#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৪৭
.
.
” তুমি না সব বিষয় নিয়ে মজা করো, ভালো লাগে না আমার। ”
বলেই তানহা গাল ফুলিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল। আর তার পেছন পেছন যেতে লাগল অতল নিজেও।
.
বিছানার এক কোণে বসে মাথায় দু-হাত দিয়ে চেপে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে তিহান। কেবল তানহার ভেজা চুলের টপটপ করে পানি ঝরার দৃশ্যটি চোখের সামনে ভাসছে। সেই সাথে ভাসছে তানহার হাসি মাখা মুখটি। যে হাসির মাঝে প্রকাশ পাচ্ছিল অতলের দুষ্টুমি উপভোগের প্রবল ইচ্ছা। মাথা ভনভন করে ঘুরছে তার। মনে মনে ভাবল,
” আমি কি একাই তানহাকে ভালোবেসেছিলাম যে, সব কষ্ট নিজের ঘাড়ে চেপে নিয়েছি! কেন এত কষ্টের ভাগিদার হব, কোন কারণে! তানহা যদি এতদিনের সম্পর্ক, স্মৃতি, ভালোবাসা সবকিছু ধুয়ে মুছে নতুন ভাবে বাঁচতে পারে আর বেশ ভালো ভাবেই বাঁচতে পারে তাহলে আমি পারব না কেন! আমিও বাঁঁচব, হ্যাঁ আমিও বাঁচব। নতুন করে সবটা শুরু করব। তানহা নামক শব্দটাই জীবন থেকে উপড়ে ফেলব। নিজের জীবনের মূল্যবান সময়গুলোকে আর বৃথা যেতে দিব না, কিছুতেই না। তানহা মেয়ে হয়ে সবকিছু ভুলে যেতে পারলে আমিতো ছেলে! আমার ভুলতে কতক্ষন। ”
বলেই তিহান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পেছনে ফিরে তাকিয়ে রইলো নিদ্রার দিকে। চোখ দুটো লাল রক্তিম বর্ণ হয়ে আছে। তারপরও চোখের পলক না ফেলেই তাকিয়ে আছে নিদ্রার দিকে।
ধীর পায়ে বিছানার দিকে গিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো নিদ্রার ঘুমন্ত মুখটির দিকে। মায়া হতে নিয়েও হলো না, বরং জেদ হলো নিজের ওপর। কোনো কিছু না ভেবে হুট করেই নিদ্রার বুকের উপর থাকা ওড়নাটি হাতে তুলে নিল তিহান। ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। আর ঝাঁপিয়ে পড়লো নিদ্রার দেহের উপর।
.
সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চলল। তবে এখনো তিহান, নিদ্রা কেউই ঘরের দরজা খুলে কারো মুখাপেক্ষী হওয়ার সাহস পায়নি। এই নিয়ে একের অধিকবার মা মরিয়ম বেগম এসে তাদের ডেকে গিয়েছে কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। দরজা খোলা তো দূর টু শব্দটি করেনি দু’জন। আর শব্দ করবেই বা কী করে, শব্দ করলেই যে ঘরের দরজা খুলে দিতে হবে যেটা তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না।
বিছানার চাদর এলোমেলো হয়ে আছে। মাথার বালিশ মেঝের একপাশে পড়ে আছে। পড়নের কিছু কাপড় এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে পুরো মেঝে জুড়ে। তার মাঝেই গুটিশুটি মেরে মেঝেতে বসে আছে নিদ্রা। আর তার থেকে প্রায় সাত-আট হাত দূরত্ব বজায় রেখে মেঝের এক কোণে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে তিহান। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এই নিয়ে তিহান বহুবার চেষ্টা করেছে নিদ্রার সাথে কথা বলার।কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। তাই নিদ্রার সাথে সাথে নিজের দৃষ্টিও মেঝের দিকে দিয়ে রেখেছে।
এভাবে মিনিট দশেক পার হবার পর নিদ্রা শান্ত গলায় বলল,
” এভাবে বসে না থেকে উঠে গোসলে যান। বেলা তো কম হয়নি। ”
