অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -১৬+১৭

#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৬

নিজের চেনা এলাকায় আসতেই বুঝতে পারলাম আমার পাশে কেউ বসে আছে। শক্তহীন নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে ফিরে চাইলাম। সাথে সাথে চারশত বিশ ডিগ্রি বোল্ডের শখ খেলাম। আমার পাশে অরিশ ভাইয়া বসে আছে।‌ ফুঁপিয়ে উঠলাম এবার। ভেতরের কষ্টগুলো অশ্রুধারা হিসেবে বেরিয়ে এলো। এই মানুষটা কেন আগে এলো না, কেন আমাকে শান্ত করতে এলো না। তিনি করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু সেঁটে গেলাম রিক্সার অন্য প্রান্তে। অরিশ ভাইয়া একটু সেঁটে গাঁ ঘেঁষে বসলেন। পশ্চাৎ থেকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলেন আমায়। পুনরায় তাকে ছাড়িয়ে সরে এলাম। তিনি হয়তো আঁচ করতে সক্ষম হলেন। অসহায় চাইনি নিক্ষেপ করে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হলো পরে অনুভব করতে সক্ষম হলাম, বাইরে থেকে কেউ অনবরত আমার শাড়ির আঁচল টানছেন। আমি হাত দিয়ে আঁচল পেঁচিয়ে ধরলাম। কিন্তু কোনো রুপ উন্নতি হয়নি। ধীরে ধীরে আরো পেঁচিয়ে যেত লাগল শাড়ির আঁচল। একসময় গলা পেঁচিয়ে এলো। তখন বাইরে মাথা এগিয়ে দিতেই দেখতে পেলাম, আমার শাড়ির আঁচল রিক্সার চাকায় পেঁচিয়ে গেছে। চিৎকার করার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই আমার। একহাতে গলা চেপে অন্যহাতে অরিশ ভাইয়ার দিকে ইঙ্গিত করলাম। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে অবলোকন করলেন আমার নিমিত্তে। ততক্ষণে আমার দম বন্ধ হয়ে এসেছে।

অরিশ ভাইয়ার হাত রাখলেন রিক্সা চালকের কাঁধে, গাড়ি থামিয়ে দিলেন তিনি। অরিশ ভাইয়া এবার নেমে উল্টো ঘুরে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। এক টানে শাড়ি ছিঁড়ে ফেললেন। হাফ ছাড়লাম আমি। গলায় অনেকটা জায়গা ছুঁলে গেলে। ক্রমাগত কেশে চলেছি আমি। আঁচল ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে পুরো শরীর কভার করা যাচ্ছে না।
অরিশ ভাইয়া নিজের শরীরের শাল খুলে আমার শরীরে পেঁচিয়ে দিলেন। ছুটে গেলেন অজানায়।

একটু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে পানির বোতল নিয়ে হাজির হলেন। আমার পাশে বসলেন। ছিপি খুলে এক ঢোক পানি মুখে পুড়ে দিলো। ধীরে ধীরে কাশি কমে এলো আমার। অরিশ ভাইয়ার হৃদ মাঝারে মাথা রেখে নিজের অন্তর্ভাগের উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস ছাড়লাম।

রুমাল ভিজিয়ে নিলো বোতলের পানিতে। আমার গলায় ছুঁলে যাওয়া স্থানগুলো ভেজা রুমাল দিয়ে ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে দিতে লাগলো। ভেজা ঠান্ডা স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি। মৃদু শব্দে বললাম..

– “কেন বার বার আমার সাথেই এমন হয়। আমার বাঁচতে একদম ইচ্ছে করে না। প্লীজ আমাকে মেরে ফেলো ভাইয়া। আমি বেঁচে থেকে সবার ক্ষতি করছি। ভাইয়ার ক্ষতি করবো বলে, সে আমাদের সাথে থাকে না। মামুনিও আমাকে সহ্য করতে পারে না। আমি চাইনা, আমার জন্য তোমার ক্ষতি হোক।”

রুমাল ছেড়ে নিজে হাত অধরের উপরে রেখে থামিয়ে দিলেন আমায়। পানিতে সমেত রুমালের ছোপ ছোপ শব্দে হুম ফিরলো তার। রিক্সার হুঁড টেনে নামিয়ে দিলেন। রিক্সা চালাতে বললেন।মুড়িয়ছ নিলেন আমায় নিজের সাথে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন..

