অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -১৮+১৯

#অনুভুতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৮

শার্টের কিছু অংশ জুড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কাদা মাটির সংস্পর্শে এসে বিবর্ণ আকার ধারণ করেছে। গাছের উঁচু ডালে বসে পা দোলাচ্ছে আরশি। গ্রীষ্মের খরতাপে গাল দুটো রক্তিম হয়ে আছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুগুলো কালো দাগ তৈরি করেছে। ডালের দুইপাশে হাত রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে আরশি।

তারুণ্য একে একে ঘরের সব কিছু লন্ড ভন্ড করে ফেলেছে। বেডে মেলে রাখা ফুলের চাদরটা খন্ডিত হয়ে নিচে পড়ে আছে। ফুল দানীটা কয়েক টুকরো হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তারুণ্য অতিশয় ক্ষোভে মাথা চেপে ধরলো। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা জামা কাপড় গুলো বেডের মাঝ বরাবর রাখল। ফুলদানির ছোট খন্ডিত টুকরো আঙুলে আঘাত করলো। তোয়াক্কা না করে আরো একবার মেলে মেলে দেখলো। কিন্তু কাঙ্খিত জিনিসটার দেখা মিললো না। দৃষ্টি ঘুড়িয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে স্থির করলো। ক্রমাগত সময় ফুরিয়ে আসছে। এখনো তার প্রিয় সাদা শার্টটা পাচ্ছে না।

মুঠো ফোন তুলে অরিশের ফোনে ডায়াল করলো। পরপর দুবার ফোন করায় রিসিভ হলো। অরিশের ক্লান্তিমাখা কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

-“তারুণ্য, রাস্তায় আছি। কিছু সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবো। রাখছি!”

-” রাখিস না, আমার সাদা শার্টটা কি তুই পড়েছিস।”

-” না, দেখ ভুল করে কোথাও রেখেছিস কি-না।”

তারুণ্য ফোন কেটে টেবিলের উপর রাখল। দৃষ্টি গেল অদূরে ঝোপঝাড় গাছের ডালে। “কে, কে?” বলে কয়েকবার চেঁচালো সে। কিন্তু প্রত্যুত্তর এলো না। বাধ্য হয়ে প্রস্থান করলো। বড় বড় পা ফেলে গাছের নিচে গিয়ে ফাঁকা গলায় ডাকে,
-“আরু, তুই আবার আমার প্রিয় শার্টটা ধরেছিস। এক্ষুনি নেমে আয়। নাম বলছি।”

শেষের দু শব্দ দৃঢ় ভাবে উচ্চারণ করলো তারুণ্য। আরশি কেঁপে উঠলো ঈষৎ। ধীরে ধীরে হাতের বন্ধন হালকা হয়ে গেল। উঁচু ডাল থেকে নিয়ে পড়ে গেল। তারুণ্য কোলে তুলে নিল আরশিকে। দৃঢ় বন্ধনে চেপে ধরে বলে,

-“এক দন্ড শান্তিতে থাকতে পারিস না তুই। কোমড়টা তো এখনই যেত।”

আরশি মুড়িয়ে উঠলো। তারুণ্য আরো দৃঢ় ভাবে ধরলো। আরশির বলশক্তি হ্রাস পেল। নম্র ভাষায় বলে,

-“তুমি সব সময় আমাকে বকো। আজকে আমাকে ছেড়ে হোস্টেলে চলে যাচ্ছ, আজকেও বকছো?
কি হয়েছে, তোমার শার্টটা একটু পড়েছি। ছিঁড়ে তো যায় নি।”

সরু চোখে আরশির মুখপানে চেয়ে রইল তারুণ্য। পা দিয়ে ঠেলে স্থানটা পরিষ্কার করে নিল। পা জোড়া গতিশীল করে বাড়ির অন্তর্ভাগে প্রবেশ করলো। স্মিত হেসে বলে,
-“তবুও তো পাগলামী থামাস না। আমি তো চলে যাচ্ছি, এবার বলার মতো কেউ নেই।”