বলেই নিদ্রা কোনোমতে উঠে বিছানার চাদর একটানে নামিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। আলমারি থেকে নতুন চাদর বের করে বিছানা গুছাতে নিলে তিহান বসা থেকে উঠে নিদ্রার কাছে গিয়ে একহাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” এত স্বাভাবিক কি করে আছ তুমি? রাগ হচ্ছে না আমার উপর? গালাগাল করতে ইচ্ছে করছে না তোমার? কি হলো চুপ করে আছ কেন? কথা বলো, আমায় বকো,মারো, যা খুশি করো। তবুও স্বাভাবিক থাকার অভিনয় টুকু করো না। ”
” মানুষ যখন পশুর রূপ ধারণ করে ফেলে তাকে বলার কিছু থাকে না। আপনার আর একটি পশুর মাঝে এই মুহুর্তে আমি কোনো ফারাক খুঁজে পাচ্ছি না। তাই রাগ, অভিমান যাই করি না কেন পুরোটাই নিজের জন্য ক্ষতি। শরীরে ঠিক ততটুকু এনার্জি অবশিষ্ট নেই বা আপনি রাখেননি যেটা দিয়ে আমি আপনার সাথে কথা যুদ্ধে নামব। আর মানুষও ভালো চোখে দেখবে না। আপনি যে আমার স্বামী। আর স্বামীদের এসব অধিকার। স্বামীরা যেকোনো সময় যতক্ষণ ইচ্ছে তার অধিকার ফলাতে পারে। হোক ধর্ষকদের মত আচরণ। তবুও স্বামী তো। এখানে স্ত্রীদের আর্তচিৎকারের কোনো প্রাধান্য নেই। সমাজও সেই চিৎকারকে প্রাধান্য দিবে না। তাহলে কেন আপনার উপর রাগ মিটাতে যাবো বলতে পারেন? ”
তিহান কিছুই বলতে পারলো না। তার যে মুখ নেই কিছু বলার। তাই নিদ্রার হাত ছেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তিহানের থেকে মুখ ফিরিয়ে বিছানার চাদর বিছিয়ে ঠিক করতে করতে নিদ্রা বলল,
” নিচে সবাই হয়তো নানান কথা বলছে। গোসল করে নিচে গিয়ে আমায় সেই কথাগুলো থেকে মুক্তি দিন। ”
তিহান কিছু না বলে কেবল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে।
.
দিনটি কোনোমতে মিথ্যে হাসির অভিনয়ে পার করে কেবলই ঘরের দরজা বন্ধ করে বড় একটা নিঃশ্বাস নিল নিদ্রা। চোখ তুলে তাকালো একবার বিছানার দিকে। তিহান অপরাধীর ন্যায় বিছানার এক কোণে শুয়ে কপালে হাত রেখে চোখ বুজে আছে। তিহানকে দেখামাত্র নিদ্রার ঘরে থাকার ইচ্ছেটাই মরে গেল। তাই ঘর পেরিয়ে বেলকনির ইজি চেয়ারে বসল। আজ চাঁদ কেও দেখতে ইচ্ছে করছে না নিদ্রার। সবকিছুই যেন অসহ্য লাগছে তার।
এদিকে তিহান যতই ভাবছে সকালের কথা ভাববে না, সেই কথাগুলো যেন তাকে আরও ঘিরে ধরে। ভেতরটা পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। অপরাধ বোধেরা যেন তার ভেতর কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। শুয়ে থাকতে পারছে না সে, ভেতরের অস্থিরতা যে গভীর হতে হতে সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছে গিয়েছে। শোয়া থেকে উঠে ঘরের মাঝে পায়চারী করতে লাগল তিহান। আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পারছে নিদ্রা বেলকনির ইজিচেয়ারে বসে আছে। তিহানের ইচ্ছে হলেও সাহসে কুলাচ্ছে না বেলকনিতে গিয়ে নিদ্রার সামনে দাঁড়াবার। তারপরও বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে একপর্যায়ে তিহান চলেই গেল বেলকনিতে। নিদ্রার বরাবর মুখ করে বেলকনির গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো তিহান।
এদিকে নিদ্রার মন খারাপ থাকলেও বিষাক্ত ছিল না,যেটা তিহানকে দেখা মাত্রই হয়েছে। নিদ্রা বসা থেকে উঠে চলে যেতে নিলে তিহান পেছন থেকে ধরে ফেলল। বলল,
