অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -৪২ ও শেষ

#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪২

আজ দেশে বহির্ভাগ থেকে অরিশ দেশে ফিরে এসেছে। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাড়ি ফিরছে সে। হেঁটে হেঁটে। রাস্তা দিয়ে গেলে সময় লাগবে অনেক। তাই পায়ে হেঁটে ফিরছে। বাড়ির থেকে তখনও বের দূরে অবস্থান করছে অরিশ। তার লাকেজসহ জিনিস পত্র পাশে রেখে চেইন খুলে পানির বোতল বের করল। এক ঢোক পান করে ব্যাগে রাখল। তার দৃষ্টি গেল ডান পাশে। এক বউ বেশে মেয়ে গাছের ডালের সাথে কিছু একটা করছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না তার। অরিশ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো, মেয়েটি গাছের সাথে দড়ি বেঁধে আ’ত্মহ’ত্যা করার চেষ্টা করছে। অরিশ ছুটে গেল সেদিকটায়। মেয়েটাকে পেছন থেকে চেপে সরিয়ে আনার চেষ্টা করলো। বারবারই ব্যর্থ হচ্ছে সে। একপর্যায়ে চ’ড় বসিয়ে দিয়ে মেয়েটির গালে। মেয়েটি দমে গেল। ব্যথার্থ হয়ে নুইয়ে গেল। অরিশ চমকে গেল। তার বুকটা কেঁপে উঠল। মেয়েটি আর কেউ নয় তরী ছিলো। অরিশ কিয়ৎক্ষণ বাকহীন হয়ে পরক্ষণেই তরীকে জড়িয়ে নিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
-” তরী! কি হয়েছে তোর? তুই এই বেশে কি করছিস? গাছের সাথেই কি করছিলি?”

তরী কেঁদে উঠলেন। অরিশের বাঁধন উপেক্ষা করে নিচে বসে পড়লো। মাটির দিকে চেয়ে থেকে বলল,
-” আমি তোমার যোগ্য নয় ভাইয়া! ভুলে যাও আমাকে!”

অরিশ তরীকে সান্তনা দিতে লাগলো। বারবার জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে? তরী উত্তর দিলো না। ধমকে উঠলেন অরিশ। তখন ধীরে ধীরে সবটা বলল তরী। অরিশ দূরে সরে গেল। অনিতা তাকে কথা দিয়েছিল তরীর কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। এই তার প্রতিদান। একদিকে মা অন্যদিকে বউ। কষ্টে ভেতরটা ছিঁড়ে গেল তার। তরীর টিউমার ক্যান্সার রুপ নিয়েছে‌। তরী ছাড়া তার জীবনের কোনো মূল্য নেই। অরিশও অসহায় কন্ঠে বলল,
-” আমাকে তোর সাথে নিবি তরী?”

-” মানে!” না বোঝার স্বরে!

-” আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে তরী। বড্ড বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আমাদের ছোট একটা মেয়ে হবে। আমাকে বাবা বলে ডাকবে। আমি সেই মুহুর্তটা উপলব্ধি করতে চাই। কিন্তু সেটা কখনো সম্ভব হবে কি-না জানা নেই।
চল আমরা তোর মায়ের কাছে চলে যাই!”

তরী অবাক চোখে চাইলো। তরীর মা তাকে জন্ম দেওয়া সময়ই গত হয়েছে। বিচলিত হয়ে উঠলো,-” কি বলছো তুমি? মা তো নেই?”

-” আমরা থাকবো না। ফুফুজানের কাছে গিয়ে থাকবো। আমি তোকে ছাড়তে পারব না তরী। তোকে নিয়ে কোথাও গেলে, মায়ের অভিশাপে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো। শত হোক, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত। যতোই হোক তিনি আমার মা। আমি নাহয় তুই, মায়ের কারো কথাই রাখলাম না। বাড়িতে গেলে মা আমাকে কসম দিয়ে তোর থেকে আলাদা করে দিবে। তাছাড়াও আমি তো তোর দেনমোহর। আমি নাহয় দেনমোহর হিসেবেই তোর সঙ্গে থাকবো।”

-” আমি যে ধর্ষ..

