অন্তরালের কথা পর্ব ২২

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ২২
.
.
এভাবে বেশ ক্ষানিকটা সময় পার হবার পর তানহা বেশ বিরক্ত হয়ে ওঠে তার উড়ন্ত চুলগুলো নিয়ে। এ চুলগুলো যে তাকে বারংবার বাঁধা দিচ্ছে পরিবেশের প্রেমে হাবুডুবু খেতে। তাই সে ব্যাগ থেকে একটি রাবার ব্যান্ড নিয়ে চুলগুলো একত্রে করে বাঁধতে নিল। ওমনি পাশ থেকে নেশা নেশা কন্ঠে অতল বলে উঠল,
” এলোকেশী কণ্যাদের যে খোলা চুলে মানায় সে কি জানো না? এলোমেলো চুলগুলো যখন তোমার ওই মায়াবী মুখের উপর ছুটোছুটি করে তুমি কি জানো তোমায় কেমন লাগে? মনে হয় তুমি এক অজানা রাজ্যের এলোকেশী রাণী। যার চুলগুলো এক মিনিটও স্থির থাকতে পারে না। যার চুলের অস্থিরতার মাঝেই তার সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। তারপরও কি চাও সেই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যকে আড়াল করে রেখে … আমাকে বঞ্চিত করতে? ”
অতলের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তানহা কিছুই বলল না। কেবল মুচকি একটি হাসি দিয়ে রাবার ব্যান্ড ফের ব্যাগে রেখে চোখ ফিরিয়ে পুনঃরায় বাহিরের জগতে মননিবেশ দিল।
.

রাত ১১:৪৩। ক্লান্ত শরীরে ঘুম ঘুম চোখে এপার্টমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল অতল ও তানহা। এপার্টমেন্টে লিফট থাকলেও সেটি কিছুক্ষণ আগেই সর্বোচ্চ তলায় উঠার উদ্দেশ্য চলে গিয়েছে। সেই লিফট আসার অপেক্ষা অতল আর তানহা দু’জনেই করতে নারাজ। তাইতো নিজেদের ফ্লোর ৫ম তলায় থাকা স্বত্তেও দুজনেই পায়ে হেঁটে যেতে শুরু করে। হাঁটার সময় তো জোড় পূর্বক হেঁটেছে। কিন্তু মেইন দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন সব ক্লান্তি এসে ভর করলো তাদের দুজনের উপর। তালা খুলার সুযোগ টুকুও যেন পাচ্ছে না তারা ক্লান্তির কাছ থেকে। কোনোমতে দরজা খুলে পায়ের জুতো দরজার একপাশে রেখে দু’হাতে দুই লাগেজ নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল অতল। পেছনে তানহা মেইন দরজার লক লাগিয়ে অতলের পিছু পিছু যেতে লাগল। রুমের কাছে যেতেই দেখে অতল ফ্রেশ না হয়ে পড়নের জামা পড়েই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমের ঘোরে চলে গিয়েছে। তানহা বেশ কয়েকবার অতলকে ডাক দিলেও বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। অতল তার নিজের মতো করেই ঘুমোতে ব্যস্ত থাকে। তাই আর তানহা তাকে ডেকে তুলবার বৃথা চেষ্টা করেনি বরং অতলের ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” ভাগ্যিস অতলের জোড়াজুড়িতে রেস্টুরেন্টে ডিনারটা করেছিল সে । তা না হলে ঘরে এসে ডিনারের জন্য রান্না করতে করতে অতলের আর খাওয়া কপালে জুটতো না। ”
বলেই তানহা এক সুট কাপড় লাগেজ থেকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে। আজ তানহা ফ্রেশ হতে তেমন একটা সময় নেয়নি। হয়তো ক্লান্তির চাপে পড়ে। তাইতো দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ঘরে এসে মুখে হালকা করে পন্ডস স্নু দিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে অতলের পাশ দিয়ে শুয়ে পড়ে আর পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।

