#অন্তরালে_ভালবাসা
৩৪
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
অহিন আরিশাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে,আজ সন্ধ্যার পর রাফিন আসবে তাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যাবে অহিন আরিশা।কালকের রাতটায় অহিন ঘুমায়নি,অবশ্যই আরিশাও ঘুমায়নি।ভোর রাতে চোখ লেগে এসেছে তার।আরিশা অহিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে শুয়ে ছিলো। অহিন ও জড়িয়ে ছিলো আরিশাকে,কে বলতে পারে আজকের পর তারা আর একসাথে থাকতে পারবে না। দুজনকে যেতে হবে এক অজানা দুনিয়ায়।তাই হয়তো এভাবে জড়িয়ে আছে,এমনভাবে জড়িয়ে আছে মনে হয় ছেড়ে দিলেই বুঝি হারিয়ে যাবে!দুজনের কেউ কোন কথা বলছে না।ব্যস চুপ করে আছে,দুজন দুজনকে অনুভব করছে,কিছু না বলেও মাঝে মাঝে আমরা যেনো সব কথা বলে ফেলি।চোখ দেখেই আমরা সব পড়ে ফেলি।অহিন আরিশার অবস্থা ও তাই।আরিশার পাগলামি গুলো অহিনকে একেবারে দুর্বল করে দিয়েছে।দুজন মানুষ একে অপরের নিশ্বাসের শব্দ শুনছে অনুভব ও করছে,মনের ভেতর যন্ত্রনা গুলো মন দিয়ে শুনছে,সবই ঠিক আছে কিন্তু তাদের আলাদা হয়ে যেতে হবে একেবারে আলাদা।জীবনটা এতো কষ্টের কেনো?
আরিশা আড়মোড়া ভেঙ্গে দেখে অহিন তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চেহারায় চাপা কষ্টের ছাপ স্পষ্ট! এতো গভীর দুচোখে আরিশাকে দেখছে সে। আরিশার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে, যন্ত্রনায় জীবন অতিষ্ঠ লাগে।এটা কেমন জীবন আর ভাল্লাগছে না এসব।আরিশা অহিনের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না করে,অহিন বলে,তুই কাঁদলে আমার কি হবে আরু?আমি নিজেকে কিভাবে সামলে নিবো?
আরিশা বলে, আমি চাই না এমন জীবন অহিন।চল আমরা কোথাও চলে যাই যেখানে কেউ আমাদের খুজে পাবে না।
—-অহিন একপেশে হেসে বলে,’তুই আসলেই পাগলি আরু!
—আমি কিছু বুঝিনা তুই আমাকে ছাড়তে পারবি না এটাই শেষ কথা।
—-পাগলামি করিস না আরু।রাফিনকে তোকে বিয়ে করতেই হবে।আমি কিছু জানতে চাই না আর।তুই যদি এমন করিস আমি তোর থেকে এতো দূরে যাবো যে আর খুজে পাবি না।মরেই যাবো আমি।
—–আরিশা হাতের পাতা দিয়ে অহিনের মুখ চেপে ধরে,আরিশা ভেজা গলায় বলে,এসব বাজে কথা বললে আমিই তোকে শেষ করে দিবো।তুই আস্তো একটা স্বার্থপর লোক।তুই শুধু অন্যের কথা ভাবিস আমার কথা কেনো ভাবিস না।
————অহিন চুপ করে থেকে বলে,আমি নিজের কথা ভাবি না আরু।আর আমি মনে করি আরু মানেই অহিন।তাই আরুর কথা ভাবার দরকার নেই।
—-আমি তাহলে অহিন বিহীন পৃথিবীতে কিভাবে বেঁচে থাকবো?অহিন বিহীন পৃথিবী কি ভিষণ যন্ত্রনার তা শুধু আমি জানি।আরিশা কাঁদছে খুব।অহিন কান্না থামাচ্ছে না।কাঁদতে দিচ্ছে।কাঁদুক কাঁদলে নিজেকে হালকা করতে পারবে।
—–এই এই অহিন প্লিজ আমি তোর পায়ে পড়ি, তুই আমাকে ছাড়িস না।আমাকে ডিভোর্স দিস না প্লিজ।প্লিজ অহিন।
—-অহিন আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,সব ঠিক হয়ে যাবে আরু।
—-কিচ্ছু ঠিক হবে না।তোর মহানুভবতা নিয়ে তুই থাক আমি রাফিনকে সব বলে দিবো।
——–না বলবি না তুই।
—–বলবো আমি।
——বললে তুই আমার মরা মুখ দেখবি।
—–আরিশার কান্নার গতি বেড়ে গেছে।এতো কঠিন কেনো তুই।এটা কি করে বলতে পারলি?আমি তোকে কতটা চাই তুই বুঝিস না।আরিশা খাট থেকে নেমে দাড়িয়ে আছে দেয়ালে সাথে।অহিন তুই কেনো বুঝতেছিস না আমি রাফিনকে মেনে নিতে পারবো না।
—–অহিন চিৎকার করে বলে,আমি তোকে কতটা চাই সে সম্পর্কে তোর কোন আইডিয়া আছে?ভালবাসার মানুষ সারাক্ষণ পাশে থাকে,আবেদন করে।তাকে এড়িয়ে যাওয়া কতটা কঠিন একজন ছেলের পক্ষে বুঝিস তুই?আরে তোকে তো আমি প্রতি ক্ষনে ক্ষনে চাই,নিশ্বাসে চাই।তারপর ও তোকে এড়িয়ে চলা কতটা যন্ত্রনা দেয় বুঝিস তুই?
