অনুভবে তুই পর্ব -১৩+১৪

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে পাত্রপক্ষের পরিবার৷ বেশ আলাপ-আলোচনা এবং রসিকতা চলছে ইনায়াত সাহেব ও ইমতিয়াজ সাহেবের সাথে। আদ্রিশ, মিতালি-নিশিতা ওরাও আছে। মেয়েরা সবাই একপাশে নেহাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। নানান প্রকার মিষ্টান্ন এবং বিভিন্ন ফলফলাদি ও মুখরোচক নাস্তা সাজানো টি-টেবিলের ওপর। নেহাকে উজ্জ্বল রঙের একটি জামদানি শাড়ি পরানো হয়েছে। পাত্রপাত্রীকে দুই পরিবারের সবারই পছন্দ হয়েছে এবং আগে থেকেই সব খোঁজখবর নেওয়া হয়ে গিয়েছে বলে এনগেজমেন্ট করে রাখবে কি-না তারই আলাপচারিতা চলছে। বাবা-মা, চাচা-চাচী সবাই এই সম্পর্কে খুশি এবং রাজি বলে ফুফুর কথা মেনে নিজেও একবার পাত্রের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে রাজি হলো নেহা। পাত্রের নাম রিজভী। আদ্রিশের পরিচিত এবং তাঁদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক। রিজভী একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বড় পদে চাকরি করে। ওর চিন্তাধারা, স্বভাব, আচার-আচরণ বেশ ভালোই লাগলো নেহার। তাই বিয়েতে আর অমত করলো না সে!

একপর্যায়ে রিজভীর সাথে আলাদা করে কথা বলতে দেওয়া হলো নেহাকে। বেশ সময় নিয়ে দু’জন কথা বলার পরে নেহা তার তিন বোনকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোদের কী মনে হয়? বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়াটাই ঠিক?’

ইশা নেহার গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ভাইয়াটাকে তো ভালোই মনে হলো। আমাদের সঙ্গেও বেশ নম্রভাবেই ব্যবহার করলো। তাই না ফিহা আপু?’

ফিহা ওর কথায় সায় জানিয়ে বলল, ‘হুম। তোমার পাশে মানাবে ওনাকে, দ্বি-মত করার কারণ দেখতে পাচ্ছি না। রোজা তুই কিছু বল!’

রোজা নিশ্চুপ হেসে বলল, ‘পারফেক্ট জুটি নেহা আপু। এই বিয়েতে অমত করা মানে হীরের টুকরো রিজেক্ট করা। তাছাড়া বাড়ির সবাই যেখানে মত দিয়েছে সেখানে ভয়টয় বা দ্বিধা করো না। ওদের ওপর পূর্ণ আস্থা থাকা উচিৎ।’

নেহা আলতো হাসলো। ওরা চারজন যখন পাত্র নিয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ঠিক সেসময় দরজার ভারী পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন ইশার মা অর্থাৎ আদ্রিশের ফুফু সুহানা শেখ। ঘরে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই ওরা চুপ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সুহানা শেখের ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি। মনে হচ্ছে ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ায় বেজায় খুশি তিনি। আদ্রিশ আর নেহাকে তিনি অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই ভালোবাসেন। তাই ওদের ওপর তাঁর যেন একটু বেশিই দাবি। নেহাকে জড়িয়ে ধরে তিনি নিজের উৎফুল্লতা প্রকাশ করলেন। খুশি খুশি গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘অবশেষে আমার মেয়েটারও বিয়ে হবে।’

নেহা লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে নরম স্বরে বলল, ‘ফুপি, এখনো কিন্তু বিয়েটা হয় নি।’

‘হয় নি তাতে কী? হবে তো।’

