অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -১৪+১৫

#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৪

হাড় কম্পন হিম শীতল রজনী। এশার আযানের মাধুর্য ধ্বনিতে সালাতের আহ্বান জানানো হয়েছে বেশ কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। সালাত আদায় সেরে পড়ার টেবিলে বসে আছি আমি আর আরশি। মহাশয়ের আসার খবর নেই। কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। বিগত দিনগুলোতে পড়াশোনা শেষ তবে রিভিশন নামক চার অক্ষরের একটা শব্দ রয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল তার গ্ৰহনযোগ্য না হলে জনাব একটু শান্তি দিবে না। কলম কামরাতে কামরাতে যখন ভাইয়ার ভাবনায় বিভোর ছিলাম, তদানীং প্রবেশ করলেন তিনি। আমার মন মস্তিস্ক নিখোঁজ অজানায়। মস্তিষ্কে মারলেন চপল। বিনিময়ে কলমের খোঁচা খেলাম অধরে। ফোঁস করে উঠলাম সাথে সাথে। হাত রাখলাম ব্যাথার্ত স্থানে। গালে হাত রেখে তৃষ্ট নয়নে চেয়ে রইলাম। আরো একটা চপল মারলেন বাহুতে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে..

– “কালকে পরীক্ষা আর তুই জামাইয়ের ভাবনায় বিভোর কেন? পরীক্ষায় ফেল করলে রাস্তার ঝারুদাড়, স্যরি ঝারুদাড়ী বানাবো তোকে।”

ভেংচি কাটলাম আমি। মনোনিবেশ দিলাম বইয়ের অন্তিম পাতায়। ভাইয়া তার লোচনের চশমা খুলে রাখলেন টেবিলের উর্ধ্বে। দুহাতে হ্রস্ব কেশসমূহ যদৃষ্টভাবে অগোছালো করে নিল। পা জোড়া পা দানির উর্ধ্বে দুলিয়ে চলেছেন। সুক্ষ্ম বৃদ্ধি কৌতূহল ধরা দিলো মস্তিষ্কে।
অতিবাহিত হলো স্বল্পকাল। বহির্ভাগ থেকে ঈষৎদন্ধকারে প্রকৃতির অপরিস্ফুট ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কর্ণগোচর হচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের মাঝে কোনো রুপ প্রভাব পড়ছে না।
নিজের ঠান্ডা শীতল দু’পা স্থাপন করলাম তার পায়ের পাতার উপরিভাগে। কম্পিত হয়ে উঠলেন তিনি। অশান্ত নেত্রে তাকালেন আমার নিমিত্তে। রহস্যময় হাসি দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলাম। আমার নিকটে আরশি আরশি অবস্থান, নাহলে আজ আমার রক্ষে ছিলো না।
কিয়ৎক্ষণ পর বইটা এগিয়ে দিলাম ভাইয়ার অভিমুখে। বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। এই ফাঁকে গালে হাত দিয়ে বোঝার অভিনয় ধরে, তার পায়ে স্লাইড করতে লাগলাম। পড়নো থামিয়ে ভ্রু নাচালেন খানিকটা। আমি ফাজলামির স্বরে বললাম..

– “ভাইয়া তুমিও কি পারো না। কালকে যদি এটা আসে তাহলে কি দিবো?”

বলেই তদানীং অধর উল্টে ফেললাম আমি। অরিশ ভাইয়া বোঝাতে মন দিলেন। আমি পুনরায় আমার কাজ সমারম্ভ করে দিলাম। পূর্বের ন্যায় এবারও পড়ার গতির কমিয়ে দিলেন তিনি। একসময় পুরোপুরি গতিহীন করে বিরতি দিলেন।অকস্মাৎ ওরনা ধরে টান দিলেন। কোটার থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো আমার। আরশি দুহাত চোখে দিয়ে রইলো। ভাইয়া এমন কিছু করবে বোধগম্য হয়নি আমার। নয়ন যুগল অম্বুতে পূর্ণ হয়ে এসেছে। নিচু করে নিলাম চোখজোড়া। পায়ে শীতল স্পর্শ পেয়ে নয়ন যুগল মেলে তাকালাম। অরিশ ভাইয়া তার হাতজোড়া দিয়ে আমার পা দুটো টেবিলের পা দানির সাথে বেঁধে দিলেন। উঠে সোজা হয়ে বসলেন। কাঁটার দিয়ে স্বত্নে গোছালো কোমড় জড়িয়ে যাওয়া কেশসমূহ থেকে কাঁটা সরিয়ে দিলেন। চুলগুলো সামনে এনে মেলে দিলেন। রহস্যময়ী হাসি হেসে বলে..

