অনুভবে তুই পর্ব -১১+১২

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১

রোজার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারটা আদ্রিশ মানতে পারলো না। সারাটা পথ মুখটা থমথমে করে রাখলো সে। রোজা ওর দিকে একবার চোখ তুলেও তাকালো না, একমনে বাইরের দৃশ্যাবলি অবলোকনে ব্যস্ত। ওর এই অবহেলা দেখে আদ্রিশের মাথায় রাগ চড়লো। অতি সন্তপর্ণে বা-হাতটা দিয়ে চেপে ধরলো রোজার ডান হাতটি। আচমকা চমকে ওঠে চোখদুটো বড় বড় করে তাকালো রোজা। মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে গিয়েও চুপ মেরে সিটের সাথে লেপ্টে রইল। পেছনে দু-জন ঘুমে ঢুলছে, ইশা বসে ফোন স্ক্রল করছে৷ রোজার চক্ষুজোড়া দপ করে জ্বলে ওঠলো। আদ্রিশ পরোয়া করলো না, একমনে সামনে তাকিয়ে দক্ষ হাতে ড্রাইভিং করায় ব্যস্ত সে। রোজা হাত মোচড়াতে থাকলে আরও শক্ত করে ধরে রাখে সে। অগত্যা হাল ছেড়ে দিলো রোজা। চোখমুখ খিঁচে কয়েকটা ভয়ঙ্কর গালি ছুঁড়লো মনে মনে। গলায় কান্নার দলা পাক বেঁধে ঘুরতে লাগলো। দু’ফোটা জল গাল ছুঁয়ে আদ্রিশের হাতের ওপর পড়তেই সে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। রোজা আড়চোখে একবার দেখলো ওকে। লোকটার মতিগতি, হাব-ভাবে বোঝা যাচ্ছে সে কিছুতেই রোজার পিছন নেওয়া ছাড়বে না। এ কোন মুসিবতে পড়লো রোজা? দী-র্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে শক্ত হয়ে বসে রইল রোজা। দু-পাশের জঙ্গলাবৃত গাছপালা ছাড়িয়ে একসময় বাড়ি এসে পৌঁছালো ওরা। গেইটের সামনে গাড়ি এসে থামলে ইশা নেহা-ফিহাকে ডেকে দেয়। ওরা নেমে যায়। রোজা তখনো নামে না। কারণ আদ্রিশ ওর হাত টেনে ধরে রেখেছে। নেহা একবার রোজাকে আসতে বলে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। ইশা-ফিহাও নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে চলে যায়। ওরা সবাই যেতেই রোজা তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘অনেক হয়েছে, আপনি কী এবার আমার হাতটা ছাড়বেন?’

আদ্রিশ অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে বলে, ‘আমার দিকে তাকাও। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখার মানে কী?’

রোজা অন্যদিকে দৃষ্টি রেখেই জবাবে বলল, ‘তাকাবো না।’

আদ্রিশের দৃষ্টি প্রখর হয়, ‘কেন?’

‘আপনার ব্যবহার আমার পছন্দ নয়। এইযে, হুটহাট অভদ্রের মতো আমার হাত ধরেন সেটাও আমার অপছন্দ।’

‘আমাকে-ও তোমার অপছন্দ?’

রোজা উত্তর দেয় না, কথা বাড়াতে চায় না। ওকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আদ্রিশের মেজাজ চটে যায়। আলতো করে একটান দিতেই রোজা ওর দিকে ঝুঁকে আসে। হিজাবটা সরে যায়। হতচকিত রোজা নিজেকে সামলিয়ে ওঠে বসতেই আদ্রিশ ‘ফুঁ’ দিয়ে ওর মুখের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। রোজা ওর বুকে জোরে একটা ধাক্কা মারে, কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা হয় না। দুটো হাত-ই চলে যায় আদ্রিশের মুঠোর ভেতর। রোজা কটমট করে বলল, ‘ছাড়ুন বলছি…’

‘আগে আমার দিকে তাকাও।’

‘কখনোই না।’

আদ্রিশ রোষপূর্ণ কন্ঠে বলল, ‘খুব বেশি তেজ তোমার, তাই না?’