তারুণ্য আরশিকে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে থামলো। হাত মুখে, মাথায় পানি ঢেলে বেরিয়ে এলো। ভেজা চুলগুলো টাওয়ালের সাহায্যে মুছিয়ে দিল। মাথায় চিরুনি চালিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। আরশিকে কান ধরে উঠবস করতে বলে, আরশি মুখ ফুলিয়ে কান ধরে পাঁচ বার উঠবস করে। আরশির অগোচরে ফোনের বন্দী করে নেয় মুহুর্তটা। কাবার্ড থেকে একটা প্যাকেট বের করে আরশির হাতে ধরিয়ে দিল। আরশির বাহুতে হাত চেপে কুঁচকে যাওয়া ললাটের অধর ছুয়ে দিয়ে বলে,
-” আমি তো চলে যাচ্ছি পাগলী, নিজের যত্ন নিস।”

ব্যাথার্থ স্থানে আঘাত পেতেই আরশি নেতিয়ে পড়লো। বাহু চেপে ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল। তারুন্য আরশির ব্যাথায় ব্যথিত হলো। নম্র স্বরে বলে, “কি হয়েছে?” আরশি নিরব বচ্ছিত ভঙ্গিতে জবাব দেয়।
-“স্যার আজকে আমার এখানে মেরেছে। (হাত বাহুতে চেপে বলে)

শার্টের হাতা নামিয়ে স্থানটায় দৃষ্টি মেলাতেই তারুণ্যের মুখশ্রী ধীরে ধীরে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। অন্তর্ভাগে ক্ষোভ চেপে স্বাভাবিক ব্যবহার করে। ফাস্ট এইড বক্সের সাহায্যে স্থানটা ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়‌। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসে।

-” আমার অনুপস্থিতিতে-ও আমার আরুর দিকে দেখার সাহস না থাকে এমন ব্যবস্থা করে যাবো‌।”

-“ঝারু ভাইয়া। (তারুণ্যের দিকে চেয়ে কথা ঘুড়িয়ে বলে)
তারু ভাইয়া, তুমি কি কারেন্ট দিয়ে তৈরি? তুমি আমাকে ছুলেই মনে হয়, আমি শকড্ খাই।
____
নিদ্রায় আচ্ছন্ন অপূর্বের আরশির কথা শ্রবণগোচর হতেই শব্দ করে হেসে উঠলো। হাঁসতে হাঁসতে এক পর্যায়ে চোখ মেলে তাকালো। ভঙ্গ হলো নিদ্রা। ঘুমের মাঝে অপূর্ব পূর্বের দিনগুলো থেকে ঘুড়ে এসেছে। স্বপ্ন দেখেছে সেই দিনগুলো। হাই তুলে উঠে বসলো সে। হেলতে হেলতে এগিয়ে গেল বন্ধ কাবার্ডের সমুখে। সেদিনের সাদা রঙের শার্টটা বের করে চেয়ে রইল। সেখানে দুইজন মানুষের রক্ত একত্রে শুকিয়ে আছে। রক্ত গুলো কুচকুচে কালো হয়ে গেছে।

চোখ ঝাঁপসা অপূর্বের। তার কাঁধে হাত রাখলো কোনো অপরুপ সুন্দর রমনী। দৃষ্টি সরিয়ে চাইলো। আঁতকে উঠলো অপূর্ব। শ্বাস ভারী হয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল। আওরাতে আওরাতে অধর নাড়িয়ে শব্দহীন উচ্চারণ করে,-” আভা।”

পরক্ষণেই বায়ু স্তরের সাথে হারিয়ে গেল। এদিক ওদিক অবলোকন করে তাকে খুঁজতে লাগলো। পশ্চাৎ থেকে মনকাড়া খিলখিল হাসি শব্দ কানে আঘাত হানলো। পরক্ষণে ফিরে চাইলো। কিন্তু অপরুপ সুন্দর রমনী আর অপরুপ নেই। গলার কাঁটা অংশ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। পড়নে ওরনা বিহীন জামা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে। মুখের অবস্থা বিবর্ণ।

দুহাতে মুখ চেপে চিৎকার করে উঠলো। এতে মেয়েটার হাসির শব্দ আরো জোড়ালো হলো।

কথায় আছে না, যত হাঁসি তত কান্না। অতিশয় হাসতে হাসতে একসময় ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,

-” অপূর্ব, এই অপূর্ব। আমাদের জীবনটা কেন এমন হলো। বেশি কিছু তো চাইনি, ছোট সুখের একটা সংসার চেয়েছিলাম।
তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারছো না, তাহলে চলো আমার সাথে।”

