#অন্তরালে_ভালবাসা
২২
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
অহিন আরিশা সাজেদা বেগমের সাথে উনার বাবার বাড়ি এসেছে।অহিনের নানুমনির খুব ইচ্ছে নাতি বউ দেখবে,তাই সাজেদা বেগম অহিন আরিশাকে নয়ে এসেছেন।অহিন প্রথমে আপত্তি করেছিলো কারণ ৫মাস পর যখন রাফিনের সাথে আরিশার বিয়ে হয়ে যাবে।তখন নানু বাড়ির সবাই কি ভাববে। তাই অহিন চায়নি আরিশাকে নিয়ে যেতে।তাছাড়া গ্রামের মানুষ অনেক রকম প্যাচানো কথা বলে।কিন্তু সাজেদা বেগম মায়ের কথার উপর কখনও কথা বলেন না।আর তার কথার উপর অহিন ও আর কিছু বলতে পারলো না।সবশেষে আসতেই হলো অহিনের নানুর গ্রামের বাড়িতে। তবে আসার সময় সাজেদা বেগম পইপই করে বলে দিয়েছেন, ৫মাস পর কি হবে সেটা যেনো অহিন বা আরিশা কেউই কাউকে কিছু না বলে এবং না বুঝতে দেয়।উনি বলেন পরে আমি সবাইকে জানিয়ে দিবো অহিনের সাথে বউয়ের বনিবনা হচ্ছে না তাই ডিভোর্স হয়ে গেছে।সত্যিটা জানলে গ্রামের মানুষ পাঁচটা কথা শুনাবে।এতে আরিশার সম্মান হানি হবে।সব শোনার পর অহিনের মনে হলো তার মা ঠিক বলছে।তাই আরিশাও আর দ্বিমত করেনি।
গ্রামের বাড়ি ঢুকতেই আরিশা দেখতে ফেলো অনেক দিনের পুরনো দোতলা বাড়ি। পুরনো হলেও বাড়ির মাঝে যে আভিজাত্যের চাপ আছে তা এখনও স্পষ্ট! গ্রামে সচরাচর এমন বাড়ি দেখা যায় না।মোঘল আমলের রাজবাড়ী যেমন ছিলো ঠিক তেমন। বাড়ির সামনের দিকে সবুজের সমারোহ, সুন্দর করে ফুলের বাগান।নানারকম ফুলের গাছে ভরে আছে চারপাশে। সন্ধ্যা হয়ে এলেও অনেক সুন্দর লাগছে বাড়িটার সামনের দিকটা।অহিন ব্যাগ হাতে সদর দরজায় ঢুকে। তার পেছনে আরিশা, সাজেদা বেগম একটু আগেই ঢুকে গেছে বাড়িতে। মুল ফটকে পা রাখতে যাবে এমন সময়, ধবধবে সাদা গায়ের রঙ, সাদা চুলে মেহদী দেয়া হয়েছে এমন একজন বয়স্ক মহিলা কঠিন গলায় বলে,দাঁড়াও আমার অনুমতি ছাড়া আমার গৃহে প্রবেশ করছো কত সাহস তোমাদের।কথাগুলো শেষ করেই পাশে দাড়ানো একজন মহিলার হাতের পাত্রে ফিক করে পানের ফিক ফেলেন।ভদ্রমহিলার চেহেরায় কেমন একটা আভিজাত্যের চাপ।বুড়ো বয়সেও হাতে সোনার চুড়ি, কানে দুল।আর আঁচলে রুপার চাবির রিং। দেখলেই কেমন একটা ভালো লাগা কাজ করে।আরিশা মনে মনে ভাবে এই মহিলা জোয়ানকালে নিশ্চয়ই ছেলেদের মাথা খারাপ করেছিলো।তার ভাবনায় ছেদ পড়ে কারো কথায়।
—ভদ্রমহিলা বলেন,এই মেয়ে নাম কি তোমার?
—অহিন বলে,নানুমনি ওর না,,,,আর বলতে পারলো না।উনি বললেন, তোমাকে যখন জিজ্ঞেস করবো তখন তুমি উত্তর দিবে।এখন যাকে জিজ্ঞেস করেছি সেই দিক।অহিন কিছুটা ভড়কে গেলো।
—আরিশা ভয় পাওয়া গলায় বলে,আমার নাম শাহলিজা নুর আরিশা।
—ভদ্রমহিলা আরিশার কাছাকাছি এসে তার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখ তুলে বলে,বউ তো মাশাল্লাহ সুন্দরী, আর লজ্জাবতীও। এতোক্ষনে রাগী রাগী মহিলার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে। আরিশার মনের ভয় কেটে যায়।
অহিনকে বলে কেমন আছো নানুভাই?
অহিন বলে,এতোক্ষন যে ভাব ধরে ছিলে নানুমনি আমিতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন একটু শান্তি লাগছে।উপ নানুমনি তুমি পারো ও বটে।অহিন নানুমনিকে জড়িয়ে ধরে।আরিশা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে একটু আগের রাগী চেহারার মহিলাটা এখন কেমন সুন্দর করে হাসছে। তার রূপের সৌন্দর্য যেনো আরও বেড়ে গেছে হাসির কারণে।
এমন সময় এক ঝাক কিশোরীর দল ছুটে আসে, এক গামলা পানিতে ফুলের পাপড়ি নিয়ে পানিতে হয়তো রঙ মেশানো তাই পানির রঙ গোলাপি। নানুমনি একপাশ হয়ে এদের জায়গা দেন সামনে আসতে।তারা এসেই আরিশাকে বলে, ভাবী পা দিবা নাকি মান দিবা?