-” চুপ! কিডন্যাপ হওয়ার আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। পরে নয়। এটা আমার ভাগ্য ছিলো।”
তরী নিশ্চুপ। অরিশ তাকে এতোটা ভালোবাসে। সে জানতো না। তরী অরিশের কাঁধে মাথা রাখলো। ভারী কন্ঠে বলল,-” ভাইয়া আজ কতো গুলো দিন, আমি কিছু খেতে পারি না। চোখের পাতা এক করতে পারি না। তোমার কাছে খাবার হবে? একটু খেয়ে শেষবারের মতো তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতাম?”

অরিশ ব্যাগ হাতরে একটা চকলেটের প্যাকেট বের করলো। তরীর জন্যই এনেছিলো। তরী একে একে পুরো চকলেট গুলো শেষ করলো। অরিশও খেল। অরিশ একবারও বলেনি, এতো খাস না। অসুস্থ হয়ে যাবি। তরী অরিশের বুকে মাথা রেখে শেষবারের মতো নিদ্রায় তলিয়ে গেল। অরিশ গাছের সাথে হেলে নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো রাতটা।

তিনটা বাজে তরীকে ডাকল। অজু করে করে অরিশের ব্যাগ থেকে জায়নামাজ বিছিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করলো। অপূর্বের জন্য দুটো চিঠি লিখল। একে অপরকে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে রইল। ভিজে গেল চোখের কার্নিশ। অরিশের চোখের বাঁধ মানছে না। অরিশ গভীর ভাবে অধর ছুয়ে দিল তরীর ললাটে। অতঃপর ললাটে ললাট ঠেকিয়ে রাখল। তরী আজ লজ্জা পেল না। মাথা গুঁজলো না অরিশের বুকে।
-” আচ্ছা অরিশ ভাইয়া আমাদের কি ছোট একটা তুর আসবে না? কখনোই কি আসবে না?”

তরীর প্রশ্নে অসহায় হয়ে পড়লো অরিশ। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,-” আসবে! কিন্তু আমাদের হাত ধরে নয়। আমাদের মৃত্যুর পর আমার আর তোর সংমিশ্রণে একজন ছোট তুরের আগমন হবে। আমার আর তোর মত হবে। অন্য কারো গর্ভে আসবে সে।”

তরীর পেটে তুর নামক একটি বাচ্চা রয়েছে। বাবা মা কেউ জানতেই পারল না। আর জানা হলো না তাদের।
” ও, ও চাঁদ! জোছনা লুকিয়ে রাখো না?
আমার প্রিয়তমা আমারই বুকেএএ,
দেখে না যেন অন্য লোকে!
ও চাঁদ! ও চাঁদ! জোছনা লুকিয়ে রাখো না?”

সকালের আলো ফোটার সাথে সাথে চারদিকে ছড়িয়ে গেল অরিশ তরীর মৃত্যুর খবর। গাছের উঁচু ডালে দড়ি পেঁচিয়ে গলায় ফাঁসি দিয়েছে। পায়ের বৃদ্ধ আঙুল মাটি ছুঁই ছুঁই। টাকনু শূন্যতায়। একে অপরের হাত ধরে আছে। দূর থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে মাটির উপরে দাঁড়িয়ে আছে।
.
অরিশ দেশে ফেরার একদিন পর অপূর্ব ফিরেছে। অরিশের তরীর জন্য আগেই ফিরে এসেছে। গ্ৰামে পা রাখতেই অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো তার শরীর। চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। ফাঁকা ফাঁকা লাগল। মানুষ হাওয়ার বেগে তাদের বাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে। অপূর্ব তার মামা মোতাহার হোসেন তার সাথে। মামা দিকে চেয়ে বলল,
-” মামা আমার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিছু নেই মনে হচ্ছে।”

আর কিছু বলার আগেই তার গাঁ ঘেঁষে একজন চলে গেল। অপূর্ব দু’পা পিছিয়ে গেল। একটু পর পুলিশ সেদিকে গেল। অপূর্ব আর মোতাহার হোসেন সেদিকে গেল। ভিড় ঠেলে সামনের দিকে যেতেই পাথর হয়ে গেল। অরিশ আর তরীর মৃতদেহ মাটিতে রাখা হয়েছে। অপূর্বের হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেল। অপূর্ব বাকরুদ্ধ। মোতাহার হোসেন স্তব্ধ। অপূর্বের ক্লান্ত ভারী পা টেনে টেনে তরীর কাছে গেল। ঝাঁপসা হয়ে এলো তার চোখ। মাথা হাত দিল। পরক্ষণে মাথা ঘুরিয়ে নিচে পড়ে গেল। সকলে ধরা ধরি করে অপূর্বের জ্ঞান ফেরালো। এই প্রথমবার অপূর্ব কেঁদেছিল। তরীর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলল,

-” বোনু? মা আমাকে তোর দায়িত্ব দিয়ে গেছিলো। তুই আমাকে হারিয়ে দিলি। আমাকে মায়ের কাছে ছোট করে দিলি। আমাকেও নিয়ে যেতি!”