অপূর্ব মাথা নিচু করে রইল। হঠাৎ একটা চুরি এগিয়ে এলো তার দিকে। অপূর্ব পাশে সরে দিয়ে চিৎকার করে উঠল। মিনিট পাঁচেকের ভেতরে হুরমুড়িয়ে রুমে ঢুকলো গার্ডরা।

অপূর্বকে প্রায় প্রায়ই এমন করতে দেখা যায়। বিধায় তার কক্ষের প্রবেশদ্বার খোলাই থাকে।
অপূর্বের অনুমান হলো। সবাইকে হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে। মেডিসিনের বক্স থেকে মেডিসিন বের করে দুটো ডরমিকাম বের করলো।‌ আধ গ্লাস পানির সাথে খেয়ে বিছানার এক পাশে সেঁটে শুয়ে পড়লো। মাঝে মাঝে রাতগুলো এইভাবে ঘুমাতে হয় তাকে।

_____________
শীতের প্রতাপ হ্রাস পেয়েছে। পৌষ মাস শেষের দিকে। উত্তরের বাঁধ ভাঙা হাওয়ায় নিভু নিভু বয়ে চলেছে জানালা ভেতরে। অরিশ কিছু একটা হিসেব করে চলেছে। কিছুদিন পরে শিক্ষাসফরে বান্দরবান যাবে। অরিশ যেতে চাইনি। তরী আর আরশির জোড়াজুড়িতে যাবে। আগামী বর্ষে পড়াশোনার চাপ থাকায় আর যাওয়া হবে না। তাছাড়া কখনো যাওয়া হবে কি-না জানা নেই।

দরজায় নক পড়লো। অরিশ চশমার ফাঁক দায়ে আঢ় চোখে দেখলো। নিভ্রান এসেছে। তিল পরিমাণ না নড়ে বলে,

-“স্যার আপনি পড়ে আসুন। আমি একটু ব্যস্ত আছি!”

-” আর আসার দরকার নেই। আমি বলতে এসেছি, আপনার বোন কি জানো নাম। ও হ্যাঁ আরশি। সে কোথায় গেল না গেল আমার জানার দরকার নেই। তবে আমার উড-বি তরিন যাতে না যায়।”

অরিশের সবটা আগে থেকেই জানা ছিল। কলমটা খাতার ভেতরে রেখে একপাশে ঠেলে রাখল। হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বলে, নিভ্রানকে। নিভ্রান অরিশের সামনের চেয়ারে বসে। অরিশ পেছনে পিঠ ঠেকায়‌ কপালের কোণে স্লাইড করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

-” কি বলছিলেন আপনি, মিঃ নিভ্রান। আপনার উড-বি তরিন। তরী সেটা শুনবে এবং মানবে, যেটা আমি বলবো।”

– “তরিনের ১৮ ছাড়িয়ে।”

-” সো ওয়াট, শুধু ১৮ কেন ৮০ ছাড়িয়ে গেলেও। আমি যা বলবো, তার এক চুল পরিমানও তরী অন্যথা করবে না।”

-” বলছি, ভাই ভাইয়ের মতো থাকলে হয় না।”

-” বাইরের লোক বাইরের লোকের মতো থাকলে হয় না। আমি ভেবেছিলাম, ওদের যেতে দিবো না, কিন্তু এখন আমি না চাইলেও ওদের যেতে হবে। দেখা যাক উড-বি্ কি করে। নাউ আউট..

অরিশ ঠেলে রাখা লিস্ট টা সামনে রাখল। মন স্থাপন করলো। নিভ্রান বুঝে গেছে, তার এখানে থাকা না একই। কিছু বিব্রত বোধ করলেন। অরিশের মুখপানে একবার চেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেগ হলেন। কিছুটা যেতেই অরিশ মাথা তুললো। ছোট ড্রয়ার থেকে কয়েকটা মার্বেল বের করে ছুঁড়ে দিলে নিচে। মার্বেল গুলো গড়িয়ে পড়িয়ে নিভ্রানের পায়ের দিকে গেল। নিভ্রান পা রাখতেই আচম্চা মেঝেতে পড়ে গেল। মার্বেল গুলো দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না তার।

অরিশ জায়গা ছেড়ে উঠলো। গতিহীন পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে গেল। একহাটু ভাঁজ করে বলে,

-“আমার ডিঙিরানী দিকে হাত বাড়ানো তো দূরে থাক, তাকালে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে।”
#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৯

