অন্তরালের কথা পর্ব ১৭

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১৭
.
.
” কি… আমি ফালতু? আমি মোটেও ফালতু না আমার আব্বু আম্মু অনেক সুন্দর একটি নাম দিয়েছে ” তাহা ” ফালতু দেয়নি। ”
” তোমার নাম তাহা হোক আর কাহা হোক তাতে আমার কি? আমি কি তোমার নাম জানতে চেয়েছি? ”
“আরে আপনি ফালতু বলে ডাকছিলেন তো তাই নাম বলেছি। সে যাই হোক আপনি ফালতু কোন কারণে বলেছিলেন?”
” আজব মেয়েতো তুমি! কচু দিলে বলো ইচা মাছ সরি চিংড়ি মাছ দিয়েছে।আসলে তোমার সাথে কথা বলাই ঠিক না তোমার মাথায় সিট আছে সিট। ”
কথাটি বলেই তিহান বাইক স্টার্ট দিয়ে ফুর করে চলে গেল। আর পেছন দিয়ে তাহা মনে মনে বলল,
” কি ভাবল সে আর কি হলো! সে চেয়েছিল আরও কতক্ষণ এই ব্যাটাকে কথার জালে পেঁচিয়ে পড়ে আচ্ছামতো ধোলাই দিতে কিন্তু ধোলাই তো দূরের কথা কথার জালেই আটকাতে পারলো না। ধ্যাৎ! ”
মনে মনে ইচ্ছামতো তিহানকে বকাঝকা দিয়ে গটগট করে চলে গেল তাহা।
.
তিহান অফিসে এসেছে সেই সকালে আর এখন ভর দুপুর। লাঞ্চ টাইম প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু তার মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। না আছে মুখে ক্লান্তির ছাপ, না আছে খাবার খাওয়ার ইচ্ছা। শুধু একমনে কাজ করেই যাচ্ছে কোনোদিকে যেন তার হুশ বলতে নেই। যে কেউ তাকে দেখলে বলবে, সে হয়তো নিজের পুরোটা সঁপে দিচ্ছে এই কর্মজীবনে।
তিহান এতটাই কাজে ডুবে আছে যে, লক্ষই করেনি পাশের চেয়ারে তার বেস্ট ফ্রেন্ড শান্ত বসে আছে। শান্ত তার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে সাথে একজন ভালো কলিগও। একই অফিসে কাজ করে দুজন। তাই দিনের বেশিরভাগটা দুজনের একসাথে কাটানো হয়।
শান্ত বসা থেকে উঠে তিহানের কেবিনের দরজা আস্তে করে লাগিয়ে ফিরে আসে। আর আলতো করে হাত রাখে তিহানের কাঁধে।
তিহান কাঁধে হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে! আর পেছনে তাকিয়ে দেখে শান্ত দাঁড়িয়ে। তাই নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল,
” কি ব্যাপার শান্ত ? কখন এসেছিস? ”
” কেন দেখিসনি বুঝি? ওহ্! দেখবি কি করে তুই তো কাজে ব্যস্ত ছিলি। ”
” কাজের চাপ প্রচুর রে তাই হয়তো লক্ষ করিনি। ”
” একই অফিসে কাজ করি তাও একই পোস্টে। আমার কিন্তু মনে হয় না আজ এতো কাজের প্রেশার আছে। আর যত কাজই থাকুক না কেন চোখের সামনে বিশ মিনিট ধরে একটি জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছে এটি দেখতে পাবি না কিংবা লক্ষ করবি না কেমন একটা সন্দেহজনক ব্যাপার না! ”

” কি বলতে চাচ্ছিস? ”
” আমার মনে হচ্ছে না আমার কথাটি তোর বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। কি হয়েছে খুলে বল আমায়? ”
” কি আবার হবে তেমন কিছুই হয়নি.. ”
” স্কুল লাইফ থেকে বন্ধুত্ব আমাদের। মুখ দেখলেই না বুঝা যায় মনের ভেতরকার খবর। দেরি না করে বলে ফেল কি হয়েছে? ”
তিহান নিজেকে হাজার সামলানোর চেষ্টা করলেও অবশেষে ব্যর্থ হয়। ছলছল চোখে শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমার জীবন যে ধোঁয়াশাময় শান্ত। যে ধোঁয়া কাটাবার না আছে কোন রাস্তা, না আছে সময়। এ ধোঁয়া যে আমার জীবনকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। বেঁচে থাকতে জীবনের এই ধোঁয়া কাটিয়ে হয়তো সুখের দেখা আর মিলবে না আমার। সুখ জিনিসটাই যে আমার হাত থেকে ফসকে আমারই এ দুচোখের সামনে দিয়ে অন্যের হাতে ধরা দিয়েছে। ”