জীবনে ভালবাসা এক অমুল্য সম্পদ যা পিতৃসম্পদ হিসেবে পাওয়া যায় না।অর্জন করে নিতে হয়।আর আমি তা অর্জন করে তারপর তা ছেড়ে দেয়া কতটা যন্ত্রনার বুঝিস তুই? আরিশাকে দেয়ালের সাথে লেপ্টে ধরে বলে,’এই তুই কি বুঝিস না আমি তোকে ছাড়া কতটা অসহায়! তুই কি বুঝিস রাতের পর রাত তোকে বুকে নিয়ে কত অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে রাত পার করেছি আমি।কখনও কখনও আমরা চাইলে ও অনেক কিছু করতে পারি না আরু।পারি না করতে।অহিন মেঝেতে বসে অঝোরে কাঁদে এতো যন্ত্রনা আর নিতে পারছে না সে।বাচ্চাদের মত কাঁদতে দেখে আরিশা ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।আরিশা হাটুগেড়ে বসে কান্না করতে থাকে।অহিন দুহাতে আরিশাকে জড়িয়ে নেয়।দুজনে একসাথে বসে কাঁদছে।খুব।
খেতে বসে অহিন আরিশাকে খাইয়ে দেয়,যদিও কারোই খেতে ইচ্ছে করছে না।তারপরও দুজন দুজনকে খাইয়ে দিচ্ছে হয়তো এই সুযোগটা আর পাবে না কেউই।অবশ্যই ভাতের চেয়ে বেশী চোখের জল পড়ছে।
বিকেলে অহিন আরিশাকে বুকে নিয়ে শুয়ে ছিলো অনেক্ষণ কিন্তু কেউ কাউকে কিছুই বললো না।যখন নিরবতা কথা বলে, “তখন মুখের বাক্যের কি প্রয়োজন?
সন্ধ্যা হলে আরিশা প্রতিদিনের মত চা করে নিয়ে আসে।দুজনে বারান্দায় বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে চা খায়।তারপর আরিশা বলে অহিন তুই আমার দিকে তাকিয়ে বসে থাক কিছুক্ষণ, আমি তোকে দেখি।একটুপর তো বেরিয়ে যেতে হবে।অহিন তাই করে কিন্তু বেশীক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারে না।অহিন উঠে চলে যায় রুমে।আরিশা পেছনে এসে জড়িয়ে ধরে অহিনকে পিঠের উপর শুয়ে পড়ে।অহিনের ভেতরটায় তখন মনে হচ্ছে কেটে কেটে লবণ লাগিয়ে দিয়েছে।অহিন পেছন ফিরে আরিশাকে পাগলের মত আদর করে।এই প্রথম আরিশা অহিনকে উন্মাদ মনে হয়।ভালবাসার উন্মাদ! আরিশাও অহিনকে শক্ত করে ধরে অহিনের ভালবাসায় সাড়া দেয়।
কিছু মুহূর্ত পর অহিন আরিশাকে বলে,তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় এয়ারপোর্ট যেতে হবে।
আরিশা তৈরি হয়ে যায়।দুজনে বেরিয়ে পড়ে।সম্পুর্ণ পথ আরিশা অহিনের কাঁধে মাথা রেখে যায়।
———————————————————————————–
রাফিন এই মুহুর্তে দাড়িয়ে আছে বন্ধুদের সামনে এসেই অহিনকে জড়িয়ে ধরে কত দিন পর দেখা।আরিশাকে অবশ্যই জড়িয়ে ধরে না।হ্যান্ডশেক করে।
অনেকদিন পর আসায় রাফিন বন্ধুদের সাথে মেতে ওঠে। অবশ্যই অহিন আরিশার খুব মন খারাপ তাও অহিন চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার।কিন্তু আরিশা একদম স্বাভাবিক থাকতে পারে না।তার চোখে বারবার জল ভরে আসছে।অহিনকে সে ছাড়তে পারবে না।অনহিনের রাফিনকে দেখে কেমন যেনো লাগছে আগে থেকে রোগা হয়ে গেছে।হয়তো অফিসের কাজের বেশী চাপ ছিলো।
——-কিরে আরিশা তুই এমন চুপচাপ কেনো? মনে হচ্ছে আমি আসায় তুই একদম খুশী হলি না।আমি কি এসে ভুল।করে ফেললাম? রাফিন কেমন গম্ভীর মুখে বলে।অহিন আরিশা একটু ঘাবড়ে যায়।রাফিন কি কিছু জেনে ফেললো?অহিন চিন্তায় পড়ে যায়,কিন্তু আরিশা মনে মনে ভাবছে জেনে গেলেই ভালো। তাহলে আর তাকে কষ্ট করে কিছু বলতে হবে না।
——-রাফিন অহিন আরিশার দিকে গভীরভাবে দেখে তারপর শরীর দুলিয়ে হাসে।আরে তোরা এতো সিরিয়াস হয়েছিস কবে থেকে।এই সামান্য কথায় কেমন গম্ভীর হয়ে গেলি?আমি শুধু মজা করে বলছি ইয়ার।
অহিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আরিশার ভালো লাগছে না এখানে।কিন্তু এটা অস্বীকার করতে পারছে না রাফিনের সাথে তার একটা সম্পর্ক ছিলো তাই তার দায় আছে বৈকি!রাফিনকে কষ্ট দিতে ও মন চাইছে না।তাও নিজেদের ভালবাসার জয় করতে তাকে কষ্ট দিতে হবেই।
রাফিন আরিশার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,’আরু কেমন আছিস তুই?রাফিনের গলায় আবেগ ভরা!
—–আরিশা তাড়াহুড়ো করে হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, ভালো আছি।তুই?
——–আরিশার এমন হাত সরিয়ে নেয়া দেখে অহিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে,কিরে রাফিনকে কি লজ্জা পাচ্ছিস?
—-আরিশা অগ্নি চোখে অহিনের দিকে তাকিয়ে আছে।ভাবছে এখানে দাড়িয়ে নিজের বউয়ের হাত অন্যজন ধরছে আর তিনি খুব মজা পাচ্ছেন! অসহ্য দয়ালু একটা।
অথচ আরিশা ঠিক জানে অহিনের কতটা কষ্ট হচ্ছে।
অহিন বলে,তুই কোথায় যাবি আগে?
