অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -২২+২৩

#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২২

হিম শীতল হাওয়া বইছে। ওরনাটা শালের মতো দেহে জড়িয়ে নিয়েছে আরশি। সামান্য একটু বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে গেছে। পা টিপে টিপে অপূর্বের পেছনে হাঁটছে সে। অপূর্ব তার থেকে ঢের দূরে। আর যাই হোক একজন পুরুষের সাথে হেঁটে পারা যায় না। আরশি কোমরে হাত রেখে ঘনঘন শ্বাস নিলো। পেছনে থেকে হতাশাগ্ৰস্থ কন্ঠে বলল,

-” আপনি একটু আস্তে আস্তে হাঁটতে পারেন না। এভাবে ঘোড়ার মতো ছুটছেন কেন? যতোই ঘোড়ার মতো ছুটে নিজেকে ঘোড়ার প্রমাণ করতে চান, আপনি জীবনেও ঘোড়া হতে পারবেন না।”

অপূর্ব পিছু ফিরলো। আরশি এতোটাই জোরে কথা বলেছিলো, অনেকটাই দূরত্ব থেকেও শ্রবণ করা সম্ভব। অপূর্বের দৃষ্টিগোচর হলো না আরশিকে। বিনিময়ে কয়েকপা পিছিয়ে এলো। মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করে বলল,

-” ঘোড়ার মতো ছুটতে হলেও জোর লাগে, চেষ্টা লাগে। এভাবে পিঁপড়ার গাড়ির মতো হাঁটলে জীবনেও নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব না।”

-“আমাকে আপনার পিঁপড়ার মনে হচ্ছে।” ফট করে বলল আরশি। অপূর্ব ঝুঁকলো আমার মুখশ্রীর দিকে। আরশি পিছিয়ে যেতে নিলো। অপূর্ব কোমর জড়িয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। নাকের ডগায় নিজের নাক ঘসে বলে,
-” পিঁপড়া তো গন্ধ শুঁকে নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু তোমার দ্বারা তা সম্ভব নয়।”

বলেই আরশিকে ছেড়ে পথ ধরলো অপূর্ব। আরশি কেবলা ক্লান্তের ন্যায় চেয়ে রইলো অপূর্বের যাওয়ার পানে। ছোপ ছোপ পানির শব্দে হুস ফিরলো আরশির। ঝিরিঝিরি ধারায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। জনশূন্য, নিস্তব্ধতায় ভীত হলো সে। ওরনার ভেতর দিয়ে অন্য হাত চেপে ধরলো। আশে পাশে চেয়ে ছুটলো অপূর্বের পিছু পিছু। হাত পেঁচিয়ে ধরলো তার। করুন সুরে বলে, “আরেকটু আস্তে হাঁটেন না।”

অপূর্ব হাত ছাড়িয়ে নিলো। পায়ের গতি কমিয়ে দিলো। ছোট ছোট পা ফেলে সামনে এগুতে লাগলো আর বলল,

-” চলতে শিখ, নিজেকে গড়তে শিখ। কখনো অন্যর ভরসায় হাহাকার করো না। যার জন্য আশায় বসে থাকবে, দেখবে একদিন সেই মানুষটি নেই। ভেঙে পড়তে হবে। তাই আগে থেকেই নিজেকে গড়তে শিখ।”

-” মাস্টার মশাইয়ের মতো জ্ঞান দিয়েন না তো। যদি এতোই জ্ঞান দিতে মন চায়, একটা জ্ঞানের স্কুল খুলে বসুন না। আমাকে ফ্রি তে কেন দিচ্ছিন, আজব।”

