অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -২০+২১

#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২০

একহাতে বাহু জড়িয়ে বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন অরিশ। হিম শীতল ঠান্ডা রাত্রিতে একই ভঙ্গিতে থাকার ফলে অকেজো হয়ে গেছে দেহ। নড়াচড়া করার মতো শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। যেন ঠান্ডায় কুপোকাত। অরিশ ভাইয়া এলোমেলো চুলগুলোতে ডান হাত দিয়ে আরেকটু এলোমেলো অগোছালো করে দিলাম। চোখের পাতা নিভু নিভু করছে তার। বহিরাগত সূর্যের তেজ হীন হালকা আলো অন্তর্ভাগে প্রবেশ করছে। আকাশটায় সূর্যের আভা ছড়িয়ে পড়ছে, কুয়াশামাখা ভোরে সূর্যের দেখা নেই। গাছ গাছালি গুলো পেছনে ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে।

হাত তুললাম আমি। অরিশ ভাইয়া আরেকটু চেপে গলায় মুখ গুঁজে দিলেন। থেমে গেল আমার ঝটফটানি। কম্পিত দেহটা এবার পুরোপুরি অকেজো। বাম হাতে তাকে বন্দী করে নিলাম। সামনে অবলোকন করলাম। নির্ভাবনায় নিদ্রাচ্ছন্ন সকলে। পায়ের কাছ থেকে বোতল তুলে, একহাতে ছিপি খুললাম। এক ঢোক সমপরিমাণ পানি দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিলাম। দ্বিতীয় ঢোক খাওয়ার আগেই হাত ফসকে বোতলটা নিচে পড়ে গেল। বোতলে অবস্থানরত পানিটুকু গড়িয়ে গড়িয়ে অদূরে চলে গেল।

সময় অতিবাহিত করার জন্য ব্যাগ থেকে মুঠোফোন বের করলাম। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। স্ন্যাপ চ্যাট দিয়ে কুকুর, বিড়াই ইফেক্ট দিয়ে পিক তুলে নিলাম ভাইয়ার। ধীরে ধীরে ব্যাগের ভেতরে রাখতে চাইলেই খপ করে হাত ধরে ফেললেন তিনি। কাঁধ থেকে নিজের মাথা তুলে ভ্রু নাচালেন। তার ভ্রু নাচাতেই আমার হার্ট বিট উর্ধ্বে অবস্থান করলো। বোধগম্য হওয়ার আগেই ফোনটা তার দখলে। ঠোঁট উল্টে গেল আমার। ফোনটা নেওয়ার উদ্যোগ হতেই হাতের দূরত্ব বাড়িয়ে দিলেন। সরিয়ে নিলেন দূরে। ললাট তুলনামূলক কুঁচকে বলেন,

-“হাউ ফানি পিচ্চি! তোর নিজের নামই তো পিচ্চি, পিচ্চি হয়ে আমার সাথে পাঙ্গা নিচ্ছিস কেন?”

কর্ণপাত না করে উঠে দাঁড়ালাম। হাত বাড়ালাম কিন্তু কোনো রুপ উন্নতি হলো না। বাম পায়ের উপরে ডান পা তুলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসলেন। সূচালো কন্ঠে বলেন,

-” একপা নড়াচড়া করলে তোর কান ধরে উঠবস করা ভিডিওটা পৃথিবীকে দেখানোর ব্যবস্থা করে দিবো।”

হাত গুটিয়ে গেল। কদম এক পা পিছিয়ে গেল। পূর্বের স্থানে বসে মাথা নিচু করে নিলাম। আমার পরিশ্রম সবটা ধূলোয় ঝাঁপসা হয়ে গেল। আমার সম্মুখে একে একে সব কয়টা ছবি রিমুভ করে ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিলেন। ফোঁস করে দম বেরিয়ে এলো। সন্তর্পণে ফোনটা ব্যাগের রাখলাম। বাহু ঝাড়া দিয়ে জানালার দিকে সেটে গেলাম। জানালায় মাথা হেলিয়ে, দু হাত বুকে গুঁজে নয়ন জোড়া গ্ৰথণ করে নিলাম। দেহের সাথে দেহ সংস্পর্শে এলো। সেঁটে এসেছেন আমার নিকটে। সন্দিহান হওয়ার গলায় বলেন,