– “কি সব বলছিস পাগলী। তারুণ্য অন্য কারণে তোর থেকে দূরে সরে আছে। চাইলে সে তোকে নিজের সাথে নিজে যেতে পারে কিন্তু তাতে বিপদ তোরই হবে।”

______________
শীতের রাত থমথমে। সন্ধ্যা হতে না হতেই মানুষ – পশু – পাখি নিজ নিজ আশ্রয়ে ফিরে আসে। ঘরে ঘরে আলাে নিভে যায়। কর্মচঞ্চল গ্রাম ও শহর ঘুমে ঢুলতে থাকে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়। শহরের পথে লাঠি ঠুকে ঠুকে চলে পাহারাদার। বিদ্যুৎবাতিগুলাে অসহায়ের মতাে রাস্তার দু – ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। গ্রামে গ্রামে চৌকিদারদের খবরদারি শােনা যায়। কুকুরগুলাে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে চলে। অনেক দূর থেকে কানে আসে শিয়ালের ‘হুক্কা হুয়া ’ ডাক।

দুই বোন বসে বসে পরীক্ষার পড়াগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি। আমার পাশে বসে মহাদয় পরীক্ষার খাতা খুলে দেখছেন। আকর্ষণীয় নজরকাড়া নয়নজোড়া চশমা দ্বারা বন্দী। সেকেন্ডে সেকেন্ডে ললাটে কুঁচকে যেতে দেখা মিলছে। হয়তো শিক্ষার্থীদের প্রতি অসন্তুষ্ট সে। একসময় সব খাতাগুলো দেখা শেষ করলেন। ভাঁজ করে কাবার্ডে রেখে এলেন। চশমা খুলে চেয়ারে গাঁ হেলিয়ে দিলেন। নয়নজোড়া ঘন অন্ধকারে আবৃত তখন। বলেন..

– “কিসব পড়াশোনা করে এরা। আমি সত্যিই বুঝতে পারি না। এক প্রশ্নের কালেক্ট এন্সার নেই। সবগুলো যেন কুমির রচনা লিখে রেখেছে।”

কদাচিৎ ফাক করে এলো ওষ্ঠ যুগল। আরশি আর আমি একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ নিরব বচ্ছিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে বললাম..

– “ভাইয়া কুমির রচনা এলো কোথা‌ থেকে?”

– “এটা কুমির রচনা না। এটা হলো টেকনিক। যেই প্রশ্নই করো, এটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কুমিরের কাছে নিয়ে যাবে।”

টেকনিক টা জানার জন্য ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি সম্মুখীন হলাম। কিন্তু ভাইয়া বলবে না মানে বলবে না। তাই কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। অবশেষে বাধ্য হয়ে বলতে লাগলেন তিনি।
— “একজন আলসে ছেলে ছিল। থ্রী-তে পড়তো সে। পড়াশোনা তার মোটেও ভালো লাগতো না। প্রতিদিন স্যারের মার খেত। একদিন সে বুদ্ধি করে একটা কুমির রচনা শিখল। স্যার যখন তাকে গরু রচনা বলতে বলল। সে কুমির রচনা বললো।
গরু একটা গৃহপালিত প্রাণী। তার চারটি পা, দুইটা কান, দুইটি চোখ ছিলো। গরু ঘাস খায়। গরু আমাদের দুধ দেয়। একদিন গরু পানি খেতে নদীর কাছে গিয়েছিলো। কুমির টেনে তাকে পানির ভেতরে নিয়ে যায়। কুমির সরীসৃপ প্রাণী। পানিতে বসবাস করে। বড় বড় দাঁত আছে।
এভাবে কুমিরের ব্যাখা দিতে লাগলো। স্যার তখন স্পিসল্যাস হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর স্যার ছেলেটিকে প্লেন রচনা জিজ্ঞাসা করল। ছেলেটি কিছুটা প্লেনের বৈশিষ্ট্য বললো। তারপরে প্লেন ক্রাস করে নদীর পানিতে নিয়ে গেল। নদীতে পড়ার পরে সেখান থেকে আবার কুমিরে মানুষ টেনে নিয়ে গেল। মুল কথা হচ্ছে, যেই রচনাই আসুক না কেন? টেনে কুমিরের কাছে নিয়ে কুমিরের ব্যাখা দিতে হবে।

