#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১৯
.
.
কথাটুকু বলেই তানহা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। আর মনে মনে ভাবল,
” যাক বাবা বাঁচা গেল! উনি কিছুই শুনতে পায়নি। তবে আরেকটু আগে এলে এক বড় ধরনের গন্ডগোল পাকিয়ে যেত। কিন্তু না, এরকম আর কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। এরকম কিছু হলে সে বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াবে কিভাবে? তাই তাকে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতন থাকতে হবে।”
তানহাকে আনমনা দেখে অতল তার ডান হাত তানহার চোখের সামনে নাড়িয়ে বলল,
” এই তুমি বারবার কোন জগতে হারিয়ে যাও বলতো? এই জগতে যেন মন টিকেই না তোমার হয়েছে টা কি খুলে বলোতো? ”
” কি আবার হবে? তেমন কিছুই হয়নি। জাস্ট কিছু কথা ভাবছিলাম। তাই হয়তো… ”
” কি এমন কথা ভাবছিলে যার জন্য আমার এতটা কাছে থাকাকালীনও অন্যদেশে পাড়ি জমাতে সময় লাগেনি তোমার? ”
তানহা কিছু বলতে পারলো না। কেবল চোখ দুটোর দৃষ্টি পরিবর্তন করে নিচে নামিয়ে ফেলে। তা দেখে অতল মুচকি হেসে বলল,
” তোমরা মেয়ে মানুষেরা এতো লজ্জা পাও কোথা থেকে? কথায় কথায় শুধু লজ্জা। এই জানো, আমার না ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে তোমাদের লজ্জার উৎপত্তিস্থল কোথায়! এমনকি গবেষণা, বিশ্লেষণ সবকিছু করারই ইচ্ছা আছে। ”
অতলের কথাটি শুনে তানহার বিরক্ত লাগলেও সেটি প্রকাশ করলো না বরং শান্ত গলায় বলল,
” আপনার মুখে দেখছি কিছুই আটকায় না। ”
” বউয়ের সাথে কথা বলার সময় যে পেটের ভেতরেও কিছু কথা আটকিয়ে রেখে পরে বলতে হয় তা তো আমার জানা ছিল না! ”
” এই কথাতেও আপনি ইয়ার্কি করছেন? ভালো, ভালো বেশ ভালো। ”
” হি হি… ভালো তো হবেই। ইয়ার্কি ছাড়া কি জীবন চলে নাকি? এই ইয়ার্কির জন্যই জীবন এতো হাসি খুশিতে ভরপুর থাকে।নয়তো জীবনের আনাচে কানাচে উঁকি দিয়ে উঠতো অস্বস্তি, বিষাদ, বিরক্তি এরকম আরো অনেক কিছুই। ”
” হয়তো… সে যাই হোক এখন নিচে চলুন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। নামায টাও পড়া হয়নি আর মায়ের খাবারের সময়ও পার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে রোদের তাপও ভীষণ বেড়ে গিয়েছে। ”
” হুম, তবে আমার কিন্তু রোদের এই তীব্র প্রখরতা টা বেশ ভালো লাগছে। এক কথায় বলা যায় মুহূর্তটা বেশ উপভোগময়। ”
“সিরিয়াসলি এই কড়া রোদ আপনার কাছে উপভোগময় মনে হচ্ছে ? ”
” হুম, অবশ্যই। কেন আমার চোখ মুখে হাসি দেখে বুঝতে পারছ না? ”
” আচ্ছা, কোনদিক থেকে আপনার উপভোগময় লাগছে শুনতে পারি কি? ”
” কৌতূহল জাগছে বুঝি? ”
” এরকম একটি উদ্ভট কথা শুনলে আমার মনে হয় যেকোনো মানুষেরই কৌতূহল জাগবে। আর আমি তো তাদের থেকে আলাদা নই তাই হয়তো আমারও জেগেছে। ”
” যে কারণেই কৌতূহল হোক না কেন, আমার কোনো বিষয়ে যে কৌতূহল জেগেছে তোমার এটাই অনেক। কারণ তোমার মাঝে আমায় নিয়ে কোনো আকর্ষণ কিংবা কৌতূহল হল দেখাই যায় না। ”
” বুঝেছি আপনি এখন কথা পেঁচিয়ে সময় নষ্ট করবেন। তার থেকে ভালো চলুন নিচে যাই। ”
অতলকে পাশ কাটিয়ে তানহা সামনের দিকে এক পা এগুলেই অতল তানহার হাত ধরে ফেলে। ক্ষানিকটা হেঁচকা টান দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিলিয়ে তানহার কপালে জমে থাকা নোনা জলের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা অতল তার এক আঙুলে আলতো করে নিয়ে তানহার চোখের সামনে ধরে ঠান্ডা গলায় বলল,
” এই উত্তপ্ত তীব্র রোদের মাঝে তোমার ওই চোখ ধাঁধানো ফর্সা কপালে জমে থাকা উষ্ণ নোনা পানি দেখতে পাওয়াটা কি ভাগ্যের ব্যাপার নয়? ক’জনের এই সৌভাগ্য হবে? আমার তো মনে হয় না আমি ব্যাতিত এই মনোমুগ্ধকর মুহুর্তটি দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য অন্যকোনো ব্যাক্তির হয়েছে কিংবা ভবিষ্যতে হবে এই ত্রিভুবনে। তাহলে কি করে এই মুহূর্তটাকে উপভোগ না করি বলো? ”