– মুখ ঘুরিয়ে রাখার মতো কিছু হয়নি, পিচ্চি।

আরশি করুনতা মাখানো খাঁ খাঁ চোখজোড়া দিয়ে চেয়ে আছে। হয়তো উপলব্ধি করার বৃথা প্রচেষ্টা চালাচে, কি হয়েছিলো কিন্তু অরিশ ভাইয়ার কাউকে কিছু বুঝতে দিলো না।
_______
খাঁ খাঁ রৌদ্দুর মাখানো মধ্যাহ্ন। একটা পঁয়তাল্লিশ। হিমঋতু বিধায় শীত উপলব্ধি হচ্ছে না। ভিড় ভাট্টার মাঝেও ঠান্ডা ঠান্ডা আদ্রর্তা বিরাজমান। গায়ে শীত নিয়ন্ত্রণ হালকা শাল মুড়ানো। মাত্র পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছি আমি। প্রশ্ন দেখতে দেখতে বাইরে এসেছি। আমার পায়ের গতির সাথে আরশির পায়ের গতি সম গতিশীল রেখে হেঁটে চলেছি। তার নয়ন যুগল চাতক পাখির ন্যায় এদিকে ওদিক সন্ধান করে চলেছে। কাউকে ভিশন করে খুঁজছে। আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে দ্রুত বেগে ছুটল সে। পশ্চাৎ থেকে কয়েকবার ডাক দিলাম কিন্তু তার হেলেদুলে পাওয়া গেল না।

প্রবেশদ্বারের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। জনশূন্য হয়ে উঠেছে ভার্সিটির অন্তর্ভাগ। এদিক ওদিক অবলোকন করছি। অরিশ ভাইয়া দাঁড়াতে বলেছেন আমায়। বেশ কিয়ৎক্ষণ পর বাইক সমেত ভার্সিটির থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। আমার সামনে থামালেন। উঠে বসলাম বাইকে। হেলমেটটা পড়িয়ে দিলেন মাথায়। ভাইয়ার বাইকে উঠলেই পর্বপ্রথম কাজ, হেলমেটটা পড়িয়ে দেওয়া। আমাকে নিয়ে কখনো কোনো রুপ ঝুঁকিপূর্ণ থাকতে ইচ্ছুক নয় তিনি।
বাইক চলতে আরম্ভ করলেন বিপরীতমুখী অর্থাৎ বাড়ির বিপরীত রাস্তায়। এসে থামালেন নির্জন শুনশান স্থানে। পার্কের অন্তর্ভাগ জনশূন্য নিরিবিলি। মধ্যাহ্নের কারণে কোনো জনমানবের চিহ্ন টুকু নেই। ঝোপঝাড় পেরিয়ে চলে এলাম অন্য একটা প্রান্তে। ঝিলের চারিপাশ জুড়ে সবুজ গাছের সমারোহ দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট কলাগাছের ভেলা বেঁধে রাখা হয়েছে। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। এতোক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে বললেন..

– “আমার পিচ্চি তরী, আজকে কৃত্রিম তরীতে উঠবে।”
না বোধক মাথা নাড়ালাম সায় দিলাম আমি। যদি একবার নিচে পড়ে যাই। পানি খেয়ে ঢোল হয়ে যাবো। এমনিতেই সাঁতার জানা নেই।
দুহাত দু-কাঁধে রাখলেন ভাইয়া। আশ্বাসে জড়ানো কন্ঠে বলে..