তরীর শক্ত হাত থেকে একটা চিরকুট খুলে পড়লো। অপূর্ব চিঠিটা পড়লো।

” ভাইয়া!
এই ভাইয়া! রেগে আছিস? কিন্তু তোর রাগ ভাঙানোর জন্য আমি যে বেঁচে নেই। তুই যখন চিঠিটা পাবি, তখন আমি তোর থেকে অনেক দূরে। তুই কেন বলিস নি, আমি ধ’র্ষি’তা? তুই কি জানিস, আমার সতীত্বের উপর আঙুল উঠেছে। আমার অজান্তেই অরিশ ভাইয়াকে ডিভোর্স দিতে হয়েছে। ভালোই হয়েছে, আমি মরে গেছি, এমনিতেই বাঁচতাম না। আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। অরিশ ভাইয়াকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, তিনি বুঝলেন না। দেনমোহর পরিশোধ করতে, আমার সাথে চলে এলেন। ভালো থাকবো আমরা।

আরশিকে দেখে রাখিস! আরশিও বিয়ে ঠিক করেছে।”
ইতি মৃত-তরী!

[রিপোর্ট নিয়ে যে প্রশ্ন আছে, তা কয়েকটা আগের পর্বে ডাক্তারের বক্তব্য পড়লে বুঝতে পারবেন।]
অপূর্বের চোখের মণি জ্বলজ্বল করে উঠলো। সকলের থেকে বিষয়টা আড়াল করেছে। সেটা তার বোন জেনে গেছে। তার বুঝতে অসুবিধা হলো না, কিভাবে জেনেছে। অপূর্ব পাশে চাইলো। বড় দা দিয়ে দড়ি কেটে নামানো হয়েছে। অপূর্ব শক্ত করে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে গর্জন করে উঠলো। সকলে সরে গেল। অপূর্ব দা নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। যারা যারা বাড়িতে ঢুকতে বাধা দিয়েছে, তাদের সকলকে এক কোপে মাথা আলাদা করে দিয়েছে। পালিয়ে গেছে সকলে। আরশি তখন নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।

অপূর্ব বাড়িতে গিয়ে অনিতার সামনে দাঁড়ালো। গায়ে রক্ত লেগে আছে। দা এর রক্ত শার্টে মুছে দা উঁচু করে বলল,

-” আমার বোনকে কি বলেছিস তুই? আমার বোনকে মেরে কি ভেবেছিস তুই, ছেলের রাস্তা পরিষ্কার। না! অরিশ নিজেও মরেছে।”

বলেই হা হা করে হেসে উঠলো অপূর্ব। অনিতা কেঁপে উঠলো। তার ছেলে নেই। চিৎকার করে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-” মিথ্যা! মিথ্যা বলছিস তুই?”

-” আমি কেন মিথ্যা বলবো? তুমি নিজে তোর সন্তানকে হারিয়েছো!”

আরশি ছুটে এলো। অপূর্বের সামনে দাঁড়িয়ে আওড়ালো! -” ক-কি হয়েছে ভাইয়া আর তরীর? কোথায় ওরা?”
মোতাহার হোসেন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-” নেই! চলে গেছে। তোর মা ওদের বাঁচতে দেয়নি! ওরা দুইজনে একসাথে গলায় দড়ি দিয়ে..”

-” মা! তুমি..

শান্ত হয়ে গেল পরিবেশ। অনিতা ছেলের দুঃখে কেঁদে উঠলো। অপূর্ব সূচালো চোখে চেয়ে দা দিয়ে আঘাত করতে নিল অনিতাকে। চিৎকার করে উঠল তার মা। মোতাহার হোসেন অপূর্বকে থামিয়ে দিলো। ঘৃণার দৃষ্টিতে বলল,
-” ওদের মেরে ফেললে, ওরা বুঝতে পারবে না। ওদেরকে ধুঁকে ধুঁকে মারতে হবে। ওরা মৃত্যুর জন্য কাতর হয়ে উঠবে। নিজেদের পাপের ফল ভোগ করবে।
আর আপনি? (অনিতার মাকে উদ্দেশ্য করে) আপনাকে অনির কথায় এই বাড়িতে এনেছিলাম। আপনি আমার সাজানো সংসার টাকে শেষ করে দিলেন। আমার এতিম ভাগ্নে টাকে মেরে ফেললেন। আপনি আর আপনার মেয়ে মা জাতীর কলঙ্ক।”

আরশি কাঁদছে। অপূর্ব হাত থেকে দা ফেলে দিলো। আরশির কাছে গিয়ে বলল, “চল!”