তানহা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অতলের দিকে। আর নিজের মনে অজান্তেই বলে ফেলল,
” এই সামান্য একটি বিষয়কে আপনি কি করে পারলেন এতটা অতুলনীয় করে তুলতে? ”
” না পারার তো কিছু দেখছি না। আমার বউটা যে অতুলনীয়। তাই তার প্রতিটি ব্যাপারই যে অতুলনীয় হবেই। ”
অতলের কথা শুনে তানহার হুশ ফিরল। সাথে জিহবায় কামড় দিয়ে অতলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চোখের দৃষ্টি নিচু করে মনে মনে ভাবল,
” ধ্যাৎ! সে কি করে পারল এরকম একটি প্রশ্ন করতে? অতল কি ভাববে এখন? ”
এদিকে তানহার মুখে বিশ্বজোড়া চিন্তা দেখে অতল মুচকি হেসে বলল,
” লজ্জা পেও না, তোমার প্রশ্ন শুনে আমি কিছুই ভাবিনি। হো হো…. ”
অতলের কথা শুনে প্রতিবারের মতো তানহা এবারো হা হয়ে গেল। কিছু বলতে যাবে ওমনি অতল হো হো করে হাসতে হাসতে বলল,
” আমি মনের কথা পড়তে পারি। এবারের না বলা প্রশ্নের উত্তরও ঠিক আছে আমি জানি। তাই অবাক কর দৃষ্টিতে না তাকিয়ে মুখের হা টি বন্ধ করে নিচে চলো। ”
অতল কথাটি বলে শেষ করবার আগেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। তাই নিজের হাসি কোনোমতে থামিয়ে তানহার হাত থেকে নিজের ফোনটি নিয়ে স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটি দেখে বলল,
” তোমাদের বাসা থেকে কল এসেছে নাও রিসিভ করো। ”
তানহা আর কিছু না বলে কল রিসিভ করে কানে ধরে হ্যালো বলবার আগেই ঢলে পড়ে অতলের বুকে। অতল একদম হতভম্ব হয়ে যায়। তানহাকে দ্রুত বুকের মাঝে ঝাঁপটে ধরে মেঝেতে তার মোবাইল খুঁজতে থাকে। জ্ঞান হারাবার সময় তানহার হাতে থাকা অতলের মোবাইলটি তানহার হাত ফসকে মেঝেতে পড়ে যায়। তাই অতল ছাদের চারিদিকে চোখ বুলাতে থাকে কিন্তু একপর্যায়ে দেখা যায় মোবাইলটি ছিটকে দূরে কোথাও যায়নি অতলের ডান পায়ের কাছেই পড়ে রয়েছে। অতল তানহাকে বুকে নিয়েই ক্ষানিকটা ঝুঁকে মোবাইলটি হাতে নিয়ে সাইড বাটনে চাপ দিতেই দেখে মোবাইল কাজ করে না। মেঝেতে পড়ার সাথে সাথে যে মোবাইল সুইচ অফ হয়ে গিয়েছে সেটি বুঝতে আর অতলের সময় লাগল না। কিন্তু এই মুহূর্তে এখানে দাঁড়িয়ে মোবাইল অন করার সময় অতলের হাতে নেই। তাই মোবাইলটি প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে তানহাকে পাজ কোলে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে নিজের ঘরে চলে আসে। তানহাকে বিছানায় শুয়ে পাশে থাকা সাইড টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটি হাতে নিয়ে তানহার চোখে মুখে ঘনঘন পানি ছিটিয়ে দিতে থাকে অতল।
এদিকে মরিয়ম বেগম তানহাকে অজ্ঞান অবস্থায় অতলের পাজ কোলে দেখে ঘাবড়ে যায়। তাই আনিস খন্দকারকে সাথে করে নিয়ে ছুটে যায় অতলের ঘরের দিকে। ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে উত্তেজিত গলায় বললেন,
” অতল, কি হয়েছে তানহার? মেয়েটা তো কিছুক্ষণ আগেও দিব্যি ছিল। এরই মাঝে এমন কি হয়ে গেল যে, মেয়েটা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে? ”
অতলের বাবাও বেশ উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
” হুম তাই তো। আমি তো একটু আগেই ওদের ঘরে ছিলাম তখনও তো মেয়েটা বেশ শক্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল আমার পাশে। তখনি অতলের কথায় বাবার সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে ঘরের বাহিরে গিয়েছিল। আচ্ছা, সেই ফোনালাপে এমন কোনো কথা হয়নি তো যার জন্য তানহার এই অবস্থা ! ”
তানহার মুখে পানি ছিটাতে ছিটাতে অতল বলল,
” না বাবা সেসময়ের ফোনালাপের জন্য হয়নি কিন্তু…”
” কিন্তু কি? ”
” তানহার কথা শেষ হবার পর পরই আমি ওকে খুঁজতে ছাদে গিয়েছিলাম তখনও তানহা একেবারে স্বাভাবিক ছিল। তারপর ওকে নিয়ে যখন ছাদ থেকে ফিরে ঘরে আসতে নেব ঠিক তখনি আবারও ওর বাসা থেকে ফোন আসে। আর ফোন কানে দিতেই ও জ্ঞান হারায়। ”