– “ডিঙিরানী, আমি থাকতে কিসের ভয় তোমার। কিছু হতে দেবো। বিশ্বাস করো না আমায়?”
বিশ্বাসের শব্দ গহীন শোনালো শ্রবণপথে। ফট করে প্রত্যুত্তর দিলাম আমি..
– “করি, তোমাকে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি।”

– “তাহলে ভয় কিসের, পিচ্চি?”

– “নেই কোনো ভয় নেই?”
কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে মেলে দিলেন ভাইয়া। তার হাতের করতলের উপর নিজের হাত ঠেকালাম। মুঠোয় ধরে শক্ত করে নিলেন। অপর হাতে ভেলা ইশারা করলেন।

নৌকায় পা ফেলতেই দুলতে শুরু করলো। এক দৌড়ে ভাইয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালাম আমি। সন্দিহান স্বরে বলে..

– “কি হয়েছে পিচ্চি?”

– “দ-দুলছে, যদি পড়ে যাই!” (ঠোঁট উল্টে আমি)

– “এই মাত্রই তো বললি, আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই?”
এবার কোমড়ে হাত দিয়ে বলল..
– “পড়ে গেলে তুমি যে আমার তুলবে, সেই বিশ্বাস আছে। কিন্তু আমার গুষ্টির দফা করা করবে, তার কোনো বিশ্বাস নেই? বলবে, “চোখ কি মাথায় তুলে রাখিস, ডাফার। হাঁটিস কোনদিকে তাকিয়ে?”
মনে করো কি? আমি বুঝি না।”

-“আজ তো তোকে..
বলে দৌড় লাগালো। তাকে দেখে আমিও ছুটলাম। আর যাই হোক ছেলেদের সাথে দৌড়িয়ে পারা সম্ভব নায় আরো একবার প্রমানিত হলো সেই চিরন্তন সত্য। পশ্চাৎ থেকে এক গুচ্ছ কেশ টেনে ধরলেন। পেঁচিয়ে নিলেন আঙুলের ডগায়। অটোমেটিক চরণ জোড়ায় বিরতি টানল আমার। মুখ ফুলিয়ে পেছনে ফিরলাল। এই ছেলেটা যখন তখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, বিশ্বাস নেই। তেমন কিছু করলেন না তিনি। চুল ছেড়ে পাজাকোলে তুলে নিলেন আমায়। এগিয়ে গেলেন ছোট ছোট পা ফেলে দ্রুত গুছিয়ে ভেলার উঠলেন। উঠে বসিয়ে দিলেন কিনারায়। সম্পূর্ণ সময় চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে ভাইয়ার বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ছিলাম। যেটা ছিল ম্যাজিকের এক অনুভূতির সাক্ষী। প্রথমবার কাছে আসা নয়, তবে প্রথমবার প্রকৃতির সাথে ভাইয়ার কাছে মিশে যাওয়া।

_____
নববর্ষ নামটা শুনলেই অন্তরে আনন্দিত আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। এই আনন্দিত আমেজ উপভোগ করতে ঘুড়তে বেরিয়েছে ভাই-বোন জুটি।
নিদ্রায় চক্ষু পাতা লেগে লেগে আসছে। রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে। মামার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দরজায় দু আঙুলের সাহায্যে টোকা দিলাম। কোনো কথন শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত এলো না। গভীর রাত্রি অবধি জেগে থাকার বদভ্যাস মামুনির নেই। সে নিদ্রাচ্ছন্ন। মামা প্রতিদিন রাত জেগে ম্যাগাজিন পড়ে। কাপ নিয়ে বেলকেনিতে গেলাম সোজাসুজি। বেলকেনিটা সাধারণ বেলকেনির মতো না। বিশাল বড় জায়গা জুড়ে। বড় একটা টি টেবিল। টেবিলের উপর খবরের কাগজ, কিছু বই, ম্যাগাজিন রাখা। এখানে প্রকৃতির ছোঁয়া আছে। দুইটা ক্যাকটাস গাছের চারা আছে। খোলা ঠান্ডা হাওয়া প্রবেশ করছে গ্ৰিল টপকে।
মামা চায়ের কাপে চুমুক বসালেন। আপাতত ড্রিম আলো জ্বলছে শুধু বেলকেনির অংশ জুড়ে। তার আলোর রেখা অন্তর্ভাগে প্রবেশে বাধা পাচ্ছে। বাইরের মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে। স্মিত হেসে পাশে বসতে বললেন আমায়। তার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। মাথায় হাত রাখলেন মামা। হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন..