তেমন হয়েছিস তোরা। সারাবছর পড়বি না, পরীক্ষার সময় কুমির রচনার মতো দিবি। কে বিয়ে করবে তোদের। এক দরজা দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে যাবি, অন্য দরজা দিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।”
আরশি ললাটে জমে থাকা ছোট ছোট কেশ গুচ্ছ পেছনে হেলিয়ে দিয়ে বলল..

– “প্যারা নাই চিল, ঘর জামাই থাকমু। এক দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকবো না, অন্য দরজা দিয়ে ফিরতে হবে না। শুধু শুধু গাড়ি ভাড়া নষ্ট হবে।”

ভাব নিয়ে কথাগুলো বলে ফোনের স্ক্রিনে স্ক্রল করতে লাগলো। অরিশ ভাইয়ার ভ্রু যুগল সরু করলেন কিছুটা। স্কেল ছুঁয়ে মারলেন আঙুলের পাতা বরাবর। ফোঁস করে উঠলো আরশি। চোখ উল্টে মা বলে চিৎকার করলো। অরিশ ভাই ক্ষুব্ধ হলেন কিছুটা। চোখ রাঙালেন। মুহুর্তেই আরশি নিস্প্রাণ হয়ে গেল। আমার সামনের বইটা টেনে নিজের কাছে নিলেন। বইয়ের উপর হাত রেখে গালে স্থাপন করলেন। আরস ভঙ্গিতে বললেন..

– “দুই কাপ চা করে আন। উইথ-আইট সুপার। গাঢ় লিকার দিয়ে। চাইলে নিজের জন্যও আনতে পারিস। গো ফাস্ট..

আরশি ভাইয়া দিকে কিছুটা অসন্তুষ্ট দৃষ্টি অবলোকন করলো। তবে তার জন্য বেশ সুবিধা হলো বোঝা যাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে প্রস্থান করলো আরশি।

আরশি মিলিয়ে যেতেই অপ্রস্তুত কর চাইনি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। অদ্ভুত নেশালো দৃষ্টিতে নিজেকে অগোছালো মনে হতে লাগলো আমার। পড়নে ওরনা নেই। ওরনা গুলো কাবার্ডে রেখে লক করে রেখেছেন তিনি। পড়নের জ্যাকেটটা নিচে নামিয়ে পড়া। চুলগুলো উপরে উঠিয়ে কাঁটা দিয়ে বাঁধা
গলায় ড্রেসিং করা হয়েছে। মাথা নিচু করে জ্যাকেট টা পেঁচিয়ে ধরলাম। অরিশ ভাইয়া এতে অতিশয় উষ্ম হলেন। ইশারায় থামিয়ে দিলেন। স্বাভাবিক স্বরে বলেন..

– “আজকে বিকালে কোথা থেকে ফিরেছিস তুই। পা ভাঙ্গা। গলা ছিড়া মুরগির মতো।”

ভাষাগুলো হারিয়ে গেল অগোচরে। আমতা আমতা করে বললাম – “এই একটু মন খারাপ ছিলো, তাই বেরিয়েছি।”

– “তাই বলে শাড়ি পড়ে? আমার জানা মতে তুই কখনো শাড়ি পড়িস না।”

সবাই হয়তো কম বেশী মিথ্যার আশ্রয় গ্ৰহণ করতে পারে। কিন্তু আমার দ্বারা হয় না। সাজিয়ে গুছিয়ে সময় নিয়ে বললাম..
– “আমার ভাইয়া থেকেও নেই, একটু ঘুরতে নিয়েও যাবে না। কবে আসবে তাও জানি না। হয়তো তার আগে বিয়ে নামক শিকলে বাঁধা পড়ে যাবো। আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব থাকবে না। তাই মন ভরে..