রৌদ্রের গন্ধ হালকা হতেই ঝিরি ঝিরি কুয়াশা শিশির বেসে ঘাসের উপরে ঝড়ে পড়ছে। গাছের উঁচু মগডালে দাঁড়ালে পুরো গ্ৰাম দেখা যায়। ধান ক্ষেত থেকে নতুন ফসল তুলার ফলে খড়ের নিম্নাংশ মাটির শিকড় আকরে রেখেছে। ফাঁকা ক্ষেত দিয়ে সহজে নিজের গমন পথ অতিক্রম করা সম্ভব।
আরশি আজও গাছের ডালে পা দুলিয়ে বসে আছে। গাছটা ছোট দিঘির দিকে নুইয়ে পড়েছে। তবে বেশি উঁচু ডালে নয়, তার ভার বহন করার মতো ক্ষমতা হয়তো উঁচু নরম ডালের নেই। তার দৃষ্টি অদূরে ধান বিহীন ক্ষেতের মাঝে বন্দী। দূর থেকে অস্পষ্ট পরিচিত মুখ দৃষ্টিগোচর হলো। অতিশয় উল্লাসে রীতিমত হাত পা কাঁপতে আরম্ভ করলো। আরশি চট করে নামতে চেয়ে ব্যর্থ হলো। পড়ে যেতে নিলো দিঘীর মাঝে। মুঠো দিয়ে আঁকড়ে ধরলো গাছের ডাল। ততক্ষণে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো। ধরাধরি টানাহেঁচড়া করে উপর থেকে নামালো আরশিকে। আরশি জাপটে ধরলেন তাকে। কিছু বলার ক্ষমতা হলো না কারো। কারণ, তার সমীপে অবস্থান করছে, তার একমাত্র ফুফুজান রুসা। তার ছেলে রাফি এবং রাফির শালা বাবু ফারহান। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে দাওয়াত দিতে এসেছেন। রুসা ভাই-বোন দের ভেতরে সবার বড় হওয়াতে তার মুখের উপর কথা বলার ক্ষমতা নেই কারো।

বাড়িতে নিজের পা স্থাপন করতেই মিইয়ে গেল সকলে। রুসা গিয়ে দখল করলেন নিজের আসন। এই আসনটা ব্যক্তিগত তার নিজস্ব। তার অনুপস্থিতিতে এখানে বসার ক্ষমতা কারো নেই। আজ তার আসার খবর পেয়ে ড্রয়িং রুমে সাজানো হয়েছে।
খালাজান কখনো আমায় স্নেহের নজরে দেখেন নি। তার কাছে তার একমাত্র আদরের ছোট বোনের খুনি আমি। খালার আসার খবর শোনামাত্র ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম আমি।‌ আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিজের নাম শুনে চমকে উঠলাম। আমাকে ডাকা হচ্ছে। ছোট ছোট পা ফেলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম নিচে। নিচে নামতেই চায়ের আদেশ করলেন মামুনি। চোরের মতো মাথায় কাপড় টেনে রান্না ঘরে ছুটলাম। ট্রে ভর্তি চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হলাম। মামুনি চা দিতে বললেন সকলকে। ফুফুর নিজস্ব চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলাম, তুললেন না তিনি। ডান হাতটা হাতলের উপর রেখে, ডান পায়ের উপর বাম পা রেখে বাজখাঁই গলায় বলেন,

-“অনি, আমি তোমার বাড়িতে এসেছি। চা খাওয়াতে হলে নিজের হাতে করে খাওয়াবে, জুতো মেরে গরু দান করবে না।”

কাঁপতে কাঁপতে চায়ের কাপটা হাতে ফসকে গেল। মৃদু শব্দে নিচে পড়ে খন্ডিত বিখন্ডিত হলো। চায়ের তরল পদার্থ টুকু শাড়ির পাড়ে গিয়ে ঠেকলো ফুফুর। বিনিময়ে শাড়ির নিচের অংশ টুকু হাতের সাহায্যে উপরে তুলে নিলেন। দৃষ্টিপাত করলেন না আমার সমীপে। তবে মামুনি থেমে রইলেন না। কটু করে বললেন,