” আমি কি এতটাই জঘন্য হয়ে গেলাম যে, আমি বেলকনিতে এসেছি বলে তোমাকে চলে যেতে হবে? ”
” এক ছাদের নিচেই যখন থাকতে হচ্ছে বেলকনি আর কি! তবে আমার ভালো লাগছে না বসে থাকতে তাই ঘুমোতে যাচ্ছি। ”
” এতক্ষণ তো ঘুম ধরেনি। যেই আসলাম অমনি ঘুম ধরে গেল? ”
” ঘুম আসার কি আদৌ টাইম টেবল আছে?যেকোনো সময়ই তো আসতে পারে। ”
” হুম। ”
” এবার আমি যাই তবে! ”
” আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না নিদ্রা? আমি না’হয় ভুল করেই ফেলেছি, তার জন্য কি ক্ষমা নেই? আর ক্ষমা না থাকুক শাস্তি তো অবশ্যই আছে। শাস্তিই না’হয় দাও তারপরও এভাবে থেকো না। ”
তিহানের কাছে এসে কলার শক্ত করে চেপে নিদ্রা বলল,
” আপনি জানেন, আপনাকে আমি ঘৃণা করি। হ্যাঁ, ঘৃণা করি। আপনার কাছে যাওয়ার জন্য কী না করেছি বলতে পারেন? আপনার মনে নিজেকে স্ত্রী হিসেবে পরিচিত করার জন্য কত কিছু করেছি। আপনি ভালোবাসেন না জেনেও নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছি। আপনি হয়তো ভাবছেন সকালের ঘটনার জন্য আমি এরকম করছি। কিন্তু না, সকালের ঘটনার জন্য আমি এরকম করছি না। তার কারণ আমার এই দেহ আপনার নামে অনেক আগেই দলিল করে দিয়েছি। সকালে যখন ঘুমের মাঝে আপনি আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন মন থেকে বলছি খুব খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার বুঝি আমার জীবনের গতি হবে। এবার বুঝি নিজের সংসার, নিজের স্বামীকে পরিপূর্ণ ভাবে পাবো। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল করে দিল আপনার সেই রক্তিম চোখ। আপনার সেই শক্ত দুটো হাত। আপনার সেই ধর্ষকদের মত আচরণ। আর বুঝিয়ে দিল এ মিলন স্বামী-স্ত্রীর মিলন নয়, এ মিলন একজন ধর্ষক ও একজন ধর্ষিতার মিলন। যে মিলনে নেই কোনো মায়া-দয়া নেই কোনো স্নেহ-ভালোবাসা। কেবল রয়েছে না পাওয়া বাসনার জ্বালা মেটানোর প্রবল ইচ্ছা। তারপরও বলছেন ক্ষমা করে দিতে? আপনি জানেন, যদি আমি আপনার ছোঁয়ার মাঝে একচুল পরিমাণ ভালোবাসা খুঁজে পেতাম বাকি সবটুকু ভুলে যেতাম। কিন্তু আমি যে সেই চুল পরিমাণ ভালোবাসা পাইনি, শুধু পেয়েছি ক্ষোভ। তাহলে কি করে, কীভাবে সবকিছু ভুলে ক্ষমা করব? ”
তিহান কিছুই বলতে পারল না। এমনকি নিদ্রার চোখের দিকেও তাকালো না। মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তিহানের কোনো উত্তর শুনতে না পেয়ে নিদ্রা আর দাঁড়ালো না। সোজা রুমের ভেতর চলে গেল।
.
মাঝে কেটে গেল একটি মাস। এ একমাসে কারো জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও তিহান নিদ্রার মাঝকার সম্পর্কে এসেছে আমূল পরিবর্তন। প্রয়োজনেও আজকাল কেউ কারো সাথে কথা বলে না। একদিক দিয়ে রয়েছে নিদ্রার রাগ, অভিমান, ক্ষোভ অন্যদিকে তিহানের অপরাধবোধ। এসব কিছুর জন্যই যেন পরিবর্তনটা খুব সহজ এসেছে। এই অপরাধবোধের তাড়নায় আজকাল তিহান ঘরে কম থাকে আর অফিসে বেশি। এমনও দিন যায় তিহান ঘরেই ফিরে না। নিদ্রাকে দেখলেই যে অনুশোচনায় ভুগতে হয় তাকে। যার জন্য ঘরে থাকার সময়টাতে দম নেয়াটাও আজকাল কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে তার জন্য।
.