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। অরিশ ভাইয়া কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার মুখপানে। মিথ্যা শব্দগুলোর চেয়ে সত্যি টাই বেশি ছিল। বইয়ের পাতায় মগ্ন হলাম।
#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৭

ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আরশি। ছাদের পাশ ঘেঁষে বড় একটা আমগাছ। এক পা আমগাছে রেখে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। গাছে তেমন পাতা নেই বললেই চলে। শীতের আগে ঝরে গেছে। বসন্তে আবার নতুন পাতা গজাবে। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে। কাঁচা আমে কচি কচি পাতা গুলো ঢাকা পড়ে যাবে। মস্তিষ্কে এই ভাবণাগুলো জায়গা করে নেওয়ার পাশাপাশি জিভে জলকণা চলে আসে। তবে আজ শীতের উত্তাপ আয়ত্বে করতে অসময়ে ছাদে আসা। সেদিনের পর থেকে অপূর্ব নামক মানুষটির সাথে দেখা হয় নি।

ছোট রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই করে বড় বড় কয়েকটা গাড়ি অতিক্রম করলো। ধুলো গুলো ছড়িয়ে পড়লো, ধোঁয়াশা হলো রাস্তাঘাট। যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়, আরশি সেই দিকটায় দাঁড়ালো। আরশি মাত্র তিনটা গাড়ি গুনতে পারলো। চতুর্থ টা গোনার আগেই কাঁচ ভেদ করে দৃষ্টি গেল অতিপরিচিত একটা মুখের দিকে। সাদা শার্টের একদম সাদামাটা লাগছে অপূর্বকে।

আরশি ছুটল পিছুপিছু। ওরনাটা কোনো রকম শরীরে পেঁচিয়ে ছুটল গতিশীল গাড়ির পেছনে পেছনে। গাড়ি এসে থাকল বড় একটা বৃদ্ধশ্রমের সামনে। তেরো বছর হয়েছে এই বৃদ্ধশ্রম তৈরি করা হয়েছে। আশ্রমটা আজ সেজে উঠেছে সাদা রঙে। ভেতরে মানুষের গমগম আওয়াজ ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে লোকজন নামতে শুরু করলো। কিন্তু কেউ ভেতরে প্রবেশ করলো না। বৃদ্ধাশ্রমের চারপাশ ঘিরে রইলো। শুধুমাত্র অপূর্ব একাই ভেতরে গেল, পেছনে পেছনে তার এসিস্ট্যান্ট ঢুকল।

অপূর্বের এসিস্ট্যান্ট বিভাসের হাতে সাদা গোলাপ ফুলের প্যাকেট। একটা একটা বৃদ্ধাদের দিচ্ছে। সবাই নিচ্ছে আর অপূর্বের মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করছে। আড়াল থেকে এইসব দেখে স্মিত হাঁসলো আরশি। ছেলেটার পাথর মনের পেছনে তুলোর ন্যায় মন বিরাজ করছে।
অপূর্বের হাতের গোলাপ পাওয়ার ইচ্ছে জাগল তার অবুঝ মনের। বেরিয়ে লাইনে দাঁড়ালো বৃদ্ধাদের মাঝখানে। হাত বাড়িয়ে দিল। অপূর্ব গোলাপ দিতে গিয়ে এক নজর মসৃণ হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। অন্তত একবার তীব্র ভাবে দেখার আকাঙ্ক্ষা জাগল। ফুলটা হাতের মুঠোয় রেখে নিচ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাতের মালিকের দিকে নিক্ষেপ করলেন। আশেপাশে তাকিয়ে পূনরায় হাতের দিকে তাকালো। নয়নজোড়া ফুলবিহীন হাত দিয়ে পরিস্কার করে নিল। অসন্তুষ্ট স্বরে বলে,

– “তুমি! তুমি এখানে কি করছো?”

