে রাগী স্বরে বলল, ‘ওঠ এক্ষুনি। পোড়া হাত নিয়ে আবার বসে আছিস? আয় পানি দিয়ে দিই।’

ফিহা বলল, ‘আমি বরফ নিয়ে আসছি। টুথপেস্ট আনবো?’

‘সেটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়? যা নিয়ে আয়।’

‘যাচ্ছি।’

ফিহা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নেহা রোজাকে ধরে নিয়ে নিয়ে গেল করিডোরের বেসিনের সামনে। ট্যাপটা ছেড়ে দিয়ে রোজার হাতটা পানিতে ভেজালো। পানি লাগতেই জ্বলুনিটা যেন আরও বেড়ে গেল। রোজা চোখমুখ খিঁচে হাতটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘জ্বলছে খুব। আর দেব না পানি।’

নেহা চোখ গরম করে তাকালো, ‘বেশি বকিস তুই। চুপচাপ পানির নিচে হাতটা দিয়ে রাখবি। নয়তো এক থাপ্পড়ে গাল ফাটিয়ে দেব।’

‘আপুওও..’

‘চুপ একদম।’

নেহা রোজাকে আর একটাও কথা বলতে দিল না। অনেকক্ষণ ধরে বরফপানিতে হাত ডুবিয়ে রাখার পর জ্বলুনি ভাবটা কমলো৷ ফিহা একটা মলম লাগিয়ে দিলো রোজার হাতের পোড়া অংশটুকুতে। ঘন্টা কয়েকের মাঝেই জ্বলুনি কমে আগের মতোই হয়ে গেল। এর মধ্যে এই খবর শুনে মিতালি, নিশিতা, ইশা এসে রোজাকে দেখে গেল। আর যাবার সময় নেহাকে সঙ্গে করে কিছু একটা দেখাতে নিয়ে গেল ইশা। সবাই চলে যাওয়ার পর ঘরে রইল ফিহা, রোজা। ফিহা ফোন স্ক্রল করায় ব্যস্ত। রোজা বইয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে আলসে ভঙ্গিতে বসে রইল। এত শীতল আবহাওয়ার মাঝেও হঠাৎ করে ওর খুব গরম লাগছিল। বিছানা থেকে নামতেই ফিহা চোখ পাকিয়ে তাকালো। বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘হাতমুখ ধুয়ে আসি। চোখমুখ কেমন ম্যাজম্যাজ করছে।’

‘হাতের ব্যথাটা কমেছে?’

‘হুম। এখন ঠিক আছে।’

‘সাবধানে যা৷ হাতে পানি লাগাস না।’

‘আচ্ছা।’

রোজা ঠিকই চোখেমুখে পানি ছিঁটানোর উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে গেল। কিন্তু কখন যে আনমনে শাওয়ারের প্যাঁচটা খুলে দিল বুঝতেই পারে নি। যার ফলে বরফ শীতল ঠান্ডা পানি এসে পড়লো এসে ভিজিয়ে দিলো ওকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল জামাকাপড়। রাগে, বিরক্তিতে মাথা গরম হয়ে গেল। নিজেকে নিজেই কথা শোনালো, ‘কেন যে এতোটা বেখায়লি, সবাই ঠিকই বলে। আমি কোনো কাজের নই, অকর্মার ঢেঁকি। ভীতুর ডিম!’

জামাকাপড় ভিজে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে ফিহাকে ডাকল রোজা। ওর গলা শুনে ফিহা উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে?’

রোজা নরম সুরে বলল, ‘কখন জানি ভিজে গেছি আপু। ব্যাগে আমার জামাকাপড় গুলো আছে। সেগুলো কষ্ট করে একটু দিয়ে যাও।’

ফিহা অবাক গলায় বলল, ‘কখন যেন ভিজে গেছি মানে? ওয়াশরুমে কী বৃষ্টি হয়েছে না-কি তুই স্বপ্ন দেখছিস? নিজের গায়ে পানি পড়লো আর তুই বুঝতেই পারলি না?’