-” কোথায়?”

অপূর্বের ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে ভীত হলো আরশি। অপূর্ব কোলে তুলে নিলো। আরশি ভারী সাজ নিয়ে অপূর্বের গলা জড়িয়ে ধরলো। অপূর্ব হাঁটল সামনের দিকে। আরশি জানে না, সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে! অপূর্ব তাকে ভালোবেসে নয়! তাকে বোনের মৃত্যুর শাস্তি দিতে নিয়ে যাচ্ছে।#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥[কল্পনায় অরিশ-তরী]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৩ (অন্তিম)

অবহেলায় কেটে গেছিলো এক বছর। ময়না তদ’ন্তের পর জানতে পেরেছে, তরী প্রেগন্যান্ট ছিলো। ক্যান্সার হয়নি তার। আরশি যন্ত্রনা ছাড়া কিছুই পায় নি অপূর্বের থেকে। প্রতিদিন অপূর্ব এসে বিনা কারণেই তাকে আঘা’ত করত। কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলতো।
একদিন অপূর্ব বাড়ি ফিরলো। এমনিতেই তার মাথা গরম ছিলো। তার উপরে আরশিকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো। বিরাগী হয়ে সেদিন মারতে মারতে রক্তাক্ত করেছিলো আরশিকে। আরশি মাথা নিচু করে রয়েছিল শুধু। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলেছিল,

-” আপনার বোন আমাকে আপনার দায়িত্ব দিয়ে গেছিলো আর আপনি আমাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেলেছেন। এই বোনকে ভালোবাসেন। মায়ের শাস্তি মেয়েকে দিচ্ছেন।
আমার ভাই আপনার বোনকে একা ছাড়বে না তাই নিজে চলে গেছে আর আপনি তার বোনকে আঘাত করছেন? এই তার প্রতিদান!”

অপূর্ব চুপ করে রয়েছিল। আরশি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। নিজের করা কাজের জন্য অনুতপ্ত হলো সে। আরশি তখন বেলকেনিতে বসে কাঁদছিল। অপূর্ব আরশির পায়ের কাছে বসে পড়লো। কানে হাত দিয়ে বলল,
-” স্যরি! আ’ম স্যরি আরু সোনা!”

আরশি তাকালো না। অপূর্ব আরশির অনামিকা আঙ্গুলে একটা রিং পড়িয়ে দিয়ে অধর ছুয়ে দিল। আরশি কেঁদে উঠলো। অপূর্বের বুকে মাথা গুঁজলো। অপূর্ব হাসলো। মেয়েটা এতোটা সহজ সরল।

সেদিনের পর থেকে শুরু হয় দুজনের সুন্দর গোছানো জীবন। চারবার কনসেভ করেছে। প্রতিবার মিসক্যারেজ হয়। এবার সে মা হবে।

বর্তমানে__
অপূর্ব দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো‌। আরশি ঘুমিয়ে আছে। তার মুখে এক চিলতে হাসি। গতিশীল পা জোড়া দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। মাথায় হাত রাখল আরশি। আরশি ফট করে চোখ মেলে চাইলো।আরশি একটু উঠে বসার চেষ্টা করল। অপূর্ব থামিয়ে দিল। মাথার অধর ছুয়ে দিল। আরশির চোখে আনন্দমাখা অশ্রু। বলে,

-” কিছু বলবে না? চুপ করে থাকবে?”

অপূর্ব বেরিয়ে আসতে চাইলে হাত ধরলো আরশি।আরশি বাচ্চাদের ন্যায় টেনে টেনে বলল,
-” তুমি আমার সাথে কথা বলবে না?