– “এভাবে ফুলটা ফিরিয়ে দিতে নেই জানেমান। তাছাড়া তুমি যেখানে আমিও সেখানে। তাড়াতাড়ি ফুল দাও।”

নিঃশব্দে ফুলটা আরশির হাতে দিয়ে সামনের দিকে তাকালো। গা ছাড়া ভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। সকলে সাদা শাড়ি পড়েছে। এর মাঝে উপস্থিত হলো বৃদ্ধাশ্রমের প্রধান বয়স্ক মহিলা। তিনি এগিয়ে আসতেই অপূর্ব মৃদু ঝুঁকে পা স্পর্শ করতে চাইলো। কিন্তু সক্ষম হলো না, থামিয়ে দিলেন তিনি। বক্ষ মাঝারে টেনে নিয়ে মাথায় অধর ছুয়ে দিলেন। আরশিও সময় নিলো না। মাথায় কাপড় টেনে প্রধান মহিলা মিসেস্ শুভাসিকে সালাম করলেন। আরশিকে নজর কেটে বললেন..

– “বাহ্, মাশাআল্লাহ। কে তুমি, মা?”

– “আমি আরশি।” অতঃপর লজ্জার্থ দৃষ্টিতে অপূর্বের দিকে তাকালো। আর কিছু বলতে হলো না। মুচকি হাসলেন তিনি। আরশির হাত ধরে নিয়ে গেলেন। আশেপাশের সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।
.
.
ঝাঁক ঝাঁক অন্ধকারের গুচ্ছ এসে আকাশকে নিজের দখলে করে নিয়েছে। আশ্রমের পেছনের দিকটায় জঙ্গলের মতো অন্ধকারে আবৃত। মিলাদ মাহফিল সম্পন্ন করে আরশি এসে দাঁড়ালো সেখানে। তার কানে ভেসে এলো অগোছালো কান্না মাখা স্বর। ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল সে। তার থেকে কদম দশেক দূরে মৃদু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। শক্তি সঞ্চয় করে কুচিগুচ্ছ ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। ফোনের স্ক্রিনে একটা হাসৌজ্জ্বল তরুন রমনীর মুখশ্রীর দেখা যাচ্ছে। রমনীটা একটা সুদর্শন পুরুষের বাহু চেপে আছে। দুজনের মুখে তৃপ্তিকর হাঁসি।

আরশি চমকালো। পায়ের নিচের মাটি ফাঁক হয়ে যাওয়ার যোগার হলো। ছেলেটি আর কেউ নয় গ্যাং স্টার অপূর্ব। আরশির চোখ জোড়া পূর্ণ হয়ে এলো জলকণায়। ফোন ছিনিয়ে নিল। পরক্ষণেই করতলের বিকট আঘাত গালে পড়লো। আরশি ছলছল চোখে চেয়ে রইল। অপূর্বের চোখ ফোলা ফোলা, পাপড়ির উপরে বিন্দু বিন্দু অম্বু ধারা জমে রয়েছে। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে বলে,

-“বিভাস, বিভাস। এই মেয়েটা এখানে কি করছে। আমার সামনে থেকে একে নিয়ে যাও। গো ফাস্ট..

বিভাস নামক ছেলেটা আসল। অপূর্বের সামনে মাথা নত করে আরশিকে সম্মানের যেতে বলে। আরশি শ্রবণ গোচর করে না। এতে অতিশয় অসন্তোষ প্রকাশ করে অপূর্ব। আরশিকে মারার জন্য এগিয়ে যায়। উপায় না পেয়ে হাত জোর করে বিভাস। আরশি করুন চোখে অবলোকন করে। জুতোর আওয়াজ তৈরি করে প্রস্থান করলো। পেছন থেকে ডেকে উঠল অপূর্ব। না ফিরে উল্টো ঘুরেই বলে,
-” বিভাস, মেয়েটাকে বাড়িতে পৌঁছে দাও।”

হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে আরশির পিছু পিছু গেল বিভাস। আরশি বিভাসের কথা শুনতে ইচ্ছুক নয়। বড় বড় পা ফেলে হাঁটার চেষ্টা করছে। বিভাস আহত হলো। বুঝতে সক্ষম হলো, অপূর্বের বিহেবিয়ারে কষ্ট পেয়েছে, অভিমান করেছে। গলা ছেড়ে বলতে শুরু করে,

-” আসলে স্যার এই দিনে কারো সাথে তেমন কথা বলে না, প্রচন্ড কাঁদে। আপনিই ভেবে দেখুন, একজন সফল সার্জন, গ্যাং স্টার কখন কাঁদে!”