—–তোদের বাসায় যাবো, আন্টির সাথে দেখা করে তারপর বাসায় যাবো।সে অনুযায়ী তারা রওনা দেয়।
কিছুক্ষণের মাঝে বাসায় এসে যায়।সাজেদা বেগম তিনজনকে একসাথে দেখে খুব খুশী হন।রাফিন গিয়ে সাজেদা বেগমকে সালাম করে,আরিশাও করে।তাদের দেখাদেখি অহিন বলে আমি কেনো বাদ যাবো। সবাই হাসে, সাজেদা বেগম তিনজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে।অনেকদিন পর তার বুকটা জুড়িয়ে যায়।খাওয়া শেষ করে একসাথে। রাফিন চলে যাবে বলে।সাজেদা বেগম আর অহিন বলে থেকে যেতে।রাফিন একবার আরিশার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দেয়।
না আন্টি আমি আজকে যাই।এসেই এখানে চলে এসেছি বাবা আর রামিসা অপেক্ষা করছে।তাছাড়া কাল তো ডিভোর্স প্যাপার নিয়ে সিহাব আসবে। তাই এখন চলে যাই সকালে আসবো।আর আরিশা তুই এখন আর ওই বাসায় যাস না।এখানে থেকে যা।দুই একদিনের মাঝে যেহেতু বিয়ে তাই আর না গেলেই হবে। একেবারে বউ হয়ে যাবি বলেই হাসে রাফিন।
সবাই মিলে রাফিনকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে।সাজেদা বেগম ঘরে চলে যান,অহিন আরিশাকে তাদের ঘরে যেতে বলে।অহিন তার ঘরে যায়,আরিশা অন্য একটি ঘরে যায়।
কিন্তু বেশীক্ষন কেউই আলাদা থাকতে পারলো না।অহিন আরিশার ঘরে আসে খালি গায়ে। দেখতে আসে আরিশা ঘুমিয়েছে কি না।এসে দেখে আরিশা ঘুমিয়ে আছে।অহিন কাঁথা টেনে আরিশার গায়ে দেয়। চলে আসতে নিলে হঠাৎ কিছু একটা টেনে বিছানায় ফেলে দেয়।অহিনের ব্জখার বাকি থাকে না এটা কে!
আরিশা অহিনে শুইয়ে দিয়ে নিজের ভার ছেড়ে দেয় অহিনের উপর। অহিন বলে।পাগলামি না আরু।আমি খালি গায়ে এসেছি।শার্ট পরে আসি।আমাকে যেতে দেয়।আরিশা বলে,না একদম না।আমি তোকে যেতে দিবো না।গেলে তুই আর আসবি না।
—আরে একটা কিছু গায়ে দিয়ে আসতে তো দিবি?
—–না আমি তোকে আমার একটা টি শার্ট দিচ্ছি।
—অহিন হাসতে থাকে এ কথা শুনে।
—এই হাসছিস ক্যান?
—–তোর গেঞ্জি আমারে হবে?আমার সাইজ আর তোর সাইজ কি এক যে হবে?
—-সাইজ ডাজ নট ম্যাটার মাই ডিয়ার হাজবেন্ডস! বলেই চোখ মেরে দুষ্ট হাসি দেয় আরিশা।
—–অহিন আরিশার ইঙ্গিত ঠিকই বুঝে।আরিশার মুখ দুহাতে ধরে একদম নিজের মুখের কাছে নিয়ে নাকের সাথে নাক ঘষে কিছুক্ষণ। এই সুযোগে আরিশা অহিনের নাকে কামড়ে দেয়।অহিন তাজ্জব বনে যায়।উফ এই মেয়ে এতো অস্থির কেনো?
অহিন আরিশাকে নিজের নিচে ফেলে চুলে মুখ গুজে দেয়।আরিশার কপালে ঠোঁট চুইয়ে দেয়।তারা একে অন্যেকে কথা দিয়েছে, এই কয়েকটি ঘন্টা তারা মন খারাপ করে থাকবে না।বরং যে সময়টুকু হাতে আছে তাই উপভোগ করবে।আমাদের হাতে সময় কম থাকলে আমরা কেনো সময় নেই বলে বলে দুঃখ করতে করতে বাকি সময়টুকু ও শেষ করে দেই। কিন্তু ভুলে যাই যা হাতে নেই তার জন্য আফসোস না করে,যা আছে তা যদি উপভোগ করি তাহলে মন্দ হয় না।অথচ আমরা জীবনকে ভোগ করতে ব্যস্ত বলেই, কি পাইনি তা নিয়ে পড়ে থাকি। অহিন আরিশা কাছ থেকে উঠে চলে যেতে চাইলে।আরিশা আবার আটকায় অহিনকে,আরিশা দরজা বন্ধ করে এসে,নিজের একটা গেঞ্জি সুটকেস থেকে বের এনে দেয় অহিনকে।অহিন সেটা মুখের সামনে নিয়ে অভিজ্ঞতার সাথে দেখে।আরিশা বলে,আরে চিন্তা করো না এটা হবে কারণ এটা আমার সাইজ থেকে আরও বড়। এটা ভুল করে বড় নিয়ে এসেছি।এখন মনে হচ্ছে ভুলটা করে ভালোই করেছি।কারণ কাজে লেগে গেছে।
অহিন আরিশার দিকে তাকিয়ে বলে তোর গেঞ্জি দেখি পড়ে কেমন হয়।অহিন যেই গেঞ্জিটা পরার জন্য মাথা দিয়ে নামাচ্ছে ঠিক তখন আরিশা এসে সেই গেঞ্জির ভেতর ঢুকে গেছে।এক গেঞ্জিতে দুজন। একসাথে একে অপরের সাথে লেপ্টে আছে।অহিন চোখ টিপে বলে,ভাগ্যিস তুই আমার গেঞ্জিতে ঢুকেছিস, আমি তোর গেঞ্জিতে ঢুকিনি।নয়তো অনর্থ হয়ে যেতো!আরিশা অহিনের কথা বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল, নীল,বেগুনী হয়ে যায়।অহিনের বুকে কয়েকটা কিল মারে।অহিন বলে,
“যদি হও সুজন ” এক গেঞ্জিতে দুজন “!
আরিশা হাসতেই হাসতে অহিনের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে শক্ত করে ধরে অহিনকে।অহিনও হাসে সেই ভুবন ভোলানো হাসি” যে হাসিতে চোখ হাসে! যে হাসিতে ঠোঁট হাসে”পাগল করা সেই হাসি”স্নিগ্ধ সেই হাসি!”আরিশা বলে,এতো অস্থির কেনো তোর হাসি!যে হাসি আমাকে স্থির থাকতে দেয় না!
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে দুজনের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক, আর চোখে মুক্তদানার মত জল চিকচিক করছে।এই জল কিসের! যন্ত্রনার না সুখের!পাওয়ার না হারিয়ে ফেলার!
ভালবাসার না বিচ্ছেদের!