রোজা দায়সারা ভাবে বলল, ‘আপনার যা মনে হয়, তাই৷ আমাকে যেতে দিন।’

‘যেতে দেব। তার আগে আমার দিকে তাকাও।’ ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল আদ্রিশ।

রোজা বিরক্তির সর্বোচ্চ সীমানায় পৌঁছালো। আদ্রিশের ব্যবহার আর কথার মারপ্যাঁচে তালগোল পাকিয়ে বাধ্য রোজা ওর দিকে তাকালো। তারপর নিভে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘এবার যেতে দিন।’

‘আমার চোখের দিকে তাকাও।’

রোজা ভড়কে গিয়ে বলল, ‘এমনটা কথা ছিল না। তাকাতে বলেছেন তাকিয়েছি। চোখের দিকে তাকাতে হবে কেন?’

আদ্রিশ গম্ভীর কন্ঠে যুক্তি প্রদর্শন করলো। বলল, ‘চোখের দিকে তাকালেই না আমার মনের কথা বুঝতে পারবে।’

‘আপনি আমাকে যেতে দিন। শুধু শুধু বিরক্ত করবেন না আমায়। আমি এসব পছন্দ করি না।’

‘কেন তোমার জন্যই অনুভূতি জন্মালো মনে? তুমি এত কঠিন কেন মেয়ে?’ আদ্রিশ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রোজার দিকে।

রোজার কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তাই সে চুপ করে থাকলো। অস্বস্তিতে জমাট বেঁধে আছে মন-মস্তিষ্ক। আদ্রিশের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা বহাল রাখলো এবং একপর্যায়ে যখন বেখেয়ালে আদ্রিশের থেকে ওর হাতটা আলগা হয়ে এলো, ঠিক তখনই নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুতপদে নামতে গেল রোজা৷ কিন্তু তখনকার মতো ব্যর্থ হলো। রোষাগ্নি চক্ষুতে আগ্নেয়গিরির ন্যায় রক্তিম আভা দেখতে পেল আদ্রিশের চোখে। ফিনফিনে বাতাসে এবার হিজাব পুরোটাই সরে গেল রোজার। এলোমেলো কিছু চুল এসে পড়ে মুখের ওপর। একটানে ওকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আদ্রিশ শীতল চোখে ওকে একপলক দেখে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। রোজা ভড়কে গিয়ে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে যেন। লোকটা ওর এত কাছে? রোজা ভাবতে পারে না কিছু। ললাটে স্পর্শ হয় আদ্রিশের উষ্ণ ওষ্ঠজোড়া। রোজার শিরদাঁড়া বেয়ে স্রোত বয়ে যায়। ঘেমে ওঠে সে। রোজা কম্পিত হাতে ওর মুখ চেপে ধরে বলে, ‘এ-এটা পা-প। কী করছেন আপনি?’

আদ্রিশ নিষ্প্রভ কন্ঠে বলে, ‘বোঝাপড়া করতে চাচ্ছি।’

রোজা নির্জীব কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কী-সে-র বোঝাপড়া?’

আদ্রিশ ওর গালে নিজের ডান হাতটা রেখে সোজা হয়ে বসে। রোজা তখনো চোখ নামায় নি। বিস্ময় নিয়ে ওর কর্মকান্ড দেখে চলেছে। কিছুই বোধগম্য বা বিশ্বাস হচ্ছে না। ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে আদ্রিশ বলল, ‘শুনো মেয়ে, তুমি আমাকে এড়িয়ে চলে প্রতিনিয়ত বুকের ভেতর দহনক্রিয়া সৃষ্টি করে যাচ্ছো, আমি ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না, কাজে মন বসাতে পারছি না তোমার জন্য৷ তোমাকে দেখার আগ অবধি আমার সবকিছু স্বাভাবিক ছিল, তোমাকে দেখার পর থেকেই সব অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। তোমার সাথে দেখা না-হলে আমার এই অসুখটা হতো না। তুমি কেন আমাদের বাড়িতে আসলে মেয়ে? কেন এলে তুমি? এলেই যখন, মেনে নিতে পারছো না কেন তুমি আমাকে?’

রোজা সবটা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আপনাদের বাড়িতে আসাটা-ই কী আমার অপরাধ? আপনাদের টাকায় খাচ্ছি-ঘুরছি-ফিরছি, এর মূল্য চান আপনি?’

আদ্রিশ জোর গলায় বলল, ‘তুমি যেমন আমাকে বুঝো না, আমার কথাগুলো-ও বুঝো না। কেন মেয়ে?’

