অন্তরালের কথা পর্ব ২০

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা- জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ২০
.
.
অন্তরালের কথা ৬
.
” আমার বাবা আমার জন্য শেষ হয়ে গিয়েছে। এই আমার জন্য। আমাকে তোমরা মেরে ফেলো আমার বাঁচার অধিকার নেই। আমি একটি কুলাঙ্গার সন্তান। আমি.. আমি বাবার কাছে যাবো।”
তানহার কথা শেষ হতে না হতে মুহূর্তের মাঝে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। আর চোখ মুখ মুছে দরজার দিকে অগ্রসর হয়। অতল সেটি দেখে দ্রুত তানহাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” তুমি একা কোথায় যাচ্ছ? ”
” ছাড়ুন আমাকে। আমি আমার বাবার কাছে যাবো। ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি। ”
” আরে তুমি কি একা যাবে নাকি আমারাও তো যাবো তোমার সাথে। তুমি শান্ত হও তানহা প্লিজ শান্ত হও। ”
” না আমি এখনি যাবো। আমার বাবা যে অপেক্ষা করে বসে আছে আমার জন্য। আমাকে এখন এই মুহুর্তে যেতে হবে বাবার কাছে। ”
” আমি কি বলেছি তুমি যাবে না? তুমি যাবে তবে আমাদের সাথে কারণ এই অবস্থায় তোমায় একা ছেড়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ”
অতলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ধাক্কাধাক্কি করে তানহা একপর্যায়ে চিৎকার করে বলল,
” আপনার মতো বেহায়া ছেলে মানুষ আমি আমার জন্মেও দেখিনি। এখনো সময় আছে আপনাকে বলছি ছেড়ে দিন আমায়। ”
অতল এ পর্যায়ে বেশ ক্ষিপ্র হলো তাই তানহাকে দমানোর জন্য তানহার দু কাঁধে ধরে বেশ জোড়ে ঝাঁকি দিয়ে ধমকের সুরে বলল,
” পাগল হয়ে গিয়েছ? এরকম পাগলামো করার মানে কি? আমি কি বলেছি যে যাবে না তুমি? ”
তানহা কিছু বলতে নেবে তখন অতল আবারও বলল,
” আর একটি কথাও না, একদম চুপ করে এখানে বসো। আমি গাড়ি বের করে ডাক দিলে চুপচাপ মায়ের সাথে চলে আসবে। এর বাহিরে কোনো কথা আমি শুনতে চাচ্ছি না বুঝতে পেরেছ? ”
তানহা আর একটি কথাও বলল না কেবল বিছানায় বসে শব্দবিহীন চোখের জল ফেলে গেল।
সন্ধ্যা ৭:৩০ টা বাজে। মাত্রই অতল তিহান ও তাদের বাবা আনিস খন্দকার তানহার বাবার দাফন কার্যসম্পাদন করে ঘরে ফিরেছে। ঘরে যেন এক থমথমে স্তব্ধ ঝড়ো হাওয়া বিরাজ করছে। যেকোনো সময় হয়তো সেই স্তব্ধতা ভেঙে এক বিশাল আকারের ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে এই ঘরে জুড়ে। ঘরে এতগুলো মানুষ থাকা সত্ত্বেও কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই কেবল তানহার দিকে তাকিয়ে আছে। অতল ঘরে পা রেখে এরকম অস্বস্তিকর পরিবেশ দেখে মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” কি হয়েছে মা? সবাই এরকম চুপচাপ কেন? ” মরিয়ম বেগম চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন,
” তানহার মা আর বেঁচে নেই। তোরা তানহার বাবার লাশ নিয়ে বের হবার প্রায় দশ মিনিট পরেই তানহার মা মারা যান। ”
অতলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এ কি শুনছে সে? এ-ও কি দেখার বাকি ছিল তার!
.