আরিশা কিছু বুঝেনা,তাই সাজেদা বেগমের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর নিজের হাতের সোনার চুড়ি খুলে সেই পানির গামলায় রাখে।সবাই হো হো করে শব্দ করে।ভাবীর গুনগান শুরু করে।
সাজেদা বেগম আগেই সব বুঝিয়ে দিয়েছে আরিশাকে।এখানে আসলে মেয়েরা এমন কথা বললে,তাকে কিছু টাকা দিতে হয় বউকে আর সেটাই মান দেয়া।আরিশা চুড়ি দিয়ে দিয়েছে এটা পরে অহিন মেয়েদের টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিবে।
আরিশা বাড়ি প্রবেশ করে বুঝতে পারে যা ভেবেছিলো তার থেকেও বেশী সুন্দর এই বাড়িটা।অহিন আরিশার জন্য একটা রুম সাজানো হয়েছে সে রুমে তাদের নিয়ে যায় নানুমনি।রুমে ঢুকতেই রজনীগন্ধার ঘ্রাণে মোহনীয় হয়ে আছে চারপাশ এতো সুন্দর আর পরিপাটি সবটা দেখলেই প্রান জুড়িয়ে যায়।
নানুমনি বলেন,এটা তোমাদের রুম।ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর কথা হবে।ভদ্রমহিলা চলে গেলে আরিশাকে অহিন বলে,কেমন লাগলো আমার নানুর বাড়ি আরু?
—খুব ভালো অহিন।তোর নানু তো সেই সুন্দরী! যাকে বলে চোখ ধাধানো সুন্দর। এই মহিলা নির্ঘাত একশো পুরুষকে নির্ঘুম রাত উপহার দিয়েছে জোয়ান কালে।এখন এতো সুন্দর তখন যানি কেমন ছিলো।
—-এই তুই এভাবে বলছিস কেনো, তোর কি মনে হয় আমার নানু একশো পুরুষের সাথে প্রেম করছে?
—-আমি আবার এটা কখন বললাম?আমিতো শুধু প্রসংশা করেছি নানুর কতটা সুন্দর।
—তোর হিংসা হচ্ছে নাকি আরিশা?অহিন দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে।
—আমি যথেষ্ট সুন্দরী। অন্যকাউকে কেনো হিংসা করবো? সবাই আমাকে হিংসা করবে। ঠোঁট উল্টিয়ে আরিশা জবাব দেয়।আরিশা অহিন ঝগড়া শেষ করে খেয়ে সেদিনকার মত ঘুমিয়ে যায়।
সকালে তাদের জন্য একটা খেলার আয়োজন করা হয়।তা হচ্ছে,স্বামীরা সবাই তার স্ত্রীকে নিয়ে কাধে নিতে সাতার কাটবে। যে সবার আগে অপরপাশে যাবে স্ত্রীকে নিয়ে সে জিতবে। আরিশা প্রথমে রাজি হয়না। কারণ এমন খেলার নাম সে বাপের জন্মে শুনেনি।সাজেদা বেগমের কথায় আরিশা পানিতে নামতে বাধ্য হয়।অহিনের কাধেঁ উঠবে এটা ভাবতেই আরিশা লজ্জা পেয়ে যায়।
যথারীতি অহিনের কাধে উঠে আরিশা।অন্যদিকে সব স্ত্রী তাদের স্বামীর কাঁধে উঠে। আরিশার প্রথমে যে লজ্জা লেগেছিলো সেটা মুহুর্তে চলে গিয়ে এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করব মনে।অহিন আরিশাকে দুহাতে চেপে ধরে আছে।অহিনের স্পর্শ এই প্রথম আরিশার মনে দাগ কেটে যাচ্ছে।মনের অজানা এক ভালো লাগা কাজ করছে।রিমির কথাগুলো শোনার পর আরিশা নিজেকে বুঝার চেষ্টা করছে।আসলে সে কি ফিল করে অহিনের জন্য।এই ৫মাসে সে তা খুজে বের করবেই মনের গহীন থেকে।অহিন একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আরিশাকে নিয়ে।আরিশা অহিনের ঘাড়ে মুখ গুজে ফেলে, আরিশার ঠোঁটের স্পর্শে অহিনের সারা শরীরে এক অজানা ভালো লাগা কাজ করে।তার শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল নরম স্রোত বেয়ে নামে।মনে হচ্ছে সে এখানেই হেরে যাবে সামনে এগুতে পারবে না।
তখন আরিশাকে বলে,সুযোগ পেয়ে পানির মধ্যে আমাকে চুমু না খেলেই কি না?লুচু মেয়ে কোথাকার!
আরিশা অহিনের কথা শুনের একদম মুখ সোজা করে ফেলে।অহিন যে ইচ্ছে করে তাকে জ্বালানোর জন্য এসব বলছে সেটা বুঝতে আরিশার দেরি হয় না।
আরিশা মুখ তুলে তাকালে অহিন দ্রুত চলেতে থাকে। আরিশার এই মুহুর্তে চারপাশে কত মানুষ আছে তার খেয়াল ছুটে গেছে কোন এক অজানা চিন্তায় মশগুল হয়ে আছে সে।যার হদিস তার নিজের কাছেও নেই।সবার চিৎকারে আরিশার ভাবনায় ছেদ পড়ে।সবাই অহিন ভাইয়া জিতে গেছে, অহিন ভাইয়া জিতে গেছে বলে চিল্লাচ্ছে।
সাজেদা বেগম অহিন আরিশার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, তার পরিকল্পনা সত্যি হতে চলেছে, তিনি অহিন আরিশাকে এখানে এনে কিছু নিয়মের মধ্যে রেখে তাদের কাছাকাছি আনার চেষ্টা করছেন।তার মনে একটু আশা যদি শেষ মুহুর্তে এসে সব ঠিক হয়ে যায়?