-“পিচ্চি রানী কি আমার উপর রেখে গেল।”

-“না!” একরোখা প্রশ্নের জবাব আমার।

-“তাহলে কি পিচ্চি রানী, খুশি হয়েছে।”

-” না!” এবারও কিছুটা ঝাঁঝালো স্বর।

কিছু বোঝার আগেই বাহু টেনে নিজের সাথে মিলিয়ে নিলেন আমায়। অধরে অধরে ছুঁই ছুঁই করে, ললাটে ললাটে মেলালেন। নিজের ফোনে তেমন অবস্থায় ছবি তুলে নিলেন আমাদের। স্মৃতিশক্তি সচল হওয়ার আগেই ছেড়ে দিলেন আমায়। পেন্সিল আর সাদা আর্ট কাগজ নিয়ে বসলেন। পিকটা স্ক্রিনে রেখে আঁকতে শুরু করলেন নিজের মনের ন্যায়।

কেটে গেল বেশ কিয়ংক্ষণ সময়। সূর্য উপরে উঠে গেছে। গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েছে সে। অভিমানের পাল্লা ভারী হলো দৃঢ়। নিজের সামনে ধরলেন পেন্সিলে আঁকা রং বিহীন এক ভালোবাসার জুটির ছবি। মুহুর্তের মাঝেই অভিমানের বরফের ন্যায় পাহাড় গলতে গলতে তরল পানির রুপ ধারণ করলো। হাতে টেনে নিলাম কাগজটা। হাতে ছুয়ে দেখলাম প্রতিটি বিন্দু। স্তব্ধ হয়ে বাকশক্তির ক্ষয় হয়েছে আমার। আমার ভাবনায় ফোড়ন কেটে বলেন,

-” তাহলে ডিঙিরানীর অভিমান ভাঙলো। এবার একটু হেঁসে আমার আঁকা টাকে সার্থক কর।”

তার শব্দগুলো হারিয়ে যাওয়ার আগেই হাসি উচ্চে পড়লো।
___________
মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেল। বিকেল সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো। পিটপিট করে নয়ন যুগল মেলে তাকালাম। আমি বাসে না থেকে বেডের উপরে ঘুমিয়ে আছি। তখন ভাইয়ার কাঁধে ঘুমিয়ে ছিলাম। ব্যাপারটা সচল হতে বেশ কিয়ৎক্ষণ সময় নিলো। আমার পায়ের কাছে বসে নীরব দৃষ্টিতে কাগজের দিতে তাকিয়ে আছে আরশি। ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। পেপার টা টেনে নিলাম। হকচকিয়ে উঠলো আরশি। আচম্বিতে এমন হওয়াতে বেশ ঘাবড়ে গেল।

এক নজর পেপারের দিকে অবলোকন করতেই টনক নড়ল আমার। মুড়িয়ে মুড়িয়ে চুলের ফিতা খুলে বেঁধে পাশে রাখলাম। আরশির এখনো অস্বাভাবিক নীরব চাওনি। তর্জনী কামড়াতে কামড়াতে বলে,

-” কি এটা ঋনী? কি চলছে ভাইয়ার সাথে?”

শীতের মাঝেও ললাটে জমে এলো লবনাক্ত জলকণা। সংকোচে পড়লাম আমি। দ্বিধা নিয়ে বললাম,

-” তুই যেটা দেখতে পারছিস, তেমন কিছু নয়।”

-“যদি তেমন কিছু হতো, আমার চেয়ে কেউ বেশি খুশি হতো না।”

-“মানে!” বালিশে মাথা রেখে সিলিং ফ্যানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে বললাম।

-“আমি জানি, তোরা একে অপরকে খুব ভালোবাসিস। অপ্রকাশিত ভালোবাসা। কিন্তু একদিন তোদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। আমার ভয়ের জায়গা, মা। তিনি কি সবটা সহজে মেনে নিবে তো?”

সূর্যের আলো বিশাল বিশাল পাহাড়ে বাধ্য প্রাপ্ত হয়ে অন্ধকারের রুপ নিলো। কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে গেল পাহাড়ি অঞ্চল। দুইজন মানব এখনো স্থির। চাতক পাখির ন্যায় হাহাকার করে আছে আরশি নামক মেয়েটি। যেই প্রশ্নের প্রত্যুত্তর আমার কাছে নেই, কি দেওয়া উচিত। ভাঙা স্বরে বললাম,-” অভাগা যেদিকে যায়, সেদিকে সাগর শুকায়। এক তরফা ভালোবাসা গুলো খুব কষ্টদায়ক..

