অন্তরালের কথা পর্ব ১৬

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১৬
.
.
অতলের এতদিনের স্বাদটা আজ পূর্ণ হলো। এতদিনে তার ভাবনার সাথে বাস্তবের মিল হলো। অতলের ঠোঁট জুড়ে প্রকাশ পেল এক প্রাপ্তিময় হাসি। এই হাসোজ্জল মুখ নিয়ে সে চলে গেল ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে।
এদিকে তানহার চোখটা মাত্রই লেগে এসেছিল। এর মাঝে পানির আওয়াজ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখে মেলে তাকাতেই দেখে সে বিছানার মাঝখানে শুয়ে আছে। আর বাথরুমে লাইট জ্বলছে। তানহার বুঝতে দেরি হলো না বাথরুমে কে! তাই সে শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়ল।
আর মাথায় দু-হাত দিয়ে চেপে মনে মনে ভাবল,
” অতল কি তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলেছে? উফফ! কি বাজে ভাবেই না সে শুয়েছিল। যদি শরীরের কোনো অংশ থেকে কাপড় সরে থাকে আর সেই ফাঁকে অতল কিছু দেখে থাকে তখন কেমন হবে! ধ্যাৎ… অসহ্যকর একটা অবস্থা। ”
চোখ মুখ কুচকে হাজারো বকাঝকা করছে তানহা নিজেকে মনে মনে। এমন সময় ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো অতল। এসে বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে তানহা মুখ কালো করে বিড়বিড় করছে। অতলের আর বুঝতে বাকি রইলো না তানহা কি কারণে এরকম করছে। তাই মুচকি হেসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
” বাব্বাহ! আমার বউ যে বকাও দিতে পারে সেটাতো জানা ছিল না! যাক ভালোই হয়েছে আজকেই জেনে নিলাম নাহলে এই রূপটি দেখতে তো বেশ অপেক্ষা করতে হতো আমাকে। ”
অতলের কথা শুনে তানহা হা হয়ে গেল। তারপর ভ্রু দুটো কুচকে তোতলিয়ে তোতলিয়ে বলল,
” মানে কি? আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? আর আমি বকা দিবই বা কেন?”
” ও মা! তুমি জানো না বুঝি? আচ্ছা বেশ তবে আমিই মনে করিয়ে দিচ্ছি। ওই যে একটু আগে মানে আমি যখন বাহির থেকে এলাম তখন তো তুমি চিতপটাং হয়ে শুয়েছিলে যেটা আমি খুব সুন্দরভাবেই দেখে ফেলেছি। সেই সাথে উপভোগও করেছি। তাই তুমি নিজেকে বিড়বিড় করে হাজারো বকায় ভাসিয়ে দিচ্ছিলে। কি ঠিক বললাম তো? ”
তানহা এবারও আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। আর গম্ভীর গলায় বলল,
” এই আপনি আমাকে একটি প্রশ্নের উত্তর দিন তো, আপনি কি মনের কথা পড়তে পারেন? এই নিয়ে যে ক’টা কথা আপনি বলেছেন প্রতিটি ঠিক হয়েছে কিন্তু এটা কি করে সম্ভব! আমি তো ভেবেই কুলাতে পারছি না। ”
তানহার কথা শুনে অতল হো হো করে হেসে উঠল। হাতে থাকা তোয়ালেটি চেয়ারের উপর ছড়িয়ে বিছানার উপর বসে তানহাকে নিজের কাছে টেনে বসিয়ে বলল,