আসলেই কি তা হবে?নাকি রাফিন আরিশার বিয়ে অনিবার্য? সেটা না হয় সময় বলবে”
#অন্তরালে_ভালবাসা
২৩
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
অহিন,আরিশাকে নিয়ে অহিনের কাজিনরা বের হয়েছে গ্রাম দেখাতে।গ্রামে সাজেদা বেগমের পরিবারের খুব নাম।তাই গ্রামের রাস্তা ধরে হাটতেই অনেক মানুষ আসছে অহিনের বউকে দেখতে।যদি নানুর বাড়িতে আর গ্রামে অহিন শাহরিয়ার নামে পরিচিত। এমনকি অহিনের নানুমনি ও তাকে শাহরিয়ার বলে ডাকে।অহিনের পুরো নাম আবরার শাহরিয়ার অহিন।তাই ছোটবেলা থেকে তার নানাভাই তাকে শাহরিয়ার নামে ডাকে।সেই থেকে সবাই এই নামেই চিনে অহিনকে এখানে।
গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাটছে অহিন,আরিশা আর অহিনের কয়েকজন কাজিন।এর মধ্যে একটা মেয়ে আছে নাম তিন্নি সে বারবার অহিনের দিকে তাকাচ্ছে।কাল এসে থেকে দেখছে আরিশা মেয়েটা অহিনের দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।আরিশার কেনো যেনো বিষয়টা হজম হচ্ছে না।অন্যের বরকে এভাবে দেখতে নেই সেটা কি জানেনা মেয়েটা! আরিশা কথাটা ভাবতেই তার মনে হয়,সে কি অহিনকে নিজের বর ভাবা শুরু করেছে! যদি তা না হয়,এমন ভাবনা তার মনে এলো কেনো?
অহিন খেয়াল করছে প্রথম থেকে,আরিশাকে আজকে নতুন বউয়ের মত লাগছে কারণ তার মাথায় গোমটা দেয়া।মায়াভরা মুখটার চোখের কোল জুড়ে কাজলের ছড়াছড়ি,বাঁশের মত চিকন নাকটা একটু লালছে হয়ে আছে।
লাভ শেইপ ঠোঁটে হালকা রঙের লিপিস্টিক দেয়া।পরনে নীল জামদানি শাড়ি। সব মিলিয়ে অপ্সরার মত লাগছে আরুকে।
কেমন একটা সুখ অনুভুতি হচ্ছে অহিনের আরিশাকে দেখলে।ফোলা ফোলা গাল দুটো কেমন আদুরে দেখাচ্ছে।ইচ্ছে করছে টেনে দিতে কিন্তু না তার ইচ্ছে তো কখনও পূরন হওয়ার নয়,তাই মনের গভীরে জন্মানোর আগে গলা টিপে মেরে ফেলে সেসব ইচ্ছেকে অহিন।
কাজিনদের থেকে একজন অহিনকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা ভাইয়া ভাবীর নাম কি?
“শাহলিজা নুর আরিশা” অহিন জবাব দেয় একটু হেসে।
মেয়েটি বলে,ওয়াও ভাইয়া, এতো কিউট নাম আর মিলেও গেছে তোমাদের দুজনের নাম।”শাহলিজা ওয়াইফ অব শাহরিয়ার”! কেয়া বাত ভাইয়া! খুব সুন্দর মিলে গেলো। তোমাদের একসাথে দেখতে যেমন ভালো লাগে, দুজনের নাম ও খুব ভালো লাগে,
“শাহরিয়ার +শাহলিজা,অহিন+আরিশা এটাকেই বোধহয় বলে বাম পাজরের হাড় দিয়ে তৈরি।
আরিশার মুখে লজ্জা ভর করেছে, মনের কোনে সুক্ষ্ণ একটা ভালো লাগা কাজ করছে কথাগুলো শুনে, এটাকেই বুঝি বলে, মন কেমনের অনুভূতি। তার মনে প্রানে এক অজানা অনুভূতি শিহরণ দিচ্ছে যার অস্তিত্ব একটু একটু টের পাচ্ছে।রিমির কথাগুলো শোনার পর থেকে আরিশা খুব চেষ্টা করছে নিজের অনুভূতির কাছে স্পষ্ট থাকতে।ভালবাসার কাছে পরিস্কার থাকতে।তাই হয়তো তার মনে অহিনের প্রতি কিছু একটা আছে সেটা সে আস্তে আস্তে টের পাচ্ছে। কিন্তু রাফিনের কথা মনে হতেই তার মনে বিষন্নতা নামে।
হাটতে হাটতে তাদের চোখে পড়ে একটা হলুদ শস্য ক্ষেত।সেই ক্ষেতে সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে আছে হলদে শস্য। এরকম দৃশ্য চেয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে,আরিশা অহিনের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,আমি শস্য ক্ষেতে যাবো অহিন,প্লিজ সবাইকে বল তুই?
অহিন বলে,শোনো সবাই এখন আমরা শস্য ক্ষেতে ফটো সেশন করবো। সো হারি আপ গাইজ!
