অন্তরালের কথা পর্ব ১৫

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১৫
.
.
একে একে অতল, তিহান ও তাদের বাবা আনিস খন্দকার তিনজনই এসে ডাইনিং টেবিলে বসেছে। আর টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তানহা ও তার শাশুড়ি মরিয়ম বেগম। সকলকে বসতে দেখে তানহা বলে উঠল,
” মা, আপনিও সবার সাথে খেতে বসে পড়ুন। এমনিতেই আপনার ডায়বেটিস এর মধ্যে দেরি করে খাবার খেলে সমস্যা হবে। ”
” না না, সমস্যা নেই। বরং তুমি নতুন বউ তুমি খেতে বসে পড়ো। পরে একা একা কি খাবে না খাবে তার তো ঠিক থাকবে না। ”
” না মা আপনি বসে পড়ুন। ”
তানহা ও মায়ের কথার মাঝে অতল বলে উঠল,
” এক কাজ করো তোমরা দুজনেই বসে পড়ো তাহলেই তো আর সমস্যা হলো না, কি বলো? ”
” হুম ঠিক বলেছিস দুজনেই বসে পড়ি। তাহলে আর কাউকেই একা খেতে হবে না।”
তানহা কিছু বলতে নিলেই মরিয়ম বেগম বলে উঠেন,
” আর কোনো কথা নেই চুপ করে বসো। ”
” জ্বি আচ্ছা। ”
খাবারের ডিশের ঢাকনা উঠাতে উঠাতে মরিয়ম বেগম বললেন,
” কি ব্যাপার তানহা, আজ দেখছি সব স্পেশাল রান্না! ” মুচকি হাসি দিয়ে তানহা বলল
” জ্বি মা। ”
আনিস খন্দকার চিংড়ির মালাই কারীর ডিশ হাতে নিতে নিতে বললেন,
” শ্বশুর বাড়িতে প্রথম রান্না বলে কথা স্মরণীয় করে রাখতে হবে না! হা হা.. ”
অতল বসা থেকে দাঁড়িয়ে সবগুলো ডিশের দিকে তাকিয়ে হা হয়ে গেল। আর বলল,
” এই সবকিছু তুমি একা রান্না করেছ তানহা ? তারউপর আমাদের সবার পছন্দের আর আমার পছন্দের ছোট মাছের চচ্চড়ি! আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ”
অতলের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তানহা কিচ্ছুটি বলল না, কেবল মুচকি হাসি দিল। আর অতল সেই হাসি দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
” এতো হেসো না। আগে দেখতে তো দাও রান্না কেমন করেছ। ভালো হলে তো তোমার হাসির রেখাটা বৃদ্ধি পাবেই তবে..বাজে হলে আমাদের বকুনি দেয়ার মাত্রাটা বৃদ্ধি পাবে। এই আমি বলে দিলাম। ”
অতলের কথা শুনে টেবিলে উপস্থিত থাকা সকলেই হেসে দিল কেবল তিহান ব্যতীত। সে মাথা নিচু করেই বসে তার প্রিয় গোস্তের ঝাল ভুনা দেখে অতীতের স্মৃতির মাঝে ফিরে গেল।
.

” এতক্ষণে বুঝি সময় হলো মহারাণী তানহার আসার? ”
” জ্বি মহারাজ তিহান। হি হি… ”
” হাসছো তানহা ? তুমি জানো সেই কখন এখানে দাঁড়িয়ে আছি?প্রায় ঘন্টার কাছাকাছি হবে এসেছি তারউপর এই কড়া রোদে। ভাবতে পারছ? ”
” হুম,খুব ভাবতে পারছি…আর এটাও বুঝতে পারছি এই একটু আধটু সময় রোদের তাপে ছেলেমানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুই হয়না। ”
” হাও ফানি! হু…. ”
” আহারে! রাগ হয়েছে বুঝি কিন্তু যতই রাগ করো আজ আমি রাগ ভাঙাবো না। তোমার রাগ আজ আপনা আপনি গলে পানি হয়ে যাবে। ”
” মানে? ”
” মানে টা এখনই বুঝবে। এখন চলো রেস্টুরেন্টের ভেতরে । ”
” তুমি কি অন্ধ হয়ে গিয়েছ তানহা? কথা বলতে বলতে যে রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে এসেছি দেখোনি? ”
” ওহ্! আসলে বুড়ি হয়ে গিয়েছি তো তাই চোখে কম না একেবারেই কানা হয়ে গিয়েছি বুঝেছ? এবার বসো। ”
” হুম বসছি। ”
” এবার কোনো প্রশ্ন ছাড়া চোখ দুটো বন্ধ করোতো তিহান। ”
” চোখ বন্ধ করব? কিন্তু কেন?