– “মন খারাপ তোর তরিন? মামার উপর রেগে আছিস? স্যরিরে পাগলী। এই বয়সে তোর মামুনির সাথে ঝগড়া করতে চাই না। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি।”

সময় নিয়ে ঘনঘন পলক ফেলে সায় দিলাম আমি। আমাকে অরিশ ভাইয়ার থেকে বহুদূরে সরানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। হৃদমাঝারে কেমন খাঁ খাঁ করছে। মামা ভাগ্নির কথার মাঝে প্রবেশ করলেন মামি। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন..

– “তুই আবার এখানে এসে বসে আছিস? তোকে না বলেছি, বাসন কাসন ধুয়ে দিতে। যা বের হ..

– “অনিতা চুপ করবে তুমি? মেয়েটার সাথে এমন করছো কেন তুমি?”

– “যা করেছি বেশ করেছি। বামন হয়ে আমার ছেলের দিকে হাত দেওয়ার দূর্সাহস দেখিয়েছে। ওকে এতো সহজে ছেড়ে দিবো না।
আমার অরি সোনাও হয়তো ওর আসল রুপ চিনে ফেলেছে। তাই শুধু আরুকে নিয়ে ঘুড়তে গেছে‌। তুই তো আপদ,

ক্লান্ত নয়ন জোড়া দিয়ে মামুনিরে দিকে চেয়ে রইলাম। ভাষা হারিয়ে গেছে অজানায়। অন্ধকারের মাঝে আমার কাতর মুখটা তাদের দৃষ্টিগোচর হলো বলে মনে হলো না। ইতিমধ্যে মামার চা প্রায় শেষের দিকে। চায়ের নিম্নাংশে তলানিতে জমে থাকা চা টুকু খেয়ে ফাঁকা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন। ফাঁকা কাপ হাতে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে প্রস্থান করলাম।
#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৫

রাত্রি গভীরতম। হাতের ফাঁকা চায়ের কাপ। ফিরে এসেছি মামার ঘরে থেকে। মামাও শুয়ে পড়ছে। অরিশ ভাইয়া আর আরশি আজকে বাড়িতে ফিরতে রাত দুইটা ছাড়িয়ে যাবে। আমাকে অপেক্ষা না করে ঘুমাতে বলেছে। তিনি এসে ফোন করবে। আরশি নাকি তার সাথেই আছে। দুই ভাই বোন একসাথে ফিরবে। নিজের ভাইয়ের কথা মস্তিষ্কে এলেই নয়ন যুগল ভিজে উঠলো আমার। আচ্ছা ভাইয়া আমার সাথে থাকলে কি, খুব অজস্র লোকসান হয়ে যেত। আমাদের ছোট একটা পরিবার হতো। সবাই একসাথে সেখানে থাকতাম। কিন্তু! সব আমার নিয়তির পরিহাস। হয়তো বাবা মা, ভাইয়ের ভালোবাসা আমার জন্য নয়। তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম।

গড়িয়ে পড়ার পূর্বে জলকণা মুছে ফাঁকা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলাম। বেসিনের এঁটো থালা বাসন গুলো ধুয়ে নিলাম। যথার্থ স্থানে সাজিয়ে রাখলাম। অতিশয় ঠান্ডায় রীতিমত হাত পা, সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার। চুলোয় উষ্ণময় ছোঁয়ায় শরীর ছেকে নিলাম। সমস্ত বাড়ির আলো নিভিয়ে পা জোড়া গতিশীল করে ছুটলাম রুমের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার পূর্বে শ্রবণ হলো অস্ফুট কন্ঠস্বর। দিদা টিভি দেখা শেষ করে চলে গেছে, এদিকে টিভি এখনো চলছে। পুনরায় নেমে গেলাম নিচে। রিমোট হাতে নিয়ে বন্ধ করতে চাইলে চ্যালেন ঘুরে গেল। টিভিতে রাত ১২টার সংবাদ চলছে।

