#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৪
মাথা নাড়িয়ে নৌকা চলমান করলো। আরশি তার ভেতরকার অনুভূতি থেকে এখনো বের হতে পারে নি। পুনরায় আবার হাত রাখলো। এবার মাটির সংস্পর্শ পেল না। হাতটা আরেকটু নিচে দিলো। এবারও পেল না। আরেকটু গভীরে হাত দিতেই উল্টে যেতে নিলো নৌকা। পড়ে যেত নিলো আরশি। মাঝি ছেলেটা আরশির হাত ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। বিনিময়ে চুল ধরলো। অপূর্বের দেওয়া ব্যাথার সাথে যোগ হলো। তার ধ্যান ভাঙল ছেলেটির কথায়।
-” এইটা হচ্ছে রানী পাথর আর ঐযে দেখছেন, ওটা রাজা পাথর। আমাদের বিশ্বাস এই দুই পাথর, আমাদের এই সাঙ্গু নদীকে ঘিরে রয়েছে। এই পাথরকে কিছু বললেই, নদীর গতি প্রবল হয়ে উঠে। ভয়ানক আকার ধারণ করে!”
আরশি পাথরের দিকে চেয়ে রইল নীরব দৃষ্টিতে। বড় বড় পাথর দুটির মাঝে দিয়ে নৌকা চলছে। ডানে সর্বপ্রথম রানী পাথর, অতঃপর বামদিকে রাজা পাথর। বলে,
-” এইসব কি আদোও সম্ভব?”
-” জানি না, তবে আমার বিশ্বাস। সম্ভব।”
_______
৯টা পঁয়তাল্লিশ। নৌকা এসে থামলো দোকানের সামনে। আমরা চারজন সহ ছেলেটিও নাস্তা করে নিলাম। দুইটা পাহাড়ি কলা, একটা ডিম। অতঃপর আবার ছুটল।
বারোটা সাতান্নতে আমরা রেমাক্রি হয়ে নাফাখুম এসে পৌঁছেছি। দুপুরের খাবার খাবো মাঝি ছেলেটি পেমম্প্রোর বাড়িতে। একটু রেস্ট নিয়ে যাবো প্যারাসেলিং করতে। নাফাখুম ঝর্নার থেকে অদূরে অবস্থিত তাদের বাড়ি। বেশ ভালো লেগেছে তাদের।
আমি আর আরশি দাঁড়িয়ে আছি নাফাখুম ঝর্নার কিছুটা দূরে। স্তরে স্তরে পানি নদীতে মিশে যাচ্ছে। পানির ঝুমঝুম শব্দে শ্রবণ শক্তি লোপ পেয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও আরশি বসে আঁকি ঝুঁকি করছে। সে কিছুতেই নামবে না। ইতিমধ্যে নেমে পড়েছে অরিশ ভাইয়া আর অপূর্ব ভাইয়া। তাদের পড়নে লাইফ জ্যাকেট। বাকি দুটো পাড়ে পড়ে আছে। আমি জামার উপরে পড়ে নিলাম। ওরনাটা গলায় পেঁচিয়ে বললাম,
-” আরু, আমরা আর এখানে আসতে পারবো কি-না জানি না। তবে মনে হয় না আসা হবে। জানি না তোর কি হয়েছে, তোর তো প্রবল ইচ্ছে ছিল নাফাখুম ঝর্নার ভেজার। আয়।”
আরশি গাছের শুকনো ভেজা ডাল দিয়ে মনের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করছে। আমার কথন শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছাতেই ফিরে চাইলো। হাতের শুকনো কাঠিটা পানিতে ফেলে হাত ঝাড়া দিলো। উঠে আমার সন্নিকটে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে বলল,
-” খুব ইচ্ছে ছিলো। এখন আর নেই। তুই ভিজ। আয় তোকে জ্যাকেট টা পড়িয়ে দেই।”
বলেই এগিয়ে এসে জ্যাকেট পড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি নিঃপ্রান হয়ে চেয়ে রইলাম আরশির মুখশ্রীর পানে।