” আরে বোকা মেয়ে এটাতো একটা নরমাল বিষয় এটা না বুঝার কি হলো? এটা বুঝতে বুঝি মন পড়া শিখতে হয়? হা হা…. আরেকটা কথা কি জানো স্বামী স্ত্রীর মাঝে আল্লাহর দেয়া এক অশেষ রহমত রয়েছে। তাই মুখ দেখেই হয়তো বুঝা যায় কে কি বলছে কিংবা কে কি চাইছে। এসবের জন্য কখনোই মন পড়ার টেকনিক ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না। ”
” আমার মনের গভীরে কি চলছে সেটা কি আপনি বুঝতে পারেন? ”
তানহার এই কথাটি শুনে অতলের বুক ছ্যাঁত করে উঠল। এক অজানা ভয় যেন মনের ঘরে উঁকি দিতে শুরু করল। অতল অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” মানে, ঠিক বুঝলাম না তোমার কথাটি। ”
” নাহ, তেমন কিছু না। অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়ুন। আর আমারও প্রচুর ঘুম পেয়েছে। ”
” বুঝলাম কিন্তু.. তোমার সেই প্রশ্নটির উত্তর না শুনলে যে আমার ঘুম আসবে না। আমার ঘুম হোক যদি চাও তাহলে উত্তরটি বলে দাও। নাহলে আমিতো সারা রাত বসে থাকবোই সাথে তোমাকেও বসিয়ে রাখবো। ”
তানহা কি বলবে বুঝতে পারছে না। আসলে সেতো কথাটি ইচ্ছে করে বলেনি মুখ ফসকে বের হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সে কথা বললে তো লাভ নেই তাকে কিছু তো একটা বলতেই হবে। তাই মনে বল নিয়ে অতলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার কথার অর্থ ছিল আপনি যে বললেন স্বামী স্ত্রী একে অপরের না বলা কথা বুঝতে পারে তাহলে আপনি কি আমার কথা আদৌ বুঝতে পেরেছেন? পারেননি যদি বুঝতে পারতেন আমাকে এভাবে বসিয়ে রাখতে পারতেন না। ”
” মানে? ”
” মানে আমার প্রচুর ঘুম পেয়েছে আপনি তো এই কথাটা বুঝতে পারেননি। তাহলে কি করে বুঝবো মনের না বলা কথা জানতে পারাটা সব দম্পতিদের জন্য আল্লাহর রহমত? আমাকে তো এটাই ধরে নিতে হবে এই রহমটি কিছু দম্পতির জন্য প্রযোজ্য আর কিছু দম্পতির জন্য নয়। তাই না? ”
তানহার কথার পরিপ্রেক্ষিতে অতল কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। কারণ তানহার কথাটি অতলের যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি। তানহা যখন প্রশ্নটি করেছিল অতল বেশ ভালোভাবে লক্ষ করেছে তানহার চোখ দুটো। সেই চোখের ভাষার সাথে এই ব্যাখ্যা নামক উত্তরটিকে অতল কোনোভাবেই মিলাতে পারছে না। তাই কথা না বাড়িয়ে অতল বিছানায় শুয়ে তানহার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের বুকের উপর ফেলে স্থির গলায় বলল,
” অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো। ”
তানহাও কিছু বলল না অতলের বুকে শুয়ে চোখ জোড়া বুজে ফেলল কিন্তু চোখ বুজতে পারলো না অতল। দু’হাত মাথার নিচে রেখে মাথার উপর ঘূর্ণিয়মান চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে নিজের মাথার চিন্তা ভাবনা গুলোকেও ঘুরাচ্ছে বিভিন্ন এংগেল থেকে অতল। ”
.