-” আমি কেন কথা বলবো? আমি তো আরেকটা লাল টুকটুকে বউ বিয়ে করবো।”

-” মানে! আমি তো তখন আবেগে বলেছিলাম। তাই বলে তুমি সত্যি? আমরা দুজনেই কিন্তু রাগ করব।”

অপূর্ব হাসলো। তার ছোট আরু আজ মা হয়েছে। তাকে বাবা বানিয়েছে। এরচেয়ে পৃথিবীতে আর কি সুখের আছে? -” কি দরকার ছিল তোর, এতো কষ্ট করার? আমি তোকে নিয়েই সুখি। প্রতিবার মিসক্যারেজ হওয়ার পর তোর কষ্টটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। বাচ্চা কাচ্চা..

-” এভাবে বলো না তুমি! আমি দেখেছি, তরীর মৃত্যুর পর তুমি কতোটা অসহায় হয়ে পড়েছিলে। আমি তোমাকে একটা ফুটফুটে নবজাতক দিয়ে খুশি করতে চেয়েছিলাম। ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তুমি বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত হবে, এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। বাদ দাও,
আমাদের প্রিন্সেস হয়েছে। তুমি দেখেছো তাকে? সবাই বলছে, ও নাকি আমাদের মতো হয়নি!”

-” না দেখিনি। তোকে ছাড়া কিভাবে দেখি?”

দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো মোতাহার হোসেন। তার কোলে শুভ্র রঙের চাদরে মোড়ানো এক ছোট অবুঝ শিশু। মোতাহার হোসেনের পেছনে নার্স ঢুকল। মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে আরশির কাছে রাখল। বলল,

-” স্যার! আপনার মেয়ে হয়েছে‌। মিষ্টিমুখ করাবেন না?”

অপূর্ব নার্সের দিকে চেয়ে সৌজন্য হাসলো। অপূর্ব এই হসপিটালেরই সার্জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার।
-” প্রথমত, মেয়েটা আমার হয়নি। আমি বাবা হয়েছি। দ্বিতীয়ত, আমি ডাক্তার হিসেবে নয়। একজন বাবা হিসেবে, হসপিটালের প্রত্যেক কে মিষ্টিমুখ করাবো!”

মোতাহার হোসেন আর নার্সের প্রস্থান ঘটল। অপূর্ব ছোট শিশুটার দিকে চাইলো। থমকে গেল সে। অবিকল অরিশ তরীর মুখটা। আরশিও স্তব্ধ। তারমানে তাদের ঘরে ছোট তুরের আগমন ঘটেছে। আরশি চোখ গ্ৰথণ করে রইল। আনন্দে আত্মহারা সে। তবুও তার আকাশ সময় আনন্দ।

-” ও তো অরিশ তরীর মতো হয়েছে! আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ দিয়েছিস তুই। আমি কৃতজ্ঞ থাকবো তোর নিকট!”

-” হ্যাঁ! ও ভাইয়া আর তরীর মতো হয়েছে। ওর নাম রাখবো তুর। একজন তুর ওদের কাছে, একজন আমাদের কাছে। আচ্ছা ওরা তিনজন কেমন আছে?”.

-” ওরা তো তিনজন নয়, চারজন। মা আছে ভুলে গেছিস। তুই দেখতে চাস, ওরা কেমন আছে? তাহলে তোর কল্পনায় ওদের সাজিয়ে নে। চোখ বন্ধ করে ভাব ওদের কথা।”

অপূর্বের কথায় নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিল আরশি। তার মেয়ে এখনো ঘুমাচ্ছে। অপূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আরশি নিজে নিজে এক কল্পনার জগৎ সাজালো। নিজের পছন্দের রং দিয়ে সাজালো। হারিয়ে গেল সেই কল্পনায়।

” অরিশ ঘুমিয়ে আছে। তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে তরী। ঘরে কেউ নেই। রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেছে। অফ ডে তাই কারো কোন ভাবনা নেই। তুর তার দিদা অর্থাৎ তরীর পায়ের কাছে ঘুমিয়েছে আজ।

তুর ঘরে এলো। বাবার অপর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। আদো আদো স্বরে ডাকলো,
-” পাপা! ও পাপা! দিদা ঘুলতে যাত্তে। আমিও দিদাল তাতে দাই!”