#অন্তরালে_ভালবাসা
৩৫
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা
রাফিন সিহাবকে নিয়ে আসে সকালে,অহিন আরিশা সাজেদা বেগম বসে আছে ড্রয়িং রুমে। অহিন আরিশার রাফিনকে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। আজ কি তবে সে দুজন দুজনকে হারানোর সময় চলে এলো? ভালবাসা আলাদা হয়ে যাবে তাহলে?এসব ভাবতেই দেখলো রাফিন গভীর দুচোখে অহিন আরিশাকে দেখছে। বসে লম্বা দম নিয়ে
সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাফিন জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যিটা বলে,’ আমি জানি অহিন আমি তোর মা সাজেদা বেগমের অবৈধ সন্তান।আমি জানি আমি আমার বাবা মায়ের ঔরসজাত সন্তান না,তারা শুধু আমাকে লালন পালন করেছে।আমি জানি তুই মায়ের দত্তক নেয়া সন্তান। আমি জানি আরিশা তোকে ভালবাসে।আমি সব জানি অহিন সব জানি।
আমি জানি অহিন তুই আরুকে ভালবাসিস আর এটাও জানি তোকে আরু ভালবাসে,ভালবাসা কোন অপরাধ নয় যে চাইলে তোকে শাস্তি দিবো।আসলে ভালবাসা হচ্ছে মনের ব্যাপার যার জন্য এটা বরাদ্দ তার হবেই, আর যার জন্য নেই তার জন্য কিছুই হবে না।আর এটাও ঠিক প্রেম আর ভালবাসা এক না!”প্রেম ভালবাসার একটি রূপ মাত্র’, কিন্তু ভালবাসা সতন্ত্র!
“প্রেমের ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ ও সংকীর্ণ”, ”আর ভালবাসার ক্ষেত্র ব্যাপক ও সার্বজনীন! ”
তাই আরিশার মনে আমার জন্য যে প্রেম ছিলো তা বিলীন হয়ে গেছে,এখন আছে শুধু তোর জন্য অবাধ ভালবাসা।তাই আমি চাই না এই ভালবাসা। যে ভালবাসায় অধিকার থাকবে তোর আর মালিকানা থাকবে আমার “! এমন ভালবাসা দিয়ে কি হবে অহিন?ছোট বেলা থেকে তোর ভাগ্য সহায় ছিলো বলে তুই সব পেয়েছিস,আর আমি সব পেয়েও হারিয়েছি।এতে তোর কোন দোষ নেই,এতে দোষ আমার ভাগ্যের। জীবন কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় সেটা কেউ জানে না।আমাদের সবার জন্মের পূর্বে ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়ে যায়,তাই সে ভাগ্যকে অস্বীকার করবে কার সাধ্য!
অহিন জীবনের এই নির্মম সত্যিটা আমি জেনেছি আমার সাথে আরিশার বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার পর ,আমি তখন পুরোপুরি ভেঙে পড়ি,আমি সেদিন বাইক নিয়ে বের হই, আর রাগ দুঃখ যখন কোন মানুষের একসাথে হয় তখন মানুষের হিতাহিত জ্ঞান শেষ হয়ে যায়।আমারও তাই হয়েছিলো, আমি পাগলের মত বাইক চালাচ্ছিলাম,তাই হঠাৎ এক্সিডেন্ট করে বসি,মাথায় হেলমেট পড়া ছিলো বলে আমি সেদিন বেঁচে যাই।কিন্তু আমার সুস্থ হতে কিছুদিন সময় লেগে যায়,আর আমার খোঁজ না পেয়ে মা মানে (সাজেদা বেগম) খোঁজ লাগাতে থাকে আর পায় ১৫দিন পর।ততদিনে তোদের বিয়ে হয়ে গেছে।আমি একটু একটু করে সুস্থ হই।মা তোকে জানাতে চাইলে ও আমি বারন করি তাও জানায়নি তোকে।আমি ভাবলাম তোদের বিয়ে হয়ে গেছে যেহেতু তোরা ভালো থাক,আমি অযথা গিয়ে কেনো তোদের মাঝে থাকবো।তখনও আমি জানতাম না আরিশা তোকে ভালবাসে।
তুই যে ঘড়ি পেয়েছিলি সেটা আমারই ছিলো। কিন্তু তুই আর সিহাব সেখানে পৌছানোর আগে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। আর আমার সাথে অন্য আরেকজনের ধাক্কা লাগে সে ঘটনাস্থলে মারা যায়।তার লাশ তোরা পেয়েছিলি।
রাফিনের চোখ মুখে কঠিন ভাব,চোয়াল শক্ত, কথা বলছে খুব স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু অহিনকে এই প্রতিটি কথা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে ভেঙে দিচ্ছে অহিনকে।অহিনের হাত পা কাঁপছে দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে তাই বসে পড়েছে।
আরিশা নির্বাক,
রাফিন একটু থেমে আবার বলা শুরু কর,মায়ের কাছ থেকে তোদের সব খবর নিতাম। মা বলতো আরিশা তোকে মেনে নিচ্ছে না।মা চাইতো তোদের সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাক।আমিও তাই চাইতাম। তাই মাকে বলি তোদের কোথাও বেড়াতে পাঠাতে,কিন্তু মায়ের বলার আগেই তুই বলিস কুয়াকাটা যাবি,সেদিন মা ফোনে কথা বলছিলো যখন তুই আসছিলি কুয়াকাটা যাবার কথা বলার জন্য, ফোনের ওপাশে আমি ছিলাম।
সব শুনে খুশি হলাম যে তোরা নিজেদের সময় দিতে চাইছিস।
অহিন বলে,তার মানে আমি সেদিন ঠিক শুনেছিলাম! তোকে মা ফোনে বাবু বলেছিলো?