অহিনের কথা শুনে সবার মনের ইচ্ছে লাই ফেলো।এখানে সবার ইচ্ছে করছিলো অহিনের গলায় ঝোলানো ক্যামেরায় নিজেদের আবদ্ধ করা,সেটা পূরন হবে শুনেই সে কি আনন্দ সবার শুধু তিন্নি ছাড়া, তিন্নি কেমন আনমনা হয়ে আছে।চুপচাপ মুখে হাসি নেই।
আরিশা ক্ষেতে নেমে যায় ননদদের সাথে, সবার সাথে অনেক গুলো ছবি তুলে সে,তারপর অহিন আরিশাকে বলে,আরু তুমি কিছু ফুল ছিড়ে নাও, তারপর আকাশের দিকে উড়িয়ে দাও, যখন সে ফুলগুলো তোমার গায়ের উপর পড়বে তখনই ছবি ক্লিক করবো। (অহিন, আরিশা গ্রামে এসে সবার সামনে একে অপরকে তুমি করে বলে,এটা সাজেদা বেগমের হুকুম)
আরিশা সেটাই করে,অহিন ছবিটার দিকে তাকিয়ে না চাইতেই তার মুখ থেকে বের হয়ে যা ওয়াও।সবাই অহিনের কথা শুনে হেসে দেয়।তিন্নি ছাড়া।
রাহি বলে,ভাইয়া তোমার বউ ওয়াও আমরা তো জানি,এখন দেখছি তুমি পাগল হয়ে গেছো ভাবীর প্রেমে।যেভাবে ওয়াও বলছো।তোমার মুখের এক্সপ্রেশনটা ও জাস্ট ওয়াও!আরিশার কানে কথাটা যেতে অহিনকে ভালো করে দুচোখে পরখ করে নিলো,গাঢ় নীল রঙের শার্টের স্লিভস কুনুই পর্যন্ত গুটানো।বুকের দিকের দুটো বোতাম খোলা এতে তার রোমশ সাদা বুকে কালো পশম গুলো স্পষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে আরিশার দিকে।শেভ করা মুখটায় হালকা খোচা খোচা দাড়িতে ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে অহিনকে।আর হেয়ার স্টাইলটা তো আরও বেশী সুন্দর, মডার্ন হেয়ার কাট দেয়া,কানের দুপাশে ছোট ছোট করে কাটা, আর কপাল বরাবর মাঝখানে বড় করে শেপ দেয়া,যা অহিনকে একটু বেশীই মানিয়েছে।অহিনের মুখে সেই ভুবন ভোলানো হাসি,যে হাসিতে চোখ হাসে,যে হাসিতে ঠোঁট হাসে,স্নিগ্ধ সেই হাসি!
আরিশার মনে হলো তার হাতে ক্যামেরা থাকলে সে এখন এই ভয়ংকর সুন্দর হাসিটা ক্যামেরায় বন্দী করে ফেলতো।
তোমার হাসিটা খুব সুন্দর অহিন ভাইয়া, আরিশা পেছনে তাকিয়ে দেখে তিন্নি অহিনকে উদ্দেশ্যে করে এই কথাটি বলছে,হঠাৎ অদ্ভুতভাবে আরিশা আবিষ্কার করলো তার মনে হিংসা হচ্ছে এই মেয়েকে নিয়ে,কেনো এই মেয়ে তার স্বামীকে সুন্দর বললো। হ্যাঁ এটা শতভাগ সত্যি যে অহিনের হাসিটা সত্যি অসম্ভব রকমের সুন্দর তাই বলে অন্য কেউ এটা কেনো বলবে,এটায় শুধু আমার হক।এসব ভাবতেই আরিশা বুঝতে পারে তার মাঝে অহিনের প্রতি অধিকারবোধ কাজ করছে।আরিশার কাছে এই মুহুর্তগুলো কেমন অগোছালো মনে হলো।
অহিনের পাশে আরিশা দাড়িয়ে অনেক গুলো ছবি তুলে, কাজিনদের জোরাজুরিতে।শস্য ক্ষেত থেকে গ্রামের চিকন রাস্তাগুলো দিয়ে তারা হেটে যাচ্ছে,বৈশাখ মাস এখন তাই চারদিকে কৃষক ধান কাটছে,একটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যে অহিন,আরিশার চোখ আটকে গেলো।একজন কৃষকের স্ত্রী তার জন্য মাঠে খাবার নিয়ে এসেছে একটা গামছায় পুটলি বেধে,কৃষানী গামছা খুলে খাবার বেড়ে দিচ্ছে,কৃষক মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে পাশে বসেছে,তার স্ত্রী শাড়ির আঁচল দিয়ে স্বামীর চোখে মুখের পানি মুছে দিচ্ছে,স্বামীর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে,এমন দৃশ্য এখনকার সময় এসে বিরল! খুব একটা দেখা যায় না,এমন দৃশ্য।তখন অহিন তার ক্যামেরায় বন্দী করে নিলো এই যুগলের সুন্দর এই মুহুর্তটাকে।অহিন আপসোসের গলায় বলে,ইশ!আমার বউ যদি আমাকে এভাবে খাইয়ে দেয় আমি তো নিজের জীবনকে স্বার্থক মনে করবো।
অহিনের কাজিন রাহি বলে,তুমি কি চাও ভাইয়া এমন কিছু?