কথা বলতে বলতে সুহানা শেখের নজর পড়লো খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের ওপর। অদ্ভুত মায়ায় ঘেরা, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ মেয়েটির। মেয়েটার সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হতেই রোজা সৌজন্যেতামূলক হাসি দিলো। রোজার সঙ্গে এর আগে পরিচয় হয় নি সুহানার। ইদানীং এই বাসায় খুব কমই আসেন তিনি। নিজের সংসার সামলে দিনশেষে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোথাও একটা যাওয়া হয় না তার। ভাইদের বাড়ি কাছে বলে মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া হয়। কিন্তু গত কয়েকমাস এতটাই ব্যস্ত আর অসুস্থ ছিলেন যে এমুখো আর হতে পারেন নি, যার ফলে রোজা নামক মেয়েটির সঙ্গে তার কোনো পরিচয় নেই। তবে ইশার মুখে অনেকবার রোজার নাম শুনে প্রথম দেখাতেই তিনি রোজাকে চিনে ফেললেন। মুহূর্তেই ভ্রু-কুঁচকে এলো তাঁর। থমথমে মুখে ফিহাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী তোর খালার মেয়েটা নাকি?’

ফিহা সায় জানিয়ে বলল, ‘হুম, ওর নাম-ই রোজা।’

সুহানা আগের মতোই মুখভঙ্গি করে বললেন, ‘দেখেই চিনতে পেরেছি। আমার মেয়ে ইশা তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সারাদিন-ই ‘রোজা’ নামটা ওর ঠোঁটের আগায় থাকে। রোজা এটা করেছে, ওটা করেছে, রান্না ভালো, দেখতে সুন্দরী, পড়াশোনার দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই এসব গল্পই আমার জানা।’

সুহানা শেখের কথা শুনে রোজা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ইশার হাসি হাসি চেহারাটাও কেমন মিলিয়ে গেল। নেহা হেসে বলল, ‘আমাদের রোজা সবদিক দিয়েই ফার্স্ট। সোনার টুকরো মেয়ে।’

সুহানা শেখ হাসলেন না। রোজা গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভালো আছেন আন্টি?’

সুহানা শেখ ভার গলায় উত্তর দিলেন, ”হা, ভালোই আছি৷ তা তুমি কেমন আছ?’

‘আলহামদুলিল্লাহ।’

‘ভালো তো থাকবেই, প্রথম প্রথম শহরে আসছো না!’

রোজা নিভলো। সুহানা শেখের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ওকে খুব একটা পছন্দ করেন নি তিনি। তাঁর কথার প্রতিত্ত্যুরে রোজা কোনো শব্দব্যয় করলো না। কাজের বুয়া এসে জানালো নেহাকে ড্রইংরুমে নিয়ে যেতে বলেছে ইনায়াত সাহেব। ফিহা আর ইশা ওকে নিয়ে গেল। রোজা বেরুতে নিলেই পেছন থেকে সুহানা শেখ ডাকলেন। রোজা ঘাড় ঘুরিয়ে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু দরকার আন্টি?’

সুহানা শেখ রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?’

‘না মানে নিচে যাচ্ছিলাম আন্টি। আপনার কিছু লাগবে?’

‘আমার কিছু প্রয়োজন নেই। বাড়িটা তো তোমার না, আমারই। কিছু দরকার হলে আমি নিজেই নিতে পারবো।’

‘আমি তাহলে যাই?’

‘না। তুমি নিচে যাবে না। পরে দেখা যাবে হিতে বিপরীত হয়েছে।’

রোজা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘মানে?’

সুহানা শেখের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। সেভাবেই মাথা নেড়ে তিনি ওকে আগাগোড়া পরখ করে কঠোর গলায় বললেন, ‘এমন একটা ভান করছো যেন কিছু বুঝতে পারছো না। নেহার আগের বিয়েটা তো অনেকটা তোমার কারণেই ভেঙেছে। তুমি দেখতে যা সুন্দরী, রুপ দিয়েই তো সবাইকে বশ করে ফেলো। এখন তোমাকে দেখলে পাত্রপক্ষ যদি তোমাকেই পছন্দ করে ফেলে? আমাদের নেহাটার কী হবে? তাই বলছি তুমি কোথাও যাবে না, এখানেই চুপ করে বসে থাকো।’