” আগেই বলেছিলাম কোনো প্রশ্ন হবে না।”
” আচ্ছা আচ্ছা, এই নাও চোখ বন্ধ করলাম। এবার তো বলো? ”
” হুম বলছি বলছি, এইবার চোখ খুলো। ”
” এ্যা…এটা তুমি করেছ? আর তুমি জানলে কি করে আমার গোস্তের ঝাল ভুনা পছন্দ? তোমায় তো কখনো আমি বলিনি! ”
” বলোনি তো কি হয়েছে, না বললে বুঝি জানা যায় না? ”
” না মানে কিভাবে? ”
” আরে কালকে তুমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলছিলে না আমায় কনফারেন্সে রেখে? তখনি আমি শুনেছি তোমার গোস্তের ঝাল ভুনা খেতে ইচ্ছে করছে। তবে মা’র জন্য আমি চুপ ছিলাম কিছু বলতে পারিনি তোমায় কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলাম যদি তোমায় সারপ্রাইজ দেয়া যায়! তাই এ বিষয়ে কোনো কথাই বলিনি। ”
” আহারে! আমার লক্ষি বউটা কত কষ্ট করে এই দু’হাতে রান্না করেছে তাও বরের ইচ্ছানুযায়ী। এই হাত দুটোকে তো চুমু দিতেই হয় সাথে বউকেও। ”
” বউকে না দিলেও চলবে তবে হাত দুটোকে দিতে হবে। হিহি… আচ্ছা এবার খেয়ে বলোতো কেমন হয়েছে? ”
” হুম হুম বলছি। ”
” হুম বলো,ভীষণ নার্ভাস লাগছে। আজকেই প্রথম গোস্তের ঝাল ভুনা রান্না করেছি।”
” প্রথম রান্নাতেই তো বাজিমাত দেখছি! এতো মজা হয়েছে কি বলবো। পুরো মনটাই ভরিয়ে দিলে বউ। সেই ২ মাস আগে মায়ের কাছে যখন গিয়েছিলাম তখন খেয়েছি আর আজ খেলাম। ”
” সেজন্যেই তো আনলাম তবে…সত্যিই কি মজা হয়েছে? ”
” মায়ের পর কারো হাতের রান্না যদি মজা হয়ে থাকে সেটা তোমার। হাত দুটো দাও এই মুহূর্তে আমায় ওই হাতে চুমু খেতেই হবে। নাহলে এই মন শান্ত হবে না। ”
অনেকক্ষণ যাবৎ অতল লক্ষ করছে তিহান অন্যমনস্ক। তাই অতল ভাতের লোকমা মুখে পুরতে পুরতে বলে উঠল,
” খাবার টেবিলে বসে কোন সফরে বেরিয়ে পড়লি তিহান? ”
তিহান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমতা আমতা করে বলল,
” কই কিছু না তো ভাইয়া। ”
” কি কিছু না? আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি তুই অন্যমনস্ক ছিলি আর এখন বলছিস কিছু না! ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও ঠিক না তিহান। খেতে বসে কেউ অন্যকিছুতে মন দেয়? আগে খেয়ে নেয় তারপর তোর যা খুশি ভাবিস। ”
” হুম। ”
” তানহা,তিহানের সামনে গোস্তের ঝাল ভুনাটা দাও তো। ওর এই খাবারটি বেশ প্রিয়। ”
তানহা চুপচাপ ডিশটি তিহানের সামনে দিয়ে নিজের স্থানে ফিরে আসতে নিলে মরিয়ম বেগম বললেন,
” তানহা মা, তিহানকে একটু কষ্ট করে তরকারিটা প্লেটে দিয়ে দাও। ও আবার খুব অলস টাইপের ছেলে কখনোই নিজের হাতে নিয়ে খাবে না। প্রয়োজন হলে সে না খেয়ে উঠে যাবে কিন্তু তাও বেড়ে খাবে না। তাই বলছিলাম আর কি! ”
তানহা শাশুড়ি মায়ের কথা রাখতে মুচকি হেসে গেল তিহানের কাছে। তিহানের মুখের দিকে না তাকিয়ে প্লেটে তরকারি বেড়ে দিতে লাগলো। তিহানেরও বিষয়টি বেশ অস্বস্তি লাগছিল তাই তানহার মুখের দিকে না তাকিয়ে বলল,
” ভাবি পর্যাপ্ত হয়েছে এর চেয়ে বেশি দিলে খেতে পারবো না। ”