বাক্য শেষ করার আগে মৃদু ছিটকিনি খোলার শব্দ শ্রবণ হলো। উচ্চারণের ইতি টেনে চাইলাম ওয়াশরুমের দরজার সমীপে। বাথরোব পড়ে মেঘলা বেরিয়ে এসেছে। ভেজা চুলে টাওয়াল পেচাতে পেচাতে বেরিয়ে এলো। ছিটকিনি তুলে দিল। পানি মিশ্রিত ছোপ ছোপ পা ফেলে লাকেজ খুলে হাতড়ে নিচ থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জামা কাপড় বের করলো। সন্দিহান স্বরে বলল,
-” নায়িকা সাহেবার ঘুম ভাঙল তবে। নায়ক আজকে কতো মেয়েদের হার্ট ফুট করে দিয়েছে, তার হিসেব নেই। একদম কোলে করে রুমে রেখে গেছে। এতো ভালোবাসা আর আমরা কিছু জানি না। তাড়াতাড়ি..

এবারও পুর্বের ন্যায় দরজায় কড়া নাড়ালো কেউ। মেঘলা অসহায় চাওনি দিলো। জামা কাপড় হাত ফসকে নিচে পড়ে গেল। তোলার মতো সময় টুকু তার হলো না। এক ছুটে ওয়াশরুমের ভেতরে।

দরজা ভেড়ানো ছিলো। স্বল্প বয়সী তরুণী স্টার্ফ প্রবেশ করলো। ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছে। ছোট ছোট পা ফেলে অতি সাবধানতা অবলম্বন করে টেবিলের উপরে রাখলেন। যেমন শব্দহীন প্রবেশ করেছিলেন তেমনি শব্দহীন প্রস্থান করলেন। পরক্ষণে মধ্য বয়স্ক মহিলা প্রবেশ করলেন। প্রতিটি জিনিস সূক্ষ্মভাবে গুছালেন।

অতিবাহিত হলো বহুসময়। দরজার ফোকট দিয়ে ক্রমাগত মাথা হেলিয়ে দিচ্ছে মেঘলা। জামা কাপড় পাল্টে নিল।
মধ্য বয়স্ক মহিলাটাকে বেশ ভালো লাগলো আমার। এক পর্যায়ে তার অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

-” চাচিজান, এই বয়সে আপনি কেন কাজ করছেন?”

তিনি ফিরে চাইলেন আমার সমীপে। হয়তো চাচিজান ডাকাতে ভরসা পেলেন। আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলেন। বললেন,

-” কাম না করলে খাইমু কি? পোলা বউ পাইয়া আমগো চিনে না। হের আবার মেলা অসুগ। যা টাহা পয়সা পাই, হে দিয়া অসুধ কিনতে কিনতেই যায়।‌ হাত পা ধইরা এইহানে কাম লইছি।”

নিশ্চুপ রইলাম আমি। আমার প্রিয় জনদের ভালোবাসার অভাব আর তার টাকার অভাব। ব্যাগ খুঁজে হাজার দুয়েক টাকা পাওয়া গেল। টাকা আর খাবার দুটোই প্যাকেট করে দিয়ে দিলাম। তিনি নীরব অনুভূতি শূন্য চাওনি দিলাম। মাথায় হাত রাখলেন আমার। বললেন,

-” বাইচা থাহো গো মা, বাইচা থাহো। আমার দুয়া একদিন তোমারে বাঁচাইয়া আনবো মৃত্যুর মুখ থেকে।”

নিজের জীবনের মানসিক আঘাতগুলো অনুভূতির অন্তরালে যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলাম। যদি কোনো একাকী প্রহরে নিজের জীবনের ইতি টানতে ইচ্ছে হয়, তখন তার কষ্টের সাথে নিজের কষ্টগুলোর মিশিয়ে, বাঁচার নতুন পথ খুঁজে নিবো।#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২১