রোজা গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। আদ্রিশ আটকালো না। এরপর রোজা রোষপূর্ণ কন্ঠে বলল, ‘আপনি কমপক্ষে আমার চেয়ে সাত বছরের বড়। তাই বড়-র মর্যাদাটা বজায় রাখবেন ভাই-য়া।’

আদ্রিশ চমকালো, থমকালো! রোজার মুখ থেকে ‘ভাই-য়া’ ডাকটি শোনার থেকে এক বোতল বিষপান করে জীবন উৎসর্গ করা যেন স্বস্তির মনে হলো ওর। ততক্ষণে রোজা সদর দরজায় পৌঁছে গেছে। রোজাকে আর হাতের কাছে না পেয়ে আদ্রিশ গাড়ি থেকে নেমে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অতঃপর অনেকটা চেঁচিয়ে-ই বলে ওঠল, ‘ভাই-য়া ডাকার শাস্তি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থেকো মাই গার্ল। এত জ্বালাবো যে, আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।’

রোজার হাসি পেয়ে গেল অজান্তেই৷ পরক্ষণেই অতি কষ্টে হাসি চেপে ঢুকে পড়লো বাড়িতে। আদ্রিশ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীর চেহারা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

টেবিলে রাতের খাবার সাজানো হয়েছে। সবাই পেটে ক্ষিধে নিয়ে বসে আছে বাড়ির মুরুব্বি দুজনের জন্য। উৎস বাড়িতে নেই। বন্ধুদের কী একটা পার্টি আছে সেখানে চলে গেছে। নিশিতা মাংসের বাটিটা এনে রাখতেই ইনায়াত সাহেব আর ইমতিয়াজ সাহেব চলে এলেন। মিতালি ইশার প্লেটে তরকারি তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘আদ্রিশ কোথায়? আসে নি? ফিহা তুই ওকে ডাকিস নি?’

খেতে খেতে ফিহা বলল, ‘আসছে।’

রোজা কথাটায় গুরুত্ব দিলো না। নিজের মতো খেয়ে চলেছে। ধপ করে পাশের চেয়ারটাতে কেউ বসতেই রোজা চমকে তাকালো। হতচকিত দৃষ্টিতে আদ্রিশের বাঁকা হাসিটা চোখে পড়তেই উৎকন্ঠিত চোখজোড়া সরিয়ে খাবারে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। আবারও? ওর পাশেই কেন? রোজা মুখটা কালো করে খাচ্ছে। মিতালি আদ্রিশের খাবারটা প্লেটে দিতেই সে মুখ কুঁচকে বলল, ‘সবজি পছন্দ না মা। তুলে না-ও এটা।’

মিতালি রেগে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘তো? কী দেব?’

আদ্রিশ কিছু বলার আগেই রোজা সবজি নিলো নিজের জন্য। অন্য কোনো দিকে ওর মনোযোগ নেই। কে খাচ্ছে না খাচ্ছে তাতে ও পাত্তা দিচ্ছে না। রোজাকে সবজি নিতে দেখেই আদ্রিশ উৎফুল্ল গলায় বলল, ‘সবজি-ই দাও।’

শুনেই রোজা তাকালো। পুরো ঘটনাটি মস্তিষ্কে ধরা পড়তেই ছোট ছোট রোষিত চোখে দেখল। এত বজ্জাত কোনো লোক হয়? আদ্রিশ ক্রুর হাসছে। রোজার রাগে গা জ্বলে গেল। তৎক্ষনাৎ সে নিজেকে সামলে নিলো। ওর বিরক্তিকর মুখশ্রীটা দেখে বেশ লাগলো আদ্রিশের৷ আজকাল প্রিয় মানুষটির সবকিছুই এত ভালো লাগে কেন ওর? খাওয়া শেষে ঘরে যাওয়ার সময় করিডরে দেখা হয়ে গেল রোজার সঙ্গে৷ দ্রুতপদে সে স্থান ত্যাগ করার প্রয়াসে যেতে নিলেই রোজার পথ আটকালো আদ্রিশ। রোজা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাতেই কঠোর গলায় সে বলল, ‘আমার হৃদয়কে বশ করার অভিনব কৌশল প্রয়োগ করেছ তুমি। সে হৃদয়কে পোড়াতে চাইলে তাঁর দহনে তুমি নিজেই পুড়ে যাবে মেয়ে। আমাকে যত এড়িয়ে যাবে, যত জ্বালাবে তাঁর চেয়ে বেশি তোমাকে জ্বালাবো আমি। মনে রেখো তুমি।’