‘না আপু। সম্ভবত শাওয়ারের প্যাঁচটা ঘুরে গিয়েছিল।’

‘আর তুই বুঝতেই পারিস নি?’

‘নাহ।’

‘রোজা? তুই আসলে কী দিয়ে তৈরি? এত রাতে গোসল করলি যে, ঠান্ডা লাগবে না? পাগল তুই?’

‘লাগবে না৷ কাপড়গুলো দিয়ে যাও না আপু।’

ফিহা রোজার ব্যাগ থেকে ওর সালোয়ারকামিজ বের করে ওয়াশরুমের দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। রোজাকে বলল, ‘তোর জামাকাপড় তুই নিজেই নে। আমি পারবো না।’

রোজা ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘প্লিজ আপু। আমার ঠান্ডা লাগছে।’

ফিহা মিথ্যে বলল, ‘আমি খাচ্ছি। হাত খালি না, এঁটো লেগে আছে।’

‘ধুয়ে দাও না।’

ফিহা কিছু একটা ভেবে বলল, ‘একটুও শান্তিতে বসতে দিবি না তুই৷ দিচ্ছি, তবে একটা কন্ডিশন আছে।’

রোজা ধৈর্যহীন গলায় বলল, ‘আবার কীসের কন্ডিশন?’

ফিহা ঠোঁট টিপে হেসে ফেলল৷ পরক্ষণেই চোখমুখ কঠিন করে শক্ত গলায় বলল, ‘তোকে আমার ভাইয়ের বউ হতে হবে। আমি তোকে ‘ভাবি, ভাবি’ বলে ডাকবো। রাজি তুই? হবি তো?’

রোজা পূর্ণকথাটা ভালো করে শুনলো না৷ অলস কন্ঠে সে বলল, ‘হ্যাঁ হবো। রাজি আমি। এখন প্লিজ আমার জামাকাপড় দাও। নয়তো ঠান্ডায় জমে মরে যাব।’

ফিহা আনমনে বলল, ‘তুই আমার ভাইয়ের একমাত্র বউ। ঠান্ডায় জমে মরে গেলে ভাই তার চক্ষু দিয়েই আমার গিলে ফেলবে।’

তারপর জোরালো গলায় বলল, ‘নে কাপড় এনেছি।’

রোজা দরজা খানিকটা ফাঁক করে কাপড়গুলো নিয়ে নিলো। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ওদিকে রোজার বোকামো, অবুঝ কথাবার্তায় বেশ ভালোই মজা পেয়েছে ফিহা। নিঃশব্দে হাসতে হাসতে একপর্যায়ে সেটা আর আটকাতে পারল না। ঘর কাঁপিয়ে হাসার একটা সময়ে সে আবিষ্কার করলো আদ্রিশ চোখ পাকিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর পেছনেই দেয়ালে ঠেস দিয়ে নেহা আর ইশা ওর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে তাঁদের বক্র হাসি। ফিহা স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওরা আবার ওর কথাটথা শুনে ফেলেনি তো? অপ্রস্তুত হেসে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আরে ভাইয়া তুমি? কখন এলে? তুমি না কোথায় গিয়েছিলে?’

আদ্রিশ ওর কথা না শোনার ভান করে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এরকম করছিলি কেন? মনে খুব ফুর্তি লেগেছে? তোর না সামনে এক্সাম?’

ফিহা চোখ রাঙিয়ে তাকালো নেহা-ইশার দিকে। দু’জন মিটিমিটি হাসছে। আদ্রিশের কথা শুনে ফিহা চট করে বলে ফেলল, ‘এক্সামের প্রিপারেশন অলরেডি ডান।’

আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকালো, ‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