রাত নয়টা ছুঁই ছুঁই। ঘর ফাঁকা। জানালার পর্দাগুলো হাওয়ার তালে উঠছে। চোখ ঢলতে ঢলতে আসে পাশে দৃষ্টিপাত করলাম। আরশি, মেঘলা কোথাও নেই। প্রতিটি কক্ষে তিনজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই মেঘলা নামক মেয়েটা আমাদের বাড়িতে রুমেই পড়েছে। বাইরে থেকে হট্টগোলের আওয়াজ আসছে। সারারাত সহ অর্ধেক দিন জার্নি করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়েছিল সকলে। বুঝতে অসুবিধে হলো না, ওরা কোথায়।

জানালা বন্ধ করে দিলাম। ওরনা টা শরীরে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেলাম, সকলে চেয়ার পেতে আড্ডায় বসেছে। ভার্সিটির ইয়ং ইয়ং প্রোফেসর থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রীমহল। আমি গিয়ে ফাঁকা চেয়ারে বসলাম। আমার সোজাসুজি বসে আছেন নিভ্রান স্যার। তার পাশে আমার বন্ধুমহলের সকলে। অরিশ ভাইয়া বারবার ছেলেদের সাথে কথা বলতে বারণ করেছেন। তাই সেদিনই ওদের সাথে ফ্রেন্ডশীপ ব্রেকআপ করেছিলাম। আমার দৃষ্টি যেতেই ঘোলাটে চোখে চেয়ে রইলেন নিভ্রান স্যার। বিরাগী হলাম। বিরক্তি রেখা যখন শীর্ষ প্রহরে পৌঁছালো তখন কানের কাছে ভুম করে উঠলো কেউ। আরশিকে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল। চোখ রাঙালাম‌। রাগ দেখিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সামনে পা বাড়াতেই আমার হাত ধরে পেছন থেকে বলে সে,

-” আমার জায়গায় ভাইয়াকে ভেবেছিলিস তাই তো? সে ঐ দিকটায় আছে। যা..”

-“না।”

না দেখে উল্টো পথে পা বাড়াতেই ধপাস করে পড়ে গেলাম। নিজের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে সবাই তাকালো আমার সমীপে। পরক্ষণেই হেঁসে দিল। লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি। পূর্বের ন্যায় যেভাবে পড়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই আছি। তদানীং রুদ্র কন্ঠস্বর শুনা গেল,

-” লাইক সিরিয়াসলি! একজন মানুষ পড়ে গেছে, আর তোমরা তাকে না তুলে হাসছো। এইসব শিখেছো তোমরা।”

পরক্ষণেই হাত ধরে টেনে তুললেন আমায়। ওরনাটা ভালো ভাবে পেঁচিয়ে দিয়ে চেয়ারে টেনে বসালেন। আদুরে গলায় বলেন,

-” কোথায় লেখেছে দেখি?”

হাঁটুতে প্রচুর জ্বলছে। মুখ ফুটে সবার সামনে বলা হয়ে উঠেনি আমার। আলতো করে হাতটা হাঁটুর উপর রাখলাম। যা বোঝার তিনি অনুমান সাপেক্ষ বুঝে নিলেন।

আরশি মলম নিয়ে এসেছে। সেটা নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। মৃদু ঝুঁকে কোলে তুলে নিলো। আসছি বলে সামনের পথ ধরলেন। পেছনে থেকে অস্ফুট হৈচৈ পড়ে গেল।
শুনশান নিরিবিলি পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠার চেষ্টা করলো। পাহাড়ি পিচ্ছিল রাস্তা হওয়াতে পা রাখা দায়। তার কুঁচকে যাওয়া চিবুক মাথার আঘাত করছে। আমি একহাতে গলা জড়িয়ে লজ্জার্থ মুখটা লুকিয়ে নিলাম।

পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসিয়ে দিলেন আমায়। হাটু ভাঁজ করে বসলেন আমার নিকটে। নীরবতা কাটিয়ে বললেন,

-“সালোয়ার তুল।”

ফট করে মাথা তুলে তাকালাম তার মুখশ্রীর দিকে। তিনি আশাবাদী চোখে চেয়ে ছিলেন। বিধায় চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনার। সরিয়ে নিতেই গাল ধরে সোজা করলেন। ললাট কুঁচকে বললেন,