” তাহলে অবশ্যই ওদের বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে আর ওর বাবার শরীরও তেমন একটা ভালো না। তুই এক কাজ কর দ্রুত ওদের বাড়িতে ফোন দিয়ে খবরাখবর যান। ”
” কিন্তু ওর বাবা তো সুস্থ ছিল আমি তার গালার স্বর শুনে যতটুকু বুঝেছি আর তুমিও তো কথা শুনেছ। ”
” সুস্থ ছিল তবে.. এখন সুস্থ নাও থাকতে পারে। শরীরের সুস্থ ও অসুস্থ এর উপর তো আর কারো হাত নেই। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে মানুষের।”
” আচ্ছা, তাহলে ফোন দিচ্ছি। ও হো ভুলেই গিয়েছে মোবাইলটা যে সুইচ অফ হয়ে আছে। দাঁড়াও অন করে নিই। ”
অতল মোবাইল অন করে তানহার বাড়ির নাম্বারে ডায়াল করতেই তানহার জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ মিটমিট করে তাকিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বাবা বলে উচ্চারণ করতেই মরিয়ম বেগম শুনতে পান। তানহার মাথার কাছে বসে তানহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
” অতল জলদি এদিকে আয় তানহার জ্ঞান ফিরেছে। ”
অতল কানে ফোন ধরেই বলল,
” ফোনের রিং বেজে গিয়েছে তাই আমি কথা বলে একেবারে আসছি। তোমরা আপাতত তানহার কাছে বসো। ”
অতলের কথানুযায়ী মরিয়ম বেগম তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
” কি হয়েছে মা? খারাপ লাগছে কি? ”
তানহা কোনো কথা বলতে পারছে না শুধু বাবা বলছে আর চোখের জল ফেলে যাচ্ছে। কথা বলার জন্য যেই বর্ণ প্রয়োজন কিংবা শব্দ প্রয়োজন সেসব কিছু যেন তার মাথা থেকে আউট হয়ে গিয়েছে। কেবল বাবা নামক এই একটি বাক্যই যেন তার মাথায় ঘুরছে।
এদিকে অতল ফোনে কথা বলে স্তব্ধ হয়ে যায়। পা জোড়া তার ভেঙে আসছে। ইচ্ছে হচ্ছে না তার এক পাও নাড়াতে। তারপরও কোনোমতে সে চলে আসে তানহার সামনে। তার মুখ জুড়ে বিরাজ করছে অমাবস্যার রাতের মতো আঁধার। একটি কথাও তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। কি বলবে, কিভাবে বলবে কিছুই তার মাথায় ধরছে না। তাই মাথার দু’পাশে দু-হাত দিয়ে ধরে ধপাস করে বিছানার কোণে বসে পড়ে।
ছেলের এরকম ফ্যাকাসে মুখ দেখে আনিস খন্দকার বেশ চিন্তিত গলায় বললেন,
” কি হয়েছে অতল? কোনো সমস্যা মানে কোনো খারাপ খবর আছে কি? ”
অতল চুপ করে আছে কিছুই বলছে না। আনিস খন্দকার দ্রুত অতলের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
” কি হলো কিছু বলছিস না কেন? আমার যে ভীষণ টেনশন হচ্ছে কি হয়েছে আমাকে খুলে বল অতল। ”
অতল মাথা নিচু করে ধীর গলায় বলল,
” তানহার বাবা…. আর নেই। ”
” মানে, কি বলছিস এগুলো? ”
” হুম, তানহার সাথে কথার বলার পর পরই উনি স্ট্রোক করে আর…. তৎক্ষণাৎ-ই মারা যান। ”
আনিস খন্দকার অতলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানহার অশ্রুসিক্ত নয়নের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” মেয়েটা বিয়ের পর স্বস্তিতে এক মুহূর্তের জন্যও নিঃশ্বাস নিতে পারলো না। ঘরে পা রাখতে না রাখতে অঘটন ঘটলো তিহানকে নিয়ে। তাও আল্লাহর অশেষ রহমত যে ওকে যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছি। আর আজ বিয়ের দ্বিতীয় দিন আরেকটি অঘটন ঘটলো। তাও আবার তানহার নিজেরই বাবার সাথে। তিহানের মতো যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনাতো দূরের কথা একপলক চোখের দেখাও দেখতে পেল না মেয়েটা। কি করে পারবে এই মেয়ে নিজেকে সামলে রাখতে? নিজেকে শক্ত করে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে? ”
কথাগুলো বলেই ফের আরও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো আনিস খন্দকার। এমন সময় হুট করে সবাইকে চমকে দিয়ে তানহা শোয়া থেকে বসে পড়ল। আর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
.
.
চলবে…….