বিছানার কোণে বসে জানালার গ্রিল ধরে তাকিয়ে আছে তানহার ঘরের জানালার কপাটগুলোর দিকে তিহান। আর মনে মনে ভাবছে,
” ভাগ্যিস বাবা বাড়িটিকে নতুন করে সাজায়নি। দাদা যেরকম ভাবে বানিয়ে দিয়েছিল সেরকমই রেখে দিয়েছে। আর আগের যুগে বাড়ি বানানোর ধরনটাও কি সুন্দর ছিল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘর গুলো বানাতো যাতে, একঘর থেকে অন্য ঘরের জানালা সহজেই সুন্দরভাবে দেখা যায়। তাই তো আজ সে কাছ থেকে না হলেও দূর থেকে তানহাকে দেখতে পায়। তানহা হয়তো বিষয়টি লক্ষ করেনি কারণ সে যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। এতে তানহা বুঝার কথাই নয় কিন্তু কতদিন এভাবে? এটা যে মোটেও ঠিক না। তানহা যে এখন আর তার প্রেমিকা নয় তার বড় ভাইয়ের বউ। তার দিকে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকানোটা যে মোটেও ঠিক নয় কিন্তু মন যে মানে না। ঘরে থাকা মানেই জানালার পাশে বসে তানহাকে এক ঝলক দেখার অপেক্ষা। আচ্ছা, সে ঘরে থাকে বলেই তো এমন হয় ঘরে না থাকলে তো এমন হবে না। হুম, তবে তাই হোক কাল থেকে সে আগের ব্যস্ত জীবনে ফিরে যাবে কিন্তু আগের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে এখানে ফেলে। ”
কথাটি ভেবেই আকাশের ঘন কালো মেঘের দিকে তাকালো আর চোখ থেকে দুফোঁটা জল ফেলল তিহান।সেই সাথে অপেক্ষা করতে লাগলো নতুন ভোর হবার।
মা-বাবা’কে কোনোমতে রাজি করিয়ে কেবলই চাকরিস্থলে যাবার জন্য বের হলো তিহান। তবে সাথে করে ব্যাগপত্র আনতে পারেনি। সে খুব করে চেয়েছিল ব্যাগপত্র নিয়ে একেবারে চলে আসতে কিন্তু তার মা যে তাকে এই মনমানসিকতায় একা ছাড়তে একেবারেই নারাজ। এমনকি এই মুহুর্তে তিহানকে জবও করতে দিবে না এরকমটা ভেবে রেখেছিল সে। কিন্তু ছেলের এতো অনুরোধ শোনার পর আর সে জব করতে বাঁধা দিতে পারেনি তবুও অনুমতি দিয়েছে কিছু শর্তসাপেক্ষে। তিহান যদি বাসা থেকে রোজ আপ-ডাউন করে অফিস যায় তবেই সে তিহানকে জব’টা করার পারমিশন দিবে অন্যথায় দিবে না। তিহানও আর দ্বিমত পোষণ করল না। ব্যাগপত্র রেখে মা’কে জড়িয়ে ধরে গ্যারেজ থেকে বাইক নিয়ে সোজা বের হয়ে গেল। বাইক চালাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে,
” ভালোই হয়েছে মায়ের কথাটি মেনে নিয়েছে সে। নয়তো ঘরের মাঝে থেকে এক অসহ্য যন্ত্রণায় তাকে ছটফট করতে হতো। এখন না হয় শুধুমাত্র রাতটি ঘরে থাকতে হবে তবুও, দিনটি তো সে নিজের মতো করে কাটাতে পারবে যেখানে প্রতিনিয়ত চোখের সামনে থাকবে না অন্যকারো আনাগোনা। আর রাতটিও সে ইচ্ছে করলে নিজের মতো করে কাটাতে পারে যদি ক্ষানিকটা দেরি করে বাসায় ফিরে। তখন কারো দেখাও মিলবে না আর বুকের মাঝে যন্ত্রণারও অবসান ঘটবে। ”
কথাগুলো ভেবেই এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো তিহান। আর ওমনি তার কানের ভেসে এলো এক মেয়েলি কন্ঠের চিৎকার। চিৎকার শুনেই তিহান তার চলন্ত বাইকটি কোনোমতে ব্রেক করে ফেলল। বাইক থেকে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ দূরত্বে একটি মেয়ে চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে। আর পেছন থেকে আরেকটি মেয়ে বলে উঠলো,
” তাহা, তোর কিছু হয়নি তো?”