দেখতে দেখতে কেটে গেল ৩ টি মাস। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন চাঞ্চল্যকর জীবন। অতীতের সেই আঁধার কালো রাতের কথা ভুলে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সকলেই ব্যস্ত। এটাই যে নিয়ম এ জগতের। কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময় যে স্রোতের ন্যায় প্রবাহমান। সময়ের গতির সাথে জীবন চলার গতি পথ ঠিক রাখার জন্য হলেও জীবনের চাকা চলমান রাখতে হয়। তাইতো আজ তানহাও জীবন ধারণ করে বেঁচে আছে তবে পরনির্ভরশীল হয়ে। তানহার বেঁচে থাকার পেছনে অবদান যদি কারো থেকে থাকে সে একমাত্র অতল। অতল ছাড়া তানহা একেবারেই নিঃস্ব সেই সাথে অচলও। তানহার সকালের ব্রাশ থেকে শুরু করে রাতের ঘুম পারানো পর্যন্ত সবকিছুর দায়িত্ব অতলের। অবশ্য অতল দায়িত্ব থেকে এসবকিছু করে না, সে তো করে তার ভালোবাসা থেকে। হতে পারে বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত একটি দিনও সে বউয়ের ভালোবাসা নামক অনুভূতি কিংবা টান পায়নি। তারপরও সে তার মনপ্রাণ উজাড় করেই তানহাকে ভালোবাসে।
তানহা গুটিশুটি মেরে ছোট বাচ্চার মতো অতলের বুকে ঘুমিয়ে আছে। মাঝে মাঝে ফ্যানের বাতাসে চুলগুলো চোখের উপর পড়তেই চোখ দুটো টিপটিপ করে নড়ে উঠে। যেন তার ভীষণ অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে। সে যে আরো ঘুমোতে চায় আর, এই ঘুমনোর জন্য প্রয়োজন এই ছোট ছোট চুলগুলো চোখের উপর থেকে সরিয়ে দেয়া। যা প্রতিদিনই অতল করে থাকে। অতলের দৈনন্দিন কাজই হচ্ছে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তানহাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে টিপটিপ করা চোখ দুটো মনভরে দেখা। তারপর চোখের উপর থেকে উড়ন্ত চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে কপালে চুমু খেয়ে আবার তানহাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষানিকটা সময়ের জন্য চোখ বুঝে তানহাকে ঘুমনোর সুযোগ করে দেয়া।
তবে আজ আর সেটি সম্ভব না, আজ যে তাদের ফিরে যেতে হবে চট্টগ্রাম। সেখানেই যে অতলের ব্যবসা বাণিজ্য। তানহার মনমানসিকতার কারণে এই তিনটে মাস অতল ব্যবসা থেকে দূরে রয়েছে কেবল তার বাবার বয়সি ম্যানেজারের উপর দায়িত্ব দিয়ে কিন্তু আর কত? বিশ্বস্ত বলেই যে একজন মানুষের উপর এতদিন দায়িত্ব দিতে হবে এমনতো কোনো কথা নেই। সেও মানুষ যন্ত্র তো নয়। তারও ক্লান্তি দূর করা প্রয়োজন। এসব নানান কথা ভেবে অতল গতকাল রাতে খাবারের টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে আজ ফিরে যাবে চট্টগ্রাম। এতে কেউ বাঁধাও দেয়নি কারণ তার যে সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা পড়ে আছে। তাই সে রাতেই নিজের ও তানহার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করে রাখে যাতে, সকালে তার জিনিসপত্র গুছানোর জন্য দৌঁড়িয়ে হাঁপাতে না হয়।