রোজার জন্য নেহার বিয়ে ভেঙেছিল? কি বলছেন সুহানা শেখ? শাখাওয়াত লোকটা যে প্রথম থেকেই বিয়েতে রাজি ছিলো না সেটা কী ওনি জানেন না? রোজা তাঁর ভুলটা ভাঙার জন্য কিছু বলতে উদ্যত হতেই সুহানা শেখ হাত ওঠিয়ে থামিয়ে দিলেন ওকে। তারপর ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিচে যাওয়ার জন্য ওঠে দাঁড়ালেন। রোজা ভদ্রতাসূচক দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। ওর বিস্মিত দৃষ্টিজোড়ায় হাজারো প্রশ্ন। সুহানা শেখ ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন। গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্ম তো গ্রামে, তাই না? সবার চোখে গ্রামের মেয়েরা সহজসরল হয়, কিন্তু মোটেও তা নয়। ওরা একেকটা চিজ হয়। নিজের স্বার্থ পূরণ করা ছাড়া ওরা কারোর ভালো চায় না। তুমি আমার ভাইদের বাড়িতে পড়তে আসছো, থাকতে আসছো তাতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার কারণে আমার ভাইদের ছেলে-মেয়ের ক্ষতি হবে সেটা তো আমি মেনে নেব না। আর শুনো, রুপ দিয়ে মানুষকে সাময়িক সময়ের জন্য বশ করতে পারলেও সারাজীবন তা পারবে না। আমার আদ্রিশকে নাকি ইতোমধ্যেই নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিয়েছ? ভালোয় ভালোয় এসব বন্ধ করো। নয়তো কি হবে তোমার সাথে চিন্তাও করতে পারবে না। সোনা হয়ে হীরের টুকরোর দিকে হাত বাড়াতে যেও না।’

বলেই শাড়ির আঁচল পিঠের ওপর টেনে নিচে চলে গেলেন তিনি। রোজা অবাকের সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেছে। দরজাটা কোনোমতে বন্ধ করে বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়লো। ঘোরটা যেন এখনো কাটছে না। সুহানা শেখ এসব কী বলে গেলেন ওকে? নেহার বিয়ে ওর জন্য ভেঙেছে? গ্রামের মেয়েরা চিজ আর স্বার্থপর হয়? রুপ দিয়ে সবাইকে বশ করে? রোজা আদ্রিশকে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিয়েছে? মানে কী এসবের? ও তো কখনো আদ্রিশকে সুযোগ দেয় নি। আর এই মহিলা সব দোষ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো? আর আদ্রিশ যে ওর প্রতি দুর্বল এটা ওনি কীভাবে জানলো? ও তো কাউকে বলে নি, সুহানা শেখের সাথে ওর তো আজ প্রথম দেখা। তাহলে কী আদ্রিশ নিজেই বলেছে? রোজা যে ওর প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না, সেজন্য প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে? সবার কাছে ওকে খারাপ প্রমাণ করতে চায়? নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে চোখ ছাপিয়ে জল বেরিয়ে এলো রোজার।