আদ্রিশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘গ্রেট। বাই দ্যা ওয়ে, তোর সেই ভীতুর ডিম বোনটি কই রে? সে নাকি হাত-পা পুড়িয়ে বসে আছে? এটা বিবেচনা করেই তো ওকে রান্নার ডেয়ার থেকে নিষ্কৃতি দিলাম। যেই লাউ সেই কদুই? এতটা কেয়ারলেস কেন এই মেয়ে? আমাদের বাড়ির নামে নিন্দেমন্দ করার জন্য ইচ্ছা করেই ও এমন করে। আমি ওকে… ‘

আদ্রিশ কথাটুকু শেষ করতে পারলো না। তার আগেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। একহাতে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো রোজা। নেহা-ফিহা-ইশা, আদ্রিশ সবাই একসাথে ওর দিকে তাকালো। ইশা একগাল হেসে চোখ টিপে ফিহাকে কিছু একটা বুঝালো। নেহা সেটা দেখলেও তেমন মাথা ঘামালো না।
অপরদিকে, সাদামাটা জামায় আবৃত রোজাকে দেখে আবিষ্ট হয়ে চেয়ে রইল আদ্রিশ। ভেজা চুল, স্নিগ্ধ মুখের গড়নে মোহায়িত হলো সে। রোজা ওকে দেখতে পেয়েই থমকে গেল। এই লোকটা এখানে কীভাবে আসলো? ওর না ইম্পোর্টেন্ট কাজ আছে? বাড়িতেই ফিরলো কখন? এখন কী ওকে সাহসীকতার ডেয়ার পূরণ করতে বলবে? রোজা বোকার মতো ওর বোনেদের দিকে দেখল। পরক্ষণেই নিজ হাতে টান অনুভব করলো। শক্তপোক্ত একটি হাত ওর কবজি এমনভাবে ধরেছে যে ব্যথায় একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো গালে। আদ্রিশ ওর জ্বলে যাওয়া হাতটার দিকে রক্তচক্ষু মেলে দেখছে। তারপর কঠিন গলায় হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘এটা কী করে হলো?’

রোজা নম্রভাবেই উত্তর দিল, ‘চা- পড়ে এমন হয়েছে।’

‘তুমি কী আমাদের নাম ডুবাতে এসেছ?’

‘না।’

‘তাহলে দেখেশুনে, সংযত হয়ে চলাফেরা করতে পারো না?’

রোজা বলল, ‘এটা জাস্ট এক্সিডেন্ট।’

কথাটি আদ্রিশের কর্ণগোচর হতেই রাগে আরও কঠোরভাবে রোজার হাতটি চেপে ধরলো সে। ব্যথাটা আরও গাঢ় হতেই রোজার ধৈর্য সীমা ছাড়িয়ে গেল। শান্ত অথচ তীব্র গলায় সে বলল, ‘হাতটা ছাড়ুন, ব্যথা পাচ্ছি।’

আদ্রিশ গমগমে স্বরে বলল, ‘ছাড়বো না।’
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

পুড়ে যাওয়া হাতটা যতটা না জ্বলছে, তারচেয়ে বেশি ব্যথা লাগছে আদ্রিশের হাতের মুঠোয় থাকা রোজার শিথিল হাতটি। দু’বার বলার পরেও যখন আদ্রিশ ওর হাত ছাড়েনি, ব্যর্থ হয়ে রোজা আর দিরুক্তিও করে নি। লোকটা কেন এমন? আর ওর সাথেই বা কেন এত বাড়াবাড়ি করছে বুঝে ওঠতে পারলো না কোনোমতেই। শক্ত করে ধরে রাখার একপর্যায়ে রোজার হাতটিতে আদ্রিশের পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে রোজা শুধু দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলল। ঠোঁট কামড়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একবিন্দু পরিমাণও নড়লো না, যেন সে কাঠের পুতুল। আরো কিছু মিনিট গড়াতেই নেহা-ফিহা-ইশা তিনবোন একে-অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। হচ্ছেটা কী সেটা নেহা বুঝতে না পারলেও ফিহা আর ইশা আন্দাজ কর‍তে পারলো। রোজার রক্তিম হাতটার দিকে তাকিয়ে এবার ব্যগ্র কন্ঠে ইশা বলে ওঠল, ‘ভাইয়া ওকে ছেড়ে দাও। হাতটা কতটুকু লাল হয়েছে খেয়াল হয়েছে তোমার? রক্ত জমে যাবে তো!’