রাফিন বলে,’হুম আমি ছিলাম ফোনে সেদিন।তোরা যখন কুয়াকাটা গিয়েছিলি,আমি ও তখন কুয়াকাটা ছিলাম।তোদের যাওয়ার পর যে তোদের পিছু নিয়েছে সে আমি ছিলাম,আরিশার সাথে যার ধাক্কা লেগেছিলো সে আমিই ছিলাম।আমার খুব ইচ্ছে করছিলো তোদের দেখতে।তাই দেখতাম দূর থেকে তোদের।দেখে আমার প্রাণ জুড়াতাম।তোদের হাসতে দেখতাম,একসাথে সুর্যাস্ত, সুর্যদয় দেখতে দেখতাম!বেস লাগতো আমার তোদের দেখে।তখন মনে হতো আমি আসলেই সবার জীবনে অযাচিত ছিলাম! কারো জন্য সঠিক ছিলাম না।তাই সবাই আমার আপন হয়েও দূরে সরে যায়।আসলেই আমার ভাগ্য এটাই ছিলো তাই এমন হলো।নয়তো নিজের মা দূরে সরিয়ে দিলো! তারপর যাকে ভালবাসালাম সেও দূরে সরিয়ে দিলো।
অবশ্যই আমার এসবে কোন আফসোস নেই।সত্যি তো এটাই তোরা সবাই আমার আপনজন। তাই কাউকে আমি ছাড়তে পারবো না।রাফিন কাঁদছে কান্নার ধমকে পুরো শরীর কাঁপছে তার। অহিন আরিশাও কাঁদছে শুধু পাথর হয়ে আছে সাজেদা বেগম,কারণ তিনি আছেন সবচেয়ে বড় সংকটে,দুজনই সন্তান কাকে বেঁচে নিবেন তিনি।কাকে বাদ দিবেন!জীবন মাঝে মাঝে আমাদের এমন সব মুহূর্তে দাড় করিয়ে দেয় যে আমরা চাইলে ও তা এড়িয়ে যেতে পারি না।আবার না পারি তার যথাযথ সমাধান করতে।শুধু মনে হয় সময় সব ঘা ঠিক করে দিবে!
কিন্তু সময় কি আদৌ কোন ঘা ঠিক করে দিতে পারে!সেই প্রশ্ন রয়েই যায়?
রাফিন লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলা শুরু করে,আমি জানতামনা অহিন আরিশাকে তুই ভালবাসতি।কিন্তু যখন তোর ডায়েরি পড়লাম বুঝে গেলাম তুই আরিশাকে আমার চেয়ে বেশী ভালবাসিস।আমি সবসময় আরিশাকে কাছে পেয়েছি কিন্তু তুই না পেয়ে ও কিভাবে যেনো সব কুরবানী দিয়ে দিলি!কতটা ভালবাসলে মানুষ এমন কাজ করতে পারে! সেটা আমি বুঝি অহিন।তোর ভালবাসা তো সাগরের চেয়েও গভীর যার গভীরতার হদিস এক জীবনে কেউ খুজে বের করতে পারবে না।
তোর জীবনে আরিশা তো অন্ধকারের আমবস্যার চাঁদের মত!একটু খানি আলোর সঞ্চার আমি কি করে তোর জীবন থেকে তাকে সরিয়ে আনি?তাই আমি সেই একটা সুযোগ তোকে দিলাম আরিশাকে কাছে টানার জন্য,কিন্তু তুই শালা তো এখানেও মহান নিজের বউকে কাছে টানিস না।আর তোর এসব দেখে নিজের উপর রাগ হতো আমার। আমি কেনো তোর মত হতে পারলাম না।
তোর মত এমন মন্দ ভাগ্য আমার ও হতে পারতো। কিন্তু কেনো হলো না?
আমি ফিরে আসি এই জন্যই যে আরিশা তোকে মেনে নিচ্ছিলো না।আর মেনে যেহেতু নেয় নি,তাই আমি চলে আসলাম আবার নতুন করে আরিশাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম। মনে হলো আরিশা শুধু আমার তাই সে তোকে ভালবাসতে পারলো না।মিথ্যে বলবো না এতে আমি খুশী হয়ে ছিলাম।গর্ব হচ্ছিলো আমার ভালবাসা কতটা শক্তি ছিলো যে তোদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও সে ভালবাসা অটুট রইলো।কিন্তু ভাগ্যের খেলায় এবার ও আমিই মার খেয়ে গেলাম।আমি এসে দেখি আরিশা পুরো পাল্টে গেছে।তার ব্যাবহার পাল্টে গেছে।আমি আসাতে তার মুখে সেই খুশীর হাসি আমি দেখিনি।দেখেছি অবিশ্বাস আর ভয়!দেখেছি সিদ্ধান্তহীনতার কষ্ট! দেখেছি বিষন্নতা! আর সেসব শুধু তোর জন্য।
আমি অবাক হয়ে দেখেছি আরিশাকে কিভাবে সে পাল্টে গেছে,সেদিন আমি ছাদে যখন তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম,কোন এক জড়তা আরিশার দু’হাত আমাকে বাধতে পারেনি তার বাহুডোরে! আমি অদ্ভুতভাবে দেখেছি আরিশা কতটা নিশ্চুপ আর বেখেয়ালি ছিলো সে শুধু আমি বুঝেছিলাম সেদিন!তার এই চুপ থাকা আমার বুকে শূলের মত বিধলো,আমাকে এক আকাশ হতাশায় ডুবিয়ে দিলো, এক বুক যন্ত্রনা উপহার দিলো! আমি বুঝতে পারলাম আমার আগের আরিশা এখন আর নেই!সে অন্যকারো হয়ে গেছে!অন্যকাউকে নিজের অজান্তেই সে তার সব অধিকার দিয়ে দিয়েছে।
যাকে এতো গুলো দিন ভালবেসেছিলাম সে অন্যকাউকে ভালবাসবে অন্যকারো সাথে সংসার করবে এটা মেনে নিতে পারছিলাম না।এটা কখনওই আমার পক্ষে মানা সম্ভব ছিলো না অন্তত আরিশা ও তোর হয়ে গেছে।নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু একটুপর মনে হতো আমি তোকে মেরে দেই।তাহলে তো সব আমার হয়ে যাবে,আমার মা আমার হবে,আমার আরিশা আমার হবে!কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো আসলেই কি এ সব কিছু আমার ছিলো?আসলেই কি এর প্রতি আমার অধিকার ছিলো?