——————————-

নিকষকৃষ্ণ আঁধারে ঢাকা শুক্লপক্ষের রজনী। হিম করা ঠান্ডা দোদুল্যমান হাওয়ায় বৃক্ষরাজি শনশন শব্দ তুলে বইছে। ফুলগন্ধি সুমিষ্ট বাতাসে চারদিক ভরে ওঠেছে। অর্ধবাঁকা একফালি চাঁদ ঝুলছে আকাশের ঠিক মধ্যস্থানে। দু-একটি তারা দ্যুতি ছড়াচ্ছে নিজেদের মতো করেই। নেহার এনগেজমেন্ট শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। পাত্রপক্ষের লোকজন এখনো বিদায় হয় নি। সারাদিন মেহমানদারি করতে করতে উৎসের অবস্থা নাজেহাল। তার ওপর বিকেলে দরকারি একটা কাজে বেরিয়ে বাইক এক্সিডেন্টে পায়ের পাতায় বেশ জখম হয়েছে ওর। প্রাথমিক চিকিৎসা নিলেও বাসায় ফিরে আর কাউকে কিছু জানায় নি। ঘরভরা মেহমানদের রেখে নয়তো সবাই ওকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যেত। বোনের এনগেজমেন্টের আনন্দটা নষ্ট করতে চায় নি। ঘন্টাখানিক ধরে রোজাকে দেখতে না পেয়ে চুপিসারে দোতলায় চলে আসে উৎস। রোজার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে সে আর ডিস্টার্ব করে নি। নিজের ঘরেই ফিরে যায়। কিন্তু মনটা খচখচ করতে থাকে। খানিকবাদেই আবারও ফিরে আসে রোজার ঘরের সামনে। দু-একবার নক করতেই ধীরপায়ে হেঁটে দরজা খুলে দেয় রোজা। উৎস অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হেসে জিজ্ঞেস করে, ‘কি-রে রোজানু, সবাই নিচে আনন্দ করছে তুই একলা ঘরে বসে বসে মশা মারছিস না-কি?’

কিন্তু ঘরে ঢুকেই মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেল উৎসের। ব্যাগপত্র গোছগাছ করে, বইপত্র গুছিয়ে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোজা। ওর চোখ ফোলা, রক্তিম আভা ছেয়ে আছে চেহারায়, নাকের ডগা টকটকে লাল। এককথায় বিধস্ত দেখাচ্ছে ওকে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা এতক্ষণ কেঁদেছে। কিন্তু কি এমন হলো যে রোজা কাঁদছে? উৎস ব্যথাযুক্ত পা- নিয়েই নিষ্প্রভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কী-রে রোজানু? তোর এই অবস্থা কেন? এত রাতে ব্যাগপত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’

রোজা শান্ত, ভাঙ্গা গলায় জবাব দিল, ‘আমি এখনি বাড়ি ফিরে যেতে চাই ভাইয়া। দয়া করে তুমি কী আমাকে নিয়ে যাবে?’

উৎস ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এত রাতে?’

রোজা দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘হুম, এত রাতেই।’

‘কিন্তু হয়েছেটা কী? তোকে কেউ কিছু বলেছে? কে কী বলেছে বল, আমি এক্ষুনি তাকে শাস্তি দেব। বলনা রোজানু!’

রোজা ধারালো কন্ঠে উত্তর দিল, ‘আমি আর এক মুহূর্তও এ-বাসায় থাকতে চাই না ভাইয়া। আমাকে গ্রামে দিয়ে আসো। আর যদি না যেতে পারো তো, আমি একাই যেতে পারবো।’

উৎস হতভম্ব হয়ে গেল। হলো টা কী ওর বোনটার? এমন করছে কেন রোজানু? ওর মতো শান্তশিষ্ট মেয়ের এরকম বিধ্বংসী রুপ তো কখনো দেখে নি। বাড়ির লোকজন কী ওকে কিছু বলেছে? উৎস চিন্তাযুক্ত হয়ে ওর বোনের রক্তিম চেহারার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ওর মনোভাব।
#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪

নিশুতি রাত। অন্ধকার গ্রাস করেছে পৃথিবীলোক। সুমিষ্ট ফুলেল সৌরভ বাতাসে ভাসছে। চারদিকটা অদ্ভুত মায়াবী রুপ ধারণ করেছে। সেই মায়াঘেরা মায়াপুরীর রাজকন্যের যদি মন খারাপ থাকে তাহলে পাণিপ্রার্থী প্রজারা কী করবে? রাজকন্যা যদি নিজ থেকে তার সমস্যার কথাগুলো না জানায় তাহলে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর উপায় কি তাঁদের? উৎসেরও হয়েছে সেই দশা। করুণ চোখমুখ করে সে বসে আছে বিছানার সাথে লাগোয়া ডিভানের ওপর। আর বিধস্ত রোজা বসে আছে বিছানার কোণে। চোখেমুখে অপমানের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠলেও উৎসের জহুরি চোখ আজ হাজার চেষ্টা করেও কিছু ধরতে পারলো না। নিজের আপন দু-বোনের পর সবথেকে প্রিয় এবং আদরের বোনটি হলো রোজা। রোজাকে সে এতটাই স্নেহ করে যতটা একজন ভাই, তাঁর ছোট বোনটিকে করে থাকে। আধঘন্টা যাবৎ জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেও রোজার মুখ থেকে কোনো কারণ উদঘাটন করতে পারে নি। যেন বলবে না বলে পণ করেছে সে এবং এই সিদ্ধান্তেই রোজা অটল। উৎস এবার ধৈর্যহীন কন্ঠে বলল, ‘রোজানু, প্লিজ তুই বল কী হয়েছে। প্রমিজ আমি কাউকে কিছু জানাবো না, সেইসাথে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করব। শুধু মুখফুটে একটিবার কারণটি বল।’

রোজা এবার মুখ খুললো, ‘কিছুই হয় নি আমার, আর না কেউ কিছু বলেছে। জোর করো না, আমাকে বাড়ি দিয়ে আসো।’

উৎস ভাবুক গলায় আঙুল নাড়িয়ে বলল, ‘উহু, কিছু একটা তো হয়েছে।’

‘হলে হোক, তুমি কী আমায় নিয়ে যাবে? নয়তো আমি একাই যাচ্ছি।’

রোজা কর্কশ কন্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে বিছানা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। চুলগুলো মুঠো করে প্যাঁচিয়ে রিবন দিয়ে বেঁধে নিলো। ড্রয়ার থেকে হিজাব বের করতে করতে রাগে গজগজ করতে থাকে রোজা। উৎস হতভম্ব হয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত পায়ে রোজাকে গিয়ে আটকায়। তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে বলে, ‘এমন করছিস কেন? আচ্ছা আমাকে বলবি না ঠিক আছে, নেহাকে অন্তত বল তোর সমস্যাটা। ডাকবো ওকে?’

রোজা জ্বলন্ত চোখে তাকায় ভাইয়ের দিকে। যার অর্থ সে কাউকেই কিছু বলবে না৷ বোনের এমন রুপ আগে দেখে নি উৎস৷ বিস্মিত হয়ে মুখের কথা হারিয়ে ফেলে। আমতাআমতা করে বলে, ‘এমনে তাকাচ্ছিস কেন? আচ্ছা যাহ, কাউকেই বলিস না। কিন্তু এভাবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাস না। লোকে কী বলবে?’

রোজা অট্টহাস্যের সুরে বলে, ‘লোকের কথা, সমাজের মানুষগুলোর বলাবলি, কানাঘুষাটাই কী আসল? কাছের মানুষটার কোনো কথারই দাম নেই?’

উৎস খানিকটা ক্ষ্যাপাটে গলায় বলে, ‘ধুর। সমাজ, লোকের তোয়াক্কা কে করে? আমি নিচতলার মেহমানদের মিন করেছি। এতগুলো লোকের সামনে দিয়ে এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান ছেড়ে এত রাতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবি? নেহা কষ্ট পাবে না?’

রোজা হতাশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন?’

