অন্তরালের কথা পর্ব ২১

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা- জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ২১
.
.
অতল জামা বিহীন তার উন্মুক্ত শরীরে এগিয়ে যাচ্ছে তানহার কাছে। একেবারেই যে শরীরে কিছু নেই তা আবার নয় কেবল কোমড়ের নিচে হাঁটু অবধি একটি টাওয়াল পড়ে রয়েছে সে। তবে দেহের উপরিভাগ একেবারেই খোলাসা। সুঠাম দেহের অধিকারী একজন পুরুষ অতল। তার মাঝে ঘন কালো লোমে ভরা সেই লম্বা দেহ। আর সেই লোমের তলদেশ রয়েছে বিন্দু বিন্দু শিশিরকণার সমাবেশ।দেখতে এতটাই প্রেমময় লাগছে তানহার পরিবর্তে যে কোনো মেয়ে থাকলে হয়তো আজ অতলের প্রেমে পড়ে যেতই যেত। হয়তো না নির্ঘাত-ই প্রেমে পড়ে যেত। আর যদি হয় সে বিয়ে করা বউ তাহলে নিশ্চিত নিজের সজ্ঞানে নিজেকে সঁপে দিতো অতলের সেই প্রেমময় বাহুডোরে। কিন্তু তানহা যে সেই প্রকৃতির মেয়েদের মাঝে পড়ে না। তাই তো নিজের মনোবলকে শক্ত করে ঠাই দাঁড়িয়ে রয়েছে তার নিজ স্থানে।
অতল ধীর গতিতে তানহার কাছে এসে একহাত ধরে বসা থেকে দাঁড় করালো। কোমড়ে আলতো স্পর্শ করে হালকা চাপ দিয়ে মিলিয়ে নেয় তার বুকভরা ভেজা লোমের সাথে। এই প্রথম অতলের জামা বিহীন দেহের সাথে এতটা কাছ থেকে মিলিত হলো তানহা। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার। তারপরও নিজের অস্বস্তিকে সাইড করে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে অতলের চোখে চোখ রেখে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকে তানহা।
অতলের ভেতর যেন খুশিতে ভরে যাচ্ছে তানহার এতো পরিবর্তন দেখে। তারপরও নিজের মনের সংশয়কে দূর করার জন্য তানহার কোমড় জড়িয়ে শান্ত গলায় বলল ,
” মন খারাপ? রাগ করেছ আমার কথায়?”
” কিসের মন খারাপ! আর কিসেরই বা রাগ! এখানে কি রাগ করা কিংবা মন খারাপ হওয়ার মতো কোনো কথা হয়েছে? ”
” আমি জানি, তুমি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছ আর, আমি এ-ও জানি রাগ না হলেও ভীষণ কষ্ট পেয়েছ তুমি আমার কথায়। কিন্তু বিশ্বাস করো তানহা আমি তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কথাগুলো বলিনি। এমনকি তোমার পেছনে আমার করা প্রতি মুহূর্তের পরিশ্রমের কথা ভেবেও সেগুলো বলিনি। আমারতো বেশ ভালো লাগে তোমার কাছাকাছি থাকতে। তোমায় নিজের মতো করে সাজিয়ে রাখতে। কিন্তু এই ভালো লাগা গুলোর আড়ালে যে বিরাট বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তোমার! সেগুলো কিভাবে মেনে নেই বলো? আমার এই ক্ষণিকের ভালো লাগার জন্য আমি তো কখনোই চাইব না তুমি দিন দিন অকেজো হয়ে মানসিক রোগীতে পরিণত হও। তাই তো আজ না পেরে কথাগুলো বলেছি। তোমাকে সুস্থ করবার জন্য, ঠিক যেমনটা আমার আগের তানহা ছিলে ঠিক সেরকম করার জন্যে। ”
” আমি জানি আপনি কখনো আমার ভালো ব্যতীত খারাপ চাইবেন না। কারণ… আমার বাবা যে আপনাকে নির্বাচন করেছিলেন। আর আমার বাবার নির্বাচন কখনোই বৃথা যেতে পারে না। তাইতো আপনাকে ঘিরে আমার এ মনের মাঝে রাগ, অভিমান, কষ্ট কিছুই জন্মায়নি। ”
” সত্যি বলছ তো রাগ করো নিই আমার উপর? ”
” আমি পারতপক্ষে কখনো মিথ্যে বলি না।”
” যাক বাবা বাঁচালে। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যদি তুমি রাগ করে থাকো সেই ভেবে। ”
” আশা করবো কিছুক্ষণ আগের কথা শুনে ঘাবড়ানোর বদলে ভরসা খুঁজে পেয়েছেন। ”
” সেতো পেয়েছি আর পাবো নাই বা না কেন বলো! একটি পুরুষের ভরসার স্থানই যে হচ্ছে তার অর্ধাঙ্গিনী, তার স্ত্রীর মাঝে। ”
” আচ্ছা, এবার আপনি আমায় ছেড়ে রেডি হয়ে নিন তো। বেলা তো আর কম হলো না। এখন বের না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আর সেই সাথে কষ্টের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে এই রোদের কড়া তাপে। ”
” কথাটি মন্দ বলোনি তবে…আমার যে এই সংস্পর্শটির সমাপ্তি ঘটাতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে এভাবেই ঝঁপটে ধরে পার করে দিই যুগের পর যুগ।”
” কে বলেছে সমাপ্তি ঘটছে? আমার তো মনে হয় এই সংস্পর্শটিকে গভীর করতেই আমাদের এই নতুন অভিযান।”
কথাটি বলেই তানহা নিজেকে অতলের বাহুডোর থেকে মুক্ত করে ঘরের চৌকাঠের বাহিরে পা রাখলো।
পেছনে তানহার যাওয়ার পথের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে অতল! তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না তানহার বলা শেষ কথাটি। তারপর নিজেই নিজেকে শান্ত করে মুচকি হেসে এক হাত দিয়ে চুল নাড়াতে নাড়াতে মৃদুস্বরে বলল,
” বউটা বুঝি সত্যি এবার বউ হলো! ”
এদিকে তানহা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। আর পেছনে ফিরে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুচকি হাসি দিয়ে মনে মনে ভাবল,
” অবশেষে পেরেছে সে, বাবা-মায়ের নির্বাচনকে সম্মান জানিয়ে নিজের মাঝে নতুন এক স্বত্বাকে লালন করতে। ”
.