রাত ৩ টা। মাঝরাত হলেও তিহানের চোখে ঘুম নেই। তবে এ কোনো নতুন কিছু না। সেরাতের পর থেকে প্রায় রাতই তিহান জেগে জেগে বেলকনিতে বসে রাত পার করে। আর হিসাব কষে অনেক অংকের। যেমনটা এই মুহূর্তে করছে। মনে মনে ভাবছে,
” এ দূর্বিষহ জীবনের অন্ত কোথায়! কোথায় মিলবে সুখের ঠিকানা! কোথায় মিলবে শান্তির নিঃশ্বাস! না-কি…. তার জীবনে সুখ নামক বস্তুটিই নেই, হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে! হয়তো তাই হবে। নাহলে এতগুলো বছরে সে ঠিকই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারতো। যেমনটা তানহা পেরেছে। আচ্ছা, সে যদি না-ই ফিরে পাবে স্বাভাবিক জীবন তাহলে কেন অন্য একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে! কেন নিজের জেদের কাছে জিততে গিয়ে বাচ্চা মেয়েটির জীবন ভরিয়ে দিয়েছে কালো ধোঁয়ায়! ”
ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো তিহান। তবে পরক্ষণেই মনে মনে বলল,
” আমি যখন নিদ্রার সুন্দর জীবন তান্ডবে পরিণত করেছি, তাহলে আমাকেই সেই জীবন সুখময় করে তুলতে হবে। ”
চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে একটি খাতা আর একটি কলম নিয়ে বেলকনিতে ফিরে এলো। বেলকনির দরজা বাহির দিয়ে লাগিয়ে আলো জ্বালিয়ে বসল চেয়ারে। হাঁটুর উপর খাতাটি রেখে লিখতে আরম্ভ করল তিহান। পৃষ্ঠা ভরে যেতেই কলমের কেপ লাগিয়ে ফিরে গেল ঘরে।
টেবিলের উপর খাতাটি রেখে এগিয়ে গেল নিদ্রার কাছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো নিদ্রার নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখটির দিকে। তবে বেশিক্ষন স্থির রাখল না সেই দৃষ্টি। মুখ ফিরিয়ে টেবিল থেকে মানিব্যাগ আর মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে, একটি শপিং ব্যাগে কিছু সংখ্যক বই নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
.
হঠাৎই এক চাপা কান্নায় ঘুম ভেঙে গেল অতলের। লাফিয়ে উঠে পাশে তাকাতেই দেখে তানহা তলপেটে হাত রেখে মুখ চেপে কাঁদছে। তানহাকে জড়িয়ে ধরে অতল বলল,
” তানহা! কি হয়েছে তোমার? ব্যাথা করছে? ”
অতলের হাত ঝাপটে ধরে চোখমুখ কুচকে তানহা বলল,
” মা…মা’কে ডাকো। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ”
” কেমন লাগছে আমাকে বলো। ”
” মা…. ”
ঘর থেকেই অতল মা বলে চিৎকার করতে লাগল। তবে বিশেষ কোনো লাভ হলো না। তাদের দরজা যে লাগানো, আর দরজা ভেদ করে তার চিৎকার বাহিরে যাওয়াটাও যে বড্ড কঠিন। তাই তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে অস্থির গলায় বলল,
” একটু কষ্ট করো প্লিজ। আমি এক্ষুনি মা’কে নিয়ে আসছি। আর এম্বুল্যান্সকেও ফোন করছি। একটু সময় দাও আমায়। ”
বলেই তানহার থেকে কোনোমতে হাত ছুটিয়ে অতল চলে গেল মরিয়ম বেগমের কাছে।
এদিকে তানহার যেন মরন যন্ত্রণা শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছুসময়ের মাঝে যে ব্যাথা এতটা গাঢ় হবে তানহা ভাবতে পারেনি। দম যেন চোখ দিয়ে বেড়িয়ে আসছে তার। সেই সাথে খিচুনি তো আছেই। তারপরও দুচোখ দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে দরজার চৌকাঠের দিকে।
মিনিট দুয়েকের মাঝে মরিয়ম বেগম’কে নিয়ে ফিরে এলো অতল। তানহার অবস্থা দেখে মরিয়ম বেগম অস্থির হয়ে গেল। তানহার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” ভয় পেয়েও না মা, অতল এম্বুল্যান্সকে ফোন করেছে এক্ষুনি তারা চলে আসবে। কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরো মা আমার। ”
অতল উত্তেজিত ভাবে মা’কে বলল,
” কিন্তু মা ওর তো কেবল নয় মাস। এখনো ডেলিভারি ডেট আসেনি তাহলে কীভাবে! ”
” অনেকেরই এরকম হয়ে থাকে এটা কোনো বিষয় না। এখন শুধু আল্লাহকে ডাক যেন সবকিছু ভালোভাবে হয়ে যায়।”
বলেই তানহার দিকে তাকাতেই মরিয়ম বেগমে’র গলা শুকিয়ে যায়। তানহার পা বেয়ে যে গড়গড় করে ব্লাড বের হয়ে বিছানা লেপ্টে যাচ্ছে। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
” অতল! তানহা! ”
” কি হয়েছে মা তানহার? কি হলো কথা বলছ না কেন….”