দু’জন ভালোবাসার মানুষ একে অপরের সাথে ঝগড়া করতে করতে গন্তব্যে ছুটে চলছে। তবে তারা অরিশ তরীর খবর পেলো কি-না, তা জানা নেই। তবে দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়াতে বেশ জমে উঠেছে।
________
পাহাড়ি বাতাসে অনবরত উড়ে চলেছে অবাধ্য চুলগুলো। বান্দরবানে ঘুড়তে আসার জন্য কতো বায়না, অভিযোগ, অভিমানের পাহাড় সাজাতে হয়েছিল আমাকে। অবশেষে কাঙ্খিত ইচ্ছেটা পূর্ণতা পেতে চলেছে। কিন্তু এখনো নিদ্রা আচ্ছন্ন হয়ে আছে নয়ন যুগল। ভোর পাঁচটায় নিদ্রা ভঙ্গ হওয়াতে তার রেশ কাটতে বেগ পেতে হচ্ছে। মাথা ভাইয়ার কাধে রেখে এদিক ওদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চলেছি।
উপরের অংশ একদম ফাঁকা। দিনের আকাশের কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্য দেখা যাচ্ছে। হয়তো ভুল করে গাড়িটার নাম রাখা হয়েছে চান্দের গাড়ি। সূর্যের গাড়ি রাখলে বেশ মানাতো। আমাদের সাথে আরো কয়েকটা দম্পতি রয়েছে। জানালা দিয়ে মাথা হেলিয়ে দিলাম। সরু রাস্তা দিয়ে গাড়িটি ছুটে চলেছে। ক্রমাগত উপরে উঠছে। সাড়ি সাড়ি পাহাড় মেঘের গমন পথে বাঁধা দিচ্ছে। ঠান্ডা শীতল বাতাস বইছে।
-” তরী, মাথা ভেতরে আন। দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।”

আমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ভেতরে নিয়ে এলাম। ফুড়িয়ে গেল আরো মিনিট পনেরো। গাড়ি এসে থামলো রাস্তার উপরে। ধীরে ধীরে নিচে নামলে আমার পৌঁছে যাবো শৈলপ্রপাতের কাছে। একে একে নেমে গেল সকলে, সাথে আমরাও পা চালালাম। তবে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। আমার পাকামির ফলে সবকিছু ভেস্তে গেছিলো। বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু রিসোর্টে নয়, থানচি শহরে।

ভালোই চলছিলো সবকিছু। পাহাড়ি শৈলপ্রপাতের পাল দিয়ে হাঁটছি আমি। বাকিরা ইতিমধ্যে পা ভিজিয়ে ফেলেছে। আমি জুতো খুলে ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিলাম পানিতে পা ভেজাবো এই আশায়। কিন্তু ভেজানোর মতো শক্তিটুকু নেই।-” দা ওয়াটার অফ দা ক্লিফ, ইফ দা ফিট আর নট ওয়েট ইউ হেভ টু রিগ্ৰেট। বিকজ উই উইল নট কাম হেয়ার এগেইন।

প্রপাতের পানি এদিক ওদিক ছুঁড়ে অন্যদিকে ফিরে বললেন অরিশ ভাইয়া। তার হাটুর উপরে গোটানো জিন্স। অতিশয় সাহস সঞ্চয় করে পা ভেজালাম পানিতে।
যা হলো তাকে সবাই কিংকতব্যবিমূঢ়। পানিতে পা রাখতেই লাফ দিয়ে ভাইয়ার গলা ঝুঁলে পড়লাম। শরীরের লোম গুলো দাঁড়িয়ে গেছে। সূর্যের আলো এদিকটায় পৌঁছাতে না পারায় হিম শীতল হয়ে আছে। ফ্রিজের ঠান্ডা পানিকেও হার মানাতে রাজি আছে। কদাচিৎ নুইড়ে পড়লেন তিনি। ছুপ ছুপ শব্দে হাত থেকে নিচে পড়লো জুতো জোড়া। কোলে তুলে নিলেন আমায়। ফলস্বরূপ ধড়াম করে পানিতে। অসহায় ভাবে চাইলেন তিনি। দাঁত কেলিয়ে বললেন,
-” আমাকে ভিজিয়া শান্তি হইয়াছেন মহারানী? যদি হইয়া থাকেন, তাহলে দয়া করিয়া উঠিয়া দাঁড়ান।”

ঠান্ডা পানিতে চরণ দুটি ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। অরিশ ভাইয়ার হাত টেনে তাকে দাঁড় করালাম। এতোটাই ঠান্ডা ছিল, মুহুর্তেই তার চোখ মুখের অবস্থা শোচনীয়। নয়ন যুগল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ঠান্ডায় রীতিমত কাঁপতে লাগলো সে। কিয়ৎক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে অসহায় হয়ে বললেন,