ঝাঁপ দিলাম হিম শীতল অম্বু ধারাতে। পানিতে পা স্পর্শ করে ভেসে উঠলাম উপরে। কিন্তু লাইফ জ্যাকেটের ক্রুটি থাকার কারণে মাথায় উপর দিয়ে ভেসে গেল। এমনিতেই সাঁতার জানি না। পায়ের নিচে মাটির দেখা পাচ্ছি না। গলা ফাটিয়ে ভাইয়া ভাইয়া চিৎকার করলাম। কিন্তু আমার চিৎকার শ্রবণ হলো না কারো কর্ণপথে। অম্বুর তলদেশে চাপা আর্তনাদ গুলো চাপা স্বরে বয়ে গেল। নাক, মুখ দিয়ে অন্তর্ভাগে প্রবেশ করতে লাগলো পানির ধারা। হাত দিয়ে পানির উপরে আঘাত করে চলেছি। শরীর ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসছে। একসময় কেনো বলিষ্ঠ পুরুষালী হাত আমার কোমর জড়িয়ে ধরলো। পানির উপরে তুলে ধরলো আমায়। শরীরের ভার ছেড়ে দিলাম। পানির উপরে মাথা তুলতেই গভীর ভাবে টেনে নিজের শ্বাস ত্যাগ করলাম। নিভু নিভু চোখে অরিশ ভাইয়ার মুখশ্রী দর্শন করলাম। মনের কোণে সুপ্ত অনুভূতি জানান দিচ্ছে, আমি পুরোপুরি নিরাপদ। এই মানুষটির বাহুডোরে থাকলে আমার ক্ষতি অনিশ্চিত।
লাইফ জ্যাকেট টা আমায় পড়িয়ে দিলেন। সাঁতরাতে সাঁতরাতে তীরে নিয়ে এলো আমায়। উপরে তুললো আমায়। লজ্জায় মাথা নিচু করে করে নিলাম লাইফ জ্যাকেট টা খুলে নিলাম। ওরনা স্রোতের টানে ভেসে গেছে বহুদূরে। নিজের পড়নের ভেজা শার্ট টা খুলে আমার দেহে জড়িয়ে দিলো। মৃদু ঝুঁকে কোলে তুলে নিলেন। সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললেন,
-” তোর আর ভিজতে হবে না। আমার প্রান পাখিটা আরেকটু হলেই উড়ে যেত।”
দূর্ঘটনা ঘটা থেকে মুক্তি মিললেও বিপদ আমার পিছু ছাড়ল না। দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটু রেস্ট নিয়ে অগ্ৰসর হতে লাগলাম পশ্চিমে। প্রতেকের হাতে একটা বাশের তৈরি ওয়াকিং স্টির্ক। প্রতি পদক্ষেপ ফেলার আগে মাটিতে আওড়াচ্ছে। যাতে বিষাক্ত পোকা মাখর থাকলে দূরে সরে যায়।
ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। সরু পথ। সামনে অরিশ ভাইয়া, পেছনে অপূর্ব ভাইয়া। মাঝে আমি আর আরশি। আরশি ফোন উঁচু করে নেটওয়ার্ক খোঁজার চেষ্টা করছে। মামুনি ফোন করেছিলো। হ্যালো উচ্চারণ করার পর নেটওয়ার্ক লো হয়ে কল কেটে গেছে। এখন আর কানেক্ট হচ্ছে না। যতোটা পশ্চিমে যাচ্ছি ততোটা ডিসকানেক্ট হয়ে যাচ্ছে।
লাঠি এক হাতে নিয়ে অন্যহাত বড় বড় লতা টানতে টানতে শিস বাজাতে লাগলাম। আমার শিস বাজানো শুনে পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ তুলছে, কাক কা কা করছে। হাঁটা থামিয়ে দিল ভাইয়া। সাথে আরশিও থামালো। আরস ভঙ্গিতে হাতের ইশারায় বললেন,
-” তোর শিস বাজানো শুনে সাপ, কেঁচো, যোগ সব চলে এসেছে। এবার ওদের সাথে উড়ে যা।”
সাপ কথাটা শুনে থেমে গেল চরণ। সামনের পথ ঘাস দিয়ে ডাকা। ঘাসের উপরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যোগ দেখা যাচ্ছে। হাওয়ার তালে রাবারের মতো শরীর দুলাচ্ছে। সরু রাস্তার পাশের মেহেগুনি গাছের ডালে একটা সাপ ফনা তুলে বসে আছে। বেশ কিয়ৎক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম, এটা দাড়াই সাপ। বছর দুই আগে অরিশ ভাইয়ার জানালায় পেঁচানো ছিল। অবিকল দেখতে এমন একটি সাপ পাওয়া গেছিলো। তার পরে প্রায় এক সপ্তাহ আমি অরিশ ভাইয়ার রুমের দিকে পা বাড়াই নেই। তবে অদ্ভুত ব্যাপার সাপটাকে আঘাত করেনি ভাইয়া, দূর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিল।
অসহায় মুখে বললাম,
-” আমি ওদের সাথে যাবো না। প্লীজ ওদের তাড়িয়ে দাও।”