সত্যিতো এটাই যে এসব কিছুই কোনদিন আমার ছিলো না।সব তোর ছিলো। তাই সব তোকে দিয়ে দিলাম।আমার কাছে বন্ধুত্বের চেয়ে বড় কিছুই নয়।অবাক হয়ে যাই ই তোকে দেখে অহিন তুই কতটা নিখুঁত অভিনয় করতে পারিস!আমার চোখে ধুলো দিয়ে তুই মহান হবি ভেবেছিস?তুই কি মনে করিস ত্যাগ শুধু তুই করতে অয়ারিস?অভিমান শুধু তোর হয়!আমার হয় না?কেনো তুই সবসময় মহান হবি!আমার ও একটু মহান হতে ইচ্ছে করে অহিন।তাই এবার তোর মহান হওয়ার পালা শেষ! তুই সব ফিরে পাবি তোর,আমি বুঝিয়ে দিতে চাই সব তোকে।
সাজেদা বেগমের দৃষ্টি মেঝেতে, তিনি পাথর হয়ে আছেন, যে সন্তানকে প্রতিনিয়ত ভালো রাখার চেষ্টা করেছেন,যে সন্তানদের সবসময় এক হয়ে থাকার জন্য এতো কষ্ট করেছেন কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সেই সন্তানদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই গেলো। ভাগ্য তাদের এমন এক জায়গায় নিয়ে এলো তারা চাইলেও এখন দুজন দুজনকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে না।সবকিছুর জন্য তিনি নিজেকে দায়ী করেছেন,সব তার পাপের ফল বলে তিনি মনে করেন।যদি সেদিন রাফিনকে অন্যকারো কাছে না দিতেন,কিংবা সেদিন আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন কোন ভুল না করতেন তাহলে হয়তো এতো গুলো জীবন এভাবে শেষ হয়ে যেতো না।তার একটা ভুলের জন্য এতো গুলো মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।পৃথিবীর কোন মেয়ে যেনো এমন ভুল না করে।ভুল যখন ভুলেই সীমাবদ্ধ থাকে তখন সেটা ভুলই থাকে।কিন্তু ভুল যখন এই সীমাবদ্ধতার বাইরে চলে যায় তখন তা আর ভুল থাকে না,জীবনের উত্থান পতনের কারণ হয়ে যায়।কোন মেয়ে বা ছেলে যদি বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে জড়ায় আর তার ফসল ফেলে দিতে চায়,বা ফেলে দেয় তখন আল্লাহর আরশ থেকে তার জন্য দন্ড নাজিল হয়ে যায়।প্রকৃতি তার প্রতিশোধ ঠিকই নেয়,প্রকৃতি কোনদিনই কিছুই ভুলে না।সে জন্য কোন মানুষ যদি ভাবে তার করা পাপ কেউ দেখছে না,তাই সে যা খুশী করে ফেলবে আর প্রয়োজনে প্রমাণ মুছে দিবে,তবে তাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে উপরে একজন আছেন তিনি সব দেখছেন, আর আপনার করা সব পাপ পূর্নের ফল আপনাকে পেতেই হবে।হয়তো আজ নয়তো কাল!
তাই সাজেদা বেগমের ভুলের শাস্তি তো তার পাওনাই ছিলো। তাই তিনি মনে করছেন তার জন্যই এতো অশান্তি। বস্তুত আমরা যখন কোন ভুল করি আমাদের মনকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিত সেটা কেনো করছি! মন আর মস্তিষ্কের কথা সবসময় এক হয় না।তাই সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে যায়।এই কঠিন সময়ে সবার উচিত মনকে স্থির রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া।নয়তো একটা ছোট ভুল জীবনকে শেষ করে দিতে পারে।
তাই সাজেদা বেগমের কষ্ট লজ্জা সব একসাথে হচ্ছে মনে হচ্ছে মাটি ফাঁক হয়ে যাক তিনি মাটির নিচে চলে যাক।সন্তানদের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পড়া উনার জন্য সত্যি খুব কষ্টকর।
রাফিন লম্বা শ্বাস নিয়ে হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে আবার বলে,’আমি জানি এসব কথা তোকে আগ্র বলার দরকার ছিলো। কিন্তু আমি চাইছিলাম আরিশা তার মনের দোটানা থেকে বের হয়ে আসুক।আমাদের দুজন থেকে একজনকে বেঁচে নিক।যাকে তার মন চাইবে।তাই আমার এতো দূরে থাকা।আর তোদের সময় দেয়া।আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম আরিশা কাকে ভালবাসে।বুঝতে পারলাম আরিশার আমার প্রতি কখনও ভালবাসা ছিলো না,বা থাকলে ও তার পরিমাণ নগন্য। তাই আরিশা তোকে ভালবাসতে পেরেছে, তাও এতোটা গভীরভাবে।আসলেই আরিশা আমার ভালবাসার প্রেমে পড়েছিলো,ভালো লেগেছিলো আমাকে। সেই বয়সে ভালবাসা আর প্রেম কে আলাদা করে বুঝার বিষয় ছিলো না।যা ছিলো তার পুরোটাই আবেগ।আর এ নিয়ে আমার কোন সমস্যা ও নেই।আমি এই ছয়টি মাস নিজেকে বুঝিয়েছি, ভেঙেছি,গড়েছি আর এখন আমি নিজেকে শক্ত করে ফেলেছি।একবার ভাবলাম আরিশাকে বিয়ে করে ফেলি সময়ের সাথে আরিশা মেনে নিবে আমাকে। কিন্তু পরে মনে হলো সংসার মানে কী মানিয়ে নেয়া!ভালবাসা না থাকলেও আমাদের দেশের মেয়েরা সংসার চালিয়ে যায়,কারণ একটাই সমাজ, তারা সমাজের নিয়মকে ভয় পায়।আমাদের দেশের
‘বেশীর ভাগ দম্পতী সংসার করে ভালবেসে নয়,দায়বদ্ধতা থেকে’!