-” অপূর্ব, তুই ওদেরকে নীল দিগন্ত, নীলগিরি, চিম্বুক দেখিয়ে নিয়ে আয়। আমি থানচি চলে যাই। এই পানি বহমান, কোথা থেকে কি নিয়ে এসেছে। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।”

বলেই উল্টো পথে হাঁটা ধরলেন তিনি। কি হলো জানা নেই আমার। হুট করে ভাইয়ার হাত ধরে ফেললাম। অশ্রুদয় চিকচিক করছে চোখের কোণে। পলক ফেললেই গড়িয়ে পড়বে। অশ্রুসিক্ত নয়নে বললাম,

-” ভাইয়া, আমিও যাবো।”
তার এক কথা, ঘুড়তে এসে শুধু শুধু সবকিছু একজনের জন্য বন্ধ করে বসে থাকতে রাজি নয়। কিন্তু আমার জন্যই ভাইয়ার এই অবস্থা। প্রকৃতি দেখায় মনযোগী হওয়া দায়। ভাইয়াকে জোড়াজুড়ি করতেই রাজি হয়ে গেলেন তিনি। অপূর্ব আর আরশি আমাদের ছাড়া ওখানে থাকতে রাজি নয়‌। তাই আবার থানচি শহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। তিনটা নাগাদ থানচি শহরে এসে পৌঁছালো তারা। মাঝপথ বৃষ্টি হয়েছিলো বিধায় গাড়িতে সমস্যা হয়েছিলো, তারউপর বিজিবি ক্যাম্পে এন্ট্রি করানো।

সকালে কিছু না খাওয়াতে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল সকলে। তাই ছোট একটা খাবারের দোকানের গিয়েছিলো তারা। ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজে খিচুড়ি আর সাঙ্গু নদীর পাবদা মাছ। আরশি অপূর্ব একটু খেয়েছিল। পারি নি আমি আর অরিশ ভাইয়া। তাই খাবার প্যাকিং করে আনা হয়েছে। বিকেল যখন চারটা পঞ্চাশ তখন খুঁজে খুঁজে থাকার উপযোগী একটা রেস্ট হাউস পাওয়া যায়। দুটো রুম ভাড়া নেওয়া হয়েছে। একটায় অরিশ আর অপূর্ব ভাইয়া আর অন্যটায় আমি আর আরশি।

_______________
আজকের দিনটা শুধু জার্নি করতে করতে কেটে গেছে। দর্শনীয় স্থানগুলো চোখের পাতায় একবার গহীন নয়নে চেয়ে দেখেছিলাম। ঠান্ডায় অরিশ ভাইয়ার অবস্থা শোচনীয়। কাঁশতে কাঁশতে দাড়ি ওয়ালা গালগুলো স্পষ্ট লাল দেখা যাচ্ছে। মেডিসিন খেয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন সে।
আমি দরজার কড়া নড়ালাম। অপূর্ব ভাইয়া জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে চিলেন, আমাকে দেখে সোজা হয়ে বসলেন। ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। উড়ন্ত চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে নিয়ে আওড়ালাম,

-” ভাইয়া যদি আমি একটু..

শেষ করার পূর্বেই হাতের ইশরা থামিয়ে দিলেন আমায়। উপরে শীত নিয়ন্ত্রণ জ্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, -” খেয়াল রেখে।”

আমি মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়িয়ে সায় দিলাম। কিন্তু দৃষ্টিগোচর হলো না তার। প্রস্থান করলেন।
ওরনার তলদেশ থেকে তেলের বোতলটা বের করে বেডের পাশে বসলাম। মাথা নিজের কোলে তুলে তেল দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
নিভু নিভু চোখে আমার সমীপে অবলোকন করলেন তিনি। মৃদু শব্দে বললেন,-” এতোক্ষণে আসার সময় হলো তোর ডিঙিরানী? আমি যে চাতক পাখির ন্যায় হাপিত্যেশ করে রয়েছি।”

হাতের সাহায্যে চোখের পাতা বুজে দিলাম। মাথা বেডের সাথে ঠেকিয়ে দিলাম। তখনও নির্বিকার ভাবে আমার ডান হাত তার চুলের ভাঁজে বন্দী। কখন গভীর নিদ্রা এসে চোখের পাতা ভারী করে ফেলেছে জানা নেই। গভীর থেকে গভীরতর হয়ে এলো নিদ্রা।#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৩