ইশার কথা কর্নকুহরে ঢুকতেই নড়েচড়ে দাঁড়ালো আদ্রিশ। মুখ তুলে চাইলো সে। এতক্ষণ যেন হুঁশই ছিল না ওর। ইশার কথাটুকুর মর্মোদঘাটন করে সে রোজার হাতটা ঠাস করে ছেড়ে দিল। কন্ঠে রাগ ঢেলে বলল, ‘নেক্সট টাইম আমার সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলার আগে দু-বার ভাববে। সবকিছু সহ্য করতে পারি, বেয়াদবি না। কথাটা ভালোভাবে মাথায় গেঁথে নাও। এরপর যদি দেখেছি বা শুনেছি খামখেয়ালিপনা করে নিজের বারোটা বাজিয়ে বসে আছ, তাহলে সেদিনই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব। মাইন্ড ইট!’

এরপর আর একটা মুহূর্তও দাঁড়ালো না সে। গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ও যেতেই রোজা ধপ করে বসে পড়লো বিছানার এক কোণে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো ভঙ্গিতে পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। টুপটাপ কয়েক ফোঁটা পানি চুল থেকে গড়িয়ে পড়ে বিছানার একাংশ ভিজিয়ে দিল। রোজা আর্তনাদের সুরে এবার বলে ওঠল, ‘আমি আর নিতে পারছি না ওনাকে। এতটা অসহ্য কোনো মানুষ হতে পারে জানা নেই আমার। নেহা আপু প্লিজ, আমি তোমাদের বাড়িতে আর থাকতে চাই না। আব্বুর সাথে যোগাযোগ করে কোনো না কোনো হোস্টেল ওঠে যাব আমি।’

রোজার কান্নারত কন্ঠস্বর শুনে ওরা তিনবোনই চুপ হয়ে গেল। কেউ কোনো বাক্যব্যয় করলো না। কিছুক্ষণ পর ইশা গিয়ে ওর পাশে বসলো। কাঁধে হাত রেখে গলার স্বর নামিয়ে সে বলল, ‘ভাইয়া আসলে ওরকম বিহেভ করতে চায় নি। এসব সামান্য বিষয়ে রাগ করে কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়? তুমি প্লিজ কেঁদো না।’

‘আমি এখানে থাকব না। ওনার টর্চারগুলো মেন্টালি আনস্টেবল করে দিচ্ছে আমাকে। কিছুতেই সেগুলো মাথা থেকে বেরুতে চাইছে না।’

ফিহা রাগান্বিত গলায় বলল, ‘রাগের মাথায় উল্টা পালটা বলছিস তুই। মা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে। আমাদের বাড়িতে কি সবাই তোকে টর্চার করে? আমরা সবাই যে ভালোবাসি তার কোনো মূল্য নেই তোর কাছে? আমরা কি এতটাই পর?’

ফিহার কথায় কান্না বন্ধ হয়ে গেল রোজার। বিমর্ষ কন্ঠে বলে, ‘আমি কী একবারও তা বলেছি আপু?’

ফিহা সচকিত দৃষ্টিজোড়া কুঁচকে বলে ওঠে, ‘বলিস নি। কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়ার সামান্য ক’টা কারণের জন্য তুই যেভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছিস, আমার তো তা-ই মনে হচ্ছে।’

‘মোটেও এরকম কিছু নয় আপু।’

রুক্ষ স্বরে ফিহা জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে কেমন কিছু?’

‘ওনি আমার সাথে অকারণেই এসব করছে। কিন্তু কেন? আমি তো ওনার সাথে ভালো করে কথাও বলি নি, সেখানে বেয়াদবি কখন আর কীভাবে করলাম?’