তানহার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা দেখে অতলের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয়নি তার ঘুম ভাঙাতে কিন্তু আজ যে কিছু করার নেই তার। তাই প্রতিদিনের মতো আজও কপালে চুমু খেয়ে তানহাকে আস্তে করে আওয়াজ দিতে লাগলো অতল। কয়েকটা আওয়াজ দিতেই তানহার ঘুম ভেঙে যায়। মিটমিট করে চোখ দুটো খুলে অতলের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো। আর অতল মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
” ঘুমটা কি ভালো হয়েছে? নাকি আরেকটু ঘুমনো প্রয়োজন? ”
তানহার মুখে কোনো শব্দ নেই। আগের ন্যায়-ই তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। অতল আবারও নিজে থেকে বলল,
” ঘুম চোখে থাকলেও আজ আর ঘুমোতে পারবে না গো। আজ যে আমাদের বের যেতে হবে বহুদূর। আর এমনিতেও বাহিরে তাকিয়ে দেখো কি রোদ উঠেছে একেবারে চারিদিক ঝলমল ঝলমল করছে। তাই না? ”
তানহা এখনো চুপ। অতল দূরে কোথাও নিয়ে যাবে শুনেও কোনো পরিবর্তন নেই তার মাঝে। না আছে মুখ জুড়ে কোনো প্রশ্নের ছাপ, না আছে জানার কৌতূহল। আর না বাহিরের দিকে তাকিয়ে দেখছে ঝলমলে রোদের আলোর খেলা। তানহার দৃষ্টি কেবল অতলের দু’চোখের উপর। অতল এ পর্যায়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানহাকে বুকের সাথে মিলিয়ে উঠে বসালো। আর শান্ত গলায় বলল,
” আমি হাজার চেষ্টা করেও তোমায় স্বাভাবিক করতে পারবো না, যদি না তুমি নিজে থেকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য লড়াই করো। দিন তো কারো জন্য থেমে থাকে না তানহা। তাহলে তুমি কেন নিজের জীবনকে অকেজো করে তুলছ? এমনও পৃথিবীতে অনেক ঘটনা আছে মায়ের কোলে সন্তানের মৃত্যু হয়। সেজন্য কি সেই মা দুনিয়াদারি ছেড়ে দিয়েছে? দেয়নি তো। সে বেঁচে থাকার জন্য তিন বেলা খেয়ে জীবনের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। তাহলে তুমি কেন পারবে না? আমি জানি, তুমি আমার কথা সব শুনতে পাও তাহলে উত্তর কেন দাও না? কেন ঝিম মেরে বসে থাকো? কেন ১০টা প্রশ্ন করলে ১টি উত্তর দাও? কেন অন্যমনস্ক হয়ে সারাদিন বসে থাকো? আর অন্যমনস্ক হওয়ারও লিমিট আছে। তুমি বসেছ তো বসেছই দিন পার হয়ে যদি ঘুটঘুটে অন্ধকারও নেমে আসে খাওয়ার খবর তোমার থাকে না। গোসল করার খবর থাকে না। এমনকি ব্রাশ করারও হুশ থাকে না। এসব তো ঠিক না তানহা। আজ আমি তোমার সাথে আছি তাই সর্বক্ষণ তোমার সবকিছু মনে করে করে নিজে করিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কাল… কাল থেকে যখন ব্যবসার কাজে যুক্ত হবো তখন…তখন তোমাকে কে এসব মনে করিয়ে দিবে বলো? কেউ তো দিবে না, আর আমি যে তোমায় ফোন দিয়ে দিয়ে মনে করিয়ে দিব তাও তো হবে না। কারণ তুমি অন্যমনস্ক থাকার ফলে ফোন যে এসেছে তাই বুঝবে না। এখন তুমি বলো আমি কি করব? ”
এতগুলো কথা শোনার পরও তানহার মুখ দিয়ে টুশব্দ তো দূরে থাক সামান্য একটি নিঃশ্বাসও পড়ল না। তাই অতল কথা আর বাড়ালো না। বিছানা থেকে উঠে আলমারি খুলে তানহার জন্য একটি মেরুনরঙা সেলওয়ার কামিজের সুট নিল নিজের কাঁধে। তারপর ফিরে তানহার কাছে এসে তানহাকে পাজ কোলে নিয়ে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে।