কথা বলার মাঝে মায়ের দৃষ্টি লক্ষ্য করে তানহার দিকে তাকাতেই অতলের মাথা ঘুরে গেল। বলল,
” মা! ”
” কথা বলার সময় নেই, দ্রুত মেঝেতে চাদর বিছিয়ে তানহাকে শুইয়ে দিয়ে বাহিরে চলে যা। আর হ্যাঁ, নিদ্রাকে দ্রুত পাঠিয়ে দেয় এখানে। ”
.
ধীরে ধীরে অবস্থা এতটাই হাতের নাগালের বাহিরে চলে যায় যে, এম্বুল্যান্স এলেও হসপিটালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তানহাকে। তবে যদি ইমার্জেন্সির কিছু হয় তার জন্য এম্বুল্যান্সকে দাঁড় করিয়ে কেবল নার্সকে ঘরে নিয়ে আসে অতল। একদিকে তানহার এ অবস্থা অন্যদিকে মাঝরাতে তিহানের উধাও হয়ে যাওয়া! দুটো মিলে যেন অতলের পাগলপ্রায় অবস্থা।
নিদ্রা গরম পানির জন্য ঘর ছেড়ে বেড়োতেই অতল বলল,
” নিদ্রা! ”
” হুম ভাইয়া। ”
” তানহা ঠিক আছে তো? ”
” আপনি চিন্তা করবেন না ভাইয়া। সবকিছু ভালো ভাবেই হবে ইনশাআল্লাহ।”
বলেই নিদ্রা চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।
তারপরও অতলের ভেতরকার অস্থিরতা যেন কমতেই চাইছে না। যতবার তানহার চিৎকার শুনতে পায় ততবারই যেন দম বন্ধ হয়ে আসে অতলের। ইচ্ছে হয় তানহার কষ্ট যদি সে ক্ষানিকটা হলেও ভাগ করে নিতে পারতো।
চোখের জল মুছে পায়চারী করতে লাগে দরজার সামনে দিয়ে। আর বোঝার চেষ্টা করে ভেতরকার অবস্থা।
” আহ্! আমি আর পারছি না মা। আমি আর পারছি না। ”
” একটু কষ্ট করো মা। সন্তানের জন্য যে মায়েদের এ কষ্ট করতে হয়। এটাই যে আল্লাহর বিধান। ”
” কিন্তু মা…..আহ্! ”
কড়া গলায় নার্স বলল,
” বাচ্চাকে কি মেরে ফেলবেন নাকি আপনি? দুনিয়াতে মনে হয় আপনি একাই মা হচ্ছেন! বারবার এককথা বলছি শুনতে পাচ্ছেন না? ”
” ওমা… আহ্..! ”
” আন্টি প্লিজ আপনার ছেলের বউকে বুঝান। এভাবে উল্টো শ্বাস নিলে কিন্তু বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে। একে তো ফুল বুকের উপর উঠে যাবে, তারউপর বাচ্চার জীবনেরও রিস্ক হয়ে যাবে। মোট কথা মা সন্তান দু’জনেরই জীবন শংকাজনক হয়ে উঠবে। ”
মরিয়ম বেগম বলল,
.
.
চলবে…..