-” একদম চোখ নামাবি না। চুপচাপ সালোয়ার তুল।”

কদাচিৎ ফাঁক হয়ে এলো ওষ্ঠ যুগল। লজ্জার্থ রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো আমার গাল দুটোয়। অন্ধকারের মাঝে দৃষ্টিগোচর না হলেও, আমার লজ্জার কমতি নেই। আমার ভাবনার মাঝেই সালোয়ার তুললেন তিনি। পা নিজের কোলে নিয়ে মলম লাগিয়ে দিতে লাগলেন। পা সরাতে চাইলেই চেপে ধরলেন দৃঢ় করে। চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম। অসহায় চাওনি উপস্থাপন করলাম। অন্ধকারের মাঝে তার মুখটা স্পষ্ট দেখা না গেলেও চোখের মণি গুলো জ্বলজ্বল করছে জোনাক পোকার ন্যায়।

মলম লাগিয়ে সালোয়ার ঠিক করে দিলেন। কোমর চেপে কোলের উপর বসিয়ে দিলেন। টেনে টেনে বললেন,
-” আমার সামনে কিসের লজ্জা তোর পিচ্চি? ছোট বেলায় আমার কোলে উঠার জন্য, আমার সাথে গোসল করার জন্য আরশির সাথে কতো ঝগড়া করেছিস।”

একমাত্র এই মানুষটির মুখে কোনোরুপ লাগাম নেই। কি হতো একটু লাগাম দিয়ে কথা বললে। গাল ছুঁয়ে দিলেন আমার। অস্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

-“এতো গাল ফুলাস না চড়ুইপাখি। একদম ব্লাস্ট করে যাবে। তারচেয়ে বরং এই অপরুপ প্রকৃতি অনুভব কর।”

ভাইয়ার কথা অনুসরণ করে নিভু নিভু চোখ করে প্রকৃতি দেখায় মনোনিবেশ করলাম। নিচের দিকে তাকাতেই কিংকতর্ব্যবিমূড় হলাম। নিজেকে মেঘ রাজ্যের রানী বলে মনে হলো। চারদিকে শীতের অনুভব পূর্ণ হিম হাওয়া। পাহাড়ে বাঁধা পেয়ে সূর্যের আলো ঠিকভাবে পৌঁছাতে না পারায় অতিশয় দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায় ভূ-ভাগ! পাহাড়ের চূড়ায় সাদা সাদা মেঘেরা জমাট বেঁধে ঘূর্ণীভূত হয়ে আছে। যখন তখন শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে।
অনুভূতি শূন্য লাগছে। উত্তেজনায় নয়ন জোড়া গ্ৰথণ করে নিলাম। নিজেকে স্বপ্ন রাজ্যের রানী লাগছে। মনে হচ্ছে, চোখ মেললেই হারিয়ে যাবে এই সময় টুকু।

ঝুমঝুম ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। চোখ মেলে অবলোকন করলাম। কমপক্ষে ভূপৃষ্ঠ থেকে আঠারো শত ফুট উচ্চতার অবস্থান করছি আমরা। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো মেঘের ভেতর থেকে নিচে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

-” ধন্যবাদ ভাইয়া, আমাকে এতো সুন্দর একটা মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য। স্মৃতির পাতায় বড় বড় অক্ষরে রংহীন সাদা কালোতে লিখে রাখব এই মুহূর্তটা।”

-” আমি যতোক্ষণ আছি, ততক্ষণ তোমার এই মুহূর্ত গুলো লিখার প্রয়োজন নেই ডিঙিরানী। তাছাড়া এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো লিখতে লিখতে স্মৃতির পাতা শেষ হয়ে যাবে। তাহলে আগামী দিনের স্মৃতি কিসে লিখবে?”