-” অসুস্থ শরীর নিয়ে কতোকষ্ট করে ওদের ডাকলি। একটু আপ্পায়ন করবি। না! তুই তো ওদের অপমান করছিস। আমি দেশের নাগরিক হয়ে, ওদের অপমান করতে পারি না। ওরা যদি রাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যায়, তাহলে আমাদের দেশের সম্পদ বিলুপ্ত পাবে। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।”
অরিশ ভাইয়া স্টির্কের উপর হাত রেখে নির্বিকার স্বরে বললেন। একসাথে সাপ, যোগ দেখে আমার অবস্থা শোচনীয় আর তিনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, তর্ক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তার নামটা দিয়ে দেই। নিশ্চিন্তে সে প্রথম হবে।
দাঁতে দাঁতের অদ্ভুত ঘর্ষণ সৃষ্টি করে বললাম,
-” তারচেয়ে বরং আপনি ওদের আপ্পায়ন করেন। আমার মতো পিচ্চি মেয়ে, ঠিকভাবে আপ্পায়ন করতে পারবে না। আপনি তো দায়িত্ব প্রাপ্ত নাগরিক, আপনিই করুন।”
-” তুই পিচ্চি।” ভ্রু নাচিয়ে বলল অরিশ ভাইয়া।
-” কোনো সন্দেহ আছে।”
মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বোঝালেন তিনি। লাঠির মাথায় সাপ পেঁচিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে মারলেন। আমি এক চিৎকার করে বসে পড়লাম সেখানে। অপূর্ব ভাইয়া এগিয়ে এলেন। চোখ রাঙিয়ে বললেন,-” সাপটা তোর প্যাকেটে রাখ, বাড়িতে গিয়ে গ্রিল করে খাস। এখন চল বাবা।”
সাপটা আস্তে করে দূরে রাখলেন। জিন্স হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে রাখলেন। ব্যাগ থেকে স্যাভলন বের করে হাতে পায়ে এমনকি স্টির্কে মেখে নিলেন। হাঁটলেন সামনে। আমরাও তার দেখানো পথ অনুসরণ করে আগালাম।
.
.
অবশেষে আমরা এসে পৌঁছালাম আমাদের কাঙ্খিত জায়গায়। পাহাড়টা বের বড়। চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। প্যারাসেলিং এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতিমধ্যে সাইন করে নিয়েছি আমি আর আরশি। প্যারাসেলিং টিম আমাদের আকাশে উড়ানোর চেষ্টা করছে। মিনিট পনেরোর ভেতরে আকাশে উড়ন্ত পাখির মতো উড়তে সক্ষম হলাম। উপর থেকে বান্দরবান শহরকে ভিন্ন এঙ্গের থেকে চেনা যায়। একদমই আলাদা। আরশি ভীত হয়ে নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে রয়েছে। তার সূচালো নখের আঘাতে আমার হাত আঘাত প্রাপ্ত।
সবকিছু বেশ ভালোই চলছিলো। আমার এই ইচ্ছেটাই আমার কাল ডেকে আনল। বেশ কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর হুট করেই বন্য শিকারীদের তীর এসে লাগলো প্যারাসেলিং এ। ধীরে ধীরে উল্টে যাচ্ছিলো। অতিশয় ভয়ে গুটিয়ে গেলাম আমি। পাহাড়ের পাদদেশে হাওয়ায় বেগে পড়তে লাগলো প্যারাসেলিং। সাথে সাথে প্যারাসেলিং টিম একশন নিলো। উপর থেকে ঝুলে রইলাম। তদানীং অনুভব করলাম জালের মতো পেচালো রশি গুলো ছিঁড়তে লাগল। উদ্ধার টিম আমাদের নিকট পৌঁছানোর পূর্বেই নিচে পড়ে গেলাম আমি।
পশ্চায় থেকে ভেসে এসে ছিল চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ।
#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৫
নিজের ডান হাতটা বক্ষের বাম পাশে অবস্থান করছে। অন্য হাতটা শূন্যতায়। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। চোখের পাতা দুটো স্থির খাদের দিকে। চোখের অশ্রু টলটল করছে। কিয়ৎক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে অনুভূতি হীন চেয়ে করলো। অপূর্বের কাঁধে হাত রেখে অন্য হাতে অপূর্বের হাত ধরলো। মৃদু শব্দে বলল,