শান্ত অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তিহানের অশ্রুসিক্ত সেই দুই নয়নে। আর অনুভব করছে তিহানের ভেতরে বয়ে যাওয়া হাহাকার ও প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসকে। অতঃপর শান্ত নিজে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিহানকে বলল,
” তানহার বিয়ে কি পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছে? ওর বাবা-মা কি আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছে না তোর জন্য? ”
” হা হা… ”
” চোখে জল মুখে হাসি এর অর্থ কি তিহান? ”
” চোখের জল নিজের ভাগ্যের টানে এসেছে আর মুখের হাসি তোর কথা শুনে এসেছে। ”
” তোর কথার মানে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। দয়া করে একটু খুলে বল আমায়। ”
” তানহার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ”
শান্ত বসা থেকে দাঁড়িয়ে সামান্য জোরালো কন্ঠে ভ্রু দুটো কুচকে তিহানকে বলল,
” মানে? কি বলছিস তিহান? তানহা কি করে পারলো এই কাজটি করতে? ”
” এতো অবাক হচ্ছিস কেন? আসল রহস্য তো এখনো লুকিয়েই আছে। ”
” কিসের রহস্যের কথা বলছিস তুই? ”
” হুম, বলছি বলছি। ”
তিহান পিসি শাট ডাউন করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এগুতে থাকে জানালার কাছে। জানালার গ্রিলে একহাত রেখে অন্যহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে তিহান চোখের জল ফেলে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
” তানহা এখন একজনের স্ত্রী।একজনের ছেলের বউ , একজনের মেয়ে আর আমার… আমার ভাবী। ”
শান্ত হা হয়ে রইলো। কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। বলার ভাষা যেন মুহূর্তের মাঝে হারিয়ে ফেলেছে। তারপরও কাঁপা কাঁপা স্বরে তিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুই যা বলছিস ভেবে বলছিস তো? ”
” তোর কি মনে হয় এইসব বিষয় নিয়ে আমি মজা করবো? আর এটা কি মজার করার মতো বিষয়? ”
” পরশু না অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তুই তানহার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি? তাহলে একদিনের মাঝে কি এমন হয়ে গেল যে, ওকে বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত নিতে হলো! ”
” একদিনের মাঝে না সেদিন রাতেই বিয়ে হয়েছে। ”
জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা একে একে খুলে বলতে লাগলো তিহান। কথাগুলো বলার মাঝে তার ভীষণ কষ্ট হলেও সে কোথাও থামলো না বরং বেশ দ্রুত কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সবকিছু শুনে শান্ত উত্তেজিত গলায় বলল,
” তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিলি তিহান? তুই কি করে পারলি ওরকম বাজে একটা সিদ্ধান্ত নিতে? তোর বুক কাঁপেনি? তোর মনে পড়েনি ইসলামের দৃষ্টিতে এই কাজটি কতটা জঘন্যতম? ইসলামের কথা বাদ-ই দিলাম তোর বাবা-মায়ের মুখটা কি তোর চোখের সামনে ভেসে উঠেনি?যারা তোকে এতগুলো বছর নিজেদের বুকে আগলে রেখেছে, তোর গায়ে একটা আঁচ লাগতে দেয়নি। সেই মানুষ দুটির কথা মনে পড়েনি? নিজের এ ক’দিনের ভালোবাসাকে এতটা গুরুত্ব দিলি যে, বাবা-মায়ের এত বছরের ভালোবাসাকে তুচ্ছ ভেবে উড়িয়ে দিলি? বিশ্বাস কর তিহান আমি এই ব্যাপারটা জাস্ট ভাবতে পারছি না। তোর মতো একটি শিক্ষিত ছেলে যে এরকম কাজ করতে পারে সেটা সত্যি আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ”