এটুকু বলেই আদ্রিশ সে স্থান ত্যাগ করলো। পেছনে রেখে গেল বিস্মিত, হতবিহ্বল রোজা নামক মেয়েটিকে।

—————–

প্রথম সেমিস্টারের এক্সাম শেষ হয়েছে আজ এক সপ্তাহ। খুব বেশি ভালো না হলেও তেমন খারাপও হয় নি রোজার পরীক্ষা। তাতে বরং ও একটু স্বস্তি-ই পেল। আদ্রিশের গোঁয়ার্তুমি, আর হুটহাট যাতনার কারণে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে নি সে৷ নয়তো রেজাল্ট বেশ ভালো হতো ওর। একটা আফসোস থেকে গেল রোজার মনে। সকালবেলা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতেই হঠাৎ মাইগ্রেনের ব্যথা ওঠলো। রাত জেগে পড়ার ফলস্বরূপ এই অসহ্যকর ব্যথা। ফলে রোজার আজ ভার্সিটি যাওয়া হয়ে ওঠলো না। সারাক্ষণ রুমেই শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিলো। এদিকে বেলা গড়াতেই ব্যস্ত হয়ে ওঠলো আদ্রিশদের বাড়ির পরিবেশ। একপ্রকার তোরজোড় আর হট্টগোল লেগে গেল যেন। মাথা যন্ত্রণা একটু কমতেই রোজা গোসল সেরে নিলো। চুলে তোয়ালে জড়িয়ে চলে গেল বারান্দায়। রোদে বসে ভেজা চুলগুলো শুকিয়ে নিচ্ছিলো। হঠাৎ বিপরীত দিকে চোখ পড়তেই আদ্রিশকে নজরে এলো ওর। ব্যলকনিতে বসে আছে সে। হাঁটু অবধি ঢাকা একটা প্যান্ট আর খালি গায়ে দু-পা চেয়ারের ওপর তুলে নিউজ পেপার পড়ছে সে। দুপুরের প্রথম প্রহরের কড়া রোদ এসে পড়ছে ওর ব্যলকনির গাছগুলোতে। ক্ষ্যাপাটে হাওয়ার ঝাপটায় চুল ওড়ছে অবিরাম। কিছু চুল নাকে-মুখে এসে পড়ছে। কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই লোকটির। শক্ত-সামর্থ্য, পেটানো শরীর আদ্রিশের। খানিকটা লজ্জা পেল রোজা। ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। দেয়াল ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে দেখলো বেলা প্রায় একটা। এই সময়ে তো আদ্রিশের বাসায় থাকার কথা নয়। তাছাড়া আজ ছুটির দিন-ও না। তাহলে ও বাসায় কেন?
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

আদ্রিশ আর রোজার রুমের ব্যলকনি মুখোমুখি, কিন্তু কয়েক গজ দূরে। এক ব্যলকনি থেকে অন্য ব্যলকনিতর সবকিছুই দেখা যায়। একটা সময় রোজাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফেলে আদ্রিশ। আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রোজা সেটা ধরতে পেরেই এমন একটা ভান করে যেন আদ্রিশকে সে দেখতেই পায় নি, ধীরস্থিরভাবে চুপ করে রুমে আসার জন্য পা বাড়ায়। তখনই আদ্রিশ গমগমে স্বরে ওকে ডাক দেয়, ‘এইযে, পালাচ্ছো কোথায়?’

রোজা সটান দাঁড়িয়ে পড়ে। চেহাতার কাঠিন্যভাবটা বজায় রেখে থেমে থেমে বলে, ‘কো-থা-য় পালাচ্ছি?’

ভ্রু কুঁচকে আদ্রিশ জিজ্ঞেস করে, ‘সত্যিই পালাচ্ছো না?’

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রোজা উত্তর দেয়, ‘উহু, একদম-ই নয়।’

‘তাহলে দাঁড়িয়ে থাকো।’

রোজা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, ‘কেন দাঁড়িয়ে থাকবো? এখানে তো আমার কোনো কাজ নেই।’

আদ্রিশ হাতের নিউজ পেপারটা চারভাগ করে ভাঁজ করে রাখে কোলের ওপর। তারপর বলল, ‘তুমি আজ ভার্সিটিতে যাও-নি?’

‘না।’

‘কোনো সমস্যা?’