ফিহা তিক্ত কন্ঠে বলে ওঠে, ‘তুই কি এটা নিয়েই পড়ে থাকবি? যাহ, তোকে আরকিছু বলবো না। যা ইচ্ছে তাই কর।’

এরপর আর এ বিষয়ে কথা বাড়লো না। অযথা একটা বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা কারোরই পছন্দ হচ্ছিলো না। কিছুক্ষণ মৌন অবস্থায় কাটিয়ে ইশা নিচতলায় চলে গেল। রাত বাড়ায় ফিহাও শুয়ে পড়লো৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেহা ঘরটির আলো নিভিয়ে দিয়ে দিল। রোজার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে মন্থর কন্ঠে বলল, ‘রাত বেড়েছে, শুয়ে পড়।’

রোজা নিষ্প্রভ চাহনিতে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘ঘুম আসছে না আপু। তুমি শুয়ে পড়ো।’

নেহা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘মন খারাপ করিস না। ফিহা আদ্রিশ ভাইয়ার মতোই খ্যাটখ্যাটে।’

‘মন খারাপ করি নি।’

নেহার আদেশসূচক কন্ঠে বলে উঠলো, ‘তবে শুয়ে পড়।’

‘ঘুমিয়ে পড়ো আপু!’

নেহা অকস্মাৎ ওর হাতজোড়া আঁকড়ে ধরে বলে, ‘প্লিজ আমাদের ওপর রাগ করে থাকিস না।’

রোজা ব্যহত দৃষ্টিতে তাকালো বোনের পানে। এত ভালো কেন নেহা? ফিহা-উৎস-আদ্রিশ যেখানে গমগমে, তীক্ষ্ণ স্বরে, ধমকে সবার সাথে কথা বলে সেখানে তাঁদের বোন হয়েও নেহা কতটা শান্তশিষ্ট, বুঝদার, নম্র! অথচ ওরই কি-না একটা ক্লাসলেস লোকের সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছিলো। শাখাওয়াত নামক লোকটির সাথে তার এই বোনটির বিয়ে হলে সে কী সুখে থাকতো? অকস্মাৎ এসব ভাবনায় মনটা পুড়তে আরম্ভ করতেই রোজা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘চলো ঘুমাই।’

নেহা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘চল!’

ওরা শুয়ে পড়লো দুজনেই। কিন্তু শুয়ে পড়লেই কি চোখে ঘুম ধরা দেয়? অন্ধকার ঘরটির তীব্র আঁধার বিষাক্ত কাঁটার মতো ফুটছিল রোজার। নিঃশ্বাস যেন বিষ যুক্ত ধোঁয়া। আদ্রিশ নামক লোকটির চেহারা মানসপটে যেন আঁকিবুঁকি বিস্তার শুরু করেছে। রোজা কিছুতেই ওকে সহ্য করতে পারছে না। আর এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কোনো উপায় বা যথাসম্মত কারণও নেই। ওই একটা লোকের জন্য নিজের খালা-বোন-ভাইদের সে কষ্ট দিতে পারবে না। আদ্রিশকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার একটি প্রয়াস নিজের মনে তৈরি করে নিলো সে। ভুলেও আদ্রিশের সামনে যাতে না পড়ে সেজন্য ওকে সচকিত থাকতে হবে। মুক্তি পেতে হবে লোকটির রোষাগ্নি দৃষ্টি থেকে, কর্কশ চিৎকার আর হিংস্র রাগ থেকে।