-” আমার বোনটাকে দেখিস অপু।”
অপূর্বের মুখ কদাচিৎ ফাঁক হয়ে এলো। কিন্তু শব্দটি উচ্চারণ করার আগে অরিশ ঝাঁপ দিলো খাদে। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। অনুভূতি শূন্য হয়ে ধপাস করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো অপূর্ব। তার বোনটাকে রক্ষা করতে এসে, ব্যর্থ হলো সে। অরিশের শেষ উক্তিটি ভেবে নিজেকে সংযত করে রাখল। আরশির কথা মস্তিষ্কে সচল হতেই খুঁজতে উদ্বেগ হলো।
রেসকিউ টিম আরশিকে জ্ঞানহীন অবস্থায় উপরে তুলে নিয়ে এলো। পাহাড়ের উপরে শুইয়ে রাখল তাকে। ভীত হয়ে হিতাহত জ্ঞান হারিয়েছে সে। অপূর্বের ফট করে উঠে বসলো। আরশির মাথাটা নিজের কোলের উপর রাখল। গালের উপর মৃদু শব্দে চপল মেরে বলল,
-” আরু, এই আরু! কিছু হয়নি তোর, এই তো আমি দেখ।” রেসকিউ টিমের মেন লোকটির দিকে চেয়ে বললো,
“কি হয়েছে ওর। খুকি, আমার খুকি কোথায়? ওকে পাননি?”
-” স্যরি স্যার, আমাদের পৌঁছানোর পূর্বেই তিনি রশি ছিঁড়ে পড়ে গেছেন। আমরা তাদের খোঁজার চেষ্টা করব। তবে এতো উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে গেলে কেউ বাঁচতে পারে না। কিন্তু..
“বাঁচতে পারে না” কথাটা তীরের ন্যায় বুকে আঘাত হানলো অপূর্বের। নিজের সামলে আহত স্বরে বলে,
-” কিন্তু, কিন্তু কিসের অফিসার?”
-“পাহাড়ের ঐ পাশের দিকটায় ঘন বন জঙ্গল। পাহাড়ের পাদদেশে পলি সঞ্চিত হয়ে সমতল ভূমির সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে অসংখ্য গাছ গাছালি রয়েছে। সেখান থেকে পাহাড়ের উচ্চতা বেশি নয়। তাই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি।”
অপূর্ব চোখ জোড়া গ্ৰথণ করে শান্তির তৃপ্তিকর শ্বাস ত্যাগ করলো। অরিশ তার ছোট্ট বোনটাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তার কোনো ক্ষতি সে হতে দিবে না। অপূর্বেরও একটা দায়িত্ব রয়েছে। অরিশ তার বোনটা রক্ষাকবচ। তাকেও আরশির রক্ষাকবচ হতে হবে।
কাঁধ ব্যাগ পানির বোতল বের করলো। ছিপি খুলে হাতের করতলে নিয়ে বিন্দু বিন্দু করে ছিটিয়ে দিলো মুখশ্রীতে।
________
রাত্রি গাঢ় হয়ে উঠেছে। মেঘের উপস্থিতি নেই আকাশে। চাঁদও অনুপস্থিত। তবুও শিশির ঝরে পড়ছে। গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে দিয়ে মাটি স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে। পাতার ফাঁকে আঁটকে অতঃপর পাতা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে মাটিকে পড়ছে। হিম শীতল পানি চোখের উপর পড়তেই নড়েচড়ে উঠলাম আমি। নিভু নিভু চোখ মেলে তাকাতেই গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে আকাশ দৃষ্টিগোচর হলো। ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। নিজেকে গাছের ডালের উপর অনুভব করলাম। চারিদিক নিস্তব্ধ, নির্জন, জনশূন্য হীন। ভীত হয়ে শীতল হয়ে এলো শরীর। গাছের ডাল আঁকড়ে ধরলাম। শরীরে ব্যাথা অনুভব করলাম। মাথা চেপে মিনিট কয়েক ভাবতে স্মৃতিনন্দন হলো সবকিছু। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া অবধি সবকিছু। বুঝতে বাকি রইল না আমি মরে ভূত হয়ে গেছি। আর যাই হোক এতোটা উচ্চতা থেকে পড়ে বাঁচা সম্ভব নয়। হঠাৎ মনের অদ্ভুত এক আকাঙ্ক্ষা জায়গা করে নিল। নিজের গ্ৰামে ফিরে দিদাকে ভয় দেখানো। দুপাশের ডাল দৃঢ় করে ধরে পা দুলিয়ে গান ধরলাম।
আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে,,
আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।
পরবর্তী লাইন ধরার আগে দৃষ্টি গেল নিচের দিকে। জোনাকির নিভু নিভু আলোয় দেখা মিললো আবছা একজন মানবের। গাছ থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়েও দিলাম না। যদি ভূত দেখে পৃথিবী ত্যাগ করে। আমার শত্রুতা তো দিদার সাথে, অন্য কারো সাথে নয়।
আমার কাঁধে ব্যাগ। তবে খাবারের ব্যাগ আরশির কাছে। গাছের উঁচু ডাল ধরে দোলালাম। টপ টপ করে পানি নিচে পড়তে লাগলো। সেই মানুষটির চোখ মুখেও পানি পড়ছে। একসময় জ্ঞান ফিরে পেল সে। উঠে বসলো। কিয়ৎক্ষণ জিম মেরে বসে রইল। অতঃপর এদিক ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক খুঁজলো। বলতে শুরু করল,
-” তরী, এই তরী! কোথায় তুই?”
চির পরিচিত কষ্ঠস্বর শুনে কম্পিত হলাম আমি। অরিশ ভাইয়া আমার জন্য পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। কিন্তু আমি যে ভূত হয়ে গেছি। ঠোঁট উল্টে বললাম,
-” ভাইয়া।”
অরিশ ভাইয়া উপরের দিকে চাইলো। আঁধারের মাঝে চেয়ে রইলো আমার পানে। তার চোখ মুখ দেখা যাচ্ছে না। ক্লান্তিমাখা গলায় বলল,
-” তরী, কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস তো? গাছে উঠেছিস কেন? নেমে আয় বলছি? পড়ে গেলে হাত পা ভেঙে যাবে।
আমাকে যদি উপরে উঠতে হয়, তাহলে তোর হাড়গোড় সব ভাঙবো। গেট ডাউন কুইকলি।”
প্রথম কথাগুলো করুন শুনালো। অন্তরন কথাগুলোতে ক্ষোভ ছিলো। শেষে কি-না ভূত হয়ে মানুষের ঝাড়ি শুনছি। ইচ্ছে তো করছে, তার ঘাড় মটকে দেই। বিরবির করে বললাম,
-” হি হি হি! আমি তো মরে গেছি। ভালোই হয়েছে, বেঁচে থাকতে অরিশ ভাইয়া আমাকে প্রচুর জ্বালিয়েছে। এবার ভূত হয়ে তাকে জ্বালাবো।”🧛♀️
বলেই উপর থেকে অরিশ ভাইয়ার উপরে ঝাপঁ দিলাম। আর যাই হোক, ভূত ব্যথা পায় না। অরিশ ভাইয়া দুহাতে পেঁচিয়ে নিলেন আমায়। চেয়ে রইলেন আমার চোখে। বিলাই চোখের মাঝে শত বছরের তৃষ্ণা লুকিয়ে আছে। দম মেরে বললেন,
-” তোকে আমি যেই কাজটা করতে বারণ করি, তুই সেই কাজটাই করিস। আমাকে অসহায় করে দিস। এরপর আমার অবাধ্য হলে তোকে পানিতে চুবিয়ে রাখব। রিমেমবার ইট, স্টুপিট।”
-” তুমি আমাকে পানিতে চুবিয়ে রাখবে। তোমার আমাকে চুবানোর দরকার নেই। আমি নিজেই পানিতে ডুবে থাকবো। বিকজ, গোস্ট নেভাব ডাই।”
তাজ্জব বনে গেলেন তিনি। দুহাত ফাঁক হয়ে এলো কদাচিৎ। ধপাস করে নিচে পড়ে গেলাম আমি। ব্যাথায় কোমর টা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমার মুখোমুখি বসে বললেন,
-” এমনিতেই এতো উঁচু থেকে পড়ে শরীরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে। আবার তুই না-কি ভূত। হাউ ফানি, তোর মতো অপদার্থের ভূতলোকেও জায়গা নেই।”
এতোক্ষণ বোধগম্য হলো আমি মরে ভূত হয়ে যাই নি। তাহলে গাছে কি করছিলাম।
.