তানহাকে গোসল করিয়ে, ভেজা চুল মুছে, হাতে পায়ে বডি লোশন দিয়ে বিছানায় বসিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো অতল। তানহার ভেজা কাপড় নিজের ভেজা কাপড় ধুয়ে টাওয়াল পড়ে সেগুলো হাতে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সোজা বারান্দায় যায় অতল। কাপড় গুলো মেলে দিয়ে ফিরে আসতেই অতল দেখে তানহা দক্ষিণা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। অতল একদমই অবাক হয়ে যায়! অতলের চোখ যেন ছানাবড়ার মতো অবস্থা। অতল হা হয়ে তাকিয়ে থাকে তানহার দিকে! পরমুহূর্তেই অতল ভাবল,
” সে দাঁড়িয়ে থাকলে যদি তানহা কোনো কারণে সংকোচ বোধ করে! না না, তার এখানে দাঁড়িয়ে হা হয়ে থাকাটা মোটেও ঠিক হবে না। তার চলে যাওয়াই ভালো হবে। এতে তানহার নিজেকে সহজ করে তুলতেও সুবিধা হবে। ”
কথাগুলো ভেবেই অতল ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ঝর্নার ছেড়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর মনে মনে ভাবে,
” কি হয়েছে তানহার? এতটা পরিবর্তন কি করে সম্ভব! শুধু যে জানালার সামনে দাঁড়ানোটাই বড় বিষয় তা তো নয়। সেই সাথে চোখের জলও যে পড়ছে। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, তানহাকে যখন সে গোসল করাচ্ছিল তখন তানহা বেশ লজ্জা পাচ্ছিল। যেটা তার মুখ দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল। কিন্তু….গত তিনমাস ধরে তো এরকম লজ্জা ব্যাপারটা ছিল না, আর গত তিন মাস-ই বা কেন! গতকালও তো তানহার মাঝে লজ্জার কোনো আভা দেখেনি সে! তারমানে কি কিছুক্ষণ আগে বলা তার কথাগুলো কাজে দিয়েছে! সত্যি কি তাই! ”
অতলের বেশ উত্তেজিত লাগছে। মুখ জুড়ে ফুটে উঠল এক বিজয়ের হাসি। দ্রুত গোসল করতে শুরু করল অতল। কারণ সে যে তার তানহাকে স্বাভাবিক রূপে দেখার লোভ সামলাতে পারছে না। কোনোরকমে গোসল সেরে অন্য আরেকটি টাওয়াল পড়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো অতল। বের হতেই দেখে তানহা একেবারে রেডি হয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বিছানার উপর বসে আছে। অতল তানহার কাছে আসতে আসতে বলল,
” একেবারে রেডি দেখছি! চোখে সান গ্লাস, ঠোঁটে লিপস্টিক, চুলের একপাশে ক্লিপ খুব সুন্দর লাগছে তো তোমায়! ”
” জ্বী, ধন্যবাদ। ”
” এতো সিম্পল সাজেও এতো অপরূপ দেখানোটা কি সবার পক্ষে সম্ভব নাকি… শুধু তোমার পক্ষেই! কোনটা? ”
” কারো পক্ষেই সম্ভব না। সেটা সম্ভব কেবল আপনার চোখের দেখা ভালোবাসাময় দৃষ্টির পক্ষে। ”
” বাব্বাহ! কথা শিখে গিয়েছ দেখছি… ওহ্ সরি, ভালোই কথা জানো দেখছি। ”
” না জানার তো কিছু নেই আর, বয়সও তো কম হয়নি। তবে হ্যাঁ, মানুষ চেনার অপেক্ষায় ছিলাম। ”
” তাই বুঝি? ”
” জ্বী, এবার কথা না বাড়িয়ে দ্রুত রেডি হয়ে নিন তা নাহলে বের হতে প্রচুর দেরি হয়ে যাবে। ”
” হুম কিন্তু আমার যে কিছু কথা জানার আছে! ”
” কথাগুলো পড়ে বললে কি হয় না? ”
” সবকিছু পরের জন্য তুলে রাখা ঠিক না। আর যদি সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু না হতো তাহলে অবশ্যই পড়ে বলতাম। ”
” আচ্ছা, তো বলে ফেলুন। ”
.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here