তিহান ছাদের কর্নারে দাঁড়িয়ে দূর আকাশ পানে তাকিয়ে রয়েছে। আর দেখছে আকাশের বুকে একঝাঁক পাখির সমাবেশ। যারা একেকবার একেক ডিজাইন বানিয়ে একসাথে উড়ে বেড়াচ্ছে। আহা! কি সুন্দর-ই না তাদের জীবন! না আছে দুঃখ, না আছে আকাঙ্খা! না আছে কিছু হারাবার, না আছে কিছু পাবার! এরকম জীবন যদি তার হতো কতো সুখেরই না হতো! না থাকতো কোনো চিন্তা, না থাকতো ভাবনা, না থাকতো কাউকে নিজের করে পাবার তীব্র বাসনা, আর না থাকতো তার এই ফোলা চোখে নোনা জলের সমাহার। কেবল সারাদিন আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াতো আর সময় অসময়ে মনের আনন্দে গুনগুন করে গান করতো।
আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভেবেই তিহানের ফোলা দুটো চোখ থেকে নোনা জলের ধারা বয়ে গেল। চোখ দুটো মুছে পেছনে ফিরে তাকাতেই সে অবাক হয়ে যায়! সেই সাথে ভীষণ ভয়ও পায়। পেছনে যে বাবা দাঁড়িয়ে। আর বাবা যদি তার এই চোখের জল দেখে ফেলে তাহলে যে ভীষণ কষ্ট পাবে। যেটা তিহান কখনোই সহ্য করতে পারবে না। তাই তিহান নিজেকে শক্ত করে স্বাভাবিক গলায় বলল,
” বাবা তুমি এই দুপুরবেলা ছাদে? কখন এলে? আর কেন-ই বা এলে কিছু কি প্রয়োজন তোমার? আমাকে ডাকলেই পারতে তুমি কেন কষ্ট করে এসেছ এই কড়া রোদের তাপে! ”
আনিস খন্দকার স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন,
” এসেছি কি আর সাধে! তোকে খুঁজতেই তো এলাম। কোথায় গিয়েছিলি কিছুক্ষণ আগে? তোকে তোর মা, ভাই খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। তোর ভাই তোকে দেখে যাবে বলে সেই কতক্ষণ অপেক্ষা করে বসেছিল কিন্তু তোর তো কোনো পাত্তাই ছিল না। ফোন করে যে বলবে ঘরে আসতে সেই রাস্তাও রাখিসনি। ফোনটা ঘরে রেখেই চলে গিয়েছিলি। শেষমেশ বাধ্য হয়েই চলে যেতে হলো তোকে না দেখে। ”
” ও, আসলে আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজে একটু বাহিরে গিয়েছিলাম তাই আর কি দেরি হয়ে যায় ফিরতে। তুমি ভেবো না আমি ভাইয়ার সাথে ফোন করে কথা বলে নিবো। এবার চলো, ঘরে যাই। ”
” আচ্ছা চল। তবে মনে করে ফোন দিয়ে কথা বলে নিস কিন্তু! ”
” আচ্ছা বাবা। ”
তিহান বাবাকে কোনোমতে বুঝিয়ে ছাদ থেকে নেমে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বুক ভরে এক নিঃশ্বাস নেয়। তারপর স্থির পায়ে এগিয়ে গেল রুমের সাথে এডজাস্ট করা বেলকনিটির কাছে। বেলকনিটি যে তিহানের খুব পছন্দের একটি জায়গা। কেননা এখানে দাঁড়িয়ে তাদের বাগানের সম্পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে সে। বাগানের গাছগুলোর হেলেদুলে খেলার ধরন, বাতাসের ছলে একগাছ অপর গাছের সংস্পর্শে গিয়ে মুহূর্তের মাঝে খিলখিলিয়ে উঠা এই সবই যেন তার ভালো থাকার টনিকের মতো কাজ করে। বাগানে থাকা প্রতিটি গাছের পাতা, ফুল, ফল যেন এই বেলকনি টির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আর সেই সাথে তার মাঝে আগ্রহ জাগায় নতুন করে বাগানের প্রেমে পড়ার। তাইতো তিহানের এতো পছন্দ এই বেলকনি। তবে সে আজ পুরনো সেই অনুভূতি, পুরনো ভালো লাগা কিংবা ভালো থাকার সেই টনিক খুঁজতে আসেনি এখানে। সে যে এসেছে আজকের সকালে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনাকে স্মৃতিচারণ করে, তার বাগানকে জুড়ে সকল অনুভূতির মাঝে সেই ঘটনাটিকেও ক্ষানিকটা অনুভূতির আকারে সাজিয়ে স্মৃতির খাতায় লিপিবদ্ধ করতে।