তাহা চোখ খুলে দেখে তার কিছুই হয়নি সে এক্কেবারে ঠিক আছে। চোখ দুটো গোল গোল করে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে পাশে থাকা বান্ধুবীকে বলল,
” লুবনা দেখ আমি বেঁচে আছি। ও মা!কি আশ্চর্য ব্যাপার পুরাই তো সিনেমা ! ”
” তুই এই মুহূর্তেও সিনেমা নিয়ে পড়ে আছিস? তুই কি মানুষ নাকি অন্যকিছু? ”
” অন্যকিছু মানে তো একটা জিনিসই হয় আর সেটা হচ্ছে এলিয়েন। কিন্তু আমার আব্বু আম্মু তো এলিয়েন না আর, আমি যেহেতু তাদেরই নিজেস্ব সম্পত্তি তারমানে আমিও এলিয়েন না। তাহলে ফলাফল আসল কি আমি মানুষ। ”
” তোর সাথে কথা বলা আর একটা পাগলের সাথে কথা বলা এক্কেবারেই সেইম। আমি চললাম মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোর সাথে আজাইরা বকবক করার ইচ্ছা নেই আমার।পাগল ছাগল কোথাকার। ”
” যা যা, তোর যেদিক দুচোখ যায় চলে যা কিন্তু ফিরে তো এই আমার কাছেই আসবি। তাই আমি আর তোকে যাওয়ার সময় আটকাবো না। যেখান ইচ্ছে হয় সেখান থেকে ঘুরে আয়। এই ফাঁকে আমি এই বাইক ওয়ালাকে দেখে নিচ্ছি। ”
এতক্ষণ তিহান হা হয়ে তাকিয়েছিল আগুন সুন্দরী তাহা’র দিকে। অবশ্য তাহা’র সৌন্দর্যের জন্য নয় বরং উদ্ভট ব্যবহারের জন্য। তবে তার ধ্যান ভাঙলো চোখের সামনে কারো হাত দিয়ে তুড়ি বাজানোর আওয়াজ পেয়ে। চোখ মুখ ঘুরিয়ে তিহান অন্যদিকে তাকালো। আর সেটি দেখে তাহা ভ্রু নাচিয়ে বলল,
” এভাবে হা হয়ে ছিলেন যে?মেয়ে মানুষ দেখলে বুঝি হা হয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়? এমনিতে তো মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন এখন আবার হা হয়ে তাকিয়ে আছেন! এসবের মানে কি? ও আচ্ছা, এইবার বুঝেছি এইসব কিছু হলো প্রি প্ল্যানিং তাই তো? প্রথমে আমাকে মারতে এসে পড়ে আবার হিরো হিরো লুক নিয়ে আমাকে গলিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলবেন তাই তো? এইসব আমার জানা আছে ফিল্ম তো আর কম দেখি না। এসব ফিল্মের স্টাইল যে ছেলেরা অহরহ এপ্লাই করে সেটা শুনেছিলাম তবে দেখিনি। কিন্তু আজ আপনি দেখিয়ে দিলেন ভালোই হয়েছে নাহলে এই অভিজ্ঞতাটা আমার হতো না।”

এমনিতেই তিহানের মেজাজ আজকাল বিগড়ে থাকে তারউপর তাহা’র একের পর এক কথা শুনে তিহান প্রচন্ড ক্ষেপে যায়। আর তাহাকে ধমকের সুরে বলল,
” এই মেয়ে তুমি তো দেখছি আস্ত একটা পাগল। সেই কখন থেকে ননস্টপ বকবক করেই যাচ্ছো। তারউপর বলছ আমি তোমাকে ইচ্ছে করে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছি! ফাঁদে ফেলে কাকে জানো? যাকে চিনে, জানে, ভালোবাসে তাকে আর তোমাকে তো আমি জন্মেও দেখিনি ফাঁদে ফেলতে যাবো কোন দুঃখে? যত্তসব ফালতু! ”
.
.
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here