.
সকাল ৯ টা বাজে। অতলের মোবাইলে, টেবিল ক্লকে সেই কখন থেকে এলার্ম বেজেই চলছে কিন্তু কারোই কোনো হুশ নেই। দুজনেই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। এতটা পথ জার্নি করে আসলে কারই বা সকাল সকাল ঘুম ভাঙে। এইটুকুনি ঘুমতো স্বাভাবিক মতে ঘুমোতেই পারে। তবে না, অতল ঘুমোলেও তানহা আর ঘুমোতে পারছে না। আর ঘুমোবেই বা কি করে যদি চোখের উপর কড়া রোদের রশ্মি এসে খেলা করে। জানলার পাশ ঘেঁষেই রয়েছে বিছানাটি। আর তানহাও শুয়েছে জানালার সাইডেই। তাইতো খুব সহজেই রোদের দেখা মিলে গেল তানহার চোখের উপরিভাগে।
তানহা শোয়া থেকে উঠে বসলো। পাশে তাকাতে দেখে অতল কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বেশ মায়া ছড়িয়ে আছে এই মুখখানি জুড়ে। কথাটি তানহার মাথায় আসতেই ভ্রু দুটো কিঞ্চিৎ পরিমাণ কুচকে মনে মনে ভাবল, ” কি ভাবছে সে এগুলো? তার তো এসব ভাবার কথা নয়! অতলকে নিয়ে যে তার মনে কোনো অনুভূতিই নেই যা আছে সব লোক দেখানো। সবটাই লোক দেখানো। আর সংসার জীবন সেতো করবে শুধুমাত্র তার বাবার সম্মান রক্ষার্থে। এর থেকে বেশি কিছুই নয়। তার মনে যে কেবল তিহানের বাস সেটা থাক সবার অগোচরে। নাই বা হলো অন্তরালের কথা প্রকাশ। ”
অতলের থেকে চোখ ফিরিয়ে জানালার দিকে দিতেই কেমন যেন তার কানের কাছে শো শো আওয়াজ আসতে লাগল। যার ফলে অদ্ভুত ভাবে তার হৃদয়ের প্রতিটি গুপ্ত স্থানে যেন প্রশান্তির বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যেতে আরম্ভ করলো। তার ভেতর যেন স্বস্তি ও অস্বস্তি দুটোই বাসা বেঁধেছে এই মুহূর্তে। তানহার চুলগুলো খোলা ছিল তাই কপাল থেকে সবগুলো চুল পেছনে নিয়ে হাত খোঁপা বেঁধে বিছানা ছেড়ে উঠে ক্রমশ এগোতে থাকে সেই আওয়াজের উৎপত্তিস্থল খুঁজতে।
একপর্যায়ে তানহা পৌঁছে গেল দুটি রুম পার হয়ে দক্ষিণ দিক মুখ করা বেলকনি টির কাছে। বেলকনিতে পা রাখতেই যেন তার মন দুলে উঠল প্রশান্তির ছোঁয়ায়। এরকম প্রশান্তি এর আগে তানহা কখনোই অনুভব করেনি। করবেই বা কি করে সে যে এর আগে কখনো সাগরের পাড়ে ঘর বাঁধেনি আর না বেঁধেছে তার বাবা-মা। এই প্রথমই তার খুব কাছ থেকে সাগর দেখা। আর আজই যে প্রথম ও শেষ দেখা তাও তো নয়, সে যে আজকের পর থেকে দৈনিকই এই মুহূর্তটি উপভোগ করতে পারবে। উফফ! তার যে কি ভালো লাগছে সে কাউকে বুঝাবে তো দূরের কথা নিজেও বুঝতে পারছে না।
তানহার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে তার এপার্টমেন্টটি এতো উপরে হওয়ার জন্য। তাইতো সে এতো সুন্দর ও সরাসরি সাগরের ক্ষনে ক্ষনে আসা সেই ছন্দরূপী ঢেউয়ের তাল উপভোগ করতে পারছে। তারউপর বেলকনিটি খোলা। নিচের অংশে পার্টিশন থাকলেও উপরিভাগটি একেবারেই খোলাশা। যার ফলে তানহার মন খারাপের দেশের প্রতিটি মুহূর্ত সুখময় হয়ে উঠবে।
তানহা তার দুটো হাতের ভর বেলকনির নিচের পার্টিশনে দিয়ে দূর সাগরের প্রান্তে তাকিয়ে আছে। আকাশ থেকে জলন্ত উত্তপ্ত আগুনের শিখা যেন তার খন্ড খন্ড আগুনের গোল্লা ছুঁড়ে ফেলছে সাগরের বুকে। সেই গোল্লা গুলো নোনা পানিতে ছিটকে পড়ে নিভে না গিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে ঝিলমিল ঝিলমিল আভা সাগরের বুক জুড়ে। আর বাড়িয়ে দিচ্ছে সাগরের সৌন্দর্যের মাত্রা কয়েকগুন।
আর সেই সৌন্দর্যকে তানহা এতটাই মন্ত্রমুগ্ধকোর নয়নে দেখছে তার জীবনের প্রতিটি দুঃখ, কষ্টই যেন তার মনের ভেতর থেকে মুহূর্তের মাঝেই ভেনিস হয়ে গেল। তার মনের চার দেয়ালে যেন কষ্ট তো দূরে থাক কষ্টের আগাছা টুকুও নেই। শুধু রয়েছে সুখ, সুখ কেবলই সুখ।
এদিকে অতল বেশ সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে তানহার পেছনে। আর দেখছে তানহার ভেতর জেগে উঠা সেই আনন্দময়ীকে। কিন্তু তানহার সেদিকে হুশই নেই, সেতো আছে তার দৃষ্টিবিলাসে মত্ত। কিন্তু যখন হুশ ফিরে তখন দেখে পেছন থেকে দুটো হাতের দশটি আঙুল তার নরম তুলতুলে কোমড়ের আনাচকানাচে আনমনে খেলে যাচ্ছে। তানহার আর বুঝতে রইলো না এ হাত দুটো কার। কারণ অতল ব্যতীত এ ঘরে যে আর কোনো তৃতীয় ব্যাক্তি নেই। তাই সে নিজে থেকে পেছনে ঘুরে অতলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
” ঘুম পরিপূর্ণ হয়েছে তবে? আমি তো ভেবেছিলাম আজ হয়তো আর ঘুম ভাঙবে না ক্লান্তির হ্রেস ধরে। ”