কিন্তু আমি এই দায়বদ্ধতা চাই না।সারাজীবন আরিশা তোকে মনে রাখবে আর আমাকে শরীরে বয়ে বেড়াবে এটা মেনে নেয়া যায় না।আমি ভালবাসা চাই কোন দায়বদ্ধতা নয়’!একদিন হয়তো আমি আরিশাকে সময়ের সাথে ভুলে যাবো।আমিও সামনে এগিয়ে যাবো কিন্তু তোদের ভালবাসার মাঝখানে এসে না আমি ভালো থাকতে পারবো, না তোরা ভালো থাকবি!তাই আমি চাই তোরা ভালো থাক তোদের সম্পর্ক অটুট থাক।একটাই তো জীবন সে জীবনে ভালবাসা না থাকলে ভালবাসার মানুষ পাশে না থাকলে কি ভিষণ যন্ত্রনা হয় আমি জানি।তাই দুজন মানুষ খারাপ না থেকে, একজন খারাপ থাকুক তাতে অন্তত দুজন তো ভালো থাকবে।আমি চাই তোরা ভালো থাক।হ্যাঁ আমার কষ্ট হবে প্রথম প্রথম কিন্তু আমি ও আস্তে আস্তে সব ভুলে যাবো।কারণ সময় মানুষকে আওব ভুলিয়ে দেয়।সময় সবকিছুর বড় ওষুধ। তাই সব সময়ই ঠিক করে দিবে।
রাফিনের চোখ দিয়ে নোনা জল অনবরত ঝরছে।কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।কখনও একটা মানুষের পক্ষে তার ভালবাসাকে অন্যকে দেয়া সম্ভব না।ভালবাসাকে শেয়ার করতে কেউই পারে না।
অহিন উঠে এসে রাফিনের সামনে হাটুগেড়ে বসে রাফিনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ করে অনবরত কাঁদতে থাকে।কথা বলতে চেয়েও কান্নার ধমকে তার মুখ দিয়ে কোন কথা আসে না।আচমকা রাফিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে।রাফিন ও জড়িয়ে ধরে।দুই ভাইয়ের কান্না দেখে আরিশা আর সাজেদা বেগম ও কাঁদছেন।মনে হচ্ছে এটা কোন মরা বাড়ি আর সবাই আপন মানুষ হারানোর যন্ত্রনায় কাদঁছে।জীবনের এই মুহুর্তে এসে ভালবাসা যে মানুষকে কতটা অসহায় করে দেয় তা উপস্তিত সবাই বুঝে গেছে।কিছুটা সময় কাটার পর অহিন রাফিনকে ছেড়ে স্বাভাবিক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে,’রাফিন আমি তোকে অনুরোধ করছি তুই আরিশাকে বিয়ে করে নেয়।
—‘তুই আর এসব বলিস না অহিন।এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছিস তুই আর না।আমার তোর কাছে অনুরোধ তুই প্লিজ আর কিছু বলিস না।
অহিন চাইলে ও আর কিছু বলতে পারে না।
—-আরিশার মনের ভেতর দ্বগ্ধ হয়ে যাচ্ছে,এতোটা কষ্ট হচ্ছে যা প্রকাশ করার মত না।এসব কিছুর জন্য সে নিজেকে দায়ী মনে করছে,কারণ রাফিনের সাথে যেহেতু তার সম্পর্ক ছিলো তাই অহিনকে ভালবাসা টাও কোথাও না কোথাও রাফিনকে ঠকানো হয়েছে।রাফিনকে কষ্ট দিয়েছে,এই যে সম্পর্কের এই জটিল সমীকরণ এর জন্য আরিশা শুধু নিজেকে দায়ী ভাবছে।রাফিনের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছে না।
তারপর ও লম্বা দম নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে রাফিনের পাশে গিয়ে বসে,রাফিন আরিশার দিকে কান্না চোখে ঠোঁটে হাসি দিয়ে তাকায়,অহিন বসে বিষন্ন মুখে।আরিশা মেঝেতে দৃষ্টি রেখেই বলে,’রাফিন তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস দোস্ত আমি বুঝতেই পারিনি কখন কি হয়ে গেলো। তুই আমার বন্ধু ছিলি প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিস তো রাজি হয়ে গেছি,অথচ তখন আমি প্রেম আর ভালবাসা কি তাই বুঝতে পারতাম না।কিন্তু যখন বুঝেছি ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছ।আমাকে তুই শাস্তি দে রাফিন।আমি তোর কাছে অপরাধী রাফিন। আরিশার গলা কাঁপছে।আমি তোকে হিসেব মত ঠকিয়েছি।
—-কেউ কাউকে ঠকায়নি আরিশা,যদি কেউ ঠকে থাকে তা হচ্ছে নিয়তির ঠকানো।মানুষের কি সাধ্য অন্যকে ঠকানোর।সব তো উপর থেকে ঠিক হয়ে আসে।তাই তুই নিজেকে অপরাধী ভাবিস না প্লিজ।তোরা ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকবো।আর তোদের কারোই কোন অনুশোচনার দরকার নেই।এখন তোরা মন দিয়ে সংসার কর!আমি ঠিক আছি।দেখবি আমার জন্যে ও কাউকে পাঠিয়ে দিয়েছে।তাই এখন তোরা সুখে শান্তিতে সংসার করবি ঠিক আছে?
—-আরিশা কান্নার জন্য কিছুই বলতে পারলো না।
—আমাকে দেখে তোদের যেনো কোন কষ্ট না হয়,আমরা আগের মত হইহুল্লোড় করবো। তোরা সবসময় আমার সাথে আগের মত ব্যাবহার করবি।যদি তোরা কোনরকম নিজেদের গুটিয়ে নিস আমার থেকে আমি খুব কষ্ট পাবো।তাই একটা নরমাল জীবন কাটাবি তোরা।সাথে আমিও। রাফিন কৌতুকের সুরে বলে,’আরিশা আমি কিন্তু তোর ভাশুর হয়ে গেলাম।বলেই ঘর কাঁপিয়ে হাসে রাফিন।চোখে জল চিকচিক করছে।এই কান্নার ভেতরে কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে শুধু সেই জানে যার ভালবাসাকে হারাতে হয়।
—-সাজেদা বেগম রাফিনের কাছে গিয়ে হাত জোড় করে বলেন তুই আমাকে ক্ষমা করে দে রাফিন?