– “হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই শুনেছেন। আজকে সন্ধ্যা সাতটায় বিচের পাশে ৯টা তরুন ছেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের অবস্থা ছিল বিধ্বস্ত। কোনো অপঘ্যাতে মাফিয়ার হাতে মৃত্যু হয়েছে তাদের। মুখমন্ডল থেঁতলে দিয়েছে। শরীর থেকে হাত, পা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। চেনার উপায় নেই। ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। চলুন আরো একবার দেখে আসি..

পরপর কয়েকটা চ্যানেল চেঞ্জ করলাম। সব চ্যানেলে একই নিউজ। ফুটেজে সন্ধ্যা সাতটা বিশ উল্লেখ করা রয়েছে।
রীতিমত মতো ঘাম ছুটছে আমার শরীর থেকে। তীব্রতর ভীতিকর পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারলাম চারদিক। চারিদিকে ঘুটঘুটে আলোকহীন আঁধার। টিভির অস্পষ্ট ঔজ্জ্বল্যে যতোটুকু দেখা যাচ্ছে। তাদের চিনতে আমার দৃষ্টি ভ্রম হয়নি। এগুলো তো সেই ছেলেরা। পড়নে সেই দিনের জামা কাপড় গুলো, তবে বিচ্ছিরি, নোংরা এবং রক্তে বিবর্ণ হয়ে গেছে। তাদের মুখশ্রী আমি দেখি নি কিন্তু সেই রাতের দৃশ্য গুলো স্মৃতির পাতায় রয়ে যাবে আজীবন। বেশ কিয়ৎক্ষণ তাদের নিখোঁজ হওয়ার বিজ্ঞাপন রাস্তা ঘাটে, টিভিতে দেখানো হয়েছিল।

মাথাটা ভারি হয়ে আসছে। লাশগুলো দেখে শরীরটা ক্রমশ শিতল রুপ ধারণ করছে। দ্রুত হাত দিয়ে টিভি বন্ধ করে নিলাম। সাথে সাথে অন্ধকারে ছেয়ে গেল সবকিছু। দুহাতে মাথা চেপে বসে পড়লাম নিচে।
_______
প্রত্যুর্ষের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে দিক দিগন্তে। কুয়াশা বিহীন ঝকঝকে নীলাভ অন্তরিক্ষ। আমি শান্তমনে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিলাম। এখনো বাড়িতে ফিরে নি অরিশ ভাইয়া আর আরশি। মামা অফিসে চলে গেছে। দিদা টিভি দেখতে দেখতে পান চিবুচ্ছে। আমি সবে সবজি তরকারি বসিয়েছি চুলোয়। এমন সময় টোকা পড়লো দরজায়। ব্যাঘাত ঘটল আমার কাজের। এক দৌড়ে ছুটলাম দরজা খুলতে। আমার বিশ্বাস অরিশ ভাইয়া এসেছে। দরজা খুলতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম আমি। আমাদের ভার্সিটির প্রোফেসর এসেছে। নিঃশব্দে সরে দাঁড়ালাম। উল্টো ঘুরে ওরনা টেনে শরীর পেঁচিয়ে নিলাম। সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে বললাম। মুচকি হেঁসে বললেন..

– “শুভ নববর্ষ তরিন!”

– সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজিব।
ইংরেজি নববর্ষ তাই ইংরেজিতে বলাই বেটার। তাছাড়া কালকে এক তারিখ ছিল আজ নয়।

– “সে যাই হোক! তোমার জন্য আমার জীবনে প্রতিটি দিনই সুন্দর দিন।”

বোধগম্য হলো না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম তার নিমিত্তে। তিনি আমাকে এমন অবস্থায় দেখে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। ধ্যান ফিরতেই ছুটলাম তার পিছুপিছু। টেবিলের উপরে প্যাকেট রাখলেন। চেয়ারে আয়েস করে বসলেন। প্যাকেটের অন্তর্ভাগে মিষ্টি করছে, আমি সিউর। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম..