.
পাশাপাশি হাঁটছি আমরা। অরিশ ভাইয়া একহাতে আমার হাত শক্ত করে ধরে অন্য হাতে ফোনের সিগন্যাল খুঁজে যাচ্ছেন। অপূর্ব ভাইয়াকে জানাতে পারতেন আমরা ঠিক আছি, সাথে তারা কেমন আছে সেটাও জানা যেত। আজকে আমাদের ফেরার কথা ছিলো।
পরিস্কার আকাশে হঠাৎ করে মেঘেরা ধরা দিলো। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। জঙ্গলের পথ কাঁদাচ্ছন্ন হয়ে গেল। আশ্রয় নিলাম তাল গাছের নিচে। আমার টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে বললেন,
-” নড়াচড়া করিস না, ভিজে যাবি।”
কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে সাদা উজ্জ্বল আলো এসে পড়লো চোখে। বেরিয়ে এলো বয়স্ক দম্পতি। ততক্ষণে বৃষ্টির ধাঁচ কমে এসেছে। বললেন,
-” তোমরা কেডা গো বাছারা। এই হানে কি করো?”
-” আমরা টুরিস্ট। এখানে ঘুরতে এসেছিলাম। পথ ভুল করে ফেলেছি আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কোন দিকে যাবো বুঝতে পারছি না।”
-” এদিকে একদম নির্জন। কিছুদূরে কয়েকটা বাড়ি ঘর আছে। তোমার লগে ঐ মাইয়া কেডা? বউ নি!”(বৃদ্ধ লোকটি)
অরিশ ভাইয়া কিছু না ভেবেই ফট করে উত্তর দিলো,
-” হ্যাঁ। আমার বউ। আমরা হানিমুনে এখানে এসেছি!
-” কিন্তু, মাইয়া ডারে ছোড ছোড লাগে। আবার বিয়াত্তা কোনো চিহ্ন টিহ্ন নাই।”
-” দাদা জান, আজকাল কি এইসব কেউ মানে?”
-” তাও ঠিক কইছো। তোমরা চাইলে এইহানে থাকবার পারো।”
কিন্তু বাদ সাধলেন বৃদ্ধা। কোনো প্রমান ছাড়া আমাদের বাড়িতে ঢোকাতে রাজি নয়। কটু করে বললেন,
-” আমি বলি কি, আজকাল অনেক মাইয়া পোলা পলাইয়া যায়গা। এরাও যদি পলাইয়া আইয়া থাহে। আমি কই কি, হেগো আবার বিয়া দিয়া দেন। কোনো ঝামেলা হইলে, আমরা তো প্রমাণ দেখাইবার পারমু।”
___________
ছোট দুইজনের উপযোগী চৌকিতে বসে আছি আমরা দুইজন। বেড়ার ফাঁক দিয়ে শীতল হাওয়া বইছে। ঘরের মাঝে ল্যাম্প জ্বালানো। হলদেটে আলো সবকিছু হলদে দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কেঁদে কেঁটে ভাসিয়ে দিয়েছি আমি। আমার খুশি হওয়ার কথা থাকলেও খুশি হতে পারছি না। বৃদ্ধা লোকটি প্রবেশ করলেন। খাতায় লিখতে বসলেন। বললেন,
– “নাম কি তোমার বাবা?”
-” অরিশ আহম্মেদ।”
-” তোমার নাম কি মা?”
দম মেরে বসে রইলাম খানিকটা সময়। পুনরাবৃত্তি করে একই প্রশ্ন করলেন তিনি। মৃদু শব্দে বললাম,-” তরিন আরাফিন তরী।”
খাতায় কলম চালালেন তিনি। পুনরায় মুখ খুললেন,
-” দেনমোহর কত ধার্য করব বাবা? ৯১ টাকা লিখমু?”
-” না, আমাকে লিখে দিন। যদি কখনো বিচ্ছেদের প্রশ্ন আসে, তখন দেনমোহর হিসেবে আমিই ওর কাছে থাকতে চাই।”
নীরব দৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে বললেন তিনি। ঘনঘন পলক ফেলে চেয়ে রইলাম তার মুখশ্রীর দিকে। চোখাচোখি হলো দুজনার। আমিও দেনমোহর হিসেবে তাকে তাই। সারাজীবনের জন্য চাই, মৃত্যুর পরেও চাই।
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)