—————-

হলদেটে নির্মল আকাশ। ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়ে বেড়াচ্ছে সাদা বকের দল। বৃষ্টি শেষে ধুয়েমুছে সজীব হয়ে ওঠেছে সবুজাভ প্রকৃতি। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তীব্র ফুলের সুবাসে ম ম করছে উৎসদের বাড়ির ছাদটি। গোধূলি বিকেলের রক্তিম আকাশে নানা রঙের খেলা মুগ্ধ করছে রোজার চোখজোড়া। ভার্সিটি থেকে এসে লম্বা একটা ঘুম দিয়েছিল ও। দীর্ঘ তিন ঘন্টা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে একটু আগেই ওঠেছে সে। কিন্তু চোখেমুখে এখনো ঘুমের রেশ রয়ে গেছে। ফোলা চোখমুখ, এলোমেলো জট পাকানো চুল, অলসতা জেঁকে বসেছে যেন পুরো শরীরে। একটু শীত শীত ভাব পড়ায় গায়ে পাতলা একটা শাল জড়িয়ে বসে আছে সে। ছাদটা পুরো খালি। রোজা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানব নেই। বাড়িতে অবশ্য মিতালি-নিশিতা ছাড়া আর কেউ নেই, কিন্তু ঠান্ডা আবহাওয়ায় সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে ঘুমের জগতে পাড়ি দিয়েছে দু’জন। মুরুব্বিরা সবাই অফিসে। উৎস তার বন্ধুদের ফ্ল্যাটে। নেহা তাঁর বান্ধবীর বাসায় গেছে নোট আনতে। ফিহা ইশার সাথে ওদের বাসায়, যদিও রোজাকে জোর করেছিল যাওয়ার জন্য তথাপি সে যায়নি আরাম করা ওয়েদার উপভোগ করার জন্য। বলতে গেলে পুরো বাড়িতে এখন রোজা একা। বেখেয়ালে তীব্র গরম চায়ের কাপটিতে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলল। শব্দ করে গোল টেবিলটার ওপর কাপটা রেখে ওড়না দিয়ে চেপে ধরলো ঠোঁটজোড়া। পানির বোতলটার ক্যাপ খুলে পোড়া জায়গাটিতে ছিঁটিয়ে দিলো। হঠাৎই ভরাট একটি কন্ঠ ভেসে এলো ছাদের দরজাটির কাছ থেকে। রোজা সচকিত দৃষ্টিতে পেছনে তাকাতেই আদ্রিশকে চোখে পড়লো ওর। দু-হাতের কনুই ভেঙে বুকের কাছে আড়াআড়ি বদ্ধ করে রোজার দিকেই তাকিয়ে আছে সে। তীব্র স্বরে বলে ওঠে, ‘এখনো খামখেয়ালি পনা স্বভাবটি যায় নি?’

রোজা নিরুত্তর। বুঝতে পারছে না কি বলবে। আদ্রিশের সামনে পড়তে হলো আবারও, ভাবতেই নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠলো সে৷ এই একটি মাস আদ্রিশকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছে সে। যার ফলে কোনো সমস্যাই হয় নি। যদিও দু-একবার সামনাসামনি পড়ে গিয়েছিল কিন্তু আদ্রিশ শব্দব্যয় করার আগেই রোজা সেখান থেকে কেটে পড়তো। কিন্তু এই স্নিগ্ধ গোধূলির এই বিকেলে, জনমানবশূন্য বাড়িটির ছাদে লোকটির সাথে আবার দেখা হয়ে যাবে ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি সে৷ তাহলে হয়তো নিজের ঘরেই দরজা এঁটে বসে থাকতো সে। বের হতো না কোনোমতেই! রোজাকে মৌনতা অবলম্বন করতে দেখে সে আবারও বলে ওঠে, ‘কথা কানে যাচ্ছে না? একটা প্রশ্ন করেছি আমি।’

রোজা থতমত খেয়ে বলল, ‘জি শুনেছি।’

‘তাহলে উত্তর দিচ্ছো না কেন?’

‘না মানে, তেমন কিছুই হয় নি। আপনি কীসের কথা বলছেন?’

আদ্রিশ ভ্রু জোড়া কুঁচকে এনে একটু এগিয়ে এলো রোজার দিকে। ক্রমেই আরো কয়েক পা এগিয়ে আসতেই রোজা হতভম্ব হয়ে দু-পা পিছিয়ে গেল। কি করতে চাইছে লোকটা? আদ্রিশ গোল টেবিলটার ওপর রাখা রোজার চুমুক দেওয়া চায়ের কাপটি হাতে তুলে নিয়ে দেখলো। পরক্ষণেই গরম চায়ের কাপটি’তে চুমুক বসালো সে। রোজা হতচকিত হয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠল, ‘কি করছেন! চা-টা অনেক গরম!’