অরিশ তরী চাইলো মেয়ের দিকে। দূরত্ব মাঝখানে ফাঁকা জায়গা করে দিলো। অন্যপাশে ফিরল তরী। অরিশ ক্লান্ত চোখে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তুরের বয়স চার বছর। এখনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। ঠোঁটের আগায় বাজে। তুর পুরোপুরি বাবার বুকে ভর দিয়ে বসল। বাবার পেটের উপর ঝাঁকুনি দিয়ে ভুম ভুম করে গাড়ি চালালো। অরিশ উঠে বসলো। মেয়ের জামা কাপড় খুলে অন্য একটা পড়িয়ে দিল। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে মেয়েকে দাঁড় করিয়ে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করে দিল। ব্রাশ ধুয়ে দানিতে রাখল। কোলে তুলে বেসিনের সমান করে মুখ ধুয়ে দিল। মুখ মুছিয়ে দিয়ে বেবী লোশন মেখে দিলো। টুপি মাথায় দিয়ে বলল,

-” একদম দুষ্টুমি করবে না। দিদার হাত ছাড়বে না। দিদার কথা শুনবে কিন্তু!”

তুর তার বাবার পাগল। বাবা তার জান। একদম শব্দটা সহজে ব্যবহার করে না অরিশ। একবার ব্যবহার করলে না মানার উপায় নেই। আদো আদো কন্ঠে বাবার গলায় টেনে চুমু দিল গালে। বলল,

-” বাবা তুমি অলেক ভালো।”

অরিশ নিজেও একবার মেয়েকে চুমু খেল। বলল,
-” আমার তুরও অনেক ভালো।”

তুর ছুটে চলে গেল। অরিশ বেডের উপর গাঁ হেলিয়ে দিলো। চোখ গ্ৰথণ করার সাথে সাথেই ভারী কিছু বুকের উপর আবিষ্কার করলো। চোখ মেলেই হাসৌজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠলো তার কাছে। ভারী গলায় বলল,-” সমস্যা কি? নামো! বাচ্চাদের মতো কি করছো। বিরক্ত করো না, ঘুমাতে দাও তরী!”

-” আমি জানতার তুমি আমাকে বকবে! প্রতিবার তুমি আমাকে বকো। কই তুর বিরক্ত করলে তো বকো না।”

-” সেজন্যই তোকে বকছি। তুরকে তো বিচ্ছু বানিয়েছিস। তাই ওর ভাগের টাও তোর! সর..

অরিশ অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। তরীর অভিমান হলো। উঠে বেলকেনিতে গিয়ে বসলো। কিয়ৎক্ষণ পর অরিশ এসে তার পাশে বসলো। হাত টেনে কোলে তুলে নিল। তরী মুখ কালো করে বলল,-” সরেই তো গেছি। আবার কেন এসেছো?”

-” আমার পিচ্চির কাছে, আমি এসেছি! তোর কি?”

বলেই অরিশ ফট করে তরীর অধরে পরপর দুই বার অধর ছুয়ে দিলো। অরিশ হাসলো। তুরের আগমন ঘটল। বাবা মায়ের দিকে চেয়ে অভিমানী গলায় বলল,
-” পাপা থুমি মাম্মাকে দুতো চুমু খেয়তো। আমাকে একতা!”

অরিশ হাত ধরে মেয়েকে তরীর কোলে বসিয়ে দিল। একগালে তরী, অন্যগালে অরিশ চুমু দিল। তুরের খুশি দেখে কে? ফট করে নেমে গেল। আঙুল গুনে গুনে বলল,-” তিনতা হয়েতে। এখন আমি দিদাল কাতে গিয়ে আলো একতা নিয়ে আতবো। তালপলে বিতরি কলবো।”

তুর ছুটে চলে গেল। অরিশ আর তরী একে অপরের দিকে চেয়ে রইল। তরীর নাক টেনে বলল,-” একদম পিচ্চি তরী!”

এই পর্বে অরিশ তরীর কাহিনিটা কল্পনায়। আরশির কল্পনা। কিছু কথা, কিছু অনুভূতি, কিছু ভালোবাসা, কিছু সত্য চাপা পড়ে রয়েছে। রয়ে গেছে অন্তরালে। অনুভূতির অন্তরাল থেকে অনুভব করতে হয়।

___________________অনুভূতির অন্তরালে ভালোবাসাটা তুই,
ইচ্ছে করে হাত বাড়িয়ে শুধু তোকে ছুঁই!
‌ -ইফা🌿
আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনারা? এখানেই শেষ হলো অনুভূতির অন্তরালে। ফিরে আসবো নতুন গল্প নিয়ে। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ 💚
“সমাপ্ত”

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here