তিহানের মুখে ভাবি ডাক শুনে তানহার ভেতর জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মুখে টু শব্দটি বলতে পারছে না। এরকম পরিস্থিতিতে যেকোনো মেয়েরই ভেঙে পড়ার কথা কিন্তু সে জায়গায় তানহা তার মনের অনুভূতি গুলোকে লুকিয়ে বেশ শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ছেলে মানুষ হয়ে অনুভূতি গুলো লুকাতে পারলো না তিহান। তাইতো খাবারের প্লেটেই দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে দিল। কিন্তু সেই চোখের জল তানহা ব্যতীত অন্য কারো চোখে পড়েনি। সবাই যে তানহার হাতের সুস্বাদু খাবার খেতে অতি ব্যস্ত।
.

মাগরিবের নামায পড়ে অতল মা-বাবা’র ঘরে গিয়ে দেখে বাবা বিছানায় বসে রয়েছে আর মা নামায পড়ছে। তাই ঘরে না ঢুকে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মায়ের নামায শেষ হবার।
এদিকে সালাম ফিরিয়ে ছেলেকে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মরিয়ম বেগম বললেন,
” বাহিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, ভেতরে আয়। তোর বাবা তো তোর জন্যই বসেছিল। ”
” হুম আসছি মা। ”
অতল ঘরের ভেতরে ঢুকে বিছানার কোণে বসে বাবাকে বলল,
” বাবা, তুমি কি কোথাও যাবে? না মানে মা বলল যে অপেক্ষা করছ আমার জন্য তাই বললাম। ”
” আরে না তেমন কোথাও যাবো না কিন্তু…ভাবছি তিহানের ঘর থেকে একটু ঘুরে আসব। ছেলেটা কি করছে দেখে আসব আর ওর সাথে কিছু কথাও আছে সেগুলো বলে আসব। ”
” ও আচ্ছা, কিন্তু কি বিষয়ে কথা বলবে বাবা? ”
এর মাঝে মোনাজাত শেষ করে মা এসে বসলো তাদের কথার মাঝে। বলল,
” তোর বাবা চাইছে গতকালের বিষয়ে কিছু কথা বলতে তিহানকে। আমরা যতটুকু বুঝতে পেরেছি ব্যাপারটি কোনো মেয়ে সম্পর্কিত। আমরা চাচ্ছি যদি তিহানের কোনো মেয়ে পছন্দ থেকে থাকে, তাহলে মেয়ের পরিবারের সাথে কথা বলে বিয়ের ব্যাপারে অগ্রসর হবো। এইসব নিয়েই তোর বাবা কথা বলবে। ”
” ও তবে আমিও যে এই বিষয়েই তোমাদের সাথে কথা বলতে এসেছি। ”
আনিস খন্দকার বললেন,
” ঠিক বুঝলাম না তোর কথা! ”
” আসলে বাবা এখন যেই কথাগুলো বলব এগুলো আমার কথা না, তিহানের বলা কথাগুলো আমি তোমাদের বলব আর সেটা তিহানের নির্দেশেই। ”
” কি কথা! ”
” তিহান আমাকে পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে কালকে রাতে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা সম্পর্কে তিহানকে যেন কোনো প্রকার প্রশ্ন না করা হয়। সে যেই হোক আমি, তুমি কিংবা মা। কেউই কোনো কারণ জিজ্ঞেস করতে পারবে না। আর যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তবে… ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। ”
মরিয়ম বেগম ঘাবড়ে গিয়ে বললেন,
” কি বলছিস ও চলে যাবে মানে? এই অসুস্থ শরীর নিয়ে ও কোথায় যাবে? তারউপর মনের দিক থেকেও প্রচুর নরভরে। কখন কী করে ফেলবে তার কি কোনো ঠিক আছে? ”
আনিস খন্দকার ধমকের সুরে বললেন,
” অতলের মা, তুমি এই মুহূর্তে চুপ থাকো। আমাকে অতলের সাথে কথা বলতে দাও।”