‘তুই নিজেও জানিস নেহা তোকে কতটা ভালোবাসে। ওর জীবনের স্পেশাল একটা দিন আজকে। তুই যদি চলে যাস ও খুব কষ্ট পাবে। তাছাড়া এখন সাড়ে নয়টা বাজে। তোদের গ্রামে পৌঁছাতে কমপক্ষে চারঘন্টা লেগে যাবে। এত রাতে যাওয়াটা কি ঠিক? তুই-ই বল।’

রোজার বিরক্ত লাগছে। আর এক মুহূর্ত এই বাসায় কাটাতে চায় না ও। কিন্তু উৎসের কথা যুক্তিযুক্ত। এত রাতে যাওয়াটা উচিৎ হবে না। সুহানা শেখের তিক্ত কথাগুলো ওর কর্ণকুহরে এখনো বাজছে, হৃদযন্ত্র প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। রোজা সুবিধাবাদী মেয়ে? সোনা হয়ে হীরের দিকে হাত বাড়ায়? এসব অপমানজনক কথাবার্তা শুনেও যদি এ বাড়িতে পরে থাকে তাহলে ওর বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন। গুরুজন বলে সুহানা শেখের মুখের ওপর কিছু বলে নি, তাই বলে কটু কথা সে কিছুতেই মেনে নেবে না। আর রইলো বাকি আদ্রিশ৷ এই লোকটার মুখটাও মাড়াতে চায় না রোজা। নিজের কাজে সফল হয় নি বলে লোক দিয়ে ওকে অপমান করাচ্ছে। সত্যিই যদি ভালোবেসে থাকতো, এমনটি করতে পারতো না। রোজা ধপ করে বিছানায় বসে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে। আজ রাতটা থাকছি, শুধু তোমার অনুরোধে। কিন্তু কাল ভোর ভোর আমি নিয়ে যাবে। আর যদি থাকতে জোর করো, তাহলে এখনই বেরিয়ে যাব। আর আমি যে চলে যাব এটা বাড়ির কাউকেই জানাবে না, তাহলে ওরা যেতে দেবে না। স্পেশালি খালামণি আর ফিহা আপু। বলো আমার শর্তে রাজি কি-না!’

উৎস কিয়ৎকাল মৌনতা অবলম্বন করে বাধ্য হয়ে রাজি হলো, ‘ওকে। কাউকে কিছুই বলবো না। কিন্তু তোর এ কাজটাতে খুব কষ্ট পেলাম।’

রোজা থমথমে গলায় বলল, ‘আমি দুঃখিত। এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।’

‘আচ্ছা আমি এখন যাই। তুই ভুলেও একা একা চলে যাস না আবার। সকালে আমিই নিয়ে যাব।’

‘ঠিক আছে।’

উৎস ব্যথাযুক্ত পা-টা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলে গেল রোজার ঘর থেকে। গোছগাছ করা ব্যাগপত্র যাতে কারোর চোখে না পড়ে সেজন্য বিছানায় নিচে লুকিয়ে ফেলল রোজা৷ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও মনে শান্তি নেই। ব্যলকনিতে গিয়ে বসে রইলো। রাতের অবারিত সৌন্দর্যের পানে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। বিষে বিষে বিষক্ষয়। নিজের মনের গহীনে লুকানো হাজারো কথামালায় মোড়ানো মনটিকে ঊর্ধ্বপথে ছুঁড়ে মারলো। ওরাও যেন ডানা মেলে ওড়ে গেল গভীর অন্তরিক্ষে। আচ্ছা, আকাশ আর নক্ষত্ররাজিদের সাথে কি কথা বলা যায়? ওরা বুঝতে পারে মানুষের মনের ভাষা? জানা নেই রোজার।