রাফিন মায়ের হাত ধরে বলে,ছিঃ মা তুমি এটা করো না।সন্তানের সামনে মা কখনও হাত জোড় করে না।বরং সন্তান মায়েত সামনে সবসময় নত হয়ে থাকে।
রাফিনের মুখে মা ডাক শুনে বুকটা ভরে গেলো সাজেদা বেগমের, এতো গুলো বছর সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শোনাত জন্য তিনি অপেক্ষা করেছেন কিন্তু আজ তিনি এমন এক সময় এই আকাঙ্ক্ষিত শব্দটা শুনলেন যখন পরিস্থিতি বাইরে চলে গেছে।
—আমার করা ভুলের শাস্তি তোরা সবাই পাচ্ছিস।আমি সব কিছুর জন্য দায়ী।বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
—-না মা সব তো আমাদের ভাগ্যে লেখা থাকে।আমরা ভাবি এক আর হয় আরেক।কারণ ভাগ্য তো পূর্ব নির্ধারিত। তাই আমরা ভুল কিছু চাইলে তো পাবো না।
—–তোরা দুই ভাই আমাকে শাস্তি দে। আমি সবকিছুর জন্য দায়ী।
—–অহিন মাকে জড়িয়ে ধরে এসে বলে,পৃথিবীতে নারী খারাপ হয় মা”কিন্তু মা কখনও খারাপ হয় না’!
‘মা যাই করুক সন্তান কখনও তার বিচার করতে পারে না।কারণ সন্তানের সেই অধিকার নেই।সন্তানে শুধু মায়ের সেবা করার অধিকার আছে।বিচার বা শাস্তি দেয়ার নয়’।
সন্তানের কথা শুনে ছেলেদের জড়িয়ে ধরলেন তিনি।মাকে দুই ভাই একসাথে জড়িয়ে ধরে।সবাই ঠোঁটে হাসি রেখে কান্না করছে।এই এক অনন্য মুহুর্ত, অসামান্য সময়’মিলনেত মেলা!”ভালবাসার খেলা!’
রাফিন সারাদিন থেকে রাতে খেয়ে চলে যায় নিজের বাসায়।সবাই অনেক জোর করেছে তাও থাকেনি সে।আজ অহিন আরিশার জন্য গুরুত্বপূর্ন দিন তাই সে থেকে জড়তা বাড়াতে চায় নি।
———————————————————————————-
অহিন আরিশা বসে আছে বারান্দায়,দুজনের মন খারাপ। তার উপর আজকের বিষয়টা মাথায় ঢুকছে না।আসলেই কি এটা সত্যি নাকি কোন স্বপ্ন! সবটা এতোটা সহজ কি করে হয়ে গেলো! যে ভালবাসার জন্য এতো অপেক্ষা, এতো ত্যাগ সে ভালবাসা এতো সহজে নিজের হয়ে গেলো! কেমন যেনো ঘোর লাগছে।আবার রাফিনের কথা মনে হতেই কষ্টে তার মনের আকাশটা মেঘলা হয়ে যাচ্ছে।আরিশা পেছন থেকে অহিনকে জড়িয়ে ধরে।
কিছুটা সময় যায় নিরবে।
—–আরু সব এমন কেনো হয়ে গেলো? রাফিন কতটা কষ্ট পেলো।এমনটা না হতে পারতো।
—–আমরা কিছুই করার কেউ না, সব উপরে যিনি বসে আছেন তার হাতে।তিনি যা চাইছেন তাই হবে।আমার তো উপলক্ষ মাত্র।
—অহিন সামনের দিকে ঘুরে আরিশাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি আসলেই কি তোকে পেয়ে গেলাম সারাজীবনের জন্য? এখন থেকে রোজ ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোর মুখ দেখবো, ঘুম থেকে উঠে তোর মুখ দেখবো।ভাবতেই স্বপ্ন স্বপ্ন অনুভব হচ্ছে! ‘
আরিশা অহিনের গলা জড়িয়ে ধরে,আমিও সকাল,দুপুর, সন্ধ্যা, রাতে শুধু তোকে দেখতে চাই, আর তোর এতো এতো আদর চাই।ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টুমির চলে বলে,তোর একশো সন্তানের মা হতে চাই।
—-অহিন আরিশাকে কোলে নিয়ে নেয়,ওররে তাই!কোন সমস্যা নেই ম্যাডাম।এতোদিন আপনি আমার ধৈর্য পরিক্ষা নিয়েছেন।অনেক জ্বালিয়েছেন।এবার দেখেন আমি কি করি।একশো কেনো, এক হাজার সন্তানের মা বানয়ে দিবো।
আরিশা লজ্জায় দুহাতে মুখ ডেকে ফেলে।ভাবছে একটু দুষ্টুমি করবে,কিন্তু এই ছেলে যে কি জিনিস আজ সে বুঝতে পারছে।এতোদিন নিয়মে বাধা ছিলো বলে কিছুই করেনি।এখন সে সে কি অবস্থা করবে আরিশার সে আরিশা বেশ ভালো বুঝে গেছে।
—-এই চোখ কেনো ডাকছেন হ্যাঁ? আমার কোকের সাথে ওয়াইন মিশিয়েছেন মনে নাই?কই তখন তো লজ্জা লাগেনি।এখন লজ্জা লাগছে হু?আর আমি যে কোন কোক খাইনি সেটা আপনি বুঝতে ও পারলেন না!আজব কমনসেন্স এতো কম কেনো তোর আরু?তুই তো আমার কাছে গেলেই কোকা কোলার গন্ধ পাইতি।সেটা না পেয়েও কেমনে নিশ্চিত হইলি?হু?
—-তার মানে তুই সব ইচ্ছা করে করছিলি?
তুই হুসে ছিলি?
—অহিন চোখ মেরে বলে,হুম সব হুসে হইছে। আর আমি,,,,,আরিশা অহিনের মুখ চেপে ধরে।তার ভিষণ লজ্জা লাগছে।ইশ!এটা আমি কি করলাম বলেই আরিশা লজ্জায় মুখ ডাকলো।
অহিন মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলে,’আরে এখন এতো লজ্জা পেলে হবে।এবার থেকে প্রতিদিন ওয়াইন খাবো বুঝলি!আরে পাগল যে আমি তোর নেশায় মত্ত সে আমাকে ওয়াইন কি করবে।আরিশা অহিনের বুকে কামড় বসিয়ে দিলো। অহিন বলে ভালোই করছিস।সব কামড়ের প্রতিশোধ আজকে আমিই নিবো।দেখবি এর জ্বালা কেমন।
এক জোড়া ভালবাসার পায়রা এক হয়ে গেল!পূর্নতা পেলো তাদের ভালবাসা।পূর্নতা পেলো সম্পর্ক!
ভালবাসা বেঁচে থাকুক চিরকাল!
চলবে,,,