আরশির পায়ের গতি থেমে গেল। বিভাস এসে আরশির সম্মুখে দাঁড়ালো। অসহায় কাতর চোখ দুটি ঘনঘন পলক ফেলে বলে, -“মানে!”

-” গ্যাং স্টারের জীবনেও অনেক কষ্ট থাকে, তারাও সাধারণ ভাবে বাঁচতে চায় ম্যাম। কিন্তু পরিস্থিতি দেয় না!”

বিভাস গাড়ি আনতে পা বাড়ায়। করলি বাধ সাধে। পায়ের গতির ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটার তালে তালে সে শুনতে চায়।

-” স্যার ছোটবেলায় তার মা মারা যায়, বাবা থেকেও নেই। বোনকে কিছু ব্যক্তিগত কারণে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। নিজের ভালোবাসার মানুষটি এইদিনে চলে গেছেন তার মায়ের কাছে।”

-“কিভাবে মারা গেলেন তিনি!” কোথাও একটা কেঁপে উঠছে আরশির।

-” তিনি ব্যক্তিগত কিছু কারো সাথে শেয়ার করা পছন্দ করে না। আমি তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট তাই এইটুকুই জানি। তবে তিনি এদেশি নয়, ইউকে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন, তখন পরিচিত হয়। আমি চাই, স্যার স্বাভাবিক হোক। আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন। কোনোরকম সাহায্য লাগবে, বলবেন।”
._________
ঠান্ডায় ঘন ঘন কাঁশতে ব্যস্ত আরশি। শরীরে তার মোটা শাল, মাফলার, কানটুপি, মুজা, গ্লাভস। তবুও শীত কমছে না। থরথর করে কেঁপে চলেছে ক্রমাগত। গরম পানিতে বেশ কয়েকবার উষ্ণতা নিয়েছে। চা কফি খেতে খেতে জিভের ডগা কালচে হয়ে গেছে। হঠাৎ এমন ঠান্ডার কারণ কাউকে বলেনি সে। তার সন্নিকটে আসন দিয়ে বসে আছি আমি। আরশির হাতে অরিশ ভাইয়ার ল্যাপটপ। এখন তার একমাত্র লক্ষ্য টাইটানিক মুভি দেখা‌। সেই লক্ষ্যে স্থির রেখে মুভি দেখতে বসলো আরশি। কিয়ৎক্ষণ আগে ভাইয়ার রুমে আমাকে দিয়ে আনিয়েছে সে।

টাইটানিক মুভি বের করে অন করলো আরশি। ক্রমাগত সেকেন্ড পার করে চলেছে। কিছু একটা মনে দিয়ে খুঁজছে সে। আমি আরশির কাজে চরম বিরক্ত। বিরক্তি নিয়ে বললাম..

– ‘আরু, টাইটানিক মুভি দেখবি বলে ল্যাপটপ নিয়ে এলাম। এমন ভাবে মুভির মাঝখানে কিছু খুঁজছিল মনে হচ্ছে কোনো গুপ্তধন লুকিয়ে আছে।”

আমার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না দিয়ে দেখতে মনোনিবেশ করলো সে। কিছুক্ষণ পর ল্যাপটপ টা বেডের উপর রাখলো। গালে হাতে দিয়ে দেখতে দেখতে বলে..

– “লুক, হেব্বি জিনিস। এই সিনটা টিভিতে কেটে আপলোড করে। তাই দেখি নি।”

সাথে সাথে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ল্যাপটপের দিকে দিতেই কুঁচকে এলো আমার চোখ। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। দুহাতে চোখ চেপে ধরে বললাম..

— কিসসস্! আরশি, প্লীজ স্টোপ দিস। ওয়াট আর ইউ লুকিং এট? স্টোপ আপ, ইফ এনিঅন কামস্।

– “চিন্তা করিস না, কেউ আসবে না। প্যারা নাই চিল, সি..