পিট পিট করছে চোখের পাতা। এদিক ওদিক ফেরার চেষ্টা করছে আরশি। বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। বিরাগী হয়ে চোখ মেলে তাকালো। নিভু নিভু চোখ পরিস্কার হয়ে উঠতেই ভরকে গেল সে। তার বক্ষে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে নিদ্রাচ্ছন্ন অপূর্ব। তার এক বলিষ্ঠ পুরুষালী হাত আরশির জামা ভেদ করে উন্মুক্ত পেট স্পর্শ করে আছে। আরশি অপূর্বের শার্ট চেপে ধরলো। নিদ্রা ভঙ্গ হতেই অজানা, অচেনা অনুভূতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে। নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেল বহুলাংশে। বক্ষে ধুকপুকানি বেড়ে অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। নিজেকে সংযত করার বৃথা প্রচেষ্টা চালালো কিয়ৎক্ষণ।

অপূর্বের আসার উৎস খুঁজতে দরজার দিকে অবলোকন করলো আরশি। দরজা ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দেওয়া। তরী রুমের কোথাও নেই। রাতে একসাথে শুয়ে ছিলো। মাঝরাতে হয়তো তরী অরিশের রুমে গিয়েছিল বিধায় অপূর্ব তার রুমে এসেছে। অসন্তুষ্ট হয়ে অপূর্বের দিকে দৃষ্টি মেলালো। নিজের আরো একবার হারিয়ে ফেললো চির পরিচিত মুখের মাঝে। অপূর্বের মুখে তেলাক্ত আভা ফুটে উঠেছে। নাকের ডগা কালচে হয়ে গেছে। চুলগুলো লেপ্টে আছে ললাটে। নাকের নিচে অবস্থান করা লালচে তিলটা জোনাক পোকার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। শার্টের উপরের তিনটে বোতাম খুলে উন্মুক্ত হয়ে আছে বুক্ষের পুরো অংশ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি চোয়ালে, লোমহীন বুক। কোথায় একটা শুনেছিল আরশি, যাদের বক্ষে লোম নেই তাদের অন্তরে দয়া মায়া বলতে কিছু হয় না। এতো দিনের কুসংস্কার আজ চরম সত্য হিসেব অন্তরে টহল দিচ্ছে।
হঠাৎ দৃষ্টি বক্ষের বাম দিকে যেতেই চমকে উঠলো আরশি। অপূর্বের বুকের বামদিকে পুড়ে যাওয়া দাগ দেখা যাচ্ছে। আরশি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো অপূর্বের পানে। চোখ ভর্তি হয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। হাত ছুঁয়ে দিলো দাগের উপরে। এই দাগটা আরশির জন্য হয়েছিলো।‌ যখন তার বয়স সাত বছর, তখন জলন্ত কয়েল রাগের বশে অপূর্বের বুকে চেপে ধরেছিলো।

অপূর্ব নড়েচড়ে উঠলো। নিভু নিভু চোখে আরশির দিকে অবলোকন করে সরে গেল। আরশি পূর্বের ন্যায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নীরব দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ নয়ন তৃষ্ণা মেটালো। অতঃপর হুট করে পেছন থেকে শার্ট টেনে দৃশ্যমান করলো কোমরের দিকটায়। কাঙ্খিত চিহ্ন টা পরিদর্শন করলো। অস্ফুট স্বরে আনমনে বলে উঠে,
-” তারু ভাইয়া।”
ফট করে উঠে বসলো অপূর্ব। পড়নের শার্ট টার খোলা বোতামগুলো লাগিয়ে নিলো। হাত দিয়ে চুলগুলো গুছিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলে, -“ক-কি।”
আরশিও উঠে বসলো। সন্দিহান স্বরে বলল,

-” কি নয় কে? কে আপনি? অপূর্ব না-কি তারুণ্য, আমার তারু ভাইয়া?”