অহিন,তার দিকে তাকিয়ে করুন গলায় বলে,চাইলেই বা কি!আমারতো এমন কপাল নেই।আরিশা অহিনের ড্রামা দেখে রেগে ফুলকো লুচি হয়ে যাচ্ছে,কি ঢং করতে পারে এই ছেলেটা, এমনভাবে বলে মনে হয় সত্যি সত্যি।আসলেতো সব নাটক করতেছে ভেবেই ঠোঁট উল্টায় আরিশা।
রাহি দৌড়ে সেই যুগলের কাছে গিয়ে কি যেনো বলে,তারপর অহিন, আরিশাকে পাশে একটা বাড়িতে নিয়ে যায়।বাড়িটিতে দুটি মাটির ঘর আছে,একটিতে নানা রঙ দয়ে নকশা করা। অন্যটি শুধু মাটির রঙের।আরিশা এই প্রথম মাটির ঘর বাস্তবে দেখলো। আগে টিভিতে দেখলেও সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি।আরিশা বলে ওহ!ওয়াও!এতো সুন্দর বাড়িটা।আমার খুব ভালো লাগছে।রাহি বলে, ভাবী সাহেবা একটু ঘরে চলো আরও ভালো লাগবে।আরিশাকে এক ঘরে, অহিনকে এক ঘরে নেয়া হলো। কিছুক্ষন পর আরিশা অহিন দুজন দুই ঘর থেকে বের হলো। দুজন মুখোমুখি, আরিশার শাড়িটা বাঙালি স্টাইলে পড়ানো যাকে বলে আটপৌর।অহিনের পরনে লুঙ্গি, একটা স্লিভলেস গেঞ্জি।মাথায় গামছা বাধা।দুজন দুজনকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। এবার বুঝতে পারলো কাজিনদের তাহলে এই প্লান ছিলো! আরিশার এভাবে লজ্জা লাগছে।
আরিশা রাহিকে বলে আপু আমার খুব লজ্জা লাগছে এভাবে শাড়ি পরে।রাহি জোরে বলে,’আরে ভাবী এভাবেই লজ্জা লাগছে,আমিতো আরও ভাবলাম তোমাকে গেন্ধা ফুল স্টাইলে জ্যাকলিনের মত শাড়ি পরাবো।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তোমার কোমরে বাটার ফ্লাই নাই।বলেই রাহি,ঠোঁট টিপে হাসে।
রাহির কথা শুনে সবাই হেসে উঠে। আরিশা আরও বেশী লজ্জা পায়।এই মেয়ে এমন বলবে জানলে কিছুই বলতো না সে।
দুজনকে ধানের মাঠে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই একই স্টাইলে আরিশাকে বলা হয় অহিনের মুখ মুছে দিতে,আরিশা লজ্জা রাঙা মুখে অহিনের মুখ মুছে দেয়,অহিনকে নিজে হাতে তুলে খাইয়ে দেয়।এমন মুহুর্তে আরিশার মনে হয় তার মনে ভালো লাগা লাজ করছে। একটু বিরক্ত ও হচ্ছে না সে।এবার সে তার মনের দুইয়ে দুইয়ে চার মিলানোর চেষ্টায় আছে।
অন্যদিকে অহিনের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে।আরিশা অহিনকে খাইয়ে দিচ্ছে এটাতো অবিশ্বাস্য কথা।তাও আরিশার মুখে লজ্জা ভর করেছে কোন সংকোচ নেই।লজ্জা রাঙা মুখে আরিশাকে চিরসবুজ বাঙালি বধূ মনে হচ্ছে।আজ অহিন মন থেকে কেনো যেনো ফিল করলো আরিশা অহিনের বউ।হ্যাঁ অহিনের বউ আরিশা!
কিন্তু হঠাৎ তার মনে পড়ে গেলো আর মাত্র ৪মাস ২৬দিন পর আরিশা রাফিনের হয়ে যাবে।রাফিন নাকি বিয়ের শপিং করে ফেলতেছে একটু একটু করে।কল করে জানিয়েছে অহিনকে।
অহিনের রোদেলা মনে একটু একটু করে মেঘ ভর করতে শুরু করেছে।সেই মেঘ অনেক গুলো দিন ধরে গুমোট হয়ে আছে এখনো পর্যন্ত বৃষ্টি হয়ে ঝরেনি শুধু এখন সেই অপেক্ষা।
অহিন, আরিশা সহ বাকিরা সারা গ্রাম ঘুরে দেখলো। চিরসবুজের গ্রাম্য পরিবেশ যেন মন কেড়ে নেয়।চারপাশে কত রকম সবজি করে রাখছে সবাই।সবাই আনন্দে আনন্দে হাটছে।কেউ কেউ এসে বলে আরে শাহরিয়ার যে কবে আইলে গ্রামে?আমাগো লগে দেখা করলা না।সাথে এটা কে?বউ নাকি?
আরে শাহরিয়ারের বউ তো মাশাল্লাহ। এতো সুন্দর বউ আমাগো দশ গ্রামে নাই।নজর না লাগুক।
এসব শুনত্র শুনতে আরিশা বারবার লজ্জা পেয়ে যায়।নারী তার প্রসংশা শুনলে লজ্জা পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আরিশার লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হয়ে যাওয়া দেখে অহিনের বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু করে দেয়।কারণ লজ্জা পেলে আরিশাকে আরও বেশী সুন্দর লাগে।মায়াবী লাগে।
এসব কিছুর মাঝে আরিশার মনে পড়ে যায় রাফিনের কথা,প্রথম ভালবাসাকে কি কোনভাবে অস্বীকার করা যায়?আর সে যদি অধিকার নিয়ে সামনে দাঁড়ায় তাহলে তো আরও যায় না।অল্প বিস্তর পাওয়া সুক্ষ্ণ কিছু ভালো লাগার মাঝেও বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয় রাফিনের জন্য।
“তার সুখের যে অসুখ করেছে” সে অসুখের কি কোন ওষুধ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পেরেছে কোন ডাক্তর কিংবা কোন গবেষক?আর বাকি জীবনে কি কেউ পারবে আবিষ্কার করতে?