এখনো আমি অন্য দিকে তাকিয়ে আছি। আরশি মন দিয়ে দেখছে। ভাগ্য হয়তো তার সহায় ছিল না। তদানীং প্রবেশ ঘটল অরিশ ভাইয়ার। আরশি দেখায় এতোটা মগ্ন ছিল যে, ভাইয়াকে দেখে নি। দ্রুত স্টোপ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে ফিচেল হাসলাম। আরশি বলে,

— ঋনি, দে তো? সিনটা শেষ হয়ে যাবে..
আমি দাঁতে দাঁত চেপে মৃদু শব্দে বললাম..

– “অনুগ্ৰহ করিয়া আপনার নয়ন জোড়া দিয়ে সামনে দর্শন করেন। নাহলে একটু পরে নতুন সিন শুরু হবে।

সামনে অরিশ ভাইয়াকে দেখে চুপসে গেল আরশি। আমতা আমতা করে বলল..

– “ভ-ভ-ভাইয়া। ত-তুই এখানে কি করছিস?”

সন্দিহান চোখে দুজনের দিকে আলোকপাত করলো সে। অপ্রস্তুত স্বরে বলেন..

– “ল্যাপটপ নিতে এসেছি। এতে তোতলানো‌ কি আছে?”
ভুতুড়ে ঢোক গিলে বললাম..
– “ভাইয়া তুমি যাও, আমি ল্যাপটপ নিয়ে আসছি! ”

নো..! বলে এক প্রকার আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন ল্যাপটপ। আচম্বিতে এমন হওয়াতে শক্ত করে ধরতে পারি নি ল্যাপটপ। আরো একবার করুন সুরে ল্যাপটপ চাইলাম, তিনি নো বললেন। এর পরের পরিস্থিতি অনুভব করে দৌড় লাগালো আরশি। এবার হয়তো ভাইয়ার সন্দেহ জোরালো হলো। ল্যাপটপ খুলে দেখলেন। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম আমি। পড়নে আমার নীল রঙের জিন্স, লাল টি শার্ট। টি শার্টের উপরে নীল রঙের জ্যাকেট। চুলগুলো দুই পাশে বেনুনী করা। উপরে কানটুপি। পায়ে কাপড়ের জুতা। দেখতে বাচ্চাদের মতো লাগছে। ল্যাপটপ টা আমার দিকে মুখ করে বলল..

-“ছিঃ তরী। কি এইসব? এখন এইসব দেখা শুরু করেছিস। ডোন্ট এক্সপেক্ট।”

– “ভাইয়া বিশ্বাস করো, আমি..

চুপ বলে কিছু একটা করলেন তিনি। টেনে বেডের উপর বসিয়ে দিলেন। নিজের সাথে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে বললেন, দেখতে। ঘৃন্নায় চোখ মুখ ইতিমধ্যে কুঁচকে এসেছে আমার। উঠতে চাইলেই বেনুনী ধরে টান দিলেন। আবার বসে পড়লাম পূর্বের জায়গায়। ভ্রু নাচিয়ে বললেন..

– “এবার দেখছিস না কেন? আগে শুধু কিস্ ছিলো, এখন বাকিসব আছে?”

এবার আমার অবস্থা শোচনীয়। মুখ কুঁচকে বললাম.. -“ভাইয়া বিশ্বাস করো, আমি এইসব দেখি নি। প্লীজ আমাকে ছেড়ে দাও।

– “পুরোটা না দেখে কোথাও যাওয়া চলছে না।”

এবার মুখ কুঁচকে কেঁদে উঠলাম আমি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম..

-“ভাইয়া প্লীজ আমাকে যেতে দাও। আমি আর কখনো এমন করবো না।”

অরিশ ভাইয়া হাত ছেড়ে কাঁধে হাত রাখলেন। আশ্বাসের কন্ঠে বলল,.

– “দেখতে হবে না। তুই কাঁদিস না।’

বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মুচকি হেসে ভাইয়ার বুকে মাঝে বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে গেলাম। বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে গেল সে।

চলবে.. ইনশাআল্লাহ
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here