—————————————————————-

আদ্রিশদের বাড়িতে কেমন আমেজ আমেজ একটা ভাব। নিচতলার মেহমান ও বাড়ির লোকজনদের হৈচৈ, কোলাহল শোনা যাচ্ছে। হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠেছে দুই পরিবারের লোকজন। মাঝারি আকারের ডাইনিংরুমে সকলে একসাথে খেতে বসেছে। মুরুব্বিরা খাওয়াদাওয়া সেরে আগেই ওঠে গেছে। রোজা আর উৎস বাদে বাদবাকি সবাই টেবিলে বসে পড়েছে। ওদের দু-জনের কথা কারোর খেয়ালেই নেই। ডাইনিং টেবিলে নেহার দু-পাশ ঘিরে খেতে বসেছে রিজভী আর ওর ছোটবোন ইমতি। শক্ত-সামর্থ্য, সুদর্শন চেহারার ছেলেটির নামের পাশে নিজের নামটা বসতে চলেছে ভেবেই মুখবিবরে একছিটে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়লো নেহার। আকাশরঙা জামদানী শাড়ির পাড়টা মাথায় ঘোমটার মতো করে জড়ানো, সেটা আরেকটু টেনে লম্বা করে লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া চেহারাটা লুকাতে চাইলো নেহা। আড়চোখে একবার চোখ পড়লো হবু বরটির ওপর। আশ্চর্য! রিজভীও ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে চলেছে। নেহার চোখে চোখ পড়তেই ওর হাসিটা আরও প্রসারিত হলো। দ্রুত চোখ নামিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো নেহা। ইশ, লোকটা কী ওকে দেখে ফেলল?

আদ্রিশ একপাশে বসে চামচ নাড়াচাড়া করে মন দিয়ে খাচ্ছে। নেহার দিকে ওর খেয়াল নেই। কিন্তু নেহা-রিজভী ওদের দু-জনের কান্ডে বেশ মজা পাচ্ছে ইশা-ফিহা, ইমতিও লক্ষ্য করছে। কানেকানে একজন আরেকজনকে কি যেন বলছে। এমন সময় মিতালি মাংসের বাটি নিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। পেছনে সুহানা শেখ সবজির তরকারি নিয়ে এলো। মিতালি এসে ওদের পাতে তরকারি দিতে দিতে জিজ্ঞেস টেবিলে একপলক চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী-রে তোরা সবাই এখানে? রোজা কোথায়? উৎস খেতে বসেনি?’

এবার যেন সবারই ওদের কথা মনে হলো। ফিহা লোকমা তুলতে তুলতে বলল, ‘রোজাকে তো অনেকক্ষণ ধরে দেখছি না, আর উৎস ভাইয়াও তো কখন ওপরে ওঠে গেল।’

নেহা মুখ তুলে চাইলো। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ব্যাপার কী? রোজাকে ঘণ্টা খানিক ধরেই দেখতে পাচ্ছি না।’

ফিহা নম্র স্বরে বলল, ‘আমি তো তোমাকে নিয়ে নিচে আসার পর আর ওপরেই যাই নি।’

ইশা বলল, ‘ও তো মনে হয় নিচেই নামে নি। চারপাশের ব্যস্ততায় খোঁজ নিতেই ভুলে গেছি।’

নিশিতা দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সবকিছু শুনে এবার ব্যস্ত হয়ে ওঠলেন। নিজের মেয়ের এনগেজমেন্টের চক্করে রোজার কোনো দেখাশোনাই করতে পারছেন না আজকাল তিনি। মেয়েটা একটু চুপচাপ, একা থাকতে পছন্দ করে। তাই রোজাকে তেমন ঘাটান না তিনি। ব্যস্ত কন্ঠে এবার ফিহাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘গিয়ে দেখ না একবার, এতকিছু হয়ে গেল মেয়েটা নিচেই নামলো না এখনো। খাওয়াদাওয়াও করে নি, দুপুরেও তো পেটে কিছু পড়েনি। শরীরটা তো এবার খারাপ হয়ে যাবে। সন্ধ্যায় আজ চা-টা দিতেও ভুলে গেছি।’

সবার কথাবার্তা কর্ণগোচর হলো রিজভীর বোন ইমতির। এবার ক্লাস নাইনে ওঠেছে সে। ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ায় যারপরনাই খুশি ও। এমনিতে ইমতি খুব চটপটে এবং এক্সট্রোভার্ট। ইতোমধ্যেই বাড়ির সবার সাথে ও সখ্যতা গড়ে তুলেছে। সবার এত ব্যতিব্যস্ততা দেখে কৌতূহলবশত বলেই ফেলল, ‘আপনারা কার কথা বলছেন?’