আনিস খন্দকারের অতলের দিকে ফিরে গম্ভীর গলায় বললেন,
” আচ্ছা অতল, তুই একটু ভেবে দেখতো তিহানের কথাটি কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? আমরা ওর বাবা-মা। আর বাবা-মা হয়েও ওর বিষয়ে কথা বলার অধিকার রাখবো না এটা কেমন কথা? এই কথাটি কি মানার যোগ্য? ”
” দেখো বাবা! মানুষের জীবনে কিছুকিছু সময় আসে যখন সে চাইলেও তার পরিবারকে তার ব্যাক্তিগত জীবনে ইনভলভ করাতে পারে না। না সে নিজে খুলে বলতে পারে আর ঠিক তখনি সেই মানুষটি আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও ওই জলন্ত আগুনের মাঝে ঝাঁপ দেয়। আমাদের তিহানও হয়তো সেই পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। তাইতো ওরকম বাজে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে আল্লাহর অশেষ দয়ায় আমরা ওকে ফিরে পেয়েছি। কিন্তু সেই পরিস্থিতি যদি আমরা নিজেরাই আবার তৈরি করি এবারও যে আমরা ওকে ফিরে পাবো তার কি কোনো শিউরিটি আছে বলো? তাহলে কেন সেই পরিস্থিতিটি তৈরি করব আমরা? তার চেয়ে বরং থাক না ও নিজের মন মতো করে। একদিন দু’দিন কিংবা তিনদিন তারপর এমনি এমনি দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“তাই বলে কিছুই জিজ্ঞেস করব না? ”
“ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে কিছু কিছু ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করাই ভালো বাবা।”
” দেখ তোরা যা ভালো বুঝিস। আমার কথায় যখন দোষ হবে তাহলে আমি আর কিছু বলব না। ”
” তুমি আমার কথায় রাগ করে বলছ বাবা কিন্তু, ঠান্ডা মাথায় একটু আমার কথাগুলি ভেবে দেখো হয়তো এই রাগ টুকু আর থাকবে না আসছি বাবা। ”
কথাটুকু বলেই অতল ধীর পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
.
ডিনার সেরে বুয়ার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে রান্নাঘরের সব কাজ শেষ করে কেবলই তানহা ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর মেলে দেয়। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে বলে কথা! সেই সুবাদে তো তার কোনো কাজই করতে হয়নি। সেই তুলনায় বেশ পরিশ্রম হয়েছে আজকে তার। এমনিতেই মানসিক যন্ত্রণা তারউপর শরীরিক যন্ত্রণা। কোমর ব্যাথায় তো সে নড়তেই পারছে না, চোখ দুটো বুঝে আসছে। এমন সময় ঘরের দরজা আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে ঘরে এলো অতল কিন্তু তানহা বুঝতে পারেনি। তাই তো সে আগের মতো করেই শুয়ে আছে।
এদিকে তানহাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অতলের মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে। তার যে অনেক বছরের শখ ছিল সে বাহির থেকে এসে যখন ঘরে ঢুকবে তার বউ ঠিক এভাবেই সারা দেহ মেলে শুয়ে থাকবে। সারা দিনের ক্লান্তি দূর করে ক্ষানিকটা শান্তি অনুভব করতে। আর সে প্রাণ ভরে সেই দৃশ্য দেখবে।
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here