– “স্যার, ভাইয়া বাড়িতে নেই। আপনি বরং ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করে আইসেন। এবার আসুন..

ভ্রু কুঁচকালেন নিভ্রান স্যার। হাত ধরে টান দিলেন আমার। বললেন..

– “আমি আমার হবু বউয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি, তার ভাইয়ের সাথে নয়। তাড়াতাড়ি মামি শাশুড়িকে ডাকো?”

ভ্যাবাচাকা খেলাম আমি। মামি শাশুড়ি মানে কি? মামুনি আবার জানিয়ে আরশির বিয়ে ঠিক করেনি তো? তাহলে মামি শাশুড়ি কেন বলবে? তাহলে কি মামুনি আমার সাথে? সেটা কি করে হয়। মামুনি সেই ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমার ভাবনার মাঝেই মামুনি চুলে এলেন!

– “ঋনী, রান্না রেখে কোথায় গিয়েছিস তুই..

শব্দ গুলো শেষ করলেন না। সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে কি রিয়েকশন দিবো, হয়তো ধ্যান হারিয়ে ফেলেছেন। খুশিতে গদগদ হয়ে এগিয়ে এলেন। বললেন..

– “বাবা ভালো আছো তুমি?” নিভ্রান স্যার কে কিছু বলতে না দিয়ে আমাকে বললেন..

– “ঋনী, যা জামাইয়ের জন্য খাবার..! তুই এইসব কি করেছিস মুখের। (তাকে উদ্দেশ্য করে) আসলে ও রান্না করতে খুব ভালবাসে তাই।”
– “ওতো কিছু আমি জানি না, আমার বউ রান্না ঘরে যাবে না ব্যাস..
নিজের আঁচল দিয়ে আমার ললাটে লেগে থাকা কালিগুলো মুছে দিলেন। প্রথমে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সবটা বোধগম্য হতেই বক্ষ চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
একপ্রকার জোর করে মামুনি আমাকে রুমে পাঠিয়ে দিলেন শাড়ি পড়তে। গাঢ় সবুজ রঙের একটা শাড়ি ধরিয়ে দিলেন হাতে। আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলাম। আমার কোনো ভাবাবেগ না পেয়ে নিজের হাতে শাড়ি পড়িয়ে দিলেন। চোখে হালকা কাজল, লিপস্টিক। নিয়ে বসালো আমার স্যারের পাশে। এতোক্ষণ পর বুঝতে পারলাম তিনিই আমার হবু বর। সেদিন যেই ছেলেটা আমাকে দেখতে এসেছিলো সে নিভ্রান স্যারের ভাই সাথে মধ্য বয়স্ক মহিলা ছিলেন তার মা।
আমি এক ধ্যানে চাতক পাখির নিমিত্তে তাকিয়ে রইলাম দরজার নিমিত্তে। এই বুঝি এলো ভাইয়া, কিন্তু আমাকে নিরাশ করে দিয়ে এলেন না। একসময় আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে।

রৌদ্র ঝিকিমিকি করা শান্ত বিকেল। ঠান্ডা শীতল হাওয়া। যেই হাওয়া নদীর গতি পরিবর্তন করে দিয়েছে তার উল্টো দিকে। পাখিরা গাছের ডালে বসে কিচিরমিচির ডেকে চলেছে।
পাশাপাশি হাঁটছি আমি। আমার সামান্য একটু দূরত্ব নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে নিভ্রান। হাঁটছে সামনের দিকে। কিন্তু দৃষ্টি আমার মাঝে বন্দী। আমাকে এমন ভাবে কেউ চেয়ে রইলেন বরাবরই বিরক্ত হই আমি। ইচ্ছে করে তার চোখ গুলো তুলে ফেলি। কিন্তু আপাতত তা সম্ভব নয়। শাড়ির লম্বা আঁচল টেনে শরীর ঢেকে নিয়েছি। নির্জন ব্রীজের উপর এসে থামলেন তিনি। বসলেন রেলিং এর উপরে। আমাকেও ইশারা করলেন বসতে। কিন্তু বসলাম না, অরিশ ভাইয়ার অনুপস্থিতে কখন রেলিং এ বসার স্পর্ধা নেই আমার।