শান্তর কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিহান কিছুই বলল না। শুধু তাকিয়ে রইলো বাহিরের রৌদ্র উত্তপ্ত তাপের থমথমে পরিবেশের দিকে। কেননা এই পরিবেশ যে তার জীবনের সাথে ১০০ ভাগই মিল।
এদিকে তিহানের কোনো উত্তর না পেয়ে শান্ত আবারও বলল,
” কি ব্যাপার চুপ করে আছিস যে? আমার কথাগুলো কি তোর কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হলো? তা না হলে তোর মতো ছেলে চুপ করে থাকার কথা নয়। ”
এবার তিহান মুখ খুললো আর বলল,
” আজ এই কথাগুলো কেন বলতে পারলি জানিস? কারণ তুই শান্ত, তিহান না। তুই কোনোদিন তিহানের জীবনে এসে দাঁড়াতে পারবি না। পারবি না তিহানের জীবনে দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া প্রতিটি মুহূর্তকে ফেস করতে। পারবি না তিহানের প্রতিটি যন্ত্রণাময় নিঃশ্বাসকে অনুভব করতে। সর্বোপরি তুই যে শান্ত। তুই এ কথাগুলোই বলতে পারবি এর থেকে বেশি কিছুই বলতে পারবি না। আর এটাই বাস্তবতা। ”
তিহানের প্রতিটি কথার শব্দে এতটা হাহাকার জমা হয়ে আছে যার ফলে শান্ত কোনো প্রতিউত্তর দিতে পারল না। কেবল তিহানের কাঁধে সান্ত্বনার হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।
.
ঘরের কাজ ও তিহানকে নিয়ে মানসিক যন্ত্রণা এ দুটোর মাঝে এতটাই ডুবে গিয়েছে যে, কখন সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি তানহা। অতলের ডাকেই যেন তার হুশ ফিরল। তাই কাজকর্ম ফেলে ধীর পায়ে এগুলো নিজের ঘরের দিকে। দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে অতলকে উদ্দেশ্য করে তানহা বলল,
” ডেকেছিলেন আমায়? ”
” হুম, এদিকে এসে ফ্যানের নিচে বসো। এতো কাজ কিসের তোমার? দু’দিনে নিজের কি হাল করেছ আয়নায় দেখেছ?”
অতলের কথা শুনে তানহা মনে মনে ভাবল,
” কাজটাই যে এখন তার নিত্যদিনের সঙ্গী হবে। এর মাঝে ডুবে থাকার ফলেই যে সে এখনও স্বাভাবিক আছে। তা নাহলে সেই কখন সবকিছু ফ্ল্যাশ হয়ে যেত। হু..”
তানহাকে অন্যমনস্ক দেখে অতল বলল,
” মিনিটের মাঝে আবার কোথায় হারিয়ে গেলে?কথা যে বলছি কান দিয়ে কি আদৌ ঢুকছে? ”
তানহা অতলের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
” ঘরের বউ কাজ না করলে করবে কে? সবকিছু কি কাজের লোকের হাতে ছেড়ে দিলে হয়? হয় না তো। সেজন্যই টুকিটাকি কাজ করি। ”
” প্রথমত এই কাজগুলো মোটেও টুকিটাকি না আর দ্বিতীয়তো, সবকিছুরই একটা সময় আছে। তুমি ঘরের কাজ করবে বেশ তো তবে একটু সময় নাও তারপর না’হয় করবে। মাত্রই তো দু’দিন হলো বাড়িতে এসেছ। এখনি যে ঘরের সব দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিতে হবে এমনতো কোনো কথা নেই। আর না আছে কোনো বাধ্যবাধকতা তাই না? ”
” হুম। ”
” তাহলে, কাটাও না একটু নিজের মতো করে সময়। সুযোগ করে দাও না আমাদের সম্পর্ককে ক্ষানিকটা মুহূর্ত । কারণ এটাই যে উপযুক্ত সময় দুজন দু’জনাকে জানবার। এরপর হয়তো তুমি চাইলেও সেই সময়টুকু খুঁজে পাবে না, হারিয়ে ফেলবে নিজেকে এই সংসার জীবনের ব্যস্ততার মাঝে। ”
” হুম। ”
.
.
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here