রোজা বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই যাই নি। এসব বিষয়ে প্রশ্ন করার মানে দেখছি না। আর হুটহাট এভাবে ডাকবেন না আমাকে। আপনি ছোট বাচ্চা নন। আর আমিও বাচ্চা নই যে, আপনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই আমার সঙ্গে ব্যবহার করবেন। এটা অন্তত মাথায় রাখুন, আমার উপকার হবে। একটু ম্যানার্স শিখুন।’

আদ্রিশ থমথমে চেহারা নিয়ে তাকায়। কিছু বলতে গেলেই রোজা অন্যদিকে দৃষ্টি দেয়। ইচ্ছে করেই আর ব্যলকনি থেকে যায় না। দাঁড়িয়ে থাকে, গুনগুন করে কবিতা আবৃত্তি করে। আদ্রিশও পলক সরায় না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজ যেন বেড়েই চলেছে। কিছু গঙ্গাফড়িং এদিক-সেদিক ওড়ে বেড়াচ্ছে। নিষ্কর্মা অলস প্রহরের এই পরিবেশটা নিরবে-নিভৃতে ঢেকে আছে। রোজা রেলিঙের দিকে একটু ঝুঁকে ভাঙা ছোট একটা কুঠুরির ফাঁক থেকে কি যেন একটা বের করে আনে। আদ্রিশ মনোযোগ দিয়ে পরখ করতে থাকে তার একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দের রমণীটিকে। গালে হাত রেখে ভাবনার জগৎে বিচরণ করে সে। জ্বলজ্বল করা নয়নদুটো নিবদ্ধ থাকে রোজার ওপর। কিছু মুহূর্ত পর রোজা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দু-হাতের তালুতে ছোট্ট একটা চড়ুইপাখির ছানা। আকুলিবিকুলি করছে রোজার হাতের চামড়ায়। আদ্রিশ অবাক হয়ে দেখে রোজার ঠোঁটের কোণের এক চিলতে হাসি। সামান্য একটা ছানা দেখে এত খুশি? কোনোদিন তো এত উৎফুল্লতা মেয়েটির চোখেমুখে দেখতে পায় নি সে!
ফুলের ওপর ওড়াওড়ি করা একটি কালচে-বাদামি ছোপ ছোপওয়ালা একটি প্রজাপতি অকস্মাৎ রোজার গাল ছুঁয়ে কাঁধের ওপর বসে পড়ে। বিস্মিত দৃষ্টিতে রোজা সেটা দেখে মুচকি হেসে ফেলে। চড়ুইয়ের ছানাটিকে আগের জায়গায় রেখে সে ঘরের ভেতর চলে আসে। ততক্ষণে প্রজাপতি জানালা দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গেছে। রোজা ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর আদ্রিশের ধ্যান ভাঙে। অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটা দেখতে না পেয়ে মনে মনে রোজার ওপর নারাজ হয়। পরমুহূর্তেই সে ওঠে দাঁড়ায়। নিজ ঘরে যে অবস্থায় ছিল, সেভাবেই বেরিয়ে চলে আসে রোজার ঘরে। নেহা-ফিহা কেউ তখন রুমে ছিল না। রোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছার চেষ্টা করছিল। ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে নিজের পেছনে যখন আদ্রিশকে দেখতে পেল, ভয়ানক চমকে ওঠলো সে। দ্রুতগতিতে বিছানার ওপর থেকে নিজের ওড়নাটা গায়ে জড়াতে জড়াতে ক্রুদ্ধ কন্ঠে রোজা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আপনি এ-ঘরে কী করছেন?’

আদ্রিশ রোজাকে রাগতে দেখে গম্ভীর গলায় বলে, ‘ঘরে চলে আসলে কেন? আমি বারান্দায় বসে তোমাকে দেখছিলাম। আমি বলি নি দাঁড়িয়ে থাকতে? কোনো কথা শুনো না কেন তুমি? আচ্ছা, বেয়াদব তো!’