-“এই মেয়ে তুই কি কোনো ভালো কাজ করতে পারিস না। তুই অপয়া অলক্ষী জানতাম, তোর দ্বারা সব খারাপই হবে। নিজের মাকে খেলি, বাবার ব্যবসা লাটে তুললি, ভাইকে গুন্ডা-মাস্তান বানিয়েও শান্তি হয়নি তোর। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাড়ি থেকে বের করে দেই।”

প্রত্যুত্তর দেবার ভাষাগুলো অন্তরালে রয়ে গেল। ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল। কাঁচ গুলো না তুলে উল্টো ঘুরে ছুটে গেলাম রুমের ভেতরে। তখনই নির্বিকার ভাবে কিছু একটা বলে চলেছেন মামুনি। তবে তা শ্রবণগোচর হলো না আমার।

মিসেস্ রুসা সূক্ষ্ম চোখে অবলোকন করলেন অনিতাকে। নিচে বসে কাঁচ গুলো ধীরে ধীরে তুলে ট্রে তে রাখলেন। পুনরায় নিজের আসন গ্ৰহন করে বললেন,

-“অনু, আমি তোমার ব্যবহার দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। তুমি আমার সামনে আমার বোন-জিকে অপমান করছ। আমার বোনের হায়াত ছিলো ঐ পর্যন্ত, তাই সে আর বাঁচে নি। বাকি রইল ব্যবসায় লোকসান আর তারুণ্যে। আল্লাহ সবকিছু আগেই তার ভাগ্যে নির্ধারিত করে রেখেছেন। তাই আমরা চাইলেও খন্ডাতে পারব না।”

রাগে যথারীতি দেহটা নড়ে চড়ে উঠছে তার। আঁচলটা মাথায় ঠিকমতো পেঁচিয়ে অনিতার আর তার মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। আঙুল তুলে বলে,
-” এই বাড়ি থেকে ওকে বের করার কথা দ্বিতীয় বার মুখে আনবে না। তার অধিকার আছে, কিন্তু তোমার আর তোমার মায়ের কোনো অধিকার নেই। এমন মন মানসিকতা পরিহার করে না পারলে, আমার ছেলের বিয়েতে এসো না।”

বলেই ধীর গতিতে হেঁটে চললেন।
আমি তখন নির্বিকার ভাবে কেঁদে চলেছি। দরজার কড়া নড়ে উঠলো। দরজা খোলার মতো শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। ধীরে ধীরে শব্দ গুলো বেড়েই চলেছে। উপায়হীন হয়ে দরজা খুলি। খালা জানকে দেখে দরজা থেকে দুকদম পিছিয়ে জায়গা করে দিলাম। রুসা মৃদু হাসেন। গালে হাত রেখে ললাটের মধ্যেখানে অধর ছুয়ে দিলেন।

পায়ের নিচের অংশ শুন্যতার মতো অনুভব হলো আমার। নোনাজল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। এখনো হাতটা গালের মাঝে রক্ষিত। কাঁপা কাঁপা হাতজোড়া ঠেকালাম হাতের উপর। তিনি হাত সরিয়ে নিলেন। পানিটুকু মুছিয়ে দিলেন স্বযত্নে। অধর জোড়া নাড়িয়ে বললাম,

-“ফুফু বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে করি নি।”

-” পাগল মেয়ের কথা শোন, তোর সাথে যে আমার আত্মার সম্পর্ক। আমার বোনের রক্ত। তোকে বিশ্বাস করবো না-তো কারে কবর?”

কিছু সময়ের জন্য মনে হলো সুখের সবোর্চ্চ সুখের দেখা মিলে। সূর্য নেই আকাশে, মস্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণিমার চাঁদ। আমার আকাশে আজ প্রথমবার সেই অচেনা চাঁদ।
______________
অম্যাবর্ষা তিথি। আকাশের চাঁদের অস্তিত্ব নেই। চাঁদ লুকিয়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। রাত দশটাকে দুটোর বেশি মনে হচ্ছে। আরশি হোস ফাস করছে। পরপর দুটো বাস ছুটে গেল তার কাঙ্খিত জায়গার উদ্দেশ্য। কিন্তু অরিশদের বাস এখনো গতিশীল হলো না। আরশি অরিশের মুখপানে চেয়ে নেমে যেতে উদ্দেগ হলো। তার ইচ্ছে পূরণ হলো না। প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে পা রাখতেই কেউ বাঁধা দিয়ে হাত রাখলো দরজার মাঝ বরাবর। তদানীং গতি থামাতে পাশ ফিরলো আরশি। বিনিময়ে বাসের দরজার সাথে মাথা ঠেকলো। মাথায় হাত চেপে মানুষটির দিকে তাকাতেই তার রাগ আগ্নেয়গিরির রুপ ধারণ করলো। অপূর্ব এসেছে। মুখে মাস্ক দিয়ে ঢাকা, মাথায় ক্যাপ। হুট করে কারো পক্ষে চেনা সম্ভব নয়। কিন্তু আরশি অপূর্ব কে এতোটাই হৃদ মাঝারে স্থানে দিয়েছে, তাকে দেখার প্রয়োজন পড়ে না।অপর হাত গান গালে রাখল। কিন্তু এই গালে অপূর্ব তাকে মারে নি, মেরেছে বা-গালে। দ্বিতীয় বার নিজের ধ্যান পরীক্ষা না করেই মাথায় হাত চেপে একদম পেছনের সিটে গিয়ে বসলো।