হ্যাঁ, আজকে সকলের ঘটনাই। তানহা ও অতল বেরিয়ে যাওয়ার সময় যে তিহান এই বাগানেই লুকিয়ে ছিল। তিহান কখনোই লুকিয়ে থাকতো না, আর তিহান লুকিয়ে থাকার মতো ছেলেও না। শুধুমাত্র তানহার এ পরিবর্তনের ধারা দেখেই তার লুকানো। সে বুঝতে চেয়েছিল তানহার পরিবর্তন হলেও সে পরিবর্তন কি অভ্যন্তরীণ দিক থেকে নাকি বাহ্যিক দিক থেকে। তার বিশ্বাস ছিল সে পরিবর্তন কেবলই বাহ্যিক দিক থেকে হবে। যার ফলে তানহার চোখ দুটো গোপনে হলেও তিহান নামক ভুবনে ছুটোছুটি করবে তিহানকে একপলক দেখবে বলে। কিন্তু না, সেরকম কিছুই হয়নি। তিহানের বিশ্বাসকে মিথ্যে করে দিয়ে তানহা কোনোদিক না তাকিয়ে সোজা চলে গিয়েছে অতলের হাত ধরে। এমনকি তার মুখ জুড়ে ছিল না কোনো অস্থিরতা ছাপ, ছিল না তিহানকে একটিবার দেখার কোনো প্রচেষ্টা।
চোখ বুঝে কথাগুলো ভাবছিল তিহান। ভাবনার সমাপ্তি ঘটতেই ভেজা পাপড়ির চোখ দুটো মেলে বাগানের সেই কোণের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল,
” কি হলো সেই ঝোপঝাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে, কোনো কি লাভ হয়েছে? হয়নি তো, আর হবেও না। তানহার যে কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপই নেই তোকে ঘিরে। তার মুখ দেখেই বুঝা গিয়েছে সে তার স্বামীকে নিয়ে বেশ সুখী। কমদিন তো হয়নি বিয়ে হয়েছে। পুরো তিন তিনটে মাস হয়েছে বিয়ের। আর তিন মাস ছোট করে দেখলেও দিন হিসেবে তো এই সময়টা ব্যাপক। পুরো ৯০ দিন সে তার স্বামীর সংস্পর্শে তাও আবার দিনে রাতে ২৪ ঘন্টা। তাহলে কি করে মনে রাখবে তোকে? স্বামীর ভালোবাসার সামনে যে তোর প্রেমিক নামক ভালোবাসা ফিকে দেখায়। তাই হয়তো সে তোকে মনে রাখতে চায় না। তাহলে তুই কেন রাখবি তাকে মনে? তোর কি আত্মসম্মান নেই? নির্লজ্জ তুই? বেহায়া? আর না, অনেক হয়েছে নিজেকে কষ্ট দেয়া। এবার আর অন্য কারো জন্য বাঁঁচবি না তুই, শুধু নিজের জন্য বাঁচবি। নিজের মতো করে বাঁচবি। নতুন করে সাজাবি নিজের জীবনকে। যে জীবনে থাকবে মুক্ত আকাশ, থাকবে না কোনো বাঁধা ধরা। ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াবি থাকবে না কষ্টদায়ক সহস্র পাখির মেলা। ”
কথাগুলো বলেই তিহান চোখের নোনা জলের ধারা মুছে ঘরে ফিরে গেল।
.
জানালার দিক মুখ করে মাথা ঠেকিয়ে অদূর প্রান্তে তাকিয়ে ট্রেনের সিটে বসে আছে তানহা। মনটা যেন তার ভরে উঠছে বাহিরের শান্তিময় পরিবেশ দেখে।কোথাও সবুজ ঘেরা মাঠ, কোথাও ছোট ছোট শাখা বিল, তো কোথাও আবার ব্রিজের তলদেশে নদীর জোয়ারের সমারোহ। এক অদ্ভুত প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে তানহার চারিপাশে।কিন্তু তানহা জানে না, সে যেমন পরিবেশের প্রেমে পড়ে পলকহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ঠিক তেমনি, পাশে থাকা দুটি চোখ তার সেই উদাসিনী মনটার প্রেমে পড়ে পলকহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
.
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here