আদ্রিশ যেন ওর কথা শুনলোই না। ধোঁয়া ওঠা বক্ষ পুড়ানো অত্যধিক গরম চায়ের কাপটির পুরো চা- নিজের গলায় ঢেলে দিলো। উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে ভিজে ওঠলো চোখের মণিজোড়া। তথাপি চা’টা সে ফেলল না। রোজা অদ্ভুত চোখে বেদনা-র্থ নয়নে তাকিয়ে রইল। এত গরম চা কীভাবে খেতে পারলো আদ্রিশ? যেখানে কাপটিতে ধরাই দায়! তাও আবার চিনি ছাড়া ঘন লিকারের এলাচ মিশ্রিত চা। আদ্রিশ যেন তৃপ্তি নিয়ে চা-টা শেষ করলো। অতঃপর আদ্রিশ নিষ্পলক চোখে রোজার দিকে তাকালো। গমগমে স্বরে বলে ওঠল, ‘আমি ঠিক এটার কথা-ই বলছিলাম!’

রোজা মাথা নিচু করে বলল, ‘প্রথমে বুঝতে পারি নি চা-টা এত গরম।’

আদ্রিশ কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল, ‘তুমি নিজের খেয়াল রাখতে জানো না? বেখেয়ালি কেন তুমি?’

রোজা অন্যরকম কন্ঠে বলে ওঠে, ‘আপনি তো তা-ও না। জেনেশুনে গরম চা খাওয়ার কী দরকার ছিল?’

কেন জানেনা আদ্রিশ মনে মনে হেসে ফেলল। অথচ একটু আগেই রাগ ওর মাথায় চড়ছিল। তবুও গলার স্বরে ক্ষিপ্রতা এনে সে বলল, ‘আমি আর তুমি কী এক?’

রোজার স্পষ্ট উত্তর, ‘মানুষ মাত্র-ই এক।’

আদ্রিশ প্রখর দৃষ্টিতে তাকায় রোজার পানে। কিয়ৎক্ষণ সেভাবেই তাকিয়ে থেকে তারপর বলে, ‘পানি নিয়ে আসো আমার জন্য।’

রোজা না করে না। কয়েক পা এগিয়ে পিছু ফিরে বলে, ‘মিষ্টি কিছু নিয়ে আসব? চা-টা চিনি ছাড়া, কিন্ত অনেক গরম ছিল।’

গোধূলিলগ্নের আকাশ বেশ পরিষ্কার। ফুলের সৌরভে কেমন মুগ্ধতা, রোজার চোখেমুখে নিদারুণ স্নিগ্ধতা।
আড়চোখে আদ্রিশ তাকায় কাপটির পানে। পরমুহূর্তেই ওর মুখের রঙ পালটে যায়। দু-পায়ে ভর দিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় ছাদের রেলিঙে। অতঃপর একরোখা ঝাঁঝ মিশ্রিত স্বরে বলে, ‘মনে তো হলো পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্ট মিশ্রিত চা-ই খেলাম। আর কোনো মিষ্টির প্রয়োজন নেই।’

কথাটির মর্মোদ্ধার কর‍তে পারলো না রোজা। অদ্ভুত, ক্ষ্যাপাটে লোকটার ভনিতায় সে পাত্তা দেয় না। সে জানে, নিজের কষ্ট হলেও লোকটি তাকে কিছু জানাবে না৷ তাই নিজের মতো করেই সে যা করার করবে। দ্রুতপদে হেঁটে নিচে নেমে আসে রোজা। গ্লাসে পানি নিয়ে সে রান্নাঘরে ঢুকে। হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে থাকে এমন কিছু খাদ্যদ্রব্য যাতে করে আদ্রিশের কষ্টটা লাঘব হয়!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here