অরিশ মৃদু শব্দে চপল মারল অপূর্বের কাঁধে। অপূর্ব ফিরে চাইলো। ক্লান্তিমাখা হাঁসি দিলো। সাথে অরিশও হাসলো। বলে,

-“এলি তবে! আমি তো মনে করেছিলাম, তোর সময় হবে না।”

-” আমি না এলে খুকি কে কখনো যেতে দিতাম না। সেদিন যা হলো। তাছাড়া বোনের চেয়ে অন্য কিছুর কোনো মূল্য নেই আমার কাছে।”

অরিশের মুখে তখন দেখা মিললো অচেনা মানুষের। সন্তর্পণে পা ফেলে বলে,
-” তাহলে যা, তোর খুকির কাছে বস।”

-“নো, ইউ হেভ টু গো।”

অরিশ নীবর চাইনি নিক্ষেপ করে চলে গেল। অপূর্ব সামনে পেছনে দৃষ্টিপাত করে আরশি দিকে স্থির চাওনি দিল। মেয়েটাকে সেদিন মেরেছে। প্রথমবার কোনো রমনীকে আঘাতপ্রাপ্ত করেছে। আরশি জানালার পার্শে বসা। তার সামনে একটা যুবক তরুণী বসেছে। অপূর্ব মেয়েটিকে অন্য কোথাও বসার অনুরোধ করলো। মেয়েটি দ্বি মুহূর্ত না ভেবে প্রস্থান করলো। অপূর্ব সৌজন্য হাসি মুখে রেখে বিনা বাঁধায় দখল করে নিল আসনটা।

পেরিয়ে গেল কিছু সময়। পাশের মানুষটিকে দেখার বিন্দুমাত্র আকাঙ্ক্ষা নেই তার। আরশি অতিশয় ক্ষোভে জানালার বাইরে মাথা বের করে রইল। একহাত চাদর পেরিয়ে জানালায় স্থাপন করা। শীতলতায় আরশির লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে। অপূর্ব টেনে টেনে বলে,
-” তোমার ঠান্ডা লাগছে, জানালা বন্ধ করে দাও।”

আরশি ফিরে চাইলো না। জানালাটা আরো খুলে দিলো। শো শো করে ভেতরে হাওয়া ছড়িয়ে পড়লো। দেহে পেঁচানো উমের শাল খুলে নিচে রেখে দিল। প্রমাণ করতে চাইলো, তার শীত করছে না।

অপূর্ব নিজের ভাবনায় বিভোর হলো। আরশির খুলে রাখা শাল দেহে পেঁচিয়ে সিটে মাথা হেলিয়ে ক্লান্ত লোচন যুগল গ্ৰথণ করে নিল। নিরবতার হৃদ মাঝারে আরশির নাম রাখল, পাবনা ফেরত পাগল। চিতল মাস, ভাঙা চিরুনি, আয়নার সাথে যোগ করলো এই নাম।

আরশি বেজায় চটে গেল। ধাড়াম করে জানালার ছিটকিনি তুলে দিল। তদানীং আলোক শূন্যতায় ডুবে গেছে বাসের অভ্যন্তরীণ। শরীরের কম্পনের মাত্রা বেড়ে গেছে। যেন কোনো বরফ সীমান্ত থেকে ভ্রমন করে এসেছে নতুবা ফ্রিজের অন্তর্ভাগে বিরাজ করছিলো সে।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here