” ঘুম না ভেঙে কি উপায় আছে বলো? বউকে বুকের আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যে ঘুমের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। আজ সেই বউকেই যদি ঘুমের মাঝে কাছে না পাই সেই ঘুম কি আর ঘুম থাকে? ”
” ঘুম যদি ঘুম না হয়ে অন্যকিছু হয় তবে সেটা কি হবে? ”
” মজা করছ আমায় নিয়ে ভালো। করো করো, বেশি বেশি মজা করো। দূর্বল জায়গা জেনে গিয়েছ যে, মজা তো করবেই। হুহ…..”
তানহাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই মুখ ফুলিয়ে কথাগুলো বলল অতল। তাই তানহা স্মিত হাসি দিয়ে বলল,
” এ্যা মা… আমি মজা করবো কেন? আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি তাই তো জিজ্ঞেস করেছি। ”
” সে আমি খুব ভালো করেই জানি বুঝতে পেরেছ। আর শোনো, তোমাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নিজের মাঝে এতটাই বদ অভ্যাস তৈরি করে ফেলেছি যে, তোমাকে ঘুমের মাঝে বুকে না পেলে সে ঘুম প্রশান্তির বদলে অশান্তির ঘুমে পরিণত হয়। এককথায় বলতে পারো ঘুমটাই হারাম হয়ে যায়। ”
” ও তাই বুঝি? ”
” হুম, আচ্ছা, এবার উল্টো ঘুরে দাঁড়াও তো। ”
” কেন? ”
” আগে ঘুরোই না তারপর না-হয় বলছি কেন। ”
তানহা আর কোনো কথা না বলে অতলের কথানুযায়ী বাহিরের দিক মুখ করে দাঁড়ালো। আর পেছন থেকে অতল ঠিক আগের ন্যায় তানহাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে তানহার ঘাড়ে নিজের থুতনি আলতো করে রেখে গালের সাথে গাল মিলিয়ে বলল,
” কেমন লাগছে নিজের ভুবনে এসে? যে ভুবনে তোমার রাজত্ব-ই সর্বক্ষণ বিচরণ করবে। ”
” খারাপ লাগার তো কিছু নেই। প্রতিটি মেয়ের-ই এরকম একটি ভুবনের স্বপ্ন থাকে। আর আমিও যেহেতু একজন মেয়ে তাই আমার স্বপ্নও এর থেকে ব্যাতিক্রম কিছু নয়। তবে…”
” তবে কি তানহা? আমাকে খুলে বলো। তোমার যেই জিনিসটি ভালো লাগবে না আমাকে সরাসরি বলো, আমি এখনি সব ঠিক করে দিব। তোমার পছন্দের বাহিরে কোনো কিছুই এ ঘরে থকবে না। কারণ তোমার খুশিতেই যে আমার খুশি। ”
অতলের এতো ভালাবাসাময় কথা শুনে তানহা আর কিছুই বলল না। কেবল সাগরের দূর প্রান্তে তাকিয়ে অতলের এই ভালোবাসা জড়ানো কথা ও ছোঁয়াকে তাদের সম্পর্কের সম্মানার্থে গ্রহণ করে নিল।
.

.
রাত প্রায় ৯ টার কাছাকাছি। তানহা ও অতল দুজনেই ডিনার করে উঠল কেবল। তানহা টেবিলের উপর থাকা খাবারের জিনিসপত্র গোছালেও অতল হাত ধুয়ে দ্রুত টেবিল ছেড়ে চলে গেল বেড রুমে। দেরি হলে যে রাত ৯ টার খবরটা মিস হয়ে যাবে তার। যেটা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব না, সে যে খবরের পাগল। প্রতিঘন্টার খবর না দেখলে যেন তার মাথা পুরোই বিগড়ে যায়।
তাইতো খাওয়া শেষ হতেই তানহাকে ডাইনিং টেবিলে একা ফেলে অতল এসে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে বসে পড়ে বিছানার মধ্যেখানে। টিভি অন করে একের পর এক চ্যানেল ঘুরাচ্ছে কিন্তু এখনো কোনো চ্যানেলে খবর শুরু হয়নি। তাই এভাবেই কয়েকটা চ্যানেল ঘুরাতে থাকে। এরই মাঝে ঘরে আসে তানহা। পরনের ওড়না দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে বিছানার এক কোণে বসে অতলকে বলল,
.
.
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here