রোজা চোখ পাকিয়ে তাকায়। কাঠ কাঠ গলায় সে হুকুমজারি করে, ‘এক্ষুনি বেরিয়ে যান বলছি৷’

আদ্রিশ শক্তপোক্ত কন্ঠে জবাবে দেয়, ‘যাবো না।’

বলে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। রোজার মাথা ঘুরতে থাকে। কেউ এখন ওপরতলায় নেই। এখন যদি কেউ এসে ওকে আর আদ্রিশকে একসাথে, একঘরে দেখে ফেলে তাহলে কী হবে? সবাই তো খারাপ ধারণা করবে। রোজা দু-পা এগিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকায় আদ্রিশের পানে। মুখ কালো করে কঠোর গলায় বলে, ‘চলে যান বলছি। আপনি কিন্তু আমার ধৈর্যের সীমারেখা ভেঙ্গে ফেলছেন। আমি বিচার দিতে বাধ্য হবো খালুজান আর আপনার আব্বুর কাছে। ‘

আদ্রিশ ছোট ছোট চোখ করে বলে, ‘আমি কী ভয় পাই না-কি?’

এই একটা কথা শুনেই রাগে তিরতির করে কাঁপতে থাকে রোজা। মাথা ক্রমশই গরম হয়ে ওঠছে। এ বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যে কতবড় ভুল সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ওর জীবনের অন্যতম ভুলের মধ্যে অন্যতম ভুল নেহাদের বাসায় থাকা। ভেবেছিল আদ্রিশকে ওয়ার্ন করার পরে ও ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে। কিন্তু লোকটার মধ্যে উন্নতির কোনো লক্ষণ তো দূর ব্যবহারটা পর্যন্ত ঠিক করতে পারে নি। উলটো আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। আচ্ছা, ভালোবাসা কী জোর করে আদায় করে নেওয়ার জিনিস? রোজার দিক থেকে ও-তো কোনো ইঙ্গিতই দেয় নি আদ্রিশকে, তাহলে? লোকটা ওর পিছু ছাড়ছে না কেন? গ্রামে যদি ওর বাবা জানতে পারে তাহলে রোজাকে এক্ষুনি নিয়ে যাবে। তিনি তো এসব প্রেম-ভালোবাসা পছন্দই করেন না। আদ্রিশ কেন বুঝতে চাইছে না এসব? রোজা হতাশ দৃষ্টিতে দী-র্ঘ-শ্বাস ফেলতেই চোখ পড়লো আদ্রিশের দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। মুখটা অল্প-বিস্তর ‘হা’ হয়ে গেল। এতক্ষণ ও পুরোপুরি খেয়ালই করে নি লোকটাকে। বারান্দায় যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই ওর ঘরে চলে এসেছে! রোজা হতবিহ্বল গলায় বলল, ‘লজ্জা-শরম সব বিকিয়ে দিয়েছেন না-কি? আপনার লজ্জা নেই বলে কী দুনিয়ার সবার মধ্যে থেকে লজ্জা ওঠে গেছে? আপনি মানুষ? না-কি ভিনগ্রহের উজবুক এলিয়েন?’

বলেই বারান্দায় গিয়ে দরজা আটকে দিলো। আদ্রিশ প্রথমে বোকার মতো বোঝার চেষ্টা করলো কথাটির মর্মার্থ। পরক্ষণেই নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো। এ বিষয়টা মাথায় ছিল না, যেভাবে পেরেছে চলে এসেছে। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে বসে থাকতে পারবেও না। নিজস্ব একটা প্রাইভেসি আছে। মুখ কালো করে ওঠে বেরিয়ে যেতে যেতে সে গলা উঁচু করে বলল, ‘হবু বৌ-য়ের কাছে এভাবে আসতে লজ্জা কী-সে-র? আমি তো মেয়ে না।’

রোজা ব্যলকনির দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল কখন লোকটা যাবে। কিন্তু আদ্রিশের মুখ থেকে ‘হবু-বৌ’ ডাকটি শুনতে পেয়ে অজানা কারণেই কান গরম হয়ে ওঠলো রোজার। হাত-পা শিরশির করে ওঠলো। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে নিষ্পলক দৃষ্টিতে বেহায়া লোকটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দিক। আমার পিছু ছাড়ুন।’

——————————————-

নিচে নেমে আসতেই রোজা অবাক হয়ে যায়। পুরো ড্রইংরুমের চেহারাই যেন পালটে গেছে। সোফাসেট-টি’টেবিল, ফ্লাওয়ার ভাস, টিভি সবকিছুর জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। নতুন কার্পেট বিছানো হয়েছে। একপাশের দেওয়ালের রঙটাও বদল হয়েছে। বুয়া ফ্লোর মুছছে। সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে রোজা বুয়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বাড়িতে কী কোনো অনুষ্ঠান আছে আন্টি?’

বুয়া হেসে বলল, ‘না গো।’

‘সবকিছু অন্যরকম লাগছে। হঠাৎ এত পরিবর্তন?’