আচম্চাই হাত ধরলেন তিনি। রেলিং এর কাছে এনে উপরে উঠানোর প্রচেষ্টা করলেন। একদিকে শাড়ি অন্যদিকে এই বিরক্তকর মানুষ। দুটিতেই হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। উপায় নেই, বাধ্য হয়ে রেলিং এ উঠলাম আমি। আনুমানিক ৭-৮ ইঞ্চি প্রশস্ত রেলিং। একহাত ধরে নিচে নিচে হাঁটলেন তিনি। তবে হাত ছাড়লেন না আমার। ধীরে পা ফেলে আমিও হাঁটলাম। একটা সময় এসে বুঝতে পারলাম, প্রচন্ড ভ্রীতি এসে জড়োসড়ো করে তুলেছে আমায়। করুনতা মাখানো চোখে তার নিমিত্তে তাকিয়ে বললাম..

– “আমার প্রচন্ড ভয় করছে। প্লীজ, আমাকে নামান।”

আমার হাত ছেড়ে দুহাত বুকে গুঁজলেন তিনি। অদ্ভুত স্বরে বললেন..

– “মাত্র এইটুকু পথ হেঁটে এমন হাঁসফাঁস করছো কেন? যখন অরিশের সাথে উঠ তখন তো দিব্বি একটা ব্রিজের রেলিং পেরিয়ে ফেলতে।”
তারমানে অরিশ ভাইয়ার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী করে আমাকে রেলিং এ তুলেছে।
প্রচন্ড ভয়ে মুখ ফসকে বলে ফেললাম..
– “অরিশ ভাইয়ার থাকলে আমার ভয় করে না।”

— “ইউ মিন, আই ক্যান নট বি ট্রাস্টেড”

বলেই হাত ধরে টান দিয়েন। নিজেকে সামলানোর আগেই পড়লাম রেলিং এর ভেতরে। পা ঠিক ভাবে মাটি স্পর্শ না করাতে আঘাত পেলাম। মনে হলো ভেঙ্গে গেছে। দুহাতে পা চেপে চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম। উঠার চেষ্টা করলে উঠতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম পা মচকে গেছে। না চাইতেও হাতটা এগিয়ে দিলাম নিভ্রানের নিকট। ধরলেন না তিনি। আমার দিকে একটু ঝুঁকে বললেন..

– “স্যরি বলো!”

– “কেন?”

– “আমার সামনে আমি ছাড়া আর কারো প্রশংসা করবে না তুমি। সেই প্রমিজ করবে তুমি। সাথে অরিশের সুনাম করার জন্য স্যরি বলবে।

ভ্রু কুঁচকালাম আমি। লম্বা একটা হাই তুলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম..- “শুধু পা মচকালে কেন? মেরে ফেললেও আপনাকে স্যরি বলবো না।”

ওকে ফাইন বলে ছুটল সে। তিনি গাড়িতে উঠে চলে গেল। ধীরে ধীরে গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেল। হাওয়া মিলিয়ে গেলেন। যদি আমি রাজি হই, তাহলে ফোন করতে বলেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করলো গগনের বুকে। নির্জন জায়গায় একা আমি একটা মেয়ে। হাঁটতেও পারছি না। ভেতরের চাপা কান্নাগুলো ছেড়ে দিলাম। কেন বারবার আমার সাথে এমন হয়। উঠে দাঁড়ালাম। রেলিং ধরে ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। হয়তো আমার কষ্ট প্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারল। কিছুদূর যেতেই একটা ফাঁকা রিক্সা পেলাম। বিনা বাক্যেয় উঠে বসলাম।

________ “অবহেলার এই শহরে,
ব্যর্থ আমি শীর্ষ প্রহরে”
-ইফা🌿
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)
(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here