-“মানে।” না বোঝার স্বরে।

-” আগামী কাল আর পরশু আমরা ঘুড়তে যাচ্ছি, সকলের থেকে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি চারজনে। নিজেদের মতো ঘুরে ২ দিন পরে আবার এখানে আসবো। আগামি কাল আমরা যাচ্ছি শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, নীল দিগন্ত। অতঃপর থানচি শহরে থাকবো রাতটা। পরের দিন বাকি দর্শনীয় স্থানগুলো। যার মধ্যে একটি স্থান নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র। যেখান থেকে এক নজরে পুরো বান্দরবান শহর দেখা যায়। এক নীল আঁচলে বেঁধে রেখেছে বান্দরবান শহর।”

-” ভাইয়া আমি প্রাসিলিং করবো।” ফট করে বলে ফেললাম আমি।

” ঠিক আছে।” বলেই টস করে হাতের উল্টো পিঠে অধর ছুয়ে দিল। দুজনের মধ্যে দূরত্ব ঘুচে গেল। অধরে অধরে ছুঁই ছুঁই। নিঃশ্বাসের শব্দ গুলো স্পষ্ট শ্রবণ করা যাচ্ছে। চোখাচোখি হলো বহুক্ষণ। মনের অপ্রকাশিত সত্য গুলো নীরব দৃষ্টিতে প্রকাশিত হলো অন্য নীরব চোখে।‌

অতিবাহিত হতে লাগলো সেকেন্ডের পর সেকেন্ড, মিনিটের পর মিনিট, ঘন্টার পর ঘন্টা। আবির্ভাব ঘটলো তৃতীয় ব্যক্তির। হকচকিয়ে গেলাম আমি। ভাইয়ার বন্ধন থেকে মুক্তি মিললো না। শোনা গেল অস্পষ্ট তরুণের স্বর,

-” স্যার, খাবার নিয়ে এসেছি। দুশো টাকা ফিরেছে।”

হাতটা মাটিতে রেখে ইশারা করে বলেন, -” খাবার টা এখানে রাখো আর টাকাটা তোমার কাছে থাক!”

-” কিন্তু স্যার..

লিভ কথাটা বেশ আলাদা ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলেন তিনি। সাথে সাথে ছেলেটি প্রস্থান করলেন। খাবারগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-” ফিনিশ ইট।”
সারাদিন কিছু না খাওয়ার ফলে খাবার দৃষ্টি নন্দন হতেই পেট মুচড়ে উঠলো। চুপচাপ খাওয়া শুরু করলাম। ভাইয়া বার্গার আনিয়েছেন। আমার প্রিয় খাবার বার্গার। পুরোটা বার্গার এক নিমিষেই শেষ করলাম।
______________
আরশি রিসোর্টের প্রতিটি জায়গা খুঁজেও অরিশ তরীর কোনো খবর মেলাতে পারে নি। কাল ঘুড়তে যাবে বিধায় রুমে ফিরে গিয়েছে সকলে। কিন্তু আরশি এখনো খুঁজে চলেছে তরীকে। খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে গেল অপূর্ব আর অরিশের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে। দরজার খোলা। দরজার দিকে পিঠ দেখিয়ে ফোন কথা বলে চলেছে অপূর্ব। আরশি দরজার কড়া নড়তেই অপূর্ব ফোন রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ফোনটা তুলনামূলক দূরে সরিয়ে বলে,-“কি?”

-” ভাইয়ার কাছে এসেছিলাম। ভাইয়াকে খুঁজে পাচ্ছি না।”

-” তোমার ভাইয়া তোমার চেয়ে অনেক বড় এবং সেনসেটিভ। সে কখনো হারিয়ে যাবে না।”
পুনরায় ফোন কানে দিলো। ফোঁস করে দম ছাড়লো আরশি। পিত্ত্বি জ্বলে যাচ্ছে তার। অপূর্ব বড় সেটা তার জানা, কিন্তু তরী। সে তো তার বয়সী। যদি তরী হারিয়ে যায় তখন। তেজ নিয়ে বলল, -” তরীকেও পাওয়া যাচ্ছে না।”
অপূর্ব চমকে গেল। লাইন কেটে দিলো। অরিশের নাম্বারে ডায়াল করলো। রিং বেজে উঠলো রুমে। টেনশনে মাথা ধরে যাচ্ছে তার। রুদ্র কন্ঠে বলল,
-” সেটা এতোক্ষণে বলার সময় হলো তোমার?”

আরশির উপর ক্ষোভ দেখিয়ে পথ ধরলো অপূর্ব। সন্দেহের পাল্লা প্রশস্ত হয়ে উঠলো। ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে অন্যকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজের দৃষ্টিকে গোয়েন্দার মতো আরেকটু সন্দেহজনক তৈরি করলো। পিছু নিলো অপূর্বের।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here