‘আমাগো নেহা-রে আইজ দেখতে আইবো পাত্রপক্ষ।’

বিস্মিত হয়ে রোজা বলল, ‘কী বলছেন? হুট করেই নাকি?’

‘পাত্রপক্ষ হঠাৎ আইজ সকালে ফোন কইরা কইছে নেহারে দেখতে আইবো, বাড়ির কেউ-ই জানতো না তো। তো পাত্রের কি কাজ পইরা গেছে হের লাইগা ছয়মাসের লাইগা দেশের বাইরে যাইব। অহন, তাড়াতাড়ি কইরাই সব করতে চায় যদি নেহারে পছন্দ হয় আরকি!’

রোজা নিচু স্বরে বলল, ‘ওহ। কিন্তু আমাকে কেউ জানালো না কেন?’

বুয়া আবার ঘর মোছায় ধ্যান দেয়। বলে, ‘আপনের শরীরডা ভালা না দেইখা ভাবি আপনারে ডাকতে মানা করছে। তাই কেউ বলে নাই।’

‘নেহা আপু কোথায়?’

‘ইশাদের বাসায় লইয়া গেছে।’

‘কেন?’

‘ও-তো রাজিই না এহন বিয়াটিয়া করতে। ছোট আপা আইসা নিয়া গেছে ওরে বুঝানোর জন্য। লইয়া আইব একটু পরেই।’

রোজা জিজ্ঞেস করে, ‘ছোট আপা কে?’

‘ইশার মা। তোমার লগে মনে হয় এহনো দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই?’

রোজা মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘হুম। আচ্ছা, আন্টি কোথায়?’

‘রান্ধাঘরে।’

রোজা সেদিকে পা বাড়ায়। মিতালি রান্নায় ব্যস্ত, নিশিতা আন্টি অন্য আরেকজন বুয়াকে সঙ্গে নিয়ে কুটনো কাটছে। রোজাকে দেখেই তিনি ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিচে নেমে এলি কেন? ব্যথা কমেছে?’

রোজা হেসে বলল, ‘কমেছে। ব্যস্ত হয়ো না। আজ নাকি নেহা আপুকে দেখতে আসবে?’

নিশিতা নত কন্ঠে জবাব দেয়, ‘হুম। হুট করেই আদ্রিশ এসে জানালো ছেলেপক্ষ আজই আসতে চায়। পছন্দ হলে আজই এনগেজমেন্ট করে রাখতে চায়।’

রোজা বলে, ‘এতো ফার্স্ট? খোঁজখবর নিয়েছো তো? এর আগের লোকটার তো…’

এবার আদ্রিশের মা মিতালি হেসে বলল, ‘সব খোঁজখবর নিয়েই দেখাদেখির পর্ব ঠিক হয়েছে মেয়ে। আর কোনো ভুল নেই। পরিবারের লোকজন যথেষ্ট অমায়িক, বেশি না হলেও আমাদের মতোই অবস্থা সম্পন্ন, ছেলেটাও ভালো, নম্র-ভদ্র। তাছাড়া আমার ছেলে নিজে খোঁজ নিয়েছে বলে কথা! বোনকে তো যার-তার হাতে তুলে দেবে না।’

নিশিতা জা’য়ের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছো বড় ভাবি। এজন্যই তো আমি এত নিশ্চিন্ত। সবকিছু আল্লাহর রহমতে ভালোভাবে মিটলেই হয়।’

রোজা বুঝতে পারলো আদ্রিশ আজ বাসায় কেন!
ঘটকের দায়িত্ব নিয়েছে না-কি? আর নিলেই বা ক্ষতি কী। রোজা ওর ব্যাপারে ভাবছে কেন। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। বাসায় কেউ-ই নেই বিধায় নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, সিঁড়ি দিয়ে আদ্রিশ নামছিলো তখন। রোজাকে দেখেই বলল, ‘আমাদের বিয়েটাও অতি শ্রীঘ্রই হবে।’

রোজা কর্কশ কন্ঠে বলল, ‘কখনোই হবে না।’

‘হতে বাধ্য।’

‘বললেই হলো? আমি রাজি না থাকলে আপনার সাধ্য কী আমায় বিয়ে করার?’

আদ্রিশ বাঁকা হেসে বলল, ‘সেটা তো সময়ই বলে দেবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সী!’

——————————————-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here