কি জানি হয়তো পারবে! হয়তো না!
#অন্তরালে_ভালবাসা
২৪
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা_হঠাৎ_বৃষ্টি
অহিন,আরিশা সহ অন্য সবাই মিলেবাড়ি আসার সময়,একটা বাঁশের সাঁকো পড়ে,এখন সমস্যা হচ্ছে আরিশা সাঁকোর উপর দিয়ে হাটতে পারে না।উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে অহিন আরিশাকে কোলে তুলে নেয়।আরিশা পা নাচাতে শুরু করে,কারণ এটা গ্রাম এখানকার মানুষ এসব বিষয়কে স্বাভাবিকভাবে নেয় না।আরিশা বারবার বলে যাচ্ছে আমাকে নামিয়ে দাও অহিন।মানুষ কি বলবে।অহিন সামনের দিকে তাকিয়ে সাঁকোতে উঠে, আরিশা চোখ বন্ধ করে ফেলে।অহিন তার সেই ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে আরিশাকে নিয়ে এগিয়ে যায়।অহিনের কাজিনরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।কারণ গ্রামে সচরাচর এমন হয় না।এসব শুধু তারা মুভিতে দেখেছে।তিন্নি বলে মেয়েটা ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ মুখের অবস্থা দেখলে মনে হয় সে এখনই পারলে আরিশাকে তার চোখের আগুন দিয়ে ভষ্ম করে দিবে।
রাহি তিন্নিকে খেয়াল করে কুনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে বলে,চল তিন্নিপু।অহিন আরিশাকে কোলে নেয়ার দৃশ্য ক্যামেরা বন্ধী করে নেয় রাহি।অন্যদিকে গ্রামের উৎসুক জনতা ছবির শুটিং দেখার মত মহা উৎসাহ নিয়ে আরিশাকে অহিনের কোলে নেয়া দেখছে।
রাহি আরিশাকে বলে,’ভাবী তোমার অনেক ভাগ্য যে তুমি এতো ভালো একজন মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়েছো।ভাইয়া যেমন দেখতে, তেমন ব্যাবহার, তেমন রোমান্টিক। এমন স্বামীর স্বপ্নই তো প্রতিটি মেয়ে কিশোরী সময় থেকে দেখে আসে।কিন্তু ঠিক কজন মেয়ে এমন ভাগ্য করে পৃথিবীতে আসে? তাই ভালবাসাকে ভালবাসায় বেধে রেখো।
রাহির প্রতিটি কথা আরিশার মনে,প্রানে এক অদ্ভুত শিহরণ দিচ্ছিলো।তার মনের গোপন কোনে ভয়ংকর রকম সুখের বৈশাখি নেমেছে।যে সুখে পাওয়ার জন্য গর্ব হচ্ছে,আর প্রাপ্তির জন্য অহংকার! জীবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আরিশার মনের কোনে অহিনের জন্য যে ভালবাসার সৃষ্টি হয়েছে তা যেনো রাহির কথায় আরও বেশী মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
আরিশার মন হয়তো বুঝতে পারছে না,তার মন ক্রমশও অহিন নামক সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছে।যে সাগরে একবার পড়লে আর কেউ উঠতে পারেনা।চলতে হয় স্রোতের টানে।
সবাই বাড়িতে ঢুকলো,অনেকটা সময় ঘুরে সবাই ক্লান্ত, নানুমনি অহিন আরিশাকে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে রেস্ট নিতে বলছে।মাগরিবের নামাজের পর তাদের দুজনকে নানুমনির ঘরে আসার দাওয়াত জানালেন নানুমনি।অহিন আরিশা,সে দাওয়াত সাদরে গ্রহণ করে।অহিন ফ্রেশ হয়ে আসে পরনে টাওয়াল।আরিশা সবসময় অহিনকে গোসলের পরে আসলে আড়চোখে দেখে কারণ সরাসরি দেখলে এই অহিনটা যা তা বলে।তাই সরাসরি তাকাতে পারেনা। অহিন আয়নার সামনে গিয়ে খালি গায়ে বডি স্প্রে দিচ্ছে, আরিশার দিকে না তাকিয়েই বলে,আচ্ছা তুই সবসময় এভাবে আমাকে চুরি কপ্রে কেনো দেখিস?
না মানে!তুই যদি চাস আমি চোখ বন্ধ করে তোর সামনে বসে থাকবো। আর তুই আমাকে।অহিনের মুখে প্রানবন্ত হাসিটা লেগে আছে সেই হাসিতে দুষ্টুমি মিশে একেবারে রোমান্টিক হাসি হয়ে গেছে।
“হাসি ও রোমান্টিক হয়”?এসব ভাবতেই আরিশা আমতা আমতা করে বলে,সবসময় তোর বাজে কথা না বললেই নয়।নিজেকে কি ভাবিস তুই?ছাকিব খান?বলেই ঠোঁট উল্টায় আরিশা।
অহিন আরিশার দিকে এগুতে থাকে,আরিশা পেছাতে পেছাতে একদম এসে দেয়ালের সাথে লেগে যায়।অহিন ডান হাত আরিশার পেছনে দেয়ালে দিয়ে,অন্যহাতে আরিশার চোখ বন্ধ করে মুখটা তুলে বলে,আমি ছাকিব খান না,আমি আবরার শাহরিয়ার অহিন।যে কোন নায়ক নয়, আবার নায়কের চেয়ে কম ও নয়!