-” কিসব যা-তা বলছো তুমি? আ-আমি অপূর্ব। গ্যাং স্টার অপূর্ব।

-“তোমাকে আমি তেমন চিনি না ভাইয়া, তবে আমার চেয়ে কেউ ভালো চিনে না। তোমার কথাই বলে দিচ্ছে, কে তুমি? তোমার বুকের দাগ, জন্ম দাগ তার প্রমাণ।”

অপূর্ব বেশ ঘাবড়ে গেল। কিছুতেই স্বীকার করতে বাধ্য নয় যে, তারুণ্য। আরশিও হার মানতে রাজি নয়। বালিশের ফাঁক দিয়ে ওরনা বের করে, গায়ে জড়িয়ে ছুটল তরীর রুমের দিকে। অপূর্ব বাঁধ সাধল। আরশি ফিরে চেয়ে চাইলো না। হাত ধরলো আরশির। ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল সে।
পুনরায় পা চালালো অরিশের রুমে যাওয়ার জন্য। অপূর্বের ভেতরের কষ্টগুলো চাড়া দিয়ে উঠলো। পেছন থেকে টেনে ধরলো আরশির গলায় পেঁচানো ওরনাটা। পেচ না খুলে আলো পেঁচিয়ে টেনে ধরল।
গলায় আঘাত পাওয়াতে চরণ দুটি থামিয়ে দিলো আরশি। পেছনে ফেরার উদ্যোগ হতেই চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ফেললো অপূর্ব। তার চোখ মুখের অবস্থা বিবর্ণ। চোখ দুটি জলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটছে। ওরনাটা আরো দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলো অপূর্ব। হিংস্র বাঘের ন্যায় গর্জন করে বলল,
-” আমি অপূর্ব মানে অপূর্ব। আবার আমিই তারুণ্য আর বাহ্যিক দিকটা প্রকাশ করতে গেলে তাকে আমি জানে মেরে দিবো..

বলে আরো দৃঢ় করলো। সাথে সাথে খক খক করে কেশে উঠলো আরশি। একদিকে চুলের ব্যাথা অন্যদিকে গলা‌। দুহাত দিয়ে ওরনাটা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করলো আরশি। তেজশক্তি হ্রাস পেতে লাগলো ক্রমাগত। চোখের পাতা উল্টে গেল। গলায় আঁচড়ের দাগ বসলো। মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে দেয়াল ঘেঁষে নুইয়ে পড়তে লাগল আরশি। অপূর্ব নিজের ভেতরে ফিরলো। ওরনার প্যাচ খুলে ফেললো। ততক্ষণে আরশির শক্তি সম্পূর্ণ রুপে হ্রাস পেয়েছে। পুরোপুরি মাটিতে বসে পড়েছে সে। দেয়ালের সাথে শরীর হেলিয়ে সমস্ত ভর ছেয়ে দিয়েছে। কাঁশতে কাঁশতে দম বন্ধ হয়ে আসছে।

অপূর্ব নীরব চাওনিতে চেয়ে রইল। বাক রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিরে এলো ভাবনার জগৎ থেকে। অতি দ্রুত জগ থেকে পানি ঢেলে হাঁটু ভাঁজ করে আরশির মুখের সামনে ধরলো। ক্লান্ত নয়নে অপূর্বের দিকে দূর্বল চাওনি দিলো। মুখ সরিয়ে নিল বিপরীত পাশে। অপূর্ব চিবুক স্পর্শ করলো। পানিটুকু অধরের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দেওয়ার পূর্ব মুহুর্তে অতিশয় ক্ষোভে গ্লাস ফেলে দিলো। ঝনঝন শব্দে অদূরে গিয়ে থামলো।
ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বিরবির করে আওড়ালো,

-” আপনি সত্যিই আমার তারু ভাইয়া তো? তিনি কখনো আমাকে আঘাত করেনি এবং অন্যকেও আঘাত করতে দেয়নি। সে তো উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার জন্য বিদেশি গেছিলো, অমানুষ হতে নয়। আপনি তো একটা অমানুষ, জানোয়ার। আপনার কাছে আপনি আর আপনার বোন ছাড়া কারো জীবনের মূল্য নেই। আই হেট ইউ।