পাশ থেকে ইশা বলে ওঠল, ‘আমাদের রোজানু। নেহা আপুর খালাতো বোন, মানে আপনার আরেকজন শালি!’

ইমতি হেসে রিজভীর দিকে তাকালো। রিজভীও খানিকটা অবাক হয়ে গেল। বোনের অযথা প্রশ্নে বাড়ির লোক নারাজ হয়েছে ভেবে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে ডান-হাতটা টেবিলের ওপর রেখে সে বলল, ‘ওহ আই সী! আসলে আমার এক কাজিনের নাম ‘রোজা।’ আপনাদের মুখে হঠাৎ নামটা শুনে কৌতূহল জাগ্রত হলো। কিছু মনে করবেন না ইমতির আচরণে।’

উপস্থিত সবাই ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে জানান দিলো ওরা কেউকিছু মনে করে নি। কিন্তু সুহানা শেখের মুখে আঁধারের বুকে ওড়ে বেড়ানো কালচে ভারী মেঘভেলা দাপটের সহিত খেলে বেড়াচ্ছিলো। রোজা মেয়েটাকে তাঁর একটুও পছন্দ নয়। ইশার মুখে রোজার প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগতো তার। কিন্তু প্রশংসা করতে করতে হুট করে ইশা যখন মায়ের কাছে রোজার প্রতি আদ্রিশের ব্যবহার, কেয়ার, অন্যরকম অনুভূতি গুলো বর্ণনা করতে লাগলো তখনি অন্তর জ্বলে ওঠলো তার। আদ্রিশকে তিনি নিজের পুত্রের চেয়ে কমকিছু ভাবেন না, বরং এরচেয়ে বেশিই ভাবেন। সুদর্শন, সু-স্বভাব এবং আদ্রিশের ব্যবহার বরাবরই তার পছন্দ। বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলে বলে, একমাত্র ফুফু হিসেবে আদ্রিশের ওপর অধিকারটাও যেন তারই বেশি। মনে মনে নিজের মেয়ে ইশার বিয়ের জন্য আদ্রিশকে চান তিনি। একদিন ইশার কানে কথাটা ঘুরিয়ে-প্যাচিয়ে ওঠালেও তাতে লাভ হয় না খুব একটা। ইশা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে ভাই-বোনের সম্পর্ক যেমন আছে তেমন থাকাটাই ভালো, কাজিনদের মধ্যে বিয়ে করার রীতিটাকেই ওর সহ্য হয় না৷ কতশত সমস্যা হয় এসব মা বুঝবে না। তার চেয়ে বড় কথা আদ্রিশকে সে কখনো ভাই ছাড়া অন্য নজরে দেখে নি। সুতরাং, এই প্রস্তাব দ্বিতীয়বার ওঠালে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে দ্বিধাবোধ করবে না সে। মেয়ের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার মোটেও পছন্দ হয় নি সুহানা শেখের। মায়ের মতামতের ওপর মেয়ের কথা কী? ওর ভবিষ্যৎটা সিকিওরড করার জন্যই তো প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন তিনি। ইশা রাজি না থাকায় আজও মেয়ের প্রতি চাপা ক্ষোভ আছে সুহানার। রোজা নামের মেয়েটার জন্য নেহার আগের বিয়েতে ঝামেলা হয়েছিল। এখন যখন আদ্রিশ রোজার প্রতি ডেস্পারেট, তিনি তা সহ্য করতে পারছেন না। কথার ছলে নেহার বর রিজভী আর ওর বোনটাও কেমন মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করেছে, সবাই পায় টা কী মেয়েটার মধ্যে? বলতে নেই, মেয়েটার সৌন্দর্য, রুপ-গুণ দেখে মনে মনে নারাজ তিনি। নিজের মেয়ে ইশা এতোটাও সুন্দরী নয় বলেই কি আদ্রিশের নজর ওর ওপর পড়ে নি?

————————————————————-

——————————–

[
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here