অহিন একদম কাছে আসাতে সদ্য করা স্প্রের ঘ্রাণে আরিশার কেমন দমবন্ধ হয়ে যাওয়া ভালো লাগছে।বুকের ভেতর ধুকপুকানিটা আরও অনেকগুন বেড়ে গেছে।মনে হচ্ছে অহিন এখন সামনে থেকে না গেলে সে এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে।অনেক কথা বলতে চাইলেও আরিশার মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের হলো না।অহিন চুপ থাকতে দেখে আরিশাকে ভেজা চুল ঝাকড়া দেয় আরিশার মুখে উপর। এতে যেনো আরিশার আরও বেশী দমবন্ধ হয়ে আসে।কারণ সদ্য করে আসা শ্যাম্পুর ঘ্রাণে আরিশার কেমন একটা ঘোর লেগে যাচ্ছে।তার উপর সামনে ফর্সা রোমশ বুক।যা ঘোর লাগার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আরিশা কোন প্রকার রোমান্টিকতা না করে,অহিনের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে, আর কামড় বসিয়ে দেয় অহিনের বুকে!অহিন পরম আবেশে চোখ বুজে,তাকে দেখে মনে হচ্ছে এটা কোন ব্যাথার অনুভূতি না।এটা আকাংখিত ভালবাসার অনুভূতি। যে স্পর্শের জন্য হাজার বছর অপেক্ষা করা যায়।এই মুহুর্তে অহিনের মনে হচ্ছে তপ্ত মরুর বুকে এক ফোটা শিশিরের সুখ অনুভব করলো!
এই সুখটাকে সারাজীবনের জন্য বুকের ভেতর লালন করতে পারে অহিন।যে ভালবাসাকে যতন করে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে সে!
আরিশা শুধু কামড় দিয়ে ক্ষান্ত হলো না।তার হাতের লম্বা স্কয়ার শেপের নখ গুলো বসিয়ে দিলো অহিনের বুকে।
তারপর অহিনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।অহিন ধাক্কার সাথে চোখ মেলে তাকায়, সে চোখে এমন কিছু একটা ছিলো যা কোন মেয়ে বুঝতে পারবে না।কারণ সারাজীবনের আকাংখিত নারীকে কাছে পেয়ে তার থেকে দূরে থাকার কষ্টটা শুধু একজন পুরুষই বুঝে।
অহিন আরিশার একদম কাছে গিয়ে আরিশার এক হাত ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়।তারপর আরিশার মুখের একদম কাছে নিজের মুখ নিয়ে যায়,আরিশার তখন প্রান বেড়িয়ে যাওয়ার অবস্থা, কিন্তু সে কোনভাবেই বাধা দিতে পারছে না।কিংবা সে বাধা দিতে চাইছেনা।
কিন্তু আরিশাকে অবাক করে দিয়ে অহিন কিছু একটা ভেবে আরিশার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়।তারপর আরিশার মুখ নিজের দুহাতে আজলা করে বলে, ‘তুই আমার স্ত্রী হয়েছিস ঠিক,কিন্তু প্রেমিকা না হয়ে বেঁচে গেছিস।নাহলে আমিও তোকে বুঝিয়ে দিতাম অহিন ঠিক কি!আমার শরীরের যত দাগ তুই দিয়েছিস তারচেয়ে হাজার গুন বেশী তোর শরীরে আমি দিতাম, যা তুই গুনে ও শেষ করতে পারতি না!তখন বুঝতি এই দাগের কি জ্বালা!
অহিনের কন্ঠে মাদকতা ছিলো স্পষ্ট যা আরিশার বুঝতে দেরি হলো না।এই প্রথম আরিশা অহিনের এমন কথা শুনে তার শিরদাঁড়া বেয়ে এক হীম শীতল নরম স্রোত নেমে গেলো।সারা শরীরের পশম দাড়িয়ে গেলো।অহিনের এমন রূপের সাথে আরিশা কোনকালেই পরিচিত ছিলো না!অহিনের এই কথাগুলো শুনে আরিশার মনে অহিনের প্রতি আরও বেশী ভালোলাগা কাজ করলো। কিন্তু বোকা আরিশা আজও বুঝলো না এই কথাগুলোর আসল মাহাত্ম্য কি ছিলো!