শেষের শব্দ টায় বুক ছিঁড়ে উঠলো অপূর্বের। রক্তে গলার দিকের জামাটা ভিজে উঠেছে। সময় অতিবাহিত হলো কিয়ৎক্ষণ। আরশি মাটি থেকে ওরনাটা তুলে নিল। শুকনো রক্তগুলো মুছে প্রস্থান করলো। যাওয়ার আগে একবার অবধি পেছনে ফিরে দেখল না।
আরশিকে যেতে দেখেই দেয়ালে আঘাত করলো অপূর্ব। হাতের ব্যাথাটা চোখ কুঁচকে সহ্য করে নিলো। না জানি, তার পুচকির কতো কষ্ট হচ্ছে। নিজের উপর বিরক্ত সে। কিন্তু কি করতে পারত সে। যতবার তারুণ্য নামটা শ্রবণ হয়, ততবার সে পুরোনো অতীতে ফেলা আসা ভয়ংকর দৃশ্য গুলো ভেসে উঠছে। প্রিয়শ্রীর মুখটা ভেসে উঠে। তারুণ্য থেকে অপূর্ব হয়ে উঠার সেই দিনগুলো মনে পড়ে।

সেদিনের পেরিয়ে গেছে অনেক মুহূর্ত। দুইজন মানব দুইজনের চাপা অভিমান নিয়ে নিজেদের সংযত করেছে। দেখা হলেও এড়িয়ে চলেছে একে অপরকে। চঞ্চল আরশি হঠাৎ করে গোমড়া হয়ে গেল। সর্বদা নিজেকে সবার থেকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত।
____________
সাঙ্গু নদীর মাঝ দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে বিজিবির নৌকা। মূলত বিজিবির কাছে থেকেই ভাড়া করে আনা হয়েছে। বিজিবি ক্যাম্পের দৃষ্টি সর্বদা আমাদের উপর। পাহাড়ে ঘেরা বনভূমির মাঝ দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। পাঁচজন চলার উপযোগী নৌকাতে আমরা চারজনে চলেছি। পানির উপর থেকে মাটি দেখা যাচ্ছে। তবে প্রবল স্রোতে নৌকা বারেবারে বেঁকে যাচ্ছে। দূরত্ব বজায় রেখে বসে আছি আমরা। চারদিকের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে ব্যস্ত। আরশি আমার সন্নিকটে বসা। চোখ মুখের অবস্থা উদ্ভর। দেহে মোটা শাল জড়ানো। অপূর্ব ভাইয়ার দিকে চোখ ফেরাতেই দেখলাম দৃষ্টি লুকাচ্ছেন তিনি। আরশির কাঁধে হাত রেখে বললাম,

-” কি হয়েছে তোর। এতো নিশ্চুপ হয়ে বসে আছিস কেন!”

-” ভালো লাগছে না, বাড়ির কথা প্রচুর মনে পড়ছে।”

বিশ্বাস হলো না, তবুও জোর করে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা চালালাম। আরশি বাইরে হাত দিলো পানি স্পর্শ করার জন্য। অপূর্ব একবার চেয়ে মলিন কন্ঠে বলে,

-” বাইরে হাত দিও না, পাথরের সংঘর্ষে আহত হতে পারো।”
ফিচেল হাসলো আরশি। বিনিময়ে অবাধ্য হয়ে আরো হাত বের করে দিলো। তার কাছ থেকে পাওয়া যন্ত্রনার কাছে এগুলো তুচ্ছ। অপূর্ব আহত হলো। স্বল্প বয়সী মাঝি ছেলেটা পেছনে ফিরলো। আরশির ফেকাসে মুখ পানে চেয়ে বলল,

-” হাত বাইরে দিয়েন না আপামনি, এম্মে আহেন। আমি আপনেরে বেবাক দেখাচ্ছি।”

আরশি এগিয়ে গেল। বসলো ছেলেটির পালে। ততক্ষণে নৌকা পৌঁছে গেছে তিন্দু, পাথরের রাজ্যে। টানা এক ঘন্টা বিশ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়েছে। ছোট ছোট এবং বিশাল বিশাল পাথর। সেকেন্ড খানিকের জন্য নৌকা থামালো। আরশির দিকে তাকিয়ে বলল,

-” আপা হাত বাড়ান পানিতে।”

আরশি হাত রাখলেই শীতল অম্বুর সংস্পর্শে এসে কেঁপে উঠলো। হাত উপরে তুলতেই দৃষ্টিনন্দন হলো মাটি নখের লেগে আছে। আনমনে বলে উঠে,

-” একদম পানি নেই।”

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here