অহিন, আরিশা অহিনের নানুমনির ঘরে এসেছে অনেকক্ষণ। তিনি তাসবিহ পড়ছেন তাই হাতের ইশারায় তাদের বসত্র বললেন।আরিশাকে বসিয়ে দিয়ে অহিন বাইরে অপেক্ষা করলো।
নানুমনির ডাকে অহিন ভেতরে আসলো। নানুমনির সামনে দুজনকে বসতে বললো।খাটের উপর নারকেল তেল চিরুনী রাখা আছে।নানুমনি আরিশাকে নিজের সামনে বসিয়ে আরিশার লম্বা চুলের খোপাটা খুলে দিলো। বলেন, ‘চুলে তেল দাও না শাহলিজা?দাও আমি তেল লাগিয়ে দেই।আরিশা চুপচাপ বসে রইলো ভদ্রমহিলা চোখে চশমা দিয়ে আরিশার খোলা চুলে যত্ন করে তেল দিয়ে শুরু করলেন।অহিন মুগ্ধ হয়ে সে দৃশ্য দেখছে।আরিশার মা তাকে এমন তেল লাগিয়ে দিতো।তাই তার সেদিন গুলো মনে হয়ে চোখের কোনে জল নামলো।
নানুমনি বলেন, বুঝলে নাতবউ, আমার যখন বিয়ে হয় আমার বয়স ১১ এই বয়সে বিয়ে সম্পর্কে কি বুঝে একটা মেয়ে তুমিই ভালো বুঝো।লজ্জার কথা হলেও তখন আমি জোৎস্না বিয়ে দেখিনাই।
আরিশা বলে,’এটা আবার কি?না জেনেই প্রশ্ন করে সে।
নানুমনি বলেন তোমরা যেটারে মান্থলি সার্কেল বলো সেটা।আরিশা লজ্জা পেয়ে যায়।কিন্তু অহিন খুব স্বাভাবিক কারণ মেয়েদের এসব বিষয়ে বরাবরই শ্রদ্ধা করে।সে জানে এটা লজ্জা বা লুকানোর কিছু নয়।এটা এই প্রকৃতিরই অংশ।
নানুমনি বলেন, ‘চিন্তা করো আমি কতটা ছোট ছিলাম। তোমার নানা ভাইয়েত আমাকে সামলাতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে।এসব বিষয় গুলো তিনি আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন।কারণ আমি তেমন কিছুই বুঝতামনা। কিন্তু তিনি ধৈর্যের সাথে সবসময় আমার পাশে ছিলেন।হাতেখড়ি হয়ে বুঝিয়েছেন ভালবাসা কি?জীবনে এমন মানুষ খুব কম আছে যে তোমার কাছ থেকে ভালবাসা শিখে তোমাকেই ভালবাসবে!কারণ মানুষ অদ্ভুতভাবে যার কাছে ভালবাসা শিখে তাকে ভাল না বেসে অন্যকাউকে ভালবাসে।কিন্তু আমি তার কাছে ভালবাসা শিখে তাকেই ভালবেসেছি।আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন আমিতো ভালবাসাই বুঝতামনা, কিন্তু বিয়ের এমন এক শক্তি যা ঘৃনাকেও ভালবাসায় রুপান্তরিত করতে পারে।জীবনে বৈধতা শব্দটার অনেক জোর।যার মাধ্যমে মানুষ অসাধ্যকে সাধন করতে পারে।যখন দুজন মানুষ এই পবিত্র সম্পর্কে জড়ায় তখন আল্লাহর আরশ থেকে প্রেম মহব্বত নাজিল হয়।যা কোন মানব মানবী অস্বীকার করতে পারে না।
তোমরাও তার উর্ধ্বে নও।তোমাদের এতো গুলো কথা বলার কারণ একটাই তোমরা জীবনে অনেক কঠিন মুহুর্তের মধ্যে দিয়ে যাবে।কারণ বিয়ে মানে প্রেম, রোমাঞ্চ নয় শুধু, বিয়ে মানে অংশীদারিত্ব “বিয়ে মানে সুখের পাশাপাশি দুঃখের দায়ভার নেয়া।জীবনে সব প্রতিকুলতার মুহুর্তে দুজন দুজনের ডাল হয়ে দাড়ানো।
বিয়ে মানে শুধু আমি তুমি নই।বিয়ে মানে আমরা! যেখানে পরিবারে সব মানুষকে ভালবাসা।কারণ যারা আমি তুমি নিয়ে সংসার করে বাকি পরিবারের সদস্যদের ছাড়া তারাই বুঝবে না।আমরা নামক শব্দটায় কতটা সুখ লুকিয়ে থাকে।তাই আমার তোমাদের কাছে আদেশ নয় অনুরোধ তোমরা দুজন দুজনের পাশে সেই মুহুর্ত পর্যন্ত থাকবে।যে মুহুর্তে তোমরা যদি কেউ একজন মরেও যাও তারপর ও দুজনের প্রতি সম্মান, ভালবাসা শ্রদ্ধা একই থাকবে।এমন একটা পার্টনারশিপ তোমরা তৈরি করো যাতে অন্যরা তোমাদের দেখে আইডল ভাবতে পারে।ভালবাসা কি তোমাদের দেখে শিখতে পারে।
তোমার নানাভাই আমার কাছে নেই, কিন্তু প্রতিটি মুহুর্তে আমি তার অস্তিত্ব অনুভব করি।তার শরীরের গন্ধ পাই।তাকে চোখ বন্ধ করলে ছুতে পারি।এতোটাই ভালবাসি আমি তাকে।অথচ দেখো বিয়ের সময় আমি বুঝতামনাই না।ভালবাসা কি?স্বামী কি?আর সংসারই বা কি?
কিন্তু এখন এই সংসার আমার প্রান।তার দেয়া চার সন্তান আমার জীবন!তার দেয়া প্রতিটি স্পর্শ আমার কাছে নতুন!
এর চেয়ে বেশী জীবনে কি চাই?এটাইতো এক নারীর পূর্নতা!এটাইতো এক পুরুষের প্রাপ্তি!
এটাই তো পরিপূর্ণ দাম্পত্য!
আর আমি চাই তোমরা আমাদের চেয়ে আরও গভীর এক দাম্পত্য তৈরি করো।এমন এক পার্টনারশিপ যা দেখে আমরা তোমাদের নানা ভাইয়ে কাছে গিয়ে বলতে পারি আমাদেরকে তোমাদের ভালবাসা হারিয়ে দিয়েছে। আর বিশ্বাস করো তোমরা, এই হেরে যাওয়ায় আমাদের জয় হবে!এই হেরে যাওয়ায় সুখ হবে আমাদের!
আরিশা নানুমনিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। সে কান্নার অর্থ তার কাছে স্পষ্ট না হলেও কিছুটা সে বুঝতে পারে।আর অহিন অবাক হয়ে যায় আরিশার কান্না দেখে।কেনো কাঁদছে তার আরু?কেনো